

সব প্রাচীন অরণ্যের ভিতরে আর একটি অরণ্য থাকে। তার রকম-সকম, তার হাওয়া-বাতাস, এমনকি গাছপালা, প্রাণী, সব আলাদা। সেথায় যদি একটি বার ঢুক্যে পড়, তাইলে যতখন না উখান থিকে বাইর হবে, ততখন তুমি একটা অন্য জীব হে! বাইরের জঙ্গল আর তার পেটের ভেতর লুকায়ে থাকা আর একটা জঙ্গল, এই দুইয়ের মধ্যে যাওয়া আসাই বনবাসী মানুষকে বাঁইচে থাকার অমৃত যোগায়, কুসুমপাতের মতোই লইতন রঙ ধরায়।
কচি রাঁড় ফুলমণি মৃত স্বামীর শোক ভোলার জন্যই কী না কে জানে, বসন্তকালের নতুন লাল পাতায় ছাওয়া কুসুম গাছের তলায় ঢুলতে ঢুলতে এইসব সাত পাঁচ ভাবছিলো।
মাঝে মাঝে সেই গুপ্ত অরণ্যের ঝলক দেখা যায় কোনো শুঁড়িপথের শেষে বা কাচপানা জলের ওপর। যে রাস্তাটা এই শেষ হলো তারপর যেন বেবাকই নতুন। নতুন গাছপালা, নতুন পাখির গান, এমনকি নতুন জীবজন্তুরও দেখা মিলতে পারে। দেখার চোখ থাকলে দেইখতে পাবে এপাশের ঘাসের রঙের সঙ্গে ওপাশের ঘাসের রঙেরও বেজায় ফারাক। আর জলের দিকে যদি তাকাও তো যে আকাশ, যে গাছপালার ছায়া দেইখবে তার সঙ্গে আসলের কিছু মিলবে না। সব লইতুন। যেন ধরিত্রীমাইয়ের পেটের ভিতর লইতুন ছা একখান।
এইসব অনেক দিন ধরে মিলিয়ে দেখে দেখে তবে ফুলমণি বুঝেছে মানুষের মতোই জঙ্গলের রূপের কোনো ঠিক নাই। সে খালি পালটায়। ঠা ঠা রোদ্দুরে সে একরকম, তো কালো মেঘের নিচে একেবারেই অন্যরকম। রহস্যময়, গহন। আবার শীতের ভোর ভোর খেতখামার, চাষের মাঠে মাকড়সার জালে বিন্দু বিন্দু শিশির আটকা পড়লে জঙ্গল বড় শান্ত, যেন মাহাতো বাড়ির বিয়ার যুগ্যি বড় মেয়েটা।
তবে এইবার তাকে উঠতে হবে। শালপাতা কুড়িয়ে, বনের সবুজ মেঝে জুড়ে সাদা বোতামের মত ছাতু কুড়িয়ে ক্লান্ত লাগায় সে বড় পাথরখানার ওপর বসেছিল বটে, কিন্তু হুঁশ আছে, সাত আট হাত দূরেই পাথর ঘেরা জলের যে ছোট 'ডোভা' সেখানে রোজ হাতি জল খেতে আসে। আজও খুব ভোর ভোর এসেছিল হয়ত, রাস্তায় তাকালেই দেখা যাচ্ছে তাদের মস্ত মস্ত নাদা ছেতরে পড়ে আছে। তা সারাদিন বনে বনে ঘুইরে ফিরে উয়াদেরও তো ছাতি ফাটে। তাই সানঝের বেলা কখুনো ডোভার ধারে লয়। ফুলমণি গামছা পাকায় মাথায়। শালের বোঝা মাথার বস্তায় আর পেটকোঁচড়ে বোতামের মত ছাতু নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেই হয় এখুন।
উঠে দাঁড়িয়েছে সে, সামনের বড় পাথরটার আড়ালে কী যেন সাঁত করে সরে গেল! এ তল্লাটে ঢোল বা বুনো কুত্তার কথা কানে এসেছে তার, সত্যিমিথ্যা জানা নাই। আগে তো ঢোলের ভয়ে সন্ধের পর বেরোনো মানা ছিল, দিনে দিনেও মহুলের ফুল কুড়োতে গ্রামের সীমানা থেকে বেশী দূর যাওয়া যেত না। তবে জঙ্গল যতো পাতলা হয়েছে,ঢোলের দেখা পাওয়া ততো কঠিন হয়েছে। এই মাসখানেক আগে নাকি গ্রাম থেকে একটু দূরে, জঙ্গলের সীমানায় একটা পোষা ছাগলকে এমন করে খেয়েছে যে তার হাড় কখানা ছাড়া আর কিছু পড়ে নেই। মাথার শিঙে আলতা ছুপানো ছিল, মালিক তাই দেখে চিনেছে।
