এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • সার্ধশতবর্ষে গান্ধী : একটি পুনর্মূল্যায়নের (অপ?) প্রয়াস

    এবড়োখেবড়ো লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০১ অক্টোবর ২০১৯ | ২০৬১৭ বার পঠিত
  • [কথামুখ — প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমার ইতিহাসের প্রথাগত পাঠ মাধ্যমিক অবধি। তবুও অ্যাকাডেমিক পরিসরের বাইরে নিছকই কৌতূহল থেকে গান্ধী বিষয়ক লেখাপত্তর পড়তে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অবিসংবাদী নেতাটি সম্পর্কে যে ধারণা লাভ করেছি আমি, তা আর পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকেই এই দুরূহ কাজে হাত দেওয়া।

    মূল লেখা শুরু করার আগে কিছু প্রাথমিক কথা বলে নিতে চাই। প্রথমত, পড়ার ছন্দ ও গতি অব্যাহত রাখতে লেখার ফাঁকে ফাঁকে কেবলমাত্র গান্ধীর নিজের লেখাপত্র ছাড়া অন্য রেফারেন্স উল্লেখ করার ব্যাপারটি সচেতনভাবেই পরিহার করেছি; যদিও প্রতিটি পর্বের শেষে আগ্রহী পাঠক যাতে ইচ্ছে করলে সেই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ লেখাপত্রের উল্লেখ থাকবে। লেখার একদম শেষে থাকবে বিস্তারিত গ্রন্থতালিকাও। দ্বিতীয়ত, উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে শুধু বাংলা বা শুধু ইংরেজিতে মূল উদ্ধৃতিটা না দিয়ে, মূলত একঘেয়েমি কাটানোর জন্যই বাংলা ও ইংরেজি – উভয় ভাষাতেই তা রেখেছি। তৃতীয়ত, এ লেখা অদীক্ষিত পাঠকের জন্যও। তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইতিহাসের ঘটনাবলির বিস্তারিত উল্লেখের ফলে ইতিহাস-সচেতন পাঠকরা বিরক্ত বোধ করবেন না, সেই আশা রাখি।

    দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, আমাকে গান্ধীবিষয়ক বেশ কিছু বই ও জার্নাল পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই কারণে তাঁর কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই ঈপ্সিতা পালকেও। তিনি একপ্রকার জোর করেই আমাকে এখানে লেখার সুযোগ না করে দিলে দশ পর্বে বিন্যস্ত এই দীর্ঘ লেখাটি কোনও দিনই হয়তো আলোর মুখ দেখত না।]

    অহিংসা-সত্যাগ্রহ-অসহযোগ; মৌনব্রত-আত্মশুদ্ধি-ব্রহ্মচর্য; খাটো ধুতি-আশ্রম-চরকা; নিরামিষ-অনশন-রামধুন; হরিজন-বাণী বিতরণ-বিজ্ঞান বিরোধিতা, বানিয়া-ব্যারিস্টার-বৈরাগীর এক চমৎকার বিরল প্যাকেজ গান্ধী এখন সম্পূর্ণই ব্রাত্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে। তাঁর চরকা, তাঁর খাদি, তাঁর মাদক বর্জনের সংকল্প, তাঁর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর যাবতীয় অস্ত্র বিসর্জনের প্রতিশ্রুতি, তাঁর সেনাবাহিনী গঠনের অপ্রয়োজনীয়তার আদর্শ — সব কবেই তামাদি হয়ে গেছে। তবুও রাষ্ট্রনেতারা সে কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না। বরং গান্ধী টুপি পরে এক দল ভড়ংবাজির আশ্রয় নেন, অন্য দল সারা বছর নাথুরামের ভজনা করে একটা দিন বহু কষ্টে তাঁর জন্য বরাদ্দ রাখেন। আর তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সুকৌশলী নির্মাণে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে রাষ্ট্র এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর তিনটে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিনি তাই অবলীলায় ‘হে রাম’ বলতে পারেন; তার জন্মদিন-মৃত্যুদিনে সরকার বের করে ডাকটিকিট-মুদ্রা; তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি ছবি অনায়াসে ছিনিয়ে আনে একগাদা অস্কার। এই বছর তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তিতে আবারও গান্ধীবন্দনার ঢল নামবে। সেই স্রোতের বিরুদ্ধেই আমার এই অবগাহনের চেষ্টা।

    প্রথম পর্ব : গান্ধী ও দক্ষিণ আফ্রিকা — মিথ-মিথ্যার মিশেল

    মাঝারি মানের ছাত্র গান্ধী জীবিকার তাড়নায় ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। পড়া শেষে ভারতে ফিরে এসে বোম্বাইতে আইনজীবী হিসাবে পসার জমাতে না পেরে আংশিক সময়ের ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে স্কুলে পড়ানোর জন্য আবেদন করেন। কিন্তু স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকায় সেই চাকরি তাঁর হয়নি। শেষে ভগ্নমনোরথ গান্ধী তাঁর ভাই উকিল লক্ষীদাসের সহায়তায় রাজকোটে টুকটাক আইনি পরামর্শ দিয়ে গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ধনী মুসলিম ব্যবসায়ী দাদা আবদুল্লা ট্রান্সভালের অন্য এক ভারতীয় ব্যবসায়ী তায়েব শেঠ-এর কাছ থেকে ৪০ হাজার পাউন্ড আদায় করার জন্য আদালতে মামলা ঠোকেন। আবদুল্লা এমন একজন আইনজীবী খুঁজছিলেন যিনি তাঁর এবং তাঁর অ্যাটর্নি বেকার-এর সঙ্গে দোভাষির কাজে দক্ষ হবেন। ১৮৯৩ সালের প্রথম দিকে আবদুল্লার পোরবন্দরস্থিত মেমন ফার্ম শাখা এ ব্যাপারে গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি রাজি হয়ে যান। গান্ধী তখন ২৪।

    স্ত্রী কস্তুরবা এবং দুই পুত্র মণিলাল ও হরিলালকে ভারতে রেখে গান্ধী যখন ১৮৯৩ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছন, তখন সেখানে ছিল মোটামুটি চার ধরণের জাতি — কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান, শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ান – ব্রিটিশ ও ডাচ (বুয়র), ভারতীয় এবং চিনারা। ডাচরা দখল করেছিল অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং ট্রান্সভাল। অন্যদিকে ব্রিটিশরা কেপ কলোনি এবং নাটালের উপনিবেশগুলো অধিকার করেছিল। তখন নাটালে বসবাসকারী ছিলেন প্রায় ৪৫ হাজার ইউরোপীয়, পাঁচ লাখ স্থানীয় আফ্রিকান এবং প্রায় ৩৫ হাজার ভারতীয়। ভারতীয়রা ছিলেন প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত — ‘প্যাসেঞ্জার’ (যাঁরা নিজ খরচে সে দেশে এসেছেন), ‘গিরমিটিয়া’ (‘Agreement’-এর অপভ্রংশ) হিসাবে পরিচিত চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক এবং চুক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও যাঁরা দেশে ফিরে যাননি। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা মূলত কয়লাখনি এবং কৃষিখামারগুলিতে কাজ করতেন। এঁদের ভোটাধিকার ছিল না, উপরন্তু তাঁদের ওপর চলত শ্বেতাঙ্গ ‘প্রভু’দের অবর্ণনীয় অত্যাচার ও অমানুষিক শোষণ।

    তখনও পর্যন্ত গান্ধী ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অত্যধিক অনুরক্ত এবং তাঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে ধনী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অসীম আস্থাশীল। তাই গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা পর্বে চুক্তিবদ্ধ ক্রীতদাসতুল্য ভারতীয় শ্রমিকদের দুর্দশা দূর করার বা তাঁদের দৈহিক উৎপীড়ন বন্ধ করার জন্য গান্ধী কোনও চেষ্টাই করেননি। বরং নাটালের প্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যাতে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ বণিকদের সমানাধিকার লাভ করতে পারেন, সে ব্যাপারে সতত সচেষ্ট ছিলেন। মূলত এই কারণেই ১৮৯৪ সালের ২২ অগস্ট তিনি গড়ে তোলেন নাটাল ভারতীয় কংগ্রেস বা NIC। নবগঠিত এই সংগঠনের সভাপতি হন ধনী ব্যবসায়ী আবদুল্লা হাজি আদম, সাম্মানিক সম্পাদক হন গান্ধী। প্রধানত চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের এই সংগঠন থেকে দূরে রাখতে কংগ্রেসের চাঁদা ধার্য হয় বার্ষিক তিন পাউন্ড। এই কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য ছিল “To promote concord and harmony among the Indians and Europeans residing in the colony [of South Africa]”। সংগঠনের সম্পাদক হিসাবে দরখাস্ত লেখা, সরকারি আধিকারিকদের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠানো, বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কাছে নিজেদের দাবি আদায়ের সমর্থনে চিঠি লেখা এবং বিভিন্ন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তমূহ সরকারের নজরে আনা ইত্যাদির মধ্যেই গান্ধীর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল।

    ১৮৯৫ সালের মে মাসে নাটাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিষয়ে Indian Immigration Law Amendment Bill আনে। এই বিলে দু’টি সংশোধনী আনা হয়। প্রথমত, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের চুক্তির মেয়াদ পূর্বতন পাঁচ বছরের পরিবর্তে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, কেবলমাত্র চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই তাঁদের ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়। তাঁরা যদি ভারতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে অসম্মতি প্রকাশ করে নাটালেই থেকে যেতে চান, সে ক্ষেত্রে তাঁদেরকে পুনরায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া, অথবা তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ পরিবারের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক তিন পাউন্ড কর দেওয়ার কথা বলা হয়। গান্ধী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য যথাক্রমে নাটাল অ্যাসেমব্লির প্রেসিডেন্ট, নাটাল কাউন্সিল এবং উপনিবেশের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি চেম্বারলিনের কাছে আবেদন জানান। একদম শেষ পর্যায়ে তিনি লর্ড এলগিনের কাছেও এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে ১৮৯৫ সালের ১১ অগস্ট এক স্মারকলিপি পাঠান। যদিও গান্ধীর আবেদনে কর্ণপাত না করে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের শোষণের এক স্থায়ী হাতিয়ার হিসাবে বিলটি পাশ হয়।

    এই সময় অবধি গান্ধী কেবলমাত্র যে একটি বিষয়ে সফল হন, সেটি হল ডারবান পোস্ট অফিসের প্রবেশপথ সংক্রান্ত আবেদন। পোস্ট অফিসে প্রবেশপথ ছিল দুটি – একটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য ও অন্যটি অ-শ্বেতাঙ্গদের জন্য। কিন্তু গান্ধী প্রথম থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের তুলনায় সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের উচ্চ স্তরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলত এই বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে গান্ধী কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখে ভারতীয়দের জন্য তৃতীয় একটি প্রবেশপথের বন্দোবস্ত করতে সফল হন — “In the Durban Post and Telegraph Offices, there were separate entrances for natives and Asiatics and Europeans. We felt the indignity too much and many respectable Indians were insulted and called all sorts of names by the clerks at the counter. We petitioned the authorities to do away with the invidious distinction and they have now provided three separate entrances for natives, Asiatics, and Europeans” (The Collected Works of Mahatma Gandhi, Electronic Book, 98 Volumes, New Delhi, Publications Division, Government of India, 1999; Vol. 1, pp. 367-368; এর পর থেকে কেবলমাত্র CWMG ১/৩৬৭-৩৬৮ লেখা হবে)।

    ইতিমধ্যে ডাচ উপনিবেশ ট্রান্সভালে সোনা এবং হিরের সন্ধান মিলতেই ব্রিটিশরা ডাচদের উপনিবেশগুলো কব্জা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই কারণে স্থানীয় শ্বেত-অধিবাসী বুয়রদের সঙ্গে ১৮৯৯ এর ১২ অক্টোবর থেকে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয়, ইতিহাসে তাই ‘বুয়র যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধে গান্ধীর অংশগ্রহণ করার কোনও কারণই ছিল না, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্বস্ত প্রজা হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত ভারতীয়দের এই যুদ্ধে ইংরেজদের হয়ে অংশগ্রহণ করার কথা বলেন। যুদ্ধে যোগদান করতে চেয়ে তিনি লেখেন, “I need hardly say that, as soon as war was declared, irrespective of their opinions as to the justness or otherwise of the war, the Indians to a man made up their minds to give their humble support to the British Government during the crisis…” (CWMG, ২/৩৫৩)। সাম্রাজ্যবাদী এই যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়ে গান্ধী অন্যত্র যে সাফাই দেন তা এই রকম — “Suffice it to say that my loyalty to the British rule drove me to participation with the British in that war. I felt that, if I demanded rights as a British citizen, it was also my duty, as such, to participate in the defence of the British Empire. I held then that India could achieve her complete emancipation only within and through the British Empire. So I collected to gather as many comrades as possible, and with very great difficulty got their services accepted as an ambulance corps” (‘The Boer War’, Chapter 64, An Autobiography or The Story of My Experiments with Truth)।

    এই যুদ্ধে তিনি ‘uniformed non-commissioned officer’ হিসাবে প্রায় এগারোশো ভারতীয় স্ট্রেচারবাহকদের শীর্ষ নেতার পদে নির্বাচিত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি মেডেল পান, যদিও বাকিদের ক্ষেত্রে তাঁর একটি চিঠির স্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। যুদ্ধে নিরীহ স্ট্রেচারবাহকের কাজ আপাতদৃষ্টিতে নিছকই সেবামূলক কাজ মনে হলেও গান্ধী এই যুদ্ধে পুরোদস্তুর অংশ নিতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে লেখেন, “At the time of the Boer War, it will be remembered, the Indians volunteered to do any work that might be entrusted to them, and it was with the greatest difficulty that they could get their services accepted even for ambulance work. General Buller has certified as to what kind of work the Natal Indian Volunteer Ambulance Corps did. If the Government only realised what reserve force is being wasted, they would make use of it and give Indians the opportunity of a thorough training for actual warfare. There is, too, on the Statute-book, a law for the purpose, which has been allowed to fall into desuetude from sheer prejudice. We believe a very fine volunteer corps could be formed from Colonial-born Indians that would be second to none in Natal in smartness and efficiency, not only in peace but in actual service also” (CWMG ৫/১১)।

    পরবর্তী কিস্তি পুজোর হুল্লোড় মিটে যাওয়ার পরে ...
    [যাঁরা গান্ধী রচনাবলি পড়তে চান কিংবা এই লেখার রেফারেন্সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান তাঁদের জন্য রইল এই গুরুত্বপূর্ণ লিংকটা।
    https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php]

    বুয়র যুদ্ধ শেষে ১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে গান্ধী ভারতে ফিরে যান। কিন্তু দেশে তাঁর আইনের পেশা না জমায় পরের বছর ডিসেম্বরে পুনরায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে আসেন। ১৯০৩ সাল থেকে তিনি ট্রান্সভালের জোহানেসবার্গে থাকতে শুরু করেন এবং ওই বছরেই গড়ে তোলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা BIA। নাটালে অবস্থানকালে গান্ধী যেমন নিজেকে ব্রিটিশদের বিশ্বস্ত প্রজা ভাবতেন এবং তাদের যে কোনও মূল্যে তুষ্ট করে প্রবাসী ধনী ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন, জোহানেসবার্গ বসবাসকালীনও তাঁর আন্দোলনের অভিমুখ ও পদ্ধতির কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। ১৯০৪ এ তিনি স্থাপন করেন ফিনিক্স আশ্রম, যেখান থেকে মূলত তাঁর রাজনৈতিক বিবৃতি ছাপার জন্য প্রকাশিত হয় ‘Indian Opinion’ নামক সংবাদপত্র, যার পাতায় পাতায় তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অবিচারের কাহিনি। জোহানেসবার্গের আখের বিস্তীর্ণ খামারবাড়িগুলির কেন্দ্রস্থলে ছিল তাঁর ফিনিক্স আশ্রমের অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এখানে কর্মরত অসংখ্য চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের ওপর দীর্ঘ দিনের শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো বা তাঁদের জীবনযাত্রাকে তুলনামূলক সহনশীল করে তোলার ব্যাপারে তিনি যে বরাবর নিশ্চেষ্ট থেকেছেন তাই নয়, ওই সংবাদপত্রের ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০৪ সংখ্যায় তিনি নির্দ্বিধায় লিখেছেন: The general condition of the indentured labourer in the Colony is satisfactory; and it can only enhance its reputation if causes even of suspicion are removed (CWMG ৪/১৩৯)।

    ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজ সরকারের অস্বাভাবিক কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে নাটালের স্থানীয় জুলু উপজাতির বিদ্রোহীরা একজন ম্যাজিস্ট্রেট সহ দু’জন শ্বেতাঙ্গ পুলিশকে হত্যা করলে ‘বাম্বাত্তা বিদ্রোহ’ সূচিত হয়। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে উদগ্রীব গান্ধী লেখেন, “What is our duty during these calamitous times in the Colony? It is not for us to say whether the revolt of the Kaffirs is justified or not. We are in Natal by virtue of British power. Our very existence depends upon it. It is therefore our duty to render whatever help we can. There was a discussion in the Press as to what part the Indian community would play in the event of an actual war. We have already declared in the English columns of this journal [Indian Opinion] that the Indian community is ready to play its part; and we believe what we did during the Boer war should also be done now. That is, if the Government so desires, we should raise an ambulance corps. We should also agree to become permanent volunteers, if the Government is prepared to give us the requisite training” (CWMG ৫/১৭৯)। কিন্তু নিছকই যে জুলুদের সেবা করার জন্য তিনি অ্যাম্বুলেন্স বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন তা আদৌ সত্যি নয়, কারণ দু’টো অনুচ্ছেদ আগেই আমরা দেখেছি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পক্ষে তিনি তিন তিনটে যুক্তি দিচ্ছেন — ক) ভারতীয়রা উপনিবেশ রক্ষা করতে সক্ষম; খ) সৈন্যদের অতিরিক্ত বাহিনী অর্থাৎ ভারতীয়দের কাজে লাগানোই অধিক যুক্তিযুক্ত এবং গ) এ বিষয়ে একটি পুরনো আইনও বিদ্যমান। অর্থাৎ গান্ধীর চোখে দক্ষিণ আফ্রিকা-জাত ভারতীয়রা সেনাবাহিনিতে নথিভুক্ত হওয়ার প্রথম হকদার!

    শুধু অংশগ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি গান্ধী, এই যুদ্ধে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব করে তিনি বলেন, “It is necessary that Indians help in the way they did when a fund was started at the time of Boer War. It will be good to collect some money and send it to the Government or to some Fund that might have been started” (CWMG ৫/২৫১)। এহ বাহ্য, শুধু সরকারকে অর্থসাহায্য করার প্রস্তাবই নয়, সৈন্যদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের জন্য তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি এ-ও বলেন: “The soldiers’ life is a hard one. The salary and allowances that the Government pay them are not always enough. Those, therefore, who do not go to the front should, in order to express their sympathy, raise a fund for the purpose of sending the soldiers fruits, tobacco, warm clothing and other things that they might need. It is our duty to subscribe to such a fund” (CWMG ৫/২৫৯)। মাদকবিরোধী হিসেবে পরিচিত গান্ধী কি না সৈন্যদের তামাক খাওয়ার অভ্যাসের কথা বিবেচনা করে তহবিল গঠন করতে চাইছেন! এই যুদ্ধেও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্ট্রেচারবাহকের ভূমিকা পালন করে বিদ্রোহ দমন করতে সাহায্য করায় গান্ধী সার্জেন্ট মেজর পদ ও সরকারি সম্মান লাভ করেন। যদিও যুদ্ধে হত সাড়ে ৩ হাজার জুলু, বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জুলু নারী ও শিশুদের অনাহারে মৃত্যু, ৩০ হাজার জুলুর গৃহহীন হয়ে পড়া এবং ব্রিটিশদের ‘পোড়া মাটি’-র ঘৃণ্য নীতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন আশ্চর্য রকমের উদাসীন।

    বাম্বাত্তা বিদ্রোহীদের ওপর ইংরেজ শাসকদের ভয়াবহ অত্যচারকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল অবধি ‘disgusting butchery’ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, অথচ শান্তির উপাসক গান্ধী ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আবারও জুলুদের বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করতে চেয়ে লিখেছিলেন: “There is again a rebellion of Kaffirs in Zululand. In view of this, hundreds of white troops have been dispatched. The Indian community must come forward at such a time without, however, thinking of securing any rights thereby. They must consider only the duty of the community. It is a common observation that when we attend to our duty, rights follow as a matter of course. It will be only proper for the Indian community to make the offer that was made last year. ... We assume that there are many Indians now who will welcome such work enthusiastically. Those who went to the front last year can do so again. Most of them are seasoned people and familiar with the nature of the work. We very much hope that this work will be taken in hand without any delay” (CWMG ৭/৩৯৭)। স্থানীয় আফ্রিকানদের স্বার্থের প্রতি উদাসীন থেকে বারংবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সাহায্য করার বিনিময়ে নিজেদের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার গান্ধীর এই ঘৃণ্য প্রয়াসকে চিহ্নিত করে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি জন ডিউব ১৯১২ সালে সঠিক ভাবেই লিখেছিলেন, “ … people like Indians have come into our land and lorded it over us, as though we who belong to the country were mere non-entities…”।

    যদিও গান্ধী আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, জুলু যুদ্ধের পরেই নাকি তাঁর মনোজগতে পরিবর্তন আসে এবং পাঁচটি ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প হন — ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই, ‘vow of poverty’ এবং সত্যাগ্রহ; আমরা দেখতে পাব যে এগুলির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর জীবনে অসংখ্যবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ‘সত্যাগ্রহ’ সম্পর্কিত আলোচনার আমরা দেখে নিই গান্ধী স্বয়ং সত্যাগ্রহ বিষয়ে কী বলেছেন। সত্যাগ্রহ সম্পর্কে গান্ধীর ধারণা এইরকম: “This doctrine of satyagraha is not new; it is merely an extension of the rule of domestic life to the political. Family disputes and differences are generally settled according to the law of love. The injured member has so much regard for the others that he suffers injury for the sake of his principles without retaliating and without being angry with those who differ from him. And as repression of anger and self-suffering are difficult processes, he does not dignify trifles into principles, but, in all non-essentials, readily agrees with the rest of the family, and thus contrives to gain the maximum of peace for himself without disturbing that of the others. Thus his action, whether he resists or resigns, is always calculated to promote the common welfare of the family. It is this law of love which, silently but surely, governs the family for the most part throughout the civilized world” (CWMG ২০/৪০) অর্থাৎ তাঁর মতে সত্যাগ্রহের গোটা বিষয়টাই পারিবারিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা নয়!

    যাই হোক, গান্ধী ১৯০৭-০৮ ও ১৯০৮-১১ সালে মূলত এলিট ভারতীয়দের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে এবং ১৯১৩-১৪-য় প্রধানত অ-খ্রিস্টান ভারতীয় বিবাহকে স্বীকৃতি না দেওয়ার বিরুদ্ধে তিনটি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। জুলু যুদ্ধের অব্যবহিত পর ১৯০৬ এর ২২ অগস্ট ট্রান্সভাল সরকারি গেজেটে ‘এশিয়াটিক ল অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স’-এর কথা প্রকাশিত হয়। নতুন এই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ট্রান্সভালে বসবাসকারী আট বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত ভারতীয়কে নতুন করে নাম পঞ্জীভুক্ত করে ছাড়পত্র বা ‘পাস’ নেওয়ার কথা বলা হয় এবং এই ছাড়পত্র এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়া, আইন-আদালত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়।

    গান্ধী তাঁর বন্ধু প্রিটোরিয়ার অ্যাটর্নি রেইনহোল্ড গ্রেগরস্কি-র কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাইলে গ্রেগরস্কি জানান, “The act is far more severe than the Dutch Law. There is not a single provision that is favourable to the Indians. The act makes the position of the Indian worse than that of the Kaffir. Not every Kaffir is required to carry a pass on him; but now every Indian will have to do so. Educated Kaffirs are exempt from such restrictive laws. But the Indian, whatever his education and standing, will have to carry a pass. The pass, it seems to us, will be like the one carried by prisoners, etc. Whatever loop-holes there existed in the Law [3] of 1885 have been closed in this Act. While Kaffirs can own land, Indians cannot. It does not seem probable that the Liberal Government will approve such a law.” (CWMG ৫/৩৩৯)। বন্ধুর এহেন ব্যাখ্যা শুনে গান্ধীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! যে গান্ধী ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নাটালের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের ‘খোলা চিঠি’-তে খোলাখুলি জানিয়েছিলেন ‘…both the English and the Indians spring from a common stock, called the Indo-Aryan’; যিনি নির্দ্বিধায় তাদের প্রভুত্বকে মেনে নিয়ে লিখেছিলেন: ‘Providence has put the English and the Indians together, and has placed in the hands of the former the destinies of the latter’; যিনি বলেছিলেন – ‘… the Indians were, and are in no way inferior to their Anglo-Saxon brethren…’ সেই প্রভু তথা ভাই ভারতীয়দের তাদের সমগোত্রীয় না ভেবে শুধু অন্যায়ই করছে না, ‘নিকৃষ্ট’ আফ্রিকানদের থেকেও নিম্নস্তরে নামিয়ে দিচ্ছে!! এই আইনকে ‘কালা কানুন’ হিসেবে অভিহিত করে এর যথোচিত জবাবের উপায় খুঁজতে শুরু করেন তিনি।

    দক্ষিণ আফ্রিকা আদতে যে আফ্রিকানদের দেশ, ইংরেজ তথা ইউরোপীয়রা যে সেখানে জবরদখলকারি ঔপনিবেশিক মাত্র – সে কথা ‘সত্যাগ্রহী’ গান্ধীর কখনও মনে হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছনোর মাত্র দেড় বছর পরে ডিসেম্বর ১৮৯৪তে যিনি লেখেন : “A general belief seems to prevail in the Colony that the Indians are little better, if at all, than savages or the Natives of Africa”; ১৮৯৬ সালে পুনরায় যিনি জানান: “Ours is one continual struggle against a degradation sought to be inflicted upon us by the Europeans, who desire to degrade us to the level of the raw Kaffir whose occupation is hunting, and whose sole ambition is to collect a certain number of cattle to buy a wife with and, then, pass his life in indolence and nakedness”; ১৮৯৯ এ যিনি ওই মতেই অবিচল থেকে বলেন “… it would place them [British Indian], who are undoubtedly infinitely superior to the Kaffirs, in close proximity to the latter”; তিনি কীভাবে ভারতীয়দের সঙ্গে ‘কাফ্রি’দের এই পার্থক্য মেনে নিতে পারেন! তাই ‘Better die rather than submit to such a law’ আহ্বান জানিয়ে এই পঞ্জীকরণে আপত্তি জানান তিনি। যুদ্ধের পোশাক খুলে রেখে ফের আইনজীবীর পোশাক গায়ে চাপান, সেপ্টেম্বরে শুরু করেন তাঁর প্রথম সত্যাগ্রহ।

    ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের তরফে তিনি উপনিবেশ স্টেট সেক্রেটারিকে জানান, “British Indians alarmed at haste with which Asiatic Ordinance is being rushed through Legislative Council. Ordinance reduces Indians to status lower than Kaffirs and much lower than that occupied under Dutch regime. British Indian Association request Imperial sanction be stayed pending deputation proceeding directly. Association requests reassuring reply” (CWMG ৫/৩৩০)। পাশাপাশি, ভারতের ভাইসরয়কেও এই ব্যাপারে তারবার্তায় জানান, “British Indians alarmed at Asiatic Ordinance passing through Legislative Council. Transvaal Ordinance degrading, insulting, reduces Indians to a worse status than that of Pariahs. British Indian Association request the Viceroy’s active intervention. His Excellency being directly responsible for their welfare” (তদেব)।

    ১১ সেপ্টেম্বর গান্ধীর নেতৃত্বে প্রায় তিন হাজার ভারতীয় এম্পায়ার থিয়েটারের প্রতিবাদ সভায় হাজির হন। সেখানে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী তাঁরা ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে পাস না তোলার জন্য এবং আইন অমান্য করে জেলে যাওয়ার জন্য সম্মত হন। অক্টোবর মাসে গান্ধী এবার একজন মুসলিম সহযোগী মহম্মদ আলিকে নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে (‘vow of poverty’ ভুলে গিয়ে প্রথম শ্রেণির টিকিটে!), লর্ড এলগিনের সঙ্গে দেখা করে কথা আদায় করার চেষ্টা করেন। এলগিন অবশ্য স্পষ্টই জানান যে ট্রান্সভাল সরকার এই বিল পাশ করলে তিনি এ ব্যাপারে মাথা গলাবেন না। ১৯০৭ সালের পয়লা জানুয়ারি ট্রান্সভাল স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে জিতে জেনারেল স্মাটস এই সরকারের উপনিবেশ সচিব হন। পার্লামেন্টে ২২ মার্চ কেবলমাত্র এশীয় মহিলাদের ছাড় দিয়ে বাকিদের ক্ষেত্রে এই অর্ডিন্যান্স পাশ হয়। মে মাসে এলগিনের সম্মতি মিলবার পরে প্রথমে ১ জুলাই থেকে ও পরে বাড়িয়ে ৩০ নভেম্বর থেকে তা চালু করার কথা বলা হয়। ট্রান্সভাল সরকার ভারতীয়দের পঞ্জীকরণের উদ্দেশ্যে প্রিটোরিয়া, পিটার্সবার্গ, জোহানেসবার্গ এবং অন্যান্য ভারতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলে অফিস খুললে গান্ধীর পরামর্শ অনুযায়ী ভারতীয় সত্যাগ্রহীরা অফিসের সামনে পিকেটিং শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত নাম পঞ্জীভুক্ত করেন প্রায় ১৩ হাজার ভারতীয়র মধ্যে মাত্র ৫১১ জন। কর্তৃপক্ষ এবার বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেন।

    ১৯০৮ এর ১০ জানুয়ারি ট্রান্সভালে গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয় এবং দু মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি জেলে যাওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন বন্ধ হল না দেখে জেনারেল স্মাটস এক চাল চালেন। তিনি ট্রান্সভাল লিডার-এর সম্পাদক অ্যালবার্ট কার্টরাইটকে গান্ধীকে রাজি করানোর ব্যাপারে পাঠান। ২৮ জানুয়ারি গান্ধী প্রিটোরিয়াতে স্মাটস-এর সঙ্গে দেখা করেন এবং দু’জনেই আপস করতে সম্মত হন। যদিও আন্দোলন প্রত্যাহারের শর্ত হিসাবে গান্ধী অযথা প্রচার করেন যে স্মাটস ‘… verbally promised to repeal the Act, if the British Indians fulfilled their part of the compromise, that is to say, underwent voluntary registration’ (CWMG ৯/২৩০), আদতে তাঁদের মধ্যে এই আইন প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতির কথাই হয়নি। অবশেষে জেনারেল স্মাটসের ‘মৌখিক প্রতিশ্রুতি’-র ভিত্তিতে ১৯০৮-এর জানুয়ারিতে প্রথম সত্যাগ্রহ তুলে নেওয়া হয়।

    এই পর্বের তৃতীয় তথা শেষ কিস্তি পরবর্তী সপ্তাহে ...

    [গান্ধী রচনাবলির প্রয়োজনীয় খণ্ডটির লিংকে ক্লিক করুন। ডাউনলোড হলে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠাসংখ্যা টাইপ করুন। তাহলেই উদ্ধৃতিটি দেখতে পাবেন। ইচ্ছা করলে আগের কিংবা পরের অংশও পড়তে পারেন।
    https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php ]

    প্রথম পর্ব : তৃতীয় তথা শেষ কিস্তি

    ‘প্রতিশ্রুতি’ স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষিত না হওয়ায় গান্ধী শুরু করেন সত্যাগ্রহের দ্বিতীয় পর্যায়, কালা কানুন বাতিলের দাবিতে এবার শুরু হয় জেল ভরো আন্দোলন। কিন্তু সেখানেও স্থানীয় আফ্রিকানদের সম্পর্কে তাঁর ঘৃণিত মনোভাব প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। সত্যাগ্রহ চলাকালীন যখন তাঁকে এবং তাঁর অনুগামীদের আফ্রিকানদের সঙ্গে জেলের একই সেলে রাখা হচ্ছে তখনও তিনি তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন: “Many of the Native prisoners are only one degree removed from the animal and often created rows and fought among themselves in their cells” (CWMG ৮/১৮৩) বা “We were then marched off to a prison intended for Kaffirs. … We could understand not being classed with the whites, but to be placed on the same level with the Natives seemed too much to put up with. … At the same time, it is indubitably right that Indians should have separate cells. … Kaffirs are as a rule uncivilized - the convicts even more so. They are troublesome, very dirty and live almost like animals” (CWMG ৮/১৯৮-৯৯)। ১৯১১ সালে যখন তাঁর সত্যাগ্রহ চলছে তখন এক বৈঠকে জেনারেল স্মাটস তাঁকে বলেছিলেন, “… this country is the Kaffirs’. We whites are a handful. We do not want Asia to come in” (CWMG ১১/৩৬০)। কিন্তু হায়! সাম্রাজ্যবাদী স্মাটস যে কথা অনুভব করেছিলেন, একুশটা বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়েও তা অনুভব করতে পারেননি গান্ধী।

    দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলন পরিচালনা পর্বেই গান্ধী মনোযোগ দেন তাঁর কার্যাবলীর সুষ্ঠু প্রচারে। ১৮৬৯ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত তাঁর জীবনের নানা কর্মকাণ্ড বিস্তারিত ভাবে লেখার জন্য গান্ধী ১৯০৯ সালে রেভারেন্ড যোসেফ ডোককে দিয়ে লেখান তাঁর প্রথম জীবনী। অক্টোবর মাসে সেই জীবনী প্রকাশিত হতেই তার ৭০০ কপি দেশ-বিদেশে বিলির জন্য উদ্যোগী হন তিনি নিজে। এই বইয়ের তথ্যকে আকর হিসাবে বিবেচনা করে পরের বছর হেনরি পোলক লেখেন গান্ধীর দ্বিতীয় জীবনী। আর ১৯০৯ সালে লন্ডন থেকে খালি হাতে ফিরে আসার সময় জাহাজে বসে মাত্র দশ দিনে গান্ধী গুজরাটি ভাষায় লেখেন ‘হিন্দ স্বরাজ’ নামক গ্রন্থটি, পরের বছর নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা প্রকাশ করেন ‘Hind Swaraj or Indian Home Rule’ নামে। সংস্কাররাচ্ছন্ন বৈষ্ণব পরিবারের প্রাত্যহিক বিচারহীন হিন্দু আচার – গুজরাটের জৈন ঐতিহ্য – বাইবেলের খ্রিস্টিয় পাপবোধ – রাসকিন (Unto This Last)-এর সরল ও সমবেত জীবনের আদর্শ – থরো (On the Duty of Civil Disobedience)-র অসহযোগ এবং টলস্টয় (The Kingdom of God Is within You)-এর খ্রিস্টিয় অহিংসা ও দারিদ্র্যব্রত চিন্তার জগাখিচুড়ি করে গান্ধী নিজে তাঁর রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে ভবিষ্যতের ভারতকে চিত্রিত করেন এই গ্রন্থে।

    এর অনেক বছর বাদে ১৯২৩ সালে গান্ধী যখন পুণের ইয়েরবেদা জেলে বন্দী, তখন তিনি লেখেন ‘Satyagraha in South Africa’। পাশাপাশি, ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে গুজরাটি ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘An Autobiography or The Story of My Experiments with Truth’। ১৯২৭ এবং ১৯২৯ সালে দু’খণ্ডে প্রকাশিত সেই আত্মজীবনী পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়। যদিও প্রত্যেকটি বইতেই তাঁর যুদ্ধে অংশগ্রহণের অংশটায় সুনিপুণভাবে প্রলেপ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তিনি যৌনজীবনকে ‘physically harmful and morally sinful’ রূপে বিবেচনা করে ব্রহ্মচর্য পালন শুরু করেছেন (যদিও পরবর্তীকালে তাঁর ব্রহ্মচর্যের পরীক্ষার জন্য অজস্র নগ্ন নারীর বক্ষলগ্না হয়ে রাত কাটাবেন তিনি); একশো একরের ফিনিক্স আশ্রম থেকে চলে আসছেন এগারো শো একর বিশিষ্ট টলস্টয় ফার্মে এবং ওই ফার্মে থাকাকালীন ভবিষ্যতে তাঁর ভাবমূর্তি মসিলিপ্ত হতে পারে ভেবে ১৯১০ নাগাদ বেশ কিছু কাগজপত্র নষ্ট করে দিচ্ছেন।

    মোটামুটি ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯০৭ থেকে ১৯১১ অবধি দীর্ঘ সময়কালে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতীয়দের সমানাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে আদৌ ফলপ্রসু হয়নি। সেই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে হতাশ গান্ধী ১৯০৯ সালের ২৩ জুন নিজেই লিখেছিলেন — “… Indians have been begging for something to be brought to them from England [as a gift]. This shows our utter helplessness. The whites of the Colonies are the strong and favoured sons [of the Empire]. We are the weak and neglected ones. How can the neglected sons get a hearing from the mother against the favoured ones?” (CWMG, ৯/৩৯১-৩৯২)। প্রখ্যাত গ্রন্থকার যোসেফ লেলিভেল্ড গান্ধীর সত্যাগ্রহ পর্বের চমৎকার মূল্যায়ন করে লিখেছেন, “Nearly five years after the start of Satyagraha, he had nothing to show for the resistance his leadership had inspired. Indians had courted arrest and gone to jail more than two thousand times, serving sentences of up to six months at hard labour, some, like Thambi Naidoo and Gandhi’s son Harilal, doing so repeatedly. Hundreds of other resisters had been deported back to India. The world had fleetingly taken notice — India especially — but the new white government had outmaneuvered Gandhi. Disillusion was building up, especially in Natal”।

    গান্ধীর আন্দোলনে আবার জোয়ার আসে যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ কেপ কলোনির সুপ্রিম কোর্ট অ-খ্রিস্টান ভারতীয় বিবাহকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কথা জানায়। গান্ধী যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন, কিন্তু তিনি ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন যে প্রকৃত গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে বিশাল সংখ্যক ভারতীয়ের সমর্থন প্রয়োজন। ওই একই সময়ে নাটাল কর্তৃপক্ষ প্রাক্তন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বার্ষিক তিন পাউন্ড কর না দিলে ফৌজদারি মামলার হুমকি দেয়। গান্ধী এই দুটি বিষয়েরই বিরোধিতা করে শুরু করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর তৃতীয় তথা শেষ সত্যাগ্রহ। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর যাবতীয় আন্দোলনের অভিমুখ নির্দিষ্ট রেখেছিলেন কেবলমাত্র অভিজাত ‘প্যাসেঞ্জার’ ভারতীয়দের জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের জন্য তিনি আদৌ চিন্তিত ছিলেন না। শুধুমাত্র নিজ স্বার্থে এই বিশাল শ্রমিকবৃন্দকে আন্দোলনে শামিল করার হীন চক্রান্তকে সমালোচনা করে ১৯১৩ সালের ১৭ অক্টোবর ‘Natal Mercury’ পত্রিকায় Natal Indian Patriotic Union (NIPU)-এর তরফে লেখা হয়: “When the NIPU espoused for the abolition of the tax, Mr Gandhi did not manifest his outrage by supporting our agitation in a substantial manner. Mr Gandhi had no inclination whatsoever to help these poor people. … Mr Gandhi’s dictum that India would ‘have no right to exist side by side with a free and self-respecting community if they have no decency and moral strength to suffer’ would have been a welcome pronouncement at the time when the agitation on this subject was in full swing, but now it falls flat on us, because we cannot believe that the same man who was like a ‘stoic’, though not intriguing at the time, could be sincere in what he says now”।
    যাই হোক, এই সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে তাঁর অনুগামী প্রায় পাঁচ হাজার বিক্ষোভকারীকে নাটালের সীমান্ত অতিক্রম করে ট্রান্সভালে প্রবেশ ও গ্রেফতার বরণ করার জন্য নির্দেশ দেন গান্ধী। তাঁর নেতৃত্বে ৬ নভেম্বর, ১৯১৩ সালে ২০৩৭ জন পুরুষ, ১২৭ জন নারী ও ৫৭ জন শিশুর একটি দল সীমানা অতিক্রম করে ট্রান্সভালে পৌঁছলে ৯ তারিখে গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয় এবং নয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় (যদিও সরকার তাঁকে ব্লুমফনটেনের বিশেষ আবাসে আয়াসেই রেখেছিল)। গান্ধীর অনুপস্থিতিতে তাঁর দুই সহকারী পোলক ও কলেনবাকের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহীরা আরও অগ্রসর হলে পোলক ও কলেনবাককেও গ্রেফতার করা হয়।

    এইবার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার সত্যাগ্রহীদের ওপর গুলি চালিয়ে তাঁদের আন্দোলন দমন করতে শুরু করে। বেশ কিছু সত্যাগ্রহী মারা যান, আহত মিছিলকারীদের জেলে ভরা হয়। ওই বছরেই দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকরা প্রথমে জুলাই মাসে সোনার খনিতে এবং ছ’মাস পরে রেলে ধর্মঘট ডাকেন। পাশাপাশি, ভারতীয়দের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার ওপর এহেন বর্বরোচিত আক্রমণের খবর গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই নিউ ক্যাসলের কয়লাখনিতে কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকরা মিছিলকারীদের সমর্থনে ধর্মঘট করেন। শ্রমিক ধর্মঘটিদের সঙ্গে যোগ দেন প্রায় পনেরো হাজার চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। যুগপৎ শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় শ্রমিকদের ধর্মঘটে দিশাহারা, বিপর্যস্ত সরকারের বিরুদ্ধে চাপ দিয়ে দাবি আদায় করার বিষয়ে গান্ধীর কাছে এক সুবর্ণ সুযোগ আসে। কিন্তু গান্ধী বলেন, “Indians do not fight for equal political rights. They recognize that, in view of existing prejudice, fresh immigration from India should be strictly limited, provision being made for the entrance of a sufficient number annually for reasonable wear and tear” (CWMG ১৩/৩৬৬)।

    অবশেষে ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এবং ব্রিটিশ সরকারের চাপের মুখে পড়ে জেনারেল স্মাটস সত্যাগ্রহীদের দাবিদাওয়া বিবেচনার জন্য ১৯১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিন সদস্যের তদন্ত কমিশন (সলোমন কমিশন) গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গান্ধী, পোলক ও কলেনবাককে ১৮ ডিসেম্বর জেল থেকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। স্মাটস এইবার আপস প্রস্তাব নিয়ে কথা বলার জন্য গান্ধীকে ডেকে পাঠান। স্মাটস তাঁকে কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী দাবিসমূহ মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে গান্ধী আবারও স্মাটসের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। শুধু তাই নয়, যে সত্যাগ্রহীরা গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন, চরম অত্যাচারিত হলেন; সেই সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের অত্যাচারের ব্যাপারে কিছুই বলবেন না বা এই নিয়ে আদালতে কোনও মামলাও করবেন না বলে তিনি স্মাটসকে প্রতিশ্রুতি দেন। জেনারেল স্মাটসের কাছে এহেন ন্যক্কারজনক মুচলেকা দেওয়ার অব্যবহিত পরেই সরকার কমিশনের প্রস্তাবগুলি Indian Relief Bill এ অন্তর্ভুক্ত করে ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে বিলটিকে আইনে পরিণত করে। ভারতীয়দের বিবাহ বৈধ বলে স্বীকৃত হয় (যদিও মুসলমানদের বহু বিবাহ অস্বীকৃত থাকে) ও তিন পাউন্ড করের অবলুপ্তি ঘটে। এই আইনকে ‘magna carta for Indians’ বলে অভিহিত করে গান্ধী তাঁর প্রায় আট বছর ব্যাপী সত্যাগ্রহ তুলে নেন।

    রাজনৈতিক গুরু গোখলের পরামর্শে ১৯১৪ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে ভারতবর্ষে পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার জন্য গান্ধী যখন ইংল্যান্ড অভিমুখে রওনা হচ্ছেন, তখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের যে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল – তার তালিকাও নেহাত কম নয়। প্রথমত, দক্ষিণ আফ্রিকার এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যেতে গেলে যে পারমিট ব্যবস্থা চালু ছিল তার অবলুপ্তি ঘটেনি, অর্থাৎ যে ‘কালা কানুন’-এর বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা তখনও পূর্ণ মাত্রায় বহাল ছিল। দ্বিতীয়ত, ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটে ভারতীয়দের জমি কেনা ও ব্যবসা স্থাপনের অনুমতি ছিল না এবং অন্য দুটি প্রদেশেও সে ব্যাপারে আইনকানুনের মারপ্যাঁচ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। সর্বোপরি, এই আইনে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের কোনও সুরাহাই হয়নি। সঠিক ভাবে বলতে গেলে তিন পাউন্ড কর বিলোপকেই গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্বের একমাত্র সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যদিও মূলত কর আদায় করার প্রশাসনিক অসুবিধার কারণেই সরকার এই কর প্রত্যাহার করে নেয়।

    কেবলমাত্র বুয়র ও বাম্বাত্তা যুদ্ধে গান্ধীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে অহিংসার পূজারী, বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনের হোতা, দরিদ্র অসহায় কৃষক-শ্রমিকদের ত্রাতা হিসেবে প্রচারিত গান্ধীর সযত্নলালিত মুখোশ এক ঝটকায় খুলে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে African Chronicle ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল লেখে: “Mr. Gandhi’s ephemeral fame and popularity in India and elsewhere rest on no glorious achievement for his countrymen, but on a series of failures, which has resulted in causing endless misery, loss of wealth, and deprivation of existing rights”। তবে অশ্বিন দেশাই এবং গুলাম ভাহেদ একটি মাত্র বাক্যে গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্বের যে মূল্যায়ন করেছেন তার তুলনা মেলা ভার। তাঁরা লিখেছেন, “He [Gandhi] was a lawyer and lawbreaker, journalist and propagandist, a loyal subject of Empire and agitator, a fighter against discrimination and a racist, a man of principle and a dealmaker, and a passive resister yet a sergeant major”।


    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. Ashwin Desai, Goolam Vahed – The South African Gandhi: Stretcher-Bearer of Empire
    ২. G B Singh – Gandhi: Behind the Mask of Divinity
    ৩. George Paxton – Gandhi’s Wars
    ৪. Joseph Lelyveld – Great Soul: Mahatma Gandhi and His Struggle with India
    ৫. Nishikant Kolge – Was Gandhi a Racist? His Writings in South Africa
    ৬. Philip Sprat – Gandhism: An Analysis, Vol. I


    লিংক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    দ্বিতীয় পর্ব : গান্ধী ও ভারতের কৃষক-শ্রমিক — ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত


    ১৯১৪ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেও গান্ধী বোম্বাইতে পৌঁছন পরের বছর ৯ জানুয়ারি। সরাসরি ভারতে না এসে তিনি লন্ডনে উপস্থিত হন এবং ভারত সচিবের কাছে চিঠি লিখে সাম্রাজ্যের সেবায় বিনা শর্তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার বাসনা জ্ঞাপন করেন। যিনি নিজেই আত্মজীবনীতে লেখেন: “I make no distinction, from the point of view of ahimsa, between combatants and non-combatants. He who volunteers to serve a band of dacoits, by working as their carrier, or their watchman while they are about their business, or their nurse when they are wounded, is as much guilty of dacoity as the dacoits themselves. In the same way those who confine themselves to attending to the wounded in battle cannot be absolved from their guilt of war” (‘A Spiritual Dilemma’, Chapter 116, An Autobiography or The Story of My Experiments with Truth) সেই একই ব্যক্তি কীভাবে পুনরায় যুদ্ধে যেতে উন্মুখ হন তা বোঝা দুষ্কর! যাই হোক, শেষ অবধি প্লুরিসিতে আক্রান্ত গান্ধী সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে ভারতে ফিরে আসেন। গুরু গোখলের পরামর্শে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অবিচার-অত্যাচার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্য তিনি এবার ভারতের গ্রাম পরিভ্রমণ শুরু করেন। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে যোগদান করার পুরস্কার হিসাবে ততদিনে তাঁর ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক পাওয়া সারা।

    ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গোখলের মৃত্যুর পর তিলকই হয়ে ওঠেন কংগ্রসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং পরের বছরে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে চরমপন্থীরা পুনরায় মূল স্রোতে ফিরে এলে তিলক ও তাঁর অনুগামীরাই কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সিদ্ধান্তসমূহের ক্ষেত্রে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এই অধিবেশনে বিহারের জনৈক ধনী কৃষক তথা ছোট মহাজন রাজকুমার শুক্ল চম্পারণের কৃষিজীবীদের ওপর নীলকরদের চরম অত্যাচারের প্রসঙ্গটি অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানালে গান্ধী তীব্র আপত্তি জানান। পরিহাস এই, রাজকুমার শুক্লর অনুরোধে সেই একই গান্ধী জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকাকে পোক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯১৭ সালে বিহারের চম্পারণ হাজির হন। পরে আমরা দেখতে পাব, তিলক ‘Indian Unrest’-এর লেখক ভ্যালেন্টিন চিরলের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে ইংল্যান্ড গেলে ১৯১৯ সালের শেষদিকে গান্ধীই হয়ে উঠবেন কংগ্রেসের সর্বেসর্বা এবং পরের বছর অগস্টে তিলকের মৃত্যু ও ডিসেম্বরে জিন্নার কংগ্রেস ত্যাগের পরে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্ন করার লোকের সন্ধান পাওয়াও ক্রমশ দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে।

    যাই হোক, আমরা ফিরে আসি চম্পারণ প্রসঙ্গে। ১৮৬০ থেকেই চম্পারণে ‘তিনকাঠিয়া প্রথা’-র বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। নীলকররা জমিদারদের থেকে ঠিকাদারি ইজারা নিয়ে চাষিদের জমির একটা অংশে (বিঘা পিছু তিন কাঠা) অলাভজনক দামে নীল বুনতে বাধ্য করে। শেষে জার্মানির কৃত্রিম রঙের সঙ্গে মোকাবিলা না করতে পেরে ১৯০০ সাল নাগাদ নীল চাষ কমে যায়। তখন নীলকররা নীল চাষের দায় থেকে চাষিদের রেহাই দেওয়ার পরিবর্তে থোক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাষিদের ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা করলে ১৯০৫-০৮ এর মধ্যে মোতিহারি-বেতিয়া অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। চাষিদের তুলনামূলক সম্পন্ন একটা অংশ এবং বিহার কংগ্রেসের কিছু নেতা পরের দশক পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। রাজকুমার শুক্লের অনুরোধে ১৯১৭ সালের ১৫ এপ্রিল গান্ধী চম্পারণ পৌঁছন।

    সেখানে পৌঁছেই তিনি সংগ্রামী নীলচাষিরা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিলে তিনি নীলকরদের কাছ থেকে তাঁদের দাবি আদায় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। চাষিদের তরফ থেকে আশ্বাস পেয়ে তিনি নীলকর ও বিহারের উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের বোঝান যে, নীলচাষিদের সামান্য কিছু দাবি পূরণ করে এই সংগ্রাম মিটিয়ে ফেলা দরকার। অন্যথায় সারা বিহার জুড়ে কৃষক আন্দোলনের ঝড় উঠতে পারে এবং তার ফলে বিহারে জমিদারি প্রথা ও ইংরেজ শাসন বিপন্ন হতে পারে। নীলকরেরা গান্ধীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে। অবশেষে বিহারের ছোটলাটের সঙ্গে উপর্যুপরি চার-চারটি বৈঠকের পর জুলাই মাসে সরকারি আমলা ও কতিপয় নীলকর ছাড়া কৃষকদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধীকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। তদন্তের ভিত্তিতে নীলকররা ক্ষতিপূরণের অর্থ নীলচাষিদের ফেরত দিতে নীতিগত ভাবে সম্মত হন। তাঁরা ভেবেছিলেন, গান্ধী হয়তো পুরো অর্থই দাবি করবেন। কিন্তু তিনি পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষতিপূরণ দাবি করলে তাঁরা ২৫ শতাংশ দিতে রাজি হন। তাঁদেরকে অবাক করে দিয়ে গান্ধী ওই ২৫ শতাংশ অর্থ ফেরত নিতেই রাজি হয়ে যান এবং তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা উঠে যায়। তাঁর পরামর্শে নীলচাষিরা সংগ্রাম বন্ধ করে কাজে যোগ দেন। কৃষক সম্প্রদায়কে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে সামান্য চালকলা দিয়ে তাঁদের তুষ্ট রাখার এই শিক্ষাই গান্ধীকে পরবর্তীকালের ‘সত্যাগ্রহ’ সংগ্রামের অন্যতম প্রধান কর্মপন্থারূপে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা যোগায়।

    কিন্তু রাতারাতি কৃষকদের মসিহারূপে পরিগণিত গান্ধী আদৌ কি এঁদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন? সহজ উত্তর, না। ১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির যে বারদোলি প্রস্তাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার অনুমোদিত হয়েছিল, তার সাতটি ধারার মধ্যে অন্তত তিনটি ধারার উল্লেখ এখানে করলে কংগ্রেস তথা গান্ধীর কৃষক-বিরোধী চরিত্রটি আরও একবার উন্মোচিত হয়ে পড়ে। প্রস্তাবের দ্বিতীয় ধারায় সরকারকে বকেয়া কর পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়: “In view of the violent outbreaks every time mass civil disobedience is inaugurated, indicating that the country is not non-violent enough, the Working Committee of the Congress resolves that mass civil disobedience … be suspended, and instructs the local Congress Committees to advise the cultivators to pay land revenue and other taxes due to the Government, and to suspend every other activity of an offensive character”। জমিদারদের আশ্বাস দিয়ে যথাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম ধারায় বলা হয় “The Working Committee advises Congress workers and organisations to inform the ryots (peasants) that withholding of rent payment to the Zemindars (landlords) is contrary to the Congress resolutions and injurious to the best interests of the country” এবং “The Working Committee assures the Zemindars that the Congress movement is in no way intended to attack their legal rights, and that even where the ryots have grievances, the Committee desires that redress be sought by mutual consultation and arbitration”।

    ১৯৩১-৩২ সাল নাগাদ পদুকোটা, জম্মু-কাশ্মীর, পুলরা থেকে কৃষক সংগ্রাম যখন সারা ভারতে ছড়াচ্ছে সেই সময় গান্ধী গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে ইংল্যান্ড যান। ইংল্যান্ড থেকে এই বিদ্রোহের বিরোধিতা ও সামন্তপ্রভুদের সমর্থন করে তিনি ঘোষণা করেন, “Even up to now the Congress has endeavoured to serve the Princes of India by refraining from any interference in their domestic and internal affairs” (CWMG ৫৩/৩৬১)। আবার ২৫ জুলাই, ১৯৩৪ জমিদারদের আশ্বাস দিয়ে বলেন — “ন্যায্য কারণ ছাড়া সম্পত্তির মালিক শ্রেণীদের তাদের সম্পত্তির থেকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাদের হৃদয় পরিবর্তন করা যাতে তোমরা তোমাদের সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের প্রজাদের অছি হিসাবে রাখতে পার এবং মুখ্যত তাদের কল্যাণে তা ব্যবহার কর। ... আমি কাজ করছি মালিক ও শ্রমিক এবং জমিদার ও প্রজার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগের জন্য। ... আমার স্বপ্নের রামরাজ্য রাজা ও নিঃস্ব উভয়ের অধিকার সুনিশ্চিত করতে চায়। ... স্বাধীনতার শান্তিতে থাকার চেয়ে বড় কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রজাদের নেই এবং তারা তোমাদের সম্পত্তি নিয়ে কখনও ঈর্ষা করবে না যদি তোমরা তা তাদের জন্য ব্যবহার কর (CWMG ৬৪/২৩০-৩২)।” মনে রাখতে হবে, সে সময় ভারতে ছিল পাঁচশোরও বেশি দেশীয় রাজ্য এবং এই অতিকায় সামন্তপ্রভুদের শোষণ-উৎপীড়নের নাগপাশে আবদ্ধ ছিলেন প্রায় দশ কোটি কৃষক।

    সর্বোপরি কৃষকদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি যে মত প্রকাশ করেন তা প্রায় বাঁধিয়ে রাখার মতো! গান্ধী ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ, লেখেন: “A peasant earns his bread honestly. He has ordinary knowledge of the world. He knows fairly well how he should behave towards his parents, his wife, his children and his fellow villagers. He understands and observes the rules of morality. But he cannot write his own name. What do you propose to do by giving him a knowledge of letters? Will you add an inch to his happiness? Do you wish to make him discontented with his cottage or his lot? And even if you want to do that, he will not need such an education. Carried away by the flood of western thought we came to the conclusion, without weighing pros and cons, that we should give this kind of education to the people”। হয়তো এই কারণেই যে রাজেন্দ্রপ্রসাদ চম্পারণের ইংরেজ জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে গান্ধীর সত্যাগ্রহে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, ঘটনার ২০ বছর পরে তাঁরই প্রত্যক্ষ মদতে তাঁর সন্তানেরা চম্পারণের একরের পর একর উর্বর জমি আত্মসাৎ করেছিল!

