অবশ্যই এই উক্তির মত তাঁর সৃষ্টিও যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। ১৯৫০ সালের ‘স্টোরি অফ এ লাভ অ্যাফেয়ার’ যে নব্য-বাস্তববাদ বা নিওরিয়ালিজমের তরতাজা পরিবেশে শুধুমাত্র একটা ব্যতিক্রম নয়, তা ইতালির চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি (১৯১২-২০০৭) ক্রমে ক্রমে ‘দি ভ্যাঙ্কুইজড’ (১৯৫২), ‘দি ক্রাই’ (১৯৫৭)-র কৃষ্টি-পথে প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন সমালোচকেরা (বিশেষ করে ফরাসীরা) ইতালির নব্য-বাস্তববাদের (মোটামুটি ভাবে ১৯৪৩-১৯৫২ - এই কালখণ্ডে ধরা হয়) সমান্তরালে আন্তোনিওনিকে চিহ্নিত করেছিলেন ইন্টেরিওর নিওরিয়ালিস্ট বা ‘আন্তর-নব্য-বাস্তববাদী’ হিসেবে। নব্য-বাস্তববাদের প্রভাব যে ইতালি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী হয়েছিল, ভারতীয় বিশেষত বাঙালি হিসেবে এই সত্যজিৎ জন্ম-শতবর্ষে আমাদের অজানা থাকার কথা নয়। মূলত ভিক্টরিও ডি-সিকার (১৯০১-১৯৭৪) ‘বাইসাইকেল থিভস’ (১৯৪৮) এবং রবার্তো রোজেলিনির (১৯০৬-১৯৭৭) ‘রোম, ওপেন সিটি’ (১৯৪৫)-র বিষয় ও নির্মাণশৈলীর যে একাত্মতা, যা অত্যন্ত মৌলিক, তা-ই যে সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-১৯৯২) চিত্র-চোখের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল, সে কথা তিনি বেশ প্রকাশ্যেই বলে গেছেন। আন্তোনিওনি মনে করতেন, যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে চরিত্র ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার মধ্যে যে সম্পর্ক, তাকে প্রকাশ করার একটি অন্য রীতিই নব্য-বাস্তববাদ। কিন্তু যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন যখন বেশ দ্রুততার সঙ্গে সংগঠিত হয়ে চলেছে, যখন বাস্তব অবস্থা বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে - তখন, সেই প্রেক্ষাপটে আন্তোনিওনি শুরুতে উক্ত মন্তব্যটি করেন। এই প্রসঙ্গে দু’টি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, নব্য-বাস্তববাদ সেলুলয়েডে যে মানুষগুলিকে প্রতিফলিত করে, তারা যে শ্রেণীর (মূলত শ্রমজীবী), আন্তোনিওনির কুশীলবরা একেবারেই সেই শ্রেণীর নয়। আন্তোনিওনির কাজ মূলত মধ্য-উচ্চবিত্ত সমাজটিকে (নগরকেন্দ্রিক) নিয়ে, কারণ এই সমাজটিকেই তিনি ভালোভাবে চিনতেন। দ্বিতীয়ত, নব্য-বাস্তববাদ যদি যুদ্ধোত্তর বাস্তবে মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকের সম্পর্কের কথা বলে, তাহলে আন্তোনিওনিকে আমরা দেখতে পাই মূলত দু’ধরনের পর্যবেক্ষক হিসেবে। তাঁর প্রথম পর্যায়ের ছবিগুলিতে মোটামুটি ‘স্টোরি অফ এ লাভ এফেয়ার’ থেকে ‘দি এক্লিপ্স’ (১৯৬২) পর্যন্ত তিনি মানুষে-মানুষে সম্পর্কের যে রহস্য, অর্থাৎ ‘অন্তর্বাস্তব’ - তার উপর আলোকপাত করেন। এখানে বহির্বাস্তব স্ব-মহিমায় বিরাজমান, অর্থাৎ বহির্বাস্তবের অবস্থান শারীরিকভাবে যতটা প্রবল, মনস্তাত্ত্বিক ভাবে যেন খানিকটা গড়ে ওঠার পর্যায়ে। বিশেষত তাঁর বিখ্যাত ত্রয়ী-চিত্রাবলী অর্থাৎ ‘দি অ্যাডভেঞ্চার’ (১৯৬০), ‘দি নাইট’ (১৯৬১) এবং ‘দি এক্লিপ্স’-এ বহির্বাস্তব বিষয়-গত ভাবে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রন্থনবাদী দার্শনিক রোলা বার্থ, আন্তোনিওনির ‘দি ক্রাই’-উত্তর চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন মিথের আধুনিক গূঢ় সঙ্কেত। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘চিত্রনাট্যের শৈলী’ প্রবন্ধটিতে এই ‘দি অ্যাডভেঞ্চার’ (লাভেন্তুরা) ছবির সংলাপ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন - বিষয়বস্তু ও মেজাজের দিক থেকে সম্পূর্ণ আধুনিক হয়েও আঙ্গিকের অঙ্গ হিসেবে সংলাপের ব্যবহারে আন্তোনিওনি-থুড়ি-আধুনিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তখনও পর্যন্ত কিভাবে রয়ে গিয়েছিল সনাতনী রীতি! আন্তোনিওনির ক্ষেত্রে অন্তর্বাস্তবে অন্যতম প্রধান ক্রীড়নক হিসেবে বহির্বাস্তব প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে বা অন্তর্বাস্তব ও বহির্বাস্তবের পারস্পরিক দেয়ানেয়া শুরু হয়, তাঁর ‘দি রেড ডেসার্ট’ (১৯৬৪) ছবিটি থেকে। সে হিসেবে এটিকে তাঁর চিত্রকর্মের দ্বিতীয় পর্যায় বলা যেতে পারে। আমাদের এই আলোচনার মূল কেন্দ্রটি মোটামুটি ভাবে থাকবে এই দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৬৬ সালে নির্মিত ‘ব্লো-আপ’ নামক ছবিটির উপর।
‘ব্লো-আপ’ ছবিটিকে আমরা মনো-পরিসরে দু’টি অর্ধে ভাগ করে নিতে পারি। এই ছবির নায়ক টমাস একজন ফটোগ্রাফার। ছবিটির প্রথমার্ধ আবর্তিত হয় টমাসের পরিচয়সূচক বাস্তবতাকে ঘিরে এবং দ্বিতীয়ার্ধ আবর্তিত হয় বাস্তবতায় টমাসের কি প্রতিক্রিয়া ও উপলব্ধি তা উন্মোচনে। এখানে বাস্তবতা বলতে শুধুমাত্র বস্তু-বিশ্বের কথা বলা হচ্ছে না। মানবমনের উপর বস্তুবর্গের যে কর্তৃত্ব আধুনিক যুগ-জটিলতার অন্যতম প্রধান চিহ্ন - সেই টানাপড়েনের উপরও আন্তোনিওনি আলো ফেলেছেন এই ছবিতে। নব্য-বাস্তববাদী চিত্র-সমালোচকদের একজন নব্য-বাস্তববাদকে দেখেছিলেন “an ethics of esthetics” হিসেবে। এই ethics of esthetics-এর এ কারণেই প্রয়োজন, তা না হলে আন্তোনিওনির চিত্র-মনের তল পাওয়া একটু মুশকিল হবে। এই ethics–এর এক ধরণের অভিজ্ঞতা-নির্ভর অনুমোদন থাকে সমাজ-মানসে, যা অনেকাংশে নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত। যুদ্ধোত্তর ইতালিতে ডি-সিকা, রোজেলিনি, লুচিনো ভিসকন্তিরা (১৯০৬-১৯৭৬) যে চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছিলেন, তা অধঃপতিত নৈতিকতায় মানুষের সংগ্রামের কথা বলে। এইসব নব্য-বাস্তববাদী ছবি করিয়ে-দের ছবিতে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় বস্তু যতটা সেই যুগের সাক্ষ্য বহন করে, ততটা মানস-নিয়ন্ত্রক নয়। এই ছবিগুলি মূলত মানবিকতার দলিল। যেমন ‘বাইসাইকেল থিভস’–এর নায়ক অ্যান্তোনিও যে বাস্তবতার শিকার, তার প্রতি পরিচালক ডি-সিকা সহানুভূতিশীল, যেন এটা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব এবং শিল্প-বিচারে বলা যেতে পারে একধরণের রোমান্টিক প্রবণতা। ট্র্যাজেডির ধ্রুপদী কাঠামোর সাথে এর কোনও মিল না থাকলেও, অ্যান্তোনিও নিজে, ওরফে ডি-সিকা তাঁর সংকটকে যেন cosmic justice হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এইসব ছবি মানুষকে এক মহান জীবনবোধের সন্ধান দেয়, যা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঐতিহাসিক ভাবে প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু ‘ব্লো-আপ’ একেবারেই তা নয়। আন্তোনিওনি তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে চালু রেখেছিলেন মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সেই হেতু যে ব্যক্তিগত জীবন-যন্ত্রণা - যা আধুনিক ও অতি-আধুনিক জীবনের অন্যতম প্রধান চিহ্ন, তা থেকে। নব্য-বাস্তববাদের মতো কোনও পূর্ব-পরিকল্পিত নৈতিকতার শিক্ষা এর পিছনে কাজ করেনি।
‘ব্লো-আপ’-এ টমাসকে আমরা দেখতে পাই আপাত ভাবলেশহীন, নিজের জীবিকার প্রতি ক্লান্ত, প্রবৃত্তি-তাড়িত, কিছুটা উন্নাসিক প্রকৃতির একজন যুবক হিসেবে। আধুনিক মতি-ছিন্ন সময়ের প্রতীক যেন টমাস। ছবির শুরুতে আমরা একদল মুকাভিনেতাকে দেখতে পাই শহরের পথে ভ্রাম্যমান, চারপাশে গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলির প্রবল দাম্ভিক উপস্থিতি। তাঁর ‘দি রেড ডেসার্ট’ ছবিটির পটভূমি যেখানে শিল্প-বিপ্লব-উত্তর ইতালি, ঐতিহাসিক শিল্প-বিপ্লবের ধারক লন্ডনের আপাত শান্ত পরিবেশ সেখানে ‘ব্লো-আপ’–এর পটভূমি। ‘ব্লো-আপ’ ছবিটি আন্তোনিওনি করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়। ষাটের দশকের ইংল্যান্ড ও লন্ডন শহর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প-বিপ্লবের স্মারক বহন করছে, তার সঙ্গে আছে ঔপনিবেশিক সম্পদের বিপুল সম্ভার। ইলেক্ট্রিসিটি, স্টিল ও পেট্রোলিয়াম ছিল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অবদান আর পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর, মেইনফ্রেম কম্পিউটারের প্রথমাবস্থা ইত্যাদি তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের অবদান। সব মিলিয়ে দেখতে শুনতে ষাটের দশকের লন্ডন ছিল বহির্বাস্তবের চূড়ান্ত জটিল ঝাঁ-চকচকে এক সন্নিবেশ।
আসলে শিল্প-বিপ্লব বা আধুনিক প্রযুক্তি আখেরে বস্তু-বিপ্লব। বস্তুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এই নিগড়টিকে আন্তোনিওনি নানাভাবে দেখেছেন। যেমন, তাঁর ‘দি এক্লিপ্স’ ছবির শুরুতে, প্রেক্ষাপটে রাখা তাকের বইগুলিকে পরিচালক ফোকাস করেন, সামনের সাদা বস্তুটি ঈষৎ ঝাপসা। বস্তুটি ফোকাসে এলে বোঝা যায় - এটি শার্টের হাতা সহ একটি মানুষের হাত। ‘দি এক্লিপ্স’-এর নায়িকা জানান - একটা চেয়ার, একটা বই ও একজন মানুষের মধ্যে তফাৎ করার ক্ষমতা তাঁর নেই; ‘ব্লো-আপ’-এ টমাস যেন এটাই প্রমাণ করতে থাকে গোটা ছবি জুড়ে। এলিয়েনেশন, কনফিউশন, ডিস্টরশন আধুনিক যুগের চিহ্নসমূহ। আন্তোনিওনির ছবিগুলি যেখানে এইসব বিষয়গুলিকে সংযোগহীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, সেখানেই তাঁর ছবিকে আধুনিক চিত্র-ভাষার পরাকাষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
এই চিহ্নায়ন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়োজন আছে। এ কথা অনস্বীকার্য, যে চিত্রকলায় যেরকম দাদাইজম, কিউবিজম বা মর্ডানিজম অথবা সাহিত্যে যেমন ধ্রুপদী, আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক ইত্যাদি বিভাজন গুণীজন স্বীকৃত, চলচ্চিত্রে তেমন বিভাজন করা হয় না। তাহলে আন্তোনিওনির চিত্র-ভাষাকে আমরা আধুনিক বলছি কি হিসেবে বা কিসের তুলনায় - এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রে তুলনামূলক পর্যালোচনার নিরিখে বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। আধুনিকতা মূলত একটি মানসাবস্থা যার উৎপত্তি আধুনিকতার নিগড়টির মধ্যেই। আধুনিক জীবনের সূত্রপাতের বিষয়টি এক্ষেত্রে তাই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতার উৎসের বিচার করতে গেলে একধরণের সমাজতান্ত্রিক ও ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকৃতি দিতেই হয়। ধনতন্ত্রের বিকাশ ও আধুনিকতা কার্যকারণ সূত্রে যুক্ত। যান্ত্রিক উৎপাদন, যুগ বা সময়কে এক তীব্র গতিশীলতা দেয় - এর ফলে পরিপার্শ্বিকের যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে তাকে আঙ্গিকগত বলতে কোনও আপত্তি নেই। উঁচু উঁচু বাড়ি, নতুন নতুন ডিজাইনের গাড়ি, ক্রম-উন্নয়নশীল অন্যান্য যানবাহন ও এর সঙ্গে তাল রেখে আসতে থাকা প্লাস্টিক রঙের ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদের আমূল পরিবর্তন এই আঙ্গিকগত পরিবর্তনের চিহ্নসমূহ। আবার এই আঙ্গিকগত পরিবর্তন যারা ঘটাল এবং একে যারা স্বাভাবিক বলে মেনে নিলো - সেই ব্যক্তি ও সমাজও এর সঙ্গে পরিবর্তিত হতে বাধ্য। যে কোনও শিল্প যেহেতু বিষয় ও তাকে প্রাণ দেওয়ার নির্মাণশৈলী বা আঙ্গিকের সহাবস্থান, তাই বিষয় হিসেবে আসে এই পরিবর্তিত মানুষ বা মানবসমাজ বা সময় এবং একে রূপদানের অভিপ্রায়ে পরিবর্তিত হয় নির্মাণশৈলী বা আঙ্গিক। অনেকে মনে করেন ধনতন্ত্র যেহেতু প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল আর চলচ্চিত্র যেহেতু প্রযুক্তির যুগের শিল্প, তাই এটি মাত্রাতিরিক্ত আঙ্গিক-সচেতন। কিন্তু যে কোনও শিল্পের ভিয়েন যে মানব-মন, সেটাকেও অস্বীকার করা যায় না। তাই তীব্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যা ধনতন্ত্রের, তা আধুনিকতারও লক্ষণ।
‘ব্লো-আপ’ ছবিতে টমাসের আচরণে এটিই প্রকাশ পায়। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য জন্ম দেয় এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক সমাজের। যেখানে এলিয়েনেশন, ডিস্টরশন এবং নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে কনফিউশন, পায় বেড়ে ওঠার সতেজ জমি। তাই নব্যবাস্তববাদীদের ছবি, যা ছিল রোমান্টিক উপলব্ধি, আন্তোনিওনির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে তা রূপ পায় আত্মসচেতনতার। তবে রোমান্টিক ধারার চলচ্চিত্রগুলিতে ঐতিহ্য ও অতীতের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার ঝোঁক ছিল না - তা নয়, কিন্তু আধুনিক নিগড়ে সেটিই বহুগুণে পরিবর্ধিত হয়ে যায়। বিশেষত চলচ্চিত্র নামক শিল্প মাধ্যমটির জন্ম যেখানে ধনতন্ত্রের বুনিয়াদে, সেখানে ‘বাইসাইকেল থিভস’–এর অ্যান্তোনিওর (যদিও অন্তিম ঝোঁক cosmic justice–এর প্রতিই) কাছে ‘ব্লো-আপ’–এর টমাসের অবশ্যই ঐতিহাসিক ঋণ আছে। অ্যান্তোনিও তাঁর জাগতিক দুঃখের কোনও ব্যাখ্যা খোঁজে কি, নিজমনে? চেষ্টা থাকলেও ছবির শেষে ব্যাখ্যার প্রয়োজনটাই যেন অর্থহীন তাঁর কাছে। নিয়তির অভিপ্রায় সম্বন্ধে তাঁর খুব একটা সংশয় নেই যেন! কিন্তু ‘ব্লো-আপ’–এর প্রথমার্ধে আন্তোনিওনি যে ভাবে টমাসের পরিচয়-প্রদানকারী বাস্তবটিকে ফুটিয়ে তোলেন কিংবা ‘দি রেড ডেসার্ট’–এর প্রধান চরিত্র গুইলিয়ানা যে জটিলতা থেকে আত্মহত্যা-প্রবণ, তা যে ভাব প্রকাশ করে - তাতে ব্যাখ্যার নিদারুণ অনুসন্ধানের পরেও সেটি অনিশ্চিতই থাকে এবং প্রশ্নটাই সেখানে চরম হিসেবে থেকে যায়। আন্তোনিওনির ‘ব্লো-আপ’-এ বা ‘দি রেড ডেসার্ট’-এ জগৎ ও জীবন কেন এরকম - এর তীব্র অনুসন্ধান আছে, কিন্তু তার কোনও সার্বিক জবাব নেই। এমন কি টমাস তার ফটোগ্রাফির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন নয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কাফকা তাঁর এক বন্ধুকে একবার বলেছিলেন, “We are nihilist figments, all of us”। এই উপলব্ধি তাঁর সৃষ্টিশীলতার পরতে পরতে জড়ানো। তাঁর ‘দি ট্রায়াল’ উপন্যাসের নায়ক একদিন হঠাৎ অভিযুক্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু কেন এমন হল, তা নায়ক কোনোদিনও জানতেই পারে না। কাফকা আমাদের এক চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাত্রা করান। এ যেন “Death is the only possible deliverance” বা “Thank god that people are mortal” – স্তালিনের সময়কালে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে থাকাকালীন রুশ কবি মান্ডেলস্টাম এই উক্তিগুলি করেছিলেন। ‘ব্লো-আপ’–এ টমাস নিজের অজান্তে যে হত্যাকে ফটোগ্রাফ বন্দি করে, তা হতে পারে কোনও চক্রান্তের অন্তিম পরিণতি, কিন্তু তার থেকেও বড় হল, ঐ ফ্রেমে প্রতিবিম্বিত ঘটনার বাস্তবতার ব্যাপারটি। সত্যি কোনও হত্যা ওখানে সঙ্ঘটিত হয়েছিল, ফটোগ্রাফ এহেন সত্যির কতটা কাছাকাছি যেতে পারে? এটা অনিশ্চিত, সীমাবদ্ধ এবং প্রশ্নটাই আবারও সেই চূড়ান্ত! এই সীমাবদ্ধতা কাফকার উপন্যাসে যেমন আবহ তৈরি করে, তেমনি একে রূপদান করে আন্তোনিওনির ক্ষেত্রে নির্মাণশৈলী বা আঙ্গিক। তবে কাফকার উপন্যাস নিশ্চয়ই আঙ্গিক-ব্যতিরেকে নয়, তা সম্ভবও নয়। আন্তোনিওনির প্রায় সমস্ত ছবিতে নৈঃশব্দ্য যদি এলিয়েনেশন বা একাকীত্বকে সূচিত করে, তাহলে ‘ব্লো-আপ’-এ সীমাবদ্ধতা (শারীরিক ততটা নয় যতটা মানসিক) এক বিশেষ আঙ্গিকে সংস্থাপিত। আমরা টমাসকে বিশেষত নিজের বাড়িতে অধিকাংশ সময় একধরণের আবদ্ধ ফ্রেমের মধ্যে দেখি। তৎকালীন লন্ডনে বাড়ির অন্তর্দৃশ্যগুলিতে টমাসকে দেখা যায় - হয় কোনও কাঠের অলিন্দ বা কাঠের ফ্রেমের বিভাজনে বা ফটোগ্রাফির সরঞ্জামগুলির সঙ্গে বিভিন্ন অবস্থানে একই ফ্রেমে, কখনও বা রমণীর ভাঁজ করা পায়ের প্রেক্ষাপটে। আন্তোনিওনি মাঝেমাঝেই অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে বস্তু-সভ্যতার কর্তৃত্ব-কারী অবস্থানটিকে প্রতিষ্ঠা করেন, জীব ও জড়ের অভিন্নত্বকে আলাদা আলাদা দৃশ্যে ধরেন।
চিরাচরিত যে লং-শটের ব্যবহার ইতালির ছবিগুলিতে দেখা যায়, তা আন্তোনিওনির হাতে বিশেষত ‘ব্লো-আপ’-এ এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। ছবির শুরুর দিকে একটি দৃশ্যে টমাসকে আমরা দেখতে পাই গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে। গাড়ি ও চালকের আসনে বসা টমাস সমেত গোটা দৃশ্যকল্পটি পরিচালক লো-অ্যাঙ্গেলে স্থির টিল্ট-ডাউন ভাবে খানিকটা কোণাকুণি দৃশ্যায়িত করেন। দৃশ্যটি চোখের উচ্চতায় না নেওয়ার জন্য, দৃশ্যটি অবজেক্টিভিটি হারিয়ে এক ধরনের সাবজেক্টিভিটি লাভ করে (তাতে অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত করে দৃশ্য-বস্তুর নিজস্ব গতি + ক্যামেরার গতি = গতি স্থিতির বিভ্রম), উপরন্তু ক্যামেরা গাড়ির ভিতর না থাকায় (অর্থাৎ আমরা (দর্শক) গাড়িতে টমাসের সহযাত্রী না হওয়ায়) এবং দৃশ্যটির আগে বলা মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন পরিচালক ছবির শুরুতেই অভিপ্রেত এলিয়েনেশন, কনফিউশন ইত্যাদি ব্যাপারগুলির আগাম ইঙ্গিত আমাদের দিয়ে দেন।
লং-শটের যে প্রথাসিদ্ধ স্থান-কাল চেতনা থাকে, তাকে অনবদ্য ভাবে ব্যবহৃত হতে দেখি ছবির অন্য আরেকটি অংশে। টমাস পার্কে ঘুরতে ঘুরতে প্রণয়-রত এক বৃদ্ধ ও তরুণীর (প্রেমিক-প্রেমিকা?) ছবি ক্যামেরা বন্দি করে।
টুকরো টুকরো কতকগুলি দৃশ্যে টমাসের পার্কে আগমন থেকে ছবি তুলে পার্ক থেকে নিষ্ক্রমণ পর্যন্ত গোটা সময় কালটিকে ভাগ করে ফেলা হয়। লং-শটের স্থান-চেতনাকে কাজে লাগিয়ে পরিচালক মৌলিকভাবে পার্কের আপাত-মনোরম পরিবেশটিকে ফুটিয়ে তোলেন। নিয়ন্ত্রিত প্যানিং - যা স্থানের ধারণা তৈরি করে, তার সঙ্গে পরিচালক টমাসের গতিবিধির উপরও নিয়ন্ত্রণ রাখেন। একটা সুন্দর লং-লো-অ্যাঙ্গেল দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই - টমাস একটা গাছের আড়াল থেকে ছবি তুলে পারস্পেক্টিভ বদলানোর জন্য আরেকটি গাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ফটোগ্রাফিক ফ্রেমের যে সীমাবদ্ধতা (যা প্রতিবিম্বিত জীবনেরও) ছবির শেষে টমাসের সঙ্গে আমাদেরও এক অন্য সত্যে উপনীত করে, এই দৃশ্যটি যেন তার প্রতি পরিচালকের আগাম আভাস!
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে অপুর সংসারের (১৯৫৯) সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি, যেখানে ফিটন গাড়িতে অপু দেশলাইয়ের আলোতে অপর্ণাকে জিগ্যেস করছে ‘তোমার চোখে কি আছে বল তো?’, লাজুক অপর্ণা উত্তরে বলে ‘কাজল’। অনেক পরে আমরা যখন জানতে পারি ওদের ছেলের নাম কাজল, তখন চকিতে এই দৃশ্য আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, আমরা বুঝতে পারি বিরল প্রতিভাধর পরিচালকেরা কি ভাবে ছবির শরীরে মণিমুক্তোর মত রেখে যান বিভিন্ন আঁচড়, কি ভাবে তার ব্যঞ্জনায় আমরা আপ্লুত হয়ে পড়ি।
পুনরায় বর্তমান আলোচনায় ফিরে এসে বলা যায় - পরিবেশকে দৃশ্যায়িত করার পিছনে আবারও সেই প্রশ্নটাই চূড়ান্ত হয়ে ওঠে, ব্যাখ্যা পাওয়ার কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই যেন, বলা বাহুল্য নব্য-বাস্তববাদী ছবিগুলোতে সেভাবে উপস্থিত ছিল না কখনও। কারণ নব্য-বাস্তববাদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে এর সাযুজ্য সম্ভব নয়। এইভাবেই বিষয় ও নির্মাণকৌশল (আঙ্গিক) একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত থাকে, তাই আধুনিকতা যতটা আঙ্গিক-সচেতন, ততটাই তার সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বিষয়-সচেতনও। বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, বিশ্বাস, বিশ্বাসভঙ্গ, সর্বোপরি মানুষে মানুষে সম্পর্কের রহস্য (বিশেষ করে প্রথম পর্যায়ের ছবিগুলিতে) পূর্বেই বলা হয়েছে আন্তোনিওনির অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। সে হিসেবে ‘ব্লো-আপ’ ব্যতিক্রমের সূত্রপাত হলেও, যৌনপ্রেম এ ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মেটাফর হিসেবে থেকে গেছে। টমাস পার্কে যে বৃদ্ধ ও তরুণীর গোপন মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করে, সেই তরুণী টমাসের কাছ থেকে ফিল্ম-রিলটি চেয়ে পায় না। অবশেষে সে টমাসের বাড়িতে এসে হাজির হয়। এই অংশে একটি দৃশ্যে আমরা আবারও আন্তোনিওনির মৌলিক আঙ্গিক-চেতনার পরিচয় পাই। একটি ত্রিকৌণিক খিলানে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো টমাসের কাছ থেকে ক্যামেরা জুম-ইন করে উল্টোদিকের দেওয়াল-অবধি হেঁটে যাওয়া তরুণীটিকে ধরে এবং আবার টমাসের দিকে ফিরে এলে জুম-আউট করে ক্যামেরা দু’জনকে একসঙ্গে ধরে ঐ ত্রিকৌণিক খিলানের মধ্যেই। তরুণীর ব্যক্তিগত জীবন আগেই টমাসের তোলা স্থিরচিত্রে সর্বজনীন হয়ে গেছে। এখন আন্তোনিওনি যেন টমাসের ব্যক্তিগত পরিসরে তরুণীকে টেনে নিতে চাইছেন।
পরপর কতকগুলি দৃশ্যে টমাস ও তরুণীটির সিগারেট খাওয়ার (oral eroticism-এর আভাস) দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ঘটনা অনুমানযোগ্যতা পেতে থাকে। এক সময় ঐ তরুণী ফিল্ম-রিলটি পাওয়ার পরিবর্তে তার শরীর পর্যন্ত দিতে রাজি হয়। এতে তরুণীটির কাছে রিলটির অপরিসীম গুরুত্বের ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা পেলেও, উচ্চ-মধ্যবিত্ত যুব-সমাজের যে বাড়বাড়ন্ত নির্বোধ রতি-মুখরতা (আন্তোনিওনির ছবির নিয়মিত দর্শক-মাত্রেই যাতে অভ্যস্ত) তা অন্য ব্যঞ্জনা পায়। এ প্রসঙ্গে আন্তোনিওনি একবার বলেছিলেন, ”Sexual eroticism is the symptom of the emotional sickness of our time”। ফ্রয়েড-প্রবর্তিত মত অনুযায়ী অতিমাত্রায় repression মানসিক গৈরুষা (Hysteria বা psychological Complexity) তৈরি করে। মিশেল ফুকো আবার ফ্রয়েড-প্রবর্তিত repression-এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখিয়েছিলেন ব্যাপারটা আসলে এর ঠিক উল্টো, যৌনতা তো অবদমিত হয়ইনি, বরং চারপাশে এই নিয়ে আলোচনা ও এর উদযাপনই প্রকট! পাশ্চাত্যের তথাকথিত উদার সমাজ anti-repression-এর অবস্থান থেকেই হোক বা আর যে কারণেই হোক, যৌনতাকে অবজেক্টিভলি নেওয়ার ও দেখার যে চেষ্টা করে আসছে, এই emotional sickness তার ফলাফলের দিকে ইঙ্গিত করে কিনা, এই প্রশ্নও দেখা দেয়! সুইডেনের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যানের (১৯১৮-২০০৭) দু’টি উক্তি এ ব্যাপারে স্মরণযোগ্য, “This is hell – perversion of sex, when sex is completely totally isolated from the other parts of life and all the emotions, it produces an enormous loneliness” এবং “God’s silence, negative print”। বার্গম্যান এই দু’টি উক্তি করেন তাঁর বিখ্যাত ত্রয়ী-চিত্রাবলীর তৃতীয় ছবি ‘সাইলেন্স’ (১৯৬৩) নিয়ে বলতে গিয়ে। অন্য দু’টি ছবি ‘থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি’ (১৯৬১) এবং ‘উইন্টার লাইট’ (১৯৬৩)। এই ত্রয়ী-চিত্রাবলী God trilogy হিসেবে খ্যাত। খৃশ্চিয়ানিটিতে আস্থাবান বার্গম্যান, যৌনতা নামক খৃস্টীয় পাপকে যেন ‘ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ’ এই সন্দর্ভ রচনা করতে ব্যবহার করেন তাঁর ‘সাইলেন্স’ ছবিটিতে! ধর্ম, দর্শন ও জীবনের প্রতি নিবিড় অনুসন্ধান এই ত্রয়ী-চিত্রাবলীকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে। একজন পরিচালকের ভাবনার জগৎকে কাটাছেঁড়া করতে করতে, বৌদ্ধিক ও উপলব্ধির জায়গা থেকে আমরা কখনও গিয়ে পৌঁছই দর্শনে, কখনও মনস্তত্ত্বে, আবার কখনও রাজনীতিতে। ভাবনার অতিরিক্ত প্রজ্ঞা এইসব পরিচালকদের করায়ত্ত ছিল, মানুষের নির্বোধ অসহায়তাকে আন্তোনিওনি বা বার্গম্যান চাবুকের মত ব্যবহার করেছিলেন।
আন্তোনিওনির দ্বিতীয় পর্যায়ের ছবিগুলি নিয়ে এই প্রশ্ন অনেক সময় উঠেছে যে তাঁর ছবির মনস্তাত্ত্বিক জগৎ, তাঁর emotional sickness অনেক সময় প্রদর্শন বিলাসিতায় পর্যবসিত! তাই টমাসকে আমরা একসময় দেখি আন্তোনিওনির ছবির রতি-ক্লান্ত দর্শকের (থিম হিসেবে যৌনতা, ভঙ্গুর নৈতিকতা, মৈথুন ইত্যাদির বারংবার ফিরে আসার ফলে) মতই ভয়ারিস্টিকালি বিবাহিত জীবনে অসুখী বান্ধবী প্যাট্রিসিয়ার যৌন-জীবন অবলোকন করতে। আসলে, এই মনস্তত্ত্বই আন্তোনিওনির প্রজ্ঞা, এইভাবে তিনি মনের গভীরে আলো ফেলেন - যাতে আমরা আমাদের ক্ষতগুলিকে চিনে নেওয়ার সুযোগ পাই। রাজনীতি আবার যেমন ফরাসী পরিচালক জাঁ লুক গোদারের (১৯৩০- ) ক্ষেত্রে ভাবনার অতিরিক্ত প্রজ্ঞা। আন্তোনিওনি এ ব্যাপারে অন্তত ‘ব্লো-আপ’ পর্যন্ত No War বা Go Away লেখা একটি মিছিলের বেশি এগোননি। সাংগঠনিক রাজনীতির সঙ্গে তাঁর চরিত্রগুলির সম্পর্ক বা অবস্থান, Go Away লেখা একটি প্ল্যাকার্ড টমাসের গাড়িতে তুলে এবং একটু পরে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে, আন্তোনিওনি পরিষ্কার করে দেন। অথচ এই দৃশ্য মোটেই আরোপিত বলে মনে হয় না, কারণ পিছনের গাড়িতে পার্কের তরুণীটিকে আমরা দেখতে পাই টমাসের পিছু নিতে, ফলে Go Away-এর মজার একটা অর্থও তৈরি হয়।
তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা মোটামুটি একটা রূপ পায় ‘ব্লো-আপ’-এর পরের ছবি ‘জাব্রিস্কি পয়েন্ট’ (১৯৬৮) থেকে। এ ব্যাপারে আলোচনা আর না বাড়িয়ে আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। তরুণীটি টমাসের বাড়ি থেকে চলে গেলে, টমাস ফিল্মরিল ডেভেলপ করার জন্য ডার্করুমে গিয়ে ঢোকে। ডার্করুমের দৃশ্যগুলি বেশ সময় নিয়ে পরিচালক দৃশ্যায়িত করেন। এক ধরণের ঘন সিপিয়া আলো ডার্করুমটির বাস্তবতা রক্ষা করে। দেওয়ালে টাঙানো প্রত্যাশিত সাদাকালো ছবিগুলির উপর অতঃপর ক্যামেরা ফোকাস করতে থাকে। বর্ণাঢ্য রঙিন বহু-স্তরীয় বাস্তবতার অনুপস্থিতিতে ঐ সাদাকালো ছবিগুলি আরও বেশী ইঙ্গিত-বহুল হয়ে ওঠে। টমাস হঠাৎ কিছু বোঝার চেষ্টা করে, ছবিতে গাছের আড়ালে কোনও আততায়ী কি? কোনও মৃতদেহ? সাদা ও কালো রঙের ঘনত্ব কমতে থাকে ছবিগুলোকে এনলার্জ করার সাথে সাথে। টমাস নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাত্রিবেলা পার্কে যায় এবং একটি মৃতদেহ দেখতেও পায়। কিন্তু আন্তোনিওনির আয়রনি এখানেই, যে টমাস এরপর কি করবে - সেটা শুধু টমাসকে নয়, আমাদেরও ধন্দে ফেলে! এই স্থিরচিত্রে সত্যানুসন্ধান কি তাহলে তৃতীয় শিল্প-বিপ্লবের ঝাঁ চকচকে আফিং-তাড়িত মত্ত যুব-মানসের নব-উত্তেজনার উপাদান মাত্র? পুরোটাই আসলে টমাসের কল্পনা? কেননা পরের দিন সকালে গিয়ে টমাস মৃতদেহটিকে আর খুঁজেই পায় না !
