চা শেষ করে তিয়াসা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না গল্প চায়ের পর্ব শেষ হল কিনা! তার মনে হল অসম্পূর্ণই রয়ে গেল শেষে৷ হয়ত ম্যানেজার বা ওয়েটার ফিরে আসবে মঞ্চে, নয়তো দুজনেই একসঙ্গে৷ এমন হলে এখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷ দেখা যাক এরপর কী ঘটে!
তাকে সম্পূর্ণভাবে অবাক করে নতুন এক জোড়া টেবিলের দিকে এগিয়ে এল৷ নীল রঙের কামিজ আর ওড়না পরা মেয়েটি আর এতক্ষণ খবরের কাগজ পড়া সেই লোকটি৷
লোকটি মাথা ঝুঁকিয়ে বসার অনুমতি চাইল আর মেয়েটি হাসল। তারপর দু’জনেই তার সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ল৷ কোনো ভূমিকা না দিয়েই মেয়েটি গল্প বলা শুরু করে দিল৷
বাড়ি ফিরে প্রফেসরের কাঁপুনি দিয়ে তুমুল জ্বর এল। ঘোরের মধ্যে তিনি কেবল সেই মেয়েটির কথাই বলছিলেন। মেয়েটি কি সেখানেই রয়ে গেল? সেই প্রাচীন মন্দিরের মেঝে ফাঁক হয়ে সে কি চিরকালের মতো হারিয়ে গেল! তিনি অনেকটাই বদলে গেলেন এরপর৷ এই সব ঘটনার জন্য তিনি দোষ দিলেন বউকে।
তাঁর এই নির্লজ্জ আচরণে অপমানে রাগে দুঃখে তাঁর স্ত্রী নিজের শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেলেন৷ যোগ দিলেন অন্য এক সংস্থায়, এরা বিশ্বের নানা অঞ্চলে অসহায় গরীব লোকেদের সাহায্যের জন্য কাজ করত৷ প্রথম কাজে যোগ দিয়েই মহিলার কর্মকেন্দ্র হল মরু প্রান্তে। সেখানে তীব্র দাবদাহ। ঠিকমত পানীয় জল বা খাবার যোগাড় করাই দুষ্কর হয়ে পড়ল তাঁর পক্ষে।ফলে দ্রুত তিনি নিজেই নানান রোগে জর্জরিত হয়ে পড়লেন৷ সেখানে পরিচয় হলো এক সুদর্শন ডাক্তারের সঙ্গে। তিনি এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। দিনরাত পরিচর্যা করে সারিয়ে তুললেন তাঁকে।
সুস্থ হয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতে তার প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলেন মহিলা৷ যদিও ডাক্তার ছেলেটি তার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোটো৷
বয়স দিয়ে কি ভালবাসা বা সম্পর্ক হয়? সম্পর্ক হয় দুটি মনের মিলনে। অন্য কোনো কিছুই সেখানে ম্যাটার করে না। এই তো সেদিন কাগজে দেখলাম ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের থেকে ফার্স্ট লেডি প্রায় তিরিশ বছরের বড়। তাতে কী যায় আসে! বেশ তো সুখে আছে তাঁরা। নিজের মনে বলে তিয়াসা এরপরের কাহিনী শোনার দিকে মন দিল।
দুখী সেই মহিলা অবশ্য নিজের মনের মধ্যেই এই কথা চেপে রাখলেন৷ ডাক্তার ছেলেটি এবার এই রোগে আক্রান্ত হলো। এই রোগে রোগীর প্রথমে খাওয়া ঘুম বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় সে৷ এক্ষেত্রেও মনে হলো কিছুই আর করার নেই৷ হাসপাতালে যেতে রাজি হল না ছেলেটি। শেষ পর্যন্ত টেন্টেই রয়ে গেল৷ মহিলা কখনই তার পাশ ছেড়ে গেলেন না। দিন রাত তার সেবায় নিয়জিত থাকল। ততদিনে ছেলেটি তার জীবনীশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে৷ যখন বাঁচার আর কোনও আশা নেই, মহিলা তার ভালবাসার কথা তাকে জানালো৷
আমি এমনই কিছু আশা করছিলাম। টিপিক্যাল শরৎচন্দ্র। যতই আধুনিক হও এর বাইরে আর কিছু হবার নেই। তিয়াসা ভাবল।
ছেলেটি তার কথা বিশ্বাসই করতে চাইলো না৷ বলতে লাগল, তার অবস্থা দেখে তার প্রতি মায়ায় সে এমন বলছে৷ এ কথা শুনে মহিলার মনে হতে লাগল সেও যেন একই রোগে জর্জরিত হয়। এটাই হবে তার ভালবাসার প্রমাণ৷ তার মনষ্কামনা অপূর্ণই রইল। মৃত্যু আরো দ্রুত কড়া নাড়ল৷ তার কোলেতে মাথা রেখে ছেলেটি মারা গেল৷ মানুষটা বিশ্বাসই করল না তার ভালবাসার কথা, এই ভেবে তিনি আরো কষ্টে, মনের যন্ত্রনায় পুড়তে লাগলেন৷ বেশ কিছুদিন একা থাকার পর তিনি নিজের পুরোনো শহরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ এই জায়গাটা তাঁর অসহ্য লাগছিল।
এই অবধি পুরোটাই বিরতিহীন৷ নীল রঙা জামা পরা মহিলাটি যেই মাত্র শেষ করল লোকটি দক্ষতার সাথে সুতোর সেই প্রান্তটি ধরে ফেলল৷ যেন রিলে রেসের স্কেল। একজন দিলেই আরেকজন দৌড়তে শুরু করবে,শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সেই বুড়ো আসামী জেল থেকে বেরিয়ে একবছর কাটালো গরীবদের জন্য তৈরি পাগলা গারদে৷ অবশেষে সে সেরে উঠল। যদিও তার কাছ থেকে জানা গেল না সেই বিভীষিকাময় রাতে কী ঘটেছিল জেলখানায়৷ এও জানা গেল না অন্য কয়েদীই বা কোথায় উবে গেল।
মুক্ত মানুষ হয়ে এক কবরখানার পাহারাদার হিসেবে কাজে যোগ দিল সে৷ সেখানে তার নজর পড়ল এক অল্পবয়সী মহিলার প্রতি। মহিলা প্রতি সপ্তাহের সোমবার সকাল এগারোটার পর আসতো৷ তখন খুব একটা দর্শনার্থী থাকে না সেখানে ৷
তার পরনে থাকে দামি শালোয়ার আর সবসময় চোখে রোদ চশমা৷ এসেই সোজা চলে যায় দশ বছরেরও বেশিদিন ধরে শুয়ে থাকা অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপকের কবরের দিকে৷ কবরের পাশেই সে বাদামী রঙের চাদর বিছিয়ে বসে। ব্যাগ থেকে দাবার বোর্ডটা বের করে৷ এক এক করে গুটিগুলো সাজিয়ে খেলা শুরু করত, সাদা-ই বেছে নিত সবসময় ৷ একটা করে চাল দিত আর কিছুক্ষণ কবরের দিকে তাকিয়ে একটা কালো গুটি সামনে বাড়াতো, যেন মনে হয় সে নির্দেশ শুনছে কারো৷ মাঝে মাঝে নিষ্পত্তি ছাড়াই খেলা শেষ হতো৷ বিকেল পাঁচটার দিকে চলে যেত সে৷
এই সেই অধ্যাপকের সমাধি, যিনি ডাকটিকিট জমাতেন। হাসপাতালে আগুন লেগে যিনি পুড়ে মারা গেছিলেন। এই কথা শুনে, ইন্টারেস্টিং, বলে ঠোঁট বেঁকিয়ে নিজের মনেই হাসল তিয়াসা।
বুড়ো নিজেও একসময় দাবাড়ু ছিল। তাই সে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠল খেলার জন্য৷ শুরুর দিকে দূর থেকে সে দেখত মহিলাকে, পরে ধীরে ধীরে এই দূরত্ব কমতে লাগলো৷ অবশ্য তার মনে একটা ভয় কাজ করতো। হয়ত মহিলা তাকে বিরক্ত করার জন্য খারাপ কিছু একটা বলবে৷ কিন্তু ভৎর্সনা করার মত তেমন কিছুই ঘটতো না। এমনকি যখন সে মহিলার খুব কাছে, মানে একদম তার পিছনেই দাঁড়িয়ে থাকতো তখনো মহিলা তাকে সেভাবে নজর করত না। বলা তো দূরের কথা! মহিলা আসলে খেলা নিয়েই মগ্ন থাকত। বাকি কিছুর দিকেই তার কোন উৎসাহ ছিল না।