    চম্পারণে কৃষকদের বিশ্বাস আদায় করার পর তিনিই যে ভারতীয় শিল্পপতিদের অকৃত্রিম বন্ধু ও যোগ্যতম প্রতিনিধি, তা বোঝাতে গান্ধী ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ জুড়ে চলা আমেদাবাদের কাপড়কলগুলির শ্রমিক ধর্মঘটকে বেছে নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় শিল্পপতিরা তাদের যুদ্ধকালীন সুযোগসুবিধা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পেছনে এসে দাঁড়ায়। আমেদাবাদের বস্ত্রশিল্প চূড়ামণি আম্বালাল সারাভাই-এর কাছ থেকে সাবরমতী আশ্রম মোটা আর্থিক অনুদান পায়, তাঁর বোন অনসূয়া বেন গান্ধীর শিষ্যায় পরিণত হন। শুধু তাই নয়, ১৯২১ সালে গান্ধী যখন ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’-এর জন্য ১ কোটি টাকা চাঁদা তোলার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেন, তখন তার মধ্যে কেবলমাত্র বোম্বাইয়ের অবদান ছিল কম করেও সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে শিল্পপতিদের এই গাঁটছড়া দেখতে পেয়ে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘Gandhism and the Labour-Peasant Problem’ প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছিলেন: “Whenever there is unrest among the workers the mill owners of Ahmedabad are in the habit of requisitioning Mahatma Gandhi to use his influence to settle the disputes. With the consent and support of Gandhiji, some of his followers had taken upon themselves the task of organising the workers into unions. The poor workers, unconscious of their class interests, have readily fallen prey to this clever move”।

    যে পরিস্থতিতে গান্ধী আমেদাবাদের ধর্মঘটে হস্তক্ষেপ করেন, সেটি ছিল একান্তভাবেই গুজরাটের মিলমালিক ও তাঁদের শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। আমেদাবাদের মিলমালিকরা স্বল্প সময়ের জন্য দেওয়া ৭০% প্লেগ বোনাসের বদলে যুদ্ধের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে শ্রমিকদের ২০% মজুরিবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রমিকরা ৫০% বেতনবৃদ্ধির দাবিতে অটল থাকেন। মালিকরা সেই দাবি না মেনে লকআউট ঘোষণা করে। অসন্তুষ্ট শ্রমিকরা হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করলে গান্ধী এইবার আসরে অবতীর্ণ হন। প্রথমে তিনি শ্রমিকদের ৩৫% বেতনবৃদ্ধি যথেষ্ট বলে মধ্যস্ততা করেন এবং তাতেও কাজ না হওয়ায় শ্রমিকদের কারখানায় জঙ্গী পিকেটিংকে নিষিদ্ধ করার কৌশল হিসাবে তিনি ১৫ মার্চ অনশনে বসেন। টানা ২৫ দিন শ্রমিকদের ধর্মঘটের পরে অবশেষে গান্ধীর অনশনের ফলে শ্রমিকদের মজুরি ৩৫% বাড়ে। গান্ধীর এই অনশনকে ‘শ্রমিকদের ভাঙা মনকে চাঙ্গা করার সার্থক প্রচেষ্টা’ বলে বর্ণনা করা হলেও জুডিথ ব্রাউন জেলাশাসকের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে, শ্রমিকরা মিলমালিকদের সঙ্গে দহরম-মহরমের জন্য গান্ধীকে প্রচণ্ড অপমান করেছিলেন।

    রাসকিন শোষক ও শোষিতের মধ্যে দ্বন্দ্বের বদলে সহযোগিতার কথা বলেছেন, আর গান্ধী সেই দাওয়াইটিকে ‘ধন্বন্তরির দান’ বলে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই মানসিকতার প্রতিফলন আমরা যেমন কৃষক ও জমিদারদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে দেখতে পাই, হুবহু তাই দেখতে পাই শ্রমিক ও মালিকদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার ছবি তিনি তুলে ধরেন ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকার ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯২০ সংখ্যায় — “If on the other hand they take their stand on pure justice and suffer in their person to secure it, not only will they always succeed but they will reform their masters, develop industries and both master and men will be as members of one and the same family”। ওই একই পত্রিকায় তিনি লেখেন: “...যখন কারখানার শ্রমিকরা কারখানার মালিকের সঙ্গে নিজেকে এবং নিজের স্বার্থকে এক করে দেখতে শিখবে, নিজেকে উন্নত করতে শিখবে, তখন তারা আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের কলকারখানা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।”

    শ্রমিক শ্রেণি যাতে ধর্মঘট করে বা বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়ে মালিকদের বেকায়দায় না ফেলতে পারে, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সর্বদা সতর্ক ও সচেতন। এই কারণেই ১৯২১ সালে রেলওয়ে এবং বাষ্পীয় জাহাজ শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “In India we want no political strikes. ...We must gain control over all the unruly and disturbing elements, or isolate them. ...We seek not to destroy capital or capitalists, but to regulate the relations between capital and labour. We want to harness capital to our side. It would be folly to encourage sympathetic strikes” (CWMG ২৩/২৮৫)। না, এখানেই তিনি থেমে থাকতে চাননি! বরং শোষকদেরই শোষিতদের অছি বা ট্রাস্টি হিসেবে দেখতে চেয়ে তিনি বলেন — “My attitude would be to convert the better-off classes into trustees of what they already possessed. That is to say, they would keep the money, but they would have to work for the benefit of the people who procured them their wealth. And for doing this they would receive a ‘commission’” (CWMG ৫৪/১০২-০৩)।

    দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন গান্ধী, তেমনই ভারতীয় কৃষক-শ্রমিকদের শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কেও তিনি ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। শুধু তাই নয়, ভারতের জনসাধারণের এই বিপুল অংশকে তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই সতর্ক থেকেছেন এবং প্রায় এড়িয়ে গেছেন। যখনই তাঁরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, প্রায় প্রতিটি সময়েই হিংসার অনুপ্রবেশের অছিলায় তিনি সেই আন্দোলনকে হয় আটকে দিয়েছেন কিংবা স্থগিত করেছেন অসীম দক্ষতায়।

    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ২. সৈয়দ শাহেদুল্লাহ – লেনিনবাদীর চোখে গান্ধীবাদ
    ৩. Philip Sprat – Gandhism: An Analysis, Vol. II
    ৪. Rammanohar Lohia – Guilty Men of India’s Partition
    ৫. R Palme Dutt – India To-Day
    ৬. Vinay Lal – The Gandhi Everyone Loves to Hate

    তৃতীয় পর্ব আগামী সপ্তাহে ...

    লিংক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    তৃতীয় পর্ব : গান্ধী ও অসহযোগ — সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের উন্মেষ


    ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সরকার বুঝতে পারে, ভারতবাসীর লোকবল ও অর্থবল ছাড়া যুদ্ধজয় অসম্ভব। সরকার-বিরোধী আন্দোলন প্রশমন এবং যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ১৯১৭ সালে ভারত-সচিব মন্টেগু যুদ্ধশেষে ভারতকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বড়লাট চেমসফোর্ড ও মন্টেগুর যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯-এ পাশ হয় ভারত শাসন আইন যা ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার’ নামে পরিচিত। এই শাসন সংস্কারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করা হয়। কেন্দ্রের হাতে থাকে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, রেলপথ, ডাকব্যবস্থা, শুল্ক ও মুদ্রা। আর প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, রাজস্ব, যোগাযোগ প্রভৃতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও এই আইন দেশবাসীর আশা পূর্ণ করতে পারেনি কারণ এই আইনের সাহায্যে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তনই সাধিত হয়নি।

    একই সময়ে ভারতে সমস্ত রকমের রাজনৈতিক আন্দোলন ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ দমনের জন্য ১৯১৯-এর ১৮ মার্চ কুখ্যাত রাওলাট আইন জারি করা হয়। এই স্বৈরাচারী আইনটির বিরুদ্ধে গান্ধী ৩০ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। যদিও পরে তারিখ পাল্টিয়ে ৬ এপ্রিল ধার্য করা হয়। প্রসঙ্গত, এই সত্যাগ্রহকে সফল করে তোলার জন্য তিনি জনসমর্থনের অপেক্ষা করেননি, এমনকি জাতীয় কংগ্রেসের মুখাপেক্ষীও থাকেননি। সাবরমতী আশ্রমের বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নাইডু, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক সহ মাত্র জনা বিশেক একান্ত অনুগামীদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এই ধর্মঘট ডাকেন। সঠিক সময়ে খবর না পাওয়ায় ৩০ মার্চই দিল্লি, মুলতান, লাহোর ও অমৃতসরে ধর্মঘট পালিত হয়।

    ১০ এপ্রিল পাঞ্জাবের দুই জনপ্রিয় নেতা সত্যপাল ও সৈফুদ্দিন কিচলুকে গ্রেফতার করলে পাঞ্জাবে ঝড়ের সূত্রপাত হয়। অহিংস জনতা ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনারের কাছে ওই দুই নেতাকে মুক্ত করার আবেদন জানাতে তাঁর বাসস্থানের দিকে গেলে সেনা গুলি চালায়। তাতে আহত ও নিহত মানুষদের দেখে উত্তেজিত জনতা পোস্ট অফিস, ব্যাংক ও রেলস্টেশনে আগুন লাগায় এবং চারজন নিরীহ ইংরেজকে হত্যা করে। ওই দিনই দুপুরে দিল্লির কাছে পালওয়াল স্টেশনে গান্ধীর গ্রেফতারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়া মাত্র লাহোরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। গান্ধী ও পাঞ্জাবের নেতৃদ্বয়ের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অমৃতসর শহরে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের হলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়, অন্ততপক্ষে ২০ জন নিহত ও ১৫০ জন আহত হন। সামরিক শাসনকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার ১২ এপ্রিল সামরিক শাসন জারি না করেই অমৃতসর শহরের অসামরিক কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। শুরু হয় সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং যথেচ্ছভাবে গ্রেফতার। ১৩ এপ্রিল ঘটে জালিয়ানওয়ালা বাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যেখানে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যাই ছিল ৩৭৯ জন।

    এই নারকীয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পরে খবর পান রবীন্দ্রনাথ। আইন ভঙ্গ করে গান্ধী ও তিনি পাঞ্জাবে একসঙ্গে প্রবেশ করে প্রতিবাদ জানাবেন এমন প্রস্তাব জানিয়ে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে পাঠান গান্ধীর কাছে। গান্ধী বলে দেন, “I do not want to embarrass the Government now”। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর নাইট উপাধি বর্জন করছেন, অননুকরণীয় ভাষায় লিখছেন — ‘... কোনো চিহ্নের দ্বারা পাঞ্জাবের এই ঘটনা চিরস্মরণীয় করা আমাদের পক্ষে গৌরবের নয়’, তখন গান্ধী জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে গিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে মনোযোগী হতে বলে লিখছেন: “The best way of checking hatred, therefore, is to teach the nation to isolate the memory of the dead, which is a sacred trust, from the ‘frightfulness’ which should be forgiven if it cannot be forgotten” (CWMG, ২০/২০৬)। এবং রাওলাট আইনের প্রতিবাদে তাঁর সত্যাগ্রহ কর্মসূচীতে হিংসার প্রবেশ দেখে একে ‘Himalayan blunder’ বলে অভিহিত করে ১৮ এপ্রিল তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।

    জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পাক্কা চারমাস পরে ২৪ অগস্ট কংগ্রেস তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গোটা পাঞ্জাবে নিহত হয়েছিলেন মাত্র ৪ জন ইংরেজ আর ভারতীয় মারা গিয়েছিলে অন্ততপক্ষে ১২০০ জন। অথচ ভারতীয়দের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে ধিক্কার না জানিয়ে গান্ধী বলেন, “But the slow torture, degradation and emasculation that followed was much worse, more calculated, malicious and soul killing, and the actors who performed the deeds deserve greater condemnation than General Dyer for the Jallianwala Bagh massacre” (CWMG, ২১/৪৭)। বলা বাহুল্য, রাওলাট আইন কিন্তু বাতিল হয়নি।

    এদিকে ভারতীয় রাজনীতিতে এক পরিবর্তন ঘটে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অধিকাংশ তীর্থস্থানগুলি ছিল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। তুরস্কের সুলতানকে সমস্ত মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে যাতে একটি সর্ব-ঐস্লামিক (প্যান-ইসলামিক) আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উৎসাহ যোগাতে থাকে। কিন্তু ১৯২০ সাল নাগাদ কামাল আতার্তুক তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করে। ভারতীয় মুসলমানরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। ওই বছরেরই মার্চ মাসে প্যারিসে মহম্মদ আলি কূটনীতিকদের কাছে এই আন্দোলনের যে তিনটি কেন্দ্রীয় দাবি হাজির করেন সেগুলি হল: ক) মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলির নিয়ন্ত্রণ যেন অবশ্যই তুরস্কের সুলতান অর্থাৎ খলিফার হাতে থাকে; খ) খলিফা যাতে ইসলামি ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষা করতে পারেন তার জন্যে তাঁকে যেন পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়া হয় এবং গ) জাজিজার-উল-আরব অর্থাৎ আরব-সিরিয়া-ইরাক-প্যালেস্তাইন যেন অবশ্যই মুসলিম সার্বভৌমত্বের অধীনে থাকে।

    আন্দোলনকে সফল করতে ১৯১৯-এর ২২-২৩ নভেম্বর দিল্লিতে সারা ভারত খিলাফত সম্মেলনে আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের তরফ থেকেই সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অসহযোগের ডাক তোলা হয়। ১৯২০ সালের ১-৩ জুন অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির এলাহাবাদ সভায় গান্ধী তাঁদের সমর্থন করেন। ‘পাঞ্জাব অন্যায়’, ‘খিলাফত অন্যায়’ ও ‘স্বরাজ’ — এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি সংযুক্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য গান্ধী কংগ্রেসের ওপর চাপ দিতে শুরু করেন। ২৬ মে, ১৯২০-তে ইয়ং ইন্ডিয়ায় তিনি লেখেন, “… by helping the Mohammedans of India at a critical moment in their history, I want to buy their friendship” আর সেপ্টেম্বরে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে তিনি প্রথম ঘোষণা করেন ‘Swaraj in one year’।

    পরের বছর গান্ধী যখন লিখছেন: “…swaraj was a certainty inside of twelve months. If the atmosphere of non-violence is truly established, I make bold to say that we shall achieve the substance even during the remaining days of this year, though we might have to wait for the form yet a while” (CWMG, ২৫/২৫৪); তার ঢের আগে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নাগপুর কংগ্রেসের সম্মেলনে জিন্না রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের এই অশুভ আঁতাতের ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯১৬ সালের লখনউ কংগ্রেসে জিন্না তিলকের সঙ্গে যৌথ ভাবে লখনউ চুক্তি সম্পাদনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। চুক্তির প্রস্তাব লেখেন জিন্না এবং এই লখনউ চুক্তিই হিন্দু প্রাধান্যযুক্ত কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম লিগের আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর ক্ষেত্রে সহমত প্রকাশ করে। নাগপুর কংগ্রেসের সভায় জিন্না গান্ধীকে অভিযুক্ত করে লেখেন, “Your methods have already caused split and division in almost every institution that you have approached hitherto, and in the public life of the country not only amongst Hindus and Muslims but between Hindus and Hindus, and Muslims and Muslims, and even between fathers and sons”। অবশেষে খিলাফতের বিরোধিতা করে জিন্না কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় আর কখনও সেই দলে ফিরে আসেননি।

    আসলে, গান্ধী যেভাবে অসহযোগ আন্দোলনে দেশের মুসলমানদের নেওয়ার জন্য জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করেছিলেন, তার যৌক্তিকতা ও সার্থকতা সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কারণ, খিলাফত ছিল আন্তর্জাতিক মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যার সঙ্গে ভারতের জাতীয় জীবনের কোনও স্বার্থই জড়িত ছিল না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অগস্টে তিলকের মৃত্যুর পর গান্ধীই হয়ে ওঠেন কংগ্রেসের সর্বেসর্বা। তাই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, অসহযোগ আন্দোলন সম্পূর্ণত গান্ধী পরিকল্পিত-ঘোষিত-নিয়ন্ত্রিত এবং আকস্মিকভাবে একক সিদ্ধান্তে প্রত্যাহৃত এক আন্দোলনের অন্য নাম এবং এই আন্দোলন থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে ‘গান্ধী যুগ’-এর শুরু। খিলাফত প্রতিষ্ঠা, পাঞ্জাবের অত্যাচারের প্রতিকার এবং এক বছরের মধ্যে স্বরাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গান্ধী যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন তার কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করা হয় — সরকারি খেতাব ও উপাধি, সরকারি স্কুল-কলেজ, পুলিশ-সেনাবাহিনী-আদালত ও সরকারি চাকরি এবং বিলিতি পণ্য বিশেষত বস্ত্র বয়কট।

    উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির ভারতীয়দের কাছে বয়কটের আহ্বান তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। মার্চ ১৯২১ অবধি ওকালতি ছেড়েছিলেন মাত্র ১৮০ জন আইনজীবী আর মোট ৫১৮৬টি খেতাবের মধ্যে মাত্র ২৪টি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু জাতীয় বিদ্যালয় ও কলেজ খোলা হয়েছিল বটে, কিন্তু এক বছরের মধ্যে স্বরাজ না আসায় তার অনেকগুলোই পাকাপাকিভাবে উঠে যায়। তবে আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন যে শ্রমিক ও কৃষকরা, গান্ধী তাঁদের ধর্তব্যেই আনেননি! গোটা ১৯২১ সাল জুড়ে শ্রমিকরা মোট ৩৯৬টি ধর্মঘট করেছিলেন, যুক্ত ছিলেন ৬ লাখ শ্রমিক এবং শ্রমদিবস নষ্টের পরিমাণ ছিল ৭০ লাখ দিন। কিছু কিছু ধর্মঘটে আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতারা, বিশেষত বাংলা ও মাদ্রাজে, সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে গান্ধীর অবস্থান ছিল দ্ব্যর্থহীন। ১৯২১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়ং ইন্ডিয়া-র ‘স্ট্রাইক’ নামক প্রবন্ধে তিনি জানান, ‘ধর্মঘট অহিংস অসহযোগের পরিকল্পনার আওতায় পড়ে না’। একই পত্রিকায় ‘দ্য লেসন অফ আসাম’ লেখাটিতে তিনি এ-ও বলেন: “In India we want no political strikes. … We must gain control over all the unruly and disturbing elements … We seek not to destroy capital or capitalists, but to regulate the relations between capital and labour. We want to harness capital to our side. It would be folly to encourage sympathetic strikes” (CWMG, ২৩/২৮৫)।

    আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে ঘটে মুসলমান কৃষকদের মোপলা বিদ্রোহ। ১৯১৬ থেকেই মালাবার উপকূলের দু’টি তালুকে (এরনাদ ও ওয়ালুতভানাদ) যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, ১৯২০-র এপ্রিলে মানজেরি সম্মেলনের পর খিলাফত আন্দোলনের নেতারা সেই বিক্ষোভকে নিজেদের হাতে তুলে নেন। ১৯২১ সালের ২০ অগস্ট অস্ত্রের তল্লাশি করার জন্য তিরুরঙ্গাভি মসজিদে পুলিশ অভিযান চালালে তার প্রতিবাদে পুলিশ চৌকি, সরকারি দফতর এবং অত্যাচারী হিন্দু ভূস্বামীদের বাড়িতে ব্যাপক হামলা হয়। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মোপলারা তালুক দুটো সম্পূর্ণ দখল করে সেখানে নিজেদের স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। এর পরে সরকার ট্যাংক, মেশিনগান ও বিমান থেকে অবিরাম গোলাগুলি এবং বোমাবর্ষণ করলে প্রায় আড়াই হাজার মোপলা মারা যান। এই বিদ্রোহকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী ‘হিন্দুবিরোধী বিদ্রোহ’ হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও ঐতিহাসিক সুমিত সরকার মোপলা বিদ্রোহকে নিছকই হিন্দু হত্যা অভিযান হিসাবে মেনে নেননি। বরং তাঁর মতে, এটি ছিল ‘এক বিশাল সশস্ত্র সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বিদ্রোহ’ যাকে নির্মমভাবে দমন করার ফলে ২৩৩৭ জন বিদ্রোহী নিহত, ১৬৫২ জন আহত এবং কম করেও ৪৫ হাজার জন বন্দী হন। এত জন বিদ্রোহীর মৃত্যুতেও অবিচলিত গান্ধী বলেন, “We must not betray any mental or secret approval of the Moplahs. We must see clearly, that it would be dishonourable for us to show any approval of the violence. … We have undertaken to do no violence even under the most provoking circumstances. … The misguided Moplahs have therefore rendered a distinct disservice to the sacred cause of Islam and swaraj” (CWMG, ২৪/১৮৯)।

    অসহযোগ আন্দোলনের একেবারে শেষ পর্যায়ে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই গান্ধী ছাড়া কংগ্রেস ও খিলাফতের প্রায় সমস্ত নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। এই মাসের শেষ দিকে আমেদাবাদে হাকিম আজমল খাঁ-র সভাপতিত্বে (নির্বাচিত সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাস জেলে বন্দী থাকার কারণে) শুরু হয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। উৎসাহী জনসাধারণ আশা করেছিলেন যে, এই অধিবেশন থেকেই আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ হিসাবে কর বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হবে। কিন্তু দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ কৃষকরা কর বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে খাজনা বন্ধের আন্দোলন চালু করলে তার রাশ টানা অসম্ভব হবে বুঝতে পেরে অধিবেশনের মূল প্রস্তাবে কর বন্ধ প্রসঙ্গে গান্ধী সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। অধিবেশনের আগে রায়বেরিলিতে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের গণবিদ্রোহকে শান্ত করতে রায়তদের নির্দেশ দিয়ে তিনি ১৮ মে, ১৯২১ লিখেছিলেন, “Whilst we will not hesitate to advise the kisans when the moment comes to suspend payment of taxes to the Government, it is not contemplated that at any stage of non-co-operation we would seek to deprive the zemindars of their rent. The kisan movement must be confined to the improvement to the status of the kisans and the betterment of the relations between the zemindars and them. The kisans must be advised scrupulously to abide by the terms of their agreement with the zemindars, whether such agreement is written or inferred from custom” (CWMG, ২৩/১৫৮)। এই অধিবেশনেও তাঁর নির্দেশে জমিদারগোষ্ঠীকে অভয় দিয়ে ঘোষণা করা হয়, “তাদের [জমিদারদের] বৈধ অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করবার কোনও ইচ্ছাই কংগ্রেস আন্দোলনের নেই। কৃষকগণ কর্তৃক জমিদারদের খাজনা বন্ধ করা কংগ্রেস প্রস্তাবের বিরোধী এবং মৌলিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর।”

    আসলে অসহযোগ আন্দোলন যে পর্বতের মূষিকপ্রসব হতে চলেছে তা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসেই তিনি তা কবুল করে বলেন, “… I do consider the idea of the Conference for devising a scheme of full swaraj premature. India has not yet incontestably proved her strength” (CWMG, ২৫/৪৭০)। তিনি যে কোনও উপায়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করার একটা ছুতো খুঁজছিলেন। চৌরিচৌরার ঘটনা তাঁকে সেই প্রার্থিত ‘এসকেপ রুট’ এনে দেয়। যুক্তপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে মদ বিক্রি ও খাদ্যশস্যের চড়া দামের বিরোধিতা করে একদল স্বেচ্ছাসেবক ধর্না শুরু করেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের নেতা ভগবান আহিরকে পুলিশ গ্রেফতার করলে ক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালালে ক্ষিপ্ত জনতা থানায় অগ্নিসংযোগ করে। মারা যান দারোগাসহ ২২ জন পুলিশ। রাওলাট সত্যাগ্রহের মতো এবারও আন্দোলনে হিংসার অনুপ্রবেশের অজুহাতে গান্ধী ১২ ফেব্রুয়ারি বারদোলিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ডাকা জরুরি বৈঠকে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা করেন। যদিও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় চৌরিচৌরার ঘটনাকে তিনি ঈশ্বর-পরিকল্পিত বলেছিলেন, কারণ এই ঘটনা তাঁকে ‘anarchy and chaos throughout the country’-র হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। প্রসঙ্গত, দায়রা আদালত প্রথমে ২২৫ জন অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অন্তত ১৭২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় (শেষ অবধি ১৯ জনকে ফাঁসি এবং বাকিদের দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়) যদিও ১৭২ জনের জীবননাশের এই বর্বর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গান্ধী বা অন্য জাতীয়তাবাদী নেতারা কোনও প্রতিবাদই করেননি।

    চৌরিচৌরার ঘটনার প্রেক্ষিতে গান্ধীর এহেন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদস্বরূপ মতিলাল নেহরু, লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ জেল থেকে সুদীর্ঘ ও ক্রোধান্বিত চিঠি লিখলে গান্ধীর শীতল উত্তর ছিল জেলে বন্দি ব্যক্তিগণ ‘রাজনীতিতে মৃত’ এবং কর্মপন্থা সম্পর্কে কোনও কিছু বলার দাবি করতে পারেন না। চৌরিচৌরার ঘটনাকে ছুতো করে গান্ধী যেভাবে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনে রাশ টানেন, তার তীব্র বিরোধিতা করে নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন: “We were angry when we learned of this stoppage of our struggle at a time when we seemed to be consolidating our position and advancing on all fronts. But our disappointment and anger in prison could do little good to anyone; civil resistance stopped, and non-cooperation wilted away”। সুভাষও ‘The Indian Struggle 1920-1942’ গ্রন্থে একই সমালোচনার সুরে লেখেন — “To sound the order of retreat just when public enthusiasm was reaching the boiling point was nothing short of a national calamity. The principal lieutenants of the Mahatma, Deshbandhu Das, Pandit Motilal Nehru and Lala Lajpat Rai, who were all in prison, shared the popular resentment. I was with the Deshbandu at the time, and I could see that he was beside himself with anger and sorrow”। খিলাফত আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরাও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।

    যে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের অভূতপূর্ব ঐক্য সম্মিলিত হয়েছিল, সেই একই আন্দোলনের আচমকা প্রত্যাহারে দেশ জুড়ে শুরু হয় অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ১১২টি দাঙ্গায় প্রায় ৪৫০ জন মারা যান, আহত হন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। গান্ধীর একতরফা সিদ্ধান্তের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে সাম্প্রদায়িকতা, তা উপলব্ধি করে নেহরু লিখেছিলেন: “It is possible that this sudden bottling-up of a great movement led to a tragic development in the country. The suppressed violence had to find a way out, and in the following years this perhaps aggravated the communal trouble”। রবীন্দ্রনাথও ব্যথিত চিত্তে লেখেন, “ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কী বীভৎস হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বেশ বোঝা যায়।” যে আন্দোলনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে উঠেছিল, তার এহেন নৈরাশ্যজনক সমাপ্তি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে ২৫টা বছর পিছিয়ে দেয়।


    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. নরহরি কবিরাজ (সম্পাদিত) – অসমাপ্ত বিপ্লব, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
    ২. সুপ্রকাশ রায় – ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম (১৮৯৩-১৯৪৭)
    ৩. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৪. Leonard A. Gordon – Brothers Against the Raj
    ৫. Philip Sprat – Gandhism: An Analysis, Vol. II
    ৬. Stanley Wolpert – Jinnah of Pakistan

    চতুর্থ পর্ব আগামী সপ্তাহে ...

    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    চতুর্থ পর্ব : গান্ধী ও অহিংসা — ছিন্ন করো ছদ্মবেশ


    এর আগের পর্বে আমরা দেখেছি, যখনই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত গণসংগ্রাম চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে তখনই গান্ধী সেই আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়ে অহিংসার ধুয়ো তুলেছেন। কিন্তু সারা জীবন তাঁর কার্যক্রম কিংবা অসংখ্য বাণী আমরা যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব তথাকথিত ‘অহিংসা’ নিয়ে গান্ধী বা তাঁর অনুগামীদের উচ্চগ্রামের ঢক্কানিনাদ কতটা অসার, কতটা মোহ আবরণ। শুধু তাই নয়; যে গান্ধী হিংসায় নিহত শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে সতত সোচ্চার, সেই একই ব্যক্তি অগণিত ভারতীয়ের মৃত্যুতে নিয়ত নিস্পৃহ।

    যুদ্ধ এবং যুদ্ধজনিত হিংসা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে যে গান্ধী লেখেন: “I draw no distinction between those who wield the weapons of destruction and those who do Red Cross work. Both participate in war and advance its cause. Both are guilty of the crime of war” (ইয়ং ইন্ডিয়া, ১৩-৯-১৯২৮); সেই তিনিই ‘Satyagraha in South Africa’ গ্রন্থে এ বিষয়ে তাঁর প্রকৃত মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করে ফেলেন এ কথা লিখে — “Our existence in South Africa is only in our capacity as British subjects. In every memorial we have presented, we have asserted our rights as such. We have been proud of our British citizenship, or have given our rulers and the world to believe that we are so proud. Our rulers profess to safeguard our rights because we are British subjects, and what little rights we still retain, we retain because we are British subjects”। ওই একই গ্রন্থে তিনি ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে ভারতীয়দের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে খোলাখুলি সমর্থন জানিয়ে আরও লেখেন, “And if we desire to win our freedom and achieve our welfare as members of the British Empire, here is a golden opportunity for us to do so by helping the British in the war by all means at our disposal”। মনে রাখতে হবে, ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এই গ্রন্থ এবং সেই বইটিতে উদ্ধৃত বাক্যবন্ধটি সংশোধনের কোনও প্রচেষ্টাই তিনি করেননি।

    প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ দিকে যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অংশগ্রহণের জন্য ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৮ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে যে যুদ্ধ সম্মেলন আহ্বান করেন, সেখানে তিনি গান্ধীকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। তিলক ও আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে সম্মেলনে না ডাকার কারণে গান্ধী এ ব্যাপারে প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। শেষে চেমসফোর্ডের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের পরে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে তিনি ওই সম্মেলনে উপস্থিত হন এবং ইংরেজদের যুদ্ধ প্রচেষ্টা সমর্থন করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ইংরেজদের সাহায্য করার জন্য ভারতের জনসাধারণকে আহ্বান করেন। সম্মেলনের পরে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ভাইসরয়কে তিনি জানান: “I recognize that, in the hour of its danger, we must give, — as we have decided to give — ungrudging and unequivocal support to the Empire, of which we aspire, in the near future, to be partners in the same sense as the Dominions overseas. But it is the simple truth that our response is due to the expectation that our goal will be reached all the more speedily… I would make India offer all her able-bodied sons as a sacrifice to the Empire at its critical moment; and I know that India by this very act would become the most favoured partner in the Empire and racial distinctions would become a thing of the past” (CWMG, ১৭/৭-৮)।

    ২৯ এপ্রিল লর্ড চেমসফোর্ডকে লেখা ওই একই চিঠিতে তিনি আরও জানান — “In Champaran, by resisting an age-long tyranny, I have shown the ultimate sovereignty of British justice. In Kaira, a population that was cursing the Government now feels that it, and not the Government, is the power when it is prepared to suffer for the truth it represents. It is, therefore, losing its bitterness and is saying to itself that the Government must be a Government for the people, for it tolerates orderly and respectful disobedience where injustice is felt. Thus, Champaran and Kaira affairs are my direct, definite, and special contribution to the war”।

    এই প্রসঙ্গে গান্ধীর তৃতীয় সত্যাগ্রহটি সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করে নেওয়া জরুরি। খারাপ ফসলের দরুন খাজনা মকুবের জন্য চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাপরভঞ্জ তালুকের মোহনলাল পান্ড্যর মতো আঞ্চলিক নেতাদের তরফ থেকে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে গান্ধীকে গুজরাটের খেড়া জেলাতে আহ্বান জানানো হয়। বিস্তর টালবাহানার পরে গান্ধী পরের বছর ২২ মার্চ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। কিন্তু তার আগেই খেড়ার চাষিদের খাজনা জমা দিতে বাধ্য করা হয় এবং সেই বছর ভালো রবি শস্যের ফলন খাজনা মকুবের বিষয়টিকে কমজোরিও করে দেয়। পরিণামে ভারতের প্রথম প্রকৃত কৃষক সত্যাগ্রহ খেড়ার ৫৫৯টি গ্রামের মধ্যে মাত্র ৭০টিতে ছাপ ফেলতে সক্ষম হয় ও নামমাত্র ছাড় পেয়েই জুন মাসে এই সত্যাগ্রহ তুলে নিতে হয়।

    এই সত্যাগ্রহে চেমসফোর্ডের সঙ্গে গান্ধী খেড়ার বিষয়ে দর কষাকষি শুরু করেন। খেড়াতে সরকার সম্মানজনক সন্ধিতে রাজি হলে তিনি যুদ্ধের জন্য ‘recruiting agent-in-chief’ হিসেবে ব্রিটিশ সেনাদলে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রচারকাজ চালাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সরকার এই প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পরে গান্ধী পূর্ণ উদ্যমে খেড়ার গ্রামগুলি থেকে সৈন্য সংগ্রহে নেমে পড়েন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রায় ১১ লক্ষ ভারতীয় সেনা, তার পরেও গান্ধী সেনা সরবরাহের দায়িত্ব কেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তার উত্তর মেলা ভার।

    দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যে হাস্যকর যুক্তিজাল বিস্তার করেছিলেন গান্ধী, হুবহু একই যুক্তি দেখিয়ে ২২ জুন নাদিয়াদের এক জনসভায় তিনি বলেন, “As long as we have to look to Englishmen for our defence, as long as we are not free from the fear of the military, so long we cannot be regarded as equal partners with Englishmen. It behoves us, therefore, to learn the use of arms and to acquire the ability to defend ourselves. … There can be no friendship between the brave and the effeminate. We are regarded as a cowardly people. If we want to become free from that reproach, we should learn the use of arms” (CWMG, ১৭/৮৩)। ওই একই সভায় খেড়ার কৃষিজীবীদের ব্রিটিশদের সমর্থন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি যুক্তি দেন — “Partnership in the Empire is our definite goal. We should suffer to the utmost of our ability and even lay down our lives to defend the Empire. If the Empire perishes, with it perish our cherished aspirations. Hence the easiest and the straightest way to win swaraj is to participate in the defence of the Empire” (CWMG, ১৭/৮৪)। ৯ জুলাই নাদিয়াদ থেকেই জিন্নাকে ভারতীয় মুসলমানদেরও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে তিনি লেখেন: “What a proud thing it would be if we recruited and, at the same time, insisted on amendments in the Reform Scheme!” (CWMG, ১৭/১২৫)।

    এই ‘মর্যাদাসূচক’ গোলামির জন্য গান্ধী অজস্র ভারতবাসীকে সাম্রাজ্যবাদী কামানের খোরাক বানাতেও দ্বিধা করেননি। ‘অহিংসার পূজারী’ গান্ধী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজকে সাহায্য করার তীব্র বাসনায় রীতিমতো হিসেব কষে দেখান যে, খেড়া জেলায় গ্রামপিছু ২০ জন তরতাজা যুবক যুদ্ধে গেলে ১২ হাজার সৈন্য যোগাড় করা কোনও সমস্যার ব্যাপারই নয়! তাঁদের প্রাণবিসর্জনকে স্বাভাবিক বিষয় ধরে নিয়ে এমনকি খেড়ার মৃত্যুহার উল্লেখ করতেও ভোলেন না তিনি!! অসংখ্য দরিদ্র ভারতীয়র প্রাণের বিনিময়ে ‘স্বরাজ’-এর স্বপ্ন দেখানো গান্ধী তাঁদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “To sacrifice sons in the war ought to be a cause not of pain but of pleasure to brave men. Sacrifice of sons at this hour will be a sacrifice for swaraj. … There are 600 villages in Kheda district. Every village has on an average a population of over 1,000. If every village gave at least twenty men, Kheda district would be able to raise an army of 12,000 men. The population of the whole district is seven lakhs and this number will then work out at 1.7 per cent, a rate which is lower than the death rate. If we are not prepared to make even this sacrifice for the Empire, for the sake of swaraj, no wonder that we should be regarded unworthy of it. If every village gives at least twenty men, on their return from the war they will be the living bulwarks of their village. If they fall on the battle-field, they will immortalize themselves, their village and their country, and twenty fresh men will follow their example and offer themselves for national defence” (CWMG, ১৭/৮৬-৮৭)। অথচ ভারতীয়দের এই ‘সহযোগিতা’ ও অকাতরে প্রাণ বিসর্জনের মূল্য হিসেবে ব্রিটিশ সরকার উপহার দিয়েছিল কুখ্যাত ‘রাওলাট বিল’!

    সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের হিংসানীতির প্রবল সমর্থক গান্ধী কেবল ভারতীয়দের ক্ষেত্রে তাঁর ‘অহিংসা’-র মুখোশটি পরে নিয়েছেন এবং যতীন দাসের অনশনে মৃত্যুবরণ; ভগৎ সিং-সুখদেব-রাজগুরুর ফাঁসি; বিনয়-বাদল-দীনেশের আত্মবলিদান; চন্দ্রশেখর আজাদের আত্মহত্যা কিংবা আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের আত্মত্যাগ তাঁর বিন্দুমাত্র মনোযোগ বা সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারেনি। এই সব ব্যাপারে হয় তিনি আজীবন নীরব থেকেছেন নয়তো ‘বিপথগামী’ বলে অভিহিত করেছেন।

    ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ট্রেড ডিসপিউট বিলের বিরোধিতা করে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত অ্যাসেম্বলি হলে বোমা ছোঁড়েন, শুর হয় দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। ১১ জুন যতীন দাসকে এই মামলার সঙ্গে যুক্ত করে গ্রেফতার করে লাহোর জেলে পাঠানো হয়। লাহোর জেলে বন্দিদের অব্যবস্থার প্রতিবাদে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত অনশন শুরু করেন। এই অনশনের সমর্থনে ১৩ জুলাই যতীন দাসসহ বাকি বন্দিরা অনশনে যোগ দেন। ২৬ জুলাই যতীন দাসের নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ইতিমধ্যে অনেক বন্দি অনশন ভঙ্গ করলেও তাঁদের দাবি না মেটা পর্যন্ত যতীন অনশন চালানোর বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন। ১৩ সেপ্টেম্বর একটানা ৬৩ দিনের অনশনের পরে তিনি বরণ করেন শহিদের মৃত্যু। অথচ অনশন যাঁর সংগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত হাতিয়ার, সেই গান্ধী যতীন দাসের এই আত্মবলিদানকে নিরাসক্তভাবে বর্ণনা করেন ‘diabolical suicide’ বা স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা বলে।

    ১৯৩০ সালের ২৩ এপ্রিল বাদশা খান ও বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার ফলে পেশোয়ারে এক বিশাল অভ্যুত্থান ঘটে। কিস্‌সাকহানি বাজারে তিন ঘন্টা ধরে সাঁজোয়া গাড়ি থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। সরকারি সূত্র অনুসারে এতে নিহত হন ৩০ জন এবং বেসরকারি হিসাবে তা ২৫০ ছাড়ায়। হিন্দু সৈন্যদের নিয়ে তৈরি গাড়োয়াল রাইফেলস-এর একটি বাহিনী পেশোয়ারের বিদ্রোহী শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনসাধারণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। গান্ধী গাড়োয়ালি সৈন্যদের ‘অবাধ্যতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ভয়ংকর অপরাধ’-এ অভিযুক্ত করে তাঁদের তীব্র ভর্ৎসনা করেন। অথচ, বিদ্রোহ দমন করতে শাসক যখন বিদ্রোহীদের হত্যা করে তখন তার প্রতিবাদে গান্ধী একটা কথাও বলেননি। ৪ মে, অর্থাৎ ঘটনার ১০ দিন পরে ব্রিটিশরা পেশোয়ারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়। গাড়োয়ালি সৈন্যদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে পনেরো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। কিন্তু গান্ধী-আরউইন চুক্তিতে রাজবন্দিদের মুক্তির উল্লেখ থাকলেও গাড়োয়ালি সেনাদের মুক্তির ব্যাপারটা বাদ রাখা হয়। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়, ‘Soldiers and police convicted of offences involving disobedience of orders... will not come within scope of this amnesty’।

    ফরাসি সাংবাদিক চার্লস পেত্রাশ ১৯৩১-এর ২৯ অক্টোবর এ ব্যাপারে গান্ধীকে প্রশ্ন করেন: “Why did you not see that the Garhwali soldiers, who had refused to fire on an unarmed crowd, were included in the truce? How do you reconcile that with your doctrine of non-violence, since these men were punished for having refused to be party to an act of violence?” উত্তরে নির্বিকারচিত্তে গান্ধী যে সাফাই দেন তা এইরকম — “The Garhwali prisoners (as they are called) deliberately disobeyed their orders. I agree that it was a non-violent action on their part, but it was also a gross breach of discipline by those who had taken an oath to carry out the commands of their officers. … I cannot ask officials and soldiers to disobey; for when I am in power I shall in all likelihood make use of those same officials and those same soldiers. If I taught them to disobey I should be afraid that they might do the same when I am in power” (CWMG, ৫৩/৪৪৭)। অর্থাৎ ক্ষমতা লাভের পরে গান্ধী স্বয়ং অহিংসার বাণী বিতরণের বদলে সামরিক বাহিনীর ওপরেই শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন!

    ১৯৩১ সালে ভগৎ সিং-এর ফাঁসির ছ’দিন পরে ২৯ মার্চ করাচিতে কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার প্রশ্নে গান্ধীর সংশোধনীর পরে নিছকই দায়সারাভাবে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তা হল — ‘যদিও কংগ্রেসের নীতি সমস্ত প্রকারের হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং এ-সব সমর্থন না করা, তবুও সে দেশপ্রেমীদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ প্রশংসচিত্তে স্মরণ করে’।

    ১৯৩৫-এর শেষ দিকে মুসোলিনি বাহিনী সাত মাস নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণের পরে আবিসিনিয়া দখল করে। অহিংসার পথ অবলম্বন করলে আবিসিনিয়ার বাসিন্দারা উপকৃত হতেন তা জানিয়ে গান্ধী বলেন, “But if the Abyssinians had retired from the field and allowed themselves to be slaughtered, their seeming inactivity would have been much more effective though not for the moment visible” (হরিজন, ২০-৩-১৯৩৭)। এই বিষয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে ১৯৩৮ সালে তিনি লেখেন: “… if the Abyssinians had adopted the attitude of non-violence of the strong, i.e., the non-violence which breaks to pieces but never bends, Mussolini would have had no interest in Abyssinia. Thus if they had simply said: ‘You are welcome to reduce us to dust or ashes but you will not find one Abyssinian ready to co-operate with you’, what would Mussolini have done? He did not want a desert” (CWMG, ৭৩/১৫৬)।

    বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জার্মানি যখন লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ ইহুদিকে হত্যা করছে সেই ১৯৩৮ সালে গান্ধী ইহুদিদের উপদেশ দিচ্ছেন: “I am convinced that, if someone with courage and vision can arise among them to lead them in non-violent action, the winter of their despair can in the twinkling of an eye be turned into the summer of hope” (হরিজন, ২৬-১১-১৯৩৮)। এই বীভৎস গণহত্যার প্রতিবাদ হিসাবে তিনি ইহুদিদের এমনকি গণ-আত্মহত্যার পরামর্শ দিতেও পিছপা হচ্ছেন না। একইভাবে জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করলে তিনি লিখছেন, চেকরা যদি “… had known the use of non-violence as a weapon for the defence of national honour, they would have faced the whole might of Germany with that of Italy thrown in ... to save their honour they would have died to a man without shedding the blood of the robber” (হরিজন, ৮-১০-১৯৩৮)।

    ১৯৪০-এর জুলাই মাসে জার্মানি ও ইংরেজদের যুদ্ধ চলাকালীন গান্ধী প্রকাশ করেন ‘To Every Britton’ নামক এক বার্তা। সেখানে ইংরেজ জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন — “I want you to fight Nazism without arms, or, if I am to retain the military terminology, with non-violent arms. I would like you to lay down the arms you have as being useless for saving you or humanity. You will invite Herr Hitler and Signor Mussolini to take what they want of the countries you call your possessions. Let them take possession of your beautiful island, with your many beautiful buildings. You will give all these but neither your souls, nor your minds. If these gentlemen choose to occupy your homes, you will vacate them. If they do not give you free passage out, you will allow yourself man, woman and child, to be slaughtered, but you will refuse to owe allegiance to them (হরিজন, ৬-৭-১৯৪০)। অথচ একই গান্ধী ১৫ মে, ১৯৪০ হিটলারের প্রশংসা করে লিখতে পারেন: “I do not consider Hitler to be as bad as he is depicted. He is showing an ability that is amazing and he seems to be gaining his victories without much bloodshed” (CWMG, ৭৮/২১৯) কিংবা ওই বছরেই ২৪ ডিসেম্বর হিটলারকে লেখা চিঠিতে তিনি জানাতে পারেন, “We have no doubt about your bravery or devotion to your fatherland, nor do we believe that you are the monster described by your opponents” (CWMG, ৭৯/৪৫৬)! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় হত্যালীলার সময়ে ‘অহিংসার পূজারী’ গান্ধী কিছুদিনের জন্যে হলেও এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে, যুদ্ধে অক্ষশক্তির জয় নিশ্চিত। হয়তো এই কারণেই তিনি ভারতবর্ষের ‘সম্ভাব্য শাসক’ অক্ষশক্তির প্রতিনিধিদের প্রিয় পাত্র হতে চেয়েছিলেন। সেই অশান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে একমাত্র নেহরু ছাড়া ভারতের অন্য কোনও নেতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদী শক্তির এক ও অভিন্ন রূপ চিনতে পারেননি। সুভাষ তো নয়-ই, গান্ধীও নয়।

    আন্তর্জাতিক আঙিনা থেকে আমরা যদি চোখ ফেরাই জাতীয় প্রেক্ষাপটের দিকে, তাহলেও একই চিত্র আমরা দেখতে পাব। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো ভারতীয় সৈন্যদের জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জুড়ে দেওয়ার কথা বললে কংগ্রেস নেতারা এই একতরফা ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হন। যুদ্ধ সম্পর্কে ১৯২৭ থেকে কংগ্রেস বারবার যে-সব প্রস্তাব নেয় তার মূল কথা ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে ভারত কখনও অংশ নেবে না এবং জনগণের সম্মতি ছাড়া ভারতকে কোনও যুদ্ধে লিপ্ত করা চলবে না। অথচ ওয়ার্কিং কমিটিতে গান্ধী শর্তনিরপেক্ষ অহিংস সমর্থনের কথা বলেন। সিমলায় বড়লাটের সঙ্গে দেখা করার পর ব্রিটিশ যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘ন্যায়’-এর পক্ষে যুদ্ধ করছে এবং এই কারণেই ভারতবাসীর তাকে সমর্থনের প্রয়োজন তা জানিয়ে গান্ধী বলেন, “I am not therefore just now thinking of India’s deliverance. It will come, but what will it be worth if England and France fall, or if they come out victorious over Germany ruined and humbled?” (CWMG, ৭৬/৩১২)। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্যই তা মেনে না নিয়ে শর্তসাপেক্ষে সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ন্যূনতম কিছু শর্ত মেনে নিলে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় কংগ্রেসের তরফে ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শর্তগুলি ছিল — ক) যুদ্ধের পরে স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক কাঠামো স্থির করার জন্য এক সংবিধান-রচনা পরিষদের প্রতিশ্রুতি এবং খ) সেই মুহূর্তে কেন্দ্রে প্রকৃত দায়িত্বশীল সরকার জাতীয় একটা কিছু গড়ে তোলা। যদিও বড়লাট সে সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ১৭ অক্টোবর লিনলিথগোর বিবৃতিতে যুদ্ধের পরে ১৯৩৫-এর আইন রদবদলের জন্য ‘শুধু কয়েকটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় বসা হবে’ জাতীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি যুদ্ধঘোষণার দিনই বলবৎ করা হয় ভারত রক্ষা অর্ডিন্যান্স।

    ২৩ অক্টোবর ওয়ার্কিং কমিটিতে ভাইসরয়ের বিবৃতিকে বাতিল করে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যুদ্ধ সমর্থন করা হবে না এবং প্রতিবাদে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভাগুলোকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার তার দমননীতি থেকে সরে না এসে একের পর এক অর্ডিন্যান্স জারি করে বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে শুরু করে। সারা দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদী কর্মী বিশেষত বামপন্থী কর্মীদের হয়রান করা শুরু হয়। এমনকি কংগ্রেস যদি গণসংগ্রাম শুরু করার দিকে কোনও পদক্ষেপ নেয় তাহলে কংগ্রেসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় সরকার। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত দুটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারকে যতদূর সম্ভব বিব্রত করা থেকে রেহাই দিয়ে কংগ্রেসি কার্যক্রম গঠনমূলক কার্যসূচী রূপায়ণে সীমাবদ্ধ থাকে।

    পরের বছর জার্মানি পশ্চিম ইউরোপ দখল করার পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব আরও একবার ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার সাপেক্ষে ইংরেজদের সমর্থনের কথা জানান। কিন্তু যে গান্ধী এক বছর আগেও যুদ্ধে ইংরেজদের শর্তনিরপেক্ষ সমর্থনের কথা বলেছিলেন, সেই তিনিই এই সময়ে কংগ্রেসের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন: “It is wrong to help the British war-effort with men or money. The only worthy effort is to resist all war with non-violent resistance” এবং ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাস থেকে অহিংস গণ সত্যাগ্রহের বদলে শুরু করেন ‘ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ’। ১৭ অক্টোবর বিনোবা ভাবে প্রথম শুরু করেন এই সত্যাগ্রহ, দ্বিতীয় জন নেহরু। গান্ধী-উদ্ভাবিত এই সত্যাগ্রহের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক জেলার সত্যাগ্রহীদের নামের তালিকা আগে গান্ধীর কাছে পেশ করতে হত। তালিকা থেকে তিনি তাঁর পছন্দমতো সত্যাগ্রহীদের বাছাই করতেন এবং কেবলমাত্র সেই নির্বাচিত ব্যক্তিরাই সত্যাগ্রহ করার অধিকার পেতেন। এই সত্যাগ্রহীরা কখন কোথায় সত্যাগ্রহ করবেন তা পুলিশকে আগে জানানো হত।

    এই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে ওই বছরেরই ২ ডিসেম্বর ওয়ার্ধা থেকে ভারত সরকারের হোম মেম্বার রেজিনাল্ড ম্যাক্সওয়েলকে গান্ধী তাঁর লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে লেখেন, “অবিচলভাবে আমার ব্রত পালন করতে গিয়ে সরকারের ন্যূনতম অস্বস্তি (least embarrassment) সৃষ্টি করাই আমার ইচ্ছা। যদি এটি সফল হয়, ব্রিটিশের সঙ্গে সঙ্গে ভারত-ও উপকৃত হবে এবং শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবী। এটি যদি ব্যর্থও হয়, সরকারের ওপরে আঘাত আসবে না। ... কর্তব্যের নির্দেশে আমি আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী পন্থা অবলম্বন করেছি। আমি এতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছি যে, আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী শিবিরে থেকেও ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যের অনুকূলেই আমি কাজ করছি, এই বিশ্বাস থেকে যে তাদের পদ্ধতি নাৎসিবাদ (Hitlerism)-কে পরাজিত করতে না পারলেও একমাত্র আমার পদ্ধতিই পারবে, যদি আদৌ পারে” (CWMG, ৭৯/৪১০)। ফলত গান্ধীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংগ্রাম এক চূড়ান্ত প্রহসনে পরিণত হয়।

    অহিংসা বিষয়ে গান্ধীর বিপরীতধর্মী মনোভাবের শেষ প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৪৬ সালের ১৮-২৩ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের নৌ-বিদ্রোহের সময়। রাজনৈতিকভাবে অনগ্রসর ‘সামরিক জাতি’ (মার্শাল রেস) থেকে নিয়োগ করাই ছিল পুরনো সামরিক প্রথা। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির যে বিস্তার হয় তাতে দেশের সব জায়গার লোকই আসার ফলে সেই প্রথা আলাদা হয়ে যায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি নৌ-সঙ্কেত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘তলোয়ার’-এর রেটিংরা খারাপ খাবার ও বর্ণবৈষম্যগত অপমানের বিরুদ্ধে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। রেটিংদের দাবি ছিল মূলত দু’টি — ক) ভালো খাবার ও শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের সঙ্গে ভারতীয় নাবিকদের বেতনসাম্য এবং খ) আজাদ হিন্দ ফৌজ তথা অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তি ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার। ‘তলোয়ার’ জাহাজের ১১০০ রেটিংদের নিয়ে যে বিদ্রোহ শুরু হয় তা ক্রমে বোম্বাই বন্দরের ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার। পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলমান ছাত্র-শ্রমিকরা পুলিশ তথা সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে তাঁদের সমর্থন করেন।

    ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্‌-মুহূর্তে এই বিদ্রোহ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলে।প্যাটেল, আজাদ এবং গান্ধী এই সহিংস বিদ্রোহের নিন্দা করেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় যে গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করতে পনেরো দিনের অরাজকতা মেনে নিতেও প্রস্তুত বলে লুই ফিশারকে জানিয়েছিলেন; হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করে কৃষকরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিতে পারে - এমন সম্ভাবনাও যিনি উড়িয়ে দেননি; সেই গান্ধীর চোখেই নৌ-বিদ্রোহ সহসা মন্দ হয়ে ওঠে! অবিকল পেশোয়ার বিদ্রোহের সময় গাড়োয়ালি সেনাদের অসহযোগিতার মতো একই কারণ দেখিয়ে তিনি লেখেন “... the lesson would be a bad inheritance. Discipline will be at least as necessary under swaraj, as it is now…”। ‘ভারতের পক্ষে একটি অশুভ ও অশোভন দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের জন্য নৌ-বিদ্রোহের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন গান্ধী ২২ ফেব্রুয়ারি রেটিংদের নিন্দা করেন এবং চাকরি নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে তাঁদের শান্তিপূর্ণভাবে পদত্যাগ করার উপদেশ দেন।

    ‘মিউটিনি ইন দ্য নেভি’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “... insulting and injuring the Europeans, is not non-violence of the Congress type …” (হরিজন, ৩-৩-১৯৪৬)। ওই একই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন: “A combination between Hindus and Muslims and others for the purpose of violent action is unholy…”। অবশেষে ২৩ ফেব্রুয়ারি প্যাটেল রেটিংদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আত্মসমর্পন করান। তাঁদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জাতীয় দলগুলি তা আটকাবে। যদিও ৪৭৬ জন বরখাস্ত নৌসেনার একজনকেও পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারত কিংবা পাকিস্তান – কোনও দেশের সেনাবাহিনীতেই পুনর্বহাল করা হয়নি।

    হিংসার প্রতি গান্ধীর ঘৃণা এবং অহিংসার বুলি যে আদতে একটি ঘৃণ্য কৌশল এবং জনসাধারণকে প্রতারণার একটি অপচেষ্টা মাত্র, তা তিনি প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পরে ভারতে প্রমাণ করেছিলেন। সংগ্রামী জনসাধারণকে দমন করবার জন্য শাসকগোষ্ঠীকে অবাধ সুযোগদানের উদ্দেশ্যে গান্ধীর উপদেশ: “প্রতিপক্ষের আঘাত যতই তীব্র হোক না কেন, তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জনসাধারণের কিছুতেই বলপ্রয়োগ করা উচিত নয়। শাসকগোষ্ঠীর হৃদয় জয় করেই তাদের মুক্তি অর্জন করতে হবে।” সুতরাং গান্ধীর নীতিতে অহিংসা কেবল ভারতবাসীর অবশ্য পালনীয় আর সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছে গুলিগোলা চালিয়ে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-নারী হত্যার অবাধ স্বাধীনতা!!

    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. বিপান চন্দ্র ও অন্যান্য – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৮৫৭-১৯৪৭
    ২. নরহরি কবিরাজ (সম্পাদিত) – অসমাপ্ত বিপ্লব, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
    ৩. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৪. D. G. Tendulkar – Mahatma: Life of Mohandas Karamchand Gandhi, Vol. VII
    ৫. Louis Fischer – Mahatma Gandhi: His Life & Times

    পঞ্চম পর্ব পরের সপ্তাহে ...

    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    পঞ্চম পর্ব : গান্ধী ও আইন অমান্য — হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের আখ্যান


    অসহযোগ আন্দোলন একতরফা ভাবে প্রত্যাহার করার পরে আইনসভায় প্রবেশের প্রস্তাব নিয়ে চিত্তরঞ্জন দাস ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি মতিলাল নেহরু ও মদনমোহন মালব্যকে সঙ্গে নিয়ে যখন প্রতিষ্ঠা করছেন স্বরাজ্য দল, সেই সময়ে ভারতীয় রাজনীতির মূল স্রোত থেকে নিজেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গান্ধী ১৯২৪-২৫ সালে ত্রিবাঙ্কুরে ‘মন্দির প্রবেশ’-এর অধিকার নিয়ে শুরু করছেন ভাইকোম সত্যাগ্রহ। গান্ধীর নির্দেশে এই আন্দোলনে কোনও অ-হিন্দুকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি ভারতীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে অনুগত জর্জ জোসেফকেও এই সত্যাগ্রহ থেকে দূরে রাখা হয়। কারণ হিসেবে ১৯২৪ সালের ২০ মে তিনি বলেন, “This is a purely Hindu question and, therefore, the non-Hindus have no place in the struggle” (CWMG, ২৭/৪৫৭)।

    ১৯২৫-এর মার্চে গান্ধী ভাইকোমে গিয়ে সেখানকার মন্দিরের গোঁড়া নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কথা বলেন। ব্রাহ্মণরা তাঁর আবেদনে কর্ণপাত না করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় গান্ধীর ভাইকোমে অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতার কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে গান্ধী লেখেন, “I appealed to their reason. I appealed to their humanity. And I appealed to the Hinduism in them [orthodox pundits]. I am sorry to confess to you that I was not able to produce the impression that I had expected that I would be able to”। আন্দোলনের ২০ মাস পরে সরকার দলিতদের জন্যে কয়েকটি ঘুরপথের রাস্তা তৈরি করে দিলে সত্যাগ্রহ বন্ধ হয়, যদিও ভাইকোমের ওই মন্দিরে তাঁদের প্রবেশাধিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১৯৩৬ পর্যন্ত।

    ইতিমধ্যে চিত্তরঞ্জন মারা গেছেন; সুভাষের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে (যা আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীনও প্রশমিত হবে না); লাজপত রায় ও মদনমোহন মালব্য স্বরাজ্য দল ত্যাগ করেছেন; জিন্না পাকাপাকিভাবে কংগ্রেসের সংশ্রব ত্যাগ করে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন (যেখানে ‘হিন্দু আধিপত্য’-র বিপদ থেকে মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলোকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অধীনে রাখার প্রস্তাব গৃহীত হচ্ছে) আর গান্ধী ১৯২৬ সালে স্বঘোষিত ‘মৌনের বছর’ অতিক্রম করে পুনরায় কংগ্রেসে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, দলের রাশ নিচ্ছেন নিজের হাতে। জাতীয় রাজনীতির এমনই এক সন্ধিক্ষণে ভবিষ্যৎ শাসন-সংস্কার সম্পর্কে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে ১৯২৭-এর ৮ নভেম্বর কেবলমাত্র ইংরেজ সদস্যদের নিয়ে ‘সাইমন কমিশন’ গঠিত হলে মাদ্রাজের জাস্টিস দল এবং পাঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট ছাড়া ভারতের সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়।

    সাইমন কমিশনকে বয়কটের কারণে তদানীন্তন ভারত সচিব লর্ড বার্কেনহেড ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানান। এর জবাবে ১৯২৭ সালের ১৯ মে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২৯টি রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে শুরু হয় সংবিধান রচনার জন্য মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে এক খসড়া রিপোর্ট (‘নেহরু রিপোর্ট’) তৈরি করার উদ্যোগ। তেজবাহাদুর সপ্রুর মতো উদারনৈতিক রাজনীতিকরা এবং জিন্নার নেতৃত্বে মুসলমান নেতারা একটি ডোমিনিয়ন মর্যাদাসম্পন্ন সংবিধানের রূপরেখা তৈরির কাজে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলান। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে সর্বভারতীয় সম্মেলনে জিন্নাসহ মুসলমান নেতৃবৃন্দ যে চারটি মূল প্রস্তাব তুলে ধরেন তা ‘দিল্লি প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। প্রস্তাবে ক) সিন্ধুকে আলাদা প্রদেশ করা, খ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে অন্যান্য প্রদেশের সমান মর্যাদা দেওয়া, গ) কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া এবং ঘ) বাংলা ও পাঞ্জাবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সুনিশ্চিত করা এবং অন্য যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে মুসলমানদের জন আসন সংরক্ষণের চলতি ব্যবস্থা বজায় রাখার কথা বলা হয়। ১৯২৭-এর ডিসেম্বরে মাদ্রাজ কংগ্রেস অধিবেশনে দিল্লি প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়।

    কিন্তু এন সি কেলকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার জব্বলপুর অধিবেশনে (এপ্রিল ১৯২৮) নতুন মুসলমানপ্রধান প্রদেশ তৈরি এবং বাংলা ও পাঞ্জাবে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। সব দিক বিবেচনা করে ১৯২৮ সালের অগস্ট মাসে লখনউতে নেহরু রিপোর্ট চূড়ান্ত রূপ নেয়। রিপোর্টে দেশের সর্বত্র যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর কথা বলা হয় এবং মুসলমানদের সংরক্ষিত আসন দেওয়া হয় একমাত্র কেন্দ্রে ও সেই সব প্রদেশে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। সিন্ধুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, এর রাজনৈতিক কাঠামো হবে মোটামুটিভাবে এককেন্দ্রীয়, অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রের হাতে।

    এর পরেও ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলনে ঐক্যের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন জিন্না। কংগ্রেস অধিবেশনের প্রাক্কালে তিনি রিপোর্টে চারটে সংশোধন — ক) কেন্দ্রীয় সভায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান প্রতিনিধি, খ) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটদান প্রতিষ্ঠা না হওয়া অবধি বাংলা ও পাঞ্জাবে জনসংখ্যার অনুপাতে আসন সংরক্ষণ, গ) সিন্ধুকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা এবং ঘ) প্রদেশগুলির হাতে অধিক দায়িত্ব অর্পণ — করার আর্জি জানান। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপরে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “We are sons of his land, we have to live together. I believe there is no progress for India until Muslims and Hindus are united”। কংগ্রেস স্বাভাবিকভাবেই প্রদেশগুলির হাতে অধিক দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। ফলে এই রিপোর্টের বিরোধিতা করে জিন্না ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে হাজির করেন তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দ দফা’ দাবি। ইতিমধ্যে ভাইসরয় লর্ড আরউইন ১৯২৯-এর ৩১ অক্টোবর সাইমন কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোলটেবিল বৈঠক ডাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

    অন্য দিকে ১৯২৭ সালে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ফিরে আসেন নেহরু, তাঁর চোখে তখন সমাজবাদের স্বপ্ন। ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে নেহরুর উদ্যোগে জাতীয় সংগ্রামের লক্ষ্য হিসাবে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ব্যাপারে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাশাপাশি ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট উপলক্ষে পাঞ্জাবের এক জনসভায় লাজপত রায় পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হলে পরিস্থিতি আরও চরম আকার নেয়। এহেন জটিল পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরতে এগিয়ে আসেন গান্ধী। তাঁর অনুপস্থিতে মাদ্রাজ কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের ব্যাপারে জওহরলালের যে প্রস্তাব পাশ হয়, গান্ধী তাতে প্রবল অসম্মতি জানান। ১৯২৮-এর ৫ জানুয়ারি ইয়ং ইন্ডিয়াতে এই সিদ্ধান্তকে ‘hastily conceived’ এবং ‘thoughtlessly passed’ বলে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “… we [the Congress] have almost sunk to the level of the schoolboys’ debating society”।

    ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অবিলম্বে আবার পূর্ণ স্বরাজের ডাক দেওয়ার জন্য সুভাষ যে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন, সেটিকে সমর্থন করেন জওহরলাল, তামিলনাড়ুর সত্যমূর্তি, বোম্বাইয়ের যোগলেকর এবং বাংলার প্রচুর সংখ্যক প্রতিনিধি। কিন্তু প্রস্তাবটি ৯৭৩-১৩৫০ ভোটে হেরে যায়। আশ্চর্যের কথা এই, নেহরু রিপোর্ট কমিটিতে সর্বমোট ১০ জন সদস্যের অন্যতম কংগ্রেসের তরুণ তুর্কি সুভাষ আগেই নেহরু রিপোর্ট-এর পক্ষে সই করেছিলেন আর জওহরলাল অধিবেশন চলাকালীন তাঁরই উত্থাপিত প্রস্তাবের বিরোধিতা দেখে অধিবেশনের বাকি দিনগুলিতে অনুপস্থিত থাকেন!

    এই সুযোগে গান্ধী দেশের মুসলমানদের দাবির কথা বিবেচনার মধ্যে না এনে, তাঁদের বাদ দিয়েই জওহরলাল কথিত ‘immoderately moderate’ মতিলাল নেহরুর ‘নেহরু রিপোর্ট’ পাশ করিয়ে নিতে সমর্থ হন। এই রিপোর্টে মাদ্রাজ কংগ্রেসে গৃহীত পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে ফের ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়। ১৯২৯ সালেও আন্দোলন শুরু না করার কারণ হিসেবে তিনি জানান, “I know well enough how to lead to civil disobedience a people who are prepared to embark upon it on my terms. I see no such sign on the horizon” (CWMG, ৪৬/৩৭৭)। নেহরু রিপোর্টে উল্লিখিত স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদার লক্ষ্য মেনে নিয়ে বলা হয়, যদি ব্রিটিশরা ১৯২৯-এর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি মঞ্জুর না করে, তাহলে কংগ্রেসের পক্ষে আইন অমান্য ও পূর্ণ স্বরাজের দিকে এগোনোর দিকে কোনও বাধা থাকবে না। ফলে সারা বছর জুড়ে গ্রামে গঠনমূলক কাজ, মদ্যপান নিবারণ এবং ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জনের মধ্যেই কংগ্রেসের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে।

    বিদ্রোহী শক্তির ওপর গান্ধীর নিজের আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা দেখতে পাই, বেশির ভাগ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও (১০ জন চেয়েছিলেন গান্ধীকে, ৫ জন প্যাটেলকে এবং মাত্র ৩ জন নেহরুকে) তিনি ১৯২৯ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়েও পদত্যাগ করেন এবং তাঁর বদলে ওই বছরের কংগ্রেস অধিবেশনে জওহরলালকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। সভাপতি হিসেবে জওহরলালকে নিজের কর্মসূচী পালন করতে বাধ্য করার ইঙ্গিত দিয়ে গান্ধী বলেন, “He [Jawaharlal] is undoubtedly an extremist thinking far ahead of his surroundings. But he is humble and practical enough not to force the pace to the breaking point. … The nation is safe in his hands” (CWMG, ৪৭/১৮৫)। অধিবেশনের কার্যবিবরণী থেকেও এ কথা পরিষ্কার হয়, গান্ধীই তখনও দৃঢ়ভাবে কংগ্রেসের সর্বময় কর্তা। খাজনা দেওয়া বন্ধ করা, যেখানে এবং যখন সম্ভব সাধারণ ধর্মঘট এবং পাল্টা সরকার — সুভাষের এই বিকল্প প্রস্তাবগুলি বাতিল করা হয় এবং আরউইন-এর ট্রেনে বোমা ছোঁড়ার ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণের অছিলা দেখিয়ে ভবিষ্যতে আরউইনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার দরজা খুলে রাখার মূল প্রস্তাবটিও গান্ধী পাশ করিয়ে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু কোনওভাবেই লর্ড আরউইন স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি না হওয়ায় অবশেষে গান্ধী পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার ডাক দিতে বাধ্য হন।

    আন্দোলন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ভার গান্ধীর ওপর অর্পণ করা হয়। ভারতের শ্রমিকশ্রেণিকে আন্দোলন থেকে দূরে রেখে এবং কৃষকদের খাজনা বন্ধ আন্দোলন থেকে বিরত রাখার আহ্বান জানিয়ে গান্ধী দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়ে জানান, “যতদিন পর্যন্ত একজন আইন ভঙ্গকারী মুক্ত বা জীবিত থাকবেন, আইন অমান্য ততদিন চলবে” (ইয়ং ইন্ডিয়া ২০-২-১৯৩০)। এক সপ্তাহ পরে ওই পত্রিকায় তিনি লেখেন: “So far as I am concerned, my intention is to start the movement only through the inmates of the Ashram and those who have submitted to its discipline and assimilated the spirit of its methods” (CWMG, ৪৮/৩৪৮)। অতঃপর নিজ হাতে বেছে নেওয়া ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ সাবরমতী আশ্রম থেকে শুরু হয় তাঁর লবণ সত্যাগ্রহ।

    আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি হিসাবে সারা দেশ জুড়ে বিলিতি পণ্য বিশেষত বস্ত্র বর্জনের ফলে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ১৯২৯-এ ব্রিটিশ কাপড়ের আমদানি ২ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ড থেকে পরের বছরে ১ কোটি ৩৭ লাখে এসে দাঁড়ালে শঙ্কিত ব্রিটিশ বস্ত্র ব্যবসায়ীরা সরকারকে অবিলম্বে সাংবিধানিক দায়িত্বশীল সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে আপস করতে চেয়ে ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে সরকার শাসন সংস্কার বিষয়ক আলোচনার জন্য বিভিন্ন দলের ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে ডাকে। সেখানে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে সদলবলে হাজির হন মহম্মদ আলি, আগা খাঁ ও ফজলুল হক; হিন্দু মহাসভার মুঞ্জে ও জয়াকর; লিবার্যা ল চিমনলাল শেতলবাদ ও তেজবাহাদুর সপ্রু; দলিত সম্প্রদায়ের আম্বেদকর ও আর শ্রীনিবাসন এবং রাজন্যবর্গের এক বিরাট বাহিনী। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসকে বে-আইনি ঘোষণা করা ও কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে গান্ধী বৈঠকে যোগদান করতে নারাজ হন। ফলে ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই শুরু হয় প্রথম বৈঠক। বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বৈঠক সফল হওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে কংগ্রেসের ওপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং ২৬ জানুয়ারি গান্ধী-সহ সকল কংগ্রেসি নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

    ১৯৩১-এর ৭ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের লাট বড়লাটকে জানান যে বেশ কিছু গান্ধী অনুগামী, বিশেষত ব্যবসায়ী শ্রেণির লোক, ভাবছেন যে তিনি যদি যথোপযুক্ত মনোভাব না নেন তাহলে তাঁর সঙ্গ তাঁরা ছেড়ে দেবেন। এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি বিড়লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ডি পি খৈতান কলকাতায় ভারতীয় বণিক সভার সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করেন: ‘… it may not be amiss to suggest to Mahatma Gandhi and the Congress that the time has come when they should explore the possibilities of an honourable settlement. ... We all want peace’। অন্যদিকে আরউইন ওইদিনই ওয়েজউড বেন-কে জানান যে “Purushottamdas would probably go to see Gandhi at Allahabad in order to try and put ‘commercial pressure’ on him”। তারপরেই গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের বিষয়ে গান্ধীর মনোজগতে এক হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বড়লাটের সাক্ষাৎ চেয়ে তিনি চিঠি লেখেন। আরউইনের সঙ্গে বৈঠকে গান্ধী যাঁদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সরকারি আশ্বাস; বিশেষ আইনের বলে যে সব রাজনৈতিক কর্মী ‘হিংসাত্মক কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে বন্দী হয়েছিলেন তাঁদের মুক্তি; লবণে সরকারের একচেটিয়া অধিকার বন্ধ করা ইত্যাদির শর্তে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবেন বলে জানান।

    কিন্তু গান্ধীর এই সব শর্ত আরোপে আরউইন অবিচল থাকেন এবং শুধু কিছু জায়গায় জমির খাজনা মকুব করতে রাজি হন। অবশেষে ৫ মার্চ ক) ভবিষ্যৎ গঠনতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনার জন্য বৈঠকে কংগ্রেসের যোগদান; খ) বিভিন্ন দমনমূলক অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার ও কেবলমাত্র অহিংস বন্দিদের মুক্তি ও গ) সমুদ্র উপকুলের কয়েকটি গ্রামে লবণ তৈরি করার অধিকার লাভের মতো কয়েকটি অকিঞ্চিৎকর শর্তের ভিত্তিতে গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ১৯৩০-৩১ সালের জাতীয় সংগ্রাম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। যে কংগ্রেসকে কিছুদিন আগেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই ব্রিটিশ সরকারের প্রকাশ্য চুক্তি জাতীয় সংগ্রামের বিরাট পরাজয় বুঝিয়ে দেয়। ১৯২২ সালের মতো এবারেও ঠিক যে মুহূর্তে সংগ্রাম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখনই হঠাৎ রহস্যজনকভাবে তা স্থগিত রাখা হয়। চুক্তির শর্ত অনুসারে গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। ভারতীয় পুঁজিপতিরাই যে ভারতীয় রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি এবং গান্ধীই যে তাঁদের উৎকৃষ্টতম প্রতিনিধি তা সম্ভবত বুঝতে পেরেই জওহরলাল হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, “Was it for this our people had behaved so gallantly for a year? Were all our brave words and deeds to end in this?”

    ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কারে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী (ইলেক্টোরেট)-র প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং তার অন্তর্ভুক্ত হয় মুসলিম, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ান সম্প্রদায়। পরবর্তীকালে ১৯১৯-এর মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারে দলিত সম্প্রদায়ের কথা বিবেচনা করা হলেও তা চালু হয়নি। এই বিষয়ে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে, যেখানে গান্ধী অনুপস্থিত ছিলেন, আম্বেদকর মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায়ের মতো দলিত সম্প্রদায়ের জন্যও আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর সুপারিশ আদায় করার ব্যাপারে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে এ ব্যাপারে তিনি গান্ধীর চরম বিরোধিতার সম্মুখীন হন। গান্ধী মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায়ের আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়টি মেনে নিলেও দলিতদের দাবি মানতে চাননি।

    সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টিতে এইবারেও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পারার কারণে শেষ পর্যন্ত ১৩ নভেম্বর সংখ্যালঘু কমিটির চেয়ারম্যান ম্যাকডোনাল্ড স্বয়ং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে সদস্যদের কাছে জানতে চান: “Will you, each of you, every member of this Committee, sign a request to me to settle the community question and pledge yourselves to accept my decision? ... I say, will you put your names to it and give that to me, with the assurance that the decisions come to will be accepted by you and will be worked by you to the best of your ability in the course of the working of the new constitution”। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হলে সংখ্যালঘু কমিটির আমন্ত্রিত সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে একটি লিখিত বয়ানে ম্যাকডোনাল্ডের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেন। গান্ধীও সেই বয়ানে স্বাক্ষর করেন এবং ভবিষ্যৎ গঠনতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনাকে শিকেয় তুলে রেখে খালি হাতে ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

    গোলটেবিল বৈঠক থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধী আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। ইতিমধ্যে ১৯৩২-এর ১৭ অগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড যে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তাতে উপরোক্ত পাঁচটি সম্প্রদায় ছাড়াও দলিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বৈঠক থেকে ফিরে আসার সময় সর্বসম্মত বয়ানে নিজের স্বাক্ষরদানের বিষয়টি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে আগের বারের মতো এবারও গান্ধী দলিতদের আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং তার বদলে আইনসভায় কয়েকজন অতিরিক্ত ‘হরিজন’ প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার ‘দান’ করতে চেয়ে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপের ফলে আম্বেদকর শেষ অবধি এই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন। গান্ধীর এই উদ্ভট নীতিকে তীব্র সমালোচনা করে আম্বেদকর পরে বেভারলি নিকোলসকে বলবেন, “Gandhi is the greatest enemy the untouchables have ever had in India”।

    অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের আবেদনকে অগ্রাহ্য করে চট্টগ্রাম, পেশোয়ার ও শোলাপুরে বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী ঘটনা সত্ত্বেও গান্ধী কিন্তু চৌরিচৌরার মতো হিংসার অজুহাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার কোনও উদ্যোগই নেননি। চৌরিচৌরার বদলে এইবারে তাঁকে প্রার্থিত ‘এসকেপ রুট’ এনে দেয় সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার বিষয়টি। আসলে হরিজন আন্দোলনকে গান্ধী কখনই দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তির উপায় হিসাবে বিবেচনা করেননি (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে পরবর্তী পর্বে)। তাই, হরিজনদের প্রতি ন্যায় বিচারের দোহাই দিয়ে প্রথমে ১৯৩৩ সালের ৮ মে আইন অমান্য আন্দোলন ছ’সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখা হয়। এবং, ২৩ অগস্ট কারামুক্ত হওয়ার পর গান্ধী ব্যক্তিগত ভাবে আইন অমান্য আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসে আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু আন্দোলন বন্ধ হলেও ব্রিটিশ তাদের দমননীতি সামান্য হ্রাস করেনি, গান্ধীও এই দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। পূর্ণ স্বরাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হওয়া আইন অমান্য আন্দোলন সেই যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার চোরাবালিতে ডুবে যায়, আজ অবধি তা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা মেলেনি।


    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. নরহরি কবিরাজ (সম্পাদিত) – অসমাপ্ত বিপ্লব, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
    ২. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – জিন্না : পাকিস্তান / নতুন ভাবনা
    ৩. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৪. সুপ্রকাশ রায় – ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম (১৮৯৩-১৯৪৭)
    ৫. B. R. Ambedkar – What Congress and Gandhi Have Done to the Untouchables
    ৬. Harold Coward (ed.) – Indian Critiques of Gandhi
    ৭. Leonard A. Gordon – Brothers Against the Raj

    পরবর্তী পর্ব আগামী সপ্তাহে ...

    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    ষষ্ঠ পর্ব : গান্ধী ও আম্বেদকর — এক বর্ণহিন্দু নেতার উন্মোচন


    গান্ধীকে তাঁর ভক্তবৃন্দ যতই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করুন না কেন; তাঁর একাধিক লেখা ও বক্তব্যে ‘রামরাজ্য’, ‘রামধুন’ বা ‘রামায়ণ’-এর উল্লেখকে নিছকই আলঙ্কারিক উক্তি হিসেবে বিবেচনা করুন না কেন; তবুও নিজেকে ‘সনাতনী হিন্দু’ প্রতিপন্ন করে তাঁর দীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি যে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছেন, তা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা মোটেও কষ্টকল্পনা নয় যে, আদতে তিনি ছিলেন এক বর্ণহিন্দু নেতা। অবশ্য যিনি ১৯২৫ সালে ঘমশ্যামদাস বিড়লাকে অনায়াসে লিখতে পারেন: “While at the charkha, one can repeat Ramanama as well. There is the case of two learned men who saved themselves from [an attack of] madness only by repeating Ramanama while plying the charkha” (CWMG, ৩০/১৭১), সেখানে তাঁর রামনামের গুণগান কতটা আলঙ্কারিক তা-ও প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে।

    শুধু কি তাই? অদ্ভুতভাবে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন চলাকালীন মোপলা বিদ্রোহের পরেই গান্ধী নিজেকে সনাতনী হিন্দু হিসেবে পরিচিত করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ১৯২১-এর ৬ অক্টোবর ইয়ং ইন্ডিয়ায় তিনি লেখেন — “আমি নিজেকে একজন সনাতনী হিন্দু বলে ঘোষণা করছি। কারণ ১) বেদ, উপনিষদ, পুরাণ এবং যা কিছু হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলে পরিচিত তার সব কিছুতে আমি বিশ্বাস করি, সুতরাং অবতার আর পুনর্জন্মেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, ২) বৈদিক বর্ণাশ্রম ধর্মে আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ়, ৩) গোরক্ষা সম্বন্ধেও আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ়, ৪) মূর্তি পূজায়ও আমি দৃঢ় বিশ্বাসী” (CWMG, ২৪/৩৭০-৭১)। এমনকি এই ঘটনার প্রায় ২০ বছর পরে লুই ফিশারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারেন, “The Moslems are religious fanatics… . They say Islam is the brotherhood of man. As a matter of fact, it is the brotherhood of Moslems”।

    তাঁর হিন্দুত্বের কথা সগর্বে ঘোষণা করে ১৯২৫ সালের ৭ মে কলকাতায় বুদ্ধজয়ন্তী উপলক্ষে ভাষণে তিনি বলতে পারেন: “It is a very strange thing that almost all the professors of great religions of the world claim me as their own. The Jains mistake me for a Jain. Scores of Buddhist friends have taken me for a Buddhist. Hundreds of Christian friends still consider that I am a Christian. … Many of my Mussalman friends consider that, although I do not call myself a Mussalman, to all intents and purposes, I am one of them; … and still something within me tells me that, for all that deep veneration I show to these several religions, I am all the more a Hindu, none the less for it” (CWMG, ৩১/২৯৯-৩০০)।

    ভারতবর্ষের দলিত সম্প্রদায় অর্থাৎ যাঁদের তিনি গালভরা ‘হরিজন’ নামে ডেকেছেন, তাঁদের সাথেও আজীবন চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তিনি। অস্পৃশ্য দলিতদের ‘হরিজন’ নামকরণ করার পেছনে গান্ধীর তুমুল চতুরতার প্রতি দিক্‌নির্দেশ করে আম্বেদকর বলেন, “By calling the Untouchables Harijans, Mr. Gandhi has killed two birds with one stone. He has shown that assimilation of the Untouchables by the Shudras is not possible. He has also by his new name counteracted assimilation and made it impossible”। শূদ্র যাতে আজীবন শূদ্র হিসাবেই থাকতে পারে, সেই ব্যাখ্যা করে তাঁদের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে ঈশ্বরের পুষ্পবৃষ্টির কথা শোনান তিনি: “The Shudra who only serves [the higher caste] as a matter of religious duty, and who will never own any property, who indeed has not even the ambition to own anything, is deserving of thousand obeisance. The very Gods will shower down flowers on him”।

    চিরাচরিত জাতপাতের প্রতিষেধক হিসেবে তিনি আবিষ্কার করেন ‘বর্ণ’ প্রথার মহিমাকে, ছোট ছোট জাতগুলোকে তিনি বড় চারটে বর্ণে রূপান্তরিত করতে চান এবং এইভাবে টিকিয়ে রাখতে চান সনাতনী বর্ণাশ্রম — “The best remedy is that small castes should fuse themselves into one big caste. There should be four big castes so that we may reproduce the old system of four Varnas”। তাঁর ‘আবিষ্কৃত’ বর্ণাশ্রমের সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি এ কথাও বলতে পারেন: “I believe that if Hindu Society has been able to stand, it is because it is founded on the caste system … To destroy the caste system and adopt the Western European social system means that Hindus must give up the principle of hereditary occupation which is the soul of the caste system. Hereditary principle is an eternal principle. To change it is to create disorder. I have no use for a Brahmin if I cannot call him a Brahmin for my life. It will be chaos if every day a Brahmin is changed into a Shudra and a Shudra is to be changed into a Brahmin”।

    যদিও জাতপাতের বিভেদকে গান্ধীর বর্ণ প্রথা দিয়ে ঢাকার এই অক্ষম প্রচেষ্টাকে তুলোধোনা করে আম্বেদকর পরে লিখবেন: “The reason why the Mahatma is always supporting caste and Varna is because he is afraid that if he opposes them he will lose his place in politics. ... Whatever may be the source of this confusion, the Mahatma must be told that he is deceiving himself and also deceiving the people by preaching caste under the name of Varna”।

    দলিতদের শিক্ষাপ্রাঙ্গণ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চান না গান্ধী, কিন্তু শিক্ষালাভের পর উপার্জনের ক্ষেত্রে কঠোর বর্ণাশ্রম প্রথাকেই স্বীকৃতি দিয়ে তিনি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেন একজন দলিত-অস্পৃশ্যকে আজীবন দলিতের চিরাচরিত পেশাগুলোকেই বেছে নিতে হবে, “The varna system is connected with the way of earning a living. There is no harm if a person belonging to one varna acquires the knowledge or science and art specialised in by persons belonging to other varnas. But as far as the way of earning his living is concerned he must follow the occupation of the varna to which he belongs which means he must follow the hereditary profession of his forefathers”। তিনি আরও ঘোষণা করেন: “In the Varna system no man has any liberty to choose his occupation. His occupation is determined for him by heredity”।

    ১৯২১ সালে যে গান্ধী অ্যান্ড্রুজকে লিখেছিলেন, “It [Untouchability] is a bigger problem than that of gaining Indian independence but I can tackle it better if I gain the latter on the way. It is not impossible that India may free herself from English domination before India has become free of the curse of untouchability” (CWMG, ২২/২৭৩), সেই একই গান্ধী ওই বছরে ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’-এ সংগৃহীত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মাত্র ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন দলিতদের উন্নয়নকল্পে! এবং তাঁর বিখ্যাত ‘অছি তত্ত্ব’-এ অসীম আস্থাশীল থেকে তিনি ১৯২২ সালের বারদোলি প্রস্তাবে দলিতদের উন্নয়নের ভার পুরোপুরি সঁপে দেন তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু মহাসভার হাতে!!

    ১৯২৯ সালে বোম্বাই প্রদেশে দলিতরা মন্দির প্রবেশ ও নলকূপ থেকে জল তোলার অধিকার চেয়ে অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা এ ব্যাপারে গান্ধীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। তাঁদেরকে অবাক করে দিয়ে গান্ধী বলেন যে, সত্যাগ্রহ কেবলমাত্র বিদেশিদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং দেশবাসীর বিরুদ্ধে তার প্রয়োগের কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না! শুধু তাই নয়, ১৯৩২ সালে মালাবারের গুরুভায়ুরে কেলাপ্পনের নেতৃত্বে দলিতদের মন্দির প্রবেশ সত্যাগ্রহের বিরোধিতা করে তিনি বলেন — “How is it possible that the Antyajas (Untouchables) should have the right to enter all the existing temples? As long as the law of caste and ashram has the chief place in Hindu Religion, to say that every Hindu can enter every temple is a thing that is not possible today”। খুবই মজার বিষয়, গুরুভায়ুরে কেলাপ্পন আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন ২২ সেপ্টেম্বর থেকে আর ‘পুণা চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছিল ঠিক তার তিন দিন পরে!

    এই সুযোগে পুণা চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করলে গান্ধীর তথাকথিত হরিজন-প্রেমের মুখোশটি আরও নগ্নভাবে প্রকট হবে। আগের পর্বেই লেখা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে না আসতে পারার কারণে ওই বিষয়ের পূর্ণ দায়িত্ব ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডকে অর্পণ করে গান্ধী ১৯৩১-এর শেষ দিকে দেশে ফিরে আসেন। যে গোলটেবিল বৈঠকে তিনি যোগদান করেছিলেন, সেই বৈঠকের ‘ফেডারাল স্ট্রাকচার কমিটি’-র ১৭ সেপ্টেম্বরের সভায় তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে সওয়াল করে বলেন: “So far as the untouchables are concerned, I have not yet quite grasped what Dr. Ambedkar has to say; but, of course, the Congress will share the honour with Dr. Ambedkar of representing the interests of the untouchables. They are as dear to the Congress at the interests of any other body or of any other individual throughout the length and breadth of India. Therefore, I would most strongly resist any further special representation” (CWMG, ৫৩/৩৮০)।

    এহ বাহ্য, তিনি যখন বুঝতে পারেন যে মুসলমান প্রতিনিধিরা আম্বেদকরের যুক্তিসঙ্গত দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল, তখন দলিতদের দাবি যাতে কোনও ভাবেই বাস্তবায়িত না হতে পারে সেই উদ্দেশ্যে অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে ৬ অক্টোবর তিনি মুসলমান নেতৃবৃন্দকে তাঁদের ১৪ দফা দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি অবধি দেন। গান্ধীর এই ধূর্ত চাল আম্বেদকরের কাছে প্রকাশিত হলে ১২ অক্টোবর ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় চিঠি লিখে আম্বেদকর জানান, “We are, however, reliably informed that in carrying his negotiations with our Muslim friends, Mr. Gandhi demanded that as one of the conditions for his accepting their fourteen points, they should oppose the claims of the Depressed Classes, and the smaller minorities. … Mr. Gandhi is not only not playing the part of a friend of the Depressed Classes, but he is not even playing the part of an honest foe”।

    দেশে ফিরে গান্ধী এই ভেবে শঙ্কিত হন যে, একমাত্র সালিশি হিসাবে ম্যাকডোনাল্ড দলিতদের পৃথক নির্বাচনমণ্ডলীর দাবি মেনে নিতে পারেন। ৬ কোটি দলিতকে ১২ কোটি হিন্দুর অন্তর্ভুক্ত করে, কেবলমাত্র সংখ্যাধিক্যের জোরে ১০ কোটি মুসলমানদের দাবিকে যে কোনও মূল্যে নস্যাৎ করার মরিয়া চেষ্টায় ১৯৩২-এর ১১ মার্চ ইয়েরবেদা জেল থেকে ভারতসচিব স্যামুয়েল হোরকে চিঠিতে আমরণ অনশনের হুমকি দিয়ে গান্ধী জানান — “… I hold that separate electorate is harmful for them and for Hinduism. ... I therefore respectfully inform His Majesty’s Government that in the event of their decision creating separate electorate for the Depressed Classes, I must fast unto death. ... I am hoping, however, that all my fears are wholly unjustified and the British Government have no intention whatever of creating separate electorate for the Depressed Classes” (CWMG, ৫৫/১১৩-১৪)।

    ইতিমধ্যে ১৭ অগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ড গান্ধীর অনশনের হুমকি উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার পরিকল্পনা ঘোষণা করলে, সেই সিদ্ধান্তকে পাল্টানোর জন্য মরণপণ লড়াইয়ে নামেন তিনি। পরের দিনই প্রধানমন্ত্রীকে তিনি লেখেন: “In pursuance of my letter to Sir Samuel Hoare and my declaration at the meeting of the Minorities Committee of the Round Table Conference on 13th November, 1931, at St. James’ Palace, I have to resist your decision with my life. The only way I can do so is by declaring a perpetual fast unto death from food of any kind save water with or without salt and soda. This fast will cease if during its progress the British Government, of its own motion or under pressure of public opinion, revise their decision and withdraw their scheme of communal electorates for the ‘depressed’ classes, whose representatives should be elected by the general electorate under the common franchise no matter how wide it is” (CWMG, ৫৬/৩৪৭)।

    এবারেও তাঁর অনশনের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে ৮ সেপ্টেম্বর ম্যাকডোনাল্ড তাঁকে জানান, “… members of the Depressed Classes will not be deprived of their votes in the general Hindu constituencies, but will have two votes in order that their membership of the Hindu community should remain unimpaired”। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন না বুঝতে পেরে গান্ধী এবার শিকার হিসেবে বেছে নেন দলিত সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা আম্বেদকরকে। দলিতদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর পরিবর্তে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীতে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন গান্ধী। চিমনলাল শেতলাবাদ, হীরাচাঁদ ওয়ালচাঁদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কমলা নেহরু, তেজবাহাদুর সপ্রু প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সমবেত চাপের মুখে অবশেষে আম্বেদকর আপস রফায় আসতে বাধ্য হন। ২৫ সেপ্টেম্বর ‘পুণা চুক্তি’-তে দলিতদের পক্ষে সই করেন আম্বেদকর এবং অন্যান্য স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান তিন ব্যক্তি ছিলেন মদনমোহন মালব্য, সাভারকর ও ঘনশ্যামদাস বিড়লা! চুক্তির মাধ্যমে ঠিক হয় আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর বদলে দলিতরা প্রদেশগুলিতে ম্যাকডোনাল্ডের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭১টি আসনের পরিবর্তে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীতে পাবেন ১৪৮টি আসন, কেন্দ্রীয় আইনসভায় পাবেন ১৮% আসন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই চুক্তির অব্যবহিত পরে মার্চ ১৯৩৩-এ অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ বিল উত্থাপিত হলেও হিন্দুদের বিরোধিতা এবং কংগ্রেসের সমর্থনের অভাবে তা পাশ করা যায়নি!

    ম্যাকডোনাল্ড-এর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার পরে জাতীয় রাজনীতিকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে গান্ধী তাঁর নিজের মতো করে হরিজন উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি চালু করেন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হরিজন’ আর ১৯৩৩-এর নভেম্বর থেকে ১৯৩৪-এর অগস্ট পর্যন্ত তিনি সাড়ে ১২ হাজার মাইল ‘হরিজন পরিক্রমা’ করেন। যদিও অন্যান্য গণ-আন্দোলনের মতো এ ক্ষেত্রেও গান্ধী হরিজন প্রচার-অভিযানকে আটকে রাখেন কুয়ো, রাস্তা ও মন্দিরে অবাধ অধিকার এবং সেই সঙ্গে কিছু মানবসেবামূলক কাজকর্মে। বহুসংখ্যক দলিতই ছিলেন কৃষক-শ্রমিক, তবুও সচেতনভাবেই এই প্রচার অভিযানের সঙ্গে কোনও রকম অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার কোনও সম্পর্ক রাখেননি তিনি। তার বদলে দলিতদের সমস্যা সমাধানকল্পে তিনি গোঁড়া হিন্দুদের ‘আত্মশুদ্ধি’র উপদেশ দিয়ে বলেন: “It is the superior class of Hindus who have to do penance for having neglected the untouchables for ages. That penance can be done by active social reform and by making the lot of the untouchables more bearable by acts of service, but not by asking for separate electorates for them” (CWMG ৫৪/৮৩)। যদিও ১৯৩৪ সালেই আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতা স্বীকার করে তিনি বলতে বাধ্য হবেন, “Unfortunately the higher castes have failed to identify themselves with their humbler fellows. This is the darkest hour of Hinduism. I have no excuse to offer for it” (CWMG ৬৫/৪৬২)।

    এর পরে ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে নিজেদের পেটোয়া কিছু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় কংগ্রেস। ফল বেরোলে দেখা যায়, প্রাদেশিক বিধানসভার ১৪৮টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৭৮টি আসন। আম্বেদকর অবশ্য স্পষ্ট হিসাব কষে দেখান, দলিতদের মোট ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ভোটের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৮% অর্থাৎ ২ লাখ ৯০ হাজার ভোট। তিনি সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তোলেন, “ Can there be any evidence more conclusive against the Congress claim to represent the Untouchables?”

    শুধু তাই নয়, এই ৭৮ জন দলিত সদস্যের মধ্যে একজনও কংগ্রেসের কোনও বিধানসভাতেই মন্ত্রীত্ব পাননি। বরং মধ্যপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রী নারায়ণ ভাস্কর খারে দলিত অগ্নিভোজকে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করলে, ১৯৩৮-এর ২৬ জুলাই ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। আম্বেদকর ঘটনার ব্যাখ্যা করে বলেন, “In explaining what was behind this charge of indiscipline in forming the new ministry, Dr Khare openly said that according to Mr Gandhi the act of indiscipline consisted in the inclusion of an untouchable in the Ministry. Dr Khare also said that Mr Gandhi told him that it was wrong on his part to have raised such aspirations and ambitions in the Untouchables and it was such an act of bad judgement that he would never forgive him. This statement was repeatedly made by Dr Khare from platforms. Mr Gandhi has never contradicted it”।

    অন্যদিকে ১৯৩৯-এর ৭ অগস্ট বোম্বে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বি কে গায়কোয়াড়-এর প্রশ্নের উত্তরে কংগ্রেস মন্ত্রী জানান, গান্ধীর মন্দির-প্রবেশ আন্দোলনের ফলে যে ১৪২টি মন্দিরে দলিতদের প্রবেশাধিকার সম্ভবপর হয়েছে তার মধ্যে ১২১টি মালিকানাহীন মন্দিরে কেউই পুজো করেন না! গোটা ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করে আম্বেদকর বললেন, “… the Congress sucked the juice out of the Poona Pact and threw the rind in the face of the Untouchables”।

    অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন চলাকালীন যে মহম্মদ আলি বলেছিলেন, ‘After the Prophet, on whom be peace, I consider it my duty to carry out the commands of Gandhiji’; ওই সময়ে যিনি গো-মাংস ভক্ষণ ছেড়েছিলেন ও চরকার প্রচার করেছিলেন সেই মহম্মদ আলিই ১৯৩০ সালে গান্ধীর আন্দোলনকে “... not a covenant for complete independence of India but of making seventy million of Indian Muslims dependent on the Hindu Mahasabha” বলে সমালোচনা করেন। অন্যদিকে ১৯৩৮-এ মুসলিম লিগের বার্ষিক সভায় জিন্না গান্ধীকে সরাসরি হিন্দু নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করে বলেন — “I have no hesitation in saying that it is Mr. Gandhi who is destroying the ideal with which the Congress was started. He is the one man responsible for turning the Congress into an instrument for the revival of Hinduism. His ideal is to revive the Hindu religion and establish Hindu Raj in this Country and he is using Congress to fulfill this object”। মজার কথা এই, ওই ১৯৩৮ সালেই হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা সাভারকরও প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে হিন্দু সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে বলেন, “Mr. Jinnah is quite correct in stating that the Congress has been, since its inception down to this day, a Hindu body”। আর আম্বেদকর জানান: “If a man with God’s name on his tongue and a sword under his armpit deserved the appellation of a Mahatma, then Mohandas Karamchand Gandhi was a Mahatma!”

    গান্ধী যে আদতে এক বর্ণহিন্দু নেতা, সে ব্যাপারে সবচেয়ে সেরা মূল্যায়ন করে আম্বেদকর বলেন, “What is there in Gandhism which is not to be found in orthodox Hinduism? There is caste in Hinduism, there is caste in Gandhism. Hinduism believes in the law of hereditary profession, so does Gandhism. Hinduism enjoins cow-worship. So does Gandhism. Hinduism upholds the law of karma, pre-destination of man’s condition in this world, so does Gandhism. Hinduism accepts the authority of the Shastras. So does Gandhism. Hinduism believes in avatar or incarnations of God. So does Gandhism. Hinduism believes in idols, so does Gandhism. All that Gandhism has done is to find a philosophic justification for Hinduism and its dogmas. Hinduism is bald in the sense that it is just a set of rules which bear on their face the appearance of a crude and cruel system. Gandhism supplies the philosophy which smoothens its surface and gives it the appearance of decency and respectability and so alters it and embellishes it as to make it even attractive…”।

    অন্যদিকে গান্ধীর হরিজন আন্দোলনের অসারত্ব প্রমাণ করে ডেভিড আর্নল্ড সিদ্ধান্ত নেন — “The Harijan movement was seen as a political gimmick which did not seriously address, let alone resolve, the real social and economic issues that lay behind their continuing oppression. Not surprisingly, therefore, among many Dalit [Untouchable] organizations Gandhi is remembered with neither affection nor respect. A manifesto issued in 1973 by the Dalit Panthers of Maharashtra... accused Gandhi of being ‘deceitful, cunning, an orthodox casteist’”।


    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. Arundhati Roy – The Doctor and the Saint
    ২. B. R. Ambedkar – Gandhi and Gandhism
    ৩. B. R. Ambedkar – Mr. Gandhi and the Emancipation of the Untouchables
    ৪. B. R. Ambedkar – What Congress and Gandhi Have Done to the Untouchables
    ৫. B. R. Ambedkar – Writings and Speeches Vol. 1 & II
    ৬. Dhananjay Keer – Dr. Ambedkar: Life and Mission
    ৭. G. B. Singh – Gandhi: Behind the Mask of Divinity
    ৮. Joseph Lelyveld – Great Soul: Mahatma Gandhi and His Struggle with India
    ৯. Stanley Wolpert – Jinnah of Pakistan


    পরবর্তী পর্ব আগামী সপ্তাহে ...