ঢোল জ্যান্ত জীব পেলে ছাড়ে না। দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একা গজরাজও তাদের কাছে অসহায়। লোমহীন লেজের মাথায় একটু পুচ্ছ আর শেয়ালের মত লম্বাটে ধূর্ত মুখ, ফুলমণি যেন নিজের চারদিকে অজস্র বুনো কুকুরের দৌড়োদৌড়ির আওয়াজ পায়, লোভার্ত চোয়াল থেকে ছিটকে আসা লালাবিন্দু যেন তার পায়ের পাতার ওপর এসে পড়ে। ঠিক সেইখানে যেখানে বনসহায়ক নৃপেন সেদিন চুমু খেয়েছিল।
মনে পড়তেই লাফিয়ে ওঠে ফুলমণি। এই আমলকি বহেড়া আর শালের জঙ্গলে এখন সে সম্পূর্ণ একা। ঢোল যদি আক্রমণ করে বা নেপু সেদিনের মতো ভটভটি লিয়ে চলে আসে! সামনের রাস্তায় হাতির জল খাবার ডোবা। তার চারদিকে ছোট বড় কালো পাথর দিগন্ত অব্দি ছাওয়া,কোনটার পিছনে কি লুকায়ে আছে বোঝার উপায় নাই একেবারে। তার পেছনে ড্যামের দিক থেকে আসা কুলকুল বাতাস মহুল ফুলের গন্ধ মাখিয়ে দিচ্ছিল সবকিছুতে ,কিন্তু ফুলমণির কপালে ঘাম। সে নিজেই নিজেকে বিড়বিড় ক'রে বলে, হাতটা উঠাই ঘামটা মুছার মতোও শরীলটাতে সাড় নাই হে।
সব মানুষের মতোই অসাড় শরীরে ছোটার বেগ আনতে ফুলমণির সময় লাগে। সময় লাগে শালপাতার বোঝা ফেলেই তীরবেগে দৌড়তে শুরু করবে কিনা ভাবতে। সেই ফাঁকে বড় পাথরের আড়াল থেকে বার হয়ে আসে একখান খেড়া, এ তল্লাটের বড় ধুসর খরগোশ। পূর্ণবয়স্কদের ওজন তিন থেকে পাঁচ কেজি তো হবেই। কিন্তু এদের দেখা পাওয়া দেখা পাওয়া খুব কঠিন। তবু উপেন বাঁচ্যে থাইকতে কতো যে খেড়া মাইরেছে তারা। সেবার সাপের উপদ্রব লাগামছাড়া হলে ফুলডুংরির নরেন হাঁসদার এনজিও ধরতী মার্শাল সোসাইটি তাদের গ্রামে বড় টর্চ বিলি করেছিল। ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে দু তিন বার নতুন দিয়ে গেছিল তাদের লোক এসে। গোটা বর্ষাকাল।
ফুলমণির চোখে ফিরে আসে সেই তুমুল বর্ষার রাত, খালি লেঙ্গট পরণে ঝুপুস ভিজা আদুল গায়ে তার আগে আগে উপেন চলে, হাতে তির ধনুক। ফুলমণির কোঁকড়া চুলের খোঁপা বেয়ে জল নামছে, কালো চট্টানের মতো পিঠে আঁকাবাঁকা ধারা। কিন্তু নড়াচড়ার উপায় নাই, তার হাতে বড় টর্চ আর তারা দাঁড়িয়ে আছে ধানখেতের আলের ওপর কোনাকুনি জায়গায়। বর্ষার জলধারা আর অন্ধকারের মধ্যে মিশে যাওয়া যেন দুই অশরীরী আত্মা, কেউ দেইখলে পিশাচ ভাইবে চইমকে উঠবেক।
ধানখেতের কচি সবুজ ঘাস খেড়ার বড় প্রিয় খাবার। সেই টানে বৃষ্টি একটু কমে গেলেই গুহা গর্ত ছেড়ে দলে দলে বেরিয়ে আসবে এই ভীতু প্রাণীগুলো। অনবরত মুখ নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক হয়ে কেউ যদি উপেনের তিরের পাল্লায় চলে আসে,তাহলে তক্ষুণি জ্বলে উঠবে ফুলমণির হাতের তীব্র টর্চ। আলো ফেলতে হবে খেড়ার মার্বেলের মত চোখজোড়ার ঠিক উপরে। ভ্যাবাচাকা খেড়া লাফায় পালাবার আগেই শনশনায় ছুটবেক উপেনের তির। ধুপ। জোরে লাফ দিয়েই কাদার ওপর নেমে আসবে খেরার ভারি দেহটা। লেজটা তখনো কাঁপবে তিরতির।
শহরে খাটতে যাবার আগে খেতের কাদা নদীর জলে ধুয়ে হাঁড়িয়া নিয়ে বসা উপেন জঙ্গলের নানা গল্প বলতো, খেড়ার কথাও বলেছিল একদিন। জ্যান্ত প্রাণীটাকে ধরা নাকি খুব কঠিন কাজ। এমনকি ফাঁদে পড়লেও সে ধরা দিবে না। মুক্ত হবার জন্য ছটফট করে মাথা ঠুকতে থাকবে, এমন ঠোকানি যে দরদর রক্ত বইয়ে নিজেই মারা পড়বে ! এমন ছটফটানি যে জালের সুতোতে ফাঁস আটকে নিজের শ্বাস নিজেই রুখবে! তবু কারো কাছে ধরা দেবে না।
এই খেড়া থেকেই উপেন ফুলমণিদের জাতনাম নাকি খেড়িয়া।
পাথরের পেছনে লুকানো প্রাণীটি খেড়া জেনে চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ে ফুলমণি,অ মাই গ্য। ঢোল হলে আজ কী কাণ্ডটাই না হতো! বস্তা মাথায় নিয়ে পড়ে থাকা শুকনো শালপাতা পায়ে দুমড়ে মুচড়ে সে গাঁয়ের দিকে হাঁটবে এখন। দুলে দুলে দৌড়বার মতো সে হাঁটা। সারা শরীর নড়বে তালে তালে। উপেন মরার পর ঘরে কেউ নাই, তবু তাড়া লাগে তার। ঝুপ্পুস আঁন্ধার নামার আগে ঘর পৌঁছে হ্যারিকেনখানা জ্বালাতে পারলে কি এক স্বস্তি যেন। বেশি রাত হলে অবশ্য সেই স্বস্তি কমতে কমতে শুন্য হয়ে যায়। শেয়ালের ডাক আর্তনাদের মত শোনায়, ছায়া ছায়া কে যেন দাওয়ার ওপর উঠে বসে থাকে,ঘরের লাগোয়া ঝোপে অদ্ভুত আওয়াজে সে মাচার উপর উঠে বসে, ছটফট করে যতখন না আবার দূর পাহাড়ের মাথা ফাটিয়ে অগ্নিগোলোকটি রোজ নতুন বাচ্চার মত ভূমিষ্ঠ হয়। শহর থেকে জ্বর নিয়ে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিক স্বামীকে শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে করতে মরতে দেখা ফুলমণির ভোর ভোর পাখির ডাক শুনলে মনে হয় আর একটা দিন বাঁচার মেয়াদ বাড়ল।
দুদিন আগের ঘটনা। পথ যেখানে তিনদিকে বেঁকে গেছে,একদিকে গ্রাম, উল্টোদিকে ড্যাম, আর একদিক গেছে জঙ্গলপানে, ঠিক সেইখানে, আর একটু গেলেই ফুলমণি যখন বাঁদিকে বেঁকে গ্রামের রাস্তা ধরবে, ঠিক সেইসময় তার কানে আসে মটর সাইকেল ভটভটির আওয়াজ। তার গ্রামে ঐ একজনেরই ভটভটি আছে, সে হল বনসহায়ক নেপু ওরফে নৃপেন। শোনা যায় বাপের জমি বিক্রির এক লক্ষ টাকা খরচ করে সে চাকরিটা বাগিয়েছে। শ্বশুরের টাকায় মটর সাইকেল কিনেছে। এখন মহা প্রতাপ তার, ভাবখানা যেন গোটা জঙ্গলের মালিক। সল্ট পিটে নুন ফেলে আসা, হাতি খেদানোয় সহায়তা করা, পোচারদের খবর রেঞ্জ অফিসে পৌঁছানো সবেতেই সে আছে। বছর বছর নতুন করে মেয়াদ বাড়ে যে চাকরির তা টিকিয়ে রাখতে হলে যে ধূর্ততা দরকার তার সবটুকুই আয়ত্ত করার ফলে তার চোখ এখন খুব উজ্জ্বল আর সারা শরীরে মাখোমাখো নিজের ওপর বিশ্বাস। সে চাইলেও উপেনের অসহায় রাঁড় এতো নির্লিপ্ত থাকতে পারছে এটা তার কাছে খুবই অবিশ্বাস্য এবং অস্বাভাবিক ব্যাপার। এই কারণে তার আহত জেদ এখন বহেড়া গাছের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে।
সে যাচ্ছিল ড্যামের দিকে, ফুলমণিকে দেখে বাইক ঘুরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। চাকা হঠাৎ ঘোরানোর ফলে পেছনে সাদা ধুলো ওড়ে।
- কুথায় গিইছিলি ?
