এভাবেই কেটে গেল আরো কিছুক্ষণ। তিয়াসা অপেক্ষা করছিল পরের ঘটনা শোনার। সে একবার ভাবল এদের ডাকবে, কিন্তু কী ভেবে সেও তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।
জানলার বাইরে এখন পড়ন্ত বিকেলের আভাস। বৃষ্টি খানিক স্তিমিত। একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র গতিতে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল। দূরে কোথাও কাকেদের কা কা কা...যেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে।
তিয়াসা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিল। সে তার কাপে আরেকবার চুমুক দিল। কি আশ্চর্য! এখনো চা গরম! আজ দিনটাই পুরো অন্যরকম!
আরও খানিক পরে ছেলেটি শুরু করল৷
জাহাজের সেই রাঁধুনি কামু বন্দরে নেমে পড়ে গেল বিপদে৷ সে খাবার জন্য এসে বসেছিল বন্দরের কাছেই এক হোটেলে। সেখানে তখন মাতাল নাবিকেরা চেচাঁমেচি হই-হুল্লোড়ে মত্ত৷ তারা খদ্দেরদের উপরও নানা অত্যাচার, হুজ্জুতি শুরু করে দিল৷ বিশেষ করে সুন্দরী, যৌবনবতী রিসেপশনের মেয়েটির উপর৷ তারা গুন্ডার মতন ছুঁতে চেষ্টা করছিল তাকে৷ এদের মধ্যে একজন বেশ মোটাসোটা চেহারার। সে মেয়েটিকে শক্ত করে জাপটে ধরে কোলের উপর তুলে নিয়ে জোর করে চুমু দিতে চেষ্টা করতে লাগলো৷ মেয়েটি সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করছিল।
এতক্ষণ চুপ থাকলেও এই দেখে কামু আর সহ্য করতে পারলো না। এক মুহূর্তের জন্য চারদিক দেখে নিয়ে সে লাফিয়ে পড়ে অসহায় মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গেল৷
মুহূর্তেই ঘটে গেল অনেক কিছু৷ ঘুষিগুলো উসকে উঠলো, জগ, প্লেট, গ্লাস, চেয়ারগুলো উড়তে লাগলো, ছোরাগুলো ঝলসে উঠল৷ মারপিট যখন শেষ হল, মাতাল নাবিকেরা মেঝেতে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, তাদের একজনের কপাল ফেটে সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। বাকিরা সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ কামুর হাত দিয়েও তখন রক্ত গড়াচ্ছে।
অসহায় মেয়েটি তার মুক্তিদাতাকে অনুরোধ করল সে যেন কেটে যাওয়া হাত বেঁধে ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
কামু রাজি হল না। তখন সে তাকে উপরে তার কামরায় লুকিয়ে থাকতে বলল৷ কিন্তু সে পুলিস পৌঁছনোর অপেক্ষায় থাকে।
