অনেকেই চোখ বুজে বলে দেন, মুসলমানদের বদলানো যাবেনা। হিন্দুরা যতই লিবারাল হোক না কেন, "মুসলমানরা মুসলমানই থাকবে।" এই বিশ্বাসটা শুধু হিন্দুত্ব সন্ত্রাসীদের নয়। বহু লিবারাল, বামপন্থীরাও এই কথা বলে থাকেন।
অথচ তাঁরা মুসলমান সমাজের কোনো খবরই রাখেন না। আমি আগেও আমার বিভিন্ন আলোচনায় ও লেখায় বলেছি, বিশাল সংখ্যক শিক্ষিত লিবারাল হিন্দু একজন মুসলমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেন নি, এবং তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে মুসলমানরা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
আমিও ঠিক এই রকমই ছিলাম। কালকের গোয়াবাগানের মিটিংয়েও বলেছি, আরএসএসের বিষফল খাওয়ার কারণে সেই ক্লাস ফোরের ঘটনা, যখন কেবলমাত্র আহমেদ নাম হওয়ার কারণে স্কুলের বন্ধু চঞ্চলের ছাতা ভেঙে দিয়েছিলাম। সেসব কথা আমি আমার দেশের জীবনস্মৃতি ঘটিকাহিনি বইতে লিখে রেখেছি।
তারপর ইউনিভার্সিটি জীবনে ও সুন্দরবন কলেজে অধ্যাপনা করার সময়ে প্রথম মুসলমান বন্ধু, ছাত্র ও সহকর্মীদের খুব কাছ থেকে দেখলাম। তাদের বাড়ি গেলাম। তাদের সঙ্গে খেলাম। তাদের ছেলেমেয়েদের আশা আকাঙ্ক্ষা সাধ স্বপ্নের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দেখলাম, তাদেরও ঠিক আমাদের মতোই দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, দুটো কান, এবং একটা নাকই আছে। বিশেষ তফাৎ নেই কোনো। বরং আমাদের অনেকের প্রাক-মনুষ্য একটা দীর্ঘ লেজ আছে, যা ওদের নেই।
আমেরিকার দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের জীবনে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলো সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সঙ্গে। ইরান, ইন্দোনেশিয়া, প্যালেস্টাইনের মুসলমানদের সঙ্গে। এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের মুসলিমদের সঙ্গে। আমার পাকিস্তানের বন্ধু হায়দার রিজভী কেকেকে ঘাতকদের হাতে প্রায় খুন হলো এগারোই সেপ্টেম্বরের পর, এবং তার কয়েক বছর পরে সত্যি খুন হলো পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ইসলামীদের হাতে। আচে দ্বীপের ছেলে আমার রুমমেট জাফর হামজা সিদ্দিক নৃশংসভাবে খুন হলো সি আই এর'র মদত দেওয়া জঙ্গী ঘাতকদের হাতে।
কী লড়াইটাই না করে গেছে, করে যাচ্ছে বাংলাদেশের লিবারাল মুসলমানরা মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আমাদের এখানে ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা জানেই না বাংলাদেশে এই দীর্ঘকাল ধরে চলা লড়াইয়ের কথা। যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের পাঁচজনের পাঁচজনই মুসলমান। যেখানে কমিউনিস্ট মৌলানা ভাসানী ধর্মপ্রাণ মুসলমান। যেখানে লালন ফকির মুসলমান। শেখ মুজিব মুসলমান, তাজউদ্দীন আহমেদ যিনি মুজিবের অনুপস্থিতিতে একাত্তরের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। শহীদজননী জাহানারা ইমাম মুসলমান। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল মুসলমান। তারপর আমাদের বিদ্রোহী নজরুল ইসলাম তো আছেনই সবার ওপরে।
শ্রমিক আন্দোলনের পরিচিত নেতা ও নেত্রীরা মুসলমান এবং হিন্দু। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের অগন্তি শহীদদের এক বিশাল অংশই মুসলমান। যেখানে উগ্র ইসলামীরা অভিজিৎ রায়কে খুন করার পর জনসমাবেশ, মিটিং মিছিলে প্রায় সবাই মুসলমান। গায়ক গায়িকা শিল্পী কবি নাট্যকার বাংলাদেশে ৯০% মুসলমান। মাটির ময়নার মতো ল্যান্ডমার্ক সিনেমার পরিচালক তারেক মাসুদ।
এদিকের এরা কেউ খবর রাখেনা। আমাদের আনন্দবাজার, দেশ জাতীয় মগজধোলাই কাগজগুলো, আমাদের বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব বা লাল নাটকের কেউই এসব কথা কখনোই আমাদের বলেনি। আমরাও চোখ বন্ধ করে থেকেছি।
আধুনিক যুগের আধুনিক মনোভাবের মুসলমানদের কারুর বাড়িতেই চারটি স্ত্রী নেই, এবং অসংখ্য বাচ্চা নেই। আগেকার দিনে হয়তো ছিল, ঠিক যেমন অন্ধকার যুগে হিন্দুদের কুলীন বামুনরা পঞ্চাশটা বিয়ে করতো, আর হিসেব-না-থাকা সন্তানের জন্ম দিয়ে কিশোরী বৌদের বিধবা করে দিয়ে মরতো। সাধারণ ঘরে মুসলমানদের যদি আট দশটা ছেলেমেয়ে হতো, সে তো হিন্দুদের ঘরেও হতো। আমার বাবারা ছিল ন-জন ভাইবোন। আমার মায়েরাও তাই।
বিজেপি আরএসএস বিশ্ব হিন্দুদের মতো উগ্রপন্থীরা তো এসব প্রচার করবেই। কিন্তু লিবারাল বাঙালি হিন্দুরা কি তাদের মনোভাব বদলেছে?
___
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।