মাথার ওপরের শালপাতার ঝোঁকা থেকে চোখ নামাতে নামাতে সে মেয়েটার সারা শরীর মেপে নেয়। অনেক দিন থেকেই মাপাজোখা চলছে, কিন্তু সুবিধে হয়নি। সেদিন সকালে উঠেই আকণ্ঠ চাপানো হাড়িয়ার ঝোঁকে বনের মধ্যে ছাতু-কুড়োনো মেয়েটার পা জড়িয়ে ধরেছিল সে। পুরুষ্টু পায়ের পাতায় গরম ঠোঁট চেপে ধরেছিল একা পেয়ে, কিন্তু মেয়েটা বুনো খরগোসের মতোই এক হাত লাফিয়ে উঠে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। আজ শুনশান বুনো রাস্তায় তাকে একা পেয়ে নেপু যেন হাতে চাঁদ পায়। কালো চকচকে জুতোপরা বাঁ পা বাইকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নামায়, তারপর পথ আটকে সিটে ঠ্যাসান দেয়। এখন মেয়েটাকে চমকাবে সে।
-- উপেন তো তিনদিনের জ্বরে মইরল, সিটাও দিন পনরোর কথা। সবাই বলাবলি কইরছে দ্যাশে নাকি মড়ক লাইগেছে। সাবনে হাত ধুও, মুখে কাপড় বাঁধো, নাইহলে পুলিশ ধইরবেক।
তা তর ঘরেই তো পত্থম মরাটা মইরল। তকে তো হাস্পাতালে দেখাতে হবেক। তর ঘর থিকা গটা গাঁয়ে রোগ ছড়াইছে, তার দায় কে নিবেক?
ফুলমণি নিজের পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন পাথরের মূর্তি। এমনিতেই সে শান্ত, মুখচোরা, এখন এই মহা দুর্দৈবে সে যেন মরেই গেছে। নেহাত পনের দিন কেন দুদিনও না খেয়ে থাকা যায় না, তাই তাকে রোজ শালপাত কুড়োতে যেতে হয়, হাটে বিক্রি করে খুচরো পয়সাও গুনতে হয়। তার মরা মাছের মতো চোখ দেখতে দেখতে মহাবিরক্ত লাগে নেপুর, ভোদাই মেয়েছেলে একটা! ঠান্ডা, দেমাকি আর বোবা। হুকুম করার মত ভঙ্গিতে সে শেষ কথা শোনায়,
- দুই দিন পর রাইতে ওষুধপতর সব ঘরে পঁহুচে যাবেক। সিদিন অনেকখন কপাট ঠকঠকাইলাম, তুই খুললি নাই। গটা গেরাম জানইলে তর কি ভাল হবেক্? লে,এই মোবাইলটা রাখ।
নেপু পকেট থেকে বার করে ছোট বাড়তি মোবাইলটা ফুলমণির হাতে গুঁজে দেয়।
- ইটা বাজলেই কপাট খুলে দিবি। পরে কুনদিন তুকে আমার মটর সাইকেলে চাপায় হাসপাতালে লিয়ে যাতে হবেক। আগে মাক্স আর সাবনটা পঁহচাই দি।
আজ এই নির্জন বনের ভিতরে খেড়া দেখবার পরমুহূর্তে আচমকা পেটকোচড়ে সেই মোবাইল চিৎকার করে উঠলে ফুলমণি আর একবার খাবি খায়। শুকনো পাতার ওপর ভয় পাওয়া খেড়ার ছুটে পালাবার খচমচ শব্দ শোনে সে, আহা ভিতু প্রাণী, এই বিকট আওয়াজে ভয় তো পাবেই। ফুলমণি শহর থেকে মাঝে মধ্যে ফেরা উপেনের মোবাইলও হাতে ধরেনি কখনো, কিন্তু নেপুর এটাকে খালি ভাঙা ঘরে ফেলে আসে কী করে, তাই পেট কোঁচড়ে পুরে জঙ্গলে নিয়ে এসেছে। এটা বাজবার কথা তো আজ রাত্রে, কী করে সেই ভবিতব্য এড়ানো যাবে, ফুলমণি অনেক ভেবেও তা ঠিক করতে পারেনি। একবার ভেবেছে গাঁও বুড়ার কাছে গিয়ে সবকথা বলে, আবার ভেবেছে তাতে তাকে গ্রামছাড়া হতে পারে। পনের দিন আগে কুটিরসংলগ্ন অল্প জমিওয়ালা যে মেয়ের স্বামী মরেছে, আর তারপরেই গ্রামে এই অজানা জ্বর এবং মৃত্যু, নেপু ইচ্ছে করলে তাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে জানে মারিয়ে দিতে পারে, রাঢ়দেশের সব একা ভূমিপুত্রীর মতো শান্ত নির্বিরোধী ফুলমণিরও এই জ্ঞান আছে।
