বেশি কিছু লেখার নেই। দরকার হলে আমার বইগুলো পড়ে নেবেন।
কী বই, কোথায় পাওয়া যাবে? আমার নাম পার্থ ব্যানার্জী দিয়ে একটা গুগল সার্চ করবেন। আমার নামে একটা উইকিপিডিয়া আছে। সেখানে আমার সারা জীবনের কাজ, বইয়ের লিস্ট সব পেয়ে যাবেন। অবশ্য পরশু অভিযান পাবলিশার্স থেকে যে বইটা বেরিয়েছে, সেটা পাবেন না। ওটা পেতে গেলে অভিযানের মারুফ হোসেনকে একটা ফোন করে দেবেন, বা ফেসবুকে একটা মেসেজ।
আমি বড় বড় কথা বলতে পারিনা, কারণ আমি ছোট লোক। ছোটোলোকও বলতে পারেন, কারণ আমি বড় হয়েছি "ছোটোলোক"দের পাড়ায়। আমাদের গোয়াবাগান বস্তির পাড়ায় আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তার নাম ছিল পেয়ারাবাগান মদের গলি। সেখানে বর্ষাকালে কোমর পর্যন্ত জল জমতো, আর বাকী বছরটায় জমতো কোমর পর্যন্ত জঞ্জাল। সে জঞ্জালের অনেক কিছু আমার ভেতরে এখনো রয়ে গেছে। যেসব কথা আমি লিখে রেখেছি আমার স্মৃতিকথা "ঘটিকাহিনি"তে। চাইলে পড়ে নিতে পারেন। একেবারেই ছোটোলোকের স্মৃতিকথা।
শ্রেণী বৈষম্য, শ্রেণী সংগ্রাম, হ্যাভস আর হ্যাভ নটস -- এসব নিয়ে অসংখ্য বড় বড় কথা বামপন্থীদের স্বর্ণযুগে আমি শুনেছি। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। দেওয়ালে দেওয়ালে সিপিএমের কাস্তে হাতুড়ি তারা, সিপিআইয়ের কাস্তে ধানের শীষ, আরএসপির কোদাল বেলচা, ফরওয়ার্ড ব্লকের বেঙ্গল টাইগার, আরও কত কী! তারপর এলো দেশব্রতী নকশালরা। তখন আমাদের স্কটিশ চার্চ স্কুলে পরীক্ষা বন্ধ দু বছর ধরে। ব্ল্যাকবোর্ড আর সাদা দেওয়ালে স্টেনসিল করে মাও সে তুঙের ছবি, এবং বন্দুকের নলই নাকি ক্ষমতার উৎস। দুপুরবেলা কানফাটানো বোমাবাজি স্কুলের গলিতে।
আর রাত্তিরবেলা প্রথমে পাড়া ঘিরে ফেলে মুক্তাঞ্চল, সিপিএম নকশালের মধ্যে খুনোখুনি, কানাগলির মধ্যে যুবকের নিথর লাশ। আর তারপর পাড়া ঘিরে ফেলে মুক্তিসূর্যদের ও তাদের সিআরপিদের তাণ্ডব। আমারই কিছু বন্ধু পুলিশের কম্বল ধোলাই খেয়ে পঙ্গু। তাদের দু একজন এখন মোদীর অন্ধ সমর্থক। অনেকটা ইডির মার খেয়ে বিজেপিতে জয়েন করার মতোই ব্যাপার।
যাদের কথা ছিল গরীবের গরীবদের ওই কোমরসমান জঞ্জাল থেকে টেনে তোলার, শিক্ষা দেওয়ার, আলো দেওয়ার, তারা তাদের দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের একচেটিয়া বিরোধীহীন প্রজন্মে তার কিছুই করেনি। করতে পারেনি। অথবা করতে চায়নি। তাদের সময়েই দুর্গাপুজো পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা তুলে চুপচাপ, শান্ত ধর্মপালন আর আনন্দ উৎসব থেকে কর্পোরেট থীম পুজোর কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাদের সময়েই গ্রহরত্ন, তাগা তাবিজ, রাজজ্যোতিষী, টিভিতে জ্যোতিষী চ্যানেল, পিসিচন্দ্র, মাসিচন্দ্র, সেঁকো জুয়েলার্সদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। আমেরিকা থেকে বার বার ফিরে এসেছি সব জমানো টাকা আর সব জমানো ছুটি খরচ করে, আর দেখেছি নব্বইয়ের দশক আর নতুন মিলেনিয়ামের প্রথম দশকে ধনতেরাস ধনত্রাস সন্ত্রাসে বদলে গেছে।
গরীবের গরীবের কথা কেউ ভাবেনি। সর্বহারার শৃঙ্খল ঠিক যেমন ছিল, তেমনই থেকে গেছে। ভারী হয়েছে আরো।
তারপর নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর। আমার হার্ডকোর বামপন্থী বন্ধুরাও আমার বাড়িতে এসে বলে গেছে, "আমরা শুধু চাইছিলাম এরা এবার যেন চলে যায়।" বলে, মুখের একটা ডিসগাস্টিং হয়ে যাবার অভিব্যক্তি দেখিয়েছে।
এবং তারপর মমতা ব্যানার্জী ও তৃণমূল।
কারণ, ছোটোলোক, গরীবের গরীবের কথা, অশিক্ষিত, ইংরিজি বলতে না পারা, বিদেশে ফ্যামিলির আদ্ধেকটা না-থাকা বাঙালির কথা -- হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, বৌদ্ধ, উঁচু জাত নিচু জাত বাঙালির কথা -- যাদের ভাবার কথা ছিল চৌত্রিশ প্লাস আরো অন্তত চৌত্রিশ বছরে, তারা মাটির গন্ধ মেখে, ধুলো কাদা মেখে তা ভাবেনি। শুধু দেওয়াল লিখনে আর পাড়ায় পাড়ায় হাজারটা দল উপদল দিয়ে গরীবের পেট ভরেনা। চাকরি, শিল্প কিছুই তৈরী হয়না।
প্রেসিডেন্সি কলেজকে এক সাধারণ মানের কলেজে পরিণত করে দিলে, কলকাতা মেডিকেল কলেজকে একেবারে নিম্ন মানের হাসপাতালে পরিণত করে দিলে, আর ইংরিজি তুলে দিলে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু বিপর্যস্ত হয়ে যায়না। বাঙালির আত্মবিশ্বাস চিরকালের মতো বিপর্যস্ত হয়ে যায়। কম্পিউটার ঢুকতে না দিলে কেবলমাত্র একটা জেনারেশনকে আধুনিক প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত করে ব্যাক বেঞ্চার করে দেওয়া হয়। আর কিছুই হয়না।
একটা পথ তো মানুষ খুঁজে বের করবেই। একদল গেছে ভুল ঘৃণা, ধর্মান্ধতা, প্রোপাগাণ্ডার ফ্যাসিস্ট রাস্তায়।
আর একদল গেছে টিএমসির রাস্তায়।
ভাগ্যক্রমে, এখনো পশ্চিমবঙ্গে বেশির ভাগ সাধারণ, অশিক্ষিত মানুষই অতি শিক্ষিত। তারা ফ্যাসিস্ট রাস্তায় এখনো যায়নি। এটাই আমাদের আসল দেওয়ালের লিখন।
বাংলার নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক বিপ্লব ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এলিট শ্রেণীর হাত ধরে আসেনি।
এসেছে মাটির গন্ধ, কাদা মাখা, নন-এলিট কিছু মার খাওয়া মানুষের হাত ধরে।
______________________
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।