এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  ভ্রমণ  শনিবারবেলা

  • দখিন হাওয়ার দেশ - ১০

    অরিন বসু
    ধারাবাহিক | ভ্রমণ | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০৮৫ বার পঠিত
  • ওয়াকা
    সূত্র: https://www.firstlighttravel.com/blog/epic-waka-journey-retraces-maori-history-across-the-pacific


    মাওরিরা

    খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকে পলিনেশীয় অঞ্চলের নাবিকেরা প্রশান্ত মহাসাগর বেয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতেন। এদের নৌ-কারিগরির বিশেষত্ব ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের উথালপাতাল হাওয়ার সঙ্গে মানানসই পাল তৈরি করার কৃৎকৌশল, নৌকোর দুপাশ ব্যেপে দাঁড় বাইবার প্রশস্ত লগি (ইং: outrigger) এবং নক্ষত্রের অবস্থান দেখে সমুদ্রে পথনির্দেশ করার ক্ষমতা। আজকের যুগের হিসেবে, এমনকি তখনকার দিনের পরিমাপেও সেইসব নৌকো (যার মাওরি নাম ওয়াকা) খুব প্রকাণ্ড কিছু ছিল না, এমনকি আমরা বাংলায় যেসব পঙ্খিরাজ নৌকোর বা সমুদ্রপোতের কাহিনি পড়েছি, তাদের মাপেও সেসব অতি ক্ষুদ্র।

    তবে নাবিকরা যে প্রশান্ত মহাসাগর মাইলের পর মাইল, মাসের পর মাস একসঙ্গে এইসব নৌকো নিয়ে পাড়ি দিতে সক্ষম হতেন, তার কারণ উত্তাল সমুদ্রে, ঝোড়ো হাওয়ায় সেসব ওয়াকা দিব্যি স্থির থাকতে পারত আউটরিগারের জন্য আর পালের হাওয়ায় সে ওয়াকা দিগ্‌বিদিক পাড়ি দিত। তার সঙ্গে নাবিকদের সমুদ্রপথ পড়ার ক্ষমতা আর অন্ধকারে নক্ষত্র চিনে দিক্‌নির্ণয় করার ক্ষমতাটিকেও বিবেচনা করতে হবে। এঁরা কী উপায়ে এতসব জানলেন বা সেই সমস্ত বিদ্যা কোথাও লিপিবদ্ধ করেননি, পরম্পরায় জেনেছেন, আর আমরা জেনেছি তাঁদের কাছ থেকে কাহিনি আর লোককথার মাধ্যমে। এ ছাড়া ইউরোপীয় নাবিকেরা যখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমালেন, তখন তাঁদের সূত্রে এঁদের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় হয়েছে।

    এখানে একটা কথা যোগ করা যেতে পারে, যে সেই একই সময়ে ইউরোপীয়রা সমুদ্রে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে শুরু করেছেন, চিনের মধ্য ভুবনের সাম্রাজ্য তার বিশাল নৌবহর নিয়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে প্রভাব বিস্তার করছে, ভারতের তামিল এবং বাঙালি নাবিকগণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বাণিজ্য এবং রাজত্ব করছেন, ও আরবদের বাণিজ্যিক অর্ণবপোত ভারত মহাসাগর পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মশলার ফিরি করে বেড়াচ্ছে। সমসাময়িক কালে পলিনেশীয় নাবিকরা পূর্ব এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছেন। আমার একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, ভারতীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাবিকেরা, ভারতীয়রা কি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ বা দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে পাড়ি জমাননি? কে জানে?