তাই মোবাইল যতোক্ষণ বাজে, পেটের ওপর হাত রেখে কুসুম গাছের নিচে ফুলমণি ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়েই থাকে। দুএকবার আঁচলের গিঁট আলগা করে। কিন্তু ফোনটি হাতে নেবার সাহস হয় না। অনেকবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজে চটুল হিন্দি গানের কলি। তারপর দ্বিগুণ ঝাঁপিয়ে ফিরে আসে বনের নৈঃশব্দ্য, সেহরি গাছের পাতা ঝরার টুপটাপ, পাখির ডাক, হাওয়ার সনসন। হাত পা ধোবার জন্য হাতি-ডোবার দিকে এগিয়ে যায় অন্যমনস্ক ফুলমণি। পায়ের গোছ জলে ডুবিয়ে সে আঁজলায় জল তুলে কানে গলায় মাখে। ভেতরের প্রাণীটি যেন একটু ঠান্ডা হয়। চাঁদিতে জল থাবড়িয়ে মাথাটা হালকা হলে সে এবার জল খাবার জন্য নিচু হয়, আর তখনই আরেকবার তারস্বরে বেজে ওঠে মোবাইল, ফুলমণি লাফিয়ে ওঠে, তার কোঁচড় আলগা হয়ে জলে পড়ে যায় সেটা। পড়েই প্রথমে ঠোকর খায় ছোট একটা পাথরে, তারপর একটা লাট্টুর মতো পাঁক খেতে খেতে গিয়ে পড়ে বেশি জলে। জল এখানে স্বচ্ছ, একহাত নিচেও কাকের চোখের মতো। কিন্তু এতোটাই গভীরে চলে গেছে সেটা যে ফুলমণি দেখতে পায় না। কিন্তু আশ্চর্য, তখনও ওপর ভেসে আসছে আওয়াজ, সেই গানের না বোঝা বুলি। যেন তলিয়ে যাবার জন্য ফুলমণিকে ডাকছে তার ভবিতব্য।
হয়ত কোনো ডুবো পাথরের খাঁজে আটকে গেছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে জলে নামে সে, শব্দ আন্দাজে কোমর জলে পা দিয়ে গুঁতায়, ডুব সাঁতার কেটে চোখ বড় বড় করে। নুয়ে পড়ে আধডোবা পাথরের নিচে, যেন সে নিজেই ডোবার পাড়-ঘেঁষা কোনো তেষ্টা কাতর গাছ। সবশেষে যখন উঠে আসে ফুলমণি, তখন তার চোখদুটি জবা ফুলের মতো লাল, কপালে এঁকেবেঁকে সেঁটে রয়েছে অজস্র চুল, গা গতর থেকে টপ টপ করে জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে শুকনো পাথর, পাতার স্তূপ, যেখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সে।