    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    সপ্তম পর্ব : গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ — এই মৈত্রী এই মতান্তর


    দু’জনেই প্রায় সমবয়সী; দু’জনেই দীর্ঘজীবী; দু’জনেই তাঁদের বাণীকে বাস্তব জগতে প্রয়োগে প্রয়াসী হয়েছেন; দু’জনেই স্বদেশহিতে মানুষের উন্নতির কথা চিন্তা করেছেন; দু’জনেই একে অপরকে আজীবন ‘মহাত্মা’ এবং ‘গুরুদেব’ সম্বোধন করেছেন; কেবল প্রথম জন স্বাধীন ভারতের সূচনা দেখলেও তার বিকাশ দেখে যেতে পারেননি, আর দ্বিতীয় জন স্বাধীন ভারত দেখার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। ১৯১৪ থেকে ১৯৪১ – দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর সময়ে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে অসংখ্য ক্ষেত্রে যুক্তিজালে ছিন্নভিন্ন করেছেন, গান্ধীর সংকীর্ণ চিন্তাভাবনাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন অথচ কী আশ্চর্য, দুজনের একজনও কখনও শালীনতার সীমা অতিক্রম করেননি। আজকের রাজনীতির এই অপার কলুষতার যুগে সে কথা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয় বই-কি।

    এ প্রসঙ্গে বলা যাক, অনেকেই মনে করেন রবীন্দ্রনাথকে যে বহু মানুষ ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতেন সেই অভিধা গান্ধীরই দেওয়া। পাশাপাশি অনেকে এটাও মনে করেন যে, রবীন্দ্রনাথই গান্ধীকে প্রথম ‘মহাত্মা’ বিশেষণটি দেন। বলা বাহুল্য, দুটি ধারণাই ভ্রান্ত। আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘গোণ্ডাল রসশালা’ নামক এক আয়ুর্বেদিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জয়রাম শাস্ত্রী গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ আখ্যা দেন। অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধিত করেন।

    যাই হোক, এবার আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পাকাপাকিভাবে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের আগে গান্ধী তাঁর ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন এবং দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের পরামর্শে ছাত্রদের শান্তিনিকেতনে পাঠানো মনস্থ করেন। গান্ধী দেশে ফেরার আগেই ১৯১৪ সালের ৪ নভেম্বর ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে মগনলাল গান্ধী হরিদ্বার থেকে শান্তিনিকেতনে আসেন। ওই ছাত্রদের পর্যবেক্ষণ করে ১৯১৪-র ১৫ নভেম্বর অ্যান্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “আমি ফিনিক্‌স-এর বালকদের যেটুকু দেখেছি তাতে মানছি যে তারা খুব ভালো, কিন্তু অমন পুরোপুরি ভালো ছেলে হওয়াটাকে আমি করুণার বিষয় বলে মনে করি। তাদের মধ্যে আদর্শের পরিবর্তে আছে নিয়মানুবর্তিতা। তারা আদেশ পালনের শিক্ষাই পেয়েছে, এটা মানুষের পক্ষে মন্দ, কারণ শুধুমাত্র আদেশ পালনই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ গুণ নয়, এ ক্ষেত্রে আদেশপালন আর আত্মবিলোপ এক হয়ে গেছে। এই বালকেরা ইচ্ছে করার ক্ষমতা ভুলে যাওয়ার বিপদে আক্রান্ত এবং ইচ্ছে করা হল কিছু পাওয়ার সেরা অঙ্গ। যা হোক, তারা সুখী, যদিও তাদের সুখী হবার কোনও কারণ দেখিনি।”

    বস্তুতপক্ষে, এই সময় থেকেই গান্ধীবাদী আদর্শের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আদর্শগত সংঘাতের শুরু এবং সেই সংঘাতের শুরু শিক্ষার প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথ যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্বান ও পণ্ডিতদের ডেকে এনে এদেশে বিশ্ববিদ্যার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তখন গান্ধী চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং আচমকা অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে এক বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ঠেলে দিচ্ছেন অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে।

    গান্ধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর মূল কথাই হল সামগ্রিক ভাবে আধুনিক সভ্যতা তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই ঘোষণার প্রধান ও প্রথম যুক্তি হচ্ছে ‘… India, as so many writers have shown, has nothing to learn from anybody else, and this is as it should be’। এই যে ভারতীয় সভ্যতার প্রতি প্রায়-মৌলবাদী ঝোঁক; এই যে ভারতবর্ষের জানলা দিয়ে আসা অন্যান্য সভ্যতার আলোকে জোর করে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা; তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লেখেন: “... আমাদের দেশের বিদ্যানিকেতনকে পূর্বপশ্চিমের মিলননিকেতন করে তুলতে হবে, এই আমার অন্তরের কামনা। বিষয়লাভের ক্ষেত্রে মানুষের বিরোধ মেটে নি, সহজে মিটতেও চায় না। সত্যলাভের ক্ষেত্রে মিলনের বাধা নেই। যে গৃহস্থ কেবলমাত্র আপন পরিবারকে নিয়েই থাকে, আতিথ্য করতে যার কৃপণতা, সে দীনাত্মা। শুধু গৃহস্থের কেন, প্রত্যেক দেশেরই কেবল নিজের ভোজনশালা নিয়ে চলবে না, তার অতিথিশালা চাই যেখানে বিশ্বকে অভ্যর্থনা করে সে ধন্য হবে। শিক্ষাক্ষেত্রেই তার প্রধান অতিথিশালা। ... আমার প্রার্থনা এই যে, ভারত আজ সমস্ত পূর্বভূভাগের হয়ে সত্যসাধনার অতিথিশালা প্রতিষ্ঠা করুক। তার ধনসম্পদ নেই জানি, কিন্তু তার সাধনসম্পদ আছে। সেই সম্পদের জোরে সে বিশ্বকে নিমন্ত্রণ করবে এবং তার পরিবর্তে সে বিশ্বের সর্বত্র নিমন্ত্রণের অধিকার পাবে।”

    গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী আদর্শগত সংঘাত বাধে গান্ধীর অহিংস নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ধারণা নিয়ে। ১০ এপ্রিল, ১৯১৯ রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে লেখেন, “নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নিজে কিছু নৈতিক নয়, একে যেমন সত্যের স্বপক্ষে প্রয়োগ করা যায় তেমন সত্যের বিপক্ষেও প্রয়োগ করা যায়, এর মধ্যে একটা বিপদ আছে, সেই বিপদ সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কারণ তখন এটা প্রলোভনে পরিণত হয়।” এই যুক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি সাক্ষাতে যেখানে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে বলেন যে, তাঁর প্রধান আপত্তি হল অসহযোগ আন্দোলনের নামে জোর করে সব মানুষকে এক ছাঁচে ঢেলে, এক মতে এনে, এক কাজে বাধ্য করানোতে। তার উত্তরে গান্ধী বলেন যে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি অমূলক, কারণ গান্ধীবাদীরা অহিংসায় বিশ্বাসী। গান্ধীর উত্তর শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেন, “Come and look over the edge of my verandah, Gandhiji. Look down there and see what your non-violent followers are up to. They have stolen from the shops in the Chitpore Road, they’ve lit that bonfire in my courtyard and are now howling round it like a lot of demented dervishes. Is that non-violence?”। রবীন্দ্রনাথ ভেবেচিন্তেই ‘stolen’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল খুচরো দোকানদাররা খদ্দেরদের কাছে বিক্রির জন্য পাইকারদের কাছ থেকে দাম দিয়ে কাপড়গুলো কিনে এনেছেন, সুতরাং অহিংস স্বেচ্ছাসেবকদের দোকানদারদের কাছ থেকে দাম দিয়ে কাপড় কিনে আনার পরেই সেটা পোড়ানো উচিত।

    ইতিমধ্যে দেশব্যাপী অহিংস অসহযোগের ডাক দিয়েছেন গান্ধী এবং সেই অসহযোগের প্রধানতম অস্ত্র নির্ধারিত হয়েছে একদিকে বিলিতি পণ্য বিশেষত বস্ত্র ‘বয়কট’ ও অন্যদিকে ‘স্বদেশি’। এই স্বদেশিরই প্রধানতম রূপ হিসাবে তিনি স্থান দিয়েছেন চরকাকে, যে চরকা ১৯১৬ সাল অবধি চাক্ষুষ করেননি বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন! এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি জানান, “I am a salesman of swaraj. I am a devotee of khadi. It is my duty to induce people, by every honest means, to wear khadi. This, according to me, will help us in securing swaraj” (CWMG, ৩১/২০৩)। আমরা আগেই দেখেছি, অসহযোগ আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল, স্বরাজও এক বছরের মধ্যে আসেনি; তবুও চরকার মাহাত্ম্য প্রচারে দমেন না গান্ধী। আবারও খদ্দর পরিধানের জন্য তিনি আপামর দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে ১৯২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বেলগাঁও কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, “I am convinced that swaraj cannot come so long as the tens of millions of our brothers and sisters do not take to the charkha, do not spin, do not make khadi and wear it” (CWMG, ২৯/৪৮৩)। শুধু তাই নয়, একই আহ্বান তিনি জানান ১৯২৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর কানপুরেও, “Even today I tell you with all the confidence that I can command that if only you all completely boycott all foreign and Indian mill-made cloth, you will achieve swaraj within less than a year” (CWMG, ৩৩/৩৪১)।

    কৃষকদের এই বাধ্যতামূলক চরকা কাটার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। অসহযোগের উন্মাদনার যুগে চরকার বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য তাঁকে প্রভূত সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে, তবুও এ ব্যাপারে আজীবন সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন তিনি। ১৯২১-এর ২৯ অগস্ট ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন — “একটি কথা উঠেছে এই যে, ভারতে শতকরা আশিজন লোক চাষ করে এবং তারা বছরে ছয় মাস বেকার থাকে তাদের সুতা কাটতে উৎসাহিত করবার জন্যে কিছুকাল সকল ভদ্রলোকেরই চরকা ধরা দরকার। প্রথম আবশ্যক হচ্ছে যথোচিত উপায়ে তথ্যানুসন্ধান দ্বারা এই কথাটি প্রতিপন্ন করা। অর্থাৎ কী পরিমাণ চাষা কতদিন পরিমাণ বেকার থাকে। যখন চাষ বন্ধ তখন চাষারা কোনো উপায়ে যে পরিমাণ জীবিকা অর্জন করে সুতাকাটার দ্বারা তার চেয়ে বেশি অর্জন করবে কি না। চাষ ব্যতিরেকে জীবিকার একটিমাত্র উপায়ের দ্বারা সমস্ত কৃষাণকে বদ্ধ করা দেশের কল্যাণের পক্ষে উচিত কি না সে সম্বন্ধেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মূল কথা এই যে, কারো মুখের কথায় কোনো অনুমানমাত্রের উপর নির্ভর করে আমরা সর্বজনীন কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারব না, আমরা বিশ্বাসযোগ্য প্রণালীতে তথ্যানুসন্ধান দাবি করি। তার পরে উপায়ের যথাযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচার করা সম্ভবপর।”

    পাশাপাশি, অসহযোগের বয়কট অস্ত্রকেও তীব্র আক্রমণ করে ওই প্রবন্ধে তিনি আরও লিখলেন — “কাপড় পোড়ানোর হুকুম আজ আমাদের ’পরে এসেছে। সেই হুকুমকে হুকুম বলে আমি মানতে পারব না, তার প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে, চোখ বুজে হুকুম মানার বিষম বিপত্তি থেকে দেশকে উদ্ধার করবার জন্যে আমাদের লড়তে হবে – এক হুকুম থেকে আর এক হুকুমে তাকে ঘুরিয়ে হুকুম-সমুদ্রের সাতঘাটে তাকে জল খাইয়ে মারতে পারব না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, যে কাপড় পোড়ানোর আয়োজন চলছে সে আমার কাপড় নয়, বস্তুত দেশবাসীদের মধ্যে যাদের আজ কাপড় নেই এ কাপড় তাদেরই, ও কাপড় আমি পোড়াবার কে। যদি তারা বলে পোড়াও তা হলে অন্তত আত্মঘাতীর ’পরেই আত্মহত্যার ভার দেওয়া হয়, তাকে বধ করবার ভার আমাদের উপর পড়ে না। যে-মানুষ ত্যাগ করছে তার অনেক কাপড় আছে আর যাকে জোর করে ত্যাগদুঃখ ভোগ করাচ্ছি কাপড়ের অভাবে সে ঘরের বার হতে পারছে না। এমনতরো জবরদস্তির প্রায়শ্চিত্তে পাপক্ষালন হয় না। বার বার বলেছি আবার বলব, বাহ্য ফলের লোভে আমরা মনকে খোয়াতে পারব না। যে কলের দৌরাত্ম্যে সমস্ত পৃথিবী পীড়িত, মহাত্মাজি সেই কলের সঙ্গে লড়াই করতে চান, এখানে আমরা তাঁর দলে। কিন্তু যে মোহমুগ্ধ মন্ত্রমুগ্ধ অন্ধবাধ্যতা আমাদের দেশের সকল দৈন্য ও অপমানের মূলে, তাকে সহায় করে এ লড়াই করতে পারব না। কেননা তারই সঙ্গে আমাদের প্রধান লড়াই, তাকে তাড়াতে পারলে তবেই আমরা অন্তরে বাহিরে স্বরাজ পাব।”

    রবীন্দ্রনাথের চরকাবিরোধী চিন্তাধারার জন্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। সমালোচনার উত্তরে ‘সবুজপত্র’-র ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘চরকা’ নামক প্রবন্ধটি যেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন: “ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি লোক স্বভাবস্বাতন্ত্র্যনির্বিচারে এই ঘূর্ণ্যমান চরকার কাছে যে যতটা পারে আপন সময় ও শক্তির নৈবেদ্য সমর্পণ করবে – চরকার কি প্রকৃতই সেই মহিমা আছে। ... কোনো বড়ো সামগ্রীই সস্তা দামে পাওয়া যায় না। দুর্লভ জিনিসের সুখসাধ্য পথকেই বলে ফাঁকির পথ। চরকায় স্বরাজ পাওয়া যায় এ কথা অনেকে বলছেন, অনেকে বিশ্বাসও করছেন, কিন্তু যিনি স্পষ্ট করে বুঝেছেন এমন লোকের সঙ্গে আজও আমার দেখা হয় নি।”

    শুধু তাই নয়, উক্ত প্রবন্ধের পরেও এই বিষয়ে আশ্বিনে সবুজপত্রে ‘স্বরাজ সাধন’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন — “পাঁজির নির্দিষ্ট দিন অনেক কাল হল ভেসে চলে গেছে, কিন্তু নেশা ছোটে নি। সেই নেশার বিষয়টা এই যে, স্বরাজিয়া সাধন হচ্ছে সহজিয়া সাধন। একটি বা দুটি সংকীর্ণ পথই তার পথ। সেই পথের অন্তর্গত হয়ে পড়েছে চরকা। ... চাষী চাষ করা কাজের নিয়ত অভ্যাসের দ্বারা আপনার মনকে ও দেহকে একটা বিশেষ প্রবণতা দিয়েছে। চাষের পথই তার সহজ পথ। যখন সে চাষ করে তখনই সে কাজ করে, যখন চাষ করে না তখন কাজ করে না। কুঁড়ে বলে কাজ করে না, এ অপবাদ তাকে দেওয়া অন্যায়। যদি সম্বৎসর তার চাষ চলতে পারত, তা হলে বছর ভরেই সে কাজ করত। ... চাষের উৎকর্ষ উদ্ভাবনের দ্বারা চাষীর উদ্যমকে ষোলো-আনা খাটাবার চেষ্টা না করে তাকে চরকা ঘোরাতে বলা শক্তিহীনতার পরিচয়। আমরা চাষীকে অলস বলে দোষ দিই, কিন্তু তার অবস্থার উন্নতিসাধনের উদ্দেশ্যে আমরা যখন তাকে চরকা ধরতে পরামর্শ দিই তখন সেটাতে আমাদেরই মানসিক আলস্যের প্রমাণ হয়।”

    গান্ধী নিজেই লিখেছিলেন চরকা হবে ভারতবর্ষের ৯০ শতাংশ কৃষিজীবী পরিবার (আগে যা ছিল ৭০% এবং ব্রিটিশ শিল্পনীতির ফলে যা আরও ২০% বেড়ে যায়) বছরের যে ৬ মাস চাষাবাদ না করে বেকার থাকতে বাধ্য হন, তাঁদের বিকল্প জীবিকা। কিন্তু বাকি ছ’মাস যখন কৃষকরা চাষাবাদ করেন তাঁদের জীবিকার্জনের ব্যাপারে গান্ধী নীরব। কেন নীরব? কেন তিনি বারংবার চরকার কথা বলেন কিন্তু লাঙল-কাস্তের কথা বলেন না? কারণ তাহলেই তাঁকে জমির মালিকানার অস্বস্তিকর প্রসঙ্গের মুখোমুখি হতে হবে! তিনি তো খোলাখুলিভাবে জমিদার ও মহাজনদের পক্ষে! কাজেই এ কথা স্পষ্ট, শ্রেণি সংগ্রামকে এড়িয়ে এবং ধনতন্ত্রকে বজায় রেখে কেমন করে সমস্যার সমাধান করা যায় — মূলত সেই লক্ষ্যেই গান্ধী গ্রামোন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন।

    অসহযোগ পর্বে বিদেশি কাপড় পরিধানকে গান্ধী ‘পাপ’ হিসাবে বিবেচনা করে বলেছিলেন: “I consider it a sin to wear foreign cloth. I must confess that I do not draw a sharp or any distinction between economics and ethics. Economics that hurt the moral well-being of an individual or a nation are immoral and therefore sinful” (CWMG, ২৪/৪১৫)। রবীন্দ্রনাথ এই মনোভাবের দৃঢ় বিরোধিতা করে যুক্তি সাজান এইভাবে। অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন ‘economics is bundled out and a fictitious moral dictum dragged into its place’; বিলিতি বস্ত্র সম্পর্কে বলেন বস্ত্র কেনা উচিত ‘economic science’-এর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে এবং গোটা ব্যাপারটাকে বিবেচনা করা উচিত ‘the language of economics’-এর ওপরে জোর দিয়ে।

    আমরা ক্রমশই দেখতে পাই খাদি তথা স্বদেশি নিয়ে ক্রান্তদর্শী কবির চিন্তাভাবনা কতটা অগ্রসর, কতটা আধুনিক, কতটা অর্থনীতির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। যে গ্রামভিত্তিক কুটিরশিল্পের দিবাস্বপ্ন দেশবাসীকে দেখান গান্ধী, তার তত্ত্বগত ভিত্তি যে অত্যন্ত দুর্বল তা তাঁর শিল্পনীতির বিশ্লেষণ করলেই ধরা পড়ে। আমরা জানি, যখন থেকে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের উৎপাদন পণ্যে পরিণত হয় এবং ধনতন্ত্রের বাজারে কেনাবেচার বস্তু হয়, তখন থেকেই তা আর ধনতন্ত্রের বাইরে থাকে না, বরং ধনতন্ত্রেরই অধীন হয়ে যায়; বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে তা ধনতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ হস্তশিল্পের শ্রমিক-কারিগর যখন ব্যবসায়ী-মহাজনদের হয়ে তাঁদেরই সরবরাহিত উপাদান দিয়ে সাধারণ মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন, তখন সেই শ্রমিক-কারিগররাও কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।

    সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই পল্লী সংগঠনের উদ্দ্যেশ্যে গান্ধী যখন ‘অল ইন্ডিয়া স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (AISA) বা ‘অল ইন্ডিয়া ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ (AIVIA) জাতীয় উদ্যোগগুলি গ্রহণ করেন, তখন সেগুলোও ক্রমে ধনতান্ত্রিক চরিত্রের সংগঠনে পরিণত হতে বাধ্য হয়। ১৯৪৬ সালে গান্ধীও উপলব্ধি করেন, যাঁরা পণ্য তৈরি করেন তাঁরা সেইসব পণ্য পরবার জন্য তৈরি করেন না, পরেনও না – কেবল বিক্রি করেন (হরিজন ২১-৭-১৯৪৬)। আর শহরের যাঁরা সেসব পণ্য কেনেন তাঁরা গান্ধীর মতে “… had to wear khadi and do the penance. They were willing to buy penance for a few extra rupees which they could easily spare and be called patriots into the bargain” (CWMG, ৯১/২৭০-৭১)।

    শুধু কি তাই? এই শ্রমিক-কারিগররা মজুরিতে ঠকেন, মহাজনদের শোষণের শিকার হন। গান্ধী নিজেই লিখেছেন, ‘যাঁরা সুতো কাটেন তাঁরা মজুরিতে ঠকেন। মজুরি যথাসম্ভব কমানো হয়’ (হরিজন ১৩-৭-১৯৩৫)। এমনকি অবিকল ধনতান্ত্রিক রীতিতে ছাঁটাই-এরও প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (হরিজন ১০-৮-১৯৩৫)। কুটিরশিল্পের এই পুঁজিবাদী চরিত্রে রূপান্তর সম্পর্কে গান্ধী নিজেই স্বীকার করে লেখেন, “What we do today is to go to the villagers with a money-bag like bankers and promise four or six annas for spinning” (CWMG, ৮৫/৪৯)।

    পাশাপাশি, দেশ ছেয়ে যায় নকল খদ্দরে। এই তিক্ত অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে গান্ধী চেষ্টা করেন খদ্দরের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখতে, কিন্তু তাতেও যে তিনি সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পারেন না সেটা স্পষ্ট হয় যখন তিনি লিখতে বাধ্য হন, “Letters are coming in from everywhere telling me that greedy persons have been selling foreign or mill-made cloth by passing it off as khadi and they also put up the price of such cloth. This does not surprise me. When the entire system of government is based on fraud, what else can we expect from people? … The easiest safeguard against this is that every village should produce its own khadi and that people in the cities should buy only such khadi as does not look like mill-made cloth, and that too preferably stamped with a Congress mark. Even if all these precautions are taken, there is no guarantee that there would be no danger of fraud” (CWMG, ২৪/১৭০)।

    তিনি দেশীয় মিলমালিকদের সততার ওপরেও ভরসা হারিয়ে ফেলে বলেন, “It is foolish to expect any big sacrifices from the mill-owners. They will be the last, not the first, to wake up, and we should conduct our struggle on that assumption. To blame them on this ground is to blame human nature. In their place we would certainly behave in much the same way” (CWMG, ২৪/৩৮০)। যদিও মিলমালিকরা খদ্দর পরিধানের এই লাগাতার প্রচারের ফলে যথেষ্ট লাভের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হন না! গান্ধীর নিজের কথায়, “মিল সব খাদি প্রচারে রুষ্ট নয়। বরং তার বিপরীত। অনেক মিল এজেন্ট আমাকে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে তাঁরা খাদি প্রচারে উপকৃত হয়েছেন। কারণ এই প্রচার বিদেশিবস্ত্র-বিরোধী আবহাওয়া গড়ে তুলেছে। এতে তাঁরা তাঁদের অপেক্ষাকৃত মোটা কাপড় বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছেন” (CWMG, ৪২/১০)।

    ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর উনবিংশ পরিচ্ছেদে মিলমালিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসাবে তিনি লিখেছিলেন, “We cannot condemn mill-owners; we can but pity them. It would be too much to expect them to give up their mills, but we may implore them not to increase them. If they would be good they would gradually contract their business. They can establish in thousands of households the ancient and sacred handlooms and they can buy out the cloth that may be thus woven”। অথচ বাস্তবচিত্র দেখতে পেয়ে তিনি লেখেন, “নতুন মিল সহজে গড়া যায় না। তার জন্য কাউকে বিশেষ চেষ্টাও করতে হয় না। ধনীরা নিজেরাই চেষ্টা করে এবং সংখ্যা বাড়িয়ে যায়” (CWMG, ২১/৩৪)।

    অর্থনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কুটিরশিল্পের জন্য যাঁরা বেশি করে বলেন তাঁদের আসল বাসনা থাকে বৃহৎ শিল্পের জন্য সংরক্ষণ শুল্ক এবং তারই সাহায্যে ঘটে বৃহৎ শিল্পের প্রসার। বলা বাহুল্য, ভারতীয় শিল্পপতিরাও খাদিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টার ওই অর্থই বুঝতেন। তাই ১৯২৪ সালের ১১ জুন ঘনশ্যামদাস বিড়লা গান্ধীকে চিঠিতে লেখেন, “আমরা খাদিকে জনপ্রিয় করতে পারি এবং সংরক্ষণ শুল্ক দ্বারা ব্রিটিশ পণ্যের বয়কটকে সুনিশ্চিত করতে পারি”। গান্ধীকেও বলতে দেখি, “Protection of her staple industry is her birthright. I would therefore protect the Indian mills against foreign competition even though for the time being it may result in mulcting the poor people. Such mulcting can take place only if the mill-owners be so unpatriotic as to raise prices owing to the monopoly they may secure. I have therefore no hesitation in advocating the repeal of cotton excise duties and imposition of a prohibitive import duty” (CWMG, ২৯/৪৫)।

    তাই যদি তিনি চান তবে তো এটাও তাঁর বোঝার কথা যে, একই সঙ্গে একই দেশে একদিকে কুটিরশিল্পের প্রস্তাব এবং অন্যদিকে সংরক্ষণ শুল্কের দাবি অচল, কারণ মিল শিল্প একচেটিয়া হলে চরকার কোনও স্থানই থাকতে পারে না। তিনি তো দেখেছিলেন তাঁর বিভিন সংঘগুলোর ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর, দেখেছিলেন মিলমালিকদের অসততা, দেখেছিলেন খদ্দরের অকারণ মূল্যবৃদ্ধি, তবুও তিনি সংরক্ষণ শুল্কের হয়ে ওকালতি করেন কাদের স্বার্থে? চরকা নিয়ে গান্ধীর এই নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে আদতে ব্যর্থ অভিযান মাত্র সে কথাও স্বীকার করে নিয়ে তিনি লেখেন: “There are seven lakh villages in India. Thousands of them do not even know what the charkha is. This is our fault and it is because of this fault that we have failed to put khadi work on a sound basis” (CWMG, ৮৪/৩৪২)।

    এই যে ‘পাপ’ নিয়ে গান্ধীর চূড়ান্ত অবসেসন, তার প্রতিফলন আমরা শুধু বিলিতি বস্ত্র পরিধানের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করি না, একইভাবে তাঁর এই পাপবোধ জড়িত থাকে তাঁর যৌনচেতনার ক্ষেত্রেও। ১৯০৬ সাল থেকে ব্রহ্মচর্যের ‘তপস্যা’-য় রত গান্ধী তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের বিপ্রতীপ বিন্দুতে অবস্থান করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ১৯২৫ সালের ১২ মার্চ গান্ধী লেখেন, “There can be no two opinions about the necessity of birth-control. But the only method handed down from ages past is self-control or brahmacharya. It is an infallible sovereign remedy doing good to those who practise it. … The union is meant not for pleasure but for bringing forth progeny. And union is a crime when the desire for progeny is absent. …Artificial methods are like putting a premium upon vice. They make men and women reckless. … Adoption of artificial methods must result in imbecility and nervous prostration. … It is still worse for a person to indulge in his animal passions and escape the consequences of his acts. … if artificial methods become the order of the day, nothing but moral degradation can be the result” (CWMG, ৩০/৩৯০-৯১)।

    এ ব্যাপারে মার্গারেট স্যাঙ্গার কবির মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “I am of opinion that [the] Birth Control movement is a great movement not only because it will save women from enforced and undesirable maternity, but because it will help the cause of peace by lessening the number of surplus population of a country scrambling for food and space outside its own rightful limits. In a hunger-stricken country like India it is a cruel crime thoughtlessly to bring more children into existence than could properly be taken care of , causing endless suffering to them and imposing a degrading condition upon the whole family…. I believe that to wait till the moral sense of man becomes a great deal more powerful than it is now and till then to allow countless generations of children to suffer privations and untimely death for no fault of their own, is a great social injustice which should not be tolerated. I feel grateful for the cause you have made your own and for which you have suffered”। একই বিষয়, অথচ একই সময়ে দাঁড়িয়ে দু’জন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর কতটা ফারাক।

    এই ফারাক আরও বেশি করে চোখে পড়ে বিহারের ভূমিকম্পের ব্যাখ্যায়। রবীন্দ্রনাথ যতটাই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করেন, গান্ধী যেন তত বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরেন তাঁর ‘পাপ’ সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণাকে। ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি আনুমানিক দুপুর সওয়া দুটো নাগাদ বিহারে এক প্রবল ভূমিকম্প হয়। পূর্বে পূর্ণিয়া থেকে পশ্চিমে চম্পারণ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকা এবং উত্তরে নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে দক্ষিণের মুঙ্গের পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ভূকম্পন অনুভূত হয়। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হিসেব অনুযায়ী এই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার, যদিও বেসরকারি মতে তার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজারে।

    ভূমিকম্পের সময় গান্ধী ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে অস্পৃশ্যতা দূরীকরনের উদ্দেশ্যে ঝটিকা সফর করছিলেন। এই ভূমিকম্পের দিন তিনি কালিকটে ছিলেন এবং দিনটি ছিল তাঁর মৌনতার দিন। ঘটনার ন’দিন পরে ২৪ জানুয়ারি মাদ্রাজের তিনেভেল্লির এক জনসভায় প্রায় ২০ হাজার শ্রোতার সামনে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে গান্ধী বলেন: “We who have faith in God must cherish the belief that behind even this indescribable calamity there is a divine purpose that works for the good of humanity. You may call me superstitious if you like; but a man like me cannot but believe that this earthquake is a divine chastisement sent by God for our sins” (CWMG, ৬৩/৩৮)। একই দিন তুতিকোরিনের সভায় তিনি ওই ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করে বলেন, “I want you to be ‘superstitious’ enough with me to believe that the earthquake is a divine chastisement for the great sin we have committed and are still committing against those whom we describe as untouchables, Panchamas, and whom I describe as Harijans” (CWMG, ৬৩/৪০)।

    যে অস্পৃশ্য-দলিতদের কথা এখানে বলছেন গান্ধী, সেই অস্পৃশ্য-দলিতদের তিনি কীভাবে ব্যবহার করেছেন তা আগের পর্বেই স্পষ্ট হয়েছে। অথচ এই অস্পৃশ্য-দলিতদের সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করতেন রবীন্দ্রনাথ? বিহারের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অনেক আগেই ১৯২৬ সালে তিনি লিখেছিলেন ‘শূদ্রধর্ম’ নামক প্রবন্ধটি যেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন — “যে-সকল কাজ বাহ্য অভ্যাসের নয়, যা বুদ্ধিমূলক বিশেষ ক্ষমতার দ্বারাই সাধিত হতে পারে, তা ব্যক্তিগত না হয়ে বংশগত হতেই পারে না। যদি তাকে বংশে আবদ্ধ করা হয় তা হলে ক্রমেই তার প্রাণ মরে গিয়ে বাইরের ঠাটটাই বড়ো হয়ে ওঠে। ... স্বধর্মরত শূদ্রের সংখ্যাই ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি, তাই এক দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ শূদ্রধর্মেরই দেশ। তার নানা প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া গেছে। এই অতি প্রকাণ্ড শূদ্রধর্মের জড়ত্বের ভারাকর্ষণে ভারতের সমস্ত হিন্দুসম্প্রদায়ের মাথা হেঁট হয়ে আছে। বুদ্ধিসাধ্য জ্ঞানসাধ্য চারিত্রশক্তিসাধ্য যে-কোনো মহাসম্পদলাভের সাধনা আমরা আজ করতে চাই তা এই প্রবল শূদ্রত্বভার ঠেলে তবে করতে হবে।”

    যাই হোক, গান্ধী বিহারের ভূমিকম্প নিয়ে যে বিবৃতি দেন তা সংবাদপত্রে রিপোর্ট হিসেবে এইভাবে প্রকাশিত হয়: “I want you, to be superstitious enough to believe with me that the earthquake is a divine chastisement for the great sin we have committed against those whom we describe as harijans”। এতে প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে গান্ধীকে চিঠি লিখে এর সত্যাসত্য সম্পর্কে জানতে চান। জানার পর তিনি এর প্রত্যুত্তরে যা লেখেন তা ‘Superstition vs. Faith’ শীর্ষক রচনা হিসাবে প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালের ‘হরিজন’ পত্রিকার ১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। তিনি লেখেন, “It has caused me painful surprise to find Mahatma Gandhi accusing those who blindly follow their own social custom of untouachability of having brought down God’s vengeance upon certain parts of Bihar, evidently specially selected for His desolating displeasure. It is all the more unfortunate because this kind of unscientific view of things is too readily accepted by a large section of our countrymen. I keenly feel the indignity of it when I am compelled to utter a truism in asserting that physical catastrophes have their inevitable and exclusive origin in certain combination of physical facts. Unless we believe in the inexorableness of the universal law in the working of which God Himself never interferes, we find it impossible to justify His ways on occasions like the one which has sorely stricken us in an overwhelming manner and scale” (CWMG, ৬৩/৫১৬)।

    গান্ধীর সত্যাগ্রহ পরিচালনার পদ্ধতিরও বিরোধিতা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রসঙ্গে রোম্যাঁ রোলাঁর উপস্থিতিতে জর্জ দুয়ামেল ও এমিন রোনিগারকে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, রোলাঁ তা ২৯ জুন, ১৯২৬ তারিখের দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ করেছেন এই ভাষায় — “গান্ধী নিজের মতে স্থির থাকেন না, তাঁর মধ্যে প্রচুর পরস্পরবিরোধিতা দেখা যায়, ক্রমাগত তিনি আপস-রফা করে চলেন। তাঁর মনে গোপনে একটা সততার অভাব আছে, তাই তিনি নিজের মনে নানারকম কূট তর্কজাল বিস্তার করে নিজেকে ও অপর সাধারণকে বোঝাতে চান তিনি যে-সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেগুলি বিশুদ্ধ ও দৈবী-প্রণোদিত। বিকল্প বা বিরুদ্ধ মত সত্য হলেও এবং সেটা সত্য বলে জানলেও, তিনি অনেক সময় তা স্বীকার করতে চান না।”

    এই কথার সমর্থন মেলে ‘The History of the Indian National Congress’ গ্রন্থের লেখক পট্টভি সীতারামাইয়ার কথাতেও, যেখানে গান্ধীর নেতৃত্বদানের প্রসঙ্গে সীতারামাইয়া লেখেন: “His [Gandhi’s] is rather the trend of the motor driver driving his car in a fog where he is able to see only 10 yards ahead and then another ten, and then another ten until he reaches his goal. He carries with him no road map to mark curves and culverts, bends and bridges, railroads and level-crossing. Yet he drives right enough because his direction is right and he knows his direction intuitively”।

    ভারতবর্ষের দুই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যে এই আদর্শগত বিভেদ বজায় থেকেছে আজীবন। যে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বরাজ সাধন’ প্রবন্ধে গান্ধীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে লিখেছিলেন, “তামার পয়সাকে সন্ন্যাসী সোনার মোহর করে দিতে পারে এ কথায় যারা মেতে ওঠে তারা বুদ্ধি নেই বলেই যে মাতে তা নয়, লোভে পড়ে বুদ্ধি খাটাতে ইচ্ছে করে না বলেই তাদের এত উত্তেজনা”; মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ১৯৩৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্টেটসম্যান পত্রিকায় সেই ‘সন্ন্যাসী’ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ কথা জানাতে ভোলেননি: “We who often glorify our tendency to ignore reason, installing in its place blind belief, valuing it as spiritual, are ever paying for its costs with the obscuration of our mind and destiny. I blamed Mahatmaji for exploiting this irrational force of credulity in our people, which might have had a quick result in a superstructure, while sapping the foundation”।

    [এই পর্বে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথের সমস্ত প্রবন্ধ পাওয়া যাবে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে।]

    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. অমিয়কুমার সেন – গুরুদেব ও মহাত্মা
    ২. সুরজিৎ দাশগুপ্ত – সম্পর্কের ত্রিকোণ — রবীন্দ্রনাথ : সুভাষচন্দ্র জওহরলাল গান্ধী
    ৩. Bindu Puri – The Tagore-Gandhi Debate on Matters of Truth and Untruth
    ৪. Makarand R. Paranjape – ‘Natural Supernaturalism?’ The Tagore-Gandhi Debate on the Bihar Earthquake
    ৫. Sabyasachi Bhattacharya (compiled and ed.) – The Mahatma and the Poet: Letters and Debates between Gandhi and Tagore 1915–1941
    ৬. Sibnarayan Ray (ed.) – Gandhi, India and the World: An International Symposium


    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    অষ্টম পর্ব : গান্ধী ও নেহরু-সুভাষ — একই বৃন্তে দু’টি কুসুম


    নেহরু ও সুভাষ দু’জনেই কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি; দু’জনেই কেম্ব্রিজ-শিক্ষিত; দু’জনেই উচ্চবিত্ত পরিবারের অভিজাত বংশের সন্তান; দু্’জনেই লোভনীয় কেরিয়ার ত্যাগ করে জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়েছেন; দু’জনের ওপরেই দেশের মানুষের অসীম আস্থা; দু’জনেই গান্ধীচিন্তার পরিপন্থী বিবৃতির ফুলঝুড়ি ছড়াতে সিদ্ধহস্ত এবং দু’জনেই আসল কাজের সময়ে গান্ধীর চতুর রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনকারী। প্রথম জন চিত্তরঞ্জনের সমপর্যায়ের সর্বভারতীয় নেতা মতিলাল নেহরুর সন্তান আর দ্বিতীয় জন চিত্তরঞ্জনের ভাবশিষ্য।

    সাধারণ মানসে যে ধারণা গেঁথে আছে সেটা হল, নেহরু ও সুভাষ আদতে ছিলেন বামপন্থী মানসিকতাসম্পন্ন এবং তাঁরা দুজনেই ভবিষ্যতের ভারতবর্ষকে সমাজতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। জনসাধারণের মধ্যে এই বদ্ধমূল ধারণার অন্যতম বড় কারণ হল বিভিন্ন সময়ে নেহরু ও সুভাষের বিভিন্ন জ্বালাময়ী ভাষণ ও লেখাপত্র। কিন্তু তাঁদের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী গ্রহণে ব্যর্থতা এবং তার রূপায়ণে অনিচ্ছার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করলে এ কথা সম্ভবত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আদতে দু’জনেই ছিলেন গান্ধীর ইচ্ছাধীন ক্রীড়নক এবং শেষাবধি কংগ্রেসের প্রতিটি কর্মসূচী গ্রহণ ও রূপায়ণে মূল ভূমিকা ছিল গান্ধীরই। ১৯১৬ সালের লখনউ কংগ্রেসে গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় নেহরুর। আর সুভাষ গান্ধীর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হন ১৯২১ সালে। যেহেতু জাতীয় রাজনীতিতে নেহরু সুভাষের চেয়ে সামান্য হলেও বর্ষীয়ান এবং বয়সেও সুভাষের চেয়ে আট বছরের বড়, তাই প্রথমে আমরা নেহরুর কথা ও কাজকে বিশ্লেষণ করে দেখব এবং শেষ পর্যায়ে সুভাষকে তাঁর পাশাপাশি রেখে তুল্যমূল্য বিচার করতে চেষ্টা করব।

    পঞ্চম পর্বেই আমরা দেখেছি যে, গান্ধীর অনুপস্থিতিতে ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে নেহরুর ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পরিবর্তে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’-র প্রস্তাব পাশ হলেও, পরের বছরেই গান্ধীর হস্তক্ষেপে আবারও তা স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ফিরে আসে। এর পরে জুলাই ১৯৩৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ পর্যন্ত অল্প কিছুকাল জেলের বাইরে থাকার সময় নেহরু বিভিন্ন চিঠি ও রচনায় গান্ধীর সঙ্গে তাঁর নানা তত্ত্বগত পার্থক্য পরিষ্কার করে তুলে ধরেন। জাতীয়দাবাদী লক্ষ্যের সঙ্গে র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী যুক্ত করার ব্যাপারে তিনি বারবার জোর দেন এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের তীব্র আক্রমণ করেন। এমনকি গান্ধীর নেতৃত্ব সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে ও তাঁদের ভবিষ্যতের পথ আলাদা হবে ঘোষণা করে ১৯৩৩ সালের ১৮ জুলাই তাঁর বিখ্যাত ‘জেল ডায়েরি’-তে নেহরু লেখেন: “I am getting more and more certain that there can be no further political cooperation between Bapu and me. At least not of the kind that has existed. We had better go our different ways”। যদিও তাতে কংগ্রেস তার কর্মসূচীতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেনি, গান্ধীও এ সবে সামান্যতম বিচলিত হননি। বরং তিনি ১৯৩৩-এর ১৮ সেপ্টেম্বর বম্বে ক্রনিকলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ওঁর কমিউনিস্ট চিন্তাভাবনা নিয়ে ... কারও ভয় পাওয়ার কিছু নেই’। আরও মজার কথা, ১৯৩৪-এর ২ অগস্ট নরেন্দ্র দেবকে গান্ধী চিঠিতে লেখেন যে নেহরু হবেন ‘the natural wearer of the Congress crown of thorns when I and other elderly men and women retire’।

    একদিকে ১৯৩৪ সালের মে মাসে আচার্য নরেন্দ্র দেবের সভাপতিত্বে এবং জয়প্রকাশ নারায়ণ, নরেন্দ্র দেব ও মিনু মাসানির নেতৃত্বে পাটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি হয় কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি। অন্যদিকে ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে সরকারি নির্দেশে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলি ও তাদের শাখা সংগঠনসমূহ নিষিদ্ধ হলে, ওই বছরেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কমিউনিস্টদের যুক্তফ্রন্ট গঠনের নীতি গৃহীত হয়। ব্যক্তিগতভাবে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের অন্তর্গত কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট দলের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতে কাজ করতে শুরু করেন। পাশাপাশি ১৯৩৬-এর মধ্যে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজের শ্রমিক কেন্দ্রগুলিতে দ্রুত সংগঠন বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু হয়। ইতিমধ্যে ১৯৩৩ সালের অক্টোবর মাসে স্বরাজ্য দলকে পুনরুজ্জীবিত করে নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরে আসার পরিকল্পনাটি হাজির করেছেন সত্যমূর্তি, পরের বছর এপ্রিলে একই পরিকল্পনার কথা বলেছেন ভুলাভাই দেশাইও। আরও তাৎপর্যপূর্ণ যে, ১৯৩৪-এর এপ্রিল মাসে বিড়লাকে লেখা চিঠিতে গান্ধী স্বীকার করেছেন, “… that there will always be a party within the Congress wedded to the idea of Council-entry. The reins of the Congress should be in the hands of that group”।

    এই প্রক্রিয়া গড়ে ওঠার পেছনে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ ও চাপ যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ১৯৩৪ সালের ১২ এপ্রিল ঠাকুরদাসকে বিড়লা লেখেন, “I should like you to keep yourself in touch with Bhulabhai [Desai]. If the Swaraj Party is to be successful, they will have to collect some fund for fighting the new election and I would suggest that fund should not be supplied from Bombay without being satisfied that the right type of men are being sent”। শুধু তাই নয়, ওই বছরেরই ৩ অগস্ট বিড়লা আরও বলেন: “Vallabhbhai, Rajaji and Rajendra Babu are all fighting Communism and Socialism. It is therefore necessary that some of us who represent the healthy Capitalism should help Gandhiji as far as possible and work with a common object”।

    ১৯৩৫ সালে ‘ভারত শাসন আইন’ পাশ হওয়ার আগেই কংগ্রেস যে ক্রমশ ভারতীয় পুঁজিপতিদের খপ্পরে পড়তে চলেছে এবং সেই দলে যে কোনও ভাবেই সমাজতান্ত্রিক বামপন্থী কর্মসূচী গৃহীত হওয়া সম্ভব নয়, তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৩৩-এর মার্চ মাসে যখন এই আইনের রূপরেখা প্রকাশ করা হয়, তখন থেকেই ঘনশ্যামদাস বিড়লা যুগপৎ ভারত ও ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বারবার আশ্বাস দিচ্ছিলেন, গান্ধী আর আন্দোলনের পথে যাবেন না বরং আগামী শাসনতন্ত্রকে কার্যকর করতে তিনি আগ্রহী। ভারতসচিব স্যামুয়েল হোরকেও বিড়লা আশ্বাসের সুরে জানান — “… He [Gandhi] alone is responsible for keeping the left wing in India in check”।

    অতঃপর আট বছর আগে সাইমন কমিশন বসানো থেকে যে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ১৯৩৫-এর অগস্ট মাসে ভারত শাসন আইনে তার সমাপ্তি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রীয় স্তরে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জায়গায় আসে পরোক্ষ নির্বাচন; দ্বৈতশাসনের বদলে দায়িত্বশীল সরকার; করদ রাজ্যগুলোর প্রতিনিধি নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেসব রাজ্যের রাজাদের হাতে; ভোটাধিকার প্রাপ্তবয়স্কদের ছ’ভাগের মাত্র একভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা ৬৫ লাখ থেকে বেড়ে হয় প্রায় ৩ কোটি এবং সরকারি ‘ইচ্ছাধীন ক্ষমতা’, ‘সংরক্ষণ’ ও ‘রক্ষাকবচ’-এর বন্দোবস্তকে আরও কঠোর করে তোলা হয়। কেন্দ্র যথেষ্ট শক্তিশালীই থাকে, ‘ইচ্ছাধীন ক্ষমতা’ ছোটলাটের হাতেই থেকে যায় আর বৈদেশিক বিষয় ও প্রতিরক্ষা পুরোপুরিই থাকে বড়লাটের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সালের ২১ ডিসেম্বর বড়লাট লিনলিথগো এই আইনটি সম্পর্কে দ্বিধাহীনভাবে জেটল্যান্ডকে লিখেছিলেন, “… because we thought that way the best way ... of maintaining British influence in India. It is no part of our policy, I take it, to ... gratuitously to hurry the handing over the controls to Indian hands at any pace faster than that which we regard as best calculated, on a long view, to hold India to the Empire”। কংগ্রেসের নেতারা যে সংবিধানকে এত বছর ধরে নিন্দে করে আসছিলেন, এইবারে ক্ষমতার স্বাদ পেতে জওহরলাল কথিত সেই ‘দাসত্বের সনদ’-কেই কার্যকরী করতে উঠে-পড়ে লাগেন তাঁরা।

    জওহরলাল যখন কমলার চিকিৎসার কারণে ইউরোপে, সেই ১৯৩৬-এর এপ্রিলে কংগ্রসের লখনউ অধিবেশনে তাঁকে সভাপতির আসনে বসান গান্ধী। যেদিন নেহরু ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন সেদিনই (৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫) গান্ধী তাঁকে লেখেন, “Unless there is an insuperable bat, you should take charge of the Congress next year”। ১২ তারিখে আরও স্পষ্ট ভাষায় জানান: “I would like you to allow yourself to be elected President for the next year. Your acceptance will solve many difficulties”। কমলার মৃত্যুর কাছাকাছি সময় নাগাদ নেহরু খবর পান, তিনি ৫৯২ জন সদস্যের মধ্যে ৫৪১ জন সদস্যের ভোট পেয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

    মূলত কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টদের কোণঠাসা করতেই ১৯৩৬ সালে ‘বামপন্থী’ নেহরুকে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এগিয়ে দেন গান্ধী, যিনি ১৯৩৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস ত্যাগ করার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “If they [Congress Socialists] gain ascendancy in the Congress, as they well may, I cannot remain in the Congress” (CWMG, ৬৫/৬)। এই জটিল পরিস্থিতিতে সব জেনে বুঝেও এপ্রিলে লখনউ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নেহরু বলেন, ভারতের তথা পৃথিবীর সকল সমস্যার সমাধান আছে সমাজতন্ত্রে যার অর্থ ‘আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় বিপুল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন’। তিনি ঘোষণা করেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিশ্ব সমস্যাবলী ও ভারতের সমস্যাবলী সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে সমাজতন্ত্রের মধ্যে। আর আমি যখন এই শব্দটা ব্যবহার করি তখন তা অস্পষ্ট মানবতাবাদী অর্থে নয়, বরং ব্যাপক বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক অর্থে করি। ... সমাজতন্ত্র ছাড়া দারিদ্র্য, ব্যাপক বেকারত্ব, মর্যাদাহীনতা ও ভারতীয় জনগণের নিপীড়ন অবসানের অন্য কোনও পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না। এর জন্যে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে বিপুল পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন। এর অর্থ, সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র ছাড়া ব্যক্তি-মালিকানার সম্পত্তির অবসান এবং বর্তমান মুনাফাভিত্তিক ব্যবস্থার বদলে সমবায় পরিষেবার উচ্চতর আদর্শভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।”

    নেহরুর লখনউ অভিভাষণ বোম্বাইয়ের বেশ কিছু প্রথম সারির শিল্পপতিকে প্রাথমিকভাবে শঙ্কিত করে তুললেও বিড়লা জওহরলালকে ঠিকই চিনেছিলেন। ২০ এপ্রিল তিনি ঠাকুরদাসকে লেখেন: “Mahatmaji kept his promise and without uttering a word, he saw that NO NEW COMMITMENTS WERE MADE (চিঠির এই অংশে বিড়লা নিজেই জোর দিয়েছেন). Jawaharlalji’s speech in a way was thrown into the wastepaper basket because all the resolutions that were passed were again against the spirit of his speech. He [Jawaharlal] could have caused a split by resigning but he did not ... Jawaharlalji seems to be like a typical English democrat who takes defeat in a sporting spirit. He seems to be out for giving expression to his ideology, but he realizes that action is impossible and so does not press for it ... things are moving in the right direction”। তিনি আরও লেখেন, “যে নির্বাচন হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করবে ‘বল্লভভাই গোষ্ঠী’, আর লর্ড লিনলিথগো যদি ঠিকভাবে পরিস্থিতি সামলাতে পারেন, তাহলে কংগ্রেসিদের ক্ষমতায় আসার সমূহ সম্ভাবনা আছে।” চিঠির উত্তরে ২৩ এপ্রিল ঠাকুরদাস বলেন: “I never had any doubt about the bonafides of J., only I feel that a good deal of nursing will have to be done to keep J. on the right rails all through”।

    লখনউ অধিবেশনের পরের মাসগুলোতে বিড়লার দূরদৃষ্টি আরও একবার প্রকট হল। সভাপতি নির্বাচিত হয়ে নেহরু তাঁর পছন্দসই ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে পারলেন না। তাঁর সভাপতির ভাষণকেও গান্ধী অভিহিত করলেন ‘a confession of his faith’ বলে। চরম হতাশ নেহরু ২৫ মে গান্ধীকে লিখলেন, “A hayadar (হিন্দি শব্দটিই ব্যবহার করেছিলেন তিনি) president would probably have resigned but I being a behaya (আবারও হিন্দিতেই) stuck on even though the majority of the Congress had decided against me on some vital issues”। রাজাগোপালাচারি গান্ধীকে ‘কিছু করা’-র অনুরোধ জানিয়ে লিখলেন: “Something should be done by you to see that Vallabhbhai’s decision as regards parliamentary policy are not challenged but given full cooperation from the Working Committee and by the Congress President”। ২৯ জুন ওয়ার্ধায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাজাগোপালাচারি এবং কৃপালনির নেতৃত্বে কার্যনির্বাহী কমিটির ৭ জন সদস্য নেহরুর সমাজবাদী ভাষণাবলির অজুহাতে পদত্যাগের ভয় দেখালেন। পদত্যাগপত্রটি লেখা হল ওয়ার্ধার আশ্রম থেকে। তিনিই যে এই কাণ্ডের মূল কাণ্ডারী সেটা জানিয়ে ৮ জুলাই নেহরুকে গান্ধী খোলাখুলি লিখলেন, “The sending of such a letter in place of resignation was my suggestion”। জওহরলালকে ‘on the right rails’-এ আনার কাজটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করলেন গান্ধী। ঠাকুরদাস অ্যান্ড কোং তো খুশি হলেনই, প্যাটেলরাও কম হৃষ্টচিত্ত হলেন না!

    ১৯৩৬-এর ডিসেম্বর মাসে ফৈজপুরে কংগ্রেস নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিল, যদিও মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ অবধি ঝুলিয়ে রাখা হল। নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেই জওহরলাল ফৈজপুর কংগ্রেসে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হলেন। আট মাস সময় কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে খুবই কম সময় বলে নেহরু আরও একবার সভাপতি হতে চাইলেন নিজেই। গান্ধী এবার প্যাটেলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত করলেন। নেহরুর মাথা থেকে তখন সমাজতন্ত্রের ভূত চিরতরে বিদায় নিয়েছে! সভাপতির ভাষণে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করলেন, “The Congress stands for full democracy in India and fights for a democratic state, not for socialism”। এর আগে যখন নির্বাচনী প্রচারের ম্যানিফেস্টো রচনা করছেন নেহরু, সেখানেও সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ অবধি করেননি!

    ১৯৩৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস দুর্দান্ত ফল করল। এগারোটি প্রদেশের মধ্যে পাঁচটি প্রদেশে (মাদ্রাজ, বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও যুক্তপ্রদেশ) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল তারা। যদিও বাংলা, আসাম, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হল। নির্বাচনে এই অভাবনীয় সাফল্যের ফলে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকল। বিড়লা লন্ডনের এক সরকারি আধিকারিককে লিখলেন: “There is no political leader including Jawaharlal who wants to see any crisis or violence .... Popular impatience and the prevalent atmosphere are responsible for these strong speeches. Even leaders are often led. But I think unrestrained language will be heard less and less in the future”।

    আবারও বিড়লা নির্ভুল প্রমাণিত হলেন। নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পরে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নিল। যদি কোনও ‘প্রদেশের কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের নেতা নিজে বোঝেন আর জনসমক্ষে বলতে পারেন যে লাট তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না’ তাহলে সেই শর্তে পদ গ্রহণ করা যাবে – এই মর্মে প্রস্তাব আনলেন প্যাটেল ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ১৯৩৭-এ এআইসিসি-র মার্চ অধিবেশনে তা গৃহীত হল। বড়লাট লিনলিথগো ‘লাট তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না’ – এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনও আশ্বাস দিতে নারাজ হলেও কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে গান্ধী মনস্থির করে ফেললেন।

    নেহরু হতাশ হলেন আবারও। এ বিষয়ে এম এন রায় তাঁকে তাঁর খসড়া প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিনা, তা জিজ্ঞাসা করায় নেহরু পরিষ্কার বললেন, “No, they have accepted the whole damn thing, supplemented by a short paragraph dictated by Gandhiji, which invalidates the rest of the resolution”। গান্ধী নিজেও সংবাদমাধ্যমের সামনে ৩০ মার্চ বললেন যে, তিনিই হচ্ছেন ‘the sole author of the office-acceptance clause of the Congress resolution’। এর পরে আমরা দেখব, নেহরু সরকারের প্রধান হচ্ছেন এবং সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী রূপায়ণ শিকেয় তুলে রেখে আরও বেশি বেশি করে গান্ধী তথা কংগ্রেসের সাবেকি, দক্ষিণপন্থী নেতাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করছেন। এই সুযোগে তাঁর আলোচনা ও মূল্যায়ন সাময়িক স্থগিত রেখে আমরা চোখ ফেরাব অন্য তরুণ তুর্কি সুভাষের দিকে।

    সুভাষের রাজনৈতিক জীবন মাত্র ২৪ বছরের, তার মধ্যে জেলে কেটেছে ৬ বছর ৩ মাস এবং ইউরোপে কেটেছে ৬ বছর ৯ মাস। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করতে ইচ্ছুক সুভাষ আইসিএস থেকে পদত্যাগ করে ১৯২১ সালের ১৬ জুলাই ইংল্যান্ড থেকে বোম্বাই পৌঁছে ওই দিনই গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ওই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে পরে তিনি লেখেন, “মহাত্মা গান্ধীর সাক্ষাৎ প্রার্থনার আমার উদ্দেশ্য ছিল, যে আন্দোলনে আমি যোগ দিতে যাচ্ছি, তার নেতার কাছ থেকে তাঁর কর্মসূচী সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা করা। ... কিন্তু সেই সময়ে যদিও আমি নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, আমার নিশ্চয়ই বুদ্ধির অভাব আছে, তবু বারে বারেই যুক্তির দ্বারা স্পষ্ট অনুধাবন করেছিলাম, মহাত্মা যে পরিকল্পনা রচনা করেছেন, তার মধ্যে স্পষ্টতার শোচনীয় অভাব আছে, এবং যে আন্দোলনের দ্বারা ভারত তার অভীষ্ট স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছবে, তার একের পর এক ধাপগুলি সম্বন্ধে, তাঁর নিজেরই স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই।”

    অতঃপর গান্ধীর সাহচর্য ছেড়ে, গান্ধীরই পরামর্শে তিনি দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের একান্ত অনুগামী শিষ্য হয়ে। অসহযোগ আন্দোলন আচমকা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ক্ষুব্ধ চিত্তরঞ্জন তৈরি করলেন স্বরাজ্য দল, হলেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র আর মাত্র ২৭ বছরের সুভাষ হলেন সেই কর্পোরেশনের সিইও। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর অব্যবহিত আগে ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর বলশেভিক প্রচারকদের সঙ্গে যুক্ত থাকার হাস্যকর অভিযোগে সুভাষকে গ্রেফতার করে প্রথমে পাঠানো হল আলিপুর জেলে, পরের বছর জানুয়ারিতে বর্মার মান্দালয়ে। দীর্ঘ কারাবাসের পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল ১৯২৭-এর ১৬ মে। ততদিনে মারা গেছেন চিত্তরঞ্জন, দেশ জুড়ে মাথা চাড়া দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ আর বঙ্গীয় কংগ্রেসে প্রকট হয়ে উঠেছে তীব্র দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। এরই মাঝে ১৯২৭ সালের ৪ এপ্রিল বর্মার ইনসিন জেল থেকে শরৎ বসুকে লেখা চিঠিতে সুভাষ খোলাখুলিভাবে কমিউনিজমের বিরোধিতা করে জানালেন: “যদি আমার বলশেভিক এজেন্ট হওয়ার ইচ্ছে থাকত তবে আমি সরকার বলা মাত্রই প্রথম জাহাজে ইউরোপ যাত্রা করতাম। সেখানে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের পর বলশেভিক দলে মিশে সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে প্যারিস থেকে লেনিনগ্রাড পর্যন্ত ছোটাছুটি করতাম, কিন্তু আমার সে রকম কোনও ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নেই।”

    ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে সুভাষ হলেন বাংলা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। ওই বছরেই মাদ্রাজ কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সুভাষ আর নেহরুকে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হল। মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই সুভাষ ক্রমে প্রাদেশিক নেতা থেকে সর্বভারতীয় নেতায় উত্তীর্ণ হলেন। ওই একই বছরে বাংলার আইনসভায় বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইনে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হল। পুরনো আইনে কৃষকদের জমি বিক্রি-দান-হস্তান্তর করার জন্য জমিদারকে সেলামি দেওয়া এবং জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে জমিদারকে অগ্রাধিকার দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আইনসভার মুসলমান সদস্যরা সেলামি দেবার বিপক্ষে ছিলেন, ইউরোপীয় সদস্যরা শতকরা দশ টাকা সেলামি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন আর কংগ্রেস ও সরকার শতকরা কুড়ি টাকা সেলামি দেওয়ার পক্ষে ছিল। ভোটাভুটির পর দেখা গেল, কেবল জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও হেমন্তকুমার সরকার ছাড়া কংগ্রসের বাকি সব সদস্য জমিদারদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। হ্যাঁ, সুভাষও!

    কৃষকদের প্রতি সহানুভূতির (!) পরে তাঁর শ্রমিকদের প্রতি সমবেদনার চিত্র দেখা যাক। মিলমালিকদের বিরুদ্ধে কারখানায় শ্রমিকদের জঙ্গি আন্দোলনের বিষয়ে সুভাষ ১৯২৮-এর ৩ মে পুণাতে মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক যুব সম্মেলনের ভাষণে বললেন, “মালিকেরা ভারতীয় হইলে তাহাদের বুঝাইয়া তাহাদেরই দেশবাসী অপর এক শ্রেণীর প্রতি আপসসুলভ এবং সহানুভূতিসম্পন্ন মনোভাব গ্রহণ করাইবার জন্য আমাদের সর্বপ্রকারে সচেষ্ট হইতে হইবে।” ওই একই ভাষণে তিনি আরও বললেন — “এখন খোলাখুলিভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের কথা প্রচার করা এবং তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ করে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিবার চেষ্টাকে আমি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অপরাধ বলিয়া মনে করি। আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু লোক যাহাদের কমিউনিস্ট বলা যাইতে পারে, লক্ষ্য করিলে বোঝা যায় যে তাহাদের কার্ল মার্কস ও বাকুনিনের মতবাদ বদহজম হইয়াছে।” যেন অবিকল গান্ধীর কথারই পুনরাবৃত্তি!