    সে যাইহোক, অন্তত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে যত দূর জানা যায়, কোনো এক সময়, খুব সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে পূর্ব পলিনেশীয় অঞ্চলের নাবিকরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে এক বা একাধিক দ্বীপভূমি বা প্রকারান্তরে দ্বীপমালা আবিষ্কার করেন। আমরা অবিশ্যি জেনেছি আখ্যানমালা থেকে। মাউই এর সেই আখ্যান স্মরণ করুন, যেখানে তিনি ভাইদের সঙ্গে মাছ ধরতে এসে সমুদ্র থেকে উত্থিত এক প্রকাণ্ড মাছের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই মাছ হয়ে গেল উত্তরদ্বীপ, তার নাম হল টেআইকাএমাউআাই (মাউআই এর মাছ), সত্যি যদি বর্তমান নিউজিল্যান্ডের উত্তরদ্বীপটি ম্যাপে দেখেন, দেখবেন যেন একটি মাছ, যার লেজের অংশ উত্তরে, আর মাথার দিকটি দক্ষিণে। দক্ষিণ দ্বীপটিতে মাউই এর নৌকো নোঙর করেছিল, তার নাম দেওয়া হল টেওয়াকাএআওরাকি (আওরাকির নৌকো), উত্তর-দক্ষিণ জুড়ে মস্ত একটি নৌকো যেন পড়ে আছে। পরবর্তীকালে দক্ষিণ দ্বীপে মাওরিরা দেখলেন সমুদ্রকূল জুড়ে অজস্র সবুজ রঙের জেড পাথর ছড়িয়ে আছে। তাই দিয়ে তাঁরা গয়না গড়লেন, অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করলেন, কালক্রমে সেই রত্নরাজি মাওরিদের জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠল। তখন দক্ষিণ দ্বীপের মাওরি নামও জেড পাথর, যাকে তাঁরা পোনামু নাম দিয়েছিলেন, তার নামে দক্ষিণ দ্বীপের নাম রাখলেন টেওয়াহিপোনামু।

    এই যে দ্বীপে তাঁরা বসতি স্থাপন করলেন, সেখানে তার আগে সম্ভবত মানুষের পদধ্বনি শোনা যায়নি। কেমন ছিল সেইসময় আর সে যুগের দ্বীপমালা? বিশাল তটরেখা জুড়ে ছিল (আজও আছে) নানান উপসাগর, বন্দর, সেখানে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, রুক্ষ পাথুরে সমুদ্রতটে রোদ পোহাচ্ছে অজস্র সিলমাছ (আজও তাদের দর্শন মেলে)। সমুদ্রের তীর থেকে দেখা যাচ্ছে বরফের পাহাড় আর আগ্নেয়গিরি, ঘন জঙ্গলে ঢাকা তটভূমি, সেখানে নানান রকমের পাখির কলরব। তারই মধ্যে জঙ্গলে চরে বেড়াচ্ছে অতিকায় পাখি, সে উড়তে পারে না। মাওরিরা তার নাম দিলেন ‘মোয়া’। এ ছাড়াও অজস্র আরও পাখির কলরবে পরিপূর্ণ সে দ্বীপভূমি। মাওরিদের আবির্ভাবের ৪০০ বছর পরে, ১৭৭০ সালের ১৭ জানুয়ারি কুইন শার্লট সাউন্ডে জাহাজে থাকার সময় ক্যাপটেন কুকের সহযোগী জোসেফ ব্যাঙ্কস (শিবপুর বটানিকাল গার্ডেন প্রতিস্থাপনায় এঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সুবিদিত) লিখছেন,

    “আজ সকালে, জাহাজ থেকে বড়োজোর কোয়ার্টার মাইল খানেক দূরে দ্বীপভূমিতে পাখিদের কাকলিতে ঘুম ভেঙে গেল। প্রচুর সংখ্যায় পাখি, *** (তাদের) গলায় যে মিষ্টি সুর, তেমনটি আমি আর কোথাও শুনিনি, যেন ছোটো ছোটো ঘণ্টার আওয়াজ”

    ব্যাঙ্কস এ কথা যখন লিখছেন তখন মাওরিদের আবির্ভাবের আমলে যত পাখি ছিল তার অর্ধেক অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপর তো আরও পাখির প্রজাতির অবলুপ্তি ঘটেছে। তবুও আজও, আপনি নিউজিল্যান্ডের যে শহরেই ভোরে জেগে উঠুন না কেন, কত যে নাম জানা আর অনামি পাখির কলকাকলিতে জেগে উঠবেন তার ইয়ত্তা নেই।

    যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। উত্তর, দক্ষিণ, রাকিউরা, যেখানেই বলুন, এইসব দ্বীপছিল পাখপাখালির স্বর্গরাজ্য, কারণ মাওরিদের আবির্ভাবের এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের পূর্বে এদেশে সেভাবে শিকারি প্রাণী বলতে কিছু ছিল না। মানুষ তো ছিলই না, সাপ, আর চতুষ্পদ প্রাণী ছিল না, জলে হাঙর ছিল না, তিমির অবিশ্যি দর্শন পাওয়া যেত, গভীর সমুদ্রে আর তটভূমিতে কদাচিৎ তিমির দল। মাওরিরাই প্রথম ইঁদুর, শুয়োর, এবং কুকুর সঙ্গে করে নিয়ে আসে। তবে তাদের আনা সেসব জন্তুজানোয়ার এখানকার অতি শীতল আবহাওয়ার সঙ্গে হয়তো খাপ খাওয়াতে পারেনি। সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে, পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতো নিউজিল্যান্ডের জঙ্গল থেকেও ডাইনোসরেরা অবলুপ্ত হয়েছে ধরে নেওয়া যেতে পারে; তবে তাদের জ্ঞাতি টুয়াটারা প্রজাতির গিরগিটি সদৃশ প্রাণী আজও চরে বেড়ায়। নিউজিল্যান্ডের এই যে নিজস্ব প্রাণীকূল, এই যে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায় না, এর মূলে নিউজিল্যান্ড দ্বীপখণ্ডের গণ্ডোয়ানা ভূমি থেকে ৮ কোটি বছর আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, যেসময় স্তন্যপায়ী জীবের বিবর্তন শুরু হয়নি। এই আট কোটি বছর ধরে একটি নিজস্ব ইকোসিস্টেম এখানে গড়ে উঠেছে। মাওরিরা যখন প্রথম এখানে আসেন তখন জঙ্গল, জলাভূমি, পশ্চিমতটে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, আর মাঝেমধ্যেই আগ্নেয়গিরি জেগে উঠছে, ভূমিকম্প (যার জন্য আজও নিউজিল্যান্ডকে বলা হয় ‘কাঁপতে থাকা দ্বীপপুঞ্জ’ (ইং: shaking isles)। তারই মধ্যে মানুষের আগমন, বসতি স্থাপন, সভ্যতা গড়ে ওঠা। মাওরিরা তবু একরকম ছিল, ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ার পরে নিউজিল্যান্ডের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল কয়েক শতকের মধ্যে।

    মানুষের বসতি স্থাপনও স্থায়ী বসবাসের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে নিউজিল্যান্ড বাস্তবিকই পৃথিবীর নবীনতম দেশ। এমনকি যে পলিনেশিয়া থেকে মাওরিরা ওয়াকা বা নৌকোয় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁরাই প্রথম নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে মনে করা হয়, তাঁদের ইতিহাসও ১০০০ বছরের কাছাকাছি পুরানো। পূর্ব পলিনেশীদের সমুদ্রে নাব্যতার টেকনোলজি, তাঁদের আধ্যাত্মিকতা, আর টেকনিকাল স্কিলের সমারোহে সমৃদ্ধ হল মানুষের নবীনতম দেশ আবিষ্কারও বসতি স্থাপন।

    কে প্রথম নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেন? ইতিহাসবিদ মাইকেল কিং এর ‘পেঙ্গুইন হিস্ট্রি অফ নিউজিল্যান্ড’ বইতে লিখেছেন নিউজিল্যান্ডের শ্বেতাঙ্গরা বহুকাল ধরে প্রচার করে এসেছে কুপে নামে এক পলিনেশীয় নাবিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে এদেশ আবিষ্কার করেন। গল্পটা এইরকম:

    “কুপে তাহিতি দ্বীপে থাকতেন, তাঁর পিতৃদেব রারোটোঙ্গার মানুষ। তাঁর নৌকোর নাম মাটাহুরা, আর নাঙাহু এ নামে আর-এক মাতব্বরের টাওয়িরিরাঙি নামে নৌকো নিয়ে এঁরা সমুদ্রে অভিযানে বেরোলেন।
    দিনের পর দিন চলে যায়, ডাঙার দেখা আর পাওয়া যায় না।
    শেষে একদিন কুপের বউ সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “হে আও হে আও!” (মেঘ, মেঘ)। দেখা গেল শ্বেতকায় মেঘ। যত সে মেঘের দিকে কুপে আর দলবল তাঁদের ডিঙি নৌকো নিয়ে এগিয়ে যান, তত দেখা যায় সে মেঘ আকাশে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নাবিকেরা চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “আওতেয়া! আওতেয়া!” (“সাদা মেঘ, সাদা মেঘ!”)। তখন এক সময়ে দেখা গেল দীর্ঘ শ্বেতকায় মেঘের নীচে শ্যামল এক দ্বীপভূমি। কুপে তখন এর নাম রাখলেন ‘আওতেয়ারোয়া’ (দীর্ঘ সাদা মেঘের দেশ)।”

    এই কথা বলে কিং বলছেন যে দেশ আবিষ্কারের এই রূপকথা স্টিফেনসন পার্সি স্মিথের গল্পের আদলে শ্বেতাঙ্গরা প্রচার করেছেন এককালে, কারণ ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে মানুষের কানে হিরোদের নিয়ে নতুন দেশ আবিষ্কারের গল্প শুনতে বেশ লাগে। পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, যে মাওরি লোককথায় এর উল্লেখ নেই কিন্তু, অন্তত প্রাক্‌-ইউরোপীয় যুগে মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের নাম আওতেয়ারোয়া বলেও উল্লেখ করত না। দ্বীপগুলোর আলাদা করে নাম ছিল যদিও, যেমন উত্তর দ্বীপের নাম ছিল টেআইকাএমাউআই, আর দক্ষিণ দ্বীপের নাম ছিল টে ওয়াকা আ আওরাকি বা টে ওয়াহি পোনামু।

    পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে এখানে আসবার পর মাওরিরা দেখলেন যে এ প্রকৃতপক্ষে এক প্রকাণ্ড দ্বীপভূমি, সরাসরি প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বটে, কিন্তু তটরেখা মিলিয়ে দেখলে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এক দেশ, যার প্রায় সর্বত্র বসতি স্থাপন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ভারী বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বর্ণময় এক দেশ—একদিকে যেমন ঘন সমুদ্রতটের জঙ্গল, অন্যদিকে তুষারমণ্ডিত গিরিশ্রেণি। তুষারশুভ্র গিরিশ্রেণি এঁরা এর আগে দেখেননি, তার নাম দিলেন ‘হুকা’ (বাং: ফেনা)।

    তাঁরা খেতেন কী? মাওরিরা তিরধনুক ব্যবহার করতে জানতেন না, পাথর, বর্শা, ইত্যাদির সাহায্যে যতটা পারা যায়। যার জন্য অতিকায় মোয়া পাখি মেরে প্রথম দিকে তার মাংস খেতেন। তা ছাড়া পলিনেশীয় দ্বীপ থেকে নিয়ে আসা রাঙালু (মাওরি নাম: ‘কুমারা’), ওল, টারো, লাউ প্রভৃতি দিয়ে, স্থানীয় ফার্নের কন্দমূল জাতীয় খাবার খেয়ে চলে যেত। এঁরা ধান বা গম চাষ করতেন না। তা ছাড়া নিউজিল্যান্ডের দীর্ঘ তটরেখা, অজস্র নদীনালায় প্রচুর মাছ, বিশেষ করে ইল মাছ, সিল তো পাওয়া যেতই।