রং নিয়ে আন্তোনিওনির মৌলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা শুরু হয়েছিল ‘দি রেড ডেসার্ট’ থেকে, তা ‘ব্লো-আপ’-এও অব্যাহত থাকে। এ ব্যাপারে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (১৯৩২-১৯৮৪) একদা মন্তব্য করেছিলেন “After painting the trees in the Desert Rosso a petrified gray, Antonioni feels no compulsions about painting an outdoor phone booth in Blow-Up a firehouse red. If reality is not expensive enough, a paint brush will take up the slack.”।
বস্তুতপক্ষে, প্লাস্টিক রঙের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের আলঙ্কারিকতা, আমাদের রুচি যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে, তা থেকেই পপ-আর্ট জন্ম নেয়। এমনটাই মনে করতেন আন্তোনিওনি। তাই পপ-আর্টও ধীরে ধীরে আধুনিক জীবন-বিক্ষুব্ধতার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠতে থাকে। ‘ব্লো-আপ’-এ এই পপ-আর্ট, ফটোগ্রাফিক আর্ট আধুনিক মননকে চলচ্চিত্রের ভাষায় বেঁধে ফেলে। ছবির একাংশে, টমাস হত্যার সত্যতা যাচাই করতে বেরিয়ে একটি ব্যান্ড মিউজিকের ফ্লোরে ঢুকে পড়ে। ব্যান্ডের গায়ক-বাদকদের মধ্যে ‘বিটলস’-এর ছায়া স্পষ্ট। টমাস উন্মত্ত দর্শকদের ভেতর থেকে বেশ কসরৎ করে গিটারের একটি ভাঙা টুকরো উদ্ধার করে এবং মিউজিক ফ্লোর থেকে বেরিয়ে রাস্তার ফুটপাথে ফেলে রেখে চলে যায়। এই অস্থিরতা, উদ্ভ্রান্তি আসলে সংযোগহীনতার কথা বলে। যে কারণে ছবির একাংশে, মোক্ষম মুহূর্তে যেখানে এনলার্জড ছবিগুলি টমাসকে এক রহস্যের সন্ধান দিচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি দু’টি রমণী টমাসের মনঃসংযোগ বিঘ্নিত করে। এই সংযোগহীনতা অপ্রত্যাশিত এবং টমাস আবার ঐ ছবিগুলির ব্যাপারে মনঃসংযোগ ফিরে পায় রমণীদু’টির সঙ্গে যৌনাচারের মাঝখানে হঠাৎ করে। এই সংযোগহীনতা কি ভাষার সমস্যা? গ্রন্থনবাদী, উত্তর-গ্রন্থনবাদী দার্শনিকদের মধ্যে এ নিয়ে গবেষণা দীর্ঘদিনের। ফ্রয়েড পুনরাবিষ্কারের সঙ্গে সেমিয়টিক্স বা ভাষার দর্শনকে যুক্ত করা, আধুনিক মনকে বোঝার জন্য জাঁক লাকার (১৯০১-১৯৮১) মত আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের প্রধান অবদান ছিল। মুখের বা লেখার ভাষা যেহেতু ‘আনমোটিভেটেড সাইন’, তাই বলার বা লেখার সময় যা ভেবে বলা হয় বা লেখা হয়, আর শ্রোতা বা পাঠক যা শোনে বা পড়ে, তা একই কিনা - এই নিয়ে অমীমাংসিত তর্ক-বিতর্ক আছে। বিশ্বব্যাপী সংযোগ যত বেড়ে চলেছে, অতি-সংযোগ বা সংযোগহীনতার সমস্যাও ততই বেড়ে চলেছে। আর এখানেই আন্তোনিওনির ছবির গুরুত্ব, প্রায় ষাট-সত্তর বছরের ব্যবধানে যার প্রাসঙ্গিকতা আরও অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হয়। আন্তোনিওনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, “Man, who has no fear of the scientific unknown, is frightened by the moral unknown.”। ‘ব্লো-আপ’-এর ন’বছর বাদে নির্মিত ‘দি প্যাসেঞ্জার’ (১৯৭৫) ছবির নায়ক লক যেন ‘ব্লো-আপ’-এর টমাসের ক্রম-পরিণতি! নায়ক লকের অস্তিত্বের সংকট এমন জায়গায় পৌছয়, যে সে নিজের পরিচয় বদলে তার মত দেখতে মৃত রবার্টসনের পরিচয় ধারণ করতে সচেষ্ট হয়! তাই আধুনিক জীবন ও মননের অনেকগুলি পর্বকে সর্বার্থেই ‘ব্লো-আপ’ ছুঁয়ে ফেলে তার দু’ঘণ্টার বিস্তারে। ছবির একেবারে শেষে, মূকাভিনেতাদের দৃশ্যহীন বলের শব্দে টমাস অংশ নেয়, এটা কি পুনরায় সংযোগ স্থাপনের ইঙ্গিত, নাকি একধরনের সংযোগহীন সংযোগের প্রস্তাবনা! এই অতিবাস্তবে টমাসকে দেখতে পাই সবুজ ঘাসের লনে একা, আর আমরা আমাদের মত করে ভাবতে থাকি –
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
(বোধ – জীবনানন্দ দাশ)
আশির দশকের গোড়ায় ছবিটি দেখেছি। পরে বার বার দেখেছি। প্রত্যেকবার নতুন করে ভাবায়।
ঐ পার্কে সত্যি কী ঘটেছিল? টমাস কী সত্যি কিছু দেখেছিল না পুরোটাই কল্পনা। আবার কল্পনাই যদি হবে তাহলে মেয়েটা বারবার রিলটা চাইতে আসবে কেন? ধাঁধা!!!!!
নাকি গল্পের শেষে খেলাটা সব বলে দিচ্ছে?