এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • লেবারের বিদেশ যাত্রা - ৩

    মঞ্জীরা সাহা
    ধারাবাহিক | সমাজ | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২৫৯৫ বার পঠিত
  • ফোনটা এসেছিল এই সুন্দরবনের ছেলেরই। ওই সাইটে সে সৌমেন বৈরাগীর সাথে একসাথে কাজে লেগেছিল। ফেরেনি সে ঝামেলার সময়ে। ও একলা নয়। এরকম আরও ছেলে থেকে গেছে।
    খুব ঝামেলা হচ্ছে গো সৌমেন দা। জল আবারো বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দিয়ে জোর করে কাজ করাচ্ছে এরা। তোমরা চলে গেলে আর আমাদের আটকে দিল।
    চালু ডিব্বায় ঠান্ডা পানি পুরি শব্জি ঝাল মুড়ি মাখার হকারের চিৎকার লোহার উপর ঘ্যাসঘ্যাস ঘিচঘিচ চাকা ঘষার আওয়াজের ভেতর হারুরের পাথর কাটার কাজে থেকে যাওয়া লেবারের মুখের কথাগুলো যতটুকু বুঝতে পেরেছিল সেটা হল দিন ওখানে এখন আরও খারাপ। আন্দোলনের মতো ব্যাপারখানার রেশ এখন বাকি সুন্দরবনের থেকে যাওয়া শ্রমিকদের উপর এসে পড়েছে। সাইট থেকে বেরিয়ে এরা যতদূরই চলে আসুক রেশ এখনও এদের উপরেও আছে। যে টাকা পাওনা ছিল সব টাকা এরা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছে। আর যে টাকা মৃত অভিলাষার পরিবার পাবে বলে গত রাতের মিটিংএ ঠিক হয়েছে সে টাকা কবে কীভাবে আসবে কিছুই জানা হয়নি।

    সৌমেন বৈরাগী তার লেবার ছেলে পিঠ ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এসে নামল হাওড়া স্টেশনের নতুন কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে বাসে বাসে গদখালি হয়ে ফেরি ভর্তি মানুষের মধ্যে কোথাও একটা ঢুকে পড়ে বালির বিরাজনগর ঘাট। অভিলাষার লাশ আসছিল গাড়িতে চেপে। কালো প্লাস্টিকে মুড়ে। সুন্দরবনের এই বালি দ্বীপ অবধি আর এসে পৌঁছায়নি। কলকাতা অবধি যেতে হয়েছিল কালো প্লাস্টিকে মোড়া বাবার পাথরে ক্ষত বিক্ষত মুখখানা শেষ দেখা দেখতে। পা বুক মুখ ঘাড়ের খাবলে যাওয়া চামড়া মাংসের মধ্যে সেলাই পড়েছিল কেবল কপালে। মারা যাওয়ার পর। পোস্ট মর্টেমের সেলাই। সেইরাতে অনেক ঝামেলার পর পোস্টমর্টেম হয়েছিল তামিলনাড়ুরই কোনও হাসপাতালে। অভিলাষার বৌকে ছেলেরা কলকাতা অবধি আর নিয়ে যায়নি। ওদের কাছে বালি থেকে নদী পেরিয়ে ক্যানিং হয়ে ট্রেনে চেপে কলকাতা পৌঁছানোটা অনেক দূরের পথ। মেয়েমানুষদের বাড়ি রেখে গিয়েছিল তাই। অভিলাষার বিধবা স্ত্রী তখন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটাকে হারিয়ে অসৌচের নিয়ম পালনের শিক্ষা পাচ্ছিল পাড়ার আর দশজন মহিলার থেকে। অভিলাষার প্রাণহীন দেহখানির সাথে আর যা আসার কথা ঠিক হয়েছিল হারুররের কারখানার সাইটের মিটিঙে, সেই টাকার অংকটা ছিল কুড়ি লাখ। শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ বাবদ পনেরো লাখ মালিক পক্ষ দেবে। আর যোগ হয়েছিল তাতে পাঁচ লাখ ঠিকাদারের পক্ষ থেকে।

    অভিলাষার মৃত্যুর পর বছর ঘুরেছে। ভাইরাস এসেছে দেশ জুড়ে। বড় বড় হাইরোডে রেল লাইনের উপর কত কত অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া লেবার মরেছে খালি পেটে হাঁটতে হাঁটতে রোদের তাপে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে। অভিলাষার বিধবা স্ত্রী কত একাদশী দ্বাদশী ত্রয়োদশী মাসের অন্য তিথি গাছে ফলা দু একটা ফল, পুকুর ধারের শাকশব্জি খেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। অভিলাষার সেই ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা আজও এসে পৌঁছায়নি বাড়ির অবশিষ্ট মানুষের কাছে।

    কত টাকা পেয়েছিল ?
    কী বলেন তো দিদি পুরো পায়নি জানি। যা দেওয়ার কথা ছিল তার অদ্ধেকও পায়নি। অদ্ধেকও না।
    সৌমেন বৈরাগীর গলার স্বরটা কেমন নীচুর দিকে নেমে এসেছে। ওইখানে বসে আমাদেরকে মিটিংএ বলেছিল পনের লাখ টাকা ওরা দেবে। আমি একলা না। আমাদের তিন চারশ ছেলেকে নিয়েই মিটিং করেছিল। কোম্পানির লোক আমাদের সবার সামনেই বলেছিল। ঠিকাদারও বলেছিল পাঁচ লাখ দেবে। কিন্তু এরা পায়নি। আশপাশ থেকে তখন অনেকগুলো কন্ঠস্বর। একটু আগে পরে একসাথে। এরা পায়নি এরা পায়নি। অদ্ধেকও পায়নি। কিছুই প্রায় পায়নি।
    কোম্পানি কাদের হাতে টাকা দিয়েছিল? কার মাধ্যমে টাকা আসার কথা ছিল এদের বাড়িতে?
    কী বলেন তো দিদি আমরা তো লেবার। ও…ই কাজ করি ঠিকেদারের আন্ডারে। আমাদের বলল টাকা দেবে। কার হাতে? কীভাবে দেবে অতো কী আর জিজ্ঞাসা করতে পেরেছি বসে সেইখানে?
    বলতে বলতে সৌমেন বৈরাগির মুখে কীরকম একটা ভীরু হাসি ফুটে উঠেছে। একটু আগের রাগভর্তি মুখের ভাঁজগুলো বদলে মুখের অন্য অন্য জায়গার চামরায় ভাঁজ পড়েছে। তারপর আমরাও এখানে এসে আবার নতুন কোম্পানির খোঁজ করছি। আর যারা থেকে গেল, বললাম না আপনাকে তাদের তো কী অবস্থা! জল দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছিল ওদের। জোর করে কাজ করিয়ে নিচ্ছিল ওদের দিয়ে। আমরা অনেক লোক ঝামেলা করে চলে আসায় লেবার সর্ট পড়ে গেছে। আমরা তো পালিয়ে এসেছি। যারা ছিল তারা এখনও আটকা জানেন!

    হারুরের পাথর কাটার সাইটের আন্দোলন, অভিলাষার রহস্য মৃত্যুর উদ্ঘাটন, অভিলাষার বিধবা বৌ এর ক্ষতিপূরণ লাভ সব প্রসঙ্গ এই বালিতেই ফেলে রেখে মাস খানেকের মধ্যে সৌমেন বৈরাগী ওর সেই ছেলে সোমনাথ আরও কিছু মানুষ রওনা দিল আবার বিরাজনগর ঘাট থেকে ফেরিতে চেপে। গন্তব্য আবার তালিলনাড়ু। এবার তামিলনাড়ুর অন্য জেলা। জেলারপট স্টেশনে নামতে হয়েছিল এবারও। সেখান থেকে এবার বাস অন্য পথে। সালেম। সেই পাথুরে অসমতল ভূমি। পাথর কাটার সাইট। এই এবারের যাওয়াটা যেভাবে ফেরি থেকে ট্রেকার, ক্যানিং লোকাল, বাস, এক্সপ্রেস ট্রেন আবার বাস, দু দিন দু রাতে সমাধা হয়ে গিয়েছিল ফেরার পথটা যে কী দূর্গম হতে চলেছে কিছুই আঁচ করতে পারেনি দু হাজার কুড়ির মার্চের মাঝমাঝি অবধিও। ওদের মনে হয়েছিল হারুরের কারখানাটা বোধ হয় পৃথিবীর একটিমাত্র জায়গা যেখানে ট্যাংকভর্তি জল থেকেও মানুষের খাওয়ার জল্টুকু শাস্তিস্বরূপ বন্ধ করে দেয়। পৃথিবীতে আর এমন খারাপ জায়গা কোথাও নেই। সেটা যে আরও আছে তা এই দূর রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া লেবারেরা আবার টেড় পেল। সেটা এই পৃথীবিতেই আছে। তামিলনাড়ুতেই যে আছে জানুয়ারি থেকে মার্চ ঘুরতে ঘুরতে ওরা বুঝে গেছিল।
    এবারের সমস্যাটা কারখনার ভেতরের মালিকের তৈরী করা ছিল না। দেশের অন্য প্রান্তে বসে সমস্যাটা তৈরি করা হচ্ছিল। জানুয়ারি মাস থেকে দেশ বিদেশের প্লেনে চেপে ভাইরাস নিয়ে আসতে দেওয়া হল। ছড়াতে দেওয়া হল। সমস্যা তৈরি হল। মার্চে গিয়ে খোঁজা হল সমাধানের পথ। বন্ধ করে দেওয়া হল সারা দেশের সব যানবাহন। সিল করা হল সবরকম বর্ডার। কে তখন অন্য রাজ্যের পাথরের উপর বসে পাথর কাটছে কে দূর রাজ্যের রোদে ফুচকা শুকাতে দিচ্ছে কে আগামী সাত দশ মাস অন্য রাজ্যের রোডে রোডে জামা কাপড় ফেরি করবে ভেবে জমানো টাকায় সাইকেলটা কিনে ফেলছে জানার দরকার পড়েনি ঘোষণা কর্তাদের।

    সমস্যার সূত্রপাত দেশের রাজধানী থেকে হলেও ওদের ক্ষেত্রে সে সমস্যাটা আরও গুরুতর করে তুলল সালেমের পাথর কাটার সাইটের মালিক। দিল্লী থেকে চব্বিশে মার্চ ঘোষণা হল সারা দেশে লকডাউন। কয়েক ঘন্টার নোটিস।
    লকডাউন শুরু হয়ে গেল। দিন কাটছে। সালেমএর পাথর কাটার সাইটে তখনও কাজ চলছে। লুকিয়ে চুরিয়ে মালিক কাজ করাচ্ছে। জল আছে। তিন বেলা খাবার আছে। মোবাইলে মোবাইলে গানের বদলে তখন নিউজ চ্যানেলের বাংলা খবর বাজছে। খবরে একটাই কথা। দেশজুড়ে ভাইরাস। মানুষের লালা থুথু নিশ্বাসে ভাইরাস। মানুষ হাঁপাচ্ছে… হাঁপাচ্ছে…। হাঁপাতে হাঁপাতে মরছে। মাসের শেষে পনের হাজার টাকা তিন বেলা ডাল ভাত শব্জি দিলেও মাথার ভেতর তখন দুটো শব্দ। করোনা ভাইরাস। ওরা ফিরতে চায় বাড়ি। নিজের গ্রামে। আর হয়তো দেখা হবে না বাড়িতে ফেলে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে। চোখের সামনে ফটফটে সাদা সাদা মার্বেল পাথরের মাঝে চোখে ভাসছে তখন মাটি টিন টালির ঘর। নিজের ঘর।

    সৌমেন বৈরাগী বলে চলেছে, জানেন দিদি তখন আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে কতক্ষণে বাড়ি ফিরে আসব! দিন আর কাটছে না। সেই কিছুতেই ছাড়বে না মালিক। টাকাও ক্লিয়ার করবে না। ছাড়বেও না। বলছে ট্রেন যেইদিন চলবে সেইদিন যাস। ট্রেন কবে চলবে জানে কেউ! কাজ বন্ধ করে দিলাম। যেই কাজ বন্ধ করছি জল বন্ধ করে দিচ্ছে। খাবার দেওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছে। ওদের কথা হল কাজ করতেই হবে। কিচ্ছু শুনবে না। আমরা বুঝতে পারছিলাম বাড়ির লোকগুলো যদি মরে তাও ছাড়বে না আমাদের। বলছে আমাদের লোক সর্ট। তোরা চলে গেলে হবে কী করে? আমরা ওই সাইটের ভিতর সেই মুড়ি খেয়ে কাটাচ্ছি তখন। কোথা থেকে কোথা থেকে জল জোগাড় করছি।

    ২০২০, মার্চ এপ্রিল মে। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় হেড লাইনে তখন মাইগ্রেটেড লেবারদের মৃত্যুর খবর। কাজ বন্ধের খবর। কিন্তু কোন সেই সালেমের পাথর কাটার সাইটের ভেতর জোর করে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়াটা খবর হয়নি। এরকম দেশ জুড়ে হাজারে হাজারে কাজের জায়গার ভেতরে সেসময়ে আরও কত কী ঘটে চলেছিল, সেই ভেতরের ঘটনাগুলো বোধহয় সেইসব প্রাচীর দেওয়া যায়গার ভেতরেই থেকে গেল।

    আমরা ব্যাগ ঠ্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসছি। সৌমেন বৈরাগীর গলাটা আবার চড়ছে, মালিকের লোক আমদের বেড় দিল। কিছুতেই ছাড়বে না আমাদের। কী বলল জানেন, আমাদের দুইখানা মোটর চুরি হয়ে গেছে। তোরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিস। ব্যাগ সার্চ করব। ব্যাগের জামাকাপড় মালপত্র উল্টে ফেলে দিল। জামাকাপড় বডি হাতিয়ে হাতিয়ে সার্চ করল। তারপরে আমরা আট দশজন ছেলে জোর করে বেরিয়ে যাই ওইখান থেকে। কোন গাড়িতে ফিরব জানিনা! কোনও ব্যবস্থা করতে পারিনি। হাঁটা লাগালাম সোজা। ভাবলাম যা হবে হবে। লাগাই হাঁটা। অনেক দূর এসে গেছি তখন। প্রায় ওইখান থেকে ত্রিশ পয়ত্রিশ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে এসে গেছি, এইবার ওইখানকার পুলিশ বেড় দিল। আটকে দিল আমাদের।
    সেটা কোথায়? কোথায় আটকেছিল?
    সেই জায়গার নাম তো জানিনা। জঙ্গল ছিল ওইখানে। ওটাতো অন্য দেশ! নামধাম জানিনা সেইসব জায়গার। পুলিশে প্রশ্ন করছে ওদের ভাষায়। আমরাও বুঝিনা ওরাও বোঝেনা আমাদের ভাষা। শেষে অনেক কষ্টে বুঝালাম আমাদের ব্যাপারটা। বললাম মালিক আমাদের খাওয়া জল সব বন্ধ করে দিয়েছিল । পুলিশ করল কী একটা গাড়িতে তুলে দিল। দিবি তো দিবি এদিকে নিয়ে আয়। আবার ওই গাড়িতে করে সেই সাইটে রেখে দিয়ে এলো। তবে একটা ভালো হল জানেন তারপর আর দুইদিন ছিলাম ওখানে, আর খাওয়া বন্ধ করেনি। জল বন্ধ করেনি। ওই যে পুলিশ ঢুকেছিল না তাই ভয় পেয়েছিল ওরা। এই দুই রাত কাটিয়ে শেষে একটা বাস রিসার্ভ হল।

    কে করে দিল ব্যবস্থা? মালিক?
    মালিক! মুখে অনেকটা হাসি এনে বলল, মালিক করে কখনও! আমাদের দেড় মাসের টাকা কিছুতেই দেবে না। একটা গোটা মাস আর দিন পনেরো কাজ করেছিলাম। শেষে অনেক ঝামেলা ঠামেলা করে খাওয়া দাওয়ার খরচ সব কেটে রেখে দিল। অনেক কম দিয়েছিল। আমাদের কয়জনেরটা যোগ দিলে প্রায় এক লাখের উপর টাকা মেরে দিল। বাসের ভাড়াও তো অনেক। বাস ভাড়া নিল এক লাখ পঁচাশি হাজার। কোথা থেকে জোগাড় করব অতো টাকা! সবার টাকা মিলিয়েও তো অত টাকা নেই। বাড়িতে সব ফোন করলাম। আমার বৌ ধার করে টাকা পাঠালো। এই উত্তম মণ্ডলের বৌ কানেরটা বন্দক দিয়ে টাকা পাঠালো। মধুর বাড়ি থেকে সুদে টাকা ধার নিল। সব ঠিকাদারের একাউন্টে দিল। সে আমাদের টাকা দিল। আমার বৌকে অবশ্য সুদ দিতে হয়নি। এমনিই টাকা ধার পেয়েছিল। কপাল ভালো বলেন দিদি!
    এরকম সব অভিজ্ঞতা শোনার পর আমার সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর চওড়া উঁচু ভাঁজ পড়া ঘামে ভেজা নানারকম কপালের মধ্যে ভালো কপালের যে উদাহরণটি তুলে ধরা হল সে কপালের আদৌ কতটুকু ভালো তা বিচার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। কেবল অবাক হচ্ছিলাম। এতো তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোর পরেও এই মানুষটি তার মধ্যে যতটুকু ভালো তততুকু কত চেষ্টায় বারবার খুঁজে নিয়ে এই বাইরের মানুষটির কাছে উপ্সথাপন করে চলেছেন।

    দু-রাত পার করে বাস এসে পৌঁছালো রবীন্দ্র সেতু অবধি। সময় শেষ। বাসের ড্রাইভার হেল্পার নিজেদের ভাষায় কীসব বুঝিয়ে দিয়ে ওদের নামিয়ে দিল বাস থেকে রাস্তায়। রাত কাটল। খোঁজ পেল এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল এই দলটির সামনে। কথা হল, দশ হাজার দিলে গাড়ি পৌঁছে দেবে গদখালি ঘাট। হাতে টাকা দিল ওরা গুনে গুনে। তারপরেই হাওয়া। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। প্রথমে সে পুলিশের খোঁজ তারপর খোঁজ লোকাল থানার। আবার একটা দিন কাটল। বিকেলের দিকে সমাধান একটা হল। থানা থেকে খোঁজ দিল ওই সময়ে কে সেই রোডে ডিউটি দিচ্ছিল। খোঁজ পাওয়া গেল সেই মহানুভবের। এবার যে গাড়িটার ব্যবস্থা হল সেটা ছোট হাতি গাড়ি। সেই গাড়িতে দশ জন উঠে রওনা দিল গদখালির দিকে। অন্ধকার হয়ে আসছিল। গদখালি অবধি আর এলো না সেই গাড়ি। সোনাখালি অবধি এসে নামিয়ে দিল ওদের। এবার শেষ উপায়। পায়ে হাঁটা। বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে বারো কিলোমিটার হাঁটা। বিগত তিন দিন ধরে পেটে মুড়ি ছাড়া আর তেমন কিছু পড়েনি। জলও শেষ। হাঁটতে হাঁটতে রাত। গদখালি ঘাটে এসে পৌঁছালো রাতে। যে খেয়াগুলোয় ওরা সেই ছোটবেলা থেকে নদীর এপার ওপার করে অভ্যস্থ সে খেয়াগুলোর মানুষের কাছে তখন ওদের একটাই পরিচয়। পাড়ার ছেলে নয়, বেপাড়ার ছেলে নয়, সুন্দরবনেরও ছেলে নয়। শুধুই বাইরে থেকে ফেরা লেবার। টি ভি খবরের কাগজ থেকে নামটা ততদিনে শিখে গেছে খেয়া চালকেরা তাদের হেল্পারেরাও। পরিযায়ী শ্রমিক। কিছুতেই নেওয়া যাবে না তাদের খেয়ায়। ভাইরাস ছড়াতে পারে। এতো পর্যন্ত স্থলভাগ প্রয়োজনে হেঁটে পার হওয়া গেলেও এবার আর কোনোভাবেই পার হওয়ার পথ রইল না। রাত কাটল গদখালি ঘাটেই। ভোর রাতে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনেক বেশি দরে রাজি হয়ে বিদ্যা পার হয়ে এসে নামলো গোসাবা ঘাট। চেনা গোসাবা ঘাটে তখন পাহারা। যেতে হবে গোসাবা স্বাস্থ্য কেন্দ্র। চার পাঁচ ঘণ্টা রোদে বসে থেকে থেকে গায়ের তাপমাত্রা টেস্ট হতে হতে বেলা শেষ। ধুলো মাখা ক্লান্ত শরীর।
    বলতে বলতে এতক্ষণে যেন সৌমেন বৈরাগীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। গলার স্বরটা কেমন বদলে গেল।
    তিন চারদিন না খাওয়া। এই হাসপাতালের সামনে আমরা যখন বসা আমাদের দেখলে বুঝতে পারতেন দিদি আমাদের কী হাল তখন! তখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে মরে গেলে ভালো হত। এইভাবে বেঁচে ফেরার থেকে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।
    দুঃসহ যাত্রায় তামিলনাড়ুর সেই রোড বাস রবীন্দ্র সেতু থানা পুলিশ হাতি গাড়ি গাড়ি বদল গদখালি ঘাট গোসাবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এতোরকমের অভিজ্ঞতা মানুষটি বোঝনোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে বুঝতে পারছি। কী বলার আছে আমার এর উত্তরে! শুধু শুনে চলেছি। এর পরেই বুঝলাম এখানেই শেষ নয়।

    এরপর ওখান থেকে আমাদের এই বালিতে পাঠিয়ে দিল। বাড়ি ঢুকতে দিলনা। এতো ঝুট ঝামেলা করে ফিরেও বাড়ির মানুষগুলোর সাথে দেখা করতে পারছিনা। এই পিছনে একটা ফাঁকা মাঠ আছে। ওইখানে একটা জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হল। চোদ্দ দিন। তবে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।
    নাক মুখে বাঁধা রুমালটা কখন যেন খুলে ফেলেছে। এবার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল নাক মুখ দিয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বার হল ।
    বছর ঘুরেছে। ঋতু বদলেছে। নদীর স্রোত জোয়ার ভাঁটায় বেড়েছে কমেছে। ভাইরাস লকডাউনের ভয়ে মানুষ ফিরে এলেও ঝড় বিদ্যুৎ বৃষ্টি বন্যা বান সমুদ্রের জল থেমে থাকেনি। মানুষগুলোও থেমে যায়নি। বাবা ছেলে আবার খুঁজছে ওরা পাথর কাটার সাইটের নতুন ঠিকানা।


    (চলবে...)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২৫৯৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    অদ-ভূত!.. - Kasturi Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prativa Sarker | ২৫ জুলাই ২০২১ ২০:৪৭496088
  • পড়ছি। খুব প্রয়োজনীয় লেখা। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন