এই মেয়েটি কি সেই নার্স বাসনা যে সার্কাসের মঞ্চ থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছিল? নাকি অন্য কেউ? তিয়াসার প্রশ্নে যুবক তার বলা থামিয়ে সামনে রাখা জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগল। তিয়াসা অস্থির হছিল। এর পরে কী চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য সে বুঝতে চাইছিল।
সামনে বসা যুবকের কোনও হেলদোল লক্ষ্য করা গেল না। বাইরে থেকে বাসের হর্নের শব্দ হঠাৎ যেন টি শপের ভিতরের নীরবতাকে ভেঙে তছনছ করে দিল। তাতেই যেন ভাষা ফিরে এল যুবতীর। এতক্ষণ ধরে বলে যাওয়া গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে থেকে সে বেছে নিল সেই প্রফেসরের স্ত্রীকে। তারপর শুরু করল নতুন অথচ ধারাবাহিক বিবৃতি।
ডাক্তার মারা যাবার পর সেই মহিলা সেই মরুভূমি অঞ্চলের কষ্টকর যাত্রা শেষ ট্রেনে চড়ে বসলো৷ আর ঝেড়ে ফেলতে চাইল স্মৃতিগুলো, যেগুলো আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন তিনি এতদিন৷ পুরো বগিতেই অনেকটা সময় একাই ছিলেন তিনি৷ পরে ছোট্ট এক শহরের স্টেশনে এক বৃদ্ধ সঙ্গী জুটলো। সেই শহরের পাশেই ছিল লম্বা পাইন গাছ ভর্তি এক কবরখানা, যার পাহারাদার ছিল এই বৃদ্ধ।
ভদ্র, বয়স্ক লোকটিকে যাত্রাসঙ্গী হিসেবে পেয়ে তিনি বেশ খুশি হলেন৷ লোকটি মহিলাকে দেখে স্মিত হেসে জানালার ধারে বসলেন।তারপর গভীর দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলেন৷ এমন আচরণ ভালো লাগল না মহিলার। তিনি অনেকটা পথ একা থাকায় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন কথা বলার জন্য। কিন্তু তার সহযাত্রী একবারেই নীরব। ফলে দু’একবার চেষ্টা করেও ইতিবাচক উত্তর না পেয়ে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
এভাবেই আরো কিছুক্ষণ চলল।
ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল দুধারের দৃশ্যাবলী। আকাশ যে কত সুন্দর- এই সকালের আলোয় তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। সবুজ আর নীল এখানে মিলেমিশে একাকার। কোথাও সোনালী আলো ঠিকরে বেরচ্ছে, আবার কোথাও ঘন নীলের ফাঁকে সাদা, কোথাও বুঝি বা সে দুখী, আনমনা, ধূসর চুল মেলে দিয়ে সবুজ বাগিচায় থমথমে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটা নদীর উপরের ব্রিজ দিয়ে ট্রেন ঝমঝম শব্দ করে এগিয়ে চলল সামনে। হয়তো কখনো এটা বিশাল ছিল। কিন্তু এখন সেটা একটা মৃতপ্রায় নালার মত। কেবল বন্যা এলে সে ভয়ার্ত গতীতে তীব্র বেগে বুঝি পালাতে চায়...তখনি দূ্কূল ভেসে যায় তার কান্নায়...নদীর কান্না কি কেউ শুনেছে? বড় বেদনার, যন্ত্রণার... এত নিষ্ঠুরতা, এত গ্লানি, এত দৈন্য সে যে আর মানতে পারছে না।
মহিলা নিজের মনেই কথা বলছিল। নদীও আমার মতই দুঃখী। তাই তো কখনো সে ফল্গু হয়ে মুখ লুকাচ্ছে লজ্জায়, ঘৃণায়, অভিমানে...সে যে মা, কিংবা বাবা...তার সন্তান সন্ততির কঠিন ব্যধী... সে কি করে!! আবার কখনো রাগে সে মুছে দিতে চাইছে তাকে ঘিরে বেড়ে ওঠা পচা গন্ধ বেরনো এই মানুষ নাম্নী নরকের কীটের থেকেও অধম জীবকে...
আকাশ আবার রঙ বদলে ফেলেছে। ঘন কালো মেঘ। পুকুরের জলেও তার ছায়া। কতগুলো সাদা হাঁস কি যেন খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিসের সন্ধান তাদের কে জানে! তারাও বোধহয় আমার মতই ভালবাসা খুঁজছে, ভেবে চোখ জলে ভরে উঠল মহিলার।
আরো চারটে স্টেশন পরে নতুন এক যাত্রী বগিতে উঠল৷ কেতা-দুরস্ত, সুন্দর পোশাক পরা মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক৷ বিনা বাক্যে তিনি দরজার পাশের সিটে বসে পড়লেন৷ তিনিও আগের যাত্রীর মতই চুপ থাকলেন।ফলে সেই একই নিঃস্তব্ধ নীরবতা পুরো বগি জুড়ে থাকলো। এমনই চলল কোন এক টানেলে অপ্রত্যাশিত থেমে না যাওয়া পর্যন্ত৷ ট্রেনের ইথারে ভেসে এলো, বড় এক পাথরখণ্ড লাইন জুড়ে পড়ে আছে। সেটা সরাতে প্রায় তিরিশ মিনিট মতো লাগতে পারে৷ কামরার আলো নিভে গেল ঘোষানার পরেই। তিন জন যাত্রীর কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে গেল না। এমনকি কেউ কাউকে কিছু বললও না৷
সেই গভীর নীরবতার পর্ব শেষ করে যখন টানেল থেকে ট্রেন বেরিয়ে এল দেখা গেল সর্বশেষে ওঠা যাত্রীটিই একমাত্র একই জায়গায় সোজা হয়ে বসে আছে৷ অপর দুই যাত্রীর কী ঘটেছে তা অন্ধকারে ঢাকা রইল৷ কোনও চিহ্নই নেই তাদের। এমনকি তাদের বাক্স-প্যাটরাও নেই সেখানে ৷
গন্তব্যে পৌঁছে সেই যাত্রীটি নেমে পড়লো৷ প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই সে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত নিল৷ সে আর গোপীনাথের সন্তান পরিচয় বহন করবে না৷ নতুন কোনো পরিচয়ে বাঁচবে সে। তারপর সে মালঘরটার খোঁজ করতে লাগল, যে ঘরে আজ দুপুরে একটি সুন্দরী মধ্যবয়সী মেয়ে তার ভারী স্যুটকেসটা রেখে এসেছে। ওর মধ্যেই জমা রয়েছে তার এতদিনের না বলা সব গল্প কিম্বা ভালবাসা।
গল্পকার একটানা বলা শেষ করে তিয়াসার দিকে তাকালো। যেন কোনও যোগসূত্র খুঁজে বের করতে চাইছে তিয়াসার মুখের দিকে চেয়ে। যেন তিয়াসার চোখের মধ্যেই লুকিয়ে বাকি গল্পটা।
আরো কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। তিয়াসা হাততালি না দিয়ে স্থির হয়ে বসে তাকিয়ে রইলো গাঢ় নীল রঙা জামা পরা মহিলা ও বয়স্ক ভদ্রলোকটির দিকে৷ তারা এবার হেসে -উঠি, ভালো থাকবেন। বলে ফিরে গেল নিজেদের বসার জায়গায়৷
প্রতিটি সংখ্যাই অনবদ্য। টানটান রহস্য। কী হয়, কী হয়! চলতে থাকুক।
ট্রেন যাত্রাটি গল্পের মোচড় যেন। পরের পর্বের অপেক্ষা
চলছি ধারাবাহিকৃর সাথে
পুরো গল্পটাই পড়লাম। টানটান কিন্তু কেন জানি না আমার অনুবাদ গল্পের মত মানে হল