পুলিস এল? তিয়াসার জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ। এসে ধরে নিয়ে গেল। বিচারে মেয়েটি ও অন্যান্য প্রতক্ষ্যদর্শীর সাক্ষ্য সত্ত্বেও সে দোষী সাব্যস্ত হলো৷ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল৷ জেলে পুরোনো এক আসামীর ঘরেই তাকে রাখা হল। সেই ব্যক্তি এগারো বছর বন্দি, তবে শীঘ্রই মুক্তি পাবে৷ খুনের অপরাধের শাস্তিভোগ করছিল সে৷ তার বউকে সে বন্ধুর সাথে নিজেদের বিছানায় দেখতে পেয়েছিল৷ অন্ধ ক্রোধে বালিশ চাপা দিয়ে প্রথমে বন্ধুকে, তারপর স্ত্রীকে খুন করে সে।এ নিয়ে তার মনে কোনো অনুশোচনা ছিল না। তার কথায় তারা দুজন তাকে ঠকিয়েছে, পাপ করেছে, তাদের শাস্তি তাই সে নিজের হাতে দিয়েছে। আর তার খুনের শাস্তি তাকে ঈশ্বর দিচ্ছেন। কারণ প্রত্যেক মানুষকেই তার স্বীয় অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়।
খুনী হলেও বৃদ্ধ লোকটির পঠন জ্ঞান বেশ ভাল৷ সে নতুন আসামীকে প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু না কিছু শিক্ষামূলক গল্প শোনাত। বেশিরভাগ গল্প ছিল জাতকের।
একদিন সে শোনালো গৌতম বুদ্ধের এক প্রিয় শিষ্যের গল্প। প্রভু তাঁর এক শিষ্যকে বললেন, আমার এক পরম ভক্ত আছে পাশের গাঁয়ে। তার খুব ইচ্ছে আমাকে খাওয়ানোর। কিন্তু আমি তো এখন তার বাড়ি যেতে পারছি না। অথচ ভক্তের ডাক অমান্যও করা যায় না। তুমি এক কাজ করো, তাদের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে এসে আমার জন্য অন্ন রেঁধে দাও। তাহলেই তার বাসনা পূর্ণ হবে।
শিষ্য গুরুর নির্দেশ মান্য করে সেই বাড়ি পৌঁছল। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন বাড়িতে ছেলে নেই। বৃদ্ধ অথর্ব বাবা মা উঠে গিয়ে যে চাল দেবেন সেই সামর্থটুকুও নেই তাদের। তারা শিষ্যকে অনুরোধ করলেন, সামনের দোকান থেকে তাদের ছেলেকে ডেকে আনতে।
শিষ্য ছেলেকে ডাকতে দোকানে পৌঁছালেন। গিয়ে চরম ঘেন্নায় রাগে তাঁর মন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এই ছেলেটি প্রভুর পরম ভক্ত? যে নাকি মাংস বিক্রি করে নিজের হাতে পশুদের জবাই করে! প্রভু নিশ্চয়ই এর কাজের গতিবিধি জানেন না। কিংবা ছেলেটি তাঁকে তার পেশা সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য দিয়েছে। সে আর ছেলেটিকে না ডেকে সেখান থেকেই ফিরে গেল প্রভুর কাছে।
চাল এনেছ? প্রভুর অধীর জিজ্ঞাসায় ক্রুদ্ধ হয়ে শিষ্য বলল, হে প্রভু, এই ছেলেটি কখনো আপনার শিষ্য হতে পারে না। সে প্রতিদিন পশুদের হত্যা করে তাদের মাংস বিক্রি করে। আপনি প্রাণ হত্যার বিরোধী। অহিংসাই আমাদের পরম ধর্ম। অথচ এই ছেলেটি সেই ধর্ম প্রতিদিন খণ্ডন করে মহাপাপে লিপ্ত। এ কী করে আপনার শিষ্য হতে পারে?
প্রভু রাগান্বিত শিষ্যের দিকে তাকালেন। ঠোঁটে তাঁর স্মিত হাসি। চোখে অপার করুণা। ধীর স্বরে বললেন, তুমি কি ছেলেটির সঙ্গে তার বাড়ি গিয়েছিলে? কোনো কথা বলেছিলে?
শিষ্য বিরক্ত ভঙ্গিতে জানালো, এমন মানুষের সঙ্গে পথ চলা তো দূরের কথা, এক মুহূর্তও কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব।
গুরু জানালেন, তুমি আবার যাও তার কাছে। কোনো কথা বলতে হবে না। শুধু দূর থেকে তাকে, তার কাজকে নজর করবে। ফিরে এসে জানাবে কী দেখলে। তারপর আমরা আবার এই নিয়ে কথা বলব।
প্রভুর নির্দেশ অমান্য করতে না পেরে শিষ্য পরদিন ভোরে গিয়ে পৌঁছল সেই ছেলেটির বাড়িতে। দেখল ছেলেটি ঘুম থেকে উঠে স্নান করে প্রথমে সূর্য প্রণাম করল। তারপর বৃদ্ধ মা বাবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাদের প্রণাম করল। এরপর তাদের মুখ ধুইয়ে জামা পালটিয়ে দুধ গরম করে খেতে দিল। খাওয়া শেষ হলে মুখ মুছিয়ে তাদের বিছানায় বসিয়ে দোকানের দিকে রওনা হল।
শিষ্য দূর থেকে দেখছিল তার কাজকর্ম। দোকানে গিয়ে ছেলেটি তার খামারে রাখা পশুদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে স্নান করিয়ে দিল। খেতে দিল। প্রত্যেকের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর শুরু হল তার জবাইয়ের কাজ। সেই কাজটিও সে এমন ভাবেই করছিল যাতে পশুগুলোর যন্ত্রণা কম হয়।
দুপুর অবধি ক্রেতাদের সামলে সে দোকান বন্ধ করে ফিরে গেল বাড়িতে। বাড়ি ফিরে স্নান করে রান্না বসালো। আবার একই ভাবে বাবা- মাকে খাওয়ালো সে। তারপর প্রভুর গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দিল তাদের। এতক্ষণে সে নিজে খেল প্রভুকে উৎসর্গ করে।
শিষ্য ফিরে এল প্রভুর কাছে। সারাদিন সে যা যা দেখেছে তার নিখুঁত বর্ণনা দিল গুরুকে।
সব শুনে গুরু হেসে বললেন, এখনো কি তোমার তাকে শুধু কসাই-ই মনে হচ্ছে?
শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হল।
বুদ্ধের গল্প শেষ করে বৃদ্ধ আসামী বলল, আমরা এক নজরে যা দেখি যা বুঝি সব সময় সেটাই চরম সত্যি নয়। বাইরের আবরণ দিয়ে মানুষের অন্তরের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। এই ছেলেটি তার জীবিকা অর্জনের জন্য প্রাণীকে হত্যা করে। কিন্তু তা বলে সে খুনী নয়। অকারণে সে জীব হত্যা বা ব্যভিচারে লিপ্ত নয়। তার বাবা-মার প্রতি ভক্তি, অন্য প্রাণীদের প্রতি ভালবাসা বা গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা সবটাই রয়েছে। তাই প্রভু তাকে নিজের পরম শিষ্য বলে অভিহিত করেছিলেন। আসলে জীবন কেমন জানো? যে যেমন দেখে তার চোখে তেমন। সঠিকভাবে অন্বেষণটাই বেঁচে থাকার সার্থকতা।
জীবন সম্পর্কে আসামীর শিক্ষায় গর্বিত নতুন আসামী৷ ফলে অনেক সময়ই তাদের কেটে যায় কথোপকথনে, নানান বিষয় নিয়ে আলোচনায়৷
যতই মুক্তির দিন কাছে আসতে থাকে ততই বৃদ্ধ উদগ্রীব হতে থাকে তার সঙ্গীকে কিছু জানাতে। সে বলতে চায় কিছু গোপন কথা যা সে আজও কাউকে বলেনি৷
মন্ত্রমুগ্ধের মত তিয়াসা শুনছিল সেই আশ্চর্য কাহিনি।
বৃদ্ধ লোকটি বলতে থাকে তার কথা – বুঝলে, জেলখানার লাইব্রেরিটা বেশ সমৃদ্ধ। কিছু বইয়ের দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আছে এখানে। বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি হঠাৎই সেখানে সন্ধান পেয়ে যাই একটি বইয়ের। সেই বইটিতে ছিল রহস্যময় অদেখা ব্রহ্ম দর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গোপন উল্লেখযোগ্য কথা ও সূত্র ৷
সে বলে যেতে থাকে,সব প্রাণীরই নিজস্ব বিবেচনাবোধ নিয়ন্ত্রিত হয় কস্মিকের কোন সুনির্দিষ্ট পর্যায়ের সেলের কাছ থেকে। যার একেকটি অনেকটা অর্থবোধক৷ এর ইশারাতেই প্রাণীর অনেক আচরণ গড়ে ওঠে।
তার মুখে এটা শুনে নতুন আসামী বেশ উৎসাহ পেল। সে তাই সময় নষ্ট না করে বইটা পড়তে চাইল৷ কিন্তু তা সম্ভব ছিল না৷ বুড়ো জানালো, সে বইটা ফেরত দেওয়ার পর থেকেই আর পাওয়া যায়নি৷ এমনকি ক্যাটালগেও কোন চিহ্নই নেই ৷
যাঃ তাহলে? তিয়াসার আক্ষেপ।
সৌভাগ্যক্রমে বুড়োর ছিল বেশ স্মৃতিশক্তি৷ ফলে কস্মিক এর জটিল অংশ ও এই সংক্রান্ত তথ্যগুলো ছবির মতন মনে ছিল তার৷ সে বলে, আলোক উজ্জ্বল সম্ভাবনার হদিশ ছিল ওই বইতে।
কসমিক রশ্মি আসলে একটা বিন্দুর মতোন কণিকা, কোনো রশ্মি না। এটা মূলত উচ্চশক্তি সম্পন্ন তড়িৎবাহিত কণিকা যার ৯০% হলো প্রোটন দিয়ে তৈরি আর বাকিটার মধ্যে ৯% হিলিয়াম নিউক্লিক অর্থাৎ আলফা পার্টিক্যাল আর ১% হলো অ্যান্টি-ইলেক্ট্রন।
বুড়ো বলছিল, প্রথমে ভেবেছিলাম, এই রেডিয়েশনটা তড়িৎচৌম্বকীয় প্রকৃতির। কিন্তু পরে দেখলাম সেটা ভুল। এটা আসলে তড়িৎ চার্জড টাইপের। কারণ চৌম্বকীয় বলের সাথে এটার মিথস্ক্রিয়তা বর্তমান! এখন এগুলো কোথা থেকে এল এই নিয়ে রহস্য আছে। বইটা পড়ে আমার ধারণা হয় গ্যালাক্সিগুলোর কেন্দ্রে যে ব্ল্যাক হোলগুলো আছে সেইগুলো থেকে, আবার অনেক সময় গামা রশ্মির বিস্ফোরণে সুপারনোভার সময় যে তড়িৎচৌম্বকীয় শক ওয়েভ দণ্ডাকারে বের হয় দুই দিক থেকে তার কারণে এর উৎপত্তি হয়। যে এই শক্তি ধরে রাখতে পারবে সে পেয়ে যাবে এক ঐশ্বরিক শক্তি৷
প্রথমদিকে বুড়ো এই বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে চেষ্টাও করেছিল। যদিও সাহসের অভাবে শেষ পর্যন্ত বেশি দূর যেতে পারেনি। এখন সে সাহস থাকলে সঙ্গীকে এগোতে বলল৷ অতি উৎসাহে সঙ্গী সেইসব কাজ করতে রাজি হয়ে গেল৷ এই রাতটাই ছিল তাদের জেলে থাকার শেষ রাত।
এই অবধি বলে গল্পকার একবার দেখে নিল তার সামনে বসা শ্রোতাকে। তার গলার স্বরে এবার একসাথে বিষণ্ণতা ও রহস্যময়তা।
পরের দিন সকালে কারারক্ষীরা বুড়োকে ছুটি হয়ে যাবার আদেশ শুনিয়ে বাইরে নিয়ে যাবার জন্য এল। তারা তাকে বিছানার এককোণে বিধ্বস্ত, এলোমেলো, অবস্থায় আবিষ্কার করল৷ সঙ্গে বদ্ধ উন্মাদের মত বুনো চাউনি। ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কিছু একটা গণনা করছিল সে, আর বাঁ হাতটা অনবরত এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছিল৷
অপর জনের কোন হদিশই ছিল না৷ কী ঘটেছিল গত রাত্রে তা অনুমান করা অসম্ভব ছিল। কারন কোনও রক্ষী সে রাতে কাউকে সেখান থেকে পালাতে দেখেনি বা কোনও মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। বুড়োর অবস্থা দেখে তাকে কেউ কিছু বলল না, শুধু ছেড়ে দেবার বদলে আবার কারারুদ্ধ করা হলো৷ এবার গরিবদের জন্য মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে৷
গল্প শেষ করেই যুবক মাথা নুইয়ে সম্মান দেখাল তিয়াসার প্রতি৷
ক্রমশঃ রহস্য ঘনীভূত