খেরাটি যেদিকে গেছে, হতভম্বের মতো সেই শুঁড়ি পথটির দিকে তাকায় ফুলমণি। ডুবন্ত সূর্যের কমলা রঙে সব কেমন লতুন সোনার পারা হয়ে আছে। মহুল ফুলের তীব্র ভালুক-ডাকা গন্ধ, পুটুস ফুলের ঝোপে একটা বোঁটাতেই তিন চার রঙা ফুল বাতাসে মাথা দোলায়। তার গন্ধও বড় সতেজ। আর রাস্তার পাশে চিরুনি পাতার অজস্র বাঁশঝাড়। ঘন অভেদ্য। এরা যেন সব লইতুন মনে হয়, চিরকালের অদেখা। ফুলমণির হঠাত মনে হলো, যেন এই পথ ধরে গেলে সে মারি মড়ক পেরিয়ে যাবে, উপেনের শোক, নেপুর তাণ্ডব,ডাইন হয়ে খুন হবার ভয়, সব পেরিয়ে যাওয়া যাবে। জঙ্গলের পেটের ভিতরের সেই আর একটা জঙ্গল যেন বুক উদোম ক'রে খুলে দিয়েছে তার সামনে আর সমানে বলে যাচ্ছে পালায়ঁ যা ফুলমণি, পালায়ঁ যা।
কিছুটা এগোলেই তাকে লুকোবার জায়গা দেবে যেন ভাঙা মন্দির, তার উঁচু মাথায় কত না বট অশথের চারা। ছোট ছোট সাদা প্যাঁচা একটু পরেই চক্কর দিতে থাকবে চূড়োর চারপাশে। নদী দেখা দেবে কিছুটা এগোলেই, তার বুক ভর্তি পাথরে ধাক্কা খেয়ে ঢেউয়ের কী ফোঁসানি! ধারের গ্রামগুলিতে এখন বাগালেরা হেট হেট শব্দ তুলে গরুর পাল গোহালে ঢোকাচ্ছে। চৈ চৈ শব্দের পথে হাঁসেরা ঘরে ফিরছে হেলেদুলে। সেইসব পেরিয়ে নদীর ধারের উঁচু নিচু রাস্তা ধরে হাঁটো হাঁটো, যতখন না সেই রাস্তা গিয়ে ভোর ভোর শেষ হয় ফুলডুংরিতে, যেখানে নরেন হাঁসদার ধরতি মার্শাল সোসাইটির আশ্রম। একগাদা অনাথ শিশু থাকে সেখানে আর ডাইন অপবাদে ঘরছাড়া কিছু মেয়ে। নিজেরা আশ্রমের খেতে কাজ করে বাচ্চাগুলোকে বড় করবার চেষ্টা করছে তারা।
শালপাতের বস্তা কুসুম গাছের তলে পড়ে থাকে যেমন তেমন। মড়ক পার হবে বলে ভর সন্ধের মুখে উপেনের কচি রাঁড় ফুলমণি নিজের কুঁড়েঘর আর এক চিলতে জমির মায়া কাটিয়ে ভেজা কাপড়েই হারা উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়।
স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২১ মে ২০২১ ১৮:২৮106235সব মেয়েদেরই যদি ধরতি মার্শাল সোসাইটির আশ্রয় জুটত! সব মোবাইল হারিয়ে যাক।
প্রজ্ঞাপারমিতা | 2402:3a80:a6f:ea46:cf00:d649:55f6:***:*** | ২১ মে ২০২১ ১৯:০৭106236মানুষের বেঁচে থাকার অন্য রূপ যখন লেখায় আপনি নিয়ে আসেন তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
ভাল থাকুক ফুলমতী। বেঁচে থাকুক খেড়রা।
জয়ন্ত সেনগুপ্ত | 2401:4900:3996:8f16:1:1:44a0:***:*** | ২১ মে ২০২১ ২০:০৩106242অপূর্ব বর্ণনা৷ চোখের সামনে ভাসছে পুরো দৃশ্যপট আর খেড়িয়া মেয়েটির অসহায় জীবনযুদ্ধের কাহিনী৷ খুব ভালো লাগলো লেখাটি
ব্রততী চৌধুরী | 2402:3a80:a74:8f0e:111a:928d:9f56:***:*** | ২১ মে ২০২১ ২০:১৮106245অপূর্ব! আমার মহাশ্বেতা দেবী কে মনে পড়ল।
চিরন্তন। ভালোবাসার গল্প
নৈশন্তি | 103.2.***.*** | ২১ মে ২০২১ ২২:০৭106254অসাধারণ সুন্দর একটা লেখা। জঙ্গলকে অন্তর থেকে না চিনলে এমন বর্ণন করা যায় না।
সুজাতা গাঙ্গুলী | 2401:4900:36b7:9f85:2770:bffa:13b7:***:*** | ২২ মে ২০২১ ০৬:৩৪106264অপূর্ব লেখা !
Aranya | 73.197.***.*** | ২২ মে ২০২১ ০৭:২৭106265অসাধারণ
সুদেষ্ণা | 2409:4061:9:bcc1::4a9:***:*** | ২২ মে ২০২১ ০৯:০৩106268শব্দগুলো যেন ফুলমণির গায়ের সাথে,গাছের পাতার সাথে,খেড়ার রূপকের সাথে শ্যামলাভঙ্গীতে লেপ্টে রয়েছে।প্রতিটি শব্দ অনিবার্য। দারুণ!
kk | 97.9.***.*** | ২২ মে ২০২১ ০৯:২৬106270ভালো লাগলো খুবই। শেষ লাইনে বোধহয় টাইপোর ফলে ফুলমণির বদলে ফুলমতি হয়ে গেছে?
অচিন্ত্যা | 45.25.***.*** | ২২ মে ২০২১ ১৩:৪০106278অসম্ভব করুণ হলেও লেখার প্রতিটি আঁক-বাঁক অদ্ভুত মাধুর্যে ভরা...
অর্পন বোস | 2409:4060:2e14:4fa0:90d0:ba8e:fca1:***:*** | ২২ মে ২০২১ ১৪:২০106280আপনার মনের কোনে একটা অদ্ভুত মানবিক মুখের ছবি সব সময় বেরিয়ে আসে আপনার অসামান্য শব্দ চয়ন ও গল্প বলার খুব সুন্দর কলমকারীতে। মগজ ও হাতের এমন যুগলবন্দীই এমন লেখা লিখতে পারে। একটা ছায়াছবি হয়ে রইল ফুলমনির গল্প।
Maria Koel | ২২ মে ২০২১ ১৬:০৭106284তোমার লেখা কেন যে পড়ি আর কী যে পাই - নতুন করে প্রকাশের অপেক্ষা রাখে না প্রতিভা দি।
কেন জানি না ফুলমণিকে দেখতে দেখতে 'খোয়াবনামা'র কুলসুম কে এক ঝলক দেখে ফেললাম! যখন পড়েছিলাম, তখন কুলসুমের অন্ধকারে তমিজের মরা বাপের সঙ্গে কথা বলা মুখটা, কালাম মাঝির ধস্তাধস্তির মাঝে কেরামত আলীর ঝাঁপিয়ে পড়া আর বুঝে ওঠার আগেই হুট করে তার প্রাণটা চলে যাওয়া - মুখটা, বারবার আমার সামনে ঘুরেফিরে চলে আসত।
কোথাও কোনো মিল নেই অথবা আছে। কি জানি! কেন মনে পড়ল!
গোপা বোস | 2409:4060:2118:8ade::1765:***:*** | ২২ মে ২০২১ ১৭:১৭106286চোখের সামনে ভেসে ওঠে জঙ্গল আর জীবন....
খুব বাস্তব। কত যে সমস্যা জঙ্গলের। জঙ্গলের মানুষের। জায়গাটা খুব চেনা। কিছু ইঙ্গিত তো আছেই।
*বোতামের মতো দেখতে একধরনের মাশরুম, জঙ্গলমহলে বনের আনাচে কানাচে ফুটে থাকে, তাকেই স্থানীয়রা ছাতু বলে।— আপনি সম্ভত কাড়ান ছাতুর কথা বলছেন।
ভালবাসলে মানুষ মরে যায়। ফুলমনির কেবলই আছড়ে পিছরে জংগল হাতড়ে বেড়ায়।
সান্তালি বাংলা উচ্চারণের লেখনি শৈলীতে প্রতিভা দি এখন অনেক শাণিত। বন প্রকৃতির বর্ননা মোহাবিষ্ট করে।
ব্রাভো, প্রিয় লেখক
* "সান্তালি" নয় = "খেড়িয়া" হবে।
দেববর্ণা সরকার | 106.214.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ১০:৫৭106339অসাধারণ লেখা।ফুলমনির জীবনযুদ্ধের কাহিনীর অপূর্ব বর্ণনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। দারুন লাগলো পড়ে।
গার্গী হাজরা | 2409:4060:40c:785b::1522:***:*** | ২৪ মে ২০২১ ১২:৩৮106390অসাধারণ লেখা।ফুলমতির জীবনযুদ্ধের কাহিনী জঙ্গলের ভিতর আর এক জঙ্গল কে দেখার ইচ্ছে বাড়িয়ে দিল।লেখিকাকে ধন্যবাদ।
