এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  শরৎ ২০২০

  • হে অতীত, কথা কও

    অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
    ইস্পেশাল | উৎসব | ৩০ অক্টোবর ২০২০ | ৩৭৫৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • আগাথা ক্রিস্টির – ‘দি কামিং অফ মিস্টার কুইন’ অবলম্বনে।


    কয়েক বছর আগের এ গল্পটা মায়া মূর্তির না সত্যার্থী শতপথীর, নিশ্চিত করে বলা কঠিন। অথবা, গল্পটা আসলে দুজনের-ই। হয়ত এরা দুজন পরস্পরের পরিপূরক। দুজনে মিলেই এগিয়ে চলা একটা নির্দিষ্ট উন্মীলনের দিকে।

    গল্পের পটভূমি অনন্ত-রঞ্জনার নূতন বাড়ি। এই ছোট শহরে এই বাড়িটাই সবচেয়ে বড়। এলাকার প্রভাবশালী লোক অনন্ত ঘোষালের সাথে সত্যার্থীর আলাপ অনন্তর হাফপ্যান্ট পড়ার বয়স থেকে। সত্যার্থী কয়েক বছরের বড়। অনন্ত ওকে দাদা বলে। তবে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের-ই। সত্যার্থীর বাবা সেই সময় অনন্তদের গ্রামে এলেন স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক হয়ে। বাসা নিলেন পাশের পাড়ায়। তারপর একসময় অনন্তদের খুব কাছেই জমি কিনে উঠে এলেন এক-ই পাড়ায়। সত্যার্থীও বড় হয়ে বাবার পথ ধরল – অধ্যাপক, অংকের। কিন্তু ওর পরম পরিতৃপ্তি দর্শনে। না, দর্শন শাস্ত্রে নয়, দেখায়। ও দেখতে ভালোবাসে। প্রকৃতি এবং মানুষ। কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্তই। সেটা নিয়ে ও আর এগোয় না। এমনকি ছবি তোলারও তেমন ঝোঁক নেই। সত্যার্থী বলে - "আমি দর্শক মাত্র।" হয়ত ঐ দেখার নেশাতেই প্রচুর ঘুরে বেড়ায়, অনন্তদের মত বছরে একবার দল বেঁধে নয়। একা একাই বছরে তিন চার বার তো হবেই। বিয়ে থা করেনি, ঝাড়া হাত-পা, অসুবিধা হয় না।

    অনন্তদের যে সব বন্ধুরা দেশেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, প্রতিবছর কালীপূজোয় তাদের বেশ কয়েকজন গ্রামের বাড়িতে এসে জমা হওয়ার চেষ্টা করে। সত্যি বলতে কি সারা বছর ধরে এই সময়টার অপেক্ষাতেই থাকে ওরা। ওদের এলাকায় কালীপূজোটা জমিয়ে হয়, মেলা বসে। হৈ হৈ ব্যাপার। অনন্তর বন্ধুদের বিশেষ আকর্ষণ কালীপূজার আগের রাত মানে ভূতচতুর্দশীর রাতটা। একটু জমিয়ে পানাহার হয়। তার দু-তিন দিন আগে থেকেই ওরা গ্রামে এসে হাজির হতে থাকে, যার যেমন ছুটি যোগাড় করা সম্ভব হয়। লক্ষ্য থাকে দিন সাতেকের মত আড্ডা দেওয়া। তার মধ্যে পূজোর দুটো দিন আগে থেকে শুরু করে পরের দিন পর্যন্ত এই সময়টা অনন্তদের বাড়িতেই থাকা। বন্ধুদের মধ্যে যাদের এখনও দেশের বাড়ির পাট চুকে যায়নি তারা নিজেদের বাড়িতে এসে ওঠে। কিন্তু যাদের সেই সুযোগ নেই তাদের ঠাঁই হয় কোন না কোন বন্ধুর বাড়ি। এ বার, অতিথির সংখ্যা কম। এই রকম পরিবার মাত্রই দুটি – সমরেন্দ্র-নিনা আর অলক-আইলীন। তারা অনন্তদের বাড়ির দুটি ঘরেই জায়গা নিয়েছে। অনন্ত-রঞ্জনা বাড়িটা একেবারে আধুনিক ডিজাইনে সাজিয়ে নিয়েছে। অনেকগুলো শোবার ঘরের সাথেই লাগোয়া বাথরুম। ফলে অতিথিদের থাকতে কোন অসুবিধা নেই।

    এই বাড়িটা ওরা কিনেছে প্রায় বছর খানেক আগে। অনন্তর বাবা-মা আর ছোট ভাইয়ের পরিবার আগের বাড়িতে থাকেন। সেটা কাছেই। অনন্তর তিন ছেলে মেয়ে কালী পূজ্যটা ওখানেই সবার সাথে কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে অতিথিরা জমা হওয়ার আগেই তারা ঠাম্মির বাড়িতে তাদের আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। শুধু কি তারাই, এ বাড়িতে যে মা-বাবারা জড়ো হয়েছে, তাদের তিন পরিবারের চার ছেলেমেয়েও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। জোর হৈচৈ চলছে সেখানে।

    এই বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে রবীন্দ্র সরণী, একটু এগিয়ে সেটা মিশেছে গিয়ে এখানকার প্রধান রাস্তায়। রবীন্দ্র সরণী আর বাড়ির মাঝখানে ফুলের বাগান। বাগানের একধারে চওড়া ড্রাইভওয়ে সোজা এসে গ্যারাজে শেষ হয়েছে। শেষ প্রান্তের প্রায় দেড় দু গজ আগে শানবাঁধানো পায়ে চলার পথটা বের হয়ে বাড়ির সমান্তরালে এগিয়ে একসময় বাঁক নিয়ে বাড়িতে ঢুকবার দরজায় পৌঁছেছে। দরজার এপাশে দোতলার উচ্চতার আড্ডাঘর অর্থাৎ বৈঠকখানা। কারুকাজ করা পাল্লা বসানো দরজার ওপর দিকে দেয়ালের গায়ে অর্ধচন্দ্রাকৃত চওড়া এলাকা কমলা আর নীল রঙের কাঁচের বরফিতে ঢাকা। সেখান দিয়ে দিনের বেলা সূর্যের আলো আর রাতে বাড়ির বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো বৈঠকখানা ঘরের ভিতর ঢুকে এসে রঙের মায়া সৃষ্টি করে।

    একতলায় বৈঠকখানার বাঁ দিকে গ্যারাজ। গ্যারাজের ভিতর প্রান্তে দুই দেয়ালে দুটি দরজার একটি দিয়ে বাড়ির ভিতরের এক ঘরে আর একটি দিয়ে এই বৈঠকখানায় ঢুকে আসা যায়। বৈঠকখানার ডান দিকে আর পিছনে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, বাথরুম ইত্যাদি বেশ কিছু ঘর। দোতলা উচ্চতায় বৈঠকখানার তিন দেয়াল জুড়ে ভিতর দিকের বারান্দা যেন নীচের রঙ্গমঞ্চকে দেখবার জন্য থিয়েটারের ব্যালকনি। বারান্দাগুলিকে ঘিরে কিছু শোওয়ার ঘর অথবা বাড়ির আরো ভিতরে যাওয়ার সরু বারান্দা। দোতলায় যাওয়ার জন্য দুটি সিঁড়ির একটি উঠে গেছে গ্যারাজের পিছনের একটি ঘর থেকে, দোতলা, তিনতলা হয়ে ছাদে চলে গেছে। আর একটি এই বৈঠকখানা ঘর থেকে উঠে গেছে ব্যালকনি-বারান্দায়। বাড়ির তিনতলাতেও একটি বড় শোবার ঘর, দুটো মাঝারি আর একটা ছোট মাপের ঘর। ঘরগুলির যে দিকে বড় রাস্তা তার উল্টোদিকে টানা অনেকটা চওড়া বারান্দা, খসখসের পর্দা গোটানো থাকে, বৃষ্টি কি পশ্চিমের রোদ থেকে বাঁচতে নামিয়ে দেওয়া হয়। বারান্দায় আগে গ্রিল ছিল না। অনন্তরা কেনার পর বসিয়ে নিয়েছে।

    বৈঠকখানার আয়তন ভালোই। পর্যাপ্ত সংখ্যক সোফা আর আরামদায়ক চেয়ারে বসার ব্যবস্থার কোন অভাব নেই। সুদৃশ্য, সুসজ্জিত কয়েকটি বিভিন্ন উচ্চতার টেবিল। দেয়ালগুলোয় দরজা জানালার অংশ বাদ দিয়ে বাকিটা রকমারি সজ্জায় সাজানো – দেয়ালে টাঙ্গানো বা দেয়ালের সামনে দাঁড় করানো। পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্র, পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ, ঢাল-তরোয়াল-বর্ম আর ভয়ানক দর্শন কাঠের মূর্তি। এর কিছু কিছু আবার উপলক্ষ অনুসারে বদলে যায়। যেমন এখন কালীপূজার ঋতুতে একদিকের দেয়ালে কাপড়ের উপর মধুবনী ছাপাইয়ে করালবদনী মহামায়ার ছবি এসেছে।

    আজ ভূত-চতুর্দশীর রাতের আড্ডায় যাতে গা-ছমছমে অনুভূতির কোন কমতি না হয় সেই জন্য বড় আলোগুলো না জ্বালিয়ে কয়েকটা ছোট টেবল-ল্যাম্পে যতটুকু-না-হলেই-নয় আলোর ব্যবস্থা।

    এই বাড়িটা একসময় ছিল এই এলাকার বনেদী পরিবার সামন্তদের বাড়ি। বছর দশেক আগে বাড়িটা হঠাৎ বিখ্যাত, বা বলা যায়, কুখ্যাত হয়ে যায়। বাড়ির সেই সময়ের মালিক ত্রিদিব সামন্ত আত্মহত্যা করে। ত্রিদিব অনন্তদের পাঠশালার দিনের বন্ধু। আবেগী, বন্ধুবৎসল, ঝোঁকের মাথায় চলা লোক। কিন্তু, নিজের সম্পর্কে একটা আড়াল রেখে চলতে ভালবাসত। সেই অভিশপ্ত রাতে তিনতলার ওর শোবার ঘরের সামনের বারান্দা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে শেষ করে দেয় ও। কেন, জানা যায়নি। ত্রিদিব ছিল বংশের শেষ বাতি। ও নিভে যাওয়ার পর বাড়িটা দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়র মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় আটকে পড়ে। ভূতের বাড়ি বলে বদনামও জুটে যায়। বাড়িটায় আর থাকত না কেউ। অনন্ত অবশ্য বলে ভূতের কাহিনী ঐ বিবদমান শরীকদের মধ্যেই কেউ ছড়িয়েছিল বাড়ি দখলের জন্য। লাভ হয়েছে অনন্তর, বেশ কম দামেই বাড়িটা পেয়ে গিয়েছে।

    এবারের আড্ডাবাজির বিশেষ আকর্ষণ অলক আর আইলীন সেন। অলক অনেক ছোটবেলায় এই এলাকার ছেলে ছিল, স্কুলে পড়ার সময় থেকে মা-বাবার সাথে কানাডার বাসিন্দা। মাঝে মাঝে ছোটবেলার শহরে এসে ঘুরে যায়। তিন চার বছর আগে একটি বিয়ের আসরে অনন্তর সাথে আলাপ এবং বন্ধুত্ব। গত বছর অলক বিয়ে করেছে। বেশি বয়সেই বিয়ে করল বলা যায়। এ দেশে অলকের বন্ধুরা ধরে নিয়েছিল ও আর বিয়ে করবে না। পশ্চিমের সমাজের জীবনধারায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে। অবিবাহিতের জীবন সেখানে সম্ভবতঃ, দেশের মত নিঃসঙ্গ নয়। কিন্তু প্রেমের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে। কে যে কখন ধরা পড়ে যায়! অলক এবছর বৌ কে নিয়ে প্রথম বার পূজোয় দেশে এসেছে। অনন্তদের বাড়িতে কালীপূজো কাটিয়ে কানাডায় ফিরে যাবে।

    প্রায় তিনদিন আগে থেকে বৃষ্টির উপদ্রব শুরু হয়েছে। এবার পূজা পড়েছে অনেক আগে। বর্ষা এখনও পুরো বিদায় নেয়নি। আজকে একেবারে সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যা তাই অনেক আগেই নেমে এসেছে। অতিথিরা সবাই একতলার বৈঠকখানায় স্তিমিত আলোয় খান-পিনা-আড্ডায় মজে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটা সামনের দেয়ালের জানালার কাঁচের পাল্লায় আর দরজার উপরের রঙ্গিন নকশার গায়ে পড়ে অবিশ্রান্ত ধারায় গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে সেইসব জলধারা পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠে আবার অন্ধকারে ডুব দিচ্ছে।

    সত্যার্থী মন দিয়ে দেখছিল সেন দম্পতিকে। অলক সেন, চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের শক্ত সমর্থ সাধারণ চেহারা। ফিটফাট। খুব মিশুকে নয়। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর ভক্ত। যেটুকু কথা বলে, ট্রুডো নিয়ে। পাশের দেশের প্রধানের সাথে ট্রুডোর তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনার বাইরে আর কিছুতে বিশেষ আগ্রহ আছে বলেও মনে হয়না। ট্রুডো নিয়ে আবার বাকী আড্ডাধারীদের তেমন কিছু বক্তব্য না থাকায় অলক সেনের কাছ থেকে আড্ডায় রসদ বিশেষ জমা পড়ছে না।

    অলক আর তার স্ত্রী আইলীন স্বভাবে পস্পরের বিপরীত। কী করে যে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, কানাডায় বসে অলক এমন বাঙ্গালী মেয়ে যোগাড় করল কে জানে! অলকের কথা অনুসারে আইলীন নাগরিকত্বে কানাডার মেয়ে কিন্তু জন্মসূত্রে বাঙ্গালী। আজকের সন্ধ্যায় বাঙ্গালী মেয়ের সাজে চমৎকার একটা শাড়ি পরেছে। সেটা ওকে মানিয়েওছে দারুণ। নীল চোখ আর হাল্কা সোনালী চুল থেকে মনে হয় পূর্বপুরুষদের মধ্যে বাইরে থেকে কেউ ছিলেন। তবে এখন যুগ অন্যরকম। এসবের কোনটা নিজস্ব আর কোনটা প্রসাধন, বলা মুস্কিল। নিজের মনেই হাসে সত্যার্থী। কাউকে বুঝতে না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে আইলীনকে দেখতে থাকে সে।

    মন-টানা ব্যক্তিত্ব। চলতি অর্থে ডাকসাইটে সুন্দরী নয়, কিন্তু মধুর বড়। কিন্তু এখন সেসব নয়, সত্যার্থীর মাথার মধ্যে অদৃশ্য শুঁড়েরা অন্য কিছু, যেন কোন সঙ্কেতের আভাষে নড়ে চড়ে উঠেছে। কোথাও একটা ছন্দ না মেলার মত কিছু আছে। নানা কথা নিয়ে গল্প করছে মেয়ে, বসছে, উঠছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এখানে নেই সে।
    আরেকটা যেটা সত্যার্থীকে টানছে সেটা হচ্ছে এই যুগলের পরস্পরের প্রতি আচরণ। অলকের আচরণে স্পষ্ট যে সে তার বৌকে খুব ভালোবাসে, চোখে হারায়। কিন্তু সেই সাথে, কী বলা যায়, আইলীনকে নিয়ে, যেন সে আতংকিত, উৎকণ্ঠিত। আর আইলীন – কিছু একটা থেকে নিজেকে আপ্রাণ সরিয়ে রাখছে। চাঁদের আলোতে যেন গ্রহণের ছায়া পড়েছে, মনে হল, সত্যার্থীর।

    অনন্ত খাবার আর পানীয়র কোন অভাব রাখে না, এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। অলক পানীয়ে ভালোই অভ্যস্ত মনে হয়। পানীয়ের প্রভাবে ওর সজাগ সতর্কতার কমতি ঘটেনি। দেখি-দেখি না করে আইলীনের দিকে নজর রাখা - চলছে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, অলকের উদ্বেগ, আশংকা, আইলীনের যেন চোখেই পড়ছেনা, সেটা কি আদৌ সম্ভব? উঁহু,। তার মানে এ মেয়ে সেই উদ্বেগের প্রতি উদাসীন। কিন্তু কেন? এ নিছক মন খারাপের গল্প নয়, দুশ্চিন্তা ছায়া ফেলল সত্যার্থীর মাথার ভিতর।

    “কী ভাবছেন সত্যদা? ভূতের গল্প?” জিজ্ঞাসা করল নিনা। “আজকের রাতটা কিন্তু ভূতের গল্পের জন্য দারুণ।” নিনার বর সমর মানে সমরেন্দ্র সিন্‌হা অনন্তর সমবয়সী, এখানকার পুরনো বাসিন্দাদের একজন। তবে গত ছয়-সাত বছর ধরে ওরা ব্যাঙ্গালোরবাসী। শুধু এই সময়টায় এখানে চলে আসে। অনন্তর বাড়িতে এই অনুষ্ঠানের নিশ্চিত অতিথিদের মধ্যে ওরা ধরা থাকে।

    নিনারা ছাড়া আর দুটি অল্প বয়সী যুগল, সৃজন ঘোষ আর তার স্ত্রী কল্পা, বীরেন আচার্য আর তার স্ত্রী অপালা। কল্পা আর বীরেন চুপচাপ থাকা মানুষ, আছে বলে সবসময় বোঝা যায় না। অপালা আর সৃজন অবশ্য আড্ডাবাজ লোক।

    হঠাৎ দেয়ালঘড়িটার আওয়াজে চমকে উঠল সত্যার্থী, তাকিয়ে দেখল সাড়ে সাতটা। যদিও মনে হচ্ছে যেন অনেক রাত হয়ে গেছে। একটা ভালো, ঝড়টা থেমেছে একটু আগে। এই সময় একদিকের টেবিলে রাখা অনন্তর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অনন্ত ড্রিঙ্কের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখল কে ফোন করছে। তারপর কানে লাগিয়ে ঘরের একদিকে চলে গেল। কয়েক মিনিট বাদে ঘরের মাঝখানে এসে ঘোষণা করার মত করে জানাল,
    “ওসি মামুদ সাহেব ফোন করলেন। ওনার ওখান থেকে একজন গেস্ট আসছেন।”
    “আজকে? এখানে? ” প্রশ্ন করল রঞ্জনা।
    “হ্যাঁ, কোন মহিলা অফিসার। । স্পেশাল অপারেশানের কাজে ওনার থানা হয়ে যাচ্ছেন, আর ডিটেল কিছু বলেননি। ওসির কাছে আমাদের আজকে রাতের আড্ডার গল্প শুনে একবার আসতে চেয়েছেন। ভদ্রমহিলার গাড়ির কিছু একটা অসুবিধা হয়েছে। মামুদ সাহেবের নিজের ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে যাবে।” জানালো অনন্ত।
    এর পর, আজকাল মেয়েরা কত কী করছে, কে কবে কোথায় গাড়ি খারাপ হয়ে কিভাবে সামলেছিল, আগে কবে কোন বছরে কত দুর্যোগ হয়েছে, কোন দুর্যোগে কার কিভাবে উৎসবের দিন পণ্ড হয়েছে, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক ইত্যাদি হয়ে, আলোচনা এসে দাঁড়ালো অভাবনীয় কাণ্ড ঘটার গল্পে। অবধারিত ভাবেই উঠে এল অনেকদিন আগের একটা রাত।
    এখানে উপস্থিতদের মধ্যে অনন্ত এবং সমর সেই রাতেও এই ঘরে জমা হয়েছিল যখন নৈশভোজ শেষে কোন রকম আভাষ না দিয়ে ত্রিদিব সামন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তারপর অস্বাভাবিক জোরে কোন একটা কিছুর পতনের আওয়াজ রাতটাকে তছনছ করে দিয়েছিল।

    “আচ্ছা, অনন্তদা, আপনি তো সেই রাতে এই ঘরে ছিলেন, তাই না?” জিজ্ঞাসা করল সৃজন।
    “হ্যাঁ, সমর আর আমি, আমরা দুজনেই ছিলাম এখানে সেই রাতে। আমরাই প্রথম দৌড়ে গিয়েছিলাম। লাভ হয়নি যদিও।”
    “অলকদা, আপনিও কি ছিলেন?” জিজ্ঞাসা করল অপালা।
    “না আমি ছিলামনা।”
    “তোমরা ত তখন এখানে থাকতে না, তাই না?” জিজ্ঞাসা করল রঞ্জনা।
    “ঠিক বলেছেন, বৌদি।” উত্তর দিল অলক।
    “আচ্ছা অলকদা, তার আগে একসময় ত আপনারা এইদিকেই থাকতেন। তখন কি আপনার সাথে ত্রিদিব সামন্তর পরিচয় ছিল?” কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করল অপালা।
    “মানে? সবার সাথে কি ওর পরিচয় থাকতে হবে নাকি?”
    খাপছাড়া তীব্রতায় অলকের এমন অদ্ভুত উত্তরে লোকজন হকচকিয়ে গেল।
    পরিস্থিতি হাল্কা করতে বিষয় ঘোরাতে চাইল রঞ্জনা। “আমি বলছিলাম কি,” বলল সে, “আজকের রাতে ঐ সব দুঃখের কথা থাক। বীরেন, তুমি বরং তোমার ভাইঝির কথা বলো, কাগজে দেখলাম ও একটা গানের কম্পিটিশনে দারুণ পারফর্ম করেছে।”

    দমবন্ধ ভাবটা কাটাতে রঞ্জনা প্রশ্নটা করল বটে, কিন্তু তার ফলটা একটু জটীল হয়ে গেল। বীরেন কথা বলার লোক নয়, আচমকা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিষম খেয়ে ভীষণ কাশতে শুরু করে দিল। অপালা তাড়াতাড়ি জল আনতে উঠে গেল।

    আইলীন কখন চুপ করে গিয়েছিল। উঠে পড়ল এখন। হাতের পাত্রটা নামিয়ে রাখল পাশের টেবিলে। একটু পানীয় তখনও রয়েছে সেটায়।
    “ভালো লাগছে না, মাথাটা দপ দপ করছে,” বলল সে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
    সত্যার্থীর মনে হল, একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে এই মেয়ে।
    “দাঁড়ান, দোতলার বারান্দার আলোটা জ্বেলে দি।”
    “না, না, এই আলোই যথেষ্ট। আমার এখন বেশি আলো