খন্যান থেকে ইরান (তৃতীয় পর্ব)
মইনুদ্দিনের হাতে টাকা প্রায় শেষ। পাসপোর্ট নেই। বললেও ফেরত পাবে না পাসপোর্ট কোম্পানির কাছ থেকে। কিন্তু হাতে ছিল অন্য কিছু। স্মার্ট ফোন। আর তাতে নেট কানেকশন।
সারাদিনের ওয়ার্কশপের কাজ চলছে। ওরা সবাই প্রতিদিন বাঁচার পথ খুঁজছে অন্ধকারের ভেতর। মইনুদ্দিনের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেল। মনে পড়ে গেল একখানা নাম। কলকাতায় তাঁর অফিস। রুবি হাসপাতালের কাছে। যাঁর সাথে মইনুদ্দিনের কোনও একটা অন্য কারণে পরিচয় হয়েছিল সামান্য। মনে পড়ে গেল তাঁর কার্যকলাপ। নেট অন করে শুরু সার্চ। গুগল সার্চ করতে করতে পেয়ে গেল একটা অ্যাপের নাম। প্লে-স্টোরে পৌঁছলো। এন.এ.টি.সি। ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটি। ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটির প্রধানের নামখানাই ওর পরিচিত। যাঁর সাথে সামান্য আলাপ হয়েছিল কখনও অন্য একটা কারণে।
ইন্সটল বাটনে প্রেস। ওপেন। খুলে গেল অ্যাপ। অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটির লোগো। নিচে লেখা ‘হ্যাভিং ট্রাবল’। তার নিচে মেসেজ বক্স। সেই সাদা বাক্সে লেখা ‘এন্টার ইওর মেসেজ’। সাদা বক্সে পৌঁছে গেল মইনুদ্দিনের আঙুল। লিখে ফেলল। ওরা কোথায় কীভাবে আটকে আছে। ব্যস! সাবমিট।
দুপুর শেষ হয়ে বিকেল-সন্ধে-রাত। ছ’ঘণ্টা পার। রাত এগারোটা। ওয়ার্কশপের কাজ সেরে অনেকক্ষণ আগে ফিরেছে ওরা। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ। ঘরের লাইট অফ। বিচের পাশের লাইট এসে ঢুকছে কাচের জানালাখানা দিয়ে। ঘুম নেই ভালোমত অনেকদিন ধরেই। আরও একটা অনিশ্চিত দিনের অপেক্ষা। আরও কিছুটা বিনা-মজুরিতে দক্ষতা দিয়ে কারিগরি দেখানোর অপেক্ষা। বাড়ির মানুষের রোগ-ব্যাধি-মৃত্যুর খবর, প্রেমিকার চিন্তা, বৌ-বাচ্চার চিন্তা, অন্য সব চিন্তা গিয়ে, কেবল নিজের জন্য দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়। হঠাৎ রিংটোন বেজে উঠল মইনুদ্দিনের ফোনে। ভারতের ফোন নম্বর। প্লাস নাইন ওয়ান দিয়ে শুরু। কলকাতা থেকে ফোন। ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটির চেয়ারম্যানের ফোন। নাম জিন্নার আলি। এই নামটাই মনে পড়েছিল মইনুদ্দিনের। সকালবেলা। সেই ব্যক্তির সঙ্গেই রাতের মধ্যে সরাসরি কথা হবে সুদূর ইরানে বসে, এত তাড়াতাড়ি রেসপন্স এসে যাবে ভাবতে পারা যায়নি। ফোনে সামান্য দু’চার কথা । রাত সাড়ে এগারোটা। শুরু হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিং। জিন্নার বাবুর পার্সোনাল হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে মেসেজ আসছে পরপর।
ক’জন আটকা পড়ে আছে?
কোথায়? ঠিক কোন অ্যাড্রেসে?
কোন কাজ?
কোন কোম্পানি?
ঠিকানা?
কবে গেছে?
কোন এজেন্ট নিয়ে গেছে?
কার আন্ডারে কোন এজেন্ট?
মেইন এজেন্ট কে?
এজেন্টের ভিলেজ? পোস্টঅফিস? থানা?
নিয়ে গেছে কীভাবে?
কোন মাস?
কোন তারিখ?
কজন ছেলে?
সবার পাসপোর্টের নম্বর?
বাবার নাম?
গ্রামের নাম?
পোস্ট অফিস?
থানা?
জেলা?
চ্যাটিং চলছে। রাত গভীর হয়ে চলেছে। দূরে পোর্টে মাল নামানো-ওঠানোর কাজ চলছে। কারখানাগুলোয় রাতের ডিউটি চলছে লেবারদের। ফোনের স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে টাচ করে একের পর এক উত্তর দিয়ে চলেছে মইনুদ্দিন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে চলেছে। রাত পার হয়ে যাচ্ছে। মইনুদ্দিনের চোখ সজাগ। সারা দিনের একটানা খাটুনির পর একফোঁটাও ঘুম নেই দু’চোখে। সব উত্তর ঠিকঠাক লিখে চলেছে। উল্টোদিকের প্রশ্নকর্তার চোখেও ঘুম আসার ব্যাপার নেই। যত ডিটেইল জানা দরকার, সব প্রশ্ন টাইপ করে চলেছে সারা রাত ধরে। ভোর চারটে বেজে গেল। উপসাগরের পারে, ইরানের আকাশে কতটুকু আলো ফুটেছিল জানা নেই তবে মইনুদ্দিনের মনে আশার আলো ফুটতে শুরু করেছিল।
পরদিন সকাল হল কলকাতায়। ইমেইল গেল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। একটা ইমেইল মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্সে। আরও একটা, প্রধান মন্ত্রীর দপ্তরে। ইমেইলগুলো করলেন জিন্নার আলি। আবার রাত কাটল। পরদিন সকাল। ফোন এল মইনুদ্দিনের মোবাইলে। ইরানের ইন্ডিয়ান এম্বাসি থেকে ফোন। খবর ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে সোজা ইরান। ইরানের তেহেরান থেকে ফোনটা এসেছিল। ইরানের চাবাহারে ইন্ডিয়ান এম্বাসি নেই। আছে তেহেরানে। সেই বহুদূরের শহর।
আপনার লেখায় এই বেদনাময় অভিজ্ঞতাও হয়ে উঠেছে রোমাঞ্চকর থ্রিলার। শেষ পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম। ভারত সরকারের লোকজন ঠিক সময়ে স্টেপ নিতে পাারাায় এত প্রাণ বাঁচল তবু।
খুব ভালো হয়েছে ম্যাডাম , আপনাদের মত মানুষ সমাজ এর প্রতিটা মানুষের পাশে থাকুন ।
খুব ভালো হয়েছে ম্যাডাম , আপনাদের মত মানুষ সমাজ এর প্রতিটা মানুষের পাশে থাকুন ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিৎ এই অ্যাপটির প্রচার করা। অনবরত গ্রাম মফস্বল থেকে লোকে কাজের প্রয়োজনে বেরোচ্ছে আর পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসি যে মাঝেসাঝে কাজের কাজও করে সে টা জেনেই ভাল লাগছে।