ক্যামেরা ঘুরছে ডান থেকে বাম। জোর হাওয়ার আওয়াজ আসছে। মাঝে মাঝে দু এক ফোঁটা বৃষ্টির ছিটে লেন্সে লেগে ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছে ছবিটা। সামনে চিৎকার। একজনের না অনেকের গলার স্বরে। চিৎকারটা ভয়ের নাকি উল্লাসের সবটা বোঝা যাচ্ছে না। একেকবার পুরুষকন্ঠে হে… হে… আওয়াজটা শনশনে হাওয়ার আওয়াজকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। নীচে শুধুই জল। কাদা মেশা ঘোলা জল। স্রোত আছে তাতে। ছবিটা দুলে উঠছে। নড়ে যাচ্ছে সামান্য সামান্য। বোঝা যাচ্ছে ক্যামেরাম্যানের পায়ে হঠাৎ হঠাৎ স্রোত ধাক্কা মারছে। সামনে যারা চ্যাঁচামেচি করছে বেশিরভাগ কুড়ি বাইশ পঁচিশ কী ত্রিশ এর ছেলেরা। মাঝে দু একজন কাঁচা পাকা দাড়ি চুলের মানুষ দেখা যাচ্ছে। ছেলেরা সামনে দিকে হাত দুটো দিয়ে বুকগুলো মাটির উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। পরপর লাইন দিয়ে আধা শোয়া। পায়ের নিচে হাঁটু অবধি জল। জলটা ঘোলা কাদাজল, নোনতা জল হয়তো মিশে গেছে এতক্ষণে তাতে। ছেলেদের বুক হাতে পায়ে মাথায় চুলে সারা শরীরে যে কাদা মাখামাখি হয়ে আছে সেটা বাঁধের কাদা। ওদের শরীরের নীচে মাটির বাঁধ। বাঁধের মাটি গলে জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। শরীর দিয়ে বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। মাটি ভাঙছে। ফাটল ধরছে। পাশেই ছেলেরা মাটি কাটছে। ঝুড়ি করে এনে ফেলছে ভেজা মাটি। বাঁধের ফাটা জায়গা মেরামত করছে। আবার ধুয়ে চলে যাচ্ছে। এরকম এক ঘন্টা দু ঘন্টা তিন ঘন্টা আরও বেশি। জল ঢুকছে গ্রামে। ঝড় বয়ে গেছে গতরাতে। হাওয়াটা এখনও উত্তাল। ভরা কোটালের জোয়ার চলছে।
ওই যে বাঁধ, ওই বাঁধ অনেক অনেক এরকম ঝড় জল সহ্য করে বছরের অনেকগুলো দিন। আর ওই যে রোগা মোটা হাড় জিরজিরে নানারকম জামায় কাদা মাখা পিঠগুলো, ওই পিঠের মানুষগুলোও অনেক কিছু সহ্য করে আসছে। যাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাটি কাটা বাঁধ ভাঙা নদীর জোয়ার ভাঁটা বান বাঘ কুমিরের কামড় ঝড় জলের সঙ্গে বাস করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সেই ইংরাজ আমল থেকে স্বাধীন ভারত। হ্যামিল্টন সাহেবের সময় ট্রাকে ট্রাকে বিহার মেদিনীপুর থেকে মাটি কাটতে দক্ষ মানুষদের নিয়ে আসা হয়েছিল এই ঘন ম্যানগ্রোভের ভূভাগকে বাঁধ বানিয়ে বাসযোগ্য করে তুলতে। এক জায়গা ছেড়ে এসে এই অন্য জায়গায় বাস শুরু হয় তখনও। দেশ স্বাধীন হয়। সরকারের পর সরকার বদল। খুব একটা কিছু বদল হয় না দ্বীপগুলির মানুষের জীবনযাত্রার। ঝড় বৃষ্টি নদীর জল বাঘের থাবার মাঝে প্রাণ হাতে মধু কাঁকড়া আনতে যাওয়া বাঁধ ভাঙার ভয় পলিটিকাল নেতার রাগের ভয় সব থেকে গেছে আগেও যেমন ছিল।
ওই বাঁধ সুন্দরবনের। আর ওই যে জালের মতো জড়িয়ে আছে জলভাগ ওগুলো দ্বীপগুলোর পাশে পাশে বিদ্যা, রায়মোঙ্গল, মাতলা, হাতানিয়া দোয়ানিয়া এরকম আরও নদী। এক্ষুনি যাদের শরীরের সঙ্গে মিশছে এসে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের জল।
এটা ইয়াস ঝড়ের পরের দিনের ছবি। ইয়াস ঝড় হয়ে গেল এই কিছুদিন আগেই। ২৫ মে ২০২১। গোসাবা ব্লকের উত্তর রাঙাবেলিয়া জটিরামপুর সর্দারপাড়া সোনাগাঁ দুলকি অঞ্চল কাটাখালি আরামপুর চণ্ডীমোড় আরও অন্য অন্য ব্লকের অনেক অনেক জায়গা ভেসে গেল। অনেক দ্বীপ পুরোপুরি ডুবে গেল জলের তলায়। ঝড়ের পর অনেকদিন জোয়ারের সময়ে ভাসিয়ে দিয়ে গেল নদী সমুদ্রের জল আবারো আবারো। মাঠ থেকে জল এখনও সরেনি। সমুদ্রের নোনা জল ভারী। মাঠে মাঠে নীচে থেকে গেছে সেই নোনা জল। উপরে হাল্কা মিষ্টি জল। নদী পুকুর বাড়ি ঘর উঠোন জলে জলাকার হয়ে গেল। পুকুরগুলো ভাসিয়ে দিয়ে গেল সমুদ্রের নোনাজল। মাছ মরল কুইন্টাল কুইন্টাল। ওই যে ছেলেরা ওদের মা বাবা বৌ বাচ্চা দিদিমা ঠাকুরমা দাদু ঠাকুরদাকে মানিয়ে নিতে হল সব কিছুর সঙ্গে। রাস্তার উপর ত্রিপল প্লাস্টিক টাঙিয়ে যুবতী মেয়ে বউকে নিয়ে মেঘ ভরা আকাশের নীচে রাতের পর রাত কাটাতে হল। রাজি হতে হল ক্যামেরার সামনে একের পর এক ত্রাণের লাইনে এসে হাত পেতে দাঁড়াতে। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় ওদের। যত দিন এগোচ্ছে তত মানিয়ে নিতে হচ্ছে আরও বেশি করে। নতুন আবহাওয়া। নতুন নতুন ভূ প্রকৃতি। নতুন নতুন কাজের জায়গার নিয়ম কানুন। নতুন মালিক ঠিকাদারের নতুন ধরনের চালাকি।
নোনা জলে বারবার চাষের ক্ষতি এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। নোনা মাটি আর সেচের ব্যবস্থার অভাবে এখানে কেবল একফসলি চাষ হয়। মূলত আমন ধান। আয়লা বুলবুল আম্ফান আরও নাম-না-জানা অনেক ঝড়ের পর নোনা জলে মাঠ ভাসিয়েছে বাঁধ ভেঙে। তারপর বছরের পর বছর এক ফসলি চাষও হয়নি। মাটিতে তিল শাক সব্জিও হয়নি।
রোজগারের অন্য কোনও রাস্তা না পেয়ে দলকে দল ছেলে ওই বাঁধের উপরের রাস্তাগুলি ধরে আশপাশের ভাঙাচোরা পিচের রাস্তা দিয়ে নদী পেরিয়ে পেরিয়ে বড় রাস্তা হাই রোড স্টেশনের পর স্টেশন পার করে চলে গেছে দূরের রাজ্যে। লেবারের কাজে।
বালি দ্বীপের বিরাজনগর গ্রাম থেকে গিয়েছিল বেশ কিছু ছেলে। বয়স্ক লোকও গিয়েছিল। ক্যানিং থেকে ডিজেল অটো বদলে বদলে বা ট্রেকারে চেপে গদখালি ঘাট। সেখান থেকে ফেরি। কেরোসিন আর ডিজেল মেশানো কাটা তেলের গন্ধে ভটভট শব্দে মানুষ সাইকেল পেটি পেটি মাল বস্তা গাদাগাদি হয়ে ফেরি ডান পাশে বাঁক নিয়ে প্রথমে বিদ্যা তারপর দুর্গাদুয়ানী নদী পার করে এসে দাঁড়াবে বালি দ্বীপের বিরাজনগর ঘাটে। সিমেন্টে ঢালাই করা সিঁড়িতে পা ফেলতে ফেলত আচ্ছাদন ছাড়া ঘাট। ডানে বাঁয়ে দু একটা পান বিড়ি লজেন্স সিগারেটএর দোকান। ভ্যান টোটো’র স্ট্যান্ড। টোটোতে চাপলে মিনিট দশেকে বিরাজনগর। সেখান থেকে যে জায়গাটায় বারো পনেরোজন গিয়েছিল সেটা এই সুন্দরবনের মতো কাদা মাটি ঝড় জলের জায়গা নয়। গন্তব্য ছিল তামিলনাড়ুর উঁচু ভূভাগে। হারুর। জেলারপট স্টেশনে নেমে বাসে করে হারুরের কারখানার সাইট। সেখানে ডানে বাঁয়ে তাকালেই পাহাড়। কুড়ি ত্রিশ বিঘে জায়গা নিয়ে সাইট। এখানকার ঠিকাদার খোঁজ দেয় সে কারখানার। ওখানে কাজ করে অন্য আরেক ঠিকাদারের আন্ডারে।
বছরের অনেকগুলো দিন যাদের পায়ের তলায় জলকাদা চোখের সামনে নদীর জলের ওঠা নামা নিয়ে দিন যাপন করতে হয় তাদের পায়ের নীচে তখন পাথর। হাতে কাঁধে বড় বড় পাথর। ওই পাথর নিয়ে হাঁটতে হয় উঁচু নীচু অসমতল ভূ ভাগের উপর দিয়ে। ভারী ভারী পাথর তুলতে হয় গাড়িতে গাড়িতে। বড় বড় মেশিন চলে সারাদিন। মেশিনের বিকট সব শব্দ। মেশিনের সামনে পাথর উঁচিয়ে ধরতে হয়। পাথর কাটিং হয়। কালো পাথর। সাদা পাথর। বড় বড় চাঁই চাঁই পাথর কেটে ছেটে আকার নেয় মানুষের প্রয়োজন মতো। মাপমতো। পালিশ হয়। চকচক করে ওঠে পাথর। কিচেনের পাথর। ড্রইং রুমের পাথর। বেডরুমের পাথর। ঝাঁ চকচকে অফিস বাড়ির পাথর। পাথরের চাঁই খোদাই হয়। মেশিনে কিংবা হাতে। ছেনি বাটালি। আরও সব আধুনিক আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়। পাথর থেকে বেরিয়ে আসে চোখ নাক মুখ আশীর্বাদের হাত মানুষের হাতে। সেই চোখ নাক আশীর্বাদের হাত অস্ত্র ধরা ফুল ধরা হাতগুলি দেব দেবীদের। চলে যায় ট্রাকে ট্রাকে চেপে মন্দিরে মন্দিরে। আর মানুষগুলোর হাত কাঁধ বুক মাথার চুল পায়ের পাতা চোখের পল্লব ঠোঁটের ভাঁজ জিভ পাথরের ধুলোয় সাদা হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোয়। তাপ বাড়ে। লু ছুটতে থাকে তামিলনাড়ুর বাতাসে। পাথুরে ধুলো মিশে যায় বাতাসে। ওদের হাত চলতে থাকে। দিনে তিনবার রান্না হয়। বড় বড় কাঠ জ্বলে ওঠে বড় বিশাল সাইজের উননে। বড় কড়াই চাপে। বড় বড় হাতা খুন্তি দিয়ে ডাল তরকারি রান্না করে বালি দ্বীপের বিরাজনগরের অসিত বরণ মাইতি। বয়স পঞ্চান্ন ষাট পেরিয়েছে। চুল পেকেছে। পাঁচ বছর ধরে ওই এক কোম্পানিতেই ওই উনোনের ঘরেই তার চব্বিশ ঘন্টার বেশিরভাগ ঘন্টাগুলো কেটে গেছে। দেড়শ জনের রান্না। সঙ্গে একজন মাত্র হেল্পার। তিন বেলা ডাল ভাত শব্জি। তামিলনাড়ুর পাথুরে মাটি টিনের ছাত গরম হয়ে যায়। উনোনের গরমে লাল হয়ে যায় চোখ নাক কান। রান্না চলে। লাইন দিয়ে থালা পেতে দাঁড়ায় দেড়শ জন। শরীর জুড়ে ঘাম গড়ায়। মগের গায়ে ঝোল গড়াতে গড়াতে লাইনকে লাইন থালায় ভাতের মাঝে সব্জির ঝোল পড়ে। আবার কাজ শুরু হয়। বছরে সাত আট মাসের কাজ। মাসে পনেরো হাজার করে মায়না। সব টাকা মাসে পায় না। কথা থাকে সব কাজের শেষে টাকার হিসেব। এভাবে স্বপন বৈরাগী উত্তম মণ্ডল মধু হালদারদের দিন কাটতে থাকে। টিনের ছাতের তলায় লাইন দেওয়া পাশাপাশি বিছানায় রাতগুলো কাটতে থাকে।
যে ঘটনায় তাদের ওই সাইট থেকে চলে আসতে হল ঘটনাটা ঘটেছিল রাতেই। রাত আটটা হবে তখন। দিনের কাজ শেষ। পাহাড় জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। পাথর কাটাকাটি নকশা তোলার জায়গা থেকে একটু দূরে সাইটের অন্যদিক। সেখানে জঙ্গল পাহাড় আরও বেশি করে অন্ধকার। পাথর কাটার পর রাবিশ ফেলা হয় সেখানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সেই রাবিশে আসল পাহাড়ের পাশে একখানা নকল পাহাড় তৈরি হয়ে গেছে। ওখানে ইলেক্ট্রিকের লাইট নেই।
বড় বড় উনোনে কাঠের আগুনে রাতের রান্না চড়েছে। সারা দিনের কাজ সেরে পাথরের ধুলো গামছা দিয়ে ডলে ডলে তুলে স্নান সেরে তেল চপচপে চুল টেনে আঁচড়ে ওরা তখন যে যার মতো। কোথাও মোবাইলে কথার আওয়াজ আসছে কানে। ফেলে রেখে যাওয়া বৌ মায়ের সঙ্গে কী বাচ্চার সঙ্গে দিন শেষের গল্প, প্রেমিকার সঙ্গে ফিসফিস, বাজারের খবর, ভেঙে পড়া টালির চালের খবর, মৃত্যুর খবর, ফেলে যাওয়া জায়গার ঝড় বাদল কী পাড়ার খবর। মোবাইলে গান বাজছে কোথাও। হিট গান। হেডফন লাগানো আছে কানে। গানের সুর ফিসফিসানির মধ্যে হঠাৎ একটা জোর চিৎকার। আয় রে … চিৎকারটা আসছে ওই দূর রাবিশ ফেলার অন্ধকার থেকে। স্বপন বৈরাগী মধু আরও সব ডান বাঁ যে যেখান থেকে পারলো দিল ছুট। অন্ধকারের দিকে দৌড় দৌড় দৌড়…।
সাসপেন্স!
আরেকটা চমৎকার সিরিজ শুরু হল।
গুরুত্বপূর্ণ লেখা, অপূর্ব লেখনি, পড়ছি ...
ভালোই লাগছে। শেষ পর্যন্ত পড়তে চাই।