মানুষ প্রথম নিউজিল্যাণ্ডে সমুদ্রপথে এসেছিল, এছাড়া আসার আর তো কোন পথ ছিল না। তারা কি ধরণের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল? সে সমস্ত রসদ নিশ্চয়ই কয়েক দিন বা বড়জোর কয়েক মাস পরে ফুরিয়ে যায়। সেই খাবার ফুরিয়ে যাবার পর তারা কি করেছিল? তারপর তাদের খাবার দাবারের কি হল? তারা কি খেত? নিউজিল্যাণ্ডের সাবেক খাবার কি? মাওরীরা কি খেত? সাহেব কি খায়? এদের উৎসব অনুষ্ঠানে কি ধরণের খাওয়া দাওয়া হয়?
মাওরী লোককথা অনুযায়ী আকাশপিতা রাঙি আর ধরিত্রীমাতা পাপার সন্তানেরা আমাদের খাবারের সংস্থান করেছেন, খাবার “উপহার” দিয়েছেন | তাঁদের আকাশরূপী সন্তান টানে আমাদের পাখী দিয়েছেন খাবার জন্য; সমুদ্র, আরেক সন্তান, যার নাম টাঙারোয়া, দিয়েছেন মাছ, হাউমিয়া দিয়েছেন জঙ্গলের বুনো খাবারদাবার, আর রঙো দিয়েছেন চাষবাস করে উৎপন্ন খাবার। সেকালে মাওরীরা প্রধানত তিন ভাবে রান্না করত, ঝলসে বা গ্রিল করে, সেদ্ধ করে, আর মাটির নীচে আগুণ জ্বালিয়ে উমু বা হাঙি পদ্ধতিতে। খাবার ঝলসানোর মাওরী নামটিও ভারি মিষ্টি , টুনুটুনু (অনেকে রোরেরোরেও বলে)। যেহেতু মাওরীরা সেযুগে , আজ থেকে ৬০০-৭০০ বছর আগে, তৈজসপত্র ব্যবহার করত না, খাবার সেদ্ধ করতে গেলে কাঠের পাত্রে বা নারকোলের মালার মধ্যে জল ঢেলে তাতে একটা জ্বলন্ত পাথর ডুবিয়ে জল ফোটাত|
হাঙির কথায় আসি। হাঙি হল মাটির নীচে গর্ত খুঁড়ে সেখানে কাঠ জ্বালিয়ে নিভুনিভু আঁচে স্টিম করে রান্না | উৎসব অনুষ্ঠানে এখনো হাঙি প্রচলিত, যদিও এখন হাঙির ব্যাপারটা আগের মতন নেই। মনে করুন একটা গ্রামে অনেকে মিলে থাকেন, সেখানে এইরকম পদ্ধতিতে রান্না করে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। হাঙি পদ্ধতিতে রান্না করতে গেলে এমন একটা জায়গা বাছতে হবে যেখানে কাছাকাছি একটা নদী কি জঙ্গল মতন রয়েছে, মাটি খুব শক্ত বা পাথুরে নয় আবার জলা-জমি ধরণেরও নয়। দেখতে হবে জল যেন না জমে | নিউজিল্যাণ্ডে বহু জায়গাতেই মাটি অপেক্ষাকৃত নরম কিন্তু পাথুরে নয়।
মাটি ছাড়া হাঙির জন্য লাগে পাথর আর কাঠ। পাথর হতে হবে একটা বেশ বড় সাইজের ঝামা যেমন হয় তেমন, তবে ঝামার থেকে ওজনে ভারি হওয়া চাই। পাথরটার ভেতরে যত বেশী ছোট ছোট ফুটো থাকে ততই ভাল, তাতে করে সে পাথর তাড়াতাড়ি করে গরম হবে আর চট করে ফাটবে না। এরকম অনেকগুলো পাথর একসঙ্গে জড়ো করা হলে, তাদের সমষ্টিগত নাম হল টাওঙা। এদেশের প্রায় সর্বত্র দেখবেন পাহাড়ের ঝরণা থেকে উথ্থিত অগণিত ছোট, অগভীর নদী। সেসব নদীর চরে ইতস্তত ছড়ানো অজস্র উপলখণ্ড | প্রাচীন কালে মাওরীদের গ্রামের প্রবীণ লোকজন পূর্ণিমার জোৎস্নারাতে নদীতে নেমে নদীর বুকে চকচকে উপলখণ্ড তুলে আনতেন | হাঙিতে ব্যবহার করার আগে পাথর গুলোকে জ্বালিয়ে দেখে নিতে হয়।