    এই করে শ-দুয়েক বছরের মধ্যে মোয়া পাখি প্রায় মেরে মেরে খেয়ে অবলুপ্ত হয়ে গেল, তখন নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হল। কৃষিকাজ শুরু করতেই হয়, যাযাবর বৃত্তি করে কতদিনই বা আর চলে? ছোটো ছোটো পাখি ধরে মাংস খাওয়া শুরু হল, মাওরি ফাঁদ পেতে পাখি ধরতে শুরু করলেন। কালক্রমে একটি স্বতন্ত্র কালচার তৈরি হল এদেশে। কাঠে খোদাইয়ের কাজ শুরু হল, পোনামুজেড পাথরে কারুকাজ করে অলংকার গড়লেন (মাওরি: হেইটিকি), কালক্রমে যাযাবর বৃত্তি কাটিয়ে থিতু হলেন তাঁরা। সমাজ তৈরি হল, জাতি, উপজাতি, গোষ্ঠী গড়ে উঠল। মেয়েরা শন (মাওরি: হারাকেকে, ইং: flax) বুনে পরিধান তৈরি করলেন। নিউজিল্যান্ডে এবার তাঁরা স্থিতু হলেন।



    মাওরিদের হেই টিকি
    সূত্র: https://commons.wikimedia.org/wiki/ File:Maori,_hei_tiki_antropomorfo,_periodote_puawaitanga,_XVI-XVIII_secolo.jpg


    তখন স্থানের সঙ্গে একটি আত্মিক সম্পর্ক স্থাপ নহল (মাওরি: ফাকাপাপা, ইং: Whakapapa)। জাতি গড়ে উঠল, এক জাতির মানুষ অন্য জাতিতে বিয়ে করতে পারত, তবে তাদের ছেলেমেয়ে হলে তবেই বাবার বা মায়ের জাতির লোক বলে সে পরিগণিত হত। জাতিরও আবার নানান ভাগ ছিল (বড়ো করে জাতিকে বলা হত ‘ইউয়ি’, আর জাতির মধ্যে ছোটোখাটো পারিবারিক ইউনিটটিকে বলা হত ‘হাপু’)। জাতপাত হলে যা অবশ্যম্ভাবী হয়, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ, আর জাতের মধ্যে উঁচু-নীচু জাতিভেদ—তাও শুরু হল। অভিজাতরা হলেন রাঙাটিরা, সাধারণ মানুষ হলেন টুটুয়া। জাতের বিচার হলে যা হয় সচরাচর, সেটিও শুরু হল, জাত্যাভিমান, মাওরিরা তার নাম দিলেন ‘মানা’। মানুষের মানা বাড়ত, কমত। জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ হয়ে পরাজিত জাতির মানুষের মানার পতন হত। আবার মানা যদি বাড়াতেই হত, তাদের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে হত, এই বিশেষ পারদর্শীদের বলা হত ‘টোহুঙা’। মাওরিরা বরাবরই আধ্যাত্মিক প্রকৃতির, ফলে যাঁরা এই সমাজে পুরোহিতের বা আমাদের ভাষায় ধরুন ব্রাহ্মণের সমান ছিলেন, তাঁদের বিশেষ খাতির। তা ছাড়া যারা মাছ ধরত, যারা কাঠ বা পাথর খোদাই করার কাজে পারদর্শী ছিল, যারা উল্কি আঁকতে জানত, এদের সকলেরই নিজস্ব মানা অনুযায়ী এক-এক ধরনের টোহুঙ্গা বলে এরা বিবেচিত হত। এই সেদিন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে মাওরিদের মধ্যে যাঁরা দেশীয় চিকিৎসায় পারদর্শী ছিলেন, তাঁদের টোহুঙ্গা রীতি মতন দাপটের ছিল। মাওরিরা দেশটিকে কালক্রমে নানান রকম ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক ভাগে ভাগ করে নিলেন, যেখানে যে জাতির আধিপত্য বিস্তার হল সেই মতো মানা অনুযায়ী তাঁদের জাতীয় নামকরণ ইত্যাদি শুরু হল (মাওরি: মানাফেনুয়া)। নদী, জঙ্গল, গাছ, পাহাড়ের নাম অনুযায়ী পারিবারিক নামকরণ শুরু হল (মাওরি: টাঙাটাফেনুয়া)। নানান জাতাপাতের ভিত্তিতে দেশটি ভাগ হল বটে, কিন্তু তাহলেও একটি সূত্রতায় সবাই বাঁধা রইলেন। ভাষা হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে বা স্থান বিশেষে সামান্য এদিক-ওদিক হত, কিন্তু মোটামুটি এক প্রান্তের মানুষের অন্য প্রান্তের মানুষের ভাষা বোঝার বিশেষ অসুবিধে ছিল না। একটি দেশ, একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠল।

