ঘন অন্ধকার ওখানে। পাহাড়ের গায়ে ক্রেন চলার আওয়াজ আসছে অন্ধাকার থেকে। ক্রেনের আওয়াজের সাথে একজনের গলার স্বর, আয় রে… দেখে যা ও…ই ও…ই। আওয়াজটা ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ফাঁকা জায়গায়। একজনের গলার স্বর আর নয়। দেখতে দেখতে কীরকম একটা হো…, ও…ই, চিৎকার। অনেক অনেক গলার স্বর মিলে গেছে আওয়াজটায়। আর বোঝা যাচ্ছেনা শব্দগুলো। কাছ থেকে দূর থেকে আরও দূর থেকে আসছে আওয়াজ। শুনতে শুনতে ছুটছে ওরা। আওয়াজটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ। একটু সামনের দিকে এগিয়ে চলে গেছে সৌমেন বৈরাগী। বালি দ্বীপেরই ছেলে। বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ হবে। সাথে তার ছেলে। একটু পেছনে। সেও ছুটছে। বয়স চৌদ্দ পনের। সেও এই কারখানারই ওয়ার্কার। পাথর কাটার কাজ করে। বাবার সাথে এ বছরই এসেছে। লেগেছে একই কাজে। এইট পর্যন্ত পড়ে পড়া ছেড়েছে। স্কুল ছেড়েছে। বন্ধু বান্ধব ছেড়েছে। রুটিনের বাংলা ইংরাজী ইতিহাস ভূগোলের বদলে এখন সাইটের মালিকের বাঁধা রুটিন। এখন তার কাজ একটাই তামিলনাড়ুর হারুরএ পাথর কাটার কাজ। ভোর থেকে রাত। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব লাইন দিয়ে।
আস্তে আস্তে লোক বাড়ছে। পাথরের উঁচু নীচু এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে ছুটছে ওরা চারপাশ থেকে। ওই রাবিশ ফেলার জায়গাটার দিকে। আরও ভিড় বাড়ছে। সৌমেন বৈরাগী দূর থেকে দেখতে পেয়ে গেল ভিড় ওখানটায়। অনেক মানুষ জটলা বেঁধে চলেছে দূরে অন্ধকারের দিকে। প্রায় একশ দেড়শ লোকের ভিড়টা চলেছে। ছুটছে কেউ। হাঁটছে কেউ জোরে জোরে। যেদিকে ফলের বাগান জঙ্গল অন্ধকার। যে রাস্তা দিয়ে সাইটের ট্রাক পাস হয় সেদিকে নয়। সৌমেনদের বুঝতে বুঝতে বেশ খানিকক্ষণ লেগে গেল ব্যাপারখানা কী! হুড়োহুড়ি চিৎকারে বোঝা যাচ্ছে না কথা গুলো ভালোমতো। ধুলো উড়ছে। নানা কথায় যা বোঝা গেল ওই পথ দিয়ে গিয়ে দূরে অনেকে মিলে কয়েকজনকে আটক করেছে।
অন্ধকারে ওদেরই একজন দেখতে পেয়ে গেছিল ব্যাপারখানা। কি যেন একটা পাস করে নিচ্ছিল জঙ্গলের দিকে। অন্ধকারে। জঙ্গল দিয়ে অন্ধকার দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল কারা যেন। সন্দেহ হয়। এগিয়ে যায় আরও একটু। আরও একটু সন্দেহ বাড়ে। দেখে কোম্পানীর মালিকের লোক ড্রাইভার। চিৎকার দেয়। চিৎকার ক্রমশ বাড়তে থাকে। একজন থেকে দুজন। দুজন থেকে আস্তে আস্তে আর আরও বেশি মানুষের গলায়।
ঘটনাটা সৌমেন বৈরাগী বসে বসে বলছিল বিরাজনগরের লীলাবতি বৈরাগীর দাওয়ায়। পাশে অসিত বরণ বৈরাগী, উত্তম মণ্ডল, স্বপন বৈরাগী, পার্থ বৈরাগী আরও জনা পনেরো। বেশ কিছু মহিলাও। সবাই দুরের রাজ্য থেকে ফেরত আসা লেবার। কেউ গিয়েছিল রান্নার কাজে কেউ গিয়েছিল কারখানার কাজে কেউ আয়ার কাজে। কাজ গেছে সবার। আনলক চার না পাঁচ চলছে এখন। আর যেতে পারেনি কেউই। লকডাউনের মাঝে সবাই ফিরে এসেছে নানা ভাবে। নানা পথ দিয়ে নানা যানবাহনে। কখনও পায়ে হেঁটে। স্থলভূমি জলভাগ নানাভাবে পেরিয়ে কাঁধে ব্যাগ বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে অনেক ঝুটঝামেলা মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছে কাজের জায়গা থেকে।
লীলা বৈরাগীর দাওয়ার টিনের ছাতের তলায় চারদিকে বাঁশের খুঁটি। চারপাশ খোলা। চারপাশ খোলা হলেও হাওয়া আসছে না এক ফোঁটাও। বর্ষা শেষ হবে হবে। আকাশে মেঘে এক ফোঁটাও ফাঁক নেই। গুমোট। অক্টোবরের শুরু। হিসেবে শরৎকাল হলেও এই পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের অঞ্চলে এখনও বর্ষা চলছে। বেলা শেষ হবে। এই দ্বীপের চারপাশের নদীগুলোয় স্রোত এখন ভীষণ। খেয়ার চালক আসার পথে বলছিল দুর্গা পুজো আসছে তো এসময়ে স্রোতের টান খুব বেশি। পার ছাপিয়ে নোনা মাটি ম্যানগ্রোভের শিকড় কাণ্ড ডুবিয়ে সাঁই সাঁই করে বইছে কাদা জল। ওরা সবাই স্থির হয়ে বসে আছে টিনের ছাতের তলায়। মেয়েদের মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাকি আঁচলটা নাক মুখের উপর দু কানের পাশ দিয়ে টেনে আটকে রাখা। পুরুষেরা সব রুমাল বাঁধা নাক মুখের ওপরে। সম্ভবত অন্য রাজ্য থেকে ফেরার পথে পুলিশের তাড়ায় এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে। দূর থেকে আসা মানুষের ক্যামেরার সামনে বসে বলতে হবে দূর রাজ্য থেকে কাজ ছেড়ে কোনওরকমে পালিয়ে আসার কথা। এখনও সেই দুঃসহ যাত্রার স্মৃতি ওদের মনে টাটকা। এই মুখে কাপড় বেঁধে রাখার কথাটাও তাই ভালোমতো মনে থেকে গেছে।
এখন যেবারের ফেরার কথাটা হচ্ছে তা এই দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার মাস পাঁচ ছয় আগের ঘটনা। সেবারের ফিরে আসার কথাটা বলতে বলতে সৌমেন বৈরাগী উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। টিনের ছাতের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। সৌমেন বৈরাগীর গলার কাছে ঘাম জমে স্যান্ডো গেঞ্জির মাথাটা ভিজে উঠেছে। অসিত মাইতি বলছেন, গন্ডগোলের চটে সব আমরা চলে এলাম। যেই দিন ওই ঘটনা ঘটেছিল আমি রান্নাঘরেই ছিলাম। ওখানেই থাকতাম সারাদিন। ঝোল ফুটছে তখন উনোনে। চ্যাচামেচি শুনতে পেয়েছিলাম আমিও। যেতে পারিনি ওইদিকে।
সৌমেন বৈরাগীর গলায় উত্তেজনা। অসিত মাইতির কথার মাঝেই বলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি ছিলাম দিদি। আমি… আমি… একদম ওই স্পটে গেছিলাম। আমি শুধু একলা না, এই সুন্দরবনের প্রায় একশ দেড়শ লোক তখন ওই বাগানের রাস্তায়। আমাদের আগেই ক’জন বেড় দিয়েছিল ওদের। আমি ছিলাম কয়েকজনের পিছনে। একজনে দেখতে পেয়ে গেছিল জঙ্গলের মধ্যে কি একটা বড় বস্তার মতো টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেনের ড্রাইভার আর মালিকের লোক। দেখেই সেই লোকের সন্দেহ হয়। তাইতো চিৎকার দিয়ে ডাকে। আমরাও সেই ছুট মারি। ওখানে জমা হয়ে আমরাও বেড় দিয়ে দাঁড়াই। বের হতে দেইনি তক্ষুণি ওইখান থেকে। দেখি জানেন বস্তার মধ্যে একটা লাশ! জানেন সেইটা আমাদের এই বালিরই লোক। এই বিরাজনগরেরই। এই পাশের পাড়ারই মানুষ। অভিলাশা মণ্ডল। ওই মালিকের লোক ড্রাইভার অভিলাষার লাশ বস্তায় পুড়ে জঙ্গল দিয়ে গায়েব করে দিচ্ছিল।
এতো বড় একটা ঘটনা এতো গড়গড় করে আমার সামনে দাঁড়ানো প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শুনে কীরকম ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম। গরমটা যেন আমার শরীরেও জাঁকিয়ে বসছিল।
প্রশ্ন করলাম, কেন?
আরে! বুঝলেন না! লাশ গায়েব করে দিলে তো আর কোনও ঝমেলাই হবে না! কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। নাহলেই তো টাকা পয়সার কেস। সাইটের মধ্যে মরেছে। একটা মানুষ মরে গেল আর পয়সা চাইবে না বাড়ির লোক এ কী কখনও হয়?
কী ভাবে মারা গেল?
সে তো আমরা কেউই নিজের চোখে দেখিনি। কিন্তু ওই একটা আন্দাজ করেছিলাম আরকি! বুঝতে পেরেছিলাম ওই যে যেখানে রাবিশ পাথরের ডাস্ট ফেলে ক্রেনে সেই ক্রেনে ও চাপা পড়েছে। নাইলে ওই পাথরের রাবিশ অভিলাষার গায়ে ফেলে দিয়েছে ক্রেন থেকে। ওই পাথরে ও চাপা পড়ে মরেছে। ওই ক্রেনের ড্রাইভারটা মালিককে মনে হয় ফোন করে। তাই মালিক নিজের লোক পাঠায়। চুপিচুপি সবাইকে না জানিয়ে গায়েব করে দেবে ভেবেছিল। যেই আমরা দেখে নিয়েছি বলছে, অসুস্থ অসুস্থ। ওই হাসপাতালে নিতে হবে। বস্তায় পুড়ে বলে হাসপাতালে নেবে! আমাদের দেখতেই দিল না ভালো করে। আমাদের তাড়া দিয়ে ওরা তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে অভিলাষাকে তুলে ওইখান থেকে হাওয়া।
আমরাও এই সুন্দরবনের সব অত্তো সহজে ছাড়িনি। ক্যানিং গোসাবা সাতজেলিয়া পাথরপ্রতিমা সাগর থেকে আমরা প্রচুর ছেলে। ওই সাইটে সাত আটশ মানুষ তারমধ্যে আমরা তিন চারশ বাঙালী। সবই এই সুন্দরবনের ছেলে। হল তারপর খুব গণ্ডগোল। এইদিকেতো আর আনেইনি লাশটাকে।
কোনদিকে?
যেইখানে আমরা ওই পাথর ঠাথর কাটতাম সেইদিকে। ওইখানে বডি আনলে তো আগুন জ্বলে উঠত। আমাদের সব ছেলে সব ক্ষেপে যেত না! তাই করল কী তাড়াতাড়ি হাসপাতালের নামে ওই বাগান থেকে হাওয়া।
অসিত মাইতি সৌমেন বৈরাগীর কথার মাঝে আবার বলা শুরু করেছেন। আমরা আর ওকে দেখতেই পাইনি। আমাদের এইদিকে বলেছে একজন অসুস্থ হয়ে গেছে হসপিটাল পে লেনা পরেগা। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সত্যিই অসুস্থ। তারপরে তো শুনলাম মরেই গেছে আঁশলে ওই স্পটেই। এইদিকে আনলে ঝামেলা হবে না! তাই সরিয়ে দিল। ওইখানে কোন্ হাসপাতালে যেন নিয়ে গেছিলো ওরে! তখন তো ডেডই ও। কী করবে নিয়ে আর!
সৌমেন বৈরাগীর কথার স্পিড আরও বেড়ে গেছে। আমরাও ঝামেলা করেছিলাম খুব। এমন ঝামেলা করেছিলাম না! আমরা সেইদিন রাত্তির বারোটা অবধি সব ওইখানে। পরের দিন কাজ বন্ধ করে দিলাম। আমাদের কোনও ছেলে আর কাজ করব না, বলে দিলাম। সারাদিন সব ওই যে ‘আন্দোলন’ বলে না, সেইরকম অনেকটা। অফিসঘরে ঢুকে ভাঙচুরও করে ছিল সব। কম্পিউটার ফম্পিউটার ভেঙে দিয়েছিল একেবারে। সে কী ঝামেলা! ওরাও করল। পরের দিন থেকে জল বন্ধ করে দিল। খাওয়ার জল, পায়খানা বাথরুমের জল আমাদের ছেলেদের জন্য সব বন্ধ করে দিল।
সেকি! আর খাওয়া দাওয়া? সেটা দিচ্ছিল?
হ্যাঁ, ওই ঠিকাদার ছিল আমাদের সে খাবার দিচ্ছিল। আমরা জল ছাড়া ওই গরমে অনেক কষ্টে কোনওরকমে ছিলাম। তাও কাজ বন্ধ করে রেখেদি। এইভাবে দুই দিন কাটলো। তারপর ওরা আমাদের নিয়ে মিটিং করল সাইটের মধ্যে। কিন্তু ঝামেলা চলল। আমাদের একটাই কথা তখন, একটা মানুষ মরে গেল আর চুপচাপ এইভাবে গায়েব করে দেওয়া! আমাদের মানুষগুলোর কোনও দাম নেই?
নোনা মাটির উপর পা রেখে সেই নোনা মাটির কোনও এক অভিলাষা মণ্ডলের দূর রাজ্যে বেঘোরে প্রানটা যাওয়ার পর জীবনের দাম খোঁজার গল্প শুনছি। কাদা নোনা মাটি থেকে সেই পাথুরে অসমতল ভূমিতে পাথরের কাজে গিয়ে বেঁচে থাকতে অভিলাষার জীবনের কী কী অভিলাষ পূরণ হয়েছিল আর জানা হয়নি। দেখা হয় নি তাঁর ফেলে রেখে যাওয়া বিধবা স্ত্রী’র সাথে। যিনি স্বামীকে শেষ দেখার ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারেননি। এক গুমোট দুপুরে সে শ্রমিকের মৃত্যুর পর তার ডেডবডির দাম আদায়ের গল্প বলতে গিয়ে রাগ ক্ষোভে জড়িয়ে আসছে আরেক শ্রমিকের জিভ। ওদের জীবনের দাম আদায়ের ‘আন্দোলনের’ মতো ব্যাপারখানা বোঝাতে কিছুটা এগিয়ে এসেছে আমার দিকে। হাত দুটো নেড়ে চলেছে অনবরত। কিন্তু সেটা কিছু মিনিট। যে উত্তেজনা যে রাগ ক্ষোভ নিয়ে অভিলাষার মৃত্যুর রহস্যগল্পটা বলতে শুরু করেছিলেন কিছুটা বলার পর আস্তে আস্তে এই জীবিত শ্রমিকের উত্তেজনা মিলিয়ে যেতে শুরু করল। পাশে বা একটু দূরে কোথাও সুন্দরী গড়ান শিরিশ জিকা গাছের পাতাগুলো যেন সামান্য সামান্য নড়তে শুরু করেছে। গলার কাছের ঘাম শুকোতে শুরু করেছে।
আমি আর থাকিনি দিদি ওইখানে। এতো ঝামেলা দেখে আমি আমার ছেলে এই অসিত দা আমরা চলে এলাম। আমাদের টাকা কেটে নেবে বেতন থেকে। ঠিকাদার খাওয়াবে কতদিন কাজ না করলে? চালু ডিব্বায় চড়েছি জেলারপট স্টেশন থেকে। ট্রেনে এক দেড় ঘণ্টা মতো চলে এসেছে, আমার মোবাইলে ফোন এলো। সাইট থেকে।
মানুষ তো নয় সংখ্যা শুধু।
জোট বাঁধ, তৈরি হও!
কম্পিউটার বনাম জল । অর্থনৈতিক অসাম্যের এটাই সত্য প্রতিরূপ।