সবাইকে মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই। গল্পে মান্য বাংলা ছাড়া অনেকখানে রাঢ় বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে। সাঁওতালি বা খেড়িয়া নয়। জঙ্গল মহলের অধিবাসী তপন মাহাতো এবং নরেন হাঁসদার কাছে এই সুমধুর ভাষাটি শেখার প্রাণপণ চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।
দীপক দাস মশাই ধরেছেন ঠিক। জায়গাটা অনেকের কাছে চেনা। মানুষগুলোও। বাস্তবই বিষয়। করোনা পেরিয়ে জঙ্গল আবার ডাক দেবে আশা করি।
কাড়ান ছাতু বললেই ঠিক হতো।
লেখকের কোনো লেখায় ভালো মন্দ মন্তব্য করি না। করা যায় না। এতো গল্প নয় সেই অর্থে- পরিব্রাজকের চোখে ধরা এক ফালি জীবন।
জীবনের জয় হোক।
রঘু জাগুলীয়া | 2401:4900:104a:40a:38eb:eef1:cc03:***:*** | ২৪ মে ২০২১ ১৮:৪৭106400"পাউরুটি" অভিষেক ঝাঁর লেখা পড়েছিলাম তিন-চার মাস আগে। তারপর কয়েকদিন আগে "মতিলাল পাদরী"। আজ আবার "খেড়া" পড়ে কেঁপে উঠল ভিতরটা দিদি।
একটা প্রাণীর জীবন দিয়ে উপেনের মতন সবার জীবন মহামারীতে কেমন অতিবাহিত হলো এইটা দেখানো। পরে ফুলমণি চরিত্রটাকে নেপুর মতন বদমাইশের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলা। সমগ্র বুনো জঙ্গলের যে ভয়ার্তরূপ। মোবাইল জলের নীচে নিয়ে গিয়ে, যে অসম্ভব ইমেজারী যৌণতার। এবং আগাগোড়াই গল্পটা একটা অসহায়তার রূপ। জঙ্গলের রঙের মতনই ক্ষণে ক্ষণে তো বদলায় আমাদেরো জীবন, জীবনের চারপাশ।
আর আগাগোড়াই একটা রঙ পেলাম। রঙের ছটা। ঐ যে খোকাসূর্য র জন্ম হলো। তাছাড়া যখনই বেহেড়া গাছ বলছো বা আমলকি ইত্যাদি বা ফুলডুংরী। ঐ রঙ মাথার মধ্যে গড়িয়ে পড়ছে।
এরকম গাছপালাময় লেখা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে দিদি। আরো লিখবে তুমি। অন্তত আমাদের জন্য।
শামীম আহমেদ | 2405:201:a803:9098:2199:8873:cb2b:***:*** | ২৮ মে ২০২১ ০৫:০৪106494ছবির মত সুন্দর গল্প। সেইসঙ্গে রয়েছে টানটান উত্তেজনা, এইসময়ের উদ্বেগ জাদুর মত মিলেমিশে। ঈদের এই উপহারটি খুব ভাল লাগল। ভালবাসা নিও ❤️
দীপক দাস | 103.3.***.*** | ০১ জুন ২০২১ ১২:৩৯106697লেখিকা দিদি উত্তর পেয়ে আপ্লুত। আসলে গল্পের প্রেক্ষাপট যে নানা কারণেই চেনা। খবর যে আসে পাতা খসানোর সময়। নবপল্লবের। কুরকুটের মহাজন আর মকর পরবের। কিছুটা ঘুরে ঘুরে দেখাও। অন্ধকার পেরিয়ে অনুজ্জ্বল আলোর দুর্গাপুজো। কাঠ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা বালিকার দল। আরও অনেক কিছু।
অতিমারিতে আমরাও আটকে গেছি। দুয়ার খুললেই পা বাড়াব। একটা গ্রামের সন্ধান পেয়েছি। যে গ্রামে ঘর ঘর কাঠের পুতুল তৈরি হয়। যাব। আবার বেরোব। আপনি এরকম গল্প আবার উপহার দেবেন।
সায়ন্তনী বসু চৌধুরী | 103.224.***.*** | ১৪ জুন ২০২১ ১৭:৩০494939অসাধারণ গল্প।