    জাতপাত, জায়গার মালিকানা হলে যা হয়, নিউজিল্যান্ডে মাওরিদের মধ্যেও তাই হল। জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক আদানপ্রদান (মানার উত্থানপতন, কখনো-কখনো প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ), সবই চলত। এই সমস্ত ট্রাইবাল আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হত পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে (মাওরি ভাষায়: ‘উটু’)। সবসময়ে সে সমস্ত সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বা পারস্পরিক আদানপ্রদান যে হত, তা নয়, বিস্তর মারামারিও হত। ধরুন ভালো ‘উটু’ হলে জাতে জাতে মিলন হল, আবার মারামারি করে বিজিতের মানার হানিও হত। ব্যক্তিগত মালিকানা, কাজকম্মো, মানা, উটু মিলিয়ে সে এক বেশ জটিল জীবনযাত্রা ছিল বই-কি! তবে এই যে মারামারির কথা বলছি, একটা ব্যাপার বিচার করে দেখুন, এরা কিন্তু খুব জটিল মারামারিতে জড়িয়ে পড়তে পারত না, কারণ পাথর ছোঁড়া বাদ দিলে মারামারির প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিগত ডুয়েলের মাধ্যমে হত (ব্যাপারটা পরে অন্যরকম হয়ে যায়, ইংরেজের হাত থেকে বন্দুক পাবার পরে)। তো সে যাইহোক, ভাষা ছিল, কিন্তু সবটাই গল্পে, কথায়, গানে। তখনও লেখা বা লিপি হয়নি। মোটামুটি বিভিন্ন জাতপাতের লোকজন মিলেমিশে থাকত, হয়তো পারস্পরিক প্রয়োজনেই। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি মাওরিদের জনসংখ্যা ছিল লাখ খানেকের সামান্য বেশি। তখনও অবধি তাঁরাই এদেশের প্রধান অধিবাসী।

    বেশ চলছিল এক জীবন। কার্ল পপারের কথায় চাঁদ বাদ দিলে নিউজিল্যান্ডই পৃথিবীর দূরতম স্থান। বাইরের সভ্যতার দৃষ্টি অতীত এক নিজস্ব জীবন।

    এমন সময় পশ্চিম দিগন্তে, প্রদোষ কালে, ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধ শ্বাসের মতন ইউরোপ খুঁজে পেল এ দেশকে। ১৬৪২-এ আবেল জানজুন টাসমান, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ থেকে নেলসনের পশ্চিম তটে হাজির হলেন। তার একশো বছর পরে ১৭৬৯-এ এলেন ক্যাপটেন কুক। সে গল্প এরপর।


    (ক্রমশ >>> )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 117.2.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:১৩101774
  • নির্ভার লেখা। গল্পের স্রোতস্বিনী এগিয়ে চলে। কাহিনীর মাঝে কোথাও হৃদয় লুকিয়ে আছে। এজন্য আমার চোখেও একটা ছবি যেন ধরা দিচ্ছিল।


    টেওয়াকা আর টেআইকা দুটো আলাদা অর্থ বহন করে। কি সেটা? 

  • অরিন | 161.65.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৩৮101775
  • খুব ভাল লাগল জয়ন্তদা। 


    "টে" কথার অর্থ "the", বা  "of"


    ওয়াকা মানে নৌকো। 


    আইকা একটা জায়গা, বা স্থাননাম। 

  • Prativa Sarker | ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:১৬101797
  • চমৎকার লাগছে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন