রাস্তা পার হয়ে স্টেশনে প্রবেশ করতেই উল্টোদিকে চায়ের দোকান দেখে তিয়াসার খুব আনন্দ হল। যে বাসটায় চেপে সে স্টেশনে এল সেটা জ্যামের জন্য আধ ঘণ্টা লেট। ততক্ষণে ড্রিম এক্সপ্রেস ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। পরের ট্রেন সাড়ে তিন ঘন্টা পর। সেই সময়টা তাকে কাটাতে হবে ওয়েটিং রুমে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে, অথবা লো দেখে। সাধারণত সে কোথাও একা গেলে পড়ার জন্য সব সময় বই সঙ্গে রাখে। এখনো আছে।
ওয়েটিং রুমের শোরগোল, বাচ্চাদের হুটোপুটি, মাটিতে চাদর পেতে খাওয়া দাওয়া, পুরো পরিবেশটাই তার বিরক্ত লাগছে। বই পড়তে গেলে মনঃসংযোগ দরকার৷ এরকম জায়গায় তা অসম্ভব। তাছাড়া এখন পড়ে নিলে ট্রেনেই বা কী পড়বে? প্রায় ৯০ পৃষ্ঠার মত এখনও বাকি৷ একা জার্নির জন্য যথেষ্ট।
তাহলে কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে চারদিকে চোখ ঘোরালো সে। স্টেশনের বাইরেই একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত টি শপ। সব জায়গায় আজকাল কফি শপ দেখা যায়। কিন্তু টি শপ ব্যাপারটা তার কাছে নতুন মনে হল। তাই সেখানেই যাওয়া মনস্থ করল সে।
পড়ন্ত দুপুর। এই সময়টায় সে চায়ের সঙ্গে হাল্কা কিছু খেতেই পছন্দ করে। কিন্তু... কী যেন একটা ভাবতে ভাবতে সে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল স্টেশনের মূল গেটেই।
আসলে তিয়াসা ভাবছিল কী করবে তার স্যুটকেস নিয়ে৷ বেশ ভারি সেটা। বাড়ি থেকে বেরোবার সময়কার ঝিরঝির বৃষ্টি এখন বেশ জোরে পড়ছে, এতক্ষণ এটাকে বয়ে বেরানোর কোন মানে হয় না৷ তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজে যাবার ব্যাপারটা তো আছেই। অগত্যা আবার ওয়েটিং রুমেই ফিরে এল তিয়াসা।
সেখানে তখন প্রায় ঠেসাঠেসি ভিড়। দাঁড়াবারও জায়গা নেই। তার মধ্যেই কতকগুলো বাচ্চা একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। বোধহয় খিদে পেয়েছে। অথচ বসে খাওয়াবার জায়গা নেই। মা-বাবা চেষ্টা করছে ভোলাতে। কিন্তু তাদের কান্না আরো বেড়ে যাচ্ছে এত লোকের চাপে।
তিয়াসা ভেতরে না ঢুকে বেরিয়ে এসে ডানদিকে তাকাল। তখনই মাল রাখার কাউন্টারের ঘরটি চোখে পড়লো। কাউন্টারের সামনে আসা মাত্র কাউন্টারের ওপাশে থাকা বেঁটে, মাথায় পাগড়ি বাঁধা, চোখ ছোট, কালো রঙের বয়স্ক লোকটাকে দেখা গেল৷ তিয়াসার ধারণা এ ধরণের লোকেরা সারাদিন নেশা করে। এই লোকটাও খৈনি হাতে নিয়ে ঢলছে। সে সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র এক হাত মুঠো করে পলকে অন্য হাতেই তুলে নিল বেশ ভারী স্যুটকেসটা, সঙ্গে ধরিয়ে দিল একটা টোকেন। সেখান থেকে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে স্টেশনের বাইরে এল তিয়াসা।
বৃষ্টির বহর দেখে টপ, প্যান্ট, জুতো, ঝোলানো হ্যান্ডব্যাগের সঙ্গে মানানসই ছাতাটা খুলল। ছিটকে গায়ে জল আসতে পারে বলে দুটো গাড়িকে পার হতে দিল৷ তারপর ছোট ছোট পা ফেলে মৃদু ছন্দে সামনে এগিয়ে গেল। দেখে বুঝে পা ফেললেও জলের ছিটেয় প্যান্টের নিচটা সামান্য ভিজল৷ সেদিকে তাকিয়ে একটু ভ্রু কুঁচকে প্রায় কচ্ছপের গতিতে রাস্তা পার হল। দোকানের সামনের ছাউনিতে পৌঁছে ছাতা বন্ধ করার সময় তাতে আটকে থাকা বৃষ্টির জল কিছুটা ছিটকে পড়ল গায়ে।
বেশ বিরক্তি নিয়েই দরজায় দাঁড়িয়ে সে দেখে নিল লম্বা কামরার চারপাশটা। গাঢ় নীল রঙের শার্ট ও নীল প্যান্ট পরা, মাঝারি গড়ন, গোঁফওয়ালা, মাথায় সাদা টুপি পরা মধ্যবয়সী ওয়েটার কাউন্টারের ডানদিকে দাঁড়িয়ে। আর আছে পাতলা, বাদামী রঙ করা চুলের বড় ফ্রেমের চশমাওয়ালা হিসাবরক্ষক। মনোযোগ দিয়ে মাথা নিচু করে হিসেবের খাতায় লিখছিল কী যেন একটা৷ তারও পরনে একই পোষাক, রংটা খালি আলাদা। নীলের বদলে হলুদ।
খুব বেশি খরিদ্দার তখন সেখানে ছিল না। দরজার বাঁ পাশের কোনে বসা বয়স্ক লোকটি মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিয়াসা ভেতরে ঢুকলে তিনি কাগজ থেকে চোখ তুলে সামান্য সময় তার দিকে তাকালেন। পর মুহূর্তেই আবার পড়ায় মগ্ন হয়ে গেলেন৷ ভাবটা এমন যেন সারা পৃথিবীর খবর তাঁকে আজই মুখস্থ করে পরীক্ষায় বসতে হবে।
সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো সে। রাস্তার দিকের বড় জানালার পাশেই বসেছিল কমবয়সী একজোড়া কপোত কপোতী৷ টেবিলে সামনাসামনি বেশ ঝুঁকে তারা, আর তাতে দুজনের ঠোঁট নাক ছুঁই ছুঁই।তারা নিচু স্বরে কথা বলছিল৷
কামরার শেষটায় গাঢ় নীল রঙের কামিজ আর একই রঙের ওড়না নেওয়া এক মহিলাও ছিল৷ কনুই ভাঁজ করে টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে বেশ চিন্তায় মগ্ন হয়ে সামনে রাখা কাপগুলো দেখছিল সে৷
জানালা থেকে একটু দূরে খালি একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল তিয়াসা৷ স্লিং ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে চেয়ারের হাতলে ঝুলিয়ে বাঁদিকে ছাতাটা রেখে দিল সে৷ তারপর নীল কুশনের মজবুত চেয়ারে বসে মনে হল যেন ডুবে গেল চেয়ারের গভীরে৷
প্রথমে তার নীল কভারের লম্বা, সোনালি কালিতে লেখা মেনু কার্ডটা খুলে দেখতে ইচ্ছা করছিল না৷ দুপুরে সাধারণত ব্ল্যাক চা আর হাল্কা কোনো বিস্কুটে অভ্যস্ত সে৷ খুব বেশি ব্যতিক্রম নেই তার নিত্যদিনের জীবনে৷ কিন্তু আজ হঠাৎ করেই আলাদা কিছু একটা করবে বলে ভাবল৷ কারণ আজকের দিনটা অন্য দিনের তুলনায় একদম আলাদা। সেই সঙ্গে চারপাশটাও বেশ অদ্ভুত লাগছে তার৷ এমনটা লাগেনি এই চায়ের দোকানে আসার আগেও৷ চায়ের বদলে নতুন কোনো সফট ড্রিঙ্ক কিম্বা অন্য কোনো স্ন্যাক্সও খাওয়া যেতে পারে ভেবে মেনু কার্ডটা হাতে তুলে নিল।
পুরো চার পৃষ্ঠা লেখায় ভরা মেনুটা৷ অবাক হয়ে দেখল কার্ডের সবটা জুড়েই নানা চায়ের নাম। অন্য কিছুর নামই নেই। আবার সেগুলোর মধ্যেও বেশিরভাগ চায়ের নামই শোনেনি৷ যদিও সেই ছোটবেলা থেকেই সে এই গরম পানীয়টা বারবার পানে অভ্যস্ত৷ এই অভ্যাসের সূচনা দিদার হাত ধরে। পরীক্ষার আগে রাতের ঘুম তাড়াতে দিদা বলতেন, এর মত ভাল জিনিস আর নেই। আরো বলেছিলেন চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। চা পাতা কার্যত চা গাছের পাতা, পর্ব ও মুকুলের একটি কৃষিজাত পণ্য যা বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। ইংরজিতে চা-এর প্রতিশব্দ হলো টি। গ্রিকদেবী থিয়ার নামানুসারে এর নাম হয় টি। চিনে ‘টি’-এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’। পরে হয়ে যায় চা। চিন দেশই চায়ের আদি জন্মভূমি।
সেই রাতে দিদার কাছে থেকেই গল্পের মত শোনা, বিশ্বের মধ্যে চিনেই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ।
দিদা এখন শুধুই স্মৃতি- এইসব ভাবতে ভাবতে মেনুটা দেখছিল সে। সেখানে চায়ের দীর্ঘ তালিকা পড়তে পড়তে সে অবাক হচ্ছিল। কতটা অজানায় আটকে ছিল সে এতদিন৷ এক সময় মনে হতো কম জানা ভাল। তাতে অনেক প্রলোভন থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু এখন তার আফশোস হচ্ছে নিজের স্বল্প জ্ঞানের কথা ভেবে। নিজেকে তার মনে হল কুয়োর মধ্যে আটকে পড়া ব্যাঙ, যে কোনোদিন জানতেই পারল না তার কুয়োর বাইরেও বিশাল জলরাশি আছে।
না, এখন আমার উচিত কুয়োয় আটকে না থেকে জীবনটাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য উপভোগ করা, নিজের মনেই বিড়বিড় করল তিয়াসা। তার জানা চা-এর সংখ্যাটা খুবই মামুলি এইসব হরেক চায়ের তুলনায়। কালো চা, সবুজ চা, হার্বাল চা, দুধ চা আর সাদা চায়ের বাইরেও যে এত স্বাদের চা হতে পারে তা তার জানাই ছিল না।
মেনু কার্ডে চায়ের নামগুলোর সাথে তাদের সুফলের দিকটিও লেখা ছিল৷ কিছু বর্ণনা অবাক করার মতন। কিছু কিছু পড়ে হাসি খেলে গেল ঠোঁটে, আবার কয়েকটা পড়ে তো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল কিছুক্ষণ৷ বাঁধাকপি, পেঁয়াজ পাতা আর গাজর দিয়ে যে চা হয় সে জানত না৷ এও জানা ছিল না জেসমিনের চায়ে থাকে জেসমিন ফুল ও তেল সহ এলাচ দারচিনি লবঙ্গের গুঁড়ো। এই চা পানে স্নায়ু শান্ত হয়ে স্বপ্ন দেখে জীবনের। নেটেলের চায়ে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়৷ মসের চা ধীরে ধীরে স্নায়ুকে শান্ত করে। ওদিকে প্যাপিরাসের চা অভিসারের সলতেটা উসকে দেয়৷
পৃষ্ঠা চারে দেওয়া আছে চমকপ্রদ কিছু চায়ের নামের তালিকা৷ পড়ে বেশ পুলকিত অবস্থা তার৷ এদের পান না করে, তৃপ্তি না পেলে অপূর্ণতা রইবে জীবনে৷ নামগুলোর মাঝেই চমকের স্বাদ আছে৷ হয়ত জিজ্ঞাসা করতে পারা যায় কী দিয়ে তৈরি এগুলো, কিন্তু রহস্য উন্মোচনের আশঙ্কায় তা থেকে বিরত থাকল সে৷
বাতাসের চা আলস্য দূর করে, মেঘের চা নিয়ে আসে ওড়ার অভিলাষ, জ্যোৎস্না চায়ে প্রলুব্ধ হয় অন্তরের ধীর বহমানতা, বসন্তের চায়ে তারুণ্যের উপলব্ধি, নিশীথের চায়ে আসে কামুকতার স্বপ্নেরা, নৈঃশব্দ্যের চা পুর্ণতা আনে নীরবতার, প্রাবল্যতার চায়ে আনে আনন্দ, শীতল চায়ে প্রত্যাশা আশার৷ যেকোন একটা পছন্দ করতেই পারে৷ আবার সবকটা চায়ের মিশ্রণ হতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট। এ যেন ফ্রায়েড রাইসে সব কিছু মিশিয়ে স্পেশাল রাইসের মতো। আসলে পৃথিবীর বেশিরভাগ খাবার ও পানীয়র তালিকাই তার কাছে অজানা৷
সে আবার তালিকাটা প্রথম থেকে পড়ল। তার পছন্দ হলো মেনুর সব শেষেরটা - গল্প চা৷ ‘এটাই দরকার আপনার’, নির্দেশিত এই পরামর্শে প্রতিদিনের সঙ্গী গল্পই বেছে নিল সে৷ তার ভাল লাগে রোজ চা পানের মত কোনো না কোনো বই পড়তে৷ হতে পারে তা প্রেমের যার মিলন নেই, হতে পারে গা ছমছম রহস্য, বা গোয়েন্দা কাহিনী, হতে পারে যুদ্ধের, কিংবা নেহাতই মামুলি কোনো জীবনের ,আবার মহামানবদের মহান কথাও হতে পারে, বা একেবারেই কোনো ধর্মগ্রন্থ...
‘আসল বিষয়টা হল মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল না থাকলে বাস্তবের চেয়ে গল্পের ভুবনের মু্গ্ধতা জীবনপ্রবাহে মিশে যায়৷ যদিও শেষে ফিরে আসে প্রবহমানকালের আবহমান বার্তা, তবু গ্রন্থের সংযোগে বিচ্যুতি ঘটে না৷ পরের গল্প পাঠেই সব দুঃখ দূর হয়ে যায়’- এই অভূতপূর্ব বিজ্ঞাপন দেওয়া চায়ের আকর্ষণ যথার্থই পছন্দ হয়ে গেল তার৷
মেনু কার্ড বন্ধ করে টেবিলে রাখতে না রাখতেই হাস্যোজ্জ্বল ওয়েটার এসে বলল, গুড আফটারনুন ম্যাডাম, কী দেব?
স্মিতহাস্যে প্রতি-উত্তরে স্মিত হেসে সে বললো, গল্প চা৷
খুব নিচু স্বরে বললেও সে লক্ষ করল, টি-শপের নীরবতায় তার মৃদু উচ্চারণ সবার কানে পৌঁছেছে ৷ হিসাবরক্ষক লেখা থামিয়ে চেয়ে রইল তার টেবিলের দিকে৷ প্রবেশ পথের সেই বয়স্ক লোকটা খবরের কাগজের উপর দিয়ে এদিকে ফিরে তাকাল৷ আর এতক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত যুগলের চোখেরা যুগপৎ মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে রইল৷ এমনকি অন্য টেবিলের গাঢ় নীল রঙের পোষাক পরা মহিলা কাপ দেখা থামিয়ে দিয়ে কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকালো৷
সেদিকে লক্ষ করে চোখ ঘুরিয়ে নিল তিয়াসা৷ নিজেকে মনে হল যেন কোনো মস্ত অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে৷ সেটা আবার নিজের দোষেই৷ হয়ত ক্যামোমিলের চায়ের অর্ডার দেওয়া উচিত ছিল, কিংবা দার্জিলিং চা। তাতে বোধহয় কেউ ফিরেও তাকাতো না৷ নিজের অজান্তেই চেয়ে ফেলল গল্প চা, কী ভাবল সবাই?
হাসিমুখ ওয়েটারের কথায় বেঁচে গেল এ যাত্রায়৷
ঠিক আছে ম্যাডাম, এখনই আনছি৷
খুব ভালোলাগল ১ম পর্ব। পরেরটার অপেক্ষায়।..
অসাধারণ লাগলো
অভিনব বিষয়, খুব ভালো লাগলো। কৌতুহল বাড়ালো...
টেক টাচ টকের লেখাটির নিরিখে একেবারে ভিন্ন স্বাদের, এগিয়ে চলুক
চলুক।পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা।
খুব ভালো
খুব ভালো লাগলো। ভিন্ন স্বাদের লেখা।
দারুণ পটভূমিকা। দারুণ কনসেপ্ট। 'গল্প চা' চলুক।
পড়লাম