আজকাল অবশ্য হাঙি করার সময় অনেক পাথরের বদলে রেললাইনের বাতিল ফিশপ্লেট ব্যবহার করেন, তবে সে জিনিসও দেখেশুনে নিতে হয়, কারণ আজকাল বহু ফিশপ্লেটে আরসেনিক থাকে, যার জন্য না ভেবে চিন্তে নিলে হাঙি থেকে আরসনিক জনিত বিষক্রিয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আর একটা ব্যাপার দেখতে হয় যেন লোহা বা স্টীলের সঙ্গে খাবারের সংস্পর্শ না হয়; নাহলে খাবারে বিশ্রি একটা লোহা বা ধাতব গন্ধ হয়ে যায়। যার জন্য ওই ধরণের জিনিস ব্যবহার করলে তার ওপরে প্রচুর কাঠ দিয়ে দিতে হয়। কাঠ হওয়া চাই ঘন, মোটা ভাল মত জ্বলতে পারে এমন কাঠ, এখানে মানুকা নামে একটি গাছ আছে, যার মধু বিখ্যাত, সেই ধরণের কাঠ এ কাজের জন্য সুপ্রশস্ত।
সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেলে, এক মিটার বাই আধ মিটার মতন গভীর গর্ত খুঁড়ে, প্রথমে কাঠ আর ডালপালা দিয়ে নীচটা ভরিয়ে দিতে হয়, তারপর কাঠ আর পাথর সাজিয়ে দিয়ে আগুণ ধরিয়ে দিতে হয়। তারপর আগুণ জ্বলতে থাকলে দেখে নিতে হয় পাথর কতটা গরম হল। খুব গরম পাথরের ওপর যখন জলের ফোঁটা বাষ্প না হয়ে চলকে পড়ে যায়, সেই সময় ছাই সরিয়ে সে জায়গায় তারের বা বেতের ঝুড়িতে করে মাছ, মাংস, সবজি, আলু, রাঙালু (রাঙালুর মাওরী নাম কুমারা), পরতে পরতে সাজিয়ে নিতে হয়।এর পর তার ওপরে চটের বস্তার কাপড় ভাল করে ভিজিয়ে, ভাল করে মাটি চাপা দিয়ে ঘন্টা দুয়েকের অপেক্ষা। ঘন্টাদুয়েক পরে যখন বেশ খাবারের গন্ধ বেরোবে তখন মাটি সরিয়ে খাবারের ক্রেটগুলো বার করে নিয়ে খাওয়া দাওয়া শুরু।
মাওরীদের খাবার দাবার খাওয়ার ধরণ, হেঁশেল, এসবের সঙ্গে আমাদের বাঙালী সাবেক প্রথার বেশ মিল পাই | মার্ক টোয়েন “Following the equator” বইতে লিখছেন,
“The Maoris had the tabu; and had it on a Polynesian scale of comprehensiveness and elaboration. Some of its features could have been importations from India and Judea. Neither the Maori nor the Hindoo of common degree could cook by a fire that a person of higher caste had used, nor could the high Maori or high Hindoo employ fire that had served a man of low grade; if a low-grade Maori or Hindoo drank from a vessel belonging to a high-grade man, the vessel was defiled, and had to be destroyed. There were other resemblances between Maori tabu and Hindoo caste-custom.”
কয়েকটি উদাহরণ দিই | যেমন মাওরী বাড়িতে চটি বা জুতো বাইরে ছেড়ে তবে ভেতরে প্রবেশ করবেন। রান্না ঘরে কখনো জুতো পরে যাওয়া চলবে না। তারপর খাবার টেবিলে পিছন ঠেকিয়ে বা খাবার টেবিলের ওপর উঠে বসা চলে না। কোথাও মাওরীদের জনসমাগম (হুই) হলে সেখানে খাওয়া দাওয়ার একটা বড় ব্যাপার থাকে, এ ব্যাপারেই আমাদের বাঙালীদের সঙ্গে মিল। এবং খাওয়া দাওয়া শুরু করার আগে একজন প্রবীণ সে খাবারটিকে পূর্বপুরুষদের নিবেদন করবেন, তারপরই সকলে মিলে খাবার গ্রহণ শুরু করবেন। একই ব্যাপার কোন জনসমাবেশে কোন অনুষ্ঠান শুরুর আগে প্রবীণ বা মানে মর্যাদায় প্রবীণ আশীর্বাদ করবেন, সমবেত গান বা স্তোত্রপাঠ (“কারাকিয়া”) হবে, তারপর সভা সমাবেশ শুরু হয়। মাওরীদের নিয়ে সবিস্তারে পরে লিখব, আপাতত দু একটা কথা লিখে সারি। মাওরীদের মধ্যে জাতপাতের সমস্যা সেভাবে নেই, তবে “জাতি” ভেদের একটা ব্যাপার আছে। যেহেতু এখানে বহু ট্রাইব, এক জাতির লোকের সঙ্গে আরেক জাতির লোকের সেভাবে সদ্ভাব নেই (অনেকটা আমাদের বাঙালিদের দলাদলির মত ব্যাপার আর কি) |
বিশেষ এক ধরণের পালং শাক (তেকোনা পালং শাক, “কোকিহি”) জোসেফ ব্যাঙ্কস নিউজিল্যাণ্ডের দক্ষিণ দ্বীপে পেয়েছিলেন, পরে ইউরোপে নিয়ে আসেন), রাঙালু (খুব সম্ভবত মাওরিরা পলিনেশিয়া থেকে এনেছিল), বুনো কুল বা পিপুল (“হোরোপিতো”), আর মানুকা গাছের মধু বাদ দিলে নিউজিল্যাণ্ডের নিজস্ব ফল বা সবজি সেরকম কিছু নেই, সবই প্রায় আমদানি করা। মাওরীরা যখন আসে, তখন এই সব দ্বীপে হয়ত মোয়া নামে প্রকাণ্ড উটপাখি সদৃশ পাখি দেখে থাকবে ও তাদের মেরে খেয়েও থাকবে, কারণ পাখী, আর টুয়াটারা নামের প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি একাদিক্রমে বেঁচে থাকা গিরগিটি ধরণের প্রাণী ছাড়া এই দ্বীপমালায় কোন
পশুর অস্তিত্ব নেই, এমনকি সাপ-খোপ-কুমীরও নেই | সমুদ্র ঘেরা, অজস্র নদীনালা, যার জন্য মাছ, আর কাঁকড়া প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় |
ত্রিকোণ পাতার পালং শাক: জোসেফ ব্যাঙ্কস নিউজিল্যাণ্ডে এদের প্রথম দেখা পান এবং ইংল্যাণ্ডে / ইউরোপে প্রচলন করেন।
ব্রিটিশ নাবিক এবং আবিষ্কারক ক্যাপটেন কুক এখানে ভেড়া, শুয়োর, এবং আলু নিয়ে আসেন। মাওরিরা খুব উৎসাহের সঙ্গে আলু চাষ শুরু করে| ডেভিড বার্টন , তাঁর “New Zealand Food and Cookery” বইতে লিখছেন যে আলুর ফলন এত রকম হয় যে তাই নিয়ে এক মাওরি জাতির সঙ্গে আরেক জাতির রীতিমতন দ্বন্দ শুরু হয়; আলুর বেশ কিছু মাওরি কালটিভারও পাওয়া যেত, এখনো বাজারে কয়েক ধরণের মেটে আলু পাওয়া যায় যেগুলো মাওরি কালটিভার। একসময় আলুর ফলন এত হয়েছিল যে মাওরীরা তাদের আলু উৎপন্ন করে রীতিমতন অস্ট্রেলিয়া (সিডনি) এবং ক্যালিফোরনিয়ায় রফতানি করত। কালক্রমে অন্যান্য গোত্রের আলু এসব দেশে আসতে শুরু করে, খাওয়া দাওয়ার চালচিত্রের দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে, ফলে মাওরীদর ফলানো আলুর বাজার মার খেতে থাকে। দুঃখের বিষয়, সেইসব সুস্বাদু কালটিভারের আলুর অনেকগুলোই এখন অবলুপ্ত, তবে যা অবশিষ্ট আছে, তাকে রক্ষা করার চেষ্টা হচ্ছে |
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় | ইংরেজ আসার আগে মাওরীদের খাওয়া দাওয়ার একটা ধরণ ধারণ ছিল, ইংরেজ ও ইউরোপীয়রা আসার পর তার বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। যেমন ইউরোপীয়ানরা ধাতব পাত্র নিয়ে আসে, তার আগে মাওরীরা ঝলসানো আর হাঙি বাদ দিয়ে বিশেষ সেদ্ধ করে খাওয়া দাওয়া করত না, তাছাড়া, মাওরী খাবারের মধ্যে আটা ময়দার প্রচলনও ছিল না। শুয়োর, গরু, বা ভেড়ার মাংস খাবারও সেরকম চল ছিল না তাদের মধ্যে | এতে করে অবশ্য শুধু মাওরি নয়, অন্যান্য পলিনেশীয় জনগোষ্ঠীর মানুষেরও নানারকমের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি দৈহিক পরিবর্তনও হয়েছে, সে সব অন্য কোন সময় আলোচনা করা যাবে, এখানে একটা পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে এযাত্রা শেষ করছি, পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপীয় ও নিউজিল্যাণ্ডের সাবেকি খানা নিয়ে আলোচনা করব।
ইংরেজ নিয়ে এল ধাতব পদার্থের বাসনপত্র, শুয়োর, আটা ময়দা, আলু | মাওরীদের হাতে পড়ে এক নতুন ধরণের খাবারের সূত্রপাত হল। এর আগে মাওরীরা খাবার বড় একটা সেদ্ধ করে খেত না। এবারে তারা খাবার সেদ্ধ করে খেতে শুরু করল, এক নতুন, প্রায় নিউজিল্যাণ্ডের সিগনেচার খাবার, “Boil up” এর জন্ম হল।
এতে পর্ক হাড়, কলমি শাক (“পুহা”), আর ময়দা জলে গুলে মেখে লেচি তৈরি করতে লাগে। লেচি তৈরী করে নিন প্রথমে | তার পর্ক হাড় আর কলমি শাক, জলে ফেলে ঘন্টাখানেক ধরে সেদ্ধ করুন, শেষ পনেরো মিনিট লেচি কেটে ফেলে দিন | সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে সুপ ছেঁকে ফেলুন আর শাক, মাংস, ডামপ্লিং সার্ভ করুন আলাদা করে। বয়েল আপ এদেশের বেশ জনপ্রিয় খাবার, হোটেল রেস্তোঁরায় হয়ত পাবেন না, তবে অনেক বাড়িতে দ্রুত খাবার হিসেবে অনেকেই রান্না করেন।
মাওরিরা একরকম ভাবে চলছিল, নিউজিল্যাণ্ডের খাওয়া দাওয়ার একটি নতুন যুগের সূত্রপাত হল ইংরেজ ও ইউরোপিয়ানরা আসার পর। সে গল্প এর পর।