বৃদ্ধ বেশ অবাক হত তার খেলা দেখে।প্রত্যেক বারই চলে যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে মিষ্টি আর নানান রকম বিস্কুট বের করে সমাধির উপর রেখে যেত সে৷ পরেরদিন সকালের মধ্যে পাখিরা খেয়ে সাবাড় করে দিত পুরোটাই৷
এই অবধি শুনে তিয়াসার মনে হল এই টি-শপের মালিকরা বুঝি কোনো একসময় লাতিন আমেরিকার বাসিন্দা ছিল। হয়ত কখনো কাজের জন্য এসেছিল, তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি দেশে। কিন্তু তাদের দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য উঠে এসেছে এই সব গল্পের মধ্য দিয়ে। সব গল্পগুলোর মধ্যেই কোনো না কোনো জাদু, রহস্যময়তা, অথবা পরাবাস্তবতা লুকিয়ে আছে।
পরমুহূর্তেই মনে হল, এ দেশেরও প্রাচীন গল্প বা মহাকাব্যগুলোয় প্রায় এরকমই বিন্যাস। কোনো চরিত্রের বিনাশ হয় না। সব চলতে থাকে যুগের পর যুগ। হয়তো লেখা হচ্ছে হাজার বছরের কোনো দীর্ঘ কাহিনী। অথচ সব চরিত্র তখনো অমর। এই গল্পের নায়িকারা যেন দ্রৌপদীর শাড়ি। আর পুরুষ চরিত্রগুলো কৃষ্ণের এক হাত দিয়ে নেমে আসা শাড়ির পাড়। সেই শাড়ির পাড়ে- ভাঁজে ভাঁজে লুকানো নানান গল্প। কোনোটা বিষাদের, কোনোটা আনন্দের, কোনোটা রহস্যের। যেকোনো মুহূর্তে সেই রহস্য উন্মোচিত হয়ে আবার একটা গল্প কিংবা চরিত্রের উৎপত্তি হবে। সে-ই টেনে নিয়ে যাবে গল্পের পরবর্তী অধ্যায়। তিয়াসা চুপ করে শুনতে লাগল পরের কাহিনি।
এভাবে পাহারাদারের অনেকগুলো মাস কেটে গেল। একদিন সাহস করে তার সঙ্গে খেলতে চাইল সে। শোনামাত্র মহিলা রাজি হয়ে গেল৷ মুখে কিছু না বলে চাদরের অপর দিকে মুখোমুখি বসার ইঙ্গিত দিলো৷ তিন ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পর সে উঠে দাঁড়ালো; অবিশ্বাস্য পরাজয়। যদিও বেশ নিশ্চিত যে, সে কোন ভুল করেনি৷
অতঃপর প্রথমবারের মত মহিলা তার রোদ-চশমা খুলে কথা বলে উঠলো৷ বৃদ্ধকে সে জানালো, এখানে শুয়ে থাকা এই ভদ্রলোক আমার বাবা।মা তাঁকে স্যানিটোরিয়ামে পাঠিয়ে আবার বিয়ে করেছিলেন। সেই সময় আমি মার গর্ভে। কিন্তু মা তাঁকে সেটা না জানিয়েই চলে এসেছিলেন। অবশ্য নতুন এই বিবাহিত জীবনে তিনি সুখী হননি। প্রথম স্বামীকে ছেড়ে আসার দুঃখ তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর সুইসাইড নোট থেকেই আমি জানতে পারি, তাঁর প্রাক্তন স্বামী,আমার বাবা, এখানে শায়িত আর তিনি দাবা খেলতে ভালবাসতেন। আরো জানতে পারি সন্তান পাবার জন্য ব্যকুল ছিলেন তিনি। তাই আমি এখানে আসি তাঁর সঙ্গে খেলতে, তাঁর অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে।
নিজের কথা বলার পর সে আরো বলল, যদি বাঁচতে চাও, ভালবাসা চাও তাহলে চাকরি ছেড়ে চলে যাও এখান থেকে৷ এই জায়গাটা অভিশপ্ত।
একথা শুনে এতটুকু দেরি না করে বৃদ্ধ সোজা অফিসে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দিলো৷ ভাড়া বাড়িতে গিয়ে যা কিছু ছিল তার, গুছিয়ে নিয়ে সোজা স্টেশনে পৌঁছল৷ কেটে নিল অন্য কোনো শহরের ট্রেনের টিকিট।
পড়ছি,
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
পড়ছি, রিপোর্টাজ ধাঁচের উপন্যাস। বিদেশি লেখা বলে হঠাৎ ভ্রম হয়...
আমি ৩/৪ টি জমিয়ে নিিয়ে পড়ে থাকি।
বেশ ভালো লাগছে