মাওরিদের খাওয়াদাওয়া জীবনযাপন একরকম চলছিল। এমন সময়, ১৭৬৯ সাল নাগাদ ক্যাপটেন কুকের জাহাজ এনডেভার নোঙর ফেলল নিউজিল্যাণ্ডের উত্তর দ্বীপের নির্জন সৈকতে | নাবিকরা নেমে পড়লেন । খাবার দাবার?
ক্যাপটেন কুক নাবিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে যা স্থানীয় খাবার বা শাকসবজি পাওয়া যাবে তাই দিয়ে খাওয়া দাওয়া সারতে | যার জন্য প্রথম দিকে নাবিকেরা ওটমিল দিয়ে পরিজ আর তাতে নিউজিল্যাণ্ডের বিশেষ ত্রিকোণবিশিষ্ট একধরণের পালং শাক পাওয়া যেত, তাই দিয়ে সকালের প্রাতরাশ সারতেন।
কুকের সহযোগী, বটানিস্ট জোসেফ ব্যাঙ্কস সেই তেকোণা পালং শাক ইংলণ্ডে নিজের বাগানে নিয়ে আসেন,
এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে সেই পালং শাকের চাষ হয়।
সেই শুরু।
নিউজিল্যাণ্ডের খাওয়া দাওয়ার ট্র্যাডিশন, যেখানে স্থানীয়, মাওরী ও ইউরোপীয় পাকপ্রণালীর সংমিশ্রণ,
তার গোড়াপত্তন একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকেই হয়েছিল। তার পরের একশো বছর নতুন দ্বীপের অধিবাসীদের কাছে দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম ও খাদ্য সংগ্রহের কঠিন জীবন। ক্রমশ জীবন সহজ হতে শুরু করল। পৃথিবী জুড়ে বাণিজ্য শুরু হল, এক দেশের পণ্য অন্য দেশে বহন করা সহজলভ্য হল। এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো থেকে নিউ জিল্যাণ্ডে খাবার দাবার আসা আরম্ভ হল, আগে যেমন খাবার দাবার রান্নার উপকরণের জন্য পুরোটাই অস্ট্রেলিয়ার ওপর নির্ভর করে থাকতে হত, সেই নির্ভরশীলতা অনেকটা কমল। মোটামুটি ১৮৫০ এর সমসাময়িক পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেশ থেকে দেশান্তরে খাদ্যদ্রব্য আমদানী রফতানি শুরু হয়, সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
নিউজিল্যাণ্ড এর ব্যতিক্রম নয়, তবে নিউজিল্যাণ্ডের খাওয়া দাওয়ার রান্নাবান্নার পট পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে |
আমরা গত পর্বে দেখেছিলাম মাওরিদের এক রকমের খাওয়া দাওয়ার ট্র্যাডিশন ছিল। ইংরেজ আসার পর তার চিত্র অন্যরকম | ইংরেজ মাওরিদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল শাক সবজি আলু ইত্যাদির জন্য। মাওরিরাও ইংরেজ আসার পরে তাদের খাবার দাবারের প্যাটার্ন অনেকটা বদলায় | নিউজিল্যাণ্ডে যে অনেক ধরণের শাকসবজি গোড়া থেকে ছিল তা নয়, এমনকি সেভাবে পশুও বিশেষ ছিল না। থাকার মধ্যে শুধু পাখি আর জংলি ফল | মাওরিরা পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসার সময় কিছু শস্য ফল পশু নিয়ে আসে, যদিও তার অনেক কিছুই আর এদেশের আবহাওয়ায় বাঁচেনি। ইংরেজরাই প্রথম ভেড়া, গরু, শুয়োর, মুরগি ইত্যাদি নিয়ে আসে। ফরাসীরা খুব সম্ভবত খরগোস নিয়ে এসেছিল। ১৮৫১ সালে প্রথম দক্ষিণ দ্বীপে ক্রাইস্টচার্চের কাছে লিটলটন অঞ্চলে খরগোসের দেখা পাওয়া যায়, সেগুলোকে ধরেও খাওয়া হত সেকালে; মনে করা হয় এদেশে প্রথম পা রাখা ফরাসীরা খরগোসগুলো সেখানে ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে। পরে ফরাসীদের হটিয়ে ইংরেজ দক্ষিণ দ্বীপে জমিয়ে বসে।
