

ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
হলটায় রোজ রোজ একটাই সিনেমা চলে। মিনিটরা আরো মিনিটদের ডাকে, ঘন্টারা আরো ঘন্টাদের, দিন,সপ্তা,মাস,বরষ ডাকে। আরো সব দিন, সপ্তা,মাস, বরষকে। সবার চোখের মণি জুড়ে এই একটা সিনেমাই চলে। মানুষ গুলো তাতে হাঁটে, বসে, ঘোরে, ফেরে। মানুষগুলোর চারপাশে হাওয়ায় ধুলোর কণার মত কথা ওড়ে। ছোটছোট গোলগোল কথা, বড়মত কোণাচে কথা, ভাঙাভাঙা গুঁড়োগুঁড়ো কথা।ওড়ে। সিনেমাটায় ঠিক এত ঘন্টা এত মিনিট পরে একটা মেরুন রঙের ট্রাম চলে যায়, সেই সময়েই রাস্তা পেরোয় একটা হলুদ ছাতা, আকাশ জুড়ে বিষ্টি থরথর ক'রে কাঁপতে থাকে। চারপাশ দিয়ে মানুষের,কথার, হাসির, রাগের, হতাশার গন্ধ, কাজের গন্ধ, ফন্দিফিকিরের গন্ধ ধোঁয়ার মত পাকিয়ে পাকিয়ে আস্তে আস্তে বাতাসে মিশতে থাকে পা টিপে টিপে। আদরের গন্ধ মিশতে থাকে,যাবার গন্ধ, আসার গন্ধ ......সিনেমা শুরু হবার ঠিক এত ঘন্টা, এত মিনিট, এত সেকেন্ড পরে। আয়নার ভেতরে আপনমনে কথা-নাতা-ছেঁড়াপাতা সেলাই করে চলে একটা মোটা চশমা,একজোড়া ভিতু চোখ, একটা মুখ। হাবলাখাবলা। সব দিন,সপ্তা,মাস বরষ জুড়েই।
একদিন কিন্তু অন্যরকম হচ্ছিলো সব। বইয়ে যা যা লেখে সব অবিশ্বাস করবেন না, জানেন তো? বইয়ে যা যা লেখে তেমনটিও হয়ে যেতে পারে কোনো একদিন। আর তাহলে সবকিছুই অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। একদম অন্যরকম। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সেদিন সিনেমা শুরু হবার তত মিনিট তত ঘন্টা পরে আমি আলমারির দরজা খুলেছিলাম। আর তাইতেই সবটা বদলে গেলো। আলমারির অন্যদিকটায় একটা দরজা থাকে জানেনই তো। সবদিন থাকেনা, কোনোকোনো বদলে যাবার দিনে। ওটা খুললেই একটা জঙ্গুলে জায়গায় নেমে পড়া যায়। সেখানকার আলোর অন্যরকম রং। আমি নিজের চোখে দেখেছি। হ্যাঁ, কেউ কেউ বলে যে আলমারি কেন, একটা খরগোশের গর্ত দিয়েও ঐ জায়গায় যাওয়া যায়, কিম্বা একটা নয় পূর্ণ তিনের চার নম্বর ইষ্টিশনের লাল টুকটুক রেলের গাড়ি চড়ে। তা যায় অবশ্যি। সত্যিই। তবে আমার হাতের কাছে আলমারিটাই ছিলো।
হ্যাঁ যেটা বলছিলাম। আলোর অন্যরকম রং। লাল নয়, সাদা নয়, 'রোজে'ও নয়, তবু বড্ড নেশা হয়ে যায় আলোটায়। আচ্ছা এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে নেশাটা কি জিনিষ আসলে? যার ঘোরে অন্যরকম সব দেখা যায়, না যার কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসতে হয়? প্রশ্নটা এখানে প্রাসঙ্গিক খুব। কারণ নেশা যে আমার হয়েছিলো তা খাঁটিয়া সত্যি।
বইয়ের পাতার মত হুবহু সবই যে হতে হবে তার অবশ্য মানে নেই কোনো। সেই জন্যেই এখানে আমি কোনো 'সেটার' দেখতে পাইনি,'সেন্টর'ও না। বরং অন্যরকম আলোর দিকে ফিনফিনে ডানা তুলে এক ঝাঁক প্রজাপতি যাচ্ছিলো। তবে শুনতে পেলাম স্পষ্ট। বলছিলো 'আজ লেবুফুল,লেবুফুল। এই তোরা ক্লোভারবনে যাসনে।' বলছিলো। তাদের ডানায় কালোসাদা ছকনক কাটা, ইনগ্রিড বার্গম্যানের ছবির মত। আর ফুরফুরে হলুদ শিফনবোনা ডানার ওরা খিলখিল করে হেসেই গড়িয়ে পড়ছিলো সবেতে। আমি শুনতে পেলাম। স্পষ্ট।
আরেকটু দূরে বুনো ঝোপের তলায় তিনটে মেটে রঙের খরগোশ। ওরা বলছে 'বুনোবেরীর বনে এবার মেলা হবে শুনেচিস? দিনবিদিনে, রাতবিরেতে খেলা খেলা মেলা মেলা। শুনেচিস?' অবাক লাগলো। সাদা খরগোশ হ'লে নয় তাও মেনে নেওয়া যেত। মানুষের মত কথা বলে সাদা খরগোশ, বইতে লিখেছে। কিন্তু এরা?