    ওই বছরেই জামশেদপুরে টাটা স্টিলের কারখানায় প্রবল শ্রমিক আন্দোলন শুরু হল। স্ট্রাইক কমিটির অনুরোধে সেখানে উপস্থিত হলেন সুভাষ। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করার বিষয়ে বিশেষ সফল তো হলেনই না, উল্টে মানেক হোমির নেতৃত্বে রাতারাতি তৈরি হওয়া পাল্টা শ্রমিক সংগঠন ‘লেবার ফেডারেশন’ সুভাষের ‘লেবার অ্যাসোশিয়ন’-এর অফিসে হামলা চালাল। তবুও ১৯২৯ সালের ১৬ জুলাই বিড়লা পুরুষোত্তমদাস ঠাকুরদাসকে লিখিত এক চিঠিতে মন্তব্য করলেন — “Mr Bose could be relied upon to help the Tata Iron and Steel Works whenever necessary, provided properly handled. ... Mr Bose is a very sincere and scrupulous man and appreciates the necessity of co-operation with reasonable and advanced types of capitalists”। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি নেহরু ও সুভাষের প্রতি ভারতীয় পুঁজিপতিদের দৃষ্টিভঙ্গীর আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য। নেহরু সম্পর্কে ঠাকুরদাস বলছেন ‘a good deal of nursing will have to be done to keep J. on the right rails all through’, আর সুভাষ সম্পর্কে বিড়লা ‘তাঁর সঙ্গে ঠিকমতো ব্যবহার করা’-র কথা বলছেন। তবুও সুভাষ নাকি সমাজতান্ত্রিক, সুভাষ নাকি বামপন্থী!

    ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ অবধি সারা দেশে যখন গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অগণিত ভারতবাসী জেলে বন্দিজীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন সুভাষ বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস ও কলকাতা কর্পোরেশনের ক্ষমতা দখল করার দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং খেয়োখেয়িতে মত্ত! যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ওয়ার্কিং কমিটিতে স্থান পেয়েছেন অথচ তিনি বাদ পড়েছেন – এই বিষয়ে তাঁদের কোলাহল তখন তুঙ্গে। সুভাষ নিজে অবধি স্বীকার করে লিখছেন, “These dissensions lowered the prestige of the Congress”। নেহরু এই নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে ১৯৩০-এর ২৯ মার্চ লিখছেন — “It is exccedingly unfortunate that in spite of the fact that the whole country is on the verge of civil disobedience and we are faced with the biggest national struggle of our generation petty election squabbles should go on in Calcutta and should to some extent neutralize the effort of Bengal in the coming fight. … It has been an amazing sight - on the one side the country ringing with preparations for civil disobedience; on the other Congressmen spending their time and energy and money in attacking each other for the purpose of gaining admittance to the Calcutta Corporation”।

    ষষ্ঠ পর্বে আমরা দেখেছি যে, ইংল্যান্ডে গোলটেবিল বৈঠক থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে গান্ধী আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেও ১৯৩৩ সালের ৮ মে তা স্থগিত রাখেন এবং ওই দিন থেকে তিনি হরিজনদের প্রতি ন্যায় বিচারের স্বার্থে অনশন শুরু করেন। অনশনের সময় আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামালে অনশনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে, এই যুক্তিতে আন্দোলন স্থগিত রাখা হয়। ইউরোপে নির্বাসিত সুভাষ তখন ভিয়েনায়। বিঠলভাই প্যাটেলও তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ভিয়েনায়। সেখান থেকে তাঁরা দুজনে মিলে ‘বসু-প্যাটেল ইস্তেহার’ নামক এক ইস্তেহারে গান্ধীর নেতৃত্বের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন: “We are clearly of [the] opinion that as a political leader Mahatma Gandhi has failed. The time has therefore come for a radical reorganization of the Congress on a new principle and with a new method. For bringing about this reorganization a change of leadership is necessary…. If the Congress as a whole can undergo this transformation, it would be the best course. Failing that a new party will have to be formed within the Congress, composed of all elements. Non-cooperation cannot be given up but the form of non-cooperation will have to be changed into a more militant one and the fight for freedom to be waged on all fronts”।

    এর পরে ‘The Indian Struggle’-এও গান্ধীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তিনি লিখলেন, যে গান্ধী — “… has rendered and will continue to render phenomenal service to his country. But India’s salvation will not be achieved under his leadership”। সুভাষ যে গান্ধীর নেতৃত্ব মানছেন না, বরং নিজেকে ‘বিকল্প’ নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য করতে চাইছেন, সেটা আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাব। এ-ও দেখতে পাব, কীভাবে তাঁর বলশেভিক বিরোধিতা, নেহরু বিরোধিতা এবং গান্ধী বিরোধিতা – সবই স্রেফ হাওয়ায় উবে যাচ্ছে!

    আগেই আমরা আলোচনা করেছি যে, নবগঠিত সোশ্যালিস্ট দলের অন্তর্গত হয়ে কমিউনিস্টরা একই সঙ্গে কাজ করছিলেন, বিশেষত কৃষক ও শ্রমিক ফ্রন্টে তাঁরা যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় সুভাষ বুঝতে পারলেন, গান্ধীকে নেতৃত্ব থেকে হটাতে গেলে কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কাজ করা এই মানুষগুলোর সমর্থন তাঁর ইচ্ছাপূরণের কাজে সহায়তা করতে পারে। তিনি রাতারাতি ভোলবদল করলেন। ইতিমধ্যে নিজেকে ‘সোশ্যালিস্ট’ হিসেবে পরিচিত করা নেহরুর পালের হাওয়া কাড়তে ১৯৩৫ সালের ১৫ মার্চ ইউনাইটেড প্রেসের কাছে এক বিবৃতিতে সুভাষ ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির মধ্যে ‘একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি নিহিত’ আছে দেখতে পেলেন, ভারতীয় রাজনীতিতে তারা যে ‘একটি অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা গ্রহণ’ করবে তার কথাও বললেন। আর সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯৩৪ সালে সুভাষ ‘Fundamental Questions of Indian Revolution’-এ লিখলেন, “এটি হবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের সমন্বয়ে গঠিত। ... সমস্ত দিক বিচার করে এ কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে যে বিশ্ব-ইতিহাসের পরবর্তী পর্বে কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের একটি সমন্বয় ঘটার সম্ভাবনা আছে। আর ভারতবর্ষেই যদি সেই সমন্বয়ের সূচনা হয়, তাহলে সেটি কি খুব আশ্চর্যের বিষয় হবে?”

    ভিয়েনায় বসেই সুভাষ জানতে পারলেন, জওহরলালই পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতি হচ্ছেন। তখন তিনি নেহরুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই শুধু করলেন না, ১৯৩৬-এর ৪ মার্চ অস্ট্রিয়ার বাগস্টাইন থেকে লেখা চিঠিতে তিনি নেহরুকে জানালেন, “Among the front-rank leaders of today — you are the only one to whom we can look up to for leading the Congress in a progressive direction. Moreover, your position is unique and I think that even Mahatma Gandhi will be more accommodating towards you than towards anybody else. I earnestly hope that you will fully utilize the strength of your public position in making decision. Please do not consider your position to be weaker than it really is. Gandhiji will never take a stand which will alienate you”। অথচ এই সুভাষই মাত্র বছর দুয়েক আগে ১৯৩৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নেহরু সম্পর্কে লিখেছিলেন, “His head pulls one way and his heart in another direction. His heart is with Gandhi”!

    ১৯৩৬-এর ৮ এপ্রিল বোম্বে পৌঁছনো মাত্র সুভাষ গ্রেফতার হলেন। অসুস্থতার কারণে সরকার তাঁকে কার্শিয়াং-এ শরৎ বসুর বাড়িতে গৃহবন্দি করল। এর মধ্যে প্রত্যাশা মতোই ডিসেম্বরের ফৈজাবাদ কংগ্রেসে জওহরলাল সভাপতি হলেন। সুভাষ তখন বাংলা কংগ্রেসের হাল ছেড়ে ডালহৌসিতে। এই সময়ে সুভাষের মতিগতির খবর নিতে ডালহৌসিতে গান্ধী দূত হিসাবে পাঠালেন মিস শ্লেডকে। সুভাষ শ্লেডের কাছে ঝেড়ে কাশলেন না। বরং তাঁকে অনুরোধ করলেন গান্ধী যেন পরবর্তী এআইসিসি-র সভা কলকাতাতে করেন – সেই খবরটা তাঁকে পৌঁছে দিতে। নেহরুকে ‘বগলদাবা পর্ব’ সমাপ্ত করার পরে সমাজবাদী-কমিউনিস্টদের ঠেকাতে গান্ধীর তখন সুভাষকে বাগে আনা প্রয়োজন। গান্ধী তাই রাজি হলেন। ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতাতেই ঠিক হল বৈঠক এবং গান্ধী-সুভাষ একান্তে কথা বললেন শরৎ বসুর বাড়িতে। সেখানে গান্ধী-সুভাষ ‘রফা’-র কাজ সম্পূর্ণ হল। রফা শেষে তৃপ্ত সুভাষ নভেম্বর মাসে যাত্রা করলেন ইউরোপে, ২৬ ডিসেম্বর এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে গোপনে বিবাহপর্ব সারলেন তিনি। এই খবর শরৎ বসু প্রথম শুনবেন ১৯৪৩-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, যখন শরৎকে সুভাষ তাঁর স্ত্রী-কন্যার খবর দিয়ে চিঠিতে জানাবেন, “I have married here and I have a daughter”।

    ওই ১৯৩৭ সালেরই অক্টোবরের শেষ দিকে এআইসিসি-র কলকাতা অধিবেশনে মহীশূরে দমন-পীড়নের নিন্দা করে বামপন্থীদের আনা একটি প্রস্তাব গৃহীত হল এবং সমস্ত রাজবন্দিকে মুক্তি না দেওয়ায় কয়েকজন বামপন্থী সদস্য মাদ্রাজের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজাগোপালাচারির কঠোর সমালোচনা করলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ১ নভেম্বর প্যাটেলকে গান্ধী লিখলেন — “I have come to the conclusion that it would be best if all [of you] resigned. Even if the others don’t resign, you should. Jamnalal is sure to resign. Who will be left then? Rajendra Babu? And won’t [it] be bankruptcy? Bhulabhai also will leave. But it will not matter even if he does not. I don’t think that Maulana’s support is necessary. If he does not resign, a time will come when he will be forced to resign. I have observed that Subhas is not at all dependable. Howevere, there is nobody but he who can be the President. I thought hard last night and again now. Let others do what they like, I am convinced that you should resign. If each does not take care of his own interest nothing will be done and the whole game will be lost” (CWMG, ৭২/৩৮০)।

    এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সুভাষকে আদৌ ‘নির্ভরযোগ্য’ মনে না করলেও গান্ধী তাঁকে সভাপতি পদে বেছে নিয়েছিলেন কেন? ওপরের চিঠি থেকে এটা অন্তত পরিষ্কার যে, সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে সুভাষ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। তাছাড়া পূর্ববর্তী সভাপতি জওহরলালকে নাম-কা-ওয়াস্তে সভাপতি রেখে গান্ধী তাঁর নিজস্ব কর্মসূচী পূর্ণমাত্রায় বহাল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, ‘বামপন্থী’ জওহরলালের সভাপতিত্বকালে ভারত শাসন আইনের প্রাদেশিক অংশটি কার্যকর করে কংগ্রেস ছ’টি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। কাজেই এ কথা মনে করা অসঙ্গত নয়, এইবারে একই কায়দায় আর এক ‘বামপন্থী’ সুভাষকে সভাপতি রেখে এই আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটি সুবিধাজনক শর্তে কার্যকর করা এবং বামপন্থী শিবিরকে বিভক্ত করার কারণেই সম্ভবত গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে সুভাষকে বেছে নিয়েছিলেন।

    একদিকে কমিউনিস্ট-সহ সোশ্যালিস্ট পার্টির পূর্ণ সমর্থন এবং অন্যদিকে রক্ষণশীল নেতাদের সমর্থন-সহ গান্ধীর ইচ্ছায় ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি হলেন সুভাষ। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে কংগ্রেসে সদস্যও বাড়ল প্রচুর। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসে ছিল ৫ লাখ সদস্য, পরের বছরে সেটা লাফিয়ে বাড়ল ৩১ লাখে আর ১৯৩৮-এ তা পৌঁছল ৪৫ লাখে। এতদিন পরে সুভাষের কাছে দেশকে বিকল্প নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ আসল। হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণে সুভাষ প্রত্যাশামতোই সমাজতন্ত্র, জমিদারিপ্রথা বিলোপ, ভূমিসংস্কার, শ্রমিক কল্যাণ ইত্যাদির কথা বললেন। সঙ্গে ভারতীয় শিল্পপতিদের আশ্বস্ত করে বললেন, “এই দেশের নাগরিকদের সঙ্গে সমান শর্তে বিদেশিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দান রীতিমতো অনৈতিক।”

    শুধু তাই নয়, ওই একই ভাষণে তিনি বললেন — “আমি আগের চাইতে এখন অধিক বিশ্বাস করি যে কংগ্রেসের সংগ্রাম পদ্ধতি হইবে সত্যাগ্রহ। কিংবা ইহাকে ব্যাপক অর্থে আইন অমান্য-সহ অহিংস অসহযোগ বলা যাইতে পারে। আমার মতে সত্যাগ্রহ কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয় – ইহা এক সক্রিয় প্রতিরোধও বটে, যদিও এই প্রতিরোধকে অবশ্যই অহিংস হইতে হইবে।” ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে সভাপতির ভাষণে খোদ সুভাষ বললেন: “... ইহাদের [বিরোধী চিন্তাধারার সংগঠন] উচিত কংগ্রেসী আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া এবং কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করা। ইহা সুনিশ্চিত করার জন্যে বহুসংখ্যক কংগ্রেস কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠনগুলিতে অংশগ্রহণ করা উচিত।” কোথায় তাঁর বহুপ্রচলিত গান্ধী বিরোধিতা? বরং অবিকল গান্ধীর বুলি, গান্ধীর কর্মসূচী!

    অনেকে সুভাষের হরিপুরা ভাষণটি নেহরুর লখনউ ভাষণের চেয়েও বেশি তুবড়ি ছোটানোর মতো মনে করলেও, তা যে প্রকৃতপক্ষে শূন্যগর্ভ আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেটা হরিপুরা কংগ্রেসে পাশ হওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের দিকে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এই কংগ্রেসে যেসব প্রস্তাব পাশ হয় তার অন্যতম হল — ১) কংগ্রেস ‘হিংসায় বিশ্বাসী’ রাজবন্দিদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার বিরোধী; ২) কিষান সভার আন্দোলনকে খর্ব করতে সিদ্ধান্ত হল কংগ্রেসই হচ্ছে কৃষকদের প্রধান সংগঠন। তাই সমস্ত কৃষক সংগঠনের কাজ হবে স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসকে সাহায্য করা; ৩) দেশীয় রাজ্যগুলোতে কংগ্রেস কমিটিগুলো কংগ্রেসের নামে কোনও আন্দোলন চালাতে পারবে না। অর্থাৎ, কৃষক-শ্রমিক-দেশীয় রাজ্যে সীমাহীন শোষণ-রাজবন্দিদের মুক্তি সব এক ঝটকায় শেষ! বাকি রইল দেশি শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা। যিনি গদিতে বসেছেন গান্ধীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তিনি তাঁদের স্বার্থরক্ষা করবেন না তা হয় নাকি? সুতরাং ১৯৩৭-এ বেঙ্গল মিলে ধর্মঘট, পরের বছর মার্টিন বার্ন-এর কুলটি এবং হিরাপুরে ধর্মঘট, তার পরের বছর ডিগবয়ে ধর্মঘট নিয়ে সুভাষ নীরবতা বজায় রাখলেন। আর তাঁর নাকের ডগা দিয়ে দিব্যি পাশ হয়ে গেল বোম্বে ট্রেড ডিসপিউটস অ্যাক্ট। ষোলো কলা পূর্ণ হল!

    পূর্ব প্রত্যাশা মতোই নেহরুর মতো সুভাষকেও প্রথম থেকেই অকেজো করে রেখেছিলেন গান্ধী। তিনি যাতে কোনও ভাবেই গান্ধীর পরিকল্পনার বিরোধিতা না করতে পারেন, সে কথা চিন্তা করেই সুভাষের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নির্বাচন করেছিলেন গান্ধী-প্যাটেল জুটি এবং সেই কমিটিতে একজন সোশ্যালিস্টেরও স্থান হয়নি। ঘটনার প্রায় এক বছর পরে ১৯৩৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নেহরু এই কারণে সুভাষকে অভিযুক্ত করে লিখবেন, “You have adopted an entirely passive attitude in the Working Committee. … In effect, you have functioned more as a Speaker than as a directing President”। আর মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী বি এন খারে সুভাষকে চিহ্নিত করবেন ‘a puppet in the hands of Mahatma Gandhi’ বলে।

    এই ফাঁকে আমরা দেখি, আর এক আগুনখেকো ‘বামপন্থী’ নেহরুর সরকারের কী অবস্থা। আমরা জানি যে, গ্রামীণ ভারতে ব্রিটিশ শাসক বেশি পরিচিত হয়েছিল জমিদারদের মাধ্যমেই। অথচ ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে প্রচুর নথিপ্রমাণ থেকে দেখা যায়, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যাঁরা ওই বোঝাপড়া চালিয়েছিলেন তাঁরা কোনও পর্যায়েই জমিদারদের জাতীয় আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে বা সমর্থন করতে বলেননি। কপিল কুমার ‘তিরিশের দশকে কংগ্রেস কৃষক ও মতাদর্শ : শ্রেণি সমঝোতা না আত্মসমর্পণ?’ প্রবন্ধে এই ঘটনার চমৎকার বাস্তবোচিত চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই প্রবন্ধটিতে আমরা দেখতে পাই রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ প্রমুখ কংগ্রেস নেতা সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন যে, তাঁরা কংগ্রেসের লখনউ ও ফৈজপুর অধিবেশনের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে কাজ করছেন। বিষয়টি স্পষ্ট হয় ১৯৩৭ সালের ৭ ডিসেম্বর রামদয়ালু সিংহকে লেখা রাজেন্দ্রপ্রসাদের চিঠি থেকে, “... যতদূর সম্ভব আমরা গিয়েছি এবং এমনকি কংগ্রেসের নীতির বিরুদ্ধাচরণ করায় অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে খোলাখুলি সমালোচিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও তা করেছি। এটা আন্দাজ করেই আমি মৌলানাকে সঙ্গে নিয়েছি, ওয়ার্কিং কমিটি কিংবা এআইসিসি-তে যদি কোনও প্রশ্ন ওঠে তাহলে আমি একজন শক্তিশালী সমর্থককে পাশে পাব।”

    কংগ্রসের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে সবুজ সংকেত আসা মাত্রই কৃপালনি লেখেন, “যদি আপনি [রাজেন্দ্রপ্রসাদ] এবং মৌলানা সাহেব নিশ্চিত থাকেন তবে সব ঠিক আছে।” আর প্যাটেল ৪ ডিসেম্বর রাজেন্দ্রপ্রসাদকে বলেন — “রায়তদের অত্যধিক দাবিদাওয়াও আমাদের প্রতিহত করতে হবে যারা [কিষান সভা] মেতে উঠেছে এবং কংগ্রেস মন্ত্রিসভার কাছে বড্ড বেশি প্রত্যাশা করছে।” দ্বারভাঙার মহারাজা সারা ভারত জমিদার সমিতি সম্মেলনের (যা গঠিত হয়েছিল ১৯৩৯-এর এপ্রিলে) সভাপতির ভাষণে বলেন, “যতদিন মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশ অনুসরণকারী গোষ্ঠী কংগ্রেসকে পরিচালিত করছে এবং সমাজবাদী ও কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে রাখা আছে ততদিন আমাদের চরম পদক্ষেপ নিতে হবে না।”

    এই নেহরুকেই ভবিষ্যৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে রেখেছিলেন গান্ধী। ১৯৩৮ সালেই তিনি বলেছিলেন, “He says what is uppermost in his mind but he always does what I want. When I am gone he will do what I am doing now. Then he will speak my language” (এর পরে ১৯৪২ সালের ১৫ জানুয়ারি ওয়ার্ধা অধিবেশনে জওহরলালকে তাঁর উত্তরসূরী ঘোষণা করে তিনি আবারও বলবেন ‘When I am gone, he will speak my language’)। সামগ্রিকভাবে এই যখন গোটা কংগ্রেসেরই পরিস্থিতি, সেখানে কংগ্রেস সভাপতি হয়েও সুভাষ যে নিছকই ঠুঁটো জগন্নাথ হিসাবে বিচরণ করবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরে মিউনিখ চুক্তির পরে ইউরোপে যুদ্ধ আসন্ন বলে সুভাষের ধারণা দৃঢ় হল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংগ্রাম যাতে শুরু করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে চরমপত্রের আকারে ভারতের দাবি পেশ করার কথা বললেন এবং সারা দেশে এ নিয়ে প্রচারও শুরু করলেন। এই ঘটনায় অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলেন গান্ধী।

    এর পরে শরৎ-সুভাষ যখন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গড়তে উদ্যোগী হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন, তখন গান্ধী সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে ১৯৩৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সেবাগ্রাম থেকে সুভাষকে লিখলেন — “I must dictate this as I am willfully blind. Whilst I am dictating this Maulana Saheb, Nalini Babu [Nalini Ranjan Sarkar, then Finance Minister of Bengal], and Ghanashyamdasji are listening. We had an exhaustive discussion over the Bengal Ministry. I am more than ever convinced that we should not aim at ousting the Ministry. We shall gain nothing by a reshuffle. And probably we shall lose much by including Congressmen in the Ministry. I feel, therefore, that the best way of securing comparative purity of administration and a continuity of a settled programme and policy would be to aim at having all the reforms that we desire carried out by the present Ministry” (CWMG, ৭৪/৩২৫)। তখন থেকেই বাংলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন বিড়লা এবং তাঁর স্বার্থের পরিপন্থী কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে গান্ধীর তীব্র আপত্তি! প্রয়োজনে কংগ্রেস সভাপতিকেও ‘dictate’ করতে তিনি পিছপা নন!!

    অবশ্য এর আগেই শুরু হয়েছে গান্ধী-সুভাষ দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট। জওহরলাল পরপর দু’বছরের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হলেও সুভাষ যে পরের বছরে কোনও ভাবেই সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হবেন না, তা স্পষ্ট হয় এ বিষয়ে গান্ধী ও তাঁর অনুগামীদের লেখা একাধিক চিঠিপত্রে। ১৯৩৮-এর জুলাই মাসে প্যাটেল রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লেখেন, “Jawahar has gone abroad for at least four months. You go out for six months and we have to deal with a President who does not know his own job”। আর এই বিষয়ে গান্ধীর মনোভাব প্রথম পরিস্ফূট হয় ওই বছরের ২৮ অক্টোবর প্যাটেল-কন্যা মণিবেনকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে। তিনি লেখেন: “সুভাষবাবুকে নিয়ে যা ঘটছে তা আমার চিন্তার বাইরে নেই। ... কিন্তু বাবার [বল্লভভাই] মত জওহরলালের ফিরে আসা [ইউরোপ থেকে] পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত, সুতরাং আমি নীরব আছি। সভাপতি নির্বাচনে এবার কিছু সমস্যা আসতে বাধ্য” (CWMG, ৭৪/১৭১)। সুভাষের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেছে নিয়ে ২১ ডিসেম্বর জওহরলালকে গান্ধী জানান — “Maulana Saheb does not want the crown of thorns. If you want to try again please do. If you won’t or he [Subhas] won’t listen, Pattabhi seems to be the only choice” (CWMG, ৭৪/৩৩৫)।

    এই প্রেক্ষাপটে পরের বছরে সুভাষ পুনরায় সভাপতির পদে দাঁড়ালেন বটে, কিন্তু এবার তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হল। এই সময়ে সুভাষ এক মারাত্মক ভুল রাজনৈতিক চাল চাললেন। নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন তিনি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও অনাবশ্যকভাবে ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন যে, কংগ্রেসের ‘দক্ষিণপন্থী’ নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশের সঙ্গে ফেডারেশনের ব্যাপারে আপস করতে ইচ্ছুক বলে তিনি সন্দেহ করছেন। এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। যদিও তিনি ১৫৮০-১৩৭৭ ভোটে জিতলেন, তবুও তাঁর নির্বাচনে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সংকট চরমে উঠল। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরের দিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি, গান্ধী সীতারামাইয়ার পরাজয়কে ‘the defeat is more mine than his’ হিসেবে চিহ্নিত করে বারদোলি থেকে বিবৃতি দিলেন — “I am nothing if I do not represent definite principles and policy. Therefore, it is plain to me that the delegates do not approve of the principles and policy for which I stand. … Subhas Babu, instead of being President on the sufferance of those whom he calls rightists, is now President elected in a contested election. This enables him to choose a homogeneous cabinet and enforce his programme without let or hindrance. … In his opinion his is the most forward and boldest policy and programme. The minority can only wish it all success. If they cannot keep pace with it, they must come out of the Congress. If they can, they will add strength to the majority” (CWMG, ৭৫/১৪-১৫)।

    নেহরুও সুভাষের সঙ্গে একমত না হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে লিখলেন, “আমি জানি না, আপনি কাদের বামপন্থী এবং কাদেরকেই বা দক্ষিণপন্থী বলে মনে করছেন। সভাপতি পদে নির্বাচনের সময় আপনি যেভাবে এই কথাগুলো ব্যবহার করেছেন তা থেকে মনে হয় গান্ধীজি এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে তাঁর অনুগামীরা হলেন দক্ষিণপন্থী। যাঁরাই তাঁদের বিরোধী তাঁরাই বামপন্থী। আমার মনে হয় এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। আমার ধারণা, তথাকথিত বামপন্থীদের অনেকেই তথাকথিত দক্ষিণপন্থীদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষিণপন্থী। ... আমি মনে করি ‘বামপন্থী’ ও ‘দক্ষিণপন্থী’ এই দুটি শব্দের ব্যবহার পুরোপুরি ভুল ও বিভ্রান্তিকর।” নেহরুর চিঠির ঠিক পরের দিন সেবাগ্রাম থেকে গান্ধী সুভাষকে বললেন: “So far as I can judge the old colleagues whom you consider as rightists will not serve on your cabinet. You can have their resignations now, if that would be more convenient for you. Their presence would be unfair to you and to them. You should be left free to frame your own programme and expect the rightists (I wish you would choose better and indigenous terms to designate the parties of your imagination) to support where they can and abstain without obstructing where they cannot see eye to eye with you” (CWMG, ৭৫/৪০-৪১)।

    সুভাষের সঙ্গে বিরোধিতার রাস্তা নিজে হাতে তৈরি করে দিলেন স্বয়ং গান্ধী। মনে রাখতে হবে, গান্ধী নিজে কংগ্রেসের সঙ্গে ১৯৩৪ সালে সম্পর্ক ছেদ করেছেন এবং এই সময়ে তিনি কংগ্রেসের চার আনার সদস্যও নন! সুভাষ প্রকাশ্যে তাঁদের সমালোচনা করেছেন – এই কারণ দেখিয়ে পুরনো কার্যনির্বাহী কমিটির ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জনই ২২ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করলেন। নেহরুও আলাদাভাবে পদত্যাগ করার কারণে তখন ক্যাবিনেটে রইলেন কেবল সুভাষ ও শরৎ। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে ত্রিপুরি কংগ্রেস শুরুর আগের দিন ৬ মার্চ ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সুভাষ সেখানে পৌঁছলে ৮ মার্চ গোবিন্দবল্লভ পন্থ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন।

    প্রস্তাবে গান্ধীর নেতৃত্ব ও কর্মসূচীর ওপরে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে ওয়ার্কিং কমিটির গঠন সম্পর্কে বলা হল — “The Committee declares its firm adherence to the fundamental policies of the Congress which have governed its programme in the past years under the guidance of Mahatma Gandhi and is definitely of opinion that there should be no break in these policies and that they should continue to govern the Congress programme in future. … In view of the critical situation that may develop during the coming year and in view of the fact that Mahatma Gandhi alone can lead the Congress and the country to victory during such crisis, the Committee regards it as imperative that the congress executive should command his implicit confidence and requests the President to nominate the Working Committee in accordance with the wishes of Gandhiji” (CWMG, ৭৫/২০৮)। পন্থ-প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে গৃহীত হল। আর সমস্ত কাজ নীরবে সম্পন্ন করে হাত ধুয়ে গান্ধী তখন বহু দূরে রাজকোটে অনশনে ব্যস্ত!

    এই পরিস্থিতিতে সুভাষ চাইলেন, তাঁর ও অন্যান্য বামপন্থীদের নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে গান্ধী আসন্ন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিন। গান্ধী সেই প্রস্তাব মানবেন কেন? তিনি তো কংগ্রেসে কমিউনিস্ট-সোশ্যালিস্টদের কোণঠাসা করতে বদ্ধপরিকর। তিনি এটাও সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন যে, সুভাষের এই প্রস্তাবে রাজি হলে কংগ্রেসের রাশ তাঁর হাত থেকে সুভাষের হাতে চলে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। যিনি অনেক আগেই নেহরুকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করে রেখেছেন, সেখানে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সুভাষকে তিনি সুযোগ দেবেন কেন? তাই স্বাভাবিকভাবেই সুভাষের প্রস্তাব পত্রপাঠ বিদায় করে গান্ধী তাঁকে ৩০ মার্চ আবারও বললেন, “Assuming, therefore, that your policy had the backing of the majority of the A. I. C. C., you should have a Working Committee composed purely of those who believe in your policy. … So far as the Gandhi-ites (to use that wrong expression) are concerned, they will not obstruct you” (CWMG, ৭৫/২১৭-১৮)।

    ২ এপ্রিল আরও চাঁছাছোলা ভাষায় গান্ধী সুভাষকে তাঁর মতাবলম্বী লোকদের নিয়ে ক্যাবিনেট গঠন করতে বললেন এবং সেই ক্যাবিনেট এআইসিসি-র অনুমোদন না পেলে সুভাষকে কংগ্রেস সভাপতির পদ ছাড়তে বললেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন — “Taking all things into consideration, I am of opinion that you should at once form your own Cabinet fully representing your views, formulate your programme definitely and put it before the forthcoming A. I. C. C. If the Committee accepts the programme, all will be plain-sailing and you should be enabled to prosecute it unhampered by the minority. If, on the other hand, your progamme is not accepted you should resign and let the Committee choose its President. And you will be free to educate the country along your own lines” (CWMG, ৭৫/২২৪)।

    সুভাষ খুব ভালোভাবেই জানতেন যে, গান্ধীপন্থী নেতাদের পদে পদে অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়ে তাঁর পক্ষে কংগ্রেস চালানো সম্ভবপর নয়। গান্ধীর ধূর্ত রাজনৈতিক চালের কাছে নতি স্বীকার করে অবশেষে সুভাষ ২৯ এপ্রিল কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পদত্যাগের পরে অস্তিত্ব রক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টায় সুভাষ যখন কংগ্রেসের মধ্যেই ৩ মে নতুন দল ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করলেন, তখনও সোশ্যালিস্ট কিংবা কমিউনিস্টদের সমর্থন পেলেন না তিনি। সোশ্যালিস্টরা তো আগেই জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে পন্থ-প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। সিপিআই-ও ত্রিপুরি অধিবেশনের পরে ঘোষণা করল, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের স্বার্থে ‘কোনও একটি গোষ্ঠীর একচেটিয়া নেতৃত্ব নয়, গান্ধীজির পরিচালনায় ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব প্রয়োজন’। তাঁকে সমর্থন করলেন না রায়পন্থী র‍্যাডিক্যাল লিগও, এমনকি তাঁর দাদা শরৎ বসুও কংগ্রেসের সঙ্গেই রইলেন।

    সুভাষের ডানা পুরোদস্তুর ছেঁটে ফেলতে চেয়ে এআইসিসি জুন মাসে দু’টি প্রস্তাব গ্রহণ করল – ক) প্রদেশ কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া কোনও কংগ্রেস কর্মী সত্যাগ্রহে অংশ নিতে পারবেন না এবং খ) প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার কাজে কোনও প্রদেশ কমিটি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। প্রস্তাব দু’টির বিরুদ্ধে সুভাষের নেতৃত্বে বাম সংহতি কমিটি ৯ জুলাই দেশ জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করলে ১১ অগস্ট শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে তাঁকে কংগ্রেসের সমস্ত পদ থেকে তিন বছরের জন্য বঞ্চিত করা হল। কংগ্রেস-বহিষ্কৃত সুভাষ গান্ধীর সঙ্গে শেষবারের মতো আপস-রফার চেষ্টা করলেন পরের বছর ডিসেম্বর মাসে।

    ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে গান্ধী যখন ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করছেন, তার কিছু দিন পরে ২৩ ডিসেম্বর এক চিঠিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যতটা সম্ভব এই আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত – এ কথা জানিয়ে গান্ধীর কাছে প্রস্তাব রাখলেন সুভাষ। ২৯ ডিসেম্বর জবাবি চিঠিতে এই প্রস্তাব সম্পর্কে গান্ধী সুভাষের মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জানালেন, “তোমার ব্লকের [ফরওয়ার্ড ব্লক] আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করার বিষয়ে আমি মনে করি, তোমার আমার মধ্যে যখন মৌলিক মতভেদ রয়েছে তখন তা সম্ভব নয়। যতদিন আমাদের মধ্যে একজন অপরের মতাবলম্বী না হয়, ততদিন আমাদের ভিন্ন নৌকায় পাড়ি দিতেই হবে, যদিও তাদের লক্ষ্যস্থল আপাতদৃষ্টিতে, কেবলমাত্র আপাতদৃষ্টিতেই, এক মনে হতে পারে” (CWMG, ৮০/৪)। নীরদ সি চৌধুরীর ভাষা ধার নিয়ে বলা যায়, ‘অহিংস’ গান্ধী সুভাষকে প্রাণে মারলেন না বরং বস্তাবন্দী করে তাঁকে সোজা মাঝদরিয়ায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে সলিল সমাধি ঘটল সুভাষচন্দ্রের।

    পাশাপাশি, শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে ক্রমশ পার্শ্বচরিত্রে পরিণত হচ্ছেন গান্ধী। তাঁকে হটিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় দ্রুত উঠে আসছেন তাঁরই একান্ত বশংবদ নেহরু-প্যাটেল জুটি। একই সময়ে ভস্মস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আসছেন জিন্না এবং ভারতীয় রাজনীতিতে তিনিই হয়ে উঠছেন প্রধানতম চরিত্র।

    [উৎসাহী পাঠক কংগ্রেস নেতাদের ত্রিপুরি কংগ্রেস-জাত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির বিস্তারিত বিবরণ পেতে Nirad C. Chaudhuri – Thy Hand, Great Anarch! India: 1921-1952, London, Chatto & Windus, July 1989, pp. 500-529 দেখতে পারেন]

    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. গিরিশচন্দ্র মাইতি – স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র
    ২. বিপান চন্দ্র – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৮৫৭-১৯৪৭
    ৩. বিপান চন্দ্র, কপিল কুমার, মুশিরুল হাসান – কংগ্রেস নেহরু ও ভারতীয় মুসলমান
    ৪. সুভাষচন্দ্র বসু – সমগ্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড
    ৫. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৬. G. D. Birla – In the Shadow of the Mahatma: A Personal Memoir
    ৭. Jawaharlal Nehru – A Bunch of Old Letters
    ৮. Rudrangshu Mukherjee – Nehru & Bose: Parallel Lives
    ৯. Sumit Sarkar – Modern India: 1885-1947


    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    নবম পর্ব : গান্ধী ও জিন্না — দুই সমান্তরাল সরলরেখা


    দু’জনের মধ্যে যত না মিল, অমিল তার চাইতে ঢের বেশি। গান্ধী হেঁটোধুতি, রামধুন, নিরামিষ ভক্ষণ, মাদক বর্জন নিয়ে নিজের মতো; অন্যদিকে জিন্না ব্রেকফাস্ট সারেন বেকন ও হ্যাম সহযোগে, সন্ধেবেলা সুরাপানের অভ্যেসেও ছেদ পড়ে না, পোশাক আর চলন-বলনে পাক্কা সাহেব, নামাজ পড়া কিংবা রোজা রাখার ধার ধারেন না। মিল বলতে দু’জনেই গুজরাটি ও ব্যারিস্টার; দু’জনেই কালের করালচক্রে জড়িয়ে থাকেন দেশভাগের সঙ্গে; দু’জনের মৃত্যুই একই বছরে এবং মৃত্যুর পরে দু’জনেই নিজ নিজ দেশে ব্রাত্য, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান।

    ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে জিন্নার প্রবেশ গান্ধীর অনেক আগে, ১৯০৬ সালে। তখন সদ্য স্থাপিত হয়েছে মুসলিম লিগ, অথচ জিন্না তাঁদের সঙ্গে না জুটে গিয়ে জাতীয়তাবাদী দাদাভাই নওরোজির একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন ওই বছরে। পরে যুগপৎ তিলক ও গোখলে, দুই পরস্পরবিরোধী মতাবলম্বী নেতার সঙ্গেও তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯১২ সালে বাঁকিপুরে কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালীন জিন্না প্রথম মুসলিম লিগের সম্মেলনে উপস্থিত হন, যদিও তখনও অবধি লিগের সদস্যপদ গ্রহণ করেননি তিনি। পরের বছরে কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লিগেও যোগ দেন জিন্না; একই বছরে গোখলে জিন্নাকে ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজদূত’ হিসেবে অভিহিত করেন। পরে ১৯১৬ সালে জিন্না সম্পর্কে একই কথা বলবেন সরোজিনী নাইডুও। ওই ১৯১৬ সালেই মুসলিম লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলবেন, “হিন্দুদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী হবে শুভেচ্ছা ও ভ্রাতৃভাবাপন্ন। আমাদের চালক নীতি হবে দেশের স্বার্থে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম মহৎ সম্প্রদায়ের ভিতর যথার্থ বোঝাপড়া এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল ভারতবর্ষের যথার্থ প্রগতি সম্ভবপর হবে।”

    এই বছরেই তিলকের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে ‘লখনউ চুক্তি’ সম্পাদিত করবেন জিন্না, যেখানে হিন্দু প্রাধান্যযুক্ত কংগ্রেস মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর ক্ষেত্রে সহমত প্রকাশ করবে। এই জিন্নাই অ্যানি বেসান্ত, তিলক, মদনমোহন মালব্যের সঙ্গে গড়ে তুলবেন ‘হোমরুল লিগ’; যেখানে গান্ধীকে সাদরে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে গান্ধী জানাবেন, ‘I could only join an organization to affect its policy and not be affected by it’ এবং বেসান্তকে বলবেন, ‘One scabbard cannot hold two swords’। এবং, ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে অনেক পরে যোগদান করেও বিপিনচন্দ্র, তিলক, চিত্তরঞ্জন, মতিলাল, জিন্না কিংবা মালব্যর মতো অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান নেতাদের অকেজো বা একপেশে করে দিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্যাটেল, নেহরুদের মতো তরুণ, তল্পিবাহক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী প্রায় একনায়কের ঢঙে কংগ্রেসকে চালনা করবেন তিনি।

    ১৯২০ সালের এপ্রিলে হোমরুল লিগের সভাপতি নির্বাচিত হন গান্ধী। অক্টোবর মাসে তিনি ৪২-১৯ ভোটে জয়ী হয়ে দলের নাম পাল্টে রাখেন ‘স্বরাজ্য সভা’ এবং দলের সংবিধান পাল্টিয়ে কেবলমাত্র ‘স্বরাজ’ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাকে নির্দিষ্ট করে দেন। গান্ধীর এ হেন অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তকে ‘illegal and arbitrary’ অভিহিত করে, গভীর মনোবেদনা নিয়ে জিন্না যখন অক্টোবরে হোমরুল লিগ থেকে পদত্যাগ করছেন, তখন গান্ধী তাঁকে নতুন জীবনে অংশগ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে ২৫ অক্টোবর বলেন: “If you wish to take your share in the new life that has opened up before the country, and benefit the country by your experience and guidance, and if you do not consider that there is anything fundamentally opposed to your conscience, I invite you and your co-signatories to reconsider your resignations” (CWMG, ২১/৩৮৪)। আহত, ব্যথিত জিন্না তাঁকে প্রত্যুত্তরে জানান — “I thank you for your kind suggestion offering me ‘to take my share in the new life that has opened up before the country’. If by ‘new life’ you mean your methods and your programme, I am afraid I cannot accept them, for I am fully convinced that it must be lead to disaster”। গান্ধীর একনায়কতন্ত্রকে তীব্র আক্রমণ করে জিন্না আরও বলেন, “The only way for the Nationalists is to unite and work for a programme which is universally accepted for the early attainment of complete responsible government. Such a programme cannot be dictated by any single individual, but must have the approval and support of all the prominent leaders in the country, and to achieve this end I am sure my colleagues and myself shall continue to work”।

    এর পরে, অনেক পরে ১৯৪২ সালে লুই ফিশারকে এক সাক্ষাৎকারে বলবেন জিন্না: “I have been in this movement for thirty-five years. Nehru worked under me in the Home-Rule Society. Gandhi worked under me. I was active in the Congress party. … My goal was Hindu-Moslem unity. … In 1916, I again persuaded the two organizations to meet simultaneously in Lucknow and was instrumental in bringing about the Lucknow Pact in which both agreed on elections and weightage. So it was until 1920 when Gandhi came into the limelight. A deterioration of Hindu-Moslem relations set in”। আমরা ক্রমেই দেখব, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনে অপমানিত জিন্না পাকাপাকিভাবে কংগ্রেস ছাড়ার পর থেকেই গান্ধী ও তাঁর জীবনের দু’টি পথ সারা জীবনের মতো দু’টি ভিন্ন দিকে ধাবিত হবে।

    যাই হোক, আমরা ফিরে আসি অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তী জিন্না প্রসঙ্গে। খিলাফতের ব্যর্থতার পর মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য ১৯২৪ সালের ৪ মে লাহোরে অনুষ্ঠিত লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন, “স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ... আমি এই ক্থা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমান মিলিত হবে সেইদিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।” এর কয়েক বছর পরে ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলনে জিন্না আবারও ঘোষণা করেন: “Believe me there is no progress for India until the Mussalmans and the Hindus are united, and let not logic, philosophy or squabble stand in the way of coming to a compromise and nothing will make me more happy than to see a Hindu-Muslim union”।

    কিন্তু ওই বছরে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে মুসলমান নেতৃবৃন্দের সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ না মেনে নিয়ে, তাঁদের বাদ দিয়েই ‘নেহরু প্রস্তাব’ পাশ হয়। নেহরু কমিটির সুপারিশ এবং তাকে ঘিরে বিতর্ক সম্পর্কে মন্তব্য করে মৌলানা মহম্মদ আলি হিন্দুদের উদ্দেশে বলেন — “মিথ্যা তত্ত্ব, অনৈতিক বিশ্বাস এবং ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে আপনারা প্রতিদিন আপনাদের সংবিধানের সঙ্গে আপস করছেন। কিন্তু আপনারা আমাদের মতো অসাম্প্রদায়িকদের সঙ্গে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী ও সংরক্ষিত আসন নিয়ে কোনও আপস করছেন না। জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগ হল আমাদের অনুপাত, তবু [কেন্দ্রীয়] আইনসভায় আপনারা আমাদের শতকরা ৩৩ ভাগ আসন দেবেন না। আপনারা সব ইহুদি, আপনারা বেনিয়া।” নেহরু প্রস্তাবের পাল্টা হিসেবে ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে জিন্না হাজির করেন তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দ দফা’ দাবি। এই চোদ্দ দফা দাবি সম্পর্কে ১৯৩১-এর ২৭ সেপ্টেম্বর গান্ধীকে লিখিত এক পত্রে ব্যঙ্গভরে নেহরু মন্তব্য করেন: “আমার প্রিয় বন্ধু জিন্নার চোদ্দ দফারূপী বিশুদ্ধ আবোলতাবোল যদি কিছুক্ষণের জন্য আমাকে শুনতে হত, তাহলে আমাকে দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপে পালিয়ে বাঁচার চিন্তা করতে হত – যেখানে হয়তো এমন কিছু মানুষের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা যাঁদের এতটুকু বুদ্ধি বা অজ্ঞতা আছে যে তাঁরা চোদ্দ দফার আলোচনা করেন না।”

    ইংল্যান্ডে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করার পরে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ জিন্না আর ভারতে ফিরে আসেননি। ১৯৩১ থেকে তিনি ইংল্যান্ডে আইন ব্যবসায় মনোযোগী হলে লিগ সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে জিন্না প্রধানত লিয়াকত আলির উদ্যোগে ও তাঁর সমর্থকদের অনুরোধে ভারতে ফিরে এসে লিগকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেন এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ওপরে জোর দেন। ১৯৩৫-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবারও বলেন, “… so long as Hindus and Muslims are nor united, let me tell you, there is no hope for India and we shall both remain slaves of foreign domination”। ১৯৩৬ সালের মার্চে তিনি লাহোরে বলেন — “আমি যা-ই করি না কেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যেদিন আমি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলাম সেদিন থেকে আমার কোনও পরিবর্তন হয়নি, এতটুকুও না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমি হয়তো ভুল করেছি। কিন্তু কখনও কোনও গোষ্ঠীর সমর্থকের মনোভাব নিয়ে তা করিনি। দেশের কল্যাণই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, ভারতের স্বার্থই আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। কোনও কিছুই এ থেকে আমাকে একচুলও সরাতে পারবে না।”

    মুসলিম লিগের সংগঠন মজবুত করতে জিন্নার আহ্বানে ১৯৩৭-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে কবি ইকবাল ও রাজা গজনফর আলি-সহ পাঞ্জাবের মোট ১১ জন মুসলিম নেতা লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। বাংলায় ঢাকার নবাব, সোহরাওয়ার্দী, ইস্পাহানি প্রমুখ ৮ জন; উত্তরপ্রদেশের নবাব ইসমাইল খাঁ, সৌকত আলি, খালিকুজ্জামান প্রমুখ ৭ জন এবং মাদ্রাজ, সিন্ধু, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, আসাম ও বোম্বের প্রখ্যাত মুসলমান নেতাদের জিন্না নিজ সহযাত্রী করতে সক্ষম হন। যদিও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খাঁ ভ্রাতৃদ্বয় এবং মৌলানা আজাদ, রফি আহমেদ কিদোয়াই, আসফ আলি প্রমুখ নেতা জিন্নার সহযোগী হননি। একই ভাবে ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে জিন্নার সঙ্গী হতে রাজি হননি বাংলার ফজলুল হক এবং পাঞ্জাবের সিকান্দর হায়াত খাঁ।

    পুনরুজ্জীবিত লিগের নেতা হিসেবে জিন্না কংগ্রেসের প্রতি যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে ১৯৩৬ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতার এক জনসভায় নেহরু ঘোষণা করেন: “যতই উদার চেহারা নিয়ে দেখা দিক না কেন, আমরা কোনও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে যাব না।” যদিও ১৯৩৬ সালে এআইসিসি-র ১৪৩ জন সদস্যের মধ্যে মুসলমান ছিলেন মাত্র ৬ জন। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরে দেখা যায়, প্রাদেশিক আইনসভার ১৫৮৫টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৭১৫টিতে অর্থাৎ ৫০ শতাংশেরও কম আসনে জয় লাভ করেছে। অন্যদিকে এত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও কংগ্রেস মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮৫টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৬টিতে জেতে এবং সিন্ধু, পাঞ্জাব, বাংলা, উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বে ও আসামে কংগ্রেস মনোনীত সব মুসলিম প্রার্থীই পরাজিত হন। মোট মুসলিম আসনের মাত্র ৫.৪% আসনে জয়লাভ করার ফলে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় দৃষ্টিতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দাবি অসার বলে প্রমাণিত হয়।

    অন্যদিকে যে মুসলিম লিগ মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করত, ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে স্পষ্টতই সেটা তারা প্রমাণ করতে পারল না। সব মিলিয়ে সারা দেশে ৪৮৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে লিগ পেল মাত্র ১০৯টি আসন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, সিন্ধু এবং মধ্যপ্রদেশে লিগ একটি মুসলিম আসনেও জিততে পারল না। পাঞ্জাবে তারা মাত্র ২টি আসন পেল আর আসামে ৯টি, মাদ্রাজে ১১টি, বোম্বাইতে ২০টি, যুক্তপ্রদেশে ২৭টি এবং বাংলায় ৪০টি আসনে তারা জয়ী হল। স্পষ্ট বোঝা গেল, মুসলমানগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে প্রাধান্য বিস্তার না করতে পারলেও হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলোতে লিগ শিকড় গাড়তে সক্ষম। পাশাপাশি, ১৯৩৭-এর পরে যুক্তপ্রদেশকে কেন্দ্র করে লিগের বিরাট পুনরুত্থান হল।

    যুক্তপ্রদেশ (বর্তমানের উত্তরপ্রদেশ)-এ কংগ্রেস ও লিগ একরকম জোটবদ্ধ ভাবে লড়ে। দুই দলের মধ্যে মোটামুটি এই বোঝাপড়া ছিল যে, সম্মিলিতভাবে উভয় দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে লিগকেও মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হবে। এই বোঝাপড়া থেকেই কংগ্রেস সাকুল্যে ৯টি মুসলিম আসনে লড়েছিল, বাকি ৫৭টি আসন লিগকে ছেড়ে দিয়েছিল। নির্বাচনে ২২৮টি আসনের মধ্যে ১৩৪টি আসন পেয়ে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। অন্যদিকে মুসলিম আসনের সবকটিতেই কংগ্রেস পরাজিত হয়, লিগ জয়ী হয় মাত্র ২৭টিতে। নির্বাচনের পরে খলিকুজ্জামানের সঙ্গে গোবিন্দবল্লভ পন্থের নির্বাচন-পূর্ব বোঝাপড়া অনুসারে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ অবধি কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমতি না দেওয়ায় ছোটলাটের মনোনীত সংখ্যালঘু সরকার অস্থায়ীভাবে গঠিত হয়। এই সময়ে লিগ ছতারির নবাবের সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে।

    অবশেষে ওয়ার্কিং কমিটির ৭ জুলাই-এর প্রস্তাবানুসারে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত মৌলানা আজাদ লিগের খলিকুজ্জামান এবং নবাব ইসমাইল খাঁকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন উত্তরপ্রদেশের সমস্যা মিটিয়ে বিহারে মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যস্ত, সেই সময়ে নেহরু-সহ উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ আজাদের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে গণ্ডগোলের সূত্রপাত ঘটান। তাঁরা দাবি করেন, লিগ থেকে কেবলমাত্র একজনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হবে এবং মন্ত্রী হওয়ার জন্য কংগ্রেসের শপথ বাক্য লিখিতভাবে স্বীকার করে দলের পুরোপুরি সদস্য হতে হবে।

    সমস্যা দানা বাধে বাংলাতেও। নির্বাচনী ফলপ্রকাশের পরে দেখা যায় বাংলার ২৫০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৫৪, লিগ ৪০ ও কৃষক প্রজা পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছে। ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি এপ্রিল ১৯৩৬-এ যে নির্বাচনী কর্মসূচী গ্রহণ করে তাতে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি লোপ, অবিলম্বে খাজনা কমানো এবং আবশ্যিক প্রাথমিক শিক্ষার দাবি জানানো হয়। কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফজলুল হক কংগ্রেসের কাছে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু ভাগচাষিদের অধিকার রক্ষা, তাঁদের ঋণের বোঝা কমানোর জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন এবং অন্যান্য কৃষককল্যাণমূলক যেসব কর্মসূচী তারা নিয়েছিল, তা বহু কংগ্রেস নেতারই স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। ফলে বাংলাতেও কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন না করে কংগ্রেস তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ঠেলে দেয় মুসলিম লিগের দিকে। পরবর্তীকালে এই ফজলুল হকই পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক হবেন। কিন্তু সেই সব প্রসঙ্গ খানিক পরে।

    বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশেও কংগ্রেস লিগের সদস্যদের মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করার সহযোগিতার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। কিন্তু কংগ্রেস নীতিগত ভাবে কোয়ালিশনের বিরোধী ছিল – কোনও ভাবেই এই যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ প্রথমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং তার কিছুদিন পরে আসামে কংগ্রেস অন্য দল বা নির্দলীয়দের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে দল ভাঙানোর খেলায় নামে। নির্দল ও লিগের পাঁচজন বিধানসভা সদস্যকে তারা গ্রহণ করে।

    এর আগে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন নেহরু ও জিন্নার বাগযুদ্ধ চরম পর্যায়ে উঠেছিল। নেহরু মুসলিম লিগকে ঝাঁঝালো ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন — “There are only two forces in the country, the Congress and the government... To vote against the Congress candidate is to vote for the continuance of British domination. It is the Congress alone which is capable of fighting the government. The opponents of the Congress are bound with each other by a community of interests. Their demands have nothing to do with the masses”। জবাবে জিন্না বলেন, “এদেশে এক তৃতীয় পক্ষও আছে এবং তা হল মুসলমানদের। ... আমরা কোনও দলের তল্পিবাহক হব না। সমান অংশীদার রূপে আমরা কাজ করতে প্রস্তুত আছি।”

    এরই মধ্যে ১৯৩৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আমেদাবাদের মুসলমানদের এক সভায় নেহরু বলেন, যেহেতু লিগের অস্তিত্ব মাত্র কয়েকটি প্রদেশে এবং ‘তা-ও উচ্চ বর্ণের কিছু সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ’ তাই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও রকম বোঝাপড়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন: “What does the Muslim League stand for? Does it stand for the independence of India, for anti-imperialism? I believe not. It represents a group of Muslims, no doubt highly estimable persons, for functioning in the higher regions of the upper middle classes and having no contacts with the Muslim masses and few even with the Muslim lower class. May I suggest to Mr. Jinnah that I come into greater touch with the Muslim masses than most of the members of the Muslim League?”

    এইবার আসরে নামেন জিন্না, তখনও অবধি তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতায় আগ্রহী। ২৫ সেপ্টেম্বর জিন্নার ব্যক্তিগত বন্ধু ও তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা দেওয়ান চমনলাল গান্ধীকে এক পত্রে লেখেন যে, জিন্না “সাম্প্রদায়িক সমস্যা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বন্ধে কেবল আলোচনা করতেই প্রস্তুত নন, একটা বোঝাপড়াতেও উপনীত হতে ইচ্ছুক।” চিঠির নকল নেহরুকে ২৮ তারিখে পাঠিয়ে তিনি গান্ধীকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। চমনলালের পত্রে অসন্তুষ্ট নেহরু ৩০ তারিখে গান্ধীকে লেখেন, “এই সময়ে আপনার ও জিন্নার মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার কেবল নিরর্থকই হবে না, ক্ষতিকারকও হতে পারে।” গান্ধী প্যাটেলকে অক্টোবরে লেখা চিঠিতে জানান — “বর্তমানে জিন্নার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের কোনও সম্ভাবনা দেখছি না। জওহরলাল এটা চায় না।” কংগ্রেসের রাজনৈতিক ক্ষমতাভোগের নিরঙ্কুশ আকাঙ্ক্ষার ফলেই কংগ্রেস ও লিগের সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হতে থাকে।

    সম্পর্ক তিক্ততম হয় যখন দাম্ভিক নেহরু সহসাই ১৯৩৮-এর ৬ এপ্রিল জিন্নাকে লেখেন, “Obviously, the Muslim League is an important communal organization and we deal with it as such. But we have to deal with all organizations and individuals that come within our ken. … We do not determine the measure of importance or distinction they possess. … Inevitably, the more important the organization, the more attention paid to it, but this importance does not come from outside recognition, but from inherent strength”।

    লিগের ‘inherent strength’ নিয়ে এই অযথা খোঁচায় জিন্নার সহনশীলতার চরম সীমা অতিক্রম করে। ১০ এপ্রিল পাল্টা প্রত্যাঘাত করে জিন্না তাঁকে উত্তর দেন: “Your tone and language again display the same arrogance and militant spirit, as if the Congress is the sovereign power. Unless the Congress recognizes the Muslim League on a footing of complete equality… we shall have to depend upon our ‘inherent strength’ which will ‘determine the measure of importance or distinction’ it possesses”।

    ১৯৩০ সালে মুসলিম লিগের এলাহাবাদ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ইকবাল বলেছিলেন — ‘‘I would like to see Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single State. Self-government within the British Empire or without the British Empire, the formation of a consolidated North-West Indian Muslim State appears to me to be the final destiny of the Muslims, at least North-West India”। জিন্না সে প্রস্তাবে আগ্রহী না হলে এ বিষয়ে ১৯৩৭ সালে জিন্নাকে একটি চিঠিতে ইকবাল আবারও লেখেন: “... A separate federation of Muslim Provinces, reformed on the lines I have suggested above, is the only course by which we can secure a peaceful India and save Muslims from the domination of Non-Muslims. Why should not the Muslims of North-West India and Bengal be considered as nations entitled to self-determination just as other nations in India and outside India are?”

    এতদিন পরে এইবারে সেই পালে বাতাস লাগে! গণসংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন জিন্না। কংগ্রেসের মতোই লিগের সাধারণ সদস্যভুক্তির অভিযান শুরু হয়। চাঁদা নির্ধারিত হয় দু’আনা। ১৯২৭ সালে লিগের সদস্য ছিল মাত্র ১৩৩০ জন, ১৯৩৮ সালে তা পরিণত হয় ১ লাখে। অন্যদিকে ক্রমশ কমতে থাকে কংগ্রেসের মুসলমান সদস্যসংখ্যা। ১৯৩৮ সালে নেহরু নিজেই জানান যে, কংগ্রেসের মাত্র ৩% সদস্য মুসলমান। ১১টি প্রদেশের মধ্যে ৭টিতে লিগ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত উপনির্বাচনের ৬১টি মুসলিম আসনের মধ্যে তারা পায় ৪৭টি আসন, কংগ্রেস পায় মাত্র ৪টি। ১৯৪৪ সালে লিগের সাধারণ সদস্য গিয়ে দাঁড়ায় ২০ লাখে।

    ১৯৩৮ সালের ১৪ অক্টোবর করাচিতে অনুষ্ঠিত সিন্ধুপ্রদেশ প্রাদেশিক মুসলিম লিগের প্রথম বাৎসরিক অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন পাঞ্জাব ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী সিকান্দর হায়াত খাঁ ও ফজলুল হক। পরের দিন সভাপতির ভাষণে জিন্না বলেন — “কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্ব – বিশেষ করে বিগত দশ বছরে – একান্তভাবে হিন্দু নীতি অনুসরণ করার ফলে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ক্রমশ অধিক মাত্রায় বিচ্ছিন্নতাবাদের শিকারে পরিণত করার জন্য দায়ী। আর যখন থেকে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে ছয়টি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, নিজেদের উক্তি, কার্য ও কর্মসূচীর দ্বারা উত্তরোত্তর এই কথা প্রমাণ করেছেন যে তাঁদের হাতে মুসলমানরা কোনও ন্যায়বিচার আশা করতে পারে না ... আমি জোর দিয়ে একথা বলতে চাই যে কংগ্রেস দলের বর্তমান নীতির পরিণাম হবে শ্রেণিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ এবং তার পরিণামে সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি।”

    কংগ্রেসের প্রতি জিন্নার এই অভিযোগের সমর্থন মিলল স্বয়ং নেহরুর স্বীকারোক্তিতে। নেহরু কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন যে, কংগ্রেসি মন্ত্রিসভাগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে না। এর মধ্যে মাদ্রাজ সরকার ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করেছিল, মধ্যপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রী বি এন খারে পদত্যাগ করেছিলেন, আসামেও দল ভাঙিয়ে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়েছিল। জিন্নার অভিযোগের অনেক আগে ১৯৩৮ সালের ২৮ এপ্রিল নেহরু গান্ধীকে লিখলেন, “আমার খুব বেশি করে মনে হচ্ছে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলো দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে এবং যতটা কাজ করা যায় ততটা করতে পারছে না ...। এতদিন ধরে, এত পরিশ্রম করে জনগণের হৃদয়ে আমরা যে সমুচ্চ স্থান অধিকার করেছি তা আমরা হারাচ্ছি।। আমরা ডুবতে ডুবতে সাধারণ রাজনীতিবিদদের স্তরে পৌঁছেছি যাদের কোনও নীতির বালাই নেই।” অবশ্য এই স্বীকারোক্তির অনেক আগেই মৌলানা হসরৎ মোহানি ১৯৩৭ সালে মুসলিম লিগের লখনউ সম্মেলনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব আনার পাশাপাশি নেহরুকে অভিযুক্ত করে মন্তব্য করেছিলেন: “Those who believed that Jawaharlal Nehru was above communalism or that he was the man who would solve the communal problem by bringing lasting amity and unity between the Hindus and the Muslims, were living in fools’ paradise”।

    হিন্দু-মুসলমানের এই অবিশ্বাসের বাতাবরণে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে লিগের বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্না হাজির করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘লাহোর প্রস্তাব’। ওই প্রস্তাবে দাবি করা হল, “নিখিল ভারত মুসলিম লিগের এই অধিবেশনের সুবিবেচিত অভিমত এই যে নিম্নোক্ত মূল নীতি অনুযায়ী না হলে কোনও সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকরী হবে না বা মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই মূল নীতি হল – ভৌগোলিক দিক থেকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একক (contiguous units) সমূহকে প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাসের (readjustments) সহায়তায় এমনভাবে পৃথক পৃথক এলাকায় পরিণত করতে হবে যে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মতো যেসব এলাকায় মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলিকে একত্র করে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের’ (‘Independent States’) গঠন করা যায় যার অঙ্গীভূত এককসমূহ স্বয়ংশাসিত ও সার্বভৌম হবে।” স্বয়ংশাসিত ও সার্বভৌম এককসমূহে ধর্মের প্রসঙ্গে প্রস্তাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হল যে “adequate, effective and mandatory safeguards shall be specifically provided in the constitution for minorities in the units and in the regions for the protection of religious, cultural, economic, political, administrative and other rights of the minorities, with their consultation”। বিখ্যাত প্রস্তাবটির খসড়া করলেন সিকান্দর হায়াত খান, তার খানিক অদলবদল করে সেটি উত্থাপন করলেন ফজলুল হক আর সমর্থন করলেন চৌধুরি খালিকুজ্জামান। যদিও এই প্রস্তাবে পাকিস্তান বা দেশভাগ – খোলাখুলি কোনোটিরই উল্লেখ করা হয়নি, তবুও এই লাহোর প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ একে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ রূপে উল্লেখ করল।

    অবশ্য লাহোর প্রস্তাবের পাক্কা ৩ বছর আগে হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সাভারকর উচ্চারণ করেছেন, ‘ভারতবর্ষকে আজ আর একক ও সমপ্রকৃতির জাতি জাতি মনে করা যায় না। পক্ষান্তরে এদেশে প্রধানত দুটি জাতি – হিন্দু ও মুসলমান’। ওই ভাষণে সাভারকর খোলাখুলি জানান — “As it is, there are two antagonistic nations living side by side in India. Several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded thus for the mere wish to do so. … India cannot be assumed today to be Unitarian and homogeneous nation, but on the contrary there are two nations in the main: the Hindus and the Muslims, in India”! আর লাহোর প্রস্তাবের ১৬ বছর আগে পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপৎ রাই এই মহাবাণী বিতরণ করেছেন: “Under my scheme the Muslims will have four Muslim States: 1) The Pathan Province or the North-West Frontier 2) Western Punjab 3) Sindh and 4) Eastern Bengal. If there are compact Muslim communities in any other part of India, sufficiently large to form a province, they should be similarly constituted. But it should be distinctly understood that this is not a united India. It means a clear partition of India into a Muslim India and a non-Muslim India”!!

    তবে লাহোর প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে যে পাকিস্তানের কোনও উল্লেখই করা হয়নি – সে কথা প্রখ্যাত গবেষক আয়েষা জালাল বলেছেন। তাঁর কথায়, “লাহোর প্রস্তাবকে তাই একটি দর-কষাকষির বিষয় হিসাবে দেখতে হবে যা (আপাতদৃষ্টিতে) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের দ্বারা গৃহীত হওয়ার উপযুক্ত ছিল ও কংগ্রেসের কাছে ছিল গ্রহণের একান্ত অযোগ্য এবং শেষ অবধি ব্রিটিশের কাছেও অগ্রহনীয়। এই কারণে লিগের এই দাবি যে মানা হবে না এর মধ্যে তার পূর্ণ নিশ্চয়তা ছিল এবং জিন্নাও প্রকৃতপক্ষে এটা চাইতেন না”। আয়েষা জালালের দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন মেলে বড়লাট লিনলিথগোর কথাতেও। ১৯৪০ সালের ৬ এপ্রিল লিনলিথগো ভারতসচিবকে এক তারবার্তায় জানান: “জিন্না এই জন্য এই [পাকিস্তান] প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন যাতে তিনি দেখাতে পারেন যে, মুসলমানদের নিজেদেরও কোনও গঠনমূলক পরিকল্পনা আছে, যাতে কংগ্রেসের উগ্রবাদী গোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবির বিরোধিতা করা যায় এবং কংগ্রেসের এই দাবিরও খণ্ডন হতে পারে যে ওই প্রতিষ্ঠানই ভারতবর্ষের একমাত্র প্রতিনিধি।”

    এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ১৯৩৫ সালেও যে মুসলিম লিগ ছিল কেবলমাত্র মুসলমান নবাব-জমিদার-অভিজাতদের এক মৃতপ্রায় সংগঠন; ১৯৩০ সালে উত্থাপিত ইকবালের প্রস্তাব বা ১৯৩৩-এ কেম্ব্রিজবাসী ছাত্র চৌধুরী রহমত আলির সরাসরি ‘পাকিস্তান’ গঠন করার আহ্বান যে লিগ পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই একই লিগ কোন সঞ্জীবনী মন্ত্রে রাতারাতি লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করার মতো এক গণসংগঠনে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা অর্জনে সমর্থ হল। এই প্রশ্নের উত্তর অনেকেই দিয়েছেন এবং তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই ব্যাখ্যা একরকম।

    স্ট্যানলি উলপার্ট বলেছেন যে, ‘ইকবালের চেয়েও নেহরু বেশি করে লিগকে এক নতুন গণমুখী কর্মকৌশল নিতে প্ররোচিত করেছিলেন’। উলপার্টের বয়ান অনুযায়ী: “More than Iqbal, it was Nehru who charted a new mass strategy for the League, prodding and challenging Jinnah to leave the drawing rooms of politics to reach down to the hundred million Muslims who spent most of each day laboring in rural fields”। এই ব্যাখ্যার সমর্থন মেলে নেহরুর জীবনীকার ফ্রাঙ্ক মোরেস-এর কথাতেও। তিনি লিখেছেন — “Had the Congress handled the League more tactfully after the [1937] elections Pakistan might never have come into being. … Jinnah certainly created Pakistan. But the Congress by its sins of commission and omission also helped to make it possible. Misreading the poor showing of the Muslim League at the polls … the Congress spurned Muslim League overtures for a coalition. The result was not to drive the League into political wilderness but to strengthen Jinnah’s hands as the foremost champion of Muslim claims and rights”।

    রাজমোহন গান্ধী তাঁর ‘Understanding the Muslim Mind’ গ্রন্থে লিখেছেন, “We can fairly accuse the Congress of 1937 of being stingy and haughty. It could have openly invited the League as a partner and disproved allegations that it sought Hindu rule. … Though Gandhi’s ‘best judgement’ was in favour of coalitions with the League, it is noteworthy that he was unresponsive when Jinnah sent that private message to him via Kher”। একই কথা বলেছেন কংগ্রেসের মৌলানা আজাদও। তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই কর্মকাণ্ডে নেহরুকে দায়ী করে বলেছেন: “উত্তরপ্রদেশ মুসলিম লিগের সহযোগিতার প্রস্তাবটি যদি তখন মেনে নেওয়া হত, তাহলে সমস্ত কার্যকরী ব্যবস্থাতেই মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে যেত। জওহরলালের কাজের ফলে উত্তরপ্রদেশের লিগ যেন নবজীবন পেল। ভারতবর্ষের রাজনীতির প্রত্যেক ছাত্রই জানেন যে উত্তরপ্রদেশ থেকেই লিগ পুনঃসংগঠিত হয়। শ্রীযুক্ত জিন্না ওই অবস্থার সুযোগ পূর্ণমাত্রায় নিলেন এবং এমন এক আক্রমণ শুরু করলেন যার পরিণামে পাকিস্তানের জন্ম হল।” আমরা পরবর্তীকালেও দেখব ক্যাবিনেট মিশন নিয়ে নেহরুর হঠকারী মন্তব্য কেমনভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষকে খণ্ডিত, রক্তাক্ত দেশবিভাগের দিকে নিয়ে যাবে।

    নেহরুর পাশাপাশি এই বারে আমরা দেখি, এই ব্যাপারে গান্ধীর ভূমিকাকে মুসলমানরা কিংবা জিন্না কীভাবে দেখতে চাইছেন। ১৯৩৮-এর ৩ মার্চ জিন্না গান্ধীকে সরাসরি লিখলেন — “We have reached a stage when no doubt should be left that you recognise the All-India Muslim League as the one authoritative organisation of Muslim of India and, on the other hand, you represent the Congress and other Hindus throughout the country. It is only on that basis that we can proceed further and devise a machinery of approach”। ওই বছরের ডিসেম্বরে পাটনায় মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশনে এই বিষয়ে সরাসরি গান্ধীকে অভিযোগ করে জিন্না বললেন, গান্ধীই হচ্ছেন ‘একমাত্র ব্যক্তি’ যিনি “… responsible for turning the Congress into an instrument for the revival of Hinduism and for the establishment of Hindu Raj in India”।

    এই বক্তব্যের সমর্থনে মুসলমানদের ওপরে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভার অত্যাচারের প্রসঙ্গে ১৯৩৮ সালের শেষে ও ১৯৩৯-এর মার্চ মাসে জিন্না প্রকাশ করলেন যথাক্রমে পীরপুর প্রতিবেদন ও শরিফ প্রতিবেদন। আর ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে ফজলুল হক পেশ করলেন ‘Muslim Sufferings under Congress Rule’। প্রতিবেদনগুলিতে মূলত যে সব অভিযোগ করা হয়েছিল সেগুলি হল — সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ব্যর্থতা, ইদে গো-হত্যা সম্বন্ধে স্থানীয় নিষেধাজ্ঞা, পৌত্তলিক স্তবক সমেত ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া এবং উর্দুর বদলে দেবনাগরি লিপিতে হিন্দিকে উৎসাহ দেওয়া। আমরা দেখতে পাব, পরবর্তীকালেও গান্ধী সম্পর্কে জিন্নার এই অভিযোগ অটুট থাকছে।

    এ হেন পরিস্থিতিতে, লিগের লাহোর প্রস্তাবের অব্যবহিত পরে গান্ধী ৬ এপ্রিল ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখলেন: “I know no non-violent method of compelling the obedience of eight crores of Muslims to the will of the rest of India, however powerful a majority the rest may represent. The Muslims must have the same right of self-determination that the rest of India has. We are at present a joint family. Any member may claim a division” (CWMG, ৭৮/১০৯)।

    যেটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করার মতো তা হল, গান্ধী যেন এই উক্তির মাধ্যমে প্রকারান্তরে দেশভাগের সমূহ দায় লিগের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চাইছেন। অথচ এর অনেক আগে ১৯০৯ সালে মন্টে-মির্লো শাসন সংস্কারে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছে; ১৯১৬ সালে সম্পাদিত হয়েছে লখনউ চুক্তি; ১৯২৮-এ মুসলমানদের বাদ দিয়েই গৃহীত হয়েছে নেহরু প্রস্তাব; ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুযায়ী ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনকে ‘দাসত্বের সনদ’ বলেও কংগ্রেস ১৯৩৭-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৭টি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠনও করেছে; তবুও কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দাবি সম্পর্কে নিছক উদাসীনই থাকেনি, রীতিমতো গায়ের জোরে নিজেকে ভারতবর্ষের সমস্ত সম্প্রদায়ের এক ও একমাত্র প্রতিনিধি বলে জাহির করার চেষ্টা করে গেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আম্বেদকরের ক্ষেত্রে গান্ধী তথা কংগ্রেস সফল হলেও ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী জিন্নার কাছে তাঁদের সফল হওয়া যে মুশকিল, সে কথাটা তাঁরা উপলব্ধি করেননি। আরও আশ্চর্যজনক, সারা জীবনে মোট ১৭ বার অনশনে বসা গান্ধী একমাত্র জিন্নার দাবিকে বদলানোর জন্য এক দিনও অনশনে বসেননি, আমরণ অনশন তো দূরের কথা।

    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. এম এ মোহাইমেন – ইতিহাসের আলোকে দেশ বিভাগ ও কায়েদে আযম জিন্নাহ
    ২. বিপান চন্দ্র ও অন্যান্য – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৮৫৭ -১৯৪৭
    ৩. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী – ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ
    ৪. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – জিন্না : পাকিস্তান / নতুন ভাবনা
    ৫. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৬. Allen Hayes Merriam – Gandhi vs. Jinnah: The Debate over the Partition of India
    ৭. Ayesha Jalal – The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan
    ৮. Louis Fischer – Mahatma Gandhi: His Life & Times
    ৯. Maulana Abul Kalam Azad – India Wins Freedom
    ১০. Rajmohan Gandhi – Understanding the Muslim Mind
    ১১. Sheshrao Chavan – Was Jinnah Alone Responsible For Partition?
    ১২. Stanley Wolpert – Jinnah of Pakistan


    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    দশম তথা শেষ পর্ব : গান্ধী ও ক্ষমতা হস্তান্তর — প্রত্যাশা-প্রাপ্তির পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য


    ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিলে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আলোচনা ব্যতিরেকেই বড়্লাট একতরফা ভাবে ভারতকে ‘যুদ্ধরত দেশ’ বলে ঘোষণা করলেন। ন্যূনতম কিছু শর্ত মেনে নেওয়ার বিনিময়ে কংগ্রেস যুদ্ধপ্রচেষ্টায় ব্রিটেনকে পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দিল। কিন্তু ১৭ অক্টোবরের সরকারি বিবৃতিতে কেবলমাত্র ‘কয়েকটি সম্প্রদায়’-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হল। এ হেন মামুলি ঘোষণায় ক্ষুব্ধ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি, ২৩ অক্টোবর সমস্ত প্রদেশ কংগ্রেস মন্ত্রিসভাকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দিলে মন্ত্রিসভাগুলো ১০ নভেম্বরের মধ্যে পদত্যাগ করল। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে শুরু হল এক জটিল অধ্যায়ের, যা দেশভাগের মতো মর্মন্তুদ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে ক্রমশ।

    এই টালমাটাল সময়ে গান্ধী তথা কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীপ্রধান সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কোনও রকম জঙ্গি আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে সংযত থাকার পরামর্শ দিলেন এবং ব্রিটিশের সঙ্গে বারংবার সম্মানজনক রফায় আসার চেষ্টা করলেন। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত রামগড় কংগ্রেসে বলা হল, ‘যে মুহূর্তে কংগ্রেস সংগঠনকে উদ্দ্যেশ্যের পক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত বলে মনে করা হবে’ তখনই শুরু হবে আইন-অমান্য আন্দোলন। হিন্দু-মুসলমানের এই অবিশ্বাসের বাতাবরণে ১৯৪০-এর ২৩ মার্চ লাহোরে লিগের বাৎসরিক অধিবেশনে জিন্না হাজির করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘লাহোর প্রস্তাব’।

    এর মাসদুয়েক পরে মে মাসে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাম্রাজ্যবাদী উইন্সটন চার্চিল, যিনি ১৯৪২ সালের নভেম্বরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়ে ঘোষণা করবেন, ‘I have not become the King’s First Minister in order to preside over the liquidation of the British Empire’। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধকালীন সাম্রাজ্যবাদী সরকারি রণনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মুসলিম লিগের দাবিকে আরও বেশি করে ইন্ধন যোগানো। ফলত চার্চিলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে ১৯৪০-এর ৮ অগস্ট লিনলিথগোর পেশ করা ‘অগস্ট প্রস্তাব’-এ ভারতবর্ষের প্রাপ্তির বিষয়ে বলা হল — ক) কোনও এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে ডমিনিয়ন মর্যাদা, খ) যুদ্ধের পরে সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি সংস্থা গঠন এবং গ) একটি যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন। একই সঙ্গে প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবে বলা হল যে, “এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতবর্ষের শান্তি এবং সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে এমন কোনও ধরণের সরকারের কাছে তাদের বর্তমান দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারে না যাদের কর্তৃত্ব ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনের একটি বড় ও শক্তিশালী অংশ অস্বীকার করে।” এই প্রস্তাবের অস্পষ্টতা কাটাতে লিওপোল্ড আমেরি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করলেন যে, ‘the foremost among these elements stands the great Muslim community of ninety million, constituting a majority both in North-Western and North-Eastern India’। যুদ্ধ চলাকালীন এই প্রস্তাবের মাধ্যমে জিন্নার কেন্দ্রীয় দাবিসমূহকে প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হল।

    অগস্ট প্রস্তাবের হতাশাজনক ঘোষণার পরে গান্ধী আইন-অমান্যের অনুমতি দিলেন, অবশ্য তা সীমিত রইল প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য রাখার অধিকারের বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যেই। যদিও এই আপাত-নির্বিষ ‘ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন ১৯৪১ সালের জুন মাস নাগাদ তুঙ্গে উঠল। প্রায় ২০ হাজার মানুষ কারাবরণ করলেন। কিন্তু বেশির ভাগ বন্দিকেই ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই আন্দোলেনে ভাটাও আসল খুবই তাড়াতাড়ি। এই আন্দোলনে ব্রিটিশকে গুরুতর রকমের বিব্রত করা যে গান্ধীর লক্ষ্য ছিল না, সে কথা তিনি ওই বছরের জানুয়ারি মাসেই বিড়লাকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন। ইত্যবসরে ২২ জুন জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করল এবং ডিসেম্বর মাসে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একে একে মালয়, সিঙ্গাপুর ও ব্রহ্মদেশ থেকে ব্রিটিশদের হটিয়ে দিল। এই দু’টি ঘটনা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতের গুরুত্বকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিল। ভারতের জনমতকে নিজেদের পক্ষে পাওয়ার লক্ষ্যে এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনার জন্য ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে রওনা দিলেন।

    ক্রিপস মিশন কোনও ভাবেই কোনও সদর্থক ভূমিকা পালনের জন্য এ দেশে আসেনি। চার্চিল-ওয়াভেল জুটি বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক চাপ, বিশেষত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের চাপের মুখে নিছকই ব্রিটেনের পক্ষ থেকে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার ভান দেখিয়ে মিশনকে পাঠিয়েছিলেন মাত্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্রিপস মিশন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সন্তোষজনক বোঝাপড়ায় ব্যর্থ হল। মিশনের ব্যর্থতা এ কথা স্পষ্ট করে দিল যে, যুদ্ধের সময়ে কোনও সম্মানজনক মীমাংসা প্রস্তাব বা কোনও প্রকৃত সাংবিধানিক অগ্রগতি ঘটানোর ব্যাপারে ব্রিটেন আদৌ আগ্রহী নয়। ক্রিপসের ভারত ত্যাগের দিন পনেরো পরে গান্ধী কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জন্য একটা খসড়া প্রস্তাব রচনা করলেন। এই প্রস্তাবে ইংরেজকেকে ভারত ছাড়ার এবং জাপানি আগ্রাসন হলে তার বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানানো হল। ১৬ মে এক সাংবাদিক বৈঠকে গান্ধী দৃপ্তভাবে জানালেন, ‘… this orderly disciplined anarchy should go, and if as a result there is complete lawlessness I would risk it’। তিনি ৬ অগস্টের এক সাক্ষাৎকারে এ-ও বললেন: ‘... if a general strike becomes a dire necessity, I shall not flinch’।

    জুলাই মাসে ওয়ার্কিং কমিটি অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভের প্রস্তাব গ্রহণ করল। প্রাথমিকভাবে নেহরু এই আন্দোলনের বিরোধী থাকলেও একেবারে শেষ সময়ে তিনি আন্দোলনের পক্ষে মত দিলেন। বোম্বাইতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে ৮ অগস্ট ‘জুলাই প্রস্তাব’ সংশোধিত আকারে পাশ হল। ‘যতদূর সম্ভব বড় মাত্রায় অহিংস পন্থায় গণসংগ্রামের’ ঘোষণার পাশাপাশি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে সরিয়ে দেওয়া হলে সেই পরিস্থিতিতে ‘every Indian who desires freedom and strives for it must be his own guide’-এর কথাও বলা হল। আন্দোলন শুরু হতে না হতেই ৯ অগস্ট গান্ধী-সহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হলেন। কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করা হল। এমতাবস্থায় নেতৃত্বহীন, সংগঠনহীন, আয়োজনহীন, কর্মসূচীহীন, যোগাযোগহীন নিরস্ত্র অসহায় জনগণ স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল।

    গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’-র ঘোষণার অব্যবহিত পরে প্রথম দু’মাস জুড়ে দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হল। পুলিশের নির্দেশ অমান্য করে সরকারি ভবনগুলোতে জোর করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হল; বিশাল জনতা আক্রমণ চালাল থানা, ডাকঘর, আদালত ও রেল স্টেশনগুলোতে। উড়িয়ে দেওয়া হল ছোট ছোট সেতু সহ রেললাইন; টেলিফোন-টেলিগ্রাফের তার কাটাও চলল পুরোদমে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, নেতাদের গ্রেফতারের পরে প্রথম সপ্তাহে ২৫০টি স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা হয়; আক্রমণ করা হয় ৫০০টিরও বেশি ডাকঘর এবং ১৫০টি থানা। উত্তর ও মধ্য বিহারের ১০টি জেলার প্রায় ৮০% থানাই বিদ্রোহীরা সাময়িকভাবে দখল করে নিলেন। বালিয়া ও গাজীপুরে অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হল। অক্টোবরের মধ্যে মেদিনীপুরের পটাশপুর, খেজুরি ও সুতাহাটা বিদ্রোহীদের দখলে এল। ৯ অগস্ট থেকে দেশব্যাপী যে ঘটনা ঘটতে থাকে সে ব্যাপারে লিনলিথগো চার্চিলকে এক তারবার্তায় জানালেন, ‘… by far the most serious rebellion since that of 1857, the gravity and extent of which we have so far concealed from the world for reasons of military security’। এই স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহকে দমন করতে ব্রিটিশ প্রচন্ড দমননীতির আশ্রয় নিল, বছরের শেষ দিকে শুধুমাত্র ৬০ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হল। অবশেষে মাত্র মাস চারেকের মধ্যেই স্রেফ ব্রিটিশের ডান্ডার চোটে আন্দোলন ঠান্ডা হল। শেষবারের মতো ব্যর্থ হল গান্ধীর আন্দোলন-আন্দোলন খেলা।

    অন্যদিকে ১৯৩৯-এর যুদ্ধ জিন্নার কাছে এক অভাবনীয় সুযোগ এনে দিল। ‘ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনার সময় মুসলমানদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হবে’ – এই আশ্বাসের ভিত্তিতে যুদ্ধে ব্রিটিশকে মুসলিম লিগের সহযোগিতা করার ঘোষণা যুদ্ধের প্রারম্ভেই করা হয়েছিল। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করে জিন্না অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে এ বিষয়ে এক প্রস্তাব পাশ করিয়ে ব্রিটিশকে যুদ্ধে সমর্থন করলেন। এরই ভিত্তিতে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গান্ধী-সহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিকে জাতীয় রাজনীতিতে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করতে উদ্যোগী হল লিগ। আর মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করার দিকে বেশ ভালোভাবেই এগোতে থাকলেন জিন্না। ১৯৪৩ সালের মধ্যে বাংলা, আসাম, সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে লিগ মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় বসল। সর্বপ্রথমে ১৯৪২-এর সেপ্টেম্বরে সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী বরখাস্ত হলেন। গভর্নর সেখানে লিগকের মন্ত্রিসভা গড়ার অনুমতি দিলেন। আসামেও একই ঘটনা ঘটল। পরের বছরে হক সরকারের পতন ঘটল বাংলায়। মে মাসে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও তৈরি হল লিগের মন্ত্রিসভা। একমাত্র পাঞ্জাব ছাড়া সমস্ত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ জিন্নার কর্তৃত্বে চলে এল। পাশাপাশি, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে সিকান্দার হায়াত খানের মৃত্যুর পরে পাঞ্জাবে জিন্নার ঢোকার পথ সুগম হল। এই সময়ে লিগের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন ইস্পাহানি ও আদমজি গোষ্ঠী। আর এই বছরেই মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরের বলি হয়ে স্রেফ না খেতে পেয়ে বাংলায় মারা গেলেন ৫০ লাখ মানুষ।

    ইতিমধ্যে দেশবিভাগের দাবি মেনে নিয়ে ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসেই গান্ধী বলেছিলেন, “If the vast majority of Muslims regard themselves as a separate nation having nothing in common with the Hindus and others, no power on earth can compel them to think otherwise. If they want partition of India on that basis, they must have partition, unless the Hindus want to fight against such a division” (CWMG, ৮২/১৮৯)। লিগের এই দ্রুত উত্থানের ফলে ১৯৪৪ সালের ৮ এপ্রিল গান্ধীর অনুমতি নিয়ে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি জিন্নার কাছে এই বিষয়ে একটি সমঝোতা প্রস্তাব পেশ করলেন। এই প্রস্তাবের মূল শর্ত ছিল – লিগ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মধ্যবর্তী সময়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি আদায়ের জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। বিনিময়ে যুদ্ধ শেষে লিগের দাবি অনুযায়ী — ক) উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ভারতবর্ষের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলিকে নির্দিষ্ট করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হবে, খ) ওই এলাকার অধিবাসীরা পৃথক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্রে যেতে চান কি না সে বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থা করা হবে এবং গ) আলাদা হলেও প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে একটি চুক্তি সম্পাদিত হবে।

    প্রস্তাবে এ-ও বলা হয়েছিল যে, ‘… the formula seems to be binding only if there is an actual transfer for this Majesty’s Government of full power and responsibilities to an Indian Government’। এই সূত্রের পূর্ণ বয়ান স্টেটসম্যান কাগজে প্রকাশিত হলে দেশবিভাগের পরিকল্পনাকে সমর্থন করার জন্য গান্ধী তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হলেন। যদিও জিন্না রাজাগোপালাচারির এই প্রস্তাবে সম্পূর্ণ আস্থা প্রকাশ না করে, তাঁর পরিবর্তে স্বয়ং গান্ধীকে প্রস্তাব পেশ করার কথা বললেন। এই আলোচনায় স্পষ্ট হল, গান্ধী শুধু দেশবিভাগের পরিকল্পনাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, জিন্নাই যে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি – প্রকারান্তরে তিনি সে কথাও মেনে নিচ্ছেন।

    যুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালের ৬ মে গান্ধী স্বাস্থ্যের কারণে জেল থেকে ছাড়া পেলেন। হিন্দু মহাসভার তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে জুলাই মাসে জিন্নার সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব দিলেন গান্ধী। ১৯৩৭-৩৮ নাগাদ জিন্না গান্ধীকে একের পর এক চিঠি লিখে ব্যক্তিগত আলোচনার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার ব্যাপারে মিটমাট করে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে যে গান্ধী আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলতেন, সেই গান্ধীই ১৯৪৪-এর অগস্ট মাসে জিন্নাকে ‘ভাই’ বলে ডেকে ও ‘কায়েদ-ই-আজম’ সম্বোধনে ভূষিত করে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আগ্রহী হলেন! এই ঘটনায় বিস্মিত আজাদ পরে লিখবেন, “I think Gandhiji’s approach to Mr. Jinnah on this occasion was a great political blunder. It gave a new and added importance to Mr. Jinnah which he later exploited to the full. … Large sections of Indian Musalmans were doubtful about Mr. Jinnah and his policy, but when they found that Gandhiji was continually running after him and entreating him, many of them developed a new respect for Mr. Jinnah. They also thought that he was perhaps the best man for getting advantageous terms in the communal settlement”।

    জিন্নার স্বাস্থ্যজনিত কারণে সেই বৈঠক জুলাই মাসের পরিবর্তে সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হল। প্রসঙ্গত, তখনও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা জেল থেকে ছাড়া পাননি। এমতাবস্থায়, জিন্নার সঙ্গে আপস রফার জন্য ১৯৪৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অবধি জিন্নার বম্বের মালাবার হিলসে মাউন্ট প্লেজান্ট রোডের বাসগৃহে ১৪ বার মিলিত হলেন গান্ধী। গান্ধী নিজে তখন থাকছেন একই রাস্তায় বিড়লার বাড়িতে। বৈঠকে স্থির হল তাঁদের দুজনের আলোচনায় যে শর্তগুলি উল্লিখিত হবে, সেগুলিকে অনুমোদিত করবার জন্য গান্ধী ও জিন্না যথাক্রমে কংগ্রেস ও লিগে তৎপর হবেন। সেখানে শর্ত হল — ক) যুদ্ধ শেষ হলে উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের যেসব জেলাগুলিতে মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, তা নির্ধারণের জন্য একটি কমিশন গড়া হবে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে জনমত নেওয়া হবে। জনমত যদি ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে রায় দেয়, তা সত্ত্বেও প্রান্তবর্তী জেলাগুলির যে কোনও রাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতা থাকবে; খ) জনমত গ্রহণের আগে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিজ নিজ মত প্রচার করতে পারবে; গ) যদি দু’টি রাষ্ট্র তৈরি হয় তবে দুই রাষ্ট্রই প্রতিরক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যানবাহন ও অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ থাকবে; ঘ) প্রয়োজন বিশেষে লোক অপসারণ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলকভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং ঙ) ব্রিটেন ভারতকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করার পরে এই সমস্ত শর্ত কার্যকর হবে।

    এই আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, গান্ধী পাকিস্তানের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব না মানতে চাইলেও দেশবিভাগের দাবি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ চলে গেলে কংগ্রেস দেশবিভাগের দাবি মেনে নেবে – এই প্রতিশ্রুতিতে জিন্না রাজি হলেন না। তিনি আগে দেশবিভাগ ও পরে স্বাধীনতার কথা বললেন। স্বাভাবিকভাবেই জিন্নার মনে হয়েছিল যে, একবার ক্ষমতা হস্তান্তর পর্ব সম্পন্ন হলে হিন্দু আধিপত্যবাদী কংগ্রেস কিছুতেই মুসলমানদের ন্যায্য অধিকারের কথা বিবেচনা করবে না। ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু মুসলমানদের এই শঙ্কার কারণকে আজাদ যথাযথ বিশ্লেষণ করে লিখেছেন — “One thing nobody could deny. As a community, the Muslims were extremely anxious about their future. It is true that they were in a clear majority in certain provinces. At the provincial level they had therefore no fears in these areas. They were however a minority in India as a whole and were troubled by the fear that their position and status in independent India would not be secure”।

    অবশ্য জিন্নার সঙ্গে গান্ধীর এই সাক্ষাতের অনেক আগেই ১৯৪৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর নেহরু তাঁর ‘জেল ডায়েরি’-তে লিখে ফেলেছেন, “আমার মনে হয় ভারতের প্রগতির ব্যাপারে জিন্নার মিথ্যা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মাথাকে বারবার গলাবার সুযোগ দেওয়ার বদলে পাকিস্তান বা আর যা কিছু তিনি চান, তা মেনে নেওয়া ভালো।” মনে রাখতে হবে, জওহরলালের এই ঘোষণার অনেক আগেই ১৯৪২ সালের ১৫ জানুয়ারি কংগ্রেসের ওয়ার্ধা অধিবেশনে গান্ধী জওহরলালকে তাঁর উত্তরসূরী ঘোষণা করে বলেছেন: “Somebody suggested that Pandit Jawaharlal and I were estranged. This is baseless. Jawaharlal has been resisting me ever since he fell into my net. You cannot divide water by repeatedly striking it with a stick. It is just as difficult to divide us. I have always said that not Rajaji, nor Sardar Vallabhbhai, but Jawaharlal will be my successor. He says whatever is uppermost in his mind, but he always does what I want. When I am gone he will do what I am doing now. Then he will speak my language too” (CWMG, ৮১/৪৩২-৩৩)।

    কেবলমাত্র পাকিস্তানের ব্যাপারে নীরবতা তখনও অবধি বজায় রেখেছেন প্যাটেল, যদিও কিছুদিন পরে তিনিও জিন্নাকে হতচকিত করে দিয়ে মেনে নেবেন এই প্রস্তাব! প্রত্যাশিতভাবেই জিন্নার সঙ্গে গান্ধীর আলোচনা ব্যর্থ হল, কিন্তু এই আলোচনার ফল হল সুদূরপ্রসারী। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি আজাদের মতামতকে তোয়াক্কা অবধি না করে গান্ধীর এই একতরফা আপস রফার চেষ্টাকে আজাদ বিশ্লেষণ করেছেন এই ভাষায় — “When in July 1944, I read the report that Gandhiji was corresponding with Mr. Jinnah and going to Bombay to meet him, I told my colleagues that Gandhiji was making a great mistake. His action would not help to solve, but on the contrary aggravate the Indian political situation. Later events proved that my apprehensions were correct. Mr. Jinnah exploited the situation fully and built up his own position but did not say or do anything which could in any way help the cause of Indian freedom”।

    ব্রিটেনে নির্বাচন হতে যখন আর মাত্র মাসখানেক বাকি, তখন ১৯৪৫ সালের জুন মাসে চার্চিল শেষ পর্যন্ত ওয়াভেলকে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করার অনুমতি দিলেন। চার্চিলের তরফে বড়লাট ওয়াভেল ১৪ জুন এক নতুন শাসন পরিষদ গঠন নিয়ে কথাবার্তার প্রস্তাব রাখলেন। আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা যাতে অংশ নিতে পারেন, সেই কারণে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত সদস্যকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। ১৯৪৫-এর ২৫ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত চলল সিমলা সম্মেলন। সেখানে কংগ্রেস দাবি করল যে, শাসন পরিষদের জন্য মনোনীত কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে সমস্ত সম্প্রদায়ের লোককেই মনোনীত করার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু সম্মেলন ভেস্তে গেল জিন্নার দু’টি অনমনীয় দাবির কারণে। তিনি বললেন – ক) কেলমাত্র লিগের সমস্ত মুসলিম সদস্য মনোনীত করার নিরঙ্কুশ অধিকার থাকবে এবং খ) যেসব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা মুসলমানরা করবেন, সেগুলি অনুমোদন করাতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে। ওয়াভেল লিগকে বাদ দিয়ে শাসন পরিষদ গঠনের কোনও চেষ্টাই করলেন না।

    জুলাই মাসে লেবার দল বিপুলভাবে জিতে ব্রিটেনে ক্ষমতায় এল, প্রধানমন্ত্রী হলেন স্যার ক্লিমেন্ট অ্যাটলি। নবনির্বাচিত সরকারের তরফে ২১ অগস্ট আগামী শীতে নতুন নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হল। সঙ্গে প্রধান প্রধান ভারতীয় দলের সমর্থন থাকবে, এমন শাসন পরিষদ গঠনের চেষ্টা করার কথাও বলা হল। এই ফাঁকে ব্রিটিশরা অত্যন্ত বোকার মতো নভেম্বর মাসে ২০ হাজার আজাদ হিন্দ ফৌজিদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে প্রকাশ্যে বিচার শুরু করার উদ্যোগ নিলে দেশ জুড়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হল। লালকেল্লায় প্রথম বিচার শুরু করে এবং কাঠগড়ায় একই সঙ্গে একজন হিন্দু, একজন মুসলমান ও একজন শিখকে একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রিটিশরা তাদের মূর্খামি আরও বাড়িয়ে তুলল। এই ব্যাপারে অনেক আগেই ১৯৪৫ সালের ২১-২৩ সেপ্টেম্বর বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত যুদ্ধ-পরবর্তী সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির প্রথম অধিবেশনে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের হয়ে সওয়াল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এইবারে নভেম্বর মাসে নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে সুকৌশলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইকে যুক্ত করে দেওয়ার বিষয়ে কংগ্রেস উঠেপড়ে লাগল। বিশেষত হিন্দু পি কে সেহগাল, মুসলমান শাহ নওয়াজ এবং শিখ গুরুবক্স সিং ধিলোঁ কংগ্রেসকে সেকুলার দল হিসাবে তুলে ধরার এক অভাবনীয় সুযোগ এনে দিল।

    নির্বাচনী প্রচারে জিন্নাও চুপ করে বসে রইলেন না। ১৯৪৫ সালের ১০ অক্টোবর বালুচিস্তান মুসলিম লিগের কোয়েটা সম্মেলনে গান্ধীর অহিংস অসহযোগের পদ্ধতিকে তুলোধোনা করে জিন্না বললেন, “… to obtain leadership, to sit like goat under the police ‘lathi’ charge, then to go to jail, then to complain of loss of weight and then to manage to release. I don’t believe in that sort of struggle, but when the time for suffering comes, I will be the first to bullet shots in my chest”। মুসলমানদের লিগের পক্ষে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে তিনি বললেন: “আজ যদি আমরা আমাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সামাজিক মর্যাদা শূদ্রদের মতো হবে এবং ভারতের বুক থেকে ইসলাম ধর্ম মুছে যাবে।”

    লালকেল্লার ঐতিহাসিক বিচারে আসামীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে মামলা লড়লেন ভুলাভাই দেশাই, তেজবাহাদুর সপ্রু, আসফ আলি ও নেহরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে সুভাষের সহযোগিতার বিষয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন নেহরু। কিন্তু আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিচার চলাকালীন ধীরে ধীরে মত পরিবর্তন করতে থাকলেন তিনি। ১৯৪৫ সালের ২০ অগস্ট স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে নেহরু বললেন: “The punishment given them would in effect be a punishment on all India and all Indians, and a deep wound would be created in millions of hearts”। ফৌজের ‘noble motives’-কে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন যে, আজাদ হিন্দের সেনারা ‘done the wrong thing for the right reason’। যদিও দেশ জুড়ে নির্বাচনী প্রচারে কোনও খামতি না রাখলেও সেনাদের আট সপ্তাহ ধরে চলা বিচারপ্রক্রিয়ায় আদালতে মাত্র তিনদিন হাজির হলেন তিনি! মুক্তির পরে সেহগাল, শাহ নওয়াজ ও ধিলোঁ জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হওয়ায় কংগ্রেসের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সুবিধাজনক হয়ে গেল।

    রাজনৈতিক অচলাবস্থার অন্তরালে ভারতব্যাপী যে ভয়ঙ্কর অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের মুক্তির দাবিতে তার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটল। এই বিচারকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বাহিনীর ভারতীয়রাও প্রভাবিত হলেন। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও অন্যান্য শ্রেণির জনসাধারণের এই সংগ্রামে যোগ দিলেন ইংরেজ সরকারের বিমান-নৌ-পুলিশবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদল ও সশস্ত্র পুলিশরা। ১৯৪৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইতে ভারতীয় বৈমানিকরা উৎপীড়নমূলক আচরণের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাপতি রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে কলকাতায় লক্ষাধিক ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক মিছিল বের করল। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে বোম্বাইতে শুরু হল নৌ-বিদ্রোহ। মার্চ মাস থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আরম্ভ হল পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ধর্মঘট ও বিদ্রোহ। ১ মার্চ জব্বলপুরে, ১৮ মার্চ দেরাদুনে, ১৯ মার্চ এলাহাবাদে, ২৩ মার্চ দিল্লিতে এবং ৩ এপ্রিল বিহারে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট পালিত হল।

    দেশব্যাপী এই অশান্ত পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ও লিগ তখন ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মত্ত! ১৯৪৫-৪৬ এর শীতকাল জুড়ে কংগ্রেস নেতারা নির্বাচন যুদ্ধে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। সাধারণ অর্থাৎ অ-মুসলিম কেন্দ্রগুলিতে কংগ্রেস ব্যাপকভাবে জিতল। ৪৫ সালের ডিসেম্বরের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভার ১০২টি আসনের মধ্যে তারা দখল করল ৫৭টি আসন এবং ৯১.৩% অ-মুসলিম ভোট এবং ৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রদেশ নির্বাচনে বাংলা, সিন্ধু ও পাঞ্জাব ছাড়া অন্যান্য সব প্রদেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। পাশাপাশি, মুসলিম আসনগুলিতে লিগও সমানভাবে চোখে পড়ার মতো সাফল্য পেল। ১৯৩৭ সালে না পারলেও, এবারে জিন্নার এতদিনের দাবি – লিগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান – সংবিধানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠা করল লিগ। ৮০.৬% মুসলিম ভোট পেয়ে কেন্দ্রের ৩০টি সংরক্ষিত আসনের সবকটিতেই তারা জয়ী হল। প্রদেশের মোট ৫০৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে পেল ৪২৭টি। এমনকি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস পেল ২১টি আসন, লিগ পেল ১৭টি। বাংলা ও সিন্ধুতে সরকারি ও ইউরোপীয় সমর্থনের ওপর নির্ভশীল হয়ে লিগ মন্ত্রিসভা স্থাপিত হল। অন্যদিকে পাঞ্জাবে ১৭৫টি আসনের মধ্যে লিগ ৭৯টি আসন পেলেও, খিজার হায়াত খান কংগ্রেস ও আকালি দলের সঙ্গে রফা করে আরও এক বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকা সুনিশ্চিত করলেন।

    ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণে জেলে বন্দি কংগ্রেস নেতারা প্রায় জাতীয় বীরের মর্যাদা পেলেন, সঙ্গে আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের ভূমিকা আপামর ভারতবাসীর মনে উগ্র দেশপ্রেমের সঞ্চার করল। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস আসীন হলে, আজাদ হিন্দ ফৌজিদের নিয়ে কংগ্রেসের প্রকৃত মনোভাব স্পষ্ট হবে কয়েক মাস পরেই! অন্যদিকে, হিন্দু জমিদার ও ভূস্বামীদের ওপরে মুসলমান রায়তদের ক্রমবর্ধমান পুঞ্জিভূত ক্ষোভ; শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের নতুন রাষ্ট্রে চাকরি ও পদোন্নতির বাসনা এবং মুসলমান ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের পাকিস্তানে হিন্দু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের এড়িয়ে একতরফা মুনাফা করার নতুন মৃগয়াক্ষেত্রের সন্ধানপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় ভারতীয় মুসলমানরা একচেটিয়াভাবে লিগকে ভোট দিলেন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালের ২৮ নভেম্বর ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় ভারত-বিষয়ক উপসমিতি এদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। অবশেষে, ১৯৪৬-এর ২২ জানুয়ারি ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্যে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার তিন সদস্য – ভারত-সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য সভার সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান এ ভি আলেকজান্ডারকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

    এই প্রতিনিধি দল (যা ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামে পরিচিত) ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ দিল্লিতে পৌঁছনোর পর থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত একক ও যৌথভাবে এবং আনুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া ভিত্তিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ, দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি, বড়লাট ও তাঁর শাসন পরিষদের সদস্যবর্গের সঙ্গে ১৮২টি বৈঠকে ৪৭২ জন ভারতীয় নেতার সঙ্গে মিলিত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি সর্বজনস্বীকৃত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। বিস্তর আলাপ-আলোচনার পরে মিশন একেবারে শেষে ১৬ মে যে প্রস্তাব দেয়, তাতে বলা বলা হল — ক) এক দুর্বল কেন্দ্র যার দায়িত্ব থাকবে কেবলমাত্র প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা; খ) প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের জন্য প্রদেশগুলি তিনটি বড় ধরণের বিভাগে সম্মিলিত হবে – ১. বিভাগ ‘ক’তে থাকবে মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং উড়িষ্যার মতো হিন্দুগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি। ২. ‘খ’ বিভাগে থাকবে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকার পাঞ্জাব প্রদেশ-সহ প্রধানত মুসলিম গরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধু। ৩. ‘গ’ বিভাগে থাকবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও আসাম; গ) নতুন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। ২৫ মে মিশন এই পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে আরও জানাল যে, প্রাথমিকভাবে এই বিন্যাস বাধ্যতামূলক হলেও সংবিধান রচিত হওয়ার পরে প্রদেশগুলি তার কোনও একটি বিভাগ বা গ্রুপ থেকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভার নতুন নির্বাচন করা হবে। বলা বাহুল্য, ভারতবর্ষকে অবিভক্ত রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটাই ছিল শেষ প্রয়াস। প্রথমে ৬ জুন লিগ এবং প্রস্তাবিত সংবিধান-রচনা পরিষদে রাজন্যশাসিত রাজ্য থেকে নির্বাচিত সদস্যদের কোনও ব্যবস্থা না থাকার সমালোচনা করলেও কংগ্রেস ২৪ জুন এই পরিকল্পনা মেনে নিল।

    গান্ধী কিন্তু ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাকে হুবহু মেনে নিতে চাননি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের বাধ্যতামূলক বিন্যাস সম্পর্কে আপত্তি জানিয়ে পেথিক লরেন্সকে ১৯ মে তিনি লেখেন, “If your answer is ‘yes’ does it not follow that the Frontier and Assam province delegates would be free to abstain from joining the sections to which they are arbitrary assigned?” (CWMG, ৯০/৪১২)। যদিও মাত্র এক সপ্তাহ পরে ২৬ মে ‘হরিজন’ পত্রিকায় ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে পূর্ণ সমর্থন করে তিনি লিখেছিলেন: “ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রীমিশন ও ভাইসরয় যে ‘স্টেট পেপার’ প্রকাশ করেছেন, চার দিন ধরে তার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে বর্তমান অবস্থায় এর চেয়ে ভালো কোনও দলিল ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা সম্ভব ছিল না” (CWMG, ৯১/১)। আশ্চর্যের কথা এই, ২৫ জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পুনরায় তাঁর আপত্তির কথা জানিয়ে কংগ্রেস নেতৃবর্গকে তিনি বলেন — “I admit defeat. You are not bound to act upon my unsupported suspicion. You should follow my intuition only if it appeals to your reason. Otherwise you should take an independent course. I shall now leave with your permission. You should follow the dictates of your reason” (CWMG, ৯১/১৯৪)।

    কিন্তু ততদিনে তিনি কংগ্রেসে প্রান্তিক হয়ে গেছেন, দ্রুত ক্ষমতা দখলের বাসনায় তাঁরই হাতে তৈরি নেহরু-প্যাটেল জুটি তাঁকে ছাপিয়ে ক্রমেই দলে ছড়ি ঘোরানোর স্থানে ততদিনে নিজেদের পোক্ত করে ফেলেছেন। তাই সেদিন দুপুরেই আহুত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তাঁকে ডাকা হয়নি – তাই নয়, সভা শেষ হওয়ার পরে তাঁকে সেই সভার সিদ্ধান্তের কথাও কেউ জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি! এই ঘটনা আবারও ঘটবে, দেশভাগজনিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে। মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই ‘বাধ্যতামূলক বিন্যাস’ নিয়েই দর কষাকষির চূড়ান্ত পরিণতিতে দেশটা ভেঙে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ক্রমশ আরও প্রান্তিক, আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন তিনি।

    ইতিমধ্যে মৌলানা আজাদের পরিবর্তে তাঁরই প্রস্তাব অনুযায়ী নেহরু কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নির্বাচিত হলেন। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলাকালীন এক সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু হঠাৎই এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসলেন। আজাদ আত্মজীবনীতে লিখেছেন — “এরপর সেই জাতীয় এক অতীব শোচনীয় ঘটনা ঘটল যা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত করে দিয়ে থাকে। ১০ জুলাই, জওহরলাল বোম্বাই-এ সাংবাদিক সম্মেলন করলেন এবং তাতে এক বিবৃতি দিলেন। অন্য সময় হলে তাঁর সেই বিবৃতিটি তেমন কোনও আলোড়নের সৃষ্টি করত না, কিন্তু তৎকালীন অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণার পরিস্থিতিতে, এক অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলির সৃষ্টি করল। কয়েকজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, এআইসিসি কর্তৃক এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর কি কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার গঠনপ্রণালীসহ [মিশনের] সমগ্র পরিকল্পনাকেই পুরোপুরি (in toto) গ্রহণ করেছে? উত্তরে জওহরলাল বলেন যে, কংগ্রেস ‘কোনও রকমের চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে এবং যখন যেরকম অবস্থার সৃষ্টি হবে তার মোকাবিলা করার স্বাধীনতা নিয়ে’ গণপরিষদে যোগদান করবে। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা রদবদল হতে পারে? জওহরলাল দ্ব্যর্থহীনভাবে উত্তর দেন, কংগ্রেস কেবল গণপরিষদে যোগ দিতে রাজি হয়েছে এবং প্রয়োজনবোধে নিজেদের অভিরুচি অনুযায়ী ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পরিবর্তন বা রদবদল করার স্বাধীনতা তাদের আছে।” ওই সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু আরও বললেন, “সমস্যাটিকে যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন, গ্রুপ গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। গ্রুপ ‘এ’ অর্থাৎ হিন্দুরা গ্রুপ গঠনের বিরোধিতা করবে। খুব জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পক্ষে গ্রুপ সমর্থন করার সম্ভাবনা আদৌ নেই। এর অর্থ হল গ্রুপ ‘বি ধসে যাবে। বাংলা এবং আসামেও গ্রুপ গঠনের বিরোধিতা করার সম্ভাবনা বেশি।”

    কংগ্রেস যে মিশনের পরিকল্পনাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বদলানোর চেষ্টা করতে পারে, লর্ড ওয়াভেল নেহরুর এই ঘোষণার আগেই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ভারত-সচিব পেথিক লরেন্সকে এক চিঠিতে তিনি জানান — “The strong reaction by Gandhi to my suggestion that Congress should make their assurance about the grouping categorically shows how well justified Jinnah was to doubt their previous assurances on the subject. It is to my mind convincing evidence that Congress always meant to use their position in the interim Government to break up the Muslim League and in the Constituent Assembly to destroy the grouping scheme which was the one effective safeguard for the Muslims”। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ অবশ্য সদ্য নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতির এই হঠকারী মন্তব্যকে লঘু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন।

    কিন্তু তাঁদের এই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর চেষ্টা আদৌ ফলদায়ক হল না। জিন্না স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ব্রিটিশ দেশে থাকাকালীনই এবং হাতে ক্ষমতা আসার আগেই কংগ্রেস যদি তাদের সিদ্ধান্ত এতবার বদলাতে পারে, তবে ব্রিটিশ দেশত্যাগ করলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য অধিকার যে ভবিষ্যতে কংগ্রেসের হাতে নিরাপদ থাকবে তার নিশ্চয়তা কোনও ভাবেই নেই। নেহরুর মন্তব্যের অব্যবহিত পরেই লিগ কাউন্সিলের সভায় এ বিষয়ে জিন্না বিবৃতি জারি করে বললেন, “ … the Muslim League Council had accepted the Cabinet Mission Plan in Delhi as it was assured that the Congress had also accepted the scheme and that the Plan would be the basis of the future constitution of India. Now that the Congress President had declared that the Congress could change the scheme through its majority in the Constituent Assembly, this would mean that the minorities were placed at the mercy of the majority”।

    এর পাল্টা চাল হিসাবে জিন্না লিগ নেতৃবৃন্দর সঙ্গে ২৭ জুলাই বোম্বেতে এক সভায় মিলিত হলেন। তিন দিন আলোচনার পরে লিগ ২৯ জুলাই এই পরিকল্পনা থেকে প্রাথমিক স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিল। লিগের পক্ষে একমাত্র পন্থা হিসেবে পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে ১৬ অগস্ট থেকে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দিয়ে জিন্না বললেন — “What we have done today is the most historic act in our history. This day we bid good-bye to constitutional methods. Throughout ... the British and the Congress held a pistol in their hand, the one of authority and arms and the other of mass struggle and non-cooperarion. Today we have also forged a pistol and we are in a position to use it”। অবিভক্ত ভারতবর্ষের জলাঞ্জলিপর্ব প্রত্যক্ষ করে পরে আজাদ হাহাকারের সুরে বলবেন: “আমি যা সবচেয়ে ভালো ও সঙ্গত মনে করেছিলাম সেইভাবেই কাজ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি দেখে আমার মনে হয় আমি হয়ত ভুল মনে করেছিলাম এবং যাঁরা আমাকেই অন্তত আরও এক বছর সভাপতি হিসেবে থাকার অনুরোধ করেছিলেন তাঁরাই হয়ত সঠিক ছিলেন।” কিন্তু হায়, তত দিনে ক্ষতির খতিয়ান পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেছে।

    অবশেষে ১৬ অগস্ট সারা দেশে তাঁদের প্রস্তাব ব্যাখ্যা করার জন্য লিগ সভার আহ্বান করল। ভারতবর্ষের সর্বত্র ওই দিন শান্তিপূর্ণভাবে সভা সমাপ্ত হলেও সবচেয়ে হিংসাত্মক ঘটনাটি ঘটল কলকাতার বুকে। লিগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও প্রশ্রয়ে সকাল ৭টা থেকে মানিকতলা এলাকায় দাঙ্গা শুরু হয়ে দিনের বাকি সময়ে তা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মুসলমান এবং পরে হিন্দু ও শিখরা সংগঠিতভাবে আক্রমণ শুরু করলে যে পুরোদস্তুর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হল, তা থামল তিন দিন পরে। কেবলমাত্র মুসলমানরাই যে সশস্ত্র ছিলেন না, হিন্দুদের তরফেও যে এই দিন দাঙ্গা করার পরিকল্পনা বহু আগেই থেকেই ছিল – তার সমর্থন মেলে ইতিহাসবিদ স্যার ফ্রান্সিস টাকারের মন্তব্যে। তিনি এই বিষয়ে লিখেছেন, ওই দিন “buses and taxis were charging about loaded with Sikhs and Hindus armed with swords, iron bars and firearms”। দাঙ্গায় মৃত্যুর খতিয়ান দিতে গিয়ে লর্ড ওয়াভেল ২১ অগস্ট লেখেন — “At any rate, whatever the causes of the outbreak, when it started, the Hindus and Sikhs were every bit as fierce as the Muslims. The present estimate is that appreciably more Muslims were killed than the Hindus”। একই কথার পুনরাবৃত্তি করে একই দিনে প্যাটেল চিঠিতে রাজাগোপালাচারিকে জানান: “This [the Calcutta killing] will be a good lesson for the League, because I hear that the proportion of Muslims who have suffered death is much larger”।

    পরবর্তীকালে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ১ সেপ্টেম্বর বোম্বাই ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল নোয়াখালি (১০ অক্টোবর), বিহার (২৫ অক্টোবর) এবং উত্তরপ্রদেশের গড়মুক্তেশ্বরে (নভেম্বরে)। পরের বছর ২ মার্চ পাঞ্জাবের হিজির হায়াত খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই দাঙ্গার আগুন গোটা পাঞ্জাবকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। দেশবিভাগ যে কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। যে কলকাতা দাঙ্গায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অধিক সংখ্যায় মৃত্যু প্যাটেলের উল্লাসের কারণ হয়েছিল, সেই কলকাতা দাঙ্গাই আজাদের কাছে গভীর বিষাদের কারণ হয়ে ওঠে। আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন — “১৬ই অগস্ট দিনটি শুধু কলকাতার জন্য কালো দিন নয়, সারা ভারতের জন্যও কালো দিন। ঘটনাবলি যেভাবে মোড় নিয়েছিল, তাতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে সম্মতির ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রত্যাশা প্রায় অসম্ভব ছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটা এক অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মুসলিম লিগকে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের সুযোগ দেওয়ার ফলেই এইরকম অনিবার্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। মি. জিন্না এই ভুলের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন এবং লিগের তরফে দেওয়া মিশন পরিকল্পনার স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।” আজাদ এই বিষয়ে জওহরলালকে দায়ী করলেও বড়লাট ওয়াভেল সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের একতরফা ক্ষমতা লাভের বাসনাকে অভিযুক্ত করে বলেছেন – গোটা দাঙ্গাটাই সংঘটিত হয়েছিল ‘as an excuse to go ahead with the transfer of power to a Congress-only cabinet’।

    পরবর্তী ও শেষ কিস্তি আগামী সপ্তাহে ...

    লিঙ্ক - https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

    দশম পর্ব : দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি


    কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে, ১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই, বড়লাট ওয়াভেল কংগ্রেস থেকে ৬ জন, লিগ থেকে ৫ জন ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩ জন-সহ মোট ১৪ জন সদস্যকে নিয়ে এক ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ গঠনের জন্য নেহরু ও জিন্নাকে আহ্বান জানালেও কংগ্রেস পরের দিনই এবং জিন্না ৩১ তারিখে সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। কিন্তু দেশ জুড়ে কলকাতা দাঙ্গার রেশ মেলানোর আগেই ২৪ অগস্ট বড়লাট ঘোষণা করলেন যে, আগামী ২ সেপ্টেম্বর নেহরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যভার গ্রহণ করবে। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতৃবর্গ ‘Muslim League may come or not. That would make no difference. The caravan will move on’ জানিয়ে জওহরলাল, প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাজাগোপালাচারি, শরৎ বসু ও জগজীবন রামকে তাদের সদস্য হিসেবে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করল। মুসলমান সদস্য হিসেবে আসফ আলি, সাফাৎ আহমেদ খান ও সৈয়দ আলি জাহির এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে শিখ সর্দার বলদেব সিং, পার্সি সি এইচ ভাবা ও ভারতীয় খ্রিস্টান জন মাথাই এই সরকারে তাঁদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বাকি দুই মুসলমান সদস্যের পদ ফাঁকাই থাকল। ২৩ জুলাই যে কংগ্রেস ওয়াভেলের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, মাত্র দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সেই কংগ্রেসেরই একতরফা শাসনক্ষমতা পেতে দেখে জিন্না শঙ্কিত বোধ করলেন। কেবলমাত্র একদলীয় সরকার হওয়ায় লিগ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে শুরু করল।

    সরকার শুরু হওয়ার পক্ষকাল যেতে না যেতেই ওয়াভেল বুঝতে পারলেন যে, লিগের অংশগ্রহণ ব্যতীত এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। ফলে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত জিন্নার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করার পরে বড়লাট লিগকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে রাজি করালেন। অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করার আগে মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করার যে সিদ্ধান্ত লিগ ২৯ জুলাই গ্রহণ করেছিল, ওয়াভেল সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানালেও জিন্না সেই অনুরোধ মানলেন না। ওয়াভেলও লিগের সদস্যদের সরকারে পাওয়ার আগ্রহে সেই নিয়ে জোরাজুরি করলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদে যোগদান করার প্রতিশ্রুতি না দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারে লিগ তাদের আসন করে নিল। অবশেষে ২৬ অক্টোবর লিগের ৫ জন সদস্য – লিয়াকত আলি, গজনফর আলি, ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগর, আব্দুর রব নিস্তার ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে শরৎ বসু, সাফাৎ আহমেদ খান ও সৈয়দ আলি জাহির পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। যদিও জিন্না নিজে নেহরুর অধীনে সরকারে কাজ করতে রাজি হলেন না। বরং ওয়াভেলের অনুরোধে সরকারে যোগদান করে জিন্না এই কথা পরোক্ষে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন যে, তিনি ও লিগ কোনও ভাবেই নেহরুর নেতৃত্বকে মেনে নিতে বাধ্য নন।

    কিন্তু কংগ্রেস যে প্রকৃতপক্ষেই ক্ষমতাকে একতরফাভাবে কুক্ষিগত করতে চায়, তা আরও একবার স্পষ্ট হল অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রক বন্টনকে কেন্দ্র করে। আজাদ লিখছেন, “দফতর বণ্টনের বিষয়ে লর্ড ওয়াভেল প্রস্তাব করেন যে, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলোর একটি লিগকে দেওয়া উচিত। তাঁর নিজের প্রস্তাব ছিল লিগকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ... কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র বিভাগটি নতুন পরিকল্পনায় তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল না। আমি তাই লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু সর্দার প্যাটেল এ ব্যাপারে একগুঁয়ে মনোভাব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, আমরা যদি তাঁকে স্বরাষ্ট্র বিভাগ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে জোরাজুরি করি, তাহলে তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে যাবেন। আমরা তখন অন্যান্য বিকল্প সম্বন্ধে বিবেচনা শুরু করলাম। রফি আহমেদ কিদোয়াই অর্থবিভাগটি মুসলিম লিগকে প্রদানের প্রস্তাব দেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, কিন্তু বিভাগটি চালাতে হলে বিশেষ ধরণের টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকা দরকার। লিগ প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্থবিভাগ পরিচালনা করবার মতো কেউ ছিলেন না। কিদোয়াই ভেবেছিলেন, লিগ হয়তো এই কারণেই অর্থবিভাগের দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করবে। যদি এমন ঘটে, তাহলে কংগ্রেসের কোনও ক্ষতি নেই। অন্যদিকে যদি কোনও লিগ সদস্য অর্থবিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে খুব তাড়াতাড়িই তিনি নিজেকে মূর্খ প্রমাণ করবেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন দু’দিক থেকেই কংগ্রেস লাভবান হবে। সর্দার প্যাটেল এই প্রস্তাবটি শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর চূড়ান্ত সমর্থন দিয়েছিলেন। আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে অর্থ দফতর হল সরকারের মূল চাবিকাঠি, এবং তা যদি লিগের অধীনে যায় তাহলে আমাদের নানা অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে। সর্দার প্যাটেল প্রতিবাদ করে বলেন, লিগ কিছুতেই অর্থবিভাগ চালাতে পারবে না এবং তারা এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। আমি এ সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারিনি, কিন্তু যেহেতু অন্য সকলে একমত [এই প্রস্তাবে] হয়েছিলেন, আমি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।”

    অবশেষে কংগ্রেসের তরফে লিগকে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা ওয়াভেলকে জানিয়ে দেওয়া হল। বড়লাট সেই সিদ্ধান্তের কথা জিন্নাকে জানালে তিনি পরের দিন এ বিষয়ে লিগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ওয়াভেলকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। আসলে অর্থবিভাগের গুরুদায়িত্ব নিয়ে লিয়াকত আলি সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারবেন কি না, সেই বিষয়ে জিন্না সন্দিহান ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন অর্থবিভাগেরই চৌধুরী মহম্মদ আলি (যিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। মহম্মদ আলি জিন্নাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, এই বিভাগের ভার লিগের হাতে থাকলে সরকারের প্রতিটা বিভাগের ওপরেই লিগ তার কর্তৃত্ব খাটাতে পারবে। এ বিষয়ে তিনি নিজে লিয়াকত আলিকে পূর্ণ সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলে জিন্না তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলেন, অর্থবিভাগের দায়িত্ব নিলেন লিয়াকত আলি।

    দেশে তখন একের পর এক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনাবলির অসহায় দর্শক। বাংলায় হিন্দু-পীড়ন বন্ধ করার জন্য প্যাটেল সেখানকার লিগ মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। যদিও বিহারের কংগ্রেস-প্রশাসন সম্পর্কে তিনি নীরব রইলেন। শুধু তা-ই নয়, ১১ নভেম্বর রাজেন্দ্রপ্রসাদকে তিনি জানালেন: “We would be committing a grave mistake if we expose the people of Bihar and their ministry to the violent and vulgar attacks of the League leaders”। গান্ধী তখন ক্ষমতার খেয়োখেয়ি থেকে বহু দূরে নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তখনও তাঁর মনে প্রবল আশা, তাঁর বহুকথিত ‘ঈশ্বর’ দৈব উপায়ে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত হওয়া থেকে উদ্ধার করবেন।

    আজাদ হিন্দ সেনানীদের বিষয়ে প্রকৃত মনোভাবে কংগ্রেসের আসল রূপ আরও একবার পরিস্ফুট হল। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলের মধ্যেই আজাদ হিন্দের অফিসাররা জেল থেকে ছাড়া পেলেও তখনও অবধি বেশ কিছু আজাদি সেনা জেলে বন্দি ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার পরে জেলবন্দী ফৌজ সেনানীদের মুক্তি এবং বকেয়া বেতনের বিষয়ে কংগ্রেস ওয়াভেলের সঙ্গে কোনও রকম সংঘর্ষে যেতে অস্বীকার করল। মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসলে নেহরু মাউন্টব্যাটেন এবং অচিনলেকের সঙ্গে একযোগে ফেডারাল কোর্টের বিচারাধীন বিষয় হিসেবে এটিকে পাঠিয়ে দিয়ে এ সম্পর্কিত বিতর্কের অবসান ঘটালেন। সরকারিভাবে ঘোষণা থাকলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় সেনাতে ফৌজের সেনাদের অন্তর্ভুক্তি না হওয়ার বিষয়টিই স্পষ্ট করে দিল যে, নির্বাচনপর্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছিল নিছকই কংগ্রেসের ইলেকশন ইস্যু।

    সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে ব্যর্থতা ও আজাদ হিন্দের সেনাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে উদাসীনতার পাশাপাশি গণ্ডগোল বাধল আসামের বাধ্যতামূলক বিন্যাসকে কেন্দ্র করে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর প্রতিনিধি হিসেবে আসাম কংগ্রেসের মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী এবং বিজয়চন্দ্র ভাগবত ১৫ ডিসেম্বর গান্ধীর পরামর্শ নিতে হাজির হলেন শ্রীরামপুরে। গান্ধী তাঁদের বাংলার সঙ্গে এক বিভাগে যোগ দিতে বারণ করলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বললেন, “I told Bardoloi that if there is no clear guidance from the Congress Committee, Assam should not go into the Sections. It should lodge its protest and retire from the Constituent Assembly. It will be a kind of satyagraha against the Congress for the good of the Congress. … As soon as the time comes for the Constituent Assembly to go into Sections you will say, “Gentlemen, Assam retires.” For the independence of India it is the only condition. Each unit must be able to decide and act for itself. I am hoping that in this Assam will lead the way (CWMG, ৯৩/১৪২-১৪৩)। ক্যাবিনেট মিশন বিরোধিতার রাস্তা দেখালেন গান্ধী, যে রাস্তা ধরে পরে অগ্রসর হবেন কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতা। এবং এই ফাঁকেই সীমান্ত গান্ধী বাদশা খাঁ অভিযোগ করবেন, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সীমান্তবাসীদের জন্য কোনও সাহায্য না করলেও আসামের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন।

    এদিকে কংগ্রেস যে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে, সে কথা পরের বছরের প্রথম দিকে আরও স্পষ্ট হল। প্যাটেল হাড়ে হাড়ে টের পেলেন, লিগকে অর্থবিভাগ ছেড়ে দেওয়ার ফলে লিয়াকত আলির অনুমতি ছাড়া তিনি একজন চাপরাশিকেও নিয়োগ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ইত্যবসরে চৌধুরী রহমত আলি, মালিক গুলাম মহম্মদ, জাহিদ হুসেন প্রমুখের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ১৯৪৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লিয়াকত আলি অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট পেশ করলেন। এই বাজেটে — ১) লবণের ওপরে কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হল; ২) চা-এর ওপরে রফতানি শুল্ক দ্বিগুণ করা হল; ৩) ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বার্ষিক এক লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপরে চাপানো হল ২৫% আয়কর এবং ৪) শুধু কর্পোরেট কর দ্বিগুণ করা হল তা-ই নয়, তাঁদের আর্থিক অনিয়মের তদন্ত করার জন্য ‘ইনকাম ট্যাক্স ইনভেস্টিগেশন কমিশন’ গঠনের কথাও বলা হল। খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘনশ্যামদাস বিড়লা, যমনালাল বাজাজ, হীরাচাঁদ ওয়ালচাঁদ-সহ হিন্দু শিল্পপতিরা এই বাজেটকে ‘Millionaire’s howls’ বলে অভিহিত করলেন এবং কংগ্রেস ফান্ডে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদেরকে সরাসরি চাপ দেওয়া শুরু করলেন।

    বিড়লা অ্যান্ড কোম্পানি খুব ভালো করেই জানতেন কংগ্রেস তাঁদের এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে। এই ঘটনার বহু আগে, ১৯৪২ সালের ৪ জুন লুই ফিশারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গান্ধী খোলাখুলি স্বীকার করেন যে, বোম্বাইয়ের মিলমালিকদের চাঁদা থেকেই কংগ্রেসের প্রায় পুরো বাজেটের অর্থ আসে । ফিশার যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন, “Doesn’t the fact that Congress gets its money from the moneyed interests affect Congress policies? Doesn’t it create a moral obligation?”, তার প্রত্যুত্তরে গান্ধী বলেন: “It creates a silent debt”। সেই ‘নীরব ঋণ’ শোধ করতে এবারে উদ্যোগী হলেন গান্ধীর ভাবশিষ্য প্যাটেল ও নেহরু। লিয়াকত আলি ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে বেছে হিন্দু শিল্পপতিদের বেকায়দায় ফেলতে চাইছেন – এই অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি মুসলিম লিগের সঙ্গে সরকার চালানো কোনও ভাবেই সম্ভব নয় বলে তাঁদের মনে হল। আজাদের কথায় — “কংগ্রেস কর্তৃক অর্থ দফতরটি লিগকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে এক সত্যিকারের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এর ফলে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন ধীরে ধীরে ভারত বিভাজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর উদ্দ্যেশ্যে কংগ্রেসকে ভারত বিভাজনের অবশ্যম্ভাবিতার কথা বলতে শুরু করলেন, এবং মন্ত্রিসভার কংগ্রেস সদস্যদের মনে সেই ধারণার বীজ বপন করলেন।”

    যদিও মৌলানা আজাদ এবং গান্ধীর অগোচরে নেহরু-প্যাটেল জুটি দেশবিভাগজনিত বীজ বপনের কাজটি শুরু করেছিলেন মাউন্টব্যাটেন এ দেশে পা রাখার আগে থেকেই। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি বিটিশ পার্লামেন্টে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’-এর ঘোষণা করার তিন দিন আগেই অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি (লিয়াকত আলির বাজেট পেশ হওয়ার মাত্র ১১ দিন আগে) প্যাটেল ওয়াভেলকে জানালেন যে, ‘he was quite prepared to let the Muslims have the Western Punjab, and Sind and NWFP if they wished to join, and Eastern Bengal’। একই ভাবে নেহরুও ২০ ফেব্রুয়ারি (লিয়াকত আলির বাজেট পেশ হওয়ার মাত্র ৮ দিন আগে) এক বক্তৃতায় বললেন যে, লিগ চাইলে পাকিস্তানে যেতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষের কোনও অংশ পাকিস্তানে না যেতে চাইলে সেই অংশকে তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। বোঝা গেল, লিয়াকত আলির বাজেট কংগ্রেসের কাছে দেশবিভাগের নিছকই এক বাহানা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

    আর মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসার প্রায় তিন সপ্তাহ আগে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে খোলাখুলিভাবে পাঞ্জাব বিভাজন ও বাংলা ভাগ করার ইঙ্গিতের প্রস্তাব এমন দিনে (৫ মার্চ) পাশ করিয়ে নেওয়া হল, যেদিন গান্ধী বিহারে তাঁর শান্তি মিশনে দিনযাপন করছেন আর আজাদ অসুস্থ অবস্থায় গৃহবন্দি। এমনকি প্রস্তাবটি ওয়ার্কিং কমিটিতে পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও গান্ধীর কাছে এই বিষয়ে যাবতীয় সংবাদ সচেতনভাবেই গোপন করে রাখা হয়েছিল। প্রস্তাবটি জানাজানি হওয়ার পরে গান্ধী এ ব্যাপারে নেহরু ও প্যাটেলকে জবাবদিহির জন্য লিখেছিলেন এবং তিনি যে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সে কথাও জানিয়ে দিতে ভোলেননি। কিন্তু তাঁর সম্মতির ব্যাপারে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কোনও রকম গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। এহ বাহ্য, ১৯৪৭ সালের ১০ মার্চ নেহরুও প্যাটেলের মতোই বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজনের প্রস্তাব দিয়ে ওয়াভেলকে জানালেন, “যদিও রূপায়িত করতে পারলে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাই সবচেয়ে ভালো সমাধান ছিল — এ ছাড়া বাংলা ও পাঞ্জাবের ব্যবচ্ছেদই একমাত্র বাস্তব বিকল্প।” নেহরুর জীবনীকার সর্বেপল্লী গোপাল এ বিষয়ে লিখেছেন: “Even before Mountbatten came to India, both British Government and the Congress Party (Nehru) had come round to the view that there was no alternative to accepting Jinnah’s demand in some form or the other”।

    এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ভারতীয়দের কাছে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’-এর ঘোষণা করলেন এবং ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে এর সময়সীমা বেঁধে দিলেন। পাশাপাশি, হঠাৎই ওয়াভেলকে সরিয়ে ভারতের বড়লাট হিসেবে মাউন্টব্যাটেনকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। মাউন্টব্যাটেন যে মূলত দেশকে দু’টুকরো করার জন্যই ভারতে এসেছিলেন এবং এই ঘোষণার পেছনে যে কংগ্রেস বিশেষত নেহরুর প্রত্যক্ষ মদত ছিল, তা জনমানসে স্পষ্ট হল বহুদিন পরে। দোমিনিক লাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কৃষ্ণ মেনন তাঁদের একজনের কাছে স্বীকার করেছিলেন – তিনি স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে বুঝিয়েছিলেন ওয়াভেল বড়লাট হয়ে থাকলে ভারতের হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হবে না এবং তিনি ওয়াভেলের বদলে জওহরলাল মাউন্টব্যাটেনকে পছন্দ করেন বলে জানিয়েছিলেন।

    লেখকদ্বয় এ বিষয়ে বইটির অষ্টম পৃষ্ঠার পাদটীকায় লিখেছেন — “Although Mountbatten didn’t know it, the idea of sending him to India had been suggested to Attlee by the man at the prime Minister’s side, his Chancellor of the Exchequer, Sir Stafford Cripps. It had come up at a secret conversation in London in December, between Cripps and Krishna Menon, an outspoken Indian left-winger and intimate of the Congress leader Jawaharlal Nehru. Menon had suggested to Cripps and Nehru that Congress saw little hope of progress in India so long as Wavell was Viceroy. In response to a query from the British leader, he had advanced the name of a man Nehru held in the highest regard, Louis Mountbatten. Aware that Mountbatten’s usefulness would be destroyed if India’s Moslem leaders learned of the genesis of his appointment the two men had agreed to reveal the details of their talk to no one. Menon revealed the details of his conversation with Cripps in a series of conversations with one of the authors in New Delhi in February1973, a year before his death”।

    মাউন্টব্যাটেন ২২ মার্চ দিল্লি এসে পৌঁছলেন এবং ২৪ তারিখে ভারতবর্ষের ৩৪তম এবং শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত সমস্যার কাজে সফল হওয়ার উদ্দেশ্যে মাউন্টব্যাটেন সবার আগে অহংবোধে আঘাত লাগা প্যাটেলকে তাঁর মতের পক্ষে আনার ক্ষেত্রে সফল হলেন। আজাদের বয়ান অনুযায়ী — “When Lord Mountbatten suggested that partition might offer a solution for the present difficulty, he found ready acceptance of the idea in Sardar Patel’s mind. He was convinced that he could not work with the Muslim League. He openly said that he was prepared to let the League have a part of India if only he could get rid of it”। তার পরেই তিনি ঝুঁকলেন জওহরলালের দিকে। ঘটনা পরম্পরায় বিস্মিত আজাদ লক্ষ্য করলেন: “লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসার এক মাসের মধ্যেই দেশবিভাগের প্রবল বিরোধী জওহরলাল, এই প্রস্তাবটিকে সরাসরি সমর্থন না করলেও নস্যাৎ করছেন না।” আর এক কদম এগিয়ে কংগ্রেস সভাপতি কৃপালনী মাউন্টব্যাটেনকে জানালেন, “একটা যুদ্ধের চেয়ে আমরা বরং ওদের পাকিস্তান ওদেরই ছেড়ে দেব, যদি উচিতভাবে বাংলা ও পাঞ্জাবের ব্যবচ্ছেদে আপনি রাজি হন।” পুরো ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ আজাদ দেশভাগের প্রধানতম হোতা হিসেবে প্যাটেলকে অভিযুক্ত করে আত্মজীবনীতে বলেছেন যে — “It must be placed on record that the man in India who first fell for Lord Mountbatten’s idea was Sardar Patel. Till perhaps the very end Pakistan was for Jinnah a bargaining counter, but in fighting for Pakistan, he had overreached himself. The situation within the Executive Council had so annoyed and irritated Sardar Patel that he now became a believer in partition”।

    এই পরিস্থিতিতে আজাদ যে কোনও মূল্যে দেশভাগ আটকাতে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গান্ধীর শরণাপন্ন হলেন। পাটনা থেকে ৩১ মার্চ গান্ধী দিল্লি এসে পৌঁছলে তাঁকে পুরো পরিস্থিতির বিবরণ দিলেন আজাদ। প্যাটেল এমনকি নেহরুও যে মাউন্টব্যাটেনের দেশবিভাগের হুমকির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করেছেন, সে বিষয়ে অবহিত হওয়ার পরে দেশ বিভাজনের প্রশ্নে আজাদ গান্ধীর মতেই অটল আছেন কি না জিজ্ঞাসা করলেন। আজাদ তাঁকে নিজের মনোভাবের কথা জানিয়ে অনুরোধ করলেন, “If you stand against partition, we may yet save the situation. If you however acquiesce, I am afraid India is lost।” প্রত্যুত্তরে গান্ধী দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করলেন — “If the Congress wishes to accept partition, it will be over my dead body. So long as I am alive, I will never agree to the partition of India. Nor will I, if I can help it, allow Congress to accept it”।

    আজাদের গান্ধীকে নিয়ে শেষ আশা দ্রুত ভঙ্গ হল। তিনি লিখছেন: “ওই দিনই [৩১ মার্চ] বিকেলবেলায় গান্ধীজি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করলেন। পরের দিন এবং ২ এপ্রিলও তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি প্রথম দিন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করে ফিরতেই সর্দার প্যাটেল তাঁর কাছে আসলেন এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষে দু’ঘন্টার ওপরে আলোচনা করলেন। সেদিন তাঁদের ভেতরে কী আলোচনা হয়েছিল তা আমি জানি না। কিন্তু আমি যখন পুনরায় তাঁর সঙ্গে দেখা করি, তখন তাঁর কথা শুনে যেমন আঘাত পেয়েছিলাম তেমন আঘাত জীবনে আর কোনও দিন পাইনি। আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি তিনি তাঁর পূর্ব অভিমত পরিবর্তন করেছেন। যদিও তিনি খোলাখুলিভাবে দেশবিভাগের পক্ষে কথা বললেন না, কিন্তু আগের মতো এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদও করলেন না।”

    যাই হোক, ভারতবর্ষকে অখণ্ড রাখতে মরিয়া গান্ধী শেষ চেষ্টা হিসেবে মাউন্টব্যাটেনের কাছে ৫ এপ্রিল জিন্নাকেই সর্বপ্রথম অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার সুযোগ দেওয়ার কথা বললেন। মাউন্টব্যাটেন সেই প্রস্তাবে গররাজি না হলেও নেহরু-প্যাটেল জুটি গান্ধীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করলেন। অসহায় গান্ধী পরাজয় মেনে নিয়ে বললেন — “Whatever the Congress decides will be done; nothing will be according to what I say. My writ runs no more. If it did the tragedies in the Punjab, Bihar and Noakhali would not have happened. No one listens to me any more. I am a small man. True, there was a time when mine was a big voice. Then everyone obeyed what I said; now neither the Congress nor the Hindus nor the Muslims listen to me” (CWMG, ৯৪/২১৬-১৭)। হায় গান্ধী! তিনি উপমহাদেশে এক বিরামহীন সংঘর্ষের আবহ রচিত হতে চলেছে তা বুঝতে পারছেন, কিন্তু তত দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তাঁর অবস্থা তখন মহাভারতের মুষলপর্বের কৃষ্ণের মতো, যিনি চোখের সামনে যদুবংশের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হবেন।

    বস্তুতপক্ষে মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে আসার সময়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আর গড়িমসি করার অবকাশ নেই। কারণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে ভারতবর্ষে যে ঘটনাপ্রবাহ চলছিল, মাউন্টব্যাটেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। লন্ডনে থাকাকালীনই তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে ১৮ মার্চ অ্যাটলি মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “হিজ ম্যাজেস্টিস গভর্নমেন্টের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হল, যদি সম্ভব হয় তবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে, মন্ত্রীমিশনের পরিকল্পনা অনুসরণ করে গঠিত এবং পরিচালিত গণপরিষদের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতবর্ষ ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র গঠন করা”। আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে মাউন্টব্যাটেনকে তাঁর নিজস্ব অভিমত সমন্বিত একটি রিপোর্ট, যার ভিত্তিতে ভারতবর্ষের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, ইংল্যান্ডে জমা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।

    মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে আসার মাত্র চার দিন পরে ২৮ মার্চ ভারত সরকারের রিফর্ম কমিশনার ভি পি মেনন তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানালেন যে, জিন্না খণ্ডিত পাকিস্তান নিতেও প্রস্তুত। মেনন লিখেছেন — “তাঁর আগমনের মাত্র চার দিন পরেই আমি বুঝতে পারি যে তিনি কীভাবে কাজ করবেন তা স্থির করে ফেলেছেন এবং মনে মনে তিনি একটি সমাধানও ভেবে রেখেছেন। আমি তাঁকে বলি, আমার ধারণায় জিন্না এবং মুসলিম লিগ একটি কেন্দ্রীয় সরকারে যাওয়ার চেয়ে একটি খণ্ডিত পাকিস্তান পেতেও ইচ্ছা করবেন। আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিই যে তিনি ভারতবর্ষে পূর্ণ ক্ষমতা এবং অধিকার নিয়ে এসেছেন এবং দলগুলি যদি কাছাকাছি না আসতে পারে তবে হিজ এক্সেলেন্সিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত কোনও দলেরই মনোমত না হতে পারে।”

    মেনন আরও জানিয়েছেন যে, ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে কিংবা পরের বছরের জানুয়ারির গোড়ার দিকে অর্থাৎ ওয়াভেলের আমলেই তাঁর মনে এক নতুন পরিকল্পনার উদয় হয়েছিল। তিনি সেই বিষয়টি নিয়ে প্যাটেলের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলোচনা করে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর প্রস্তাবটি প্যাটেলের মনঃপূত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস যাতে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে – সে ব্যাপারে প্যাটেল বিশেষভাবে নিজের প্রভাব খাটাবেন বলেও মেননকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্যাটেলের কাছে আশ্বাস পেয়ে মেনন এই প্রস্তাবের খসড়াটি বিবেচনার জন্য তদানীন্তন ভারত সচিব পেথিক লরেন্সের কাছে পাঠান। যদিও প্যাটেলের মনঃপূত হওয়ার বিষয়টি মেনন গোপন রাখায় ব্রিটিশ সরকার সেভাবে রকম গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাবটি বিবেচনা করেনি। অবশ্য মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসার আগেই লন্ডনে এই খসড়াটি দেখেছিলেন বলে মেননের কাছে কবুল করেছিলেন।

    এইবারে আসরে নামলেন মাউন্টব্যাটেন। মেননের এই প্রস্তাবকে ভিত্তি করে ১০ এপ্রিল দিল্লিতে একটি স্টাফ মিটিং-এ তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি খসড়া (যার সঙ্গে মেনন যুক্ত ছিলেন না) পেশ করলেন। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল খসড়াটির নানা দিক সম্পর্কে প্রাদেশিক গভর্নরদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পরে তিনি এ ব্যাপারে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত মত জানাবার জন্য ২ মে খসড়াটি ইজমে ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিব জর্জ আবেলকে লন্ডনে পাঠালেন। ১০ মে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা মাউন্টব্যাটেনের খসড়াটি কিছু সংশোধন ও সংযোজনের পরে অনুমোদন করল। এই ফাঁকে মাউন্টব্যাটেনের অনুমতি পেয়ে ৯ মে মেনন তাঁর প্রস্তাবটি সম্পর্কে নেহরুর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করলে নেহরুও প্যাটেলের মতোই পরিকল্পনাটি পছন্দ করলেন। কিন্তু ১০ মে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা অনুমোদিত মাউন্টব্যাটেনের খসড়ার বিরুদ্ধে নেহরু এবং জিন্না তীব্র আপত্তি জানালে মাউন্টব্যাটেন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।

    শেষ পর্যন্ত যে মেনন-রচিত পরিকল্পনাটিই সব পক্ষ মেনে নেবে, সে কথা বুঝে যাওয়ার পরে মাউন্টব্যাটেন স্বয়ং মেননকেই তাঁর পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি খসড়া প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ জানালেন। ১৬ মে মেনন তাঁর খসড়াটি ভাইসরয়ের কাছে জমা দিলে তা নেহরু, প্যাটেল, জিন্না, লিয়াকত আলি খান এবং বলদেব সিং প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অনুমোদিত হল। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সমস্ত কিছু চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য মাউন্টব্যাটেনকে অবিলম্বে লন্ডনে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ পাঠিয়েছিল। ১৮ মে মেননকে সঙ্গে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন এই খসড়া সহ লন্ডনে রওনা হলেন। ব্রিটিশ সরকারও কালবিলম্ব না করে এই নতুন পরিকল্পনাটি অনুমোদন করল।

    ৩১ মে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে নেহরু-প্যাটেল-কৃপালনী, জিন্না-লিয়াকত আলি-আব্দুর রব নিস্তার এবং বলদেব সিংকে ২ জুন এক সভায় মিলিত হতে আহ্বান করলেন মাউন্টব্যাটেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনাটি নেতাদের কাছে উপস্থাপিত করার পরে সকলকেই সেদিন মাঝরাতের মধ্যেই তাঁদের সম্মতি জানিয়ে দিতে বললেন। মাঝরাতের আগেই কৃপালনি কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে প্রস্তাবটির প্রতি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সমর্থন জানিয়ে চিঠি দিলেন। বলদেব সিং-ও শিখদের পক্ষ থেকে পরিকল্পনাটিকে সমর্থন করলেন। লিগের বাকি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পরে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বললেও শেষ পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেনের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে ‘a shadow and a husk, a maimed, mutilated and moth-eaten’ পাকিস্তানের ব্যাপারে রাজি হলেন জিন্নাও। পরের দিনই অর্থাৎ ৩ জুন তিন সম্প্রদায়ের তিন দলের তিনজন নেতা নেহরু জিন্না ও বলদেব সিং মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনাকে সমর্থন করে বেতারে ভাষণ দিলেন। নেহরু তাঁর বেতার ভাষণে বললেন: “I am convinced that our decision to divide India is the right one even from the larger point of view”। ওই একই দিনে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি একটি প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি জানালেন।

    মাউন্টব্যাটেন ভারতে পা দেওয়ার মাত্র ৯ সপ্তাহের মধ্যে দেশটাকে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন আমাদের মান্যবর নেতারা! আর গান্ধী? তিনি তখন নখদন্তহীন। এর আগেই তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে এবং তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়ে মাউন্টব্যাটেন গান্ধীকে অন্ধকার অনিশ্চিতের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন। তাই ১ জুন মনু গান্ধীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় গান্ধী জানালেন — “Today I find myself all alone. [Even the Sardar and Jawaharlal] think that my reading of the situation is wrong and peace is sure to return if partition is agreed upon. … They did not like my telling the Viceroy that even if there was to be partition, it should not be through British intervention or under the British rule. They wonder if I have not deteriorated with age. … We may not feel the full effect immediately, but I can see clearly that the future of independence gained at this price is going to be dark. ... I shall perhaps not be alive to witness it, but should the evil I apprehend overtake India and her independence be imperilled, let posterity know what agony this old man went through thinking of it. Let not the coming generation curse Gandhi for being a party to India’s vivisection. But everybody is today impatient for independence. Therefore there is no alternative. This is like eating wooden laddoos, if they eat it they die of colic; if they don’t they starve” (CWMG, ৯৫/১৮২-৮৩)।

    রাজমোহন গান্ধী এই দেশবিভাজনের কারণ হিসেবে একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে বলেছেন, “It is noteworthy that no one, whether from the Raj or an Indian side, directly asked Jinnah, in the presence of Gandhi or Nehru, whether he would give up a sovereign Pakistan if he received a ‘Pakistan zone’ composed of all the provinces he wanted, and noteworthy, likewise, that no one directly asked Gandhi or Nehru, in Jinnah’s presence, if Congress would let Assam and NWFP go to a ‘Pakistan zone’ if Jinnah yielded a sovereign Pakistan”। অথচ শুধুমাত্র কতিপয় মানুষের অহং, তীব্র ক্ষমতালিপ্সা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিণতি হিসেবে এই মর্মান্তিক দেশভাগের ফলে মারা গিয়েছিলেন ৬ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু। রাতারাতি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন দেড় কোটি মানুষ, যে ঘটনাকে রামমনোহর লোহিয়া ‘ probably the greatest migration, forced or willing, in all history’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এক রক্তপাতহীন ক্ষমতা হস্তান্তর আসলে পরবর্তীকালে রক্তস্নানে স্নাত করেছে ভারত ও পাকিস্তানের মাটিকে।

    এই বিভাজনের সিংহভাগ দায় যে নেহরু-প্যাটেল জুটির তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৫ জুন প্যাটেলকে লেখা বিড়লার চিঠিতে। সেখানে বিড়লা রীতিমতো উল্লসিত সুরে লিখছেন — “Your kind letter of 1 June is to hand. I am so glad to see from Viceroy’s announcement that things have turned out according to your desire. It is no doubt a very good thing for the Hindus and we will now be free from the communal canker. The partitioned area, of course, would be a Muslim State. … I am very happy that the Bengal Partition question has also been settled by you. The question of ministry would loom large in near future. ....Of the many candidates none is strong enough except Syama Prasad [Mookerjee] Babu”। আর একটি কারণ ব্যাখ্যা করে দেশবিভাগ হওয়ার ১৩ বছর পরে নেহরু স্বীকার করেছিলেন: “আসল কথা হল আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং আমাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই আবার জেলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে মেনে নিতে পারতেন। আমরা যা চেয়েছিলাম সেভাবেই যদি অবিভক্ত ভারতবর্ষের জন্য চেষ্টা চালাতাম তাহলে আমাদের জেলে যেতে হত। আমরা দেখেছিলাম পাঞ্জাবে আগুন জ্বলছে। প্রতিদিন হত্যার খবর আমাদের কানে আসছিল। দেশবিভাগের পরিকল্পনা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়েছিল এবং আমরা তা গ্রহণ করেছিলাম।”

    এহেন দুঃখজনক পরিস্থিতিতে ৩ জুন সরকারি বিবৃতি ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই দিল্লিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি দেশবিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নিলেও তা ছিল এআইসিসি-র অনুমোদনসাপেক্ষ। ১৬ জুন এআইসিসি-র অধিবেশন ডাকা হল। এআইসিসি-র বৈঠকে প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেন গোবিন্দবল্লভ পন্থ, সমর্থন করানো হল দেশবিভাগের ঘোর বিরোধী আজাদকে দিয়ে। আর অখণ্ড ভারতের স্বপ্নসাধক গান্ধীকে এই প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতা দিতে অনুরোধ করা হল। সেই অধিবেশনের মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়ে লোহিয়া লিখেছেন — “Barring us two [Jayprakash Narayan and Rammanohar Lohia] Mahatma Gandhi and Khan Abdul Ghaffar Khan, none spoke a single word in opposition to partition. … Messrs Nehru and Patel were offensively aggressive to Gandhiji at this meeting. I had a few sharp exchanges with both of them some of which I shall relate. What appeared to be astonishing then as now, though I can today understand it somewhat better, was the exceedingly rough behaviour of these two chosen disciples towards their master. There was something psychopathic about it. They seemed to have set their heart on something and, whenever they scented that Gandhiji was preparing to obstruct them, they barked violently”।

    যদিও সেদিনকার অধিবেশনের বক্তৃতায় অনুগত সৈনিকের মতো গান্ধী বলতে বাধ্য হলেন: “… Although the House had the right to accept or reject the Working Committee’s decision, they must remember that the Working Committee as their representative had accepted the plan and it was the duty of the AICC to stand by them…”। এর আগে একাধিকবার একক প্রচেষ্টায় ওয়ার্কিং কমিটির বা এআইসিসি-র গৃহীত সিদ্ধান্তকে পাল্টে ফেলার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন গান্ধী, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময়ে তিনি অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেন তাঁরই একান্ত অনুগত শিষ্যবৃন্দের কাছে।

    ওয়াভেল তাঁর ১০ জানুয়ারি এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির দিনলিপিতে লিখেছেন যে, তিনি জানতেন জিন্না যেভাবে ফুসফুসের যক্ষায় আক্রান্ত তাতে দু-তিন বছরের বেশি তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু রক্ষণশীল দলের অনুগত ওয়াভেল, শ্রমিক দলের মনোনীত ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে সে কথা প্রকাশ করেননি। জিন্নার মৃত্যু আসন্ন – এ কথা যদি মাউন্টব্যাটেন জানতেন, তাহলে হয়তো ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হত। আজাদও পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন — “ইতিহাস এটি স্বীকার করে নেবে যে লর্ড ওয়াভেলের নীতিকে মেনে নিয়ে তাঁর পরামর্শ মতো চললেই ভালো হত”। অন্যদিকে প্যাটেলও দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন যে পাকিস্তান গঠিত হলে সেটি বেশিদিন টিকবে না [“Pakistan would collapse in a short time and the provinces which had seceded from India would have to face untold difficulty and hardship”] এবং পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাবের কিছু অংশ, সিন্ধু ও বালুচিস্তানকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ভারতবর্ষ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করছে তা দেখতে পেলে বাকি অঞ্চলও অবশ্যই তার অন্তর্গত হতে চাইবে। কিন্তু ততদিনে কোটি কোটি ভারবাসীর স্বাধীনতা ও অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া সারা।

    পাশাপাশি যে আবরণে নিজেকে আবৃত করে এতদিন নিজের অধিকারের বিষয়ে লড়াই করে এসেছিলেন জিন্না, পাকিস্তান পাওয়ার সঙ্গেই সেই আবরণকে নস্যাৎ করে দিলেন তিনি। পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল মনোনীত হয়ে ১১ অগস্টের ভাষণে তিনি বললেন — “You are free to go to your temples, you are free to go to your mosques or to any other place of worship in this State of Pakistan. You may belong to any religion or caste or creed – that has nothing to do with the fundamental principle that we are all citizens of one State… Now, I think we should keep that in front of us as our ideal, and you will find that in course of time, Hindus would cease to be Hindus, and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual but in the political sense as citizens of the State”।

    তার পরের কাহিনি আর খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। প্যাটেল-মেনন জুটির হায়দ্রাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীর সহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যকে ভয় অথবা লোভ দেখিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা; পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জীবনে শেষবারের মতো গান্ধীর অনশন; দু’দেশ জুড়েই সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিণাম হিসেবে উদ্বাস্তুদের নিরবচ্ছিন্ন স্রোত; পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ জিইয়ে রাখা এবং সব শেষে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীর হাতে গান্ধীহত্যাতে এই দীর্ঘ কাহিনির সমাপ্তি।

    যেহেতু এই লেখার কেন্দ্রবিন্দুতে বিরাজ করেছেন গান্ধী, তাই সমাপ্তি হিসেবে তাঁর হত্যা বিষয়ে দু-চারটে কথা। গান্ধী তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিঃসঙ্গ বোধ করেছিলেন। তাঁর জনমোহিনী ক্ষমতার প্রথম বিলুপ্তি ঘটেছিল মুসলমানদের কাছে; পরে এক বিশাল সংখ্যক দলিত-প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ তাঁকে আর নিজেদের লোক হিসেবে ভাবতে পারেননি। জীবনের শেষ দিকে তাঁর নিজের হাতে তৈরি নেতারা তো তাঁকে আর গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেননি, এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুরুত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছিল। ২৯ মে তাঁর এক সহকর্মীকে গান্ধী বলেছিলেন: “I am being told to retire to the Himalayas. Everybody is eager to garland my photos and statues. Nobody really wants to follow my advice” (CWMG, ৯৫/১৬৬)। তাঁর হত্যার মাত্র মাসখানেক আগে ১৮ ডিসেম্বর তিনি লেখেন, “I know that today I irritate everyone. How can I believe that I alone am right and all others are wrong? What irks me is that people deceive me. They should tell me frankly that I have become old, that I am no longer of any use and that I should not be in their way. If they thus openly repudiate me I shall not be pained in the least” (CWMG, ৯৮/৭২)।

    আর তাঁর হত্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অরুণ গান্ধী লিখেছেন — “Both factions (fundamentalists and the Congress Party administration) realized they had one thing in common: the belief that a martyred Gandhi was better [for them] than a living Gandhi. They were convinced that he had to be assassinated. The fundamentalists engineered the assassination plot while the administration looked the other way”। নাথুরাম গডসে আসলে গান্ধীকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, আর তাঁকে হত্যা করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কুশীলবরা সুকৌশলে তাঁকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছেন সারা দুনিয়ায়। হায়! তাঁরা যদি ‘মহাত্মা’ সম্পর্কে স্মরণে রাখতেন গান্ধীর বাণীটি: “If one makes a fuss of eating and drinking and wears a langoti, one can easily acquire the title of Mahatma in this country”!!


    সহায়ক লেখাপত্র :
    ১. বিপান চন্দ্র ও অন্যান্য – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৮৫৭ -১৯৪৭
    ২. বিমলানন্দ শাসমল – ভারত কী করে ভাগ হলো
    ৩. ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – দেশবিভাগ : পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনী
    ৪. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী – ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ
    ৫. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – জিন্না : পাকিস্তান / নতুন ভাবনা
    ৬. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭
    ৭. Allen Hayes Merriam – Gandhi vs. Jinnah: The Debate over the Partition of India
    ৮. Louis Fischer – Mahatma Gandhi: His Life & Times
    ৯. Maulana Abul Kalam Azad – India Wins Freedom
    ১০. Rajmohan Gandhi – Understanding the Muslim Mind
    ১১. Rammanohar Lohia – Guilty Men of India’s Partition
    ১২. V.P. Menon – The Transfer of Power in India

    *************************************************************************************************
    প্রায় তিন মাস ধরে এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল। অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে ডেস্কটপ খটখটিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার শব্দ টাইপ করার পরে যদি একজন পাঠকেরও এ লেখা ভালো লাগে, তবেই এ লেখার সার্থকতা। যাঁরা পড়েছেন ও মন্তব্য করেছেন; যাঁরা পড়েছেন কিন্তু মন্তব্য করেননি, যাঁরা পড়েনও নি ও মন্তব্যও করেননি — তাঁদের প্রত্যেককেই আমার তরফ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    প্রতিশ্রুতিমতো লেখাটির শেষে একটি বিস্তারিত গ্রন্থতালিকা সংযোজিত করে দিলাম, যদিও সংগ্রহে থাকা সত্ত্বেও সব গ্রন্থের উল্লেখ করলাম না এখানে। তৃতীয় বন্ধনীতে প্রথম প্রকাশসালের উল্লেখ করা হল।


    সহায়ক লেখাপত্র :

    ১. এম এ মোহাইমেন – ইতিহাসের আলোকে দেশ বিভাগ ও কায়েদে আযম জিন্নাহ, ঢাকা : পাইওনিয়ার পাবলিকেশনস, ১৯৯৪
    ২. নরহরি কবিরাজ (সম্পাদিত) – অসমাপ্ত বিপ্লব, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, কলকাতা : কে পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, ২০০৭ [১৯৯৭]
    ৩. বিপান চন্দ্র ও অন্যান্য – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ১৮৫৭-১৯৪৭ (অনু. সুনীল মুখোপাধ্যায়), কলকাতা : কে পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, ২০১৪ [১৯৯৪]
    ৪. বিপান চন্দ্র, কপিল কুমার, মুশিরুল হাসান – কংগ্রেস নেহরু ও ভারতীয় মুসলমান, কলকাতা : সেরিবান, ২০১৬ [১৯৯৬]
    ৫. বিমলানন্দ শাসমল – ভারত কী করে ভাগ হলো, কলকাতা : হিন্দুস্থান বুক সার্ভিস, ১৯৯১
    ৬. ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – দেশবিভাগ: পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনী, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৮ [১৯৯৩]
    ৭. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী – ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৪ [১৯৯৯]
    ৮. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – জিন্না : পাকিস্তান / নতুন ভাবনা, কলকাতা : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৪২৪ [১৩৯৪]
    ৯. সৈয়দ শাহেদুল্লাহ – লেনিনবাদীর চোখে গান্ধীবাদ, কলকাতা : নবজাতক প্রকাশন, ১৯৭১
    ১০. সুপ্রকাশ রায় – গান্ধীবাদের স্বরূপ, কলকাতা : র্যা ডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১৫ [১৯৮৭]
    ১১. সুপ্রকাশ রায় – ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম (১৮৯৩-১৯৪৭), কলকাতা : র্যা ডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১৩ [১৯৫৫]
    ১২. সুভাষচন্দ্র বসু – সমগ্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, সম্পাদনা : শিশিরকুমার বসু, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., ১৯৮৩
    ১৩. সুমিত সরকার – আধুনিক ভারত : ১৮৮৫-১৯৪৭, কলকাতা : কে পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, ২০১৩ [১৯৯৩]
    ১৪. সুরজিৎ দাশগুপ্ত – সম্পর্কের ত্রিকোণ — রবীন্দ্রনাথ : সুভাষচন্দ্র জওহরলাল গান্ধী, কলকাতা : সিগনেট প্রেস, ২০১৭
    ১৫. কোরক, কলকাতা, শারদীয় ২০১৮ (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৮)
    ১৬. পরিচয়, কলকাতা, ৮৭ বর্ষ ১ম সংখ্যা, শারদ ১৪২৫ (জুলাই-অক্টোবর ২০১৮)
    ১৭. Allen Hayes Merriam – Gandhi vs. Jinnah: The Debate over the Partition of India, Calcutta: Minerva Associates (Publications) Pvt. Ltd., 1980
    ১৮. Arundhati Roy – ‘The Doctor and the Saint’ in S. Anand (ed.), Annihilation of Caste: The Annotated Critical Edition, New Delhi: Navayana, 2014
    ১৯. Ashwin Desai, Goolam Vahed – The South African Gandhi: Stretcher-Bearer of Empire, New Delhi: Navayana Publishing Pvt Ltd, 2015
    ২০. Ayesha Jalal – The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan, Cambridge: Cambridge University Press, 1985
    ২১. B. R. Ambedkar – Gandhi and Gandhism, New Delhi: Critical Quest, 2008
    ২২. B. R. Ambedkar – Mr. Gandhi and the Emancipation of the Untouchables, Jullandhar: Bheem Patrika Publications, 1943
    ২৩. B. R. Ambedkar – What Congress and Gandhi Have Done to the Untouchables, Bombay: Thacker & Co. Ltd, 1945
    ২৪. B. R. Nanda – Gandhi and His Critics, New Delhi: Oxford University Press, 1997
    ২৫. Bindu Puri – The Tagore-Gandhi Debate on Matters of Truth and Untruth, New Delhi: Springer, 2015
    ২৬. D. G. Tendulkar – Mahatma: Life of Mohandas Karamchand Gandhi, Vol. I to VIII, New Delhi: Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India, 1960
    ২৭. Dhananjay Keer – Dr. Ambedkar: Life and Mission, Bombay: Popular Prakashan, 1962 [1954]
    ২৮. Frank Moraes – Jawaharlal Nehru: A Biography, New York: The Macmillan Company, 1958
    ২৯. G. B. Singh – Gandhi: Behind the Mask of Divinity, New York: Prometheus Books, 2004
    ৩০. G. D. Birla – In the Shadow of the Mahatma: A Personal Memoir, Calcutta: Orient Longmans Ltd., 1953
    ৩১. George Paxton – Gandhi’s Wars, Article appeared in ‘Gandhi Marg’, Volume 39, Number 2 & 3, July-Sept & Oct-Dec 2017
    ৩২. Harold Coward (ed.) – Indian Critiques of Gandhi, New York: State Univeristy of New York, 2003
    ৩৩. Jawaharlal Nehru – A Bunch of Old Letters, Bombay: Asia Publishing House, 1958
    ৩৪. Joseph Lelyveld – Great Soul: Mahatma Gandhi and His Struggle with India, New York: Alfred A Knopf, 2011
    ৩৫. Leonard A. Gordon – Brothers Against the Raj, New Delhi: Rupa Publications India Pvt. Ltd., 2015 [1997]
    ৩৬. Louis Fischer – Mahatma Gandhi: His Life & Times, Mumbai: Bharatiya Vidya Bhavan
    ৩৭. M. K. Gandhi – Hind Swaraj or Indian Home Rule, Ahmedabad: Navajivan Publishing House, 1938
    ৩৮. M. K. Gandhi – Satyagraha in South Africa, Translated from Gujarati by Valji Govindji Desai, Ahmedabad: Navajivan Publishing House, 1993-94,
    ৩৯. Makarand R. Paranjape – ‘Natural Supernaturalism?’ The Tagore-Gandhi Debate on the Bihar Earthquake, The Journal of Hindu Studies, 2011, pp. 1-29
    ৪০. Maulana Abul Kalam Azad – India Wins Freedom (The Complete Version), Hyderabad: Orient BlackSwan, 2019 [1988]
    ৪১. Maybritt Jill Alpes – The Congress and the INA Trials, 1945-50: A Contest over the Perception of ‘Nationalist’ Politics, Studies in History, Volume 23, No.1, 2007
    ৪২. Nishikant Kolge – Was Gandhi a Racist? His Writings in South Africa, Economic & Political Weekly, Vol. LI No. 5, January 30, 2016, pp. 88-93
    ৪৩. Philip Sprat – Gandhism: An Analysis, Vol. I & II, Kolkata: Radiance, 2008
    ৪৪. R. L. Khipple (ed.) – Famous Letters of Mahatma Gandhi, Lahore: The Indian Printing Works, 1947
    ৪৫. R. Palme Dutt – India To-Day, Bombay: People’s Publishing House, 1947 [1940]
    ৪৬. Rajmohan Gandhi – Understanding the Muslim Mind, New Delhi: Penguin Books India, 2000 [1986]
    ৪৭. Rammanohar Lohia – Guilty Men of India’s Partition, Delhi: B R Publishing Corporation, 2017
    ৪৮. Rudrangshu Mukherjee – Nehru & Bose: Parallel Lives, Haryana: Penguin Random House India Pvt. Ltd., 2015
    ৪৯. S. Bhattacharya (compiled and ed.) – The Mahatma and the Poet: Letters and Debates between Gandhi and Tagore 1915-1941, New Delhi: National Book Trust, 2008 [1997]
    ৫০. S. S. Gill – Gandhi: A Sublime Failure, New Delhi: Rupa & Co, 2003 [2001]
    ৫১. Sarvepalli Gopal – Jawaharlal Nehru: A Biography, 3 Vols, New Delhi: Oxford University Press, 1989
    ৫২. Sheshrao Chavan – Mohammad Ali Jinnah: The Great Enigma, New Delhi: Authors Press, 2006
    ৫৩. Sibnarayan Ray (ed.) – Gandhi, India and the World: An International Symposium, Bombay: Nachiketa Publications Limited, 1970
    ৫৪. Stanley Wolpert – Jinnah of Pakistan, Delhi: Oxford University Press, 1985
    ৫৫. Subhas Chandra Bose – The Indian Struggle 1920-42, New Delhi: Oxford University Press, 1997
    ৫৬. Sumit Sarkar – Modern India: 1885-1947, New York: Palgrave Macmillan, 1989
    ৫৭. V.P. Menon – The Transfer of Power in India, Calcutta: Orient Longmans, 1957
    ৫৮. Vinay Lal – The Gandhi Everyone Loves to Hate, Economic & Political Weekly, October 4, 2008, pp. 55-64

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০১ অক্টোবর ২০১৯ | ২০৬১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একরামূল হক শেখ | ***:*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:৪৯51198
  • একটু খাপ ছাড়া পড়লেও, ''নবম পর্ব : গান্ধী ও জিন্না — দুই সমান্তরাল সরলরেখা '' পুরোটাই পড়লাম। মামুলি এক পাঠককে ট্যাগ করার জন্য ধন্যবাদ। দারুণ সব তথ্য, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সমৃদ্ধ করেছে। যদিও খলনায়ক-কে নায়ক করা অসাধ্য, তবে আপনার লেখা পড়ার পর জিন্নাহর কিছু ভালো গুনের কথা অনেকেই জানতে পারবেন। এবং জিন্নাহ-প্রীতি আশা করছি না, জিন্নাহ-কে 'সাম্প্রদায়িক'ও বলতে অসুবিধা নেই, তবে তাঁর বেশ কিছু কীর্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাবে নিশ্চয়। আপনাকে ধন্যবাদ বলা ঠিক না, কিন্তু শুভেচ্ছাতো জানানোই যায়। চরৈবেতি...
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:২০51199
  • @লেখকের জন্য,

    আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনি লিখেছেন --- //এলেবেলে যা বলছেন সেগুলো সবই সত্য বলে মানলেও বৃহত্তর রাজনৈতিক এবং বৃহত্তর Humanity র প্রেক্ষাপট দেখলে গান্ধীর কাজগুলো ও কিছু পলিটিক্স যাকে নোংরা মনে হচ্ছে, তা কি জাস্টিফাই করা যায় না? ... গান্ধীর মূল অস্ত্র, মূল জীবনভাষ্য অহিংসা। ... এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও প্রীতি ও করুনার আদর্শর মধ্যেই মানুষ শান্তি খুঁজে ফেরে আজও। এখানেই গান্ধীর সার্থকতা, বৃহত্তর প্রাসঙ্গিকতা!//

    প্রথমত, ‘গান্ধীর মূল অস্ত্র, মূল জীবনভাষ্য অহিংসা’-টা আপামর ভারতবাসীর কাছে খুব প্রিয় ও চালু লব্জ। এই লব্জটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গান্ধী নিজে এবং পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যসামন্তরা খুব খেটেখুটে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। যেমন চেষ্টা করেছেন জওহরলালকে ‘বামপন্থী’ সাজানোর কিংবা সুভাষকে ‘রক্ষাকর্তা’ দেখানোরও। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরে সে সবই মরভূমিতে মরুদ্যানের ভ্রম হিসেবে প্রমাণিত।

    যে গান্ধী ১৯০৬ সালের জুলু যুদ্ধের পরে অহিংসার ‘ব্রত’ নিয়েছিলেন বলে নিজে জানিয়েছেন, তা পুরোটাই অলীক মায়া। তাই ১৯০৭, ১৯১৪ এবং ১৯১৮ সালে তিনি পরম উৎসাহে ও চরম উদ্যমে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে যোগদান করতে বা পরোক্ষভাবে সৈন্য রিক্রুট করতে নেমে পড়েছেন! যিনি রাশিয়ায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করতে হবে বলেছেন (হরিজন, ১২-০৫-১৯৪৬); তিনি সে নিদান হাঁকার মাত্র ৬ বছর আগে ভারতের ক্ষেত্রে মত প্রকাশ করেছেন এই বলে --- ‘we might have to maintain a police force’ (হরিজন, ২৫-০৮-১৯৪০) বা ‘I have not the courage to declare that we can carry on without a police force’ (হরিজন, ০১-০৯-১৯৪০)!!

    দ্বিতীয়ত, যদি তাত্ত্বিকভাবে ‘অহিংসা’-কে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখব, অহিংস আন্দোলন তখনই সম্ভব যখন মানুষের কতগুলো নাগরিক অধিকারকে আইনত স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং রাষ্ট্র সেই অধিকার রক্ষার জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট হয়। তাই বারে বারেই দেখা গেছে যে সত্যাগ্রহী আন্দোলন কোনও না কোনও শক্তিশালী সরকার-শাসিত অঞ্চলেই আত্মপ্রকাশ করেছে - এবং স্বাভাবিকভাবেই নাটাল, ট্রান্সভাল বা ভারতে রাষ্ট্র বা পুলিশ তাই সর্বদা গান্ধীকে রক্ষা করেছে। অহিংসার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে গান্ধীর অনশন সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। যখনই গান্ধী বুঝেছেন তাঁর অনশন কার্যকরী হবে না, তখনই গান্ধী অনশন করার কথা ভাবেনও নি! তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তিনি আম্বেদকরকে তাঁর কাছে নতি স্বীকার করার জন্য এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছেন, অথচ জিন্নার ক্ষেত্রে করেননি। কেন করেননি? প্রশ্নটা সহজ আর উত্তরও তো জানা।

    আসলে অহিংসা রাষ্ট্রের কাছে বড় প্রিয়, বড় পছন্দের বিষয়। এই অহিংসায় বিশ্বাসীদের ওপরে সে তার হিংসার অস্ত্র প্রয়োগ করে আন্দোলনকে মুহূর্তে ঠান্ডা করে দিতে পারে। সর্বোপরি দু-একজন অনুগামী বাদ দিলে গান্ধীর অনুগত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ গান্ধীর নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর অহিংসার তত্ত্বকে পাত্তাই দেননি। উদাহরণ কাশ্মীরে সেনা পাঠিয়ে ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ করা।

    এ প্রসঙ্গে ‘The End of Gandhi’ নিবন্ধে রজনী পাম দত্ত গান্ধীর সত্যাগ্রহের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্যের চমৎকার বয়ান তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যেখানে অহিংস অসহযোগীরা কেবলমাত্র গ্রেফতার হয়েছেন, সেখানে শ্রমিকরা সর্বদা পুলিশের গুলির সম্মুখীন হয়েছেন। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত কলকাতার দুটি সংবাদ উদ্ধৃত করে তিনি দেখিয়েছেন — Fifteen Nationalist Congress volunteers engaged in picketing have been arrested. Undeterred by the arrests at the recent prohibited meetings of the Bengal Provincial Congress, the organisers held another public meeting yesterday, and 273 arrests were made (Times, 28/1/22) এবং — A serious riot, in which 4,000 mill hands were involved, broke out yesterday at the Standard Jute Mills at Titagarh, in the environs of Calcutta, and culminated in the police firing on the crowd, with the result that two rioters were killed and forty wounded (Manchester Guardian, 31/1/22)। তাহলে বুঝতেই পারছেন অহিংস অসহযোগীদের ক্ষেত্রে একই রাষ্ট্রের ভিন্ন আচরণের কারণ। তাই গান্ধী ব্রিটিশের নয়নের মণি! এ ব্যাপারে প্রচুর রেফারেন্স আছে সরকারি ও বেসরকারি তরফে। চাইলে বলবেন, দেওয়া যাবে এক এক করে।

    হ্যাঁ, এর আগে ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার মহাশয় খুবই বিস্তারিতভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটা লিখছিলেন, যদিও সেটা শেষ হয়েছিল কি না জানি না। মানে অন্তত আমার চোখে পড়েনি। তাঁর লেখনীগুণের কণামাত্রও আমার নেই, তা স্বীকার করছি নির্দ্বিধায়। আমি আমার সীমাবদ্ধ পড়াশোনা ও ক্ষমতার ওপরে নির্ভর করে সেটা লেখার চেষ্টা করেছি/করছি মাত্র, কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে গান্ধীকে বেছে নিয়ে। তাতে কতটা সফল হয়েছি কিংবা আদৌ সফল হয়েছি কি না - সে বিচার পাঠকরা করবেন।

    @একরামূল হক শেখ,

    আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এখানে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মাননীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও বিচারধারা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, নিছক সাদা কিংবা কালোর বাইনারিতে আটকে থাকতে না চেয়ে আমি ধূসর এলাকাটাকে ধরার চেষ্টা করছি। তাই আমার এই সামান্য লেখায় কেউ যেমন ভগবান নন, তেমনই কেউ শয়তানের প্রতিমূর্তিও নন।

    ভারতীয় ইতিহাসে জিন্নাকে সর্বদা কালো দেখানোর একটা চল আছে। আমি খুব সচেতনভাবেই এই প্যাটার্নটাকে ভাঙতে চেয়েছি। জিন্নাকে আমি বহুমাত্রিক দৃষ্টি থেকে দেখব বলেই ভারতীয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানি এবং ইউরোপিয় লেখকদের লেখাপত্তর মনোযোগ সহকারে পড়ার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। এবং সেই কাজ করতে গিয়ে জিন্নাকে আমার ‘সাম্প্রদায়িক’ মনে হয়নি। আমি দিনের শেষে উপলব্ধি করেছি পরাধীন ভারতবর্ষে মাত্র তিনজন রাজনৈতিক নেতা সেকুলার ছিলেন --- জিন্না, আজাদ এবং বাদশা খান। কী আশ্চর্য, এঁরা তিনজনেই মুসলমান! আজ যখন এই সম্প্রদায়ের মানুষদের স্বাধীন ভারতে ‘অপর’ বলে সদম্ভে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন এই তিনজন নেতার কথা ভেবে নিজেকে হতাশ ও লজ্জিত লাগে বইকি।
  • রঞ্জন | ***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:১৫51200
  • ১) রজনীপাম দত্তের মন্তব্যটি খুব লাগসই মনে হল না। বিপরীত উদাহরণ কম নয় ।
    অহিংস সত্যাগ্রহীদের উপর পুলিশের গুলির ঢের উদাহরণ আছে। ভারতে (মাতঙ্গিনী হাজরা), রাশিয়ায়, আমেরিকায় (লুথার কিং) এবং আফ্রিকায়।
    তেমনই সংঘবদ্ধ শ্রমিক বা জন-আন্দোলনের সামনে রাষ্ট্রের বর্বর শক্তি মাথা নুইয়েছে এমন উদাহরণও আছে।
    আসল প্রশ্নটি বোধহয় ব্যাপক জনসমর্থনের -- যার অভাবে সশস্ত্র আন্দোলনও বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষণিক ফুলঝুরি জ্বালিয়ে নিভে যায়। ( এ ব্যাপারে প্রয়াত দুই নকশাল নেতা কানু সান্যাল এবং নারায়ণ দাস স্যান্যালের উপলব্ধি ভাবতে বাধ্য করে )।
    তাই শ্রীদত্তের উদাহরণএই চোখে পড়ে যে অহিংস পথে গণ-আন্দোলন লম্বা সময় ধরে চালানো যায়।
    ২) অহিংসার প্রশ্নে গান্ধী এবং নেহরু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে তফাৎটি হল (আমি যা বুঝেছি) এ'রকমঃ
    গান্ধীঃ অহিংসা হল স্ট্র্যাটেজিক বা রণনৈতিক ইস্যু। এটি লং-টার্ম এবং নন- নেগোশিয়েবল। তাই এর জন্যে বিভিন্ন বিন্দুতে কম্প্রোমাইজই সই।
    নেহেরু এবং অন্যরাঃ অহিংসা হল ট্যাক্টিক্যাল বা রণকৌশলগত ইস্যু। মানে অল্পকালীন ব্যাপার। যখন যেমন কাজে দেবে তখন তেমন ব্যবহার। নইলে তুলে রেখে দাও।
    [ একান্তই ব্যক্তিগত মত, ভুল হতে পারে।]
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:৪৬51201
  • ১) মাতঙ্গিনী হাজরা অহিংস আন্দোলন করেছিলেন ঠিকই, অন্য অনেকেই করেছিলেন ওই সময়ে কিন্তু গান্ধীকে জেলে পুরে দেওয়ার পরে ব্রিটিশের ব্রুটালিটিটাও একবার ভাবুন। হ্যাঁ ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ার বিষয়ে চিন্তা করেনি বলেই ক্ষণিকের ফুলঝুরি হয়ে নিভে গেছে। তবে হিন্দুত্ববাদী সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে কানু সান্যালদের ফারাক অবশ্যই আছে। আবার সহিংস আন্দোলনের চিনের উদাহরণও আছে।

    ২) একদম ঠিক, যদিও গান্ধীর অহিংসা তত্ত্বের পুরোটা কম্প্রোমাইজ এবং স্থিতাবস্থা জারি রাখার রণনীতি বলে আমার নিজের মনে হয়।
  • ganasamarthan | ***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:৫৬51202
  • সহিংস চিনা আন্দোলন ও অহিংস গান্ধীবাদি আন্দোলনের মধ্যে কোনটা পচ্ছন্দ - তার গ্লোবাল ভোট নেওয়া হলে কে জিতবে বলে মনে হয়?
  • রঞ্জন | ***:*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:৩৭51203
  • ১) অহিংস আন্দোলনের উপর রাষ্ট্র একটু 'অহিংস ' ভাবে বলপ্রয়োগ করে এই ধারণাটি বোধহয় গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় বদলানো প্রয়োজন।
    ধরুন, চিনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের সেই ঘটনাটি -- যেখানে মাথায় ফেট্টি বাঁধা অকুতোভয় দুই তরুণ ও তরুণী সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের নীচে পিষে গেল।
    বা, স্বামী অগ্নিবেশ এবং অন্য্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির বস্তার ভিজিটের সময় কী ভাবে তাদের পেটানো হয় অথবা গান্ধীবাদী নেতা হিমাংশুকুমারের অফিস ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
    আসলে সবটাই নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। রাষ্ট্রের দ্বারা পরিস্থিতির মূল্যায়নের ওপর। কী ধরণের বলপ্রয়োগে পাবলিকের এবং অন্য স্টেক হোল্ডারদের কী কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার মূল্যায়নের ওপর।
    দুটো উদাহরণ দিচ্ছি (জনশ্রুতি ভিত্তিক, ভুল হতে পারে )।
    ক) ।১৯৭০ সালে নবগঠিত সিপিয়াই(এমএল) দলের প্রথম পার্টি কংগ্রেস কোলকাতার উপকন্ঠে গোপনে সম্পন্ন হয়।
    কোলকাতার গোয়েন্দা বিভাগের কাছে সব খবরই ছিল। কিন্তু ঘিরে ফেলে পুরো পলিট ব্যুরোকে তুলতে গেলে যে ব্যাপক হিংসা ও রক্তপাত ঘটত তার ব্যাক ল্যাশ কস্ট-এফেক্টিভ হত না। উল্টোদিকে নকশাল নেতারাও এই একই অ্যাসেসমেন্ট করে ক্যালকুলেটেড রিস্ক নিয়েছিলেন।

    তাই পুলিশ সার্কেলের বাঈরে অপেক্ষা করল এবং অন্ধ্র থেকে আসা দুই নেতাকে সম্ভবতঃ খড়গপুর স্টেশন থেকে তুলে নিল (আপ্পালাসুরি এবং আপ্পালাস্বামী? নাকি নাগভুষণ পট্টনায়েক?)।
    কিন্তু তখন অন্ধ্রে পুলিশ ধরছে অ্যার মারছে, মহিলারা ব্যতিক্রম নন। নির্মলা সম্পূর্ণা ইত্যাদি নেত্রীরা।
    পরে কলকাতায় বরানগর-কাশীপুর-আমতলা ত ইতিহাস।

    খ) অনন্ত সিং দলের জাদুগোড়ায় বালখিল্য অভিযান। পুলিশের উপর আক্রমণ, বাস হাইজ্যাক করে রুয়ামের জঙ্গলে আত্মগোপন। পুলিশ হেলিকপ্টার ইত্যদি দিয়ে সার্চ করে দুদিনে সবাইকে বন্দী করল।
    মেরি টাইলার নামের বৃটিশ শিক্ষিকা বন্দীদের একজন হওয়ায় সম্ভবতঃ খুব একটা থার্ড ডিগ্রি দেওয়া হয়নি। মানে গোটাটাই পরিস্থিতি নির্ভর।
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:১৩51204
  • @রঞ্জন,

    আমি আগেই লিখেছি "যদি তাত্ত্বিকভাবে ‘অহিংসা’-কে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখব, অহিংস আন্দোলন তখনই সম্ভব যখন মানুষের কতগুলো নাগরিক অধিকারকে আইনত স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং রাষ্ট্র সেই অধিকার রক্ষার জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট হয়। তাই বারে বারেই দেখা গেছে যে সত্যাগ্রহী আন্দোলন কোনও না কোনও শক্তিশালী সরকার-শাসিত অঞ্চলেই আত্মপ্রকাশ করেছে - এবং স্বাভাবিকভাবেই নাটাল, ট্রান্সভাল বা ভারতে রাষ্ট্র বা পুলিশ তাই সর্বদা গান্ধীকে রক্ষা করেছে।"

    এটা লিখেছি গান্ধীর অহিংসার প্রেক্ষিতে। মানে গান্ধী যেহেতু শাসকের হয়ে বাফারের কাজটা নিপুণভাবে করছেন, তাই শাসকেরও প্রয়োজন পড়ছে সেই বাফারটিকে প্রোটেকশন দেওয়ার এবং সেটা যথাসম্ভব মোলায়েমভাবেই। তাই তাঁকে বন্দি করা হয় বটে কিন্তু রাখা হয় আগা খাঁ প্যালেসে।

    কিন্তু শাসক যখনই বুঝবে অহিংস আন্দোলনকারীরা তাদের বাফারের কাজ করছে না, বরং তাদের কোর এরিয়ায় ঢুকে পড়তে চাইছে তখনই সে হিংস্র অত্যাচার চালিয়ে সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে একবারের বেশি দু'বার ভাববে না। জামিয়া মিলিয়ায় সদ্য ঘটে যাওয়া অহিংস আন্দোলনের ওপরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
  • অর্জুন | ***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:৫৩51205
  • @এবড়োখেবড়ো

    প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পোস্ট করার সঙ্গে, সঙ্গেই পড়েছিলাম ও মন্তব্য করেছিলাম।

    মাঝে একটা গ্যাপ গেল। একদম পড়া হচ্ছিল না। তাই প্রথম থেকে ষষ্ঠ পর্ব টানা পড়লাম।

    ঋজু ন্যারেটিভ। লেখার স্টাইল জার্নালিস্টিক, ইনভেস্টিগেটিভ যদিও বিষয়টা অ্যাকাডেমিক। এটা লেখার গুণগত মানের নিরীখে বললাম। সমালোচনা নয়।

    মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মত একটি চরিত্রে আলো-আঁধারি মিশেল খুব স্বাভাবিক কিন্তু এই লেখায় আঁধারি অংশের দিকটা পরিস্ফুট করা হচ্ছে।

    খুব গোছানো তথ্য এবং কম্প্রিহেন্সিভ গবেষণা। গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের কাহিনী ও তার পর্যালোচনা কিছু জানা থাকলেও এত ডিটেলে ঘেঁটে দেখিনি এর পূর্বে। কিছু তথ্য জেনে বেশ চমকে যেতেও হচ্ছে।

    বেশ থরো রিডিং না থাকলে এই লেখায় কিছু মন্তব্য করা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছেনা।

    বাকি পর্বগুলো পড়ে ও বিশদ তথ্য ঘেঁটে চেষ্টা করব মন্তব্য দিতে।

    লেখকের পরিশ্রমকে অভিনন্দন।
  • এস চক্রবর্তী | ***:*** | ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:৩৭51206
  • ১৯৪০-এর ৮ অগস্ট লিনলিথগোর পেশ করা ‘অগস্ট প্রস্তাব’-এ ভারতবর্ষের প্রাপ্তির বিষয়ে বলা হল — ক) কোনও এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে ডমিনিয়ন মর্যাদা, ................

    এই সময় চাপ দিলে আরও বেশী সুবিধা পাওয়া যেত । তাইনা ? দেওয়া হয়নি কেন ? কারন তখন যুদ্ধের গতি সম্পূর্ণ ইংরেজদের বিপরীতে।একটু ডিটেল পাওয়া যাবে?

    “যুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালের ৬ মে গান্ধী স্বাস্থ্যের কারণে জেল থেকে ছাড়া পেলেন”। ..........

    এই তথ্য ভুল কারন যুদ্ধ ১৯৪৫ সালে শেষ হয়েছে।
    1 September 1939 – 2 September 1945
    ৬বছর ১দিন চলেছিল এই যুদ্ধ ।
    কোনটি ঠিক করতে হবে ? যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য না জেল থেকে ছাড়া পাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ।
    ধন্যবাদ ।
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০৭51207
  • @এস চক্রবর্তী,

    //১৯৪০-এর ৮ অগস্ট লিনলিথগোর পেশ করা ‘অগস্ট প্রস্তাব’-এ ভারতবর্ষের প্রাপ্তির বিষয়ে বলা হল — ক) কোনও এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে ডমিনিয়ন মর্যাদা, ................
    এই সময় চাপ দিলে আরও বেশী সুবিধা পাওয়া যেত । তাইনা ? দেওয়া হয়নি কেন ? কারন তখন যুদ্ধের গতি সম্পূর্ণ ইংরেজদের বিপরীতে।একটু ডিটেল পাওয়া যাবে?//

    চাপ দিলে সত্যিই কি আরও বেশি সুবিধা পাওয়া যেত? বোধহয় না। কারণ তত দিনে লিগ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং তারা যুদ্ধে ইংল্যান্ডকে সমর্থনও করেছিল। এই বিভাজনের রাজনীতি চতুর ইংরেজ বহু আগে থেকেই করেছিল এবং তার ডিভিডেন্ডও পেয়েছিল।

    //“যুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালের ৬ মে গান্ধী স্বাস্থ্যের কারণে জেল থেকে ছাড়া পেলেন”। ..........

    এই তথ্য ভুল কারন যুদ্ধ ১৯৪৫ সালে শেষ হয়েছে।//

    হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ এই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। ওটা ‘যুদ্ধ শেষে’-র পরিবর্তে ‘যুদ্ধ চলাকালীন’ পড়ুন দয়া করে। মূল পাণ্ডুলিপিতে আমি ভুলটা শুধরে নিলাম।
  • avi | ***:*** | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:৪৪51208
  • অনবদ্য। পুরোটাই পড়ে চলেছিলাম, মন্তব্য অংশেও অনেক কিছু জেনেছি। ইতিহাস বিষয়ে এই স্তরে জ্ঞান জাস্ট নেই, আলোচনায় অংশ নেওয়া গেল না, অসম্ভব ঋদ্ধ হলাম। অনেক ধন্যবাদ।
  • এস চক্রবর্তী | ***:*** | ০৫ জানুয়ারি ২০২০ ০৫:৫৭51209
  • প্যাটেল-মেনন জুটির হায়দ্রাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীর সহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যকে ভয় অথবা লোভ দেখিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা; পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জীবনে শেষবারের মতো গান্ধীর অনশন; দু’দেশ জুড়েই সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিণাম হিসেবে উদ্বাস্তুদের নিরবচ্ছিন্ন স্রোত; পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ জিইয়ে রাখা এবং সব শেষে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীর হাতে গান্ধীহত্যাতে এই দীর্ঘ কাহিনির সমাপ্তি।

    কয়েকটি আপত্তি / প্রশ্ন
    প্যাটেল-মেনন জুটির হায়দ্রাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীর সহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যকে ভয় অথবা লোভ দেখিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা;
    এই কাজটি আমার মতে অতি উত্তম কাজ , আপনার মত কি ?

    পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জীবনে শেষবারের মতো গান্ধীর অনশন; দু’দেশ জুড়েই সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিণাম হিসেবে উদ্বাস্তুদের নিরবচ্ছিন্ন স্রোত; পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ জিইয়ে রাখা
    পাকিস্থানের এই টাকা কি পাওনা ছিল না গান্ধী নিজে মনে করতেন যে ওটা ওদের লেজিটীমেট অধিকার?

    সব শেষে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীর হাতে গান্ধীহত্যাতে এই দীর্ঘ কাহিনির সমাপ্তি
    গান্ধী আগেই মারা গেছিলেন আমাদের মননে । দৈহিক মৃত্যু নিয়ে আপনার কোন আফসোস ?
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ০৭ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:২৩51210
  • @এস চক্রবর্তী

    এ লেখা এমনিতেই মৃত, তবুও যে আপনি পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। উত্তর দেরিতে দেওয়ার কারণে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

    ১. //প্যাটেল-মেনন জুটির হায়দ্রাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীর সহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যকে ভয় অথবা লোভ দেখিয়ে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা;
    এই কাজটি আমার মতে অতি উত্তম কাজ , আপনার মত কি ?//

    আমার মতে অতি অধ্ম কাজই শুধু নয়, চরম দ্বিচারিতার লক্ষণ। কারণ ধর্মের অজুহাতে দেশভাগের গপ্পোটা তাতে টেকসই হয় না, জিন্না বা লিগকে সহজে টার্গেট করাও যায় না। ভুলে যাবেন না ১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী কাশ্মীরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৭১%, তাকে জোর করে ভারতের 'অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ' বানাতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা খাতে খরচ ক্রমে বেড়েছে এবং সেই সুযোগে নিজেদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার খতিয়ানকে দিব্যি কার্পেটের তলায় চাপা দেওয়া গেছে।

    ২. //পাকিস্থানের এই টাকা কি পাওনা ছিল না গান্ধী নিজে মনে করতেন যে ওটা ওদের লেজিটীমেট অধিকার?//

    গান্ধীর মনে করা বা না করার কোনও ব্যাপারই নয়, টাকাটা সত্যি সত্যিই পাওনা ছিল পাকিস্তানের। দেশের সেনাবাহিনী ভাগ হলে সম্পত্তির ভাগ হবে না কেন? প্যাটেল উগ্র জাতীয়তাবাদী 'সেজেছিলেন' কিন্তু সেনাবাহিনী লেলিয়ে ও কমিউনিস্টদের ভয় দেখিয়ে নিজামের হায়দ্রাবাদকে কব্জা করতে গিয়ে একবারের জন্যও দ্বিধান্বিত হননি। অহিংসার শিক্ষাটি, সন্দেহ নেই, তিনি দারুণ আয়ত্ত করেছিলেন!

    ৩. গান্ধী তো দূরের কথা, রবীন্দ্রনাথের দৈহিক মৃত্যু নিয়েই আমার কোনও আফশোস নেই। আফশোস আছে গান্ধীর হত্যা নিয়ে। কারণ তাঁর স্বাভাবিক বয়সোচিত মৃত্যু হলে রাষ্ট্র এতদিন পরেও তাঁর 'সন্ত' নির্মাণের প্রক্রিয়াটিতে এত যত্নশীল হতে পারত না। সেদিক থেকে নাথুরাম তাঁকে মেরে ভারতবাসীর মননে অমর করে দিয়েছেন।

    @অভি,

    ওভাবে বলবেন না। এ লেখা নিছকই খেয়ালবশে লেখা, ইতিহাসে জ্ঞান আমার সত্যি সত্যিই মাধ্যমিক স্তরের। তবুও যে এ লেখা আপনার ভালো লেগেছে, তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
  • এবড়োখেবড়ো | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ০৫:২০51212
  • @রঞ্জন,

    ১ থেকে ৪ আপনি আমার থেকেও ভালো বুঝিয়ে বলেছেন। ৫-এর রাস্তায় আমি ইচ্ছা করেই পা বাড়াইনি, যদিও তা নিয়েও আলাদা একটি পর্ব লেখাই যেত।

    এবার আপনি জোরসে ঝগড়া শুরু করুন যার জন্য লেখার প্রথম থেকেই মুখিয়ে আছি! আমার ভুল বোঝা বা বোঝানোকে মেনে নিতে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না, সে কথা আপনাকে আগাম দিয়ে রাখলাম।
  • রঞ্জন | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ১২:৫১51211
  • অনেক পরিশ্রমী লেখা। তথ্যের নির্মাণ নিয়ে কোন কথা হবে না।
    কিন্তু গান্ধী মূল্যায়নে মতদ্বৈধ থাকতেই পারে।
    আমি আমার দ্বিধাটুকু বলি।
    প্রথমে দেখি লেখকের বক্তব্য ঠিকমত বুঝেছি কিনা। উনি হ্যাঁ বললে বা সংশোধন করে দিলে তারপর আমার কথা বলব। একেবারে প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায়। পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ!

    পূর্বপক্ষঃ
    ১) লেখক প্রমাণ করেছেন যে গান্ধী মননে হিন্দু রক্ষণশীল, পদে পদে আপোষ করতে তৎপর, আন্দোলনের তীব্রতায় ভীত হয়ে রাশ টেনে ধরতে উদ্যমী।
    ফলে তিনি ভারতীয় জনগণের আক্রোশের সামনে বৃটিশ কলোনিয়ালিস্ট স্বার্থ রক্ষায় 'বাফার' হয়ে দাঁড়িয়েছেন। হয়ত বা অজান্তেই। কিন্তু তাঁর দর্শন এবং সমাজচিন্তা, অবজেক্টিভলি দেখলে, তাঁকে দিয়ে এই কাজই করিয়েছে।
    ২) ভারতের অধিকাংশ জনতা কৃষক। কিন্তু গান্ধীজি তাদের স্বার্থ না দেখে জমিদারদের স্বার্থ দেখেছেন। আমেদাবাদের মিল শ্রমিকদের ইউনিয়ন সংগঠনে তিনি সেই বাফারের কাজই করেছেন। কার স্বার্থে? অবশ্যই মিল-মালিকদের।
    ৩) তাঁর গ্রাম-স্বরাজ, তাঁর আধুনিক চিকিৎসা বিরোধী এবং বিজ্ঞান বিরোধী মনোভাব আমাদের অতীতমুখী এবং পশ্চাদপদ করেছে।
    ৪) তাঁর অহিংসা এবং অসহযোগ? আসলে সংগ্রামী জনতাকে রাষ্ট্রের সংগঠিত আক্রমণের সামনে অসহায় নিরস্ত্র করে দাঁড় করিয়ে দেয়। কার স্বার্থে? খেয়াল করুন অহিংসার ব্যাপারে গান্ধীর সিলেক্টিভ স্ট্যান্ড। জনতা সহিংস হলে উনি বলবেন অহিংস হও; আর রাষ্ট্রের বেলা? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
    ৫) আরো বলা যেত। সাবরমতী আশ্রমে ওঁর আর্টিফিসিয়াল মডেল, কস্তুরবাকে আর্টিকুলেট হতে না দেওয়া। রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা, সেক্স নিয়ে অবসেশন, বুড়োবয়সেও। ্তাঁর ছেলেদের বিদ্রোহ। মানে ভাল বাবা হতেও পারেননি, এদিকে জাতির জনক। কিন্তু লেখক সেরাস্তায় হাঁটেননি। ব্যক্তিগত জীবনচর্চা বাদ দিয়ে এই পরিসরে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন নিয়েই চর্চা করেছেন।
    এবার এবড়োখেবড়ো বলুন আমি ওনার কথা মোটামুটি বুঝেছি কিনা।
  • এস চক্রবর্তী | 172.69.***.*** | ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ২৩:২১45386
  • আমার মতে অতি অধ্ম কাজই শুধু নয়, চরম দ্বিচারিতার লক্ষণ। কারণ ধর্মের অজুহাতে দেশভাগের গপ্পোটা তাতে টেকসই হয় না, জিন্না বা লিগকে সহজে টার্গেট করাও যায় না। ভুলে যাবেন না ১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী কাশ্মীরে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৭১%, তাকে জোর করে ভারতের 'অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ' বানাতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা খাতে খরচ ক্রমে বেড়েছে এবং সেই সুযোগে নিজেদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার খতিয়ানকে দিব্যি কার্পেটের তলায় চাপা দেওয়া গেছে। আপনার হিসাব শুধু কাশ্মীর নিয়ে । আর হায়দ্রাবাদ কে ভুললে চলবে না । জুনাগর তাদের ক্ষেত্রে কি এই হিসাব করবেন ?
  • রঞ্জন | 162.158.***.*** | ১৫ জানুয়ারি ২০২০ ২২:১৮45393
  • @এবড়োখেবড়ো,

    যাক, ৮ তারিখের পোস্টে আপনার মন্তব্য দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমি আপনার মূল বক্তব্য বুঝতে ভুল করিনি। একটা কথা নির্দ্বিধায় বলি। আমি পুরো লেখাটা ডাউনলোড করে সেভ করেছি -- আমার রেফারেন্স হিসেবে ভবিষ্যতে খুব কাজে লাগবে।

    এবার আমার উত্তরপক্ষঃ

    ১) আগেই বলেছি, ফ্যাক্ট নিয়ে কোন কথা হবে না। কথা হবে ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে। একই তথ্যসমূহ থেকে আলাদা সিদ্ধান্ত হতেই পারে।  রশোমন ফিল্ম, রবীন্দ্রনাথের পেইন্টিং নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং রম্যাঁ রোলাঁর বিপরীত মেরুতে অবস্থান। কিন্তু ইতিহাসের পাতা, রাজনৈতিক অবস্থান আর সিনেমা/চিত্রকলা? কিসের সঙ্গে কিসে?

    তাহলে ধরুন, ইমার্জেন্সি। প্রচুর লোক তখন ইমার্জেন্সির পক্ষে ছিলেন -- ট্রেন সময়মত চলছে, কারখানায় স্ট্রাইক হচ্ছে না, দেশে এনার্কি কমেছে, স্কুল কলেজে পড়াশুনো পরীক্ষা সময়মত হচ্ছে, গরীবের জন্যে সরকার অনেক স্কীম বানিয়েছে ইত্যাদি। অনেকটা আজকের সময়ের মত।

    বলতে চাইছি আধ-গ্লাস জলকে আধগ্লাস খালি বলব নাকি আধগ্লাস ভরা? নির্ভর করছে আমি অভিমুখ কোন দিকে দেখছি। ভরা থেকে কমে আধা হয়েছে? নাকি খালি থেকে আধা ভরেছে?

    ২) এবার বলছি যে এই লেখায় কি কি নির্বিবাদে স্থাপিত হল? তিনটে।

    গান্ধী আদৌ সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী আপোষহীন যোদ্ধা ছিলেন না ।

    গান্ধী বিবাদের সময় খেটে খাওয়া মানুষের থেকে শোষকশ্রেণীর দিকে বেশি ঝোল টেনেছেন।

    গান্ধীবাবার অহিংসা খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ে রণনীতির দিক থেকে মহা-ফালতু  বললে কম বলা হয়।

    ৩) কোন লেখা বা শিল্পকর্মের সমালোচনায় আমরা অনেক সময় তাতে কিকি নেই, কি কি হলে ভাল হত -- সেই কথা বলে থেমে যাই। তাতে বাদ পড়ে যায় -- কি কি আঁচে, কি কি পেয়েছি। এবড়োখেবড়োর তথ্যনিষ্ঠ পরিশ্রমী বিশ্লেষণে ধরা পড়েনি ফোর্থ ডাইমেনশন। একশ' বছর আগের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ভারতবর্ষে শক্তিশালী বৃটিশ উপনিবেশকে আঘাত হানতে ভারতের রণনীতি কি হবে? কি হতে পারত? যখন সশস্ত্রবিপ্লবের সমস্ত প্রচেষ্টা কিছু বুদবুদ তুলে মিলিয়ে গেল --- অনুশীলন/যুগান্তর/বাঘা যতীন থেকে ভগত সিং ধরেই বলছি --- তখন গান্ধীজির বেয়াল্লিশের আন্দোলন যে বিপুল মাস মোবিলাইজেশনের শক্তি দেখাল তার মন্ত্র তখনকার বিপ্লবীদের জানা ছিল না। ভারতের গ্রামীণ জনতার নাড়ির ছন্দ বোধহয় গান্ধীজির থেকে ভাল করে কেউ বোঝেননি।

    ৪) জনতার খাতিরে ধার্মিক মেটাফরের প্রয়োগঃ

    দেখুন, এই সেদিনও জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিলেন পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট কবি ফৈজ, তাতে কি পরিমাণ ধার্মিক মেটাফরের ব্যবহার। 'হম দেখেঙ্গে' কবিতাটির শীর্ষক ছিল কোরানের একটি বয়েত দিয়ে যার মানে হয় 'ঈশ্বরের মুখ"। তাতে রয়েছে সব মুকুট ছুঁড়ে ফেলার সিংহাসন থেকে টেনে নামানোর আহবান। কিন্তু গানটি (ইকবাল বানোর কন্ঠে আত্মবিশ্বাসে গর্জে উঠেছে) শেষ হচ্ছে 'রয়ে যাবে শুধু আল্লার নাম' বলে । কানপুর আই আই টির পন্ডিতমন্ন প্রফেসর একে হিন্দু-বিরোধী ভাবতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের জনতা বা আজকের শাহীন বাগ একে ন্যায়ের দুনিয়ার মেটাফর হিসেবে বুঝতে ভুল করেনি।

    ৫) সাভারকর ও গান্ধীঃ

    প্রথমজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক নন , প্রার্থনা নিয়ে বিদ্রূপ করেন, সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করেন। জাতপাত বর্ণাশ্রম মানেন না। আমিষভোজী, গরুকে মাতা বললে ব্যঙ্গ করেন। ভারতের ভবিষ্যৎ বলতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্টিফিক সমাজের কথা বলেন।কালাপানি গেলেন। অত্যাচার সহ্য করলেন। কিন্তু তাঁর যাত্রা শেষ হল বৃটিশের সহযোগিতায় এবং ঘোর মুসলিম বিদ্বেষে।

    দ্বিতীয়জনের শুরু বৃটিশ ভজনায়, আবেদন নিবেদনের পথে, শেষ হল বৃটিশ কলোনি কে 'শয়তানের সাম্রাজ্য' আখ্যা দিয়ে 'কুইট ইন্ডিয়া' ডাক দিয়ে। নিষ্ঠাবান নিয়ামিষভোজী, গোপূজক হিন্দু, বর্ণাশমের ঐতিহাসিক ভূমিকায় বিশ্বাসী, দেশি চিকিৎসায় বিশ্বাসী, গ্রামসমাজের মধ্যে মুক্তি খোঁজেন। সেই ভদ্রলোক ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন জাতপাতের বিরুদ্ধে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে। বললেন -- ' ঈশ্বরো আল্লা তেরো নাম'। নির্ভয়ে মেজরিটারিয়ান মতের বিপক্ষে পাকিস্তানকে পাওনা টাকা দেওয়ার দাবিতে অনশনে বসলেন এবং প্রাণ দিয়ে বিশ্বাসকে ধরে রাখলেন। 

    কোনটা ভরা গ্লাস আধা হল অ্যার কোনটা খালি হল?

    ৬) আজকে ওঁর নীতি কতটুকু মানব সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে।

  • এবড়োখেবড়ো | 162.158.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ২১:৪৭45403
  • @রঞ্জন,

    আগেই দুঃখপ্রকাশ করছি দেরিতে উত্তর দেওয়ার জন্য। আসলে গুরুর নতুন লে আউটে সড়গড় হতে সামান্য অসুবিধার কারণে এই দেরি। যাই হোক, আপনার উত্তরপক্ষের উত্তর দিই।

    ১) // একশ' বছর আগের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ভারতবর্ষে শক্তিশালী বৃটিশ উপনিবেশকে আঘাত হানতে ভারতের রণনীতি কি হবে? কি হতে পারত? যখন সশস্ত্রবিপ্লবের সমস্ত প্রচেষ্টা কিছু বুদবুদ তুলে মিলিয়ে গেল--- অনুশীলন/যুগান্তর/বাঘা যতীন থেকে ভগত সিং ধরেই বলছি--- তখন গান্ধীজির বেয়াল্লিশের আন্দোলন যে বিপুল মাস মোবিলাইজেশনের শক্তি দেখাল তার মন্ত্র তখনকার বিপ্লবীদের জানা ছিল না। ভারতের গ্রামীণ জনতার নাড়ির ছন্দ বোধহয় গান্ধীজির থেকে ভাল করে কেউ বোঝেননি। //

    আমার মতে ভারতের রণনীতি হতে পারত হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন। কিন্তু কংগ্রেস তথা গান্ধী এই দিকটাকে উপেক্ষা করেছেন। ১৯২৮-এর নেহরু রিপোর্ট মুসলমানদের মাত্র ৮% অধিক সংরক্ষণ না দেওয়ার গোঁয়ার্তুমিতে সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে। পরবর্তীকালে যুক্তপ্রদেশে মন্ত্রিসভায় লিগকে না নেওয়া, ৩৭-এর নির্বাচনে লিগকে অবহেলা করা, পরে লিয়াকত আলিকে অর্থমন্ত্রকে ঠেলে দেওয়া --- একের পর এক ভুল কংগ্রেস করে গেছে। গান্ধী-জিন্না দ্বৈরথের সৃষ্টি যদি না হত, গান্ধী যদি হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস না গড়ে তুলতেন তাহলে ব্রিটিশ ভেদ-বিভাজনের রাজনীতি করতে পারত না। ক্ষমতা হস্তান্তর রক্তপাতহীনভাবেই হত কিন্তু তার জন্য এত রক্ত ঝরত না।

    সশস্ত্র বিপ্লবেও এই খামতি ছিল। সেখানে মুসলমানদের ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। ভুললে চলবে না, তার আদর্শ ছিল বঙ্কিম-বিবেকানন্দের হিন্দু পুনর্জাগরণ। কাজেই সেটা ব্যর্থ।

    আর গান্ধীর ৪২-এর আন্দোলনে গান্ধী কোথায়? পুরোটাই ছন্নছাড়া। পরিকল্পনাহীন, নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ যা শেষ করতে ব্রিটিশের সময়ই লাগেনি। এবং সেই গণবিক্ষোভ মোবিলাইজ করার ক্ষেত্রে গান্ধীর অবদান শূন্য। বরং তিনি যদি সত্যি সত্যি মাসকে মোবিলাইজ করতেন তাহলে তার ফল কী হতে পারত তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। 

    ভারতের গ্রামীণ জনতার নাড়ির ছন্দ গান্ধী সব থেকে ভালো বুঝেছেন, কিন্তু তাঁর আন্দোলনে তাঁরা কোথায়? বিপুল কৃষকসমাজ তো তাঁর আন্দোলনে চিরকালই ব্রাত্য। আর তাছাড়া গ্রামীন মানুষ তাঁকে পুজো করেছে অবতাররূপে। এ কাজে গান্ধীর ভূমিকাও আছে, তাঁর অনুগামীদের ভুমিকাও কম নয়।

    ২) জনতার খাতিরে ধার্মিক মেটাফরের প্রয়োগঃ

    ধার্মিক মেটাফর শিক্ষিত জনতা বুঝলেও বুঝতে পারেন, অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বোঝেনি। যিনি ভূমিকম্পকে পাপ হিসেবে চিহ্নিত করেন সেটাকে মেটাফর ভাবা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। সেটা যে আদতে মেটাফর ছিল না, গান্ধীর বিশ্বাস ছিল সেটা সবাই জানেন। আসলে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিলিয়ে ফেলা এবং তারপরে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির আহ্বান জানানো গান্ধীর অন্যতম বড় ভুল। তিনি বাঘের পিঠে উঠেছেন এবং শেষে বাঘ তাঁকে গিলে ফেলেছে।

    ৩) সাভারকর ও গান্ধীঃ

    সাভারকর সম্পর্কে আপনার সঙ্গে সহমত কিন্তু গান্ধী সম্পর্কে নই। কারণ খুব খুঁটিয়ে দেখলে গান্ধীর একমাত্র আন্দোলন অসহযোগ এবং পরবর্তীতে আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন তাঁর আপসের রাস্তা খুলে রাখার জন্য করা। ১৯২১-এর পরে গান্ধীর একটা আন্দোলনের কথা বলুন যেখানে তিনি তাঁর দাবি আদায়ে সমর্থ। এমনকি ১৯২১-এর আন্দোলনও সাম্প্রদায়িকতার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া আন্দোলনের অন্য নাম।

    আর গান্ধী আদৌ জাতপাতের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি বরং তাঁদের সঙ্গে ছলনা করেছেন, যা আলোচিত হয়েছে গান্ধী-আম্বেদকর পর্বে।

  • এবড়োখেবড়ো | 162.158.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২০ ২১:১৩90815
  • এস চক্রবর্তী, আপনার উত্তর বিলম্বে দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

    আসলে জুনাগড়ের সঙ্গে কাশ্মীর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৯৪৬-এর নির্বাচনের আওতায় দেশীয় রাজ্যগুলো ছিল না। ক্যাবিনেট মিশনেও তাদের নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এমনকি অ্যাটলির সরকারি ঘোষণাতেও এই রাজ্যগুলোর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা সুকৌশলে পাশ কাটানো হয়। এমতাবস্থায় ২৭ জুন অর্থাৎ স্বাধীনতার মাত্র ৫০ দিন আগে সরকার ‘দেশীয় রাজ্য বিভাগ’ গঠন করে। এই নতুন দফতরের মন্ত্রী হলেন প্যাটেল, তিনি সচিব হিসেবে বাছলেন ভি পি মেননকে। এই ব্যাপারে প্যাটেল ছাড়াও গান্ধী ও নেহরু এই রাজ্যগুলোকে ভারতের অধীনে নিয়ে আসার ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেনকে অনুরোধ করেন। ১৫ অগস্টের আগেই প্রায় সব দেশীয় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও যে তিনটে বড় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি তার অন্যতম ছিল জুনাগড়।

    জুনাগড়ের প্রধান বন্দরনগর ভেরাবল থেকে করাচির দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। এখানকার নবাব ছিলেন মুসলমান এবং ৮২% প্রজা ছিলেন হিন্দু অর্থাৎ কাশ্মীরের ঠিক উল্টো। জুনাগড় পাকিস্তানভুক্ত হল। জুনাগড়ের পাকিস্তানভুক্তির বিষয়টা প্যাটেলের অহং-এ আঘাত হানল। একে তো গুজরাট তাঁর খাসতালুক, তার ওপরে ওই জুনাগড়েই আছে সোমনাথ মন্দির। ফলে যে প্যাটেল নেহরুর কাশ্মীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা নিয়ে ততটা আগ্রহী ছিলেন না, সেই একই প্যাটেল এবার জুনাগড়ের পাশাপাশি কাশ্মীর নিয়েও উদ্যোগী হলেন। জুনাগড় ভারতের দখলে আসল ৯ নভেম্বর, পাশাপাশি ৭১% মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীরকেও ভারতভুক্ত করা হল ২৬ অক্টোবর। জুনাগড় পাকিস্তানে না গেলে কাশ্মীর নিয়ে প্যাটেল আদৌ আগ্রহী হতেন কি না তা লক্ষ টাকার প্রশ্ন। প্রসঙ্গত জুনাগড়ের ক্ষেত্রে কিন্তু গণভোট নেওয়া হয়েছিল অথচ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ।

  • শুভাঞ্জন চক্রবর্তী | 73.169.***.*** | ২৬ আগস্ট ২০২০ ১২:৩৫96670
  • অসাধারণ লেখা।  সমৃদ্ধ হলাম। 

  • অভিজিৎ কর গুপ্ত | 103.77.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২০ ২০:১২98777
  • প্রতিবেদন শেষে ৫৮ টি বইএর তালিকা দেখে কৌতুক বোধ হলো। গান্ধি কিছু বিশেষ ধরনের স্বঘোষিত গবেষকদের নিরাপদ বিষয়। যথেচ্ছ কাঁটা ছেঁড়া করা যায়। এবং সেটা মাত্র গোটা কয়েক বই পড়েই! বিস্তৃত আলোচানা করার আগ্রহ বোধ করছি না। শুধু একটা ছোট্ট প্রশ্ন: গান্ধীর সল্ট মার্চ নিয়ে একটি বাক্য না থাকার কারণ কি? মাত্র ২৬ দিনের ঐ মার্চ Peshwar থেকে Chitagung পর্যন্ত কি অভিঘাত তৈরি করেছিল, সে সম্পর্কে কোনো বইএর সন্ধান কি গবেষক (!) পাননি!  গান্ধি মারা যাবার মাস তিনেক পরে নেহরু বেশকিছু মানুষকে নিয়ে বসে ছিলেন সেবা গ্রামে। আলোচনার বিষয় ছিল, গান্ধি হত্যা। এর ঠিক ৬০ বছর পর ২০০৮ এ সবরমতি আশ্রমে বেশ কিছু গবেষক আলোচনায় বসেেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এই বাংলার পার্থ চট্টোপাধ্যায়। 


    ওই আলোচনাও বই আকারে বেরিয়েছে। বর্তমান গবেষক বোধহয় নামও শোনেন নি !!???


    লেখককে অনুরোধ করে লাভ হবে কিনা জানিনা, কারণ উনি যথেষ্ট সচেতন ভাবেই অর্ধ এবং অসত্য প্রচারে পারঙ্গম, তবুও বলছি, আমি আরো ১৫৮ টা বইএর তালিকা দিতে পারি, যে সম্ভার লেখকের যুক্তিবিন্যাসকে নস্যাৎ করতে পারে । এযুগটাই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার যুগ।" It is the age of burrying the truth "


    ব্রাভো !!! চালিয়ে যান.....

  • ar | 96.23.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০৯:৩৭98800
  • পঞ্চম পর্ব : গান্ধী ও আইন অমান্য — হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের আখ্যান

    "আন্দোলন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ভার গান্ধীর ওপর অর্পণ করা হয়। ভারতের শ্রমিকশ্রেণিকে আন্দোলন থেকে দূরে রেখে এবং কৃষকদের খাজনা বন্ধ আন্দোলন থেকে বিরত রাখার আহ্বান জানিয়ে গান্ধী দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়ে জানান, “যতদিন পর্যন্ত একজন আইন ভঙ্গকারী মুক্ত বা জীবিত থাকবেন, আইন অমান্য ততদিন চলবে” (ইয়ং ইন্ডিয়া ২০-২-১৯৩০)। এক সপ্তাহ পরে ওই পত্রিকায় তিনি লেখেন: “So far as I am concerned, my intention is to start the movement only through the inmates of the Ashram and those who have submitted to its discipline and assimilated the spirit of its methods” (CWMG, ৪৮/৩৪৮)। অতঃপর নিজ হাতে বেছে নেওয়া ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ সাবরমতী আশ্রম থেকে শুরু হয় তাঁর লবণ সত্যাগ্রহ। "

  • ইয়ে, | 115.114.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ১১:২১98806
  • কিন্তু আমরা ১৫৮ টা বইয়ের লিস্ট পেতে আগ্রহী। যুক্তিবিন্যাসকে নস্যাৎ করাটাও জানতে চাই। পয়েন্ট ধরে ধরে রেফারেন্সের পাতা বলে দিলেই হবে। বেশি কিছু লিখতে হবে না। প্লিজ।

  • কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ০৫ জুলাই ২০২৪ ২২:৫৯534226
  • ফ্রান্সিস ট্যাকারের মন্তব্যের তথ্যসূত্রটা দিতে পারবেন @এলেবেলে দা? একটু দরকার ছিল
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন