১৬৪২ এর আগসট মাসের প্রথম দিন। বাটাভিয়ায় (এখনকার জাকার্তা) ডাচ ইসট ইনডিয়া কোমপানীর গভরনর জেনারেল অ্যানটনি ভ্যান ডিমেন স্থির করলেন অজানা দক্ষিণ গোলারধে তাঁরা অভিযান করবেন। আবেল জানজুন টাসমান এক দক্ষ নাবিক, তিনি সেই অভিযানের দায়িত্ব পেলেন। তাঁর অধীনে জীহান আর হেমসকারক নামের দুটি জাহাজ ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারত মহাসাগর বেয়ে পাড়ি দিল বিষুবরেখা পেরিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে| ১৪ই আগস্ট তাঁরা মরিশাস পৌঁছলেন, সেখান থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের ভারত মহাসাগরে সমুদ্রের সাংঘাতিক ঠাণ্ডা হাওয়ার দরুন আরো দক্ষিণে না যেতে পেরে পাড়ি জমালেন পূর্ব দিকে |
সে বছর তাঁর ডায়রিতে আবেল টাসমান লিখছেন,
“আজ নভেমবরের ২৪ তারিখ, চমৎকার আবহাওয়া, পরিষ্কার আকাশ, দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে হালকা বাতাস বইছে। বিকেল চারটের সময় দূরবীনে চোখ রেখে দেখছি ১০ মাইল দূরে তটরেখা দেখা যাচ্ছে।”
সেই প্রথম ইউরোপীয় নাবিকরা অস্ট্রেলিয়াকে দেখছেন, পৃথিবীর একটি নতুন দেশ, নতুন গোলার্ধ পশ্চিম দুনিয়ার মানুষ আবিষ্কার করছেন।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আরো পূবদিকে চললেন টাসমান। এখনকার টাসমান সমুদ্র পেরিয়ে তিনি নিউজিল্যাণ্ডের দক্ষিণ দ্বীপের পশ্চিম তটরেখা তাঁর দূরবীনে নজরে এল। আবেল টাসমান তাঁর ডায়রিতে লিখছেন,
“ডিসেমবরের ১৪ তারিখ দুপুরবেলা ১২ টা নাগাদ, আমরা তখন তটরেখা থেকে মাইল দুয়েক দূরে। ৪২ ডিগ্রি ল্যাটিচিউড, ১৮৯ ডিগ্রি লংগিচিউড, দেখতে পেলাম তটরেখা, সে এক উঁচু জমি, তটরেখা জুড়ে পাহাড়, সেই পাহাড়ের চূড়ো ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। আমরা আরো উত্তরের দিকে চললাম, তীরের কাছাকাছি একটি জায়গায় এলাম, সেখান থেকে দেখা যায় তটভুমিতে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কোথাও মানুষজন দেখতে পেলাম না, কোথাও যে ধোঁয়া উঠছে তারও তেমন কোন চিহ্ন পেলাম না । “
“১৮ তারিখ:
সকালবেলা নোঙর করে সারাদিন কাটল | তখন সূর্যাস্তের সময়, সমুদ্র শান্ত; ঘন্টাখানেক পরে তটভুমিতে বেশ কিছু আলোর রেখা দেখা গেল , চারটে নৌকো আমাদের জাহাজের দিকে এগোতে লাগল, এদের মধ্যে দুটো আমাদের নিজেদের। অন্য দুটো নৌকোর আরোহীরা আমাদের সঙ্গে কর্কশ গলায় কি সব বলছিল, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। রামশিঙার মতন কি একটা যন্ত্র বাজাচ্ছিল, আমরাও আমাদের ট্রামপেট বাজিয়ে উত্তর দিলাম। বেশ কয়েকবার চাপান উতোর চলল। তারপর সন্ধ্যে নামতেই তারা ফিরে গেল। আমরা বন্দুক বাগিয়ে রাত জেগে রইলাম।”
টাসমানদের সঙ্গে দক্ষিণ দ্বীপের মাওরীদের প্রথম সাক্ষাৎ।
টাসমান লিখছেন:
“সকালে একটা নৌকো, তাতে ১৩ জন স্থানীয় মানুষ, তারা আমাদের জাহাজের কাছে এল। আমাদের বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করল, ওদের ভাষা ঠিক সলোমোন দ্বীপের লোকেদের যেমন ভাষার কথা আমাদের বাটাভিয়াতে গভর্নর বলেছিলেন, দেখলাম তেমনটি নয়। এদের দেখে যা বুঝলাম, আমাদের মতনই চেহারা, বেশ শক্তপোক্ত, কর্কশ গলার আওয়াজ। এদের গায়ের রঙ হলদেটে খয়েরী গোছের, ঘন কালো চুল, মাথার ওপরে জাপানীদের মত করে খোঁপা বেঁধে রাখে তার ওপর সাদা রঙের পালক গোঁজা। এদের নৌকোগুলো লম্বাটে মত, তার ওপরে বসার পাটাতন পাতা (টাসমান যে নৌকোর বর্ণনা করছেন তার মাওরী পোষাকী নাম “ওয়াকা”, এই নৌকোয় ভেসে আজ থেকে হাজার বছর আগে মাওরিরা নিউ জিল্যাণ্ডে পদার্পণ করেন) । এদের জামাকাপড় দেখে মনে হল খড় দিয়ে তৈরী করেছে, প্রায় সকলের বুক খোলা।
আমরা ওদের মাছ, কাপড়, সুতো, ছুরি, এসব দেখালাম, আমাদের জাহাজে আসতে বললাম। এরা কেউ এল না, ফিরে গেল। এর মধ্যে জীহানের অফিসার-রা আমাদের জাহাজে এলেন, আমরা মনে করলাম এরা মনে হয় আমাদের সঙ্গে ভাব করতে চায়, এই মনে করে আমরা তীরের আরো কাছে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবে এই কথা ভেবেছি, দেখলাম ৭ টি নৌকো আমাদের দিকে তীর থেকে এগিয়ে আসছে, তার একটিতে ১৭ জন, আরেকটিতে ১৩ জন ..”
এর পর মাওরীদের হাতে টাসমানের বেশ কয়েকজন সঙ্গী নিহত হন। এই ঘটনার পর টাসমান আর সে দেশে পা রাখেন নি, ফিরে যান। যে দ্বীপটি তিনি আবিষ্কার করেন তার নাম পরে পরিবর্তিত করে রাখা হয় নিউ জিল্যাণ্ড। এর পর একশো বছরের ওপর এই দ্বীপে ইউরোপীয়দের পা পড়েনি। একশো আঠাশ বছর পর ১৭৭০ সালে ইংরেজ নাবিক ক্যাপটেন কুক আসবেন নিউজিল্যাণ্ডে, শুরু হবে সে দেশের এক কলোনিয়াল ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায়।
ধান ভানতে শিবের গীতের মতন এতটা কথা লিখলাম এই জন্য যে পৃথিবীর শেষতম আবিষ্কৃত এই দেশে আজও ইউরোপীয় বনাম মাওরী টানাপোড়েন চলেছে, সেই গল্পে আসব। শুধু তাই নয়, এই আশ্চর্য দ্বীপের আরো অনেক কিছু লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। জানা অজানার আলো-আঁধারিতে এই আশ্চর্য দেশটিকে দক্ষিণ থেকে উত্তর, আর উত্তর থেকে দক্ষিণ, চলুন ঘুরে আসি।
প্রতিটি দেশ-মহাদেশ আবিস্কারের সাথে জড়িয়ে আছে আদিবাসী গণহত্যা আর নির্যাতনের মর্মান্তিক ইতিহাস। আজও আদিবাসী নিধনযজ্ঞ চলছেই।
খুবই ব্যতিক্রমী ধারাবাহিক। মন দিয়ে পড়ছি, অনুসরণ করছি
তথ্য সমৃদ্ধ ...ভালো লাগছে ।
ভালো