নিউজিল্যাণ্ডে খাদ্যোপযোগী নেটিভ শাকসবজি বিশেষ পাওয়া যেত না, আর চারপেয়ে জন্তুর তো পাওয়া যেতই না, তাদের কথা বাদ দিন | খাবার হিসেবে সে অভাব পূর্ণ করেছিল এখানকার জঙ্গলে জঙ্গলে নানান প্রজাতির পাখী,
আর জলে অঢেল মাছ, কাঁকড়া, শামুক, গুগলি, প্রভৃতি | জমি এখানে উর্বর, কিন্তু যেহেতু জলহাওয়া অপেক্ষাকৃত অনুষ্ণ,
যার জন্য সব রকমের ফল বা সবজি এখানে মনের মত করে ফলানো যেত না | বিশেষ করে ট্রপিকাল ফল তো নয়ই |
যার জন্য আজও কলা, আম, কাঁঠাল, লঙ্কা, ঢ্যাঁড়স, বেগুন জাতীয় অপেক্ষাকৃত গরম অঞ্চলের সবজি আমদানী করতে হয় ফিজি বা অস্ট্রেলিয়া থেকে। অবশ্য উত্তরের দ্বীপে, অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল, সেখানে কলা বা ওইধরণের কিছু ফল ও সবজি চাষ করা হয়।
এখানকার আঙুর উৎকৃষ্ট, যার জন্য নিউজিল্যাণ্ডের ওয়াইনের আন্তর্জাতিক বাজারে কদর আছে। যদিও আঙুরও এখানকার নেটিভ নয়, স্যামুয়েল মারসডেনের হাত ধরে এখানে আসে। চারলস ডারউইন তার নিউজিল্যাণ্ড ভ্রমণের সময় এখানকার ওয়াইনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ফলের মধ্যে কমলালেবু, বড় গোঁড়ালেবু, বা কিউয়িফ্রুট এখানে ভারি চমৎকার হয়। তবে ইংরেজ বা ইউরোপীয়রা এখানে আসার সময় সে ধরণের ফল তাঁরা পান নি, এমনকি গম, যব, চাল, বা ওই ধরণের শস্যও অমিল ছিল| কারবোহাইড্রেটের জন্য যে কারণে তাঁদের আলুর ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হত। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। যেমন এত ঠাণ্ডা দেশে পাঁউরুটি তৈরীর yeast চট করে পাওয়া যেত না, যার জন্য আলু, ময়দা, আর চিনি মিশিয়ে রাতভোর রেখে পাঁউরুটি তৈরী হত।এখনো বিভিন্ন জায়গায় অনেকে সেভাবে রুটি তৈরী করেন, মাওরীরা ওই রুটির নাম দিয়েছিল রিউইনা রুটি (R`ewena bread) |
তবে মাছ ও মাংসের ব্যাপারে, বিশেষ করে ভেড়ার মাংসের ব্যাপারে প্রকৃতি নিউজিল্যান্ডে উদার। একটা উদাহরণ দিই।
প্রখ্যাত কলামনিস্ট ডেভিড বারটন, ভেড়া পালন করার এবং চারণ করার জন্য শিপ স্টেশনগুলোতে কি ধরণের খাবার পাওয়া যেত, তার কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন,
“Mutton, damper and tea (and that colonial tea) at breakfast, dinner, and supper, day after day, month after month …” (New Zealand Food and Cookery)
সেযুগের মেষপালকরা তাদের স্টেশনগুলোতে যব আর ভেড়ার মাংস (মাটন) দিয়ে একটি খাবার রান্না করত | এতে মাংস,
যব (বার্লি), পেঁয়াজ, গাজর, লেবুর খোসা, নুন আর মরিচ দেওয়া হত।সে রেসিপি ভারি সহজ, মাংস, বার্লি, পেঁয়াজ,
গাজর, লেবুর খোসা সব সুদ্ধ গরম জলে ফেলে ফোটানো। রান্না হয়ে গেলে লেবুর খোসা তুলে ফেলে দেওয়া |খাবার জন্য ছিল চা আর ড্যামপার নামের পাঁউরুটি।
