ভারত -- শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে। লেখক -- পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযান পাবলিশার্স, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা। মার্চ ২০২৪। দাম ৩০০ টাকা।
বুক রিভিউ -- লেখক প্রশান্ত ভট্টাচার্য্য। প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক সুখবর" কাগজে।
_____________________
'...হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া 'হিন্দুরাজের' ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। ... শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাহার কোনোটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনো পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?'
১৯৩৮ সালের ১৪ জুন কুমিল্লায় ভাষণে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজীর তথাকথিত ভক্তকুলের শিরোমণি নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতের মূল সমস্যাকে ডেস্কের তলায় ফেলে দেশটাকে হিন্দু বানানোর যজ্ঞে আহুতি দিয়ে চলেছেন। এটা প্রায় সব বিরোধী নেতারা নিজেদের ভাষণে বলছেন, মোদী ফের ক্ষমতায় এলে, দেশে আর ভোট হবে না। অথচ মোদীর তৃতীয়বার মসনদে আসীন হওয়া ঠেকাতে তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব।
এমন পরিস্থিতিতে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ভারত শেষ ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে' বইটি হাতে এল। পার্থ মার্কিন প্রবাসী ভারতীয়। আরএসএসের গর্ভগৃহ থেকে জন্ম তাঁর। ফলে যে উৎকণ্ঠা থেকে এই বইয়ের প্রবন্ধ ক'টি পার্থ লিখেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সমাজে তো নেইই, এমনকী, অ্যাকাডেমিক ওয়ার্ল্ডেও নেই। এই দুই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, এরা আরএসএস ও বিজেপির মধ্যে একটা বিভেদ রেখার কল্পনা করে নিয়ে, তাকেই মান্যতা দেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো এক সভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে সচকিত করে জানালেন, 'আরএসএস নিয়ে তাঁর কিছু বলার নেই; ধর্ম নিয়ে তারা থাকেন, কাজ করে ইত্যাদি, প্রভৃতি। অর্থাৎ সেই বিসমিল্লাহে গলদ। যত সঙ্কট ও হাঙ্গামা নাকি ভারতীয় জনতা পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট৷ করে, মোদী-শাহর বিজেপিকে নিয়ে, বাজপেয়ী-আদবানির বিজেপিটা যেন ছিল পাতে দেওয়ার মতো! যেমনটা, একসময়ে জ্যোতি বসুদের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী দলগুলো বুঝত।
অনেকটাই সেই রবীন্দ্রনাথের 'ভালো ইংরেজ', 'খারাপ ইংরেজ' এর মতো, এঁরাও খোঁজেন 'ভালো-বিজেপি', 'খারাপ-বিজেপি'। আলোচ্য গ্রন্থের লেখকের ব্যথাটা এখানে। কেননা, 'দানবের পেটে দু-দশক' কাটিয়ে আসা পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় এই মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী দলটির বিষাক্ত নখ-দাঁত দেখে এসেছেন তার সঙ্গে ঘর করে। বিজেপির হিংস্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। রামমন্দির নির্মাণের কালাপাহাড়ি হিন্দুত্বকে জগন্নাথ মন্দির গড়ে মোকাবিলা করা যায় না। বড়োজোর ভোটে জেতা যায়।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ আছে। কোনো প্রবন্ধই অতিদীর্ঘ নয়। বেশির ভাগই ১২ থেকে ১৪ পাতায় শেষ। আমার বিবেচনায় এ বইয়ের সেরা প্রবন্ধটি হল -- ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু 'দেশপ্রেমমূলক' পজিটিভ বার্তা প্রচারের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি-- শিরোনামের লেখাটি। প্রবন্ধটির শুরুতেই লেখক তাঁর গুরু নোম চমস্কির কথা এনেছেন। এই মহান ভাবুক-অ্যাক্টিভিস্টের 'ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট' বা গণসম্মতি উৎপাদনের তত্ত্ব থেকে তিনি কী আহরণ করেছেন, তার পণ্ডিতি না ফলিয়ে ঢুকে পড়ছেন ঘটমান বর্তমানে।
লেখকের আলোকপাত,
'একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কীভাবে স্পোর্টসকে মনোপলি করে এবং তার বুক বাজানো উল্লাসকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে মেকি মেসেজ দেওয়া হয়, এবং ড্রাগের মতোই মানুষ হয় ঘুমিয়ে থাকে আর নয়তো বিকটভাবে দেশপ্রেম দেখায়, যার সঙ্গে দেশ বা প্রেম কোনোটারই সম্পর্ক নেই, শুধু মগজের ডোপামিন নামক হরমোনের হার্ডরক ড্যান্স আছে, তাঁর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আজকের ভারত। আমেরিকায় ফুটবল (যার সঙ্গে ফুটের কোনো সম্পর্কই নেই), ব্রিটেনে ফুটবল (যেখানে ভায়োলেন্স একেবারে প্রাতঃকৃত্যের মতোই অবশ্যম্ভাবী), আর ভারতে ক্রিকেট। দশ দেশের 'বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন'। লক্ষ কোটি টাকা জুয়া।' এই যে দেশপ্রেমের বা নিওনরম্যাল ন্যাশনালিজম, এরসঙ্গে না আছে জাতীয়তাবাদ, না আছে দেশপ্রেম। একটা মেকি ফানুস। এমনভাবে একটা 'গণচেতনা' ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে রোটি-কাপড়া-মকান এর মতো জরুরি সমস্যা ও সঙ্কটগুলো রিসাইকল বিনে ফেলে, এই দেশপ্রেমে মেতে ওঠো। মোদী দেশের পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান রক্ষার্থে না এগিয়ে, এবেলা-ওবেলা ট্যুইটবাজি করে যাচ্ছেন কারও সাফল্যে। বিজেপি ও তার রাজনৈতিক মেন্টর আরএসএস জানে, মানুষকে যদি শুধুমাত্র দেশপ্রেম বা হিন্দুত্ব বা রামমন্দির বা উগ্র ইসলাম বা ইউএসএ বা মোদী, বা ক্রিকেট-কোহলি-সচিন-ধোনি বা চন্দ্রযান বা বন্দে ভারত বা সুপারপাওয়ার বা পুলওয়ামা -- যেটা যখন কাজে লাগে লাগিয়ে নাচানো যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে।
এই ফ্যানাটিক ন্যাশনালিজমের জন্য সবসময় একটা অপর লাগে। দেশের মধ্যে মুসলিম আর বাইরে পাক-ই-স্তান আর চিন। অথচ কতকাল আগে ১৮৯৫ সালে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের 'স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস' ছাপা হয়। তাতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের এই জন্মভূমি চিরকাল অন্তর্বিবাদানলে দগ্ধ হইয়া আসিতেছিল, আজি সেই বিবাদানল নির্বাপিত হইবে। আজি মাতৃভক্তিপরায়ণ পুত্রেরা সকলে মিলিত হইয়া ইহাকে শান্তিজলে অভিষিক্ত করিবেন। ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইঁহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইঁহার পর নহেন, ইনি উঁহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইঁহার পালিত সন্তান। এক মাতারই একটি গর্ভজাত আর একটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব-সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়- সব শাস্ত্র মতেই হয়।'
কী অদ্ভুতভাবে সোশাল মিডিয়া দিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যার ন্যারেটিভ। রীতিমতো পেশাদার ভক্তদের দিয়ে একাজ করানো হচ্ছে। বুস্ট করিয়ে লাইক বাড়ানো হচ্ছে৷ শেয়ার করা আর লাইকের ঠেলায় ভাইরাল করা হচ্ছে। লেখককে হন্ট করেছে, বাঙালির বদলে যাওয়া চেহারাটা। গত ৫০ বছরের শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতায় আর ইদানীংকালের গোদিমিডিয়ার কল্যাণে একাংশ বাঙালি বিজেপিকে দুর্নীতিমুক্ত পার্টি হিসেবে ঠাউরে নিয়েছে।
লেখকের ভাষায় 'মিডিয়ার কল্যাণে বহু সাধারণ মানুষ মনে করেন যে, বিজেপি দুর্নীতিমুক্ত পার্টি, নরেন্দ্র মোদী পরিচ্ছন্ন নেতা এবং অমিত শাহ ভদ্র মানুষ। অনেক বাঙালি এদের ইতিহাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের যোগসূত্র নিয়ে মোটেই ভাবেন না। আরএসএস যে বিজেপিকে চালায় এবং আরএসএস যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, মানুষের সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন কিছু মানুষও আছেন যাঁরা নাথুরাম গডসে কে, অথবা গডসে-সাভারকারের গান্ধিহত্যার বিষয়টি জানলেও বিষয়টা নিয়ে সরব নন। আর অন্য একদল নব্য বাঙালি গান্ধি-হত্যাকে সমর্থন করেন।' আমরা যার সর্বশেষ উদাহরণ দেখলাম অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। তমলুকের এই বিজেপি প্রার্থী ভারতীয় জনতা পার্টিকে যেমন দুর্নীতিমুক্ত মনে করেন, তেমনই গান্ধী না গডসে প্রশ্নে গডসেতে আশ্রয় খোঁজেন। এ যদি ফ্যাসিস্টবান্ধব ও আত্মঘাতী বাঙালি না হয়, তবে কে?
বিজেপি ও তার দুধ খাওয়ানো আরএসএসের কতগুলো কায়দা আছে। ওদের সবচেয়ে বড়ো সুবিধে হল, আজকের দিনে এক বিশালসংখ্যক মানুষ-শিক্ষিত মানুষ কিছু পড়ে না। সুতরাং, মিডিয়াকে কিনে ফেলতে পারলেই, আর আইটি সেলের মাধ্যমে গার্বেজ ছড়িয়ে যেতে পারলেই ওদের কাজ অর্ধেক হয়ে গেল। বাকি অর্ধেক বিরোধীরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে গেছে এবং করে যাচ্ছে, মূলত তাদের অনৈক্য এবং মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার অভাব প্রমাণ করে। এই বিপদে নিঠক ভোট রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা যেতে পারে কিন্তু চূড়ান্তভাবে পারা যায় এই লড়াই আসলে মতাদর্শ বনাম মতাদর্শের নয় তাই বিজেপি মার্কা ফ্যাসিবাদ আটকানোর জন্য দরকার যেমন গণ আন্দোলন ঠিক তার পাশাপাশি দরকার চিন্তার স্বচ্ছতা।
ধর্মনিরপেক্ষ মন গণতন্ত্রের প্রতি ষোলআনা আস্থা ছাড়া কোনোভাবেই বিজেপিচারিত ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা সম্ভব নয়।
যদিও এই বইয়ের লেখক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত এখনো অনেক আশাবাদী, কেননা বইয়ের নামকরণে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তিনি এখনো মনে করছেন ভারত ধ্বংসের সন্ধিক্ষণে, অতএব সেই সন্ধিক্ষণ দাঁড়িয়ে যদি সব লড়াইটাই মতাদর্শগতভাবে হয় তবে সুড়ঙ্গের শেষে আলো পাওয়া যাবে।
জার্মান কবি-দার্শনিক ফ্রেডরিখ হ্যেল্ডার্লিন বলেছিলেন, 'ভাষা মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক সম্পত্তি'। একসময় বুঝিনি, এখন বুঝছি, যখন 'মোদীর গ্যারান্টি' মোদী নিজেই গেয়ে চলেছেন আর ভক্তরা প্রণিপাত করছেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।