তিয়াসার মনে হল মহিলার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই এসে বসবেন হিসাবরক্ষক। সে হাতদুটো এক করে মিলিয়ে হাততালির মতন করলো৷ তখনো সে গল্পের মধ্যেই বিরাজ করছিল। তার মনে হচ্ছিল এই যে এক জনের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে আরেকজন এসে বসছে তা আসলে দৃশ্যান্তরে যাবার প্রস্তুতি। নাটকে যেমন সাময়িকভাবে পর্দা ফেলে আরেকটি পর্বের প্রস্তুতি নেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই এখানেও প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে। আর সেই সুযোগে কুশীলবরা পরের দৃশ্যের ডায়লগ ঝালিয়ে নিচ্ছে।
সে ভাবছিল, এই দুটি গল্প শুনে ধরনটা মনে হলো ভালবাসার ও গোপনীয়তার, কিন্তু উত্তেজনায় ভরপুর৷ যদিও দু’জন মূল চরিত্রের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়াটা বেশ রহস্যের, কিন্তু ভালবাসাই তাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেল৷ প্রথমটা নয় ত্রিভুজ প্রেম, কিন্তু দ্বিতীয়টা?
নিজের মনেই গল্পের নিখোঁজ চরিত্রের বিশ্লেষণ করছিল তিয়াসা। সে বেশ উৎসাহী ছিল ভাই-বোনের মধ্যেকার সম্পর্কের রহস্য জানতে।
সে ভাবছিল হিসাবরক্ষককে জিজ্ঞাসা করবে এরপর এ টেবিলে কে গল্প শোনাবে৷ ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। কারণ প্রথম দুটো গল্পের মাঝে সেতুবন্ধন ছিল৷ তাছাড়া শেষটায় সে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। শুধু দু-একটা কথা বলেছে। যদি তার ভুল না হয় এখনও যথেষ্ট চা আছে, হয়ে যাক চায়ের সাথে আরেকটা নতুন গল্প৷
মৃদু উত্তেজনা নিয়ে সে কাপে চুমুক দিল। এখন কে গল্প বলবে? সম্ভবত বাইরের কেউ৷ এরা তো পেশাদার অভিনেতা নয় যে দীর্ঘক্ষণ অভিনয় বজায় রাখতে পারবে। যদিও তারা বেশ পটু গল্পকথনে আর শ্রোতাও সহজে মিশে যায় গল্পে৷ কোন পুনরাবৃত্তি না করেই এক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা তাদের৷ নিঃসন্দেহে গল্প চা-ই পছন্দের শীর্ষে এই টি-শপে৷
কিন্তু যখন হিসাবরক্ষক ক্যাশের পিছন থেকে মাথা নুইয়ে দেখালো তখন তিয়াসা কথা ভুলে গেল। যারপরনাই অবাক করা ঘটনা অপেক্ষা করছে দোকানে৷ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সে দেখলো জানালার পাশে বসা অল্পবয়সী সেই যুগল এগিয়ে এলো৷ হাসতে হাসতে কোন কথা না বলে তারা দুই চেয়ারে বসে পড়ল৷ অন্যকিছু ভাবার মতন সময়ই পেল না তিয়াসা, কারণ ততক্ষণে যুবকটি গল্প বলা শুরু করে দিয়েছে৷
সার্কাস ছাড়ার পর দুই জাদুকর মিস্টার কামু আর মিস কামনা আলাদা হয়ে গেল৷ কামু সমুদ্রে ভাসমান দামি প্রমোদতরীর রেস্টোরেন্টে পাচক হিসেবে চাকরি পেল৷ আরব সাগরে থাকা অবস্থায় তার পরিচয় হল ধনী যুবতী বিধবার সঙ্গে৷ তার স্বামী ছিল উচ্ছৃঙ্খল, মাতাল ও আরো নানা গুণে ভরা। তার মৃত্যুও ঘটল অদ্ভুতভাবে। কপালে কোনো কিছুর প্রচণ্ড আঘাতে। সেই চিহ্ন দেখে সংবাদপত্র, মিডিয়া এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, খুন, বলে প্রচার করল৷ অনেক ক্লু তারা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কাউকেই ধরা গেল না। ফলে ক’দিনের মধ্যেই সব কিছু ধামাচাপা পড়ে গেল৷
এদিকে সেই পাচক মাশরুম, শৈবাল আর শামুক দিয়ে তৈরি চমৎকার খাবার বানিয়ে সেই বিধবার নজর কেড়ে নিল৷ অনেকে বলে সে সেই খাবারের মধ্যে নেশা বা সম্মোহন সৃষ্টিকারী কিছু মেশাত। অবশ্য এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
ব্ল্যাক ম্যাজিক? তা আবার হয় নাকি? তিয়াসার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না সামনে বসে থাকা গল্পকার।
শুধু একবার নিজের নাকে হাত বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করে দিল, বেশ কিছুদিন সেই খাবার খাওয়ার পর যুবতী চাইল পাচকের সঙ্গে দেখা করতে৷ প্রথম দর্শনেই যুবতী তার কথা আর রূপের মুগ্ধতায় মজে গেল৷ এরপর যুবতী নানান অছিলায় তাকে প্রায়ই ডেকে পাঠাতে লাগল৷ রোজই সে তাকে বিপুল টিপস্ ও উপহার দিচ্ছিল।
কিন্তু এই বিষয়টা দীর্ঘদিন চলল না। জাহাজের ক্রুরা যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন যাত্রীদের মেলামেশায়। ফলে বিনা প্রয়োজনে অন্য কারোর কেবিনে বিশেষ করে একা কোনো মহিলার কেবিনে প্রবেশাধিকার গুরুতর অন্যায় বলে ধরা হয়৷ কামুর আনা-গোনাও তাই নিষিদ্ধ হল।
এত কিছুর পরেও কোন এক ঘোরলাগা বিকেলে মহিলার প্রত্যাশা পূরণ হল৷ যুবক কামু তার রূপ ও শরীরী আকর্ষণে তার কেবিনে প্রবেশ করল। অবশ্য শোনা যায় সে পানীয় পানে আপত্তি জানিয়েছিল৷ নিজেকে সংযত রাখারও অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘি আর আগুন একসঙ্গে থাকলে শেষ অবধি কী ঘটবে আগে থেকে অনুমান করা খুব কঠিন নয়।
তারপর, তিয়াসার কৌতূহল। তারপর কী হল?
কেউ জানে না আসলে কী ঘটেছিল ওই রাতে কেবিনে৷ সকালে যখন রুম বয় কেবিন সাফ করতে এল তখন সে দেখল মেঝেতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাদের রাঁধুনি। আর সেই মহিলা শুয়ে বিছানায়৷ অনেকক্ষণ ধরে তাদের ডাকাডাকি করেও সাড়া না পাওয়ায় জাহাজের ম্যানেজারকে খবর দেওয়া হল। জাহাজের ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন মহিলার মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাট্যাকে৷ কামুর ঘুম ভাঙে প্রায় সারা দিন ঘুমোবার পরে। কেন সে এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল, কীই বা ঘটেছিল সেসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারে নি সে। কিন্তু মহিলার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হওয়ায় এর সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র পাওয়া গেল না। তাই এই মৃত্যুতে সরাসরি দোষ পড়ল না তার উপর৷ তবু সেই মুহূ্র্তে চাকরি চলে গেল তার। এবং পরের বন্দরে তাকে নামতে বাধ্য করা হল কোনো রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই৷
সে কী? যুবকের ভাগ্যটাই দেখছি খারাপ। তিয়াসা নিজের ঘোরে বলে।
আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এমন জায়গায় এসে থেমে গেলে খুব রাগ হয়
ভালো চলছে
এবারের পর্বটা অন্য বারের তুলনায় ছোট মনে হলো যেন! আরও একটু পেলে ভালো হতো।
এই প্রত্যাশাটাই লেখকের হাতযশ।
ভালো লাগল
খুব আকর্ষণীয় ...রহস্যে ভরা। ভালো লাগছে