আর সে ড্যামপার তৈরী হত ময়দা, নুন আর জল দিয়ে মেখে, ডাচ ওভেন বা আগুনে সেঁকে পাঁউরুটি, তাতে ঈস্ট থাকত না। সেকালের “খাদ্যরসিক” মেষপালকরা পোড়াকাঠের ছাই আর পটাশ মিশিয়ে রুটি ফোলাবার উদ্যোগ করতেন অবিশ্যি।তা সে খাবার যেমনই হোক, প্রথম দিকের কষ্টকর দিনগুলো, চাষবাস করে, ভেড়া গরু চরিয়ে জমিজিরেত গড়ে খাবার দাবারে যখন প্রাচুর্য এল, তখন থেকে, ধরা যাক উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়, তখন থেকে বলতে নেই এখনও পর্যন্ত এদেশে খাবার দাবার মোটামুটি পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং বেশীর ভাগ খাবার অপেক্ষাকৃত সস্তায় পাওয়া যায়। তবে আগের মতন বা অন্তত উনবিংশ শতকের সেই প্রভূত পরিমাণে খাবার দাবারের দিনগুলো সম্ভবত গিয়েছে।
বারটনের বই থেকেই আরেকটি উদাহরণ দিই | লিখছেন ভিক্টোরিয়ান আমলে ধরুন ১৮৫০ সাল বা তার পরের দিকে,
নিউজিল্যাণ্ডের মধ্যবিত্ত সায়েবের সাধারণ ঘরের বাড়িগুলোতে অবধি বেশ এলাহী ভোজের বন্দোবস্ত হত। এরা সকাল বেলা শুরু করত আণ্ডা, বেকন, পরিজ, ল্যাম্ব কাটলেট দিয়ে (এখানে কাটলেট বলতে বেশ মোটা করে মাংসের চাকতির কথা বলা হচ্ছে), তার সঙ্গে কখনো সখনো কারি বা মাছের একটা পদ থাকত। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
যেহেতু নিউজিল্যাণ্ডে বিশেষ করে মফঃস্বল বা গ্রামের দিকটায় যেহেতু বহু মানুষ কৃষিকাজ করেন, সকালের প্রাতরাশ একটা বেশ বড় ধরণের খাবারের ব্যাপার ছিল, এখনো তাই রয়েছে। তারপর দুপুরের দিকে স্যুপ, মাংসের রোস্ট, পুডিং আর ফল থাকত। রাতের দিকে আকছার চার পাঁচ কোরস খাবার থাকত, তার মধ্যে স্যুপ, মাছ, মাংস, শাকসবজি,
পুডিং মিলিয়ে জমজমাট খাওয়ার ব্যবস্থা। রাতের ভুরিভোজের পরেও ফল, মিষ্টি ইত্যাদি খাবার একটা চল ছিল।এবং নিউজিল্যাণ্ডে কখনোই সেভাবে মাছ-মাংসের অভাব ছিল না। ডেভিড ভিয়ার্ট “First catch your weka” বইতে লিখেছেন যে ১৯৭২ সালে তিনি যখন ওয়েলিংটনে সরকারী দপ্তরে কাজ করতেন, তখন তাঁরা অমলেটে মোড়া মাংসের স্টেক দিয়ে প্রাতরাশ সারতেন। বুঝুন ব্যাপার! সেও প্রায় আজ প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। এর মাঝে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে, কিন্তু গ্রাম, শহর, মফঃস্বলে, যেখানে বলুন, সাধারণ পরিবারে খাওয়া দাওয়ার প্যাটার্ণটা অনেকটা বদলায়নি ।
নিউজিল্যাণ্ডে বুনো চারপেয়ে জন্তু না থাকলেও নানারকমের খাদ্যোপযোগী বন্য পাখী আছে, মাওরীরা যেমন মোয়া নামের অতিকায় পাখী প্রায় খাবার জন্য মেরে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল বলে শোনা যায়। আরেকটি পাখী, যার মাংস অনেকে খান, বিশেষ করে মাওরীদের মধ্যে জনপ্রিয়, সেটি মাটনবার্ড | তা এই পাখীটি আপনি নিউজিল্যাণ্ডের বাইরে বিশেষ পাবেন না। পাখীটি আকারে ছোট, এবং মাংসের মধ্যে অনেকটা চর্বি থাকার জন্য, এবং স্বাদও বেশ উগ্র, যার জন্য ইংরেজ একে চর্বিঅলা ভেড়ার মাংসের সঙ্গে তুলনা করত, এর নাম দেওয়া হয়েছে মাটন বার্ড | এছাড়া বুনো মুরগী, যার নাম ওয়েকা।
এছাড়াও নিউ জিল্যাণ্ডের মত একটি দ্বীপে মাছ নানান রকমের ও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আমার কাছে অবাক লাগে যে মাংসের তুলনায় মাছ খাওয়ার চল নিউজিল্যাণ্ডে সাদা সাহেবেদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। এখন তার কারণ থাকতে পারে যে আবহমান কাল থেকে ইংরেজের প্রাধান্য, তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভেড়া , বীফ, আর পর্ক পাওয়া যায়, যার জন্য মাছের দিকে ততটা আকর্ষণ ছিল না এদের। তবে অবশ্য মাছ খাওয়ার চল বরং মাওরি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে, আর আমাদের এশীয়দের মধ্যেই অনেক বেশী। নিউজিল্যাণ্ডের নিজস্ব মাছের মধ্যে হোকি, দিশি গ্রোপার, মোকি, তারাকিহি, বেশ বড় মাপের ইলমাছ ইত্যাদি নদীর মাছ তো রয়েছেই, তাছাড়া নিউজিল্যাণ্ডের স্যামনও বিখ্যাত। যদিও তেলযুক্ত এই চিনুক স্যামন মাছ নিউজিল্যাণ্ডের নদীতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসেছে, এবং স্যামন যে লেক বা নদীতে পাবেন না তা নয় (ওয়াইল্ড স্যামন), তবে বাজারে যে ধরণের স্যামন পাওয়া যায়, তার সবটাই ফার্মড স্যামন। কাজেই স্যামনকে সে অর্থে নিউ জিল্যাণ্ডের নেটিব বলা যাবে না।
প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে তো, ফলে এখনকার নিউজিল্যাণ্ড দেখলে বোঝা যাবে না যে সাবেক কিউয়িদের বিদেশী খাবার সম্বন্ধে কিরকম রক্ষণশীল মনোভাব ছিল একসময়ে। তবে এখনো, অধিকাংশ কিউয়ি বাড়িতে মাংস আর তিন রকম সবজি দিয়েই খাবার সম্পন্ন হয়, তিন রকম সবজির মধ্যে হয়ত গাজর, কড়াইশুটি, আর আলু। অথচ দেখুন দ্বীপভূমিতে যেখানে চারপাশের সমুদ্রে মাছ অঢেল, সেখানে এই সেদিন পর্যন্ত নিউজিল্যাণ্ডের মানুষ খুব বেশী মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণী খেতেন না, তুলনায় মাংস অনেক বেশী প্রচলিত | ইদানীং অনেকে স্বাস্থ্য সচেতন হবার দরুণ মাছের বিশেষ করে স্যামন জাতীয় মাছ খাওয়ার কদর বেড়েছে।
নিউজিল্যাণ্ডের মানুষের খাওয়া দাওয়া নিয়ে কথা বলতে গেলে আরো দু-তিনটে বিষয়ের অবতারণা করতে হয়।
এক, দুনিয়ার খাবারের জগতে নিউজিল্যাণ্ডের অবদান বলতে বেকিং, তার মধ্যে পাভলোভা আর পাইয়ের কথা না বললেই নয়। দুই, কাফে কালচার আর বাইরে খাওয়ার চল, সেখানেও কিউয়ি ব্যারিস্টা ওস্তাদের হাতের ফ্ল্যাট হোয়াইট সবিশেষ উল্লেখযোগ্য | তিন, চীনে, ভারতীয়, গ্রীক, ইতালীয় সংমিশ্রণের রেস্তোঁরা সংস্কৃতির কথাটাও বলতে হয়।
বেকিং , মানে ধরুন কেক পেস্ট্রি তৈরী এখানকার মানুষের ডিএনএ তে। ফি রোববার, “সানডে রোস্ট” এর সঙ্গে সারা সপ্তাহের খাবার জন্য এখনো বহু বাড়িতে স্কোন আর মাফিন তৈরী হয়। তারপর ধরুন প্রায় সারা বছর জুড়ে নিউজিল্যাণ্ডের কোথাও না কোথাও Agriculture and Produce Show, যার পোষাকী নাম এ এণ্ড পি শো হতে থাকে।
সেই সব “শো” এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট স্থানীয় মহিলাদের বেকিং কম্পিটিশন। তা নিউজিল্যাণ্ড বেকিং এর সবচেয়ে তুখোড় উদাহরণ পাভলোভা আর পাই। আমাদের যেমন রোল, পাটিসাপটা, সিঙারা, যাকে সাদা বাংলায় পথের খাবার বা স্ট্রীট ফুড বলা যেতে পারে, নিউজিল্যাণ্ডের স্ট্রীট ফুড বলতে যদি কিছুকে নির্দেশ করতে হয়, সে হবে পাই | যে কোন মাংস (বীফ, পর্ক, ল্যাম্ব, মুরগী, মাছ, মায় মেটে) এবং শাকসবজি আর মিশিয়ে রান্না করে পাইয়ের খোলের মধ্যে ভরে দিন; তারপর তার ওপরে চীজ কুরিয়ে বা কেটে পরতে পরতে রাখুন, এবার পাইয়ের ময়দার খোলের “ঢাকনা” বন্ধ করে দিন, বন্ধ করার পর ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ৩০ মিনিট রেখে বেক করুন | পাই তৈরী।
পাই খাবার কায়দা জানতে হয়। খেতে হলে ওপরের খোলটা কেটে প্রথমে খেয়ে নিন, তারপর বাকী অংশটুকু চামচে দিয়ে তুলে খেয়ে ফেলুন। পাই এখানে এত জনপ্রিয় যে প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলগুলোতে কাফেগুলো ভোর পাঁচটা থেকে খুলে যায়, তার আগে রাতে তিনটে নাগাদ কারিগররা পৌঁছে যান, রুটি আর পাই তৈরী করতে।
পাই তৈরীতে বিশেষ ঝঞ্ঝাট নেই, মোটামুটি এক ডিশের খাবার, একটি পাই খেলেই আপনার অনেকক্ষণ শরীর ও মন ভরে যাবে | কাজেই মেলায় বলুন,রাস্তার খাবার বলুন, বা ধরুন ছেলেমেয়েদের সপ্তাহান্তে ক্যাম্পে বা মাঠে খেলাতে নিয়ে গেছেন আর হাতে খানিকটা সময় আছে, খাবার খাবেন ভাবছেন, এই সময় পাই খাবার পক্ষে প্রশস্ত, ও পাই প্রস্তুতকারীরাও বিলক্ষণ জানেন, যার জন্য তাঁরাও বিচিত্র রকমের পসরা নিয়ে হাজির। কিনে খেলেই হল |
চটজলদি আর কাফে স্টাইলের খাবার কথা যখন উঠছে, পাভলোভার আর ফ্ল্যাট হোয়াইট কফির কথাটা এই সূত্রে লিখি। বিখ্যাত রাশিয়ান ব্যালেরিনা আনা পাভলোভা ১৯২৯ সালে তাঁর ব্যালে ট্রুপ নিয়ে নিউজিল্যাণ্ড আর অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন | তো সেই সময়ে তাঁর সম্মানে ওয়েলিংটনের এক পেস্ট্রি নির্মাতা তাঁর টুটুর বহর দেখে উদ্দীপিত হয়ে ডিমের সাদা অংশ দিয়ে মেরাং, আর তার ওপরে ফলের সমারোহে এই খাবারটি তৈরী করেন। তবে অস্ট্রেলিয়ানরাও দাবী করেন একই সময়ে বা তার আগে পার্থ শহরের এক কারিগরের হাতে এর জন্ম হয়। এই নিয়ে দুই দেশের সাংঘাতিক রেষারেষি ছিল একসময়ে | সে যাই হোক, পাভলোভার গল্প ভারি আকর্ষণীয় ও জটিল, সময় পেলে সে গল্প অন্যত্র লেখা যাবে। উৎসাহী হলে হেলেন লিচের লেখা পাভলোভা স্টোরি নামে বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
নিউজিল্যাণ্ডের আরেকটি পানীয় ফ্ল্যাট হোয়াইট কফি। যদিও নিউজিল্যাণ্ডের কফি কালচার হালের। ধরুন গত ৫০ বছরে গড়ে উঠেছে, তাও প্রদেশ বিশেষে। যেমন দক্ষিণ দ্বীপের ক্রাইস্টচার্চ বা ডুনেডিন এলাকায়, যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয়দের তুলনায় ইংরেজের ও সে কালচারের বেশ প্রভাব রয়েছে, সে সব জায়গায় এখনো চায়ের প্রচলন বেশী, কাফেগুলোতে সুদৃশ্য টি পটে চা আর দুধ চিনি পাওয়া যায়। আবার ওয়েলিংটন আর অকল্যাণ্ড অঞ্চলে, যে সব জায়গা অপেক্ষাকৃত কসমোপলিটান, সেখানে কফির জনপ্রিয়তা। অবিশ্যি কালচার যাই হোক, চায়ের কথা উঠলে,মাওরি পাকিহা নির্বিশেষে কিউয়ি মানুষ চায়ের ভক্ত, তবে সে চা কিন্তু দার্জিলিং এর চা নয়, বরং আসামের চায়ের মতন,কড়া হওয়া চাই | এককালে এনামেলের পাত্রে ক্যাম্পে চা খাওয়ার সেই ট্র্যাডিশন থেকে যার শুরু, বুঝে নিন। চায়ের কালচার ব্রিটিশের অবদান।
কফি নিউজিল্যাণ্ডে হালে জনপ্রিয় হতে পারে,কিন্তু ফ্ল্যাট হোয়াইট কফি নিঃসন্দেহে কিউয়ি ওয়েলিনংটন অঞ্চলের অবদান। যেহেতু এখানে সেভাবে প্রথম থেকে ইউরোপীয় প্রভাবে কফি কালচার গড়ে ওঠে নি, লোকে সাধারণত ইনস্ট্যান্ট কফি নিয়েই সুখী ছিলেন, কফির খুঁতখুঁতুনি সেভাবে হয় নি। লোকে মোটামুটি ইনস্ট্যানট কফি দিয়ে দিব্যি কাজ চালাতেন। কাফের কালচার হালের কালচার। ১৯৮১ সালে ডেরেক টাউনসেণ্ড নামে এক কিউয়ি ব্যারিস্টা এসপ্রেসো কফিতে গরম মাঠা ওঠা দুধ মিশিয়ে এই ড্রিঙ্কটি তৈরী করেন, এবং পানীয়টি দ্রুত জনপ্রিয় হয়।
এই গল্পে গল্পে যে কথাটা বলার, দুশো বছরের ওপর ধরে একটি দেশে খাওয়া দাওয়ার একটা নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
দেশটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিবাসীদের নিয়েও গড়ে উঠেছে, তাঁরাও তাঁদের ফেলে আসা দেশের খাবার নিয়ে এদেশের খাদ্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। চীনারা যেমন। ১৮৫৪ সালে ওটাগো অঞ্চলে নদীর জল থেকে সোনা নিষ্কাশনের একটা ঢেউ ওঠে, এবং সে কাজে আগে একবার লিখেছিলাম যে ভারতীয় ও চীনাদের অবদান ছিল। বিশেষ করে গোয়ানিজ এডওয়ার্ড পিটারস, যাঁর নাম ছিল ব্ল্যাক পিটারস, তিনি এ অঞ্চলে সোনা খুঁড়ে বার করায় প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। পরবর্তী কালে বহু চীনা লোকজন এই কাজ করেন, এবং তাঁদের মধ্যে বহু চীনা এই করে সমৃদ্ধ হন। তার পর অবশ্য এঁরা নিউজিল্যাণ্ডের অন্যত্র চলে যান, এবং সে সব জায়গায় অনেকে চীনা রেস্তোরা খুলে বসেন। চীনা রেস্তোঁরায় সাহেব বড় একটা সাহস করে যেত না, যে কোন কারণেই হোক। পরে অবিশ্যি খুবই জনপ্রিয় হয়, বিশেষ করে ৭০ এর দশকে যখন বহু কিউয়ি দেশ ছেড়ে এক বছর গ্যাপ নিয়ে ইউরোপের, বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের খাবারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এ দেশে বিদেশী খাবারের একটা দিগন্ত খুলে যায়।
তার আগে অবিশ্যি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ইতালীয়, গ্রীক ও য়ুগোস্লাভ অভিবাসীদের সূত্রে কিছুটা হলেও পূর্ব ইউরোপীয় খাদ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বছর তিনেক আগে আমাদেরকে একবার এখানকার ইতালীয় দূতাবাসে জনৈক ইতালীয় অফিসার দুঃখ করে বলেছিলেন যে এখানে তিনি ভালো চীজের বড় অভাব বোধ করেন। বিশেষ করে মোজারেলা ডি বুফালা (মোষের দুধের মোজারেলা চীজ), তার বড়ই দাম এদেশে। সে অবশ্য সত্যি কথা। তবে এখানে বিদেশী খাবার দাবারের ব্যবসা করা খুব সাহসের ব্যাপার। যেমন ভারতীয় খাবার দাবার যে এখানে পাওয়া যায় না তা নয়, তবে তুলনায় কম। আমার কাছে অবাক লাগে যে বিলেতে যে কালে চিকেন টিক্কা মশালা সে দেশের প্রায় জাতীয় খাবারের তকমা পেয়েছে, সেখানে, এ দেশের আম সাহেব, যাঁরা নিজেদের বিলেতের অংশ ভাবতে বেজায় ভালবাসেন,
তাঁরা সেভাবে ভারতীয়, ধরে নিন উত্তর ভারতীয় খানায় মজেন নি।
তবে ভারতীয়রা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ভারী সংখ্যায় এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। গোড়ার দিকে গুজরাটের নাভসারি অঞ্চলের মানুষ এখানে রীতিমতন জমিয়ে শাকসবজি ফলানোর আর বিক্রিবাটার ব্যবসা করতেন। বস্তুত, এ দেশের সবজি বাজারের বেশ একটা বড় অংশ ভারতীয় আর চীনাদের দখলে। কাজেই , ভারতীয় শাকসবজি, চাল, ডাল, আপনি প্রায় সর্বত্র দিব্যি পাবেন, অন্তত যে সমস্ত জায়গায় ভারতীয়দের দেখা যায়। না হলেও যে কোন বড় শহরে ভারতীয় “কিরানা” গোছের দোকান পাবেন। ভারতীয় রেস্তোঁরাও আজকার বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। আগের মতন তাতে শুধুই উত্তর ভারতীয় খাবার দাবার নয়, দক্ষিণ ভারতীয়, এমনকি খোদ বাঙালী খাবারের দোকানও দেখেছি ক্রাইস্টচার্চে, তবে দুঃখের বিষয়, দোকানটি এক বছর হল ব্যবসা গুটিয়েছে।
***
ধান ভানতে শিবের গীতের মতন খাবার দাবার নিয়ে অনেক কথা হল বটে, আপনি বলবেন দেখতে বেরিয়েছেন দেশ, কোথায় কোথায় কি খাবেন, কখন খাবেন? একটা তালিকা করা যাক।
প্রাতরাশ দিয়ে শুরু করা যাক।
ধরুন, অকল্যাণ্ড কি ওয়েলিংটনের রয়েছেন, সকালে শুরু করবেন, এই ধরুন ছটা নাগাদ। এক কাপ ধূমায়িত মাঠা ওঠা দুধের (না চাইলে সয়া মিল্ক) ফ্ল্যাট হোয়াইট আর একটি স্কোন বা মাফিন দিয়ে দিন শুরু করুন। দশটা নাগাদ মর্ণিং টি নিন। উত্তর দ্বীপের অকল্যাণ্ড অঞ্চলে থাকলে অবশ্যই বলব একটি পাই আর এক কাপ চা/কফি দিয়ে সকালের হাজরি সারুন। মাকেতু অঞ্চলের মাংসের পাই বিখ্যাত। মাংস না খেলে সবজির পাইও খেতে পারেন, বা ডিমের পাই | তা না হলে All Day Breakfast নিতে পারেন, বা Ploughman’s platter | তাতে করে নিউজিল্যাণ্ডের “মাংস-প্রিয়তার” সঙ্গে একটা সম্যক পরিচয় হবে। দেখবেন এয়া বড় মোটা চর্বি-অলা বেকন, টকটকে লাল কুসুমের আণ্ডা সাদা অংশ শুদ্ধ, সসেজ, মাশরুম, আলু-ভাজা, আর টকটকে লাল একটা রোস্ট করা টমেটো | সঙ্গে মুচমুচে করে টোস্ট করা পাঁউরুটি আর মাখন | আর পশ্চিম তটে (West coast) এ ঘুরে বেড়ালে বলব মেটে আর বেকনের পাই খেয়ে দেখতে।
সকালের এই চর্বি জমানো খাবার খেয়ে যদি দুপুরের খাবার হালকা স্যাণ্ডুইচ আর ফল দিয়ে যদি সারতে চান তো বলব,
ফলের মধ্যে অবশ্যই এখানকার গোল্ডেন কিউইফ্রুট খেয়ে দেখবেন। অন্য কোথাও চট করে পাবেন না। ল্যাংড়া আমের স্বাদ। দক্ষিণ দ্বীপে ঘুরে বেড়ালে বিকেলের আফটারনুন টি মিস করবেন না, হালকা স্যাণ্ডউইচ (শশা/চীজ স্লাইসের) আর চা হোক। রাতের বেলা রেড/হোয়াইট ওয়াইন সহযোগে কিউয়ি রোস্ট মিল হয়ে যাক। এ জিনিস নিউজিল্যাণ্ডের ট্রেডমারক, দুশো বছরের ঐতিহ্য মশাই | যে অঞ্চলেই থাকুন, ল্যাম্ব যদি খান, খেয়ে দেখবেন। দেবেন দেখবেন দুটো কি তিনটে রোস্টের চাঙ্ক, তার সঙ্গে বেশ খানিকটা গাজর আর কড়াইশুঁটি মৃদু সঙ্গত দিচ্ছে, একটা প্রমাণ সাইজের রোস্ট করা আলু আর কুমড়ো | যদি চান, আলুর বদলে রাঙালু খেয়ে দেখতে পারেন, নাম “কুমারা” | তা এ হচ্ছে সাবেকী কিউয়ি ঘরানার খানা,আপনি শুদ্ধ শাকাহারী কি ভেগান হলেও অসুবিধে নেই। নানান দেশ বিদেশের বিচিত্র খাবারের খোঁজ প্রায় সর্বত্র পেয়ে যাবেন।
রোতোরুয়া অঞ্চলে থাকলে মাওরি হাঙি স্টাইলের খাবার মিস করবেন না। অবিশ্যি আজকাল আর আদ্যিকালের মাটিতে পাথর পুড়িয়ে রান্না করে না, তার বদলে হাঙি ওভেন পাবেন। তাতে যে স্বাদের যে খুব অদলবদল হবে তা নয়,
তবে ঐ অথেনটিক নিয়ে যাঁদের খুঁতখুঁতুনি, তাঁরা মাওরি পরিবারে গেলে গণ খাওয়া দাওয়াতে সাবেকি হাঙির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। পশ্চিম তটে থাকলে সিজনে চুনো মাছের হোয়াইটবেটের অমলেট খেয়ে দেখবেন। আর কাইকোরায় ওজন করে সমুদ্রের ধারে গোটা ক্রেফিশ (গলদা চিংড়ির মতন স্বাদ) | যখন তখন প্রায় বিলিতি কেতায় কাগজে মুড়ে ফিশ এণ্ড চিপস পাবেন (মাছভাজা আর আলুভাজা), তবে কিনলে ব্লু কড দেখে অর্ডার দেবেন,
ভাল লাগবে।
কথায় কথায় খাবার দাবার নিয়ে অনেকটা হল।
সামনের পর্বে ঘোরাঘুরির গল্প বলব।
পাই বেক করতে তিরিশ "ঘন্টা" নয়, তিরিশ মিনিট মত লাগে।
ওফ দারুণ হচ্ছে সিরিজটা। দু একটা ছবি দেখে লোভ আরো বেড়ে যাচ্ছে, আরো ছবি দেখতে মন চাইছে।
"কত অজানারে জানাইলে তুমি"! অপূর্ব!
আর নিউজিলান্ড এর আইসক্রিম। জাস্ট অসাধারণ। অনেক দেশে আইসক্রিম খেয়েছি। কিন্তু ওরকম ফ্রেশ আর অত বড়ো স্কুপ সাইজ কোথাও দেখিনি। একটা আইসক্রিম দিয়ে প্রায় লাঞ্চ হয়ে যায়। ব্র্যান্ডেড আইসক্রিম তো ছেড়েই দিলাম। বেড়াতে গিয়ে দেখেছি গ্রামের মধ্যে অনেক ছোট ছোট দোকানে ফ্রেশ ফল কেটে , পাল্প করে হোমমেড আইসক্রিমের সাথে মিশিয়ে স্কুপ বানিয়ে দেয়। সেগুলোও এতো ভালো খেতে যে বলার নয়।
মানে কেও পেটুক হলে আর ওদিকে সুগার কোলেস্টেরলের প্রবলেম থাকলে নিউজিলান্ড বেড়ানো খুব কষ্টের।
:) :)
আইসক্রিম তো ঠিক আছে, কিন্তু ওই যে "... টকটকে লাল কুসুমের আণ্ডা সাদা অংশ শুদ্ধ..." আহা! এমন ডিম খেতে মঞ্চায়!
এই সিরিজটা দারুণ হচ্ছে !
খুব ভালো লাগছে। চলুক চলুক।
এই ডিনারে কিউয়ি রোষ্ট মিলের সাথে হাওয়াইয়ে লুয়াও ট্রাডিসানের কোন সম্পর্ক আছে কি না কে জানে!