তিয়াসা কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন জন্মাছিল। বুড়োর পড়া গ্রন্থটা কি রেইকি সংক্রান্ত প্রাচীন কোনো লেখা? প্রাচীন ভারতে মুনি ঋষিরা বিশ্বাস করতেন ভোরের সূর্যের থেকে নির্গত কিরণ যদি নিজেদের শরীরে নিয়ে সংরক্ষণ করা যায় তবে সেই শক্তির দ্বারা মানুষ নিজে যেমন আলোকপ্রাপ্ত হয়, তেমনি অন্যকেও এই শক্তি দিয়ে অনেক কিছু থেকে মুক্ত করা যায়। সেইজন্যেই গায়ত্রী মন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছিল। জাপান ক্রমশ ভারতীয়দের এই চর্চাকে নিজের করে নেয়। যা থেকে আধুনিক রেইকির উৎপত্তি।
কিন্তু তিয়াসাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই যুবতী বলতে শুরু করে দিলেন -
এদিকে সেই উচ্চপদস্থ কর্মচারী অফিস ছেড়ে চলে যাবার পরে প্রাক্তন মহিলা জাদুকর ওরফে সেক্রেটারি মিস কামনা যোগ দিল পুরাতত্ত্ববিদদের সঙ্গে এক অভিযানে৷ জায়গাটা শহর থেকে খানিক দূরে, পদ্মা ও বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে। জানা গেল, এই প্রত্নস্থলটি ৪০০ বছর থেকে ৮০০ বছর খ্রিস্টপূর্বে গড়ে উঠেছিল। ইতিপূর্বেই মাটির তৈরি এই দুর্গপ্রাচীরের ভেতরেই প্রাচীন গড়, ইটাখোলা এবং নুনগোলা ইত্যাদি স্থানে খননের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের নগর-সভ্যতার পাঁচটি পৃথক সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। যোগ দেবার পর সংস্থার নবীন গবেষক মেয়েটিকে জানালো, এই স্থানটির সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় রাজা বিক্রমাদিত্যের সভারত্ন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এবং তাঁর পুত্রবধূ খনার নাম যুক্ত।
মেয়েটি লাইব্রেরিতে গিয়ে এই নিয়ে নানা বই পড়ে আরো জানল, এই গড়ই ছিল সম্ভবত বিখ্যাত প্রাচীন সমুদ্র-বন্দর 'গঙ্গারিডাই'-এর রাজধানী বা 'গাঙ্গে' বন্দর। এর আগে এখানে চারবার অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। তার থেকে এখানে প্রাক মৌর্যযুগ থেকে শুঙ্গ যুগ, শুঙ্গ-কুষাণ যুগ, গুপ্তযুগ, গুপ্তযুগের শেষ ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সেই তরুণ গবেষক তার উৎসাহ দেখে মুগ্ধ হয়ে জানতে চাইল, আপনি কি এর আগে এই ধরনের কোনো অভিযানে গেছেন বা এই সংক্রান্ত কোনো পড়াশোনা আছে আপনার?
মেয়েটি জানালো তার এ বিষয়ে জ্ঞান সামান্যই। তখন গবেষক নতুন উদ্যমে তাকে বললেন, এখন আমরা দেখতে চাইছি সেখানে যে পুরনো মন্দির পাওয়া গেছে সেটা বাদে আর কোনোভাবে এখানে প্রাচীন সভ্যতার আরো কিছু হদিশ পাওয়া যায় কিনা!
এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন দীর্ঘদেহী, ঈষৎ পাকা চুলের এক প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রফেসর৷ প্রথম দর্শনেই মেয়েটি প্রেমে পড়ে গেল তার। কিন্তু প্রফেসরের স্ত্রীর উপস্থিতির কারণে সে তার ভাল-লাগাটুকু মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখল৷
অবশেষে অভিযানের কাজ শুরু হল। তারা গিয়ে পৌঁছল সেই গড়ে। এর আগে এখানে বিশাল উত্তরমুখী বৌদ্ধধর্মের যোগসূত্র এক মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এর পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম - এই তিনদিকে চওড়া বারান্দা; মন্দির-সংলগ্ন উত্তরদিকে একটি মণ্ডপ এবং কাছে আরেকটি ছোট মন্দিরও পাওয়া গেছে। মন্দিরের বাইরের দেওয়াল টেরাকোটা চিত্ৰফলকে সুসজ্জিত।
এই মন্দিরটাই হল এবারের মূল লক্ষ্য। প্রফেসরের স্থির বিশ্বাস এই মন্দির সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম মন্দিরের নিদর্শন। মন্দিরটি তিনবার নির্মিত হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। একবার গুপ্তযুগে, তারপর গুপ্ত-পরবর্তী যুগে দুবার। প্রফেসরের ধারণা এর নিচে লুকানো আছে আরো নানা রহস্যময় ও অজানা জিনিস। তাঁর অনুমান সঠিক বলেই প্রাথমিকভাবে দেখা গেল। সেই মন্দিরের নিচে সন্ধান পাওয়া গেল অমূল্য সম্পদের এক গলির৷ সেই দেওয়াল জুড়ে অজানা হায়রোগ্লিফিকস্৷
সেকী! উৎসাহিত তিয়াসা। সে নিজেও ইতিহাসের ছাত্রী। প্রত্নতত্ত্বের বিষয়ে তার অসীম আগ্রহ। সে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল, গ্রিক শব্দ ‘হায়ারোগ্লিফিক' এর অর্থ ‘উৎকীর্ণ পবিত্র চিহ্ন'। গ্রিকরা যখন মিশর অধিকার করে তখন তাদের ধারণা হয়, পুরোহিতরা যেহেতু লিপিকরের দায়িত্ব পালন করেন, এবং মন্দিরের গায়ে লিপি খোদাই করা রয়েছে, তাই তা নিশ্চয়ই ধর্মীয় কোনো পবিত্র লিপি।
এত অবধি ভাবার পর তিয়াসা সামনে বসে থাকা গল্পকারদের দিকে তাকিয়ে বলল, উদ্ভবের কাল থেকে বিলুপ্তির কাল পর্যন্ত হায়ারোগ্লিফিক ছিলো শব্দলিপি ও অক্ষরলিপি নির্ভর। মিশরীয় লিপিকররাই মূলত লিখনপদ্ধতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তাঁরাই ঠিক করতেন লিপি কোথায় লেখা হচ্ছে। তার প্রেক্ষিতে লিপিমালা ডান না বাম, কোনদিক থেকে শুরু হবে সেটা ঠিক করা হতো।
তাকে থামিয়ে দিল সেই যুবতী গল্পকার। তিয়াসার মনে হল, এইটুকু সময় গল্পকার চুপ করে পরের বক্তব্যগুলো নিজের মধ্য গুছিয়ে নিচ্ছিল।
গল্পকার বলতে শুরু করল, মিশরীয় ফারাও মেনেসের রাজত্বকালে হায়ারোগ্লিফিক লিপির সৃষ্টি।
যুবকটি এবার তাকে থামিয়ে বলে, গ্রিকরা যখন মিশর দখল করে নেয়, তখন তাদের বিশ্বাস ছিলো হায়ারোগ্লিফিক পবিত্র লিপি। আর এই 'পবিত্রতা' কথাটা যতদিন কাজ করছিলো গবেষকদের মাথায়, ততদিন কোনো না কোনোভাবে ভুল পাঠোদ্ধার হচ্ছিল এই লিপির। এতে আরো রহস্যমণ্ডিত হচ্ছিল মিশরীয় ইতিহাস। নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করলে তাঁর সৈন্যরা বিখ্যাত রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট উদ্ধার করেন। রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট আসলে একটি শিলালিপি। এই দ্বিভাষিক ত্রিলিপি অঙ্কিত শিলালিপিটিই খুলে দিয়েছিলো মিশরীয় লিপি ও ভাষা পঠনের দুয়ার।
এবার কি আমরা আবার গল্পে ফিরতে পারি? এই অবধি শোনার পর তিয়াসা বলল। ইতিহাসের মুখস্থ ধারাবিবরণী তার আর ভাল লাগছিল না। সে এবার যথেষ্ট কৌতূহলী পরের ঘটনা জানার জন্য।
সেদিকে তাকিয়ে যুবতী বলতে শুরু করল, হায়রোগ্লিফিকস্ এর রহস্য উন্মোচনের নেশায়, তারা উত্তেজনায় যে যার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল। তবে বেশিদিন নয়৷ শীঘ্রই দলের তিনজন লোকের অজানা এক রোগ ধরা পড়লো৷ লক্ষণ ছিল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, সারা গায়ে ব্যথা আর সাথে বমি৷ সেই গলির অশরীরী বাতাসই মনে হয় এগুলোর কারণ৷ খুব তাড়াতাড়ি এদের শহরে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করতে হবে, নইলে প্রাণ সংশয় হতে পারে, বলে তখনকার মত অনুসন্ধান বাতিল ঘোষিত হল ৷
বাতিল? যাঃ, তিয়াসার গলায় আক্ষেপ।
সেদিকে এক পলক তাকিয়ে যুবতী আবার বলল, এরপরে প্রাচীন কোনো অপদেবতার অভিশাপের দোহাই দিয়ে মহিলাকেও চলে যেতে বললেন প্রফেসর। কিন্তু সে অভিযান বন্ধ করে ফিরে আসার আগে শেষবারের মতন নিচে নেমে একটা সুযোগ নিতে চাইল৷ গলিতে পৌঁছানো মাত্র আশপাশটা নড়েচড়ে উঠল আর মেঝেটা সরে গেল খানিকটা৷ মনে হলো প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প। মুহূর্তের মধ্যে সকলে একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল। ধাক্কাধাক্কিতে সবাই প্রায় মারাত্মক আহত হল। শুধুমাত্র প্রফেসরের স্ত্রীই একেবারে শেষে থাকায় কম আঘাত পেল৷ যখন প্রাণ হাতে নিয়ে সিঁড়ির দোরগোরায় পৌঁছাল তারা, তখনই পেছনে থেকে সার্চলাইটের প্রখর আলো জ্বলে উঠলো৷ মুহূর্তের মধ্যে তারা দেখলো সেই মেয়েটি আবার নিচে নেমে যাচ্ছে৷ তারা চিৎকার করে তাকে সাবধান করছিল, যেকোনো মুহূর্তে এই গলিটা ভেঙে যাবে। মেয়েটি কোন কর্ণপাতই করলো না ৷ হামাগুড়ি দিয়ে সে চলতে লাগলো। তার হাত দুটো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত পড়ছিল৷ কিন্তু সেদিকে তাকানোর আর সুযোগ পেলেন না প্রফেসার৷ ততক্ষণে মেঝেটা বিকট শব্দ করে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল৷ কোনমতে লাফ দিয়ে বেঁচে গেলেন তাঁরা৷
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। দারুন উত্তেজিত হয়ে আছি । প্রতিটি পর্বের শেষে মে কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে তার মনে অনেক কল্পনার জন্ম দিচ্ছে।
সুন্দর এগোচ্ছে