মখমলি মাঠে লুটোপুটি খেলছিলো ভেড়ার ছানারা। হি হি হি হো হো, এই দেখ তোর কপালে মিট্ঠি ঢুঁসো দিলাম। উ হু হু হি হি আমি তা'লে এই কালোটিপুটাকে ঠেলে ফেলে দিই? উঁউ উঁউ উঁউ ওমাআআ, দেখোনা আমাকে ফেলে দিচ্ছে এ এ। অবাক হচ্ছিলাম আমি, অচেনা এসব শব্দ এত চেনা, এত চেনা? অবাক হচ্ছিলাম না ততটা, আলমারীর ভেতর দিয়ে কোথাও গেলে এরকমই হবার কথা হয়তো।
তবু, সবকিছু অন্যরকম হয়ে যেতোনা হয়তো, সেই প্যাঁচাটার দেখা না পেলে। মস্ত উঁচু শ্যাওলা ধরা বীচ্গাছে বসেছিলো। বাদামী রঙের পালক, হলুদ বাতির মত চোখ। ফোঁপরা গাছের গায়ে খালি মাথা ঠোকে আর মাথা ঠোকে। দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এইই সে। জ্ঞানের প্যাঁচা।
-- 'শেষটা এই দরজার সন্ধান পেলে?'
কথার চারপাশে আবছা দীর্ঘশ্বাসের ছায়াছায়া দেখে একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম -- 'কেন? কি হয় তাহলে?'
-- 'কিছুই না। নিয়মটা জানো তো?
যাব্বাবা, কিসের নিয়ম, কি বৃত্তান্ত?
--'তবে কি? দাম না দিয়েই কিছু পেতে চাও নাকি? ওসব কোথাওই হয়না। শুল্ক লাগে বুঝলে? এখানে সবাইই আসেনা কেন নাহলে?'
কড়া চায়ের লিকার,একটু উনোবুনো গন্ধওয়ালা চুট্টাপাতা আর তিতকুটে বেগুনী মেশানো গন্ধ ওর সবকটা কথায়।
--' এলে যে, পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে কিনা ভেবেছিলে? যাবে। তুমি না ভাবলেও যাবে। অমনি অমনি খোলেনা দরজা। দাম লাগবে। যা তোমার নয় সেখানে কদম রেখেছো,এখন ফিরতে চাও অমনি অমনি? হা:।'
নিয়মটা বুঝে নিলাম ওর থেকে। এই দরজা খোলে শুধু তিনবার। সারা জীবনে। যতই কেন ধাক্কা মারো, চাবি ঘোরাও, তার বেশি খুলবেনা, কিছুতেই। আর যখনই দরজার মধ্যে দিয়ে পেরোবে, দরজা তোমায় পাল্টে দেবে। কি পাল্টায়, কতটা পাল্টায় তা শুধু ওর মর্জি। কারুরই জানা নেই, জ্ঞানের প্যাঁচারও নয় এমনকি। পারাণি দিতে হবেই পেরোতে গেলে। শুল্ক লাগে, শুল্ক। হা:।
বলেছিলাম তো আপনাকে, সবকিছুই একদিন পাল্টে যেতে পারে। দরজা আমায় পাল্টে দিয়েছিলো, যখন প্রথমবার খুলেছিলাম। নাহলে ঐ আঙুর রসের মত আলো এমনিই দেখতে পায়না সবাই। প্রজাপতির, খরগোশের, ভেড়ার ছানার কথা ....... এটা সত্যি সত্যি গল্পের বই নয় ভাইসাব। বাস্তব কথাটা শুধু শুধুই লেখা হয়নি অভিধানে। ওসব কক্ষণো হয়না, পাল্টে না গেলে।
তারপর চলে এলাম। চেনা। রোজরোজ যেখানে রীলের পর রীল ঘরঘর ক'রে ঘুরে চলে। নেশার মধ্যে কিম্বা বদলের মধ্যে, সব কিছু টের পাওয়া যায়না । দরজা খুলতে হয়েছিলো আবার। দ্বিতীয়বার। ওপার থেকে এপারে আসার জন্য। দরজা কি করেছিলো আমাকে জানিনি তখনি। শুধু বুকের ভেতর দিয়ে চিনচিনে একটা ছুরি চলে যাচ্ছিলো ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে। সেই আমার দ্বিতীয় বারের শুল্ক দেওয়া। দেবার সময় কিছুতেই জানা যায়না কি গেলো, কতখানি গেলো।
-------------------------------------------------------------------------------------------
আমি দেখছিলাম, মেরুন ট্রাম, একটা হলুদ ছাতা, আকাশ জুড়ে বিষ্টি, থরথর। কিন্তু তখুনি শব্দ ক'রে একটা বাজ পড়লো। সব চিরে ফেঁড়ে যায়, ছিন্নভিন্ন। ওখানে আকাশ জুড়ে বিষ্টি ছাড়া কোনোকিছু না। বাজ পড়েছিলো আগের দিনের ঠান্ডা ছুরিটার চিনচিনে আলপথ জুড়ে। আমার বুকের মধ্যে।
অমনিই হয়, যদি দেখেন বদলে গেছিলো রীলের পরে রীল।
পর্দায় হাঁটে, বসে,ঘোরে,ফেরে,কোনো মানুষ নয়। আমি দেখি ট্রামের মধ্যে ঝুলন্ত হাতল ধরে ঝিমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রোজ যে ছাই সোয়েটার তার উল ছেঁড়া ফুটো হাতার তলায় কালো থাবা। সরু বাঁকানো নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে হাতলটা। রোজের মতই ঝিমায় কিন্তু একটা লোমশ স্লথ আর ছাড়া কিছু নয়! সামনের সীটে বসা ছটফটে খলবলে মেয়ে দুটোর গল্প রোজ খিলখিলে হয়ে ছড়িয়ে যায় চারদিকে। গেছিলো আজও। ওদের একজনের গোলাপী ফুলফুল জামার থেকে বেরিয়ে আসা লম্বা হিলহিলে গোলাপী গলা, বাঁকা ঠোঁট। ফ্লেমিংগো! অন্যজন থপথপে ধূসর, মস্ত হাঁ মুখ খোলে বন্ধ করে বারবার। জলহস্তী! কোকো শ্যানেল, লুই ভিত্তোঁ, ক্রিশ্চিয়ান দিওরে ল্যাপ্টানো ওরা; একজনের গোলাপী হিলহিলে গলা। একজনের মস্ত হাঁ মুখ।
আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে হলুদ ছাতার দিকে দেখি; চেনা জিনিষ খুঁজতে। টিপটিপে বিষ্টির মধ্যে ছাতা সামলে দৌড়ে রাস্তা পেরোয়, তার লম্বাটে মুখ চোখে পড়ে। কানদুটো ছটফট করে একটু, কালো চোখ তুলে এদিক ওদিক দেখে নেয় ক্রসওয়াকে। একটা ইম্পালা। ছাতার সাথে ম্যাচ ক'রে পরে ও রোজ কিছু না কিছু। হলুদ মোটা বালাটা দেখতে পেলাম এক ঝলক,ডান হাতে, আর খুর। জোর বিষ্টি ঝেঁপে আসে, আবছা কাঁচের ওপাশে জোরে ওয়াইপার চালিয়ে ঘড়ি দেখে নেভি নীল স্যুট পরা লোকটা। ওর চোখ দুটো পাটকিলে,ধক্ধক করে আগুনের মত। ওর হলুদ মুখে কালো কালো ফোঁটা। বাজ পড়ে খুব জোরে শব্দ করে ; তখনই।
দূরে ঝাপসা বৃষ্টির মধ্যে ল্যাম্পপোস্টের লম্বা খুঁটি মাস্তুল তুলে দাঁড়িয়েছিলো। তার টং এ হাড় আর মুন্ডু দেওয়া কালো পতাকার বদলে 'সে' বসেছিলো। খালি মাথা ঠোকে আর মাথা ঠোকে খুঁটিটায়। জ্ঞানের প্যাঁচা।
--'পর্দাতে যা দেখায় সবটাই স্বপ্ন নয়, বুঝলে? পর্দা বেড়ে উঠে কখনো চারদিক ঘিরে নেয়। বুঝলে?'
বুঝেছিলাম। পর্দা বেড়ে উঠে ঘিরে নেয় চারদিক। একে আপনি বাচ্চাদের পার্কের চারমাত্রিক সিনেমার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না।
---------------------------------------------------------------------------------------------
একটা ক্লান্ত এলোমেলো দিন আস্তে আস্তে ওর ভিজে গায়ে নীল অন্ধকার জড়িয়ে নিচ্ছিলো। ক্লান্ত এলোমেলো ওর ভিজে চুলের মধ্যে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। কাল যে রাস্তা দিয়ে ছুরিটা গেছে সেইখানে খুব ফাঁকা লাগছিলো। অতল একটা ফাঁকা।
একটা বাজনা শুনতে পেলাম। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে , সিকিখোলা চানের ঘরের দরজার ওপারে। আনিয়া এসে গেছে তার মানে। আ:,ভালো লাগে।
আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। আনিয়া এসে গেছে। একটুকরো চানঘরে ফিকে বেগুনী বাষ্প স্বপ্নের মত ছেয়ে আছে। মোটা মোমবাতি, ক্যামোমাইল আর অরেঞ্জ ব্লসমের গন্ধ। ছোটছোট উইস্টিরিয়া আঁকা শাওয়ার কার্টেনের ওপাশে চানের টবে প্রচুর ফেনা। নরম গলায় বাজনা কথা বলে। আনিয়া। ভালো লাগে। ক্লান্ত এলোমেলো ভিজে নীল দিনের শেষে আমার ভালো লাগে।
আমার আসার সাড়া পেয়েছিলো হয়তো। আনিয়া এক হাতে পর্দা সরায়। ফিকে বেগুনী ফেনা ভর্তি চানের টব থেকে ওর একটা পা বাইরে বার করে।
কালো লোমশ পা। বিশাল। উইস্টিরিয়া আঁকা পর্দা ধরে আছে; কালো লোমশ পা। বিশাল। আরো ছ'টা তাড়াহুড়ো করে। ও টব থেকে উঠে আসতে চায়। ব্ল্যাক উইডো। আনিয়া !!!
আমার ঠিক সামনে চানঘরের বিশাল আয়নায় বাষ্প জমেছিলো। বাষ্পের ঝাপসা পর্দার পেছনে আমার ছায়া। আমি। আমি!! ঝাপসা। বাষ্প মুছতে সাহস হয়না। আনিয়া তাড়াতাড়ি টব থেকে উঠে আসতে চাইছিলো। রোজ ঠিক এই সময়ে একটা মৃদু নরম ওম এর মধ্যে আমি মিশে যাই। আজই বা অন্যথা হবে কেন?
আমি পালাতে থাকি, পালাতে চাই। আনিয়ার কাছ থেকে, আয়নার কাছ থেকে। আমার সামনে আলমারী। তার অন্ধকার ভেতরে আস্তে আস্তে একটা দরজা ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত রঙের আলো ওপাশটায়। দরজা খুলছে, এই নিয়ে তিনবার, শেষবার। ওর মধ্যে দিয়ে ওপারে চলে গেলেই ও বদলে দেবে আমাকে। বদল; কিভাবে? কিভাবে? কতখানি? এই নিয়ে তিনবার। শেষবার। তারপর,যতই কেন ফিরতে চাও,ধাক্কা মারো, চাবি ঘোরাও, আর খুলবেনা, কিছুতেই।
হা:।
পেছনে আটটা লোমশ কিলবিলে পায়ের তড়িঘড়ি শব্দ হয়। দরজাটা আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে।
দীমু | 182.69.***.*** | ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ০১:২০526165
kk | 2607:fb91:4c21:664d:48d9:f8f3:9ce1:***:*** | ০৭ নভেম্বর ২০২৫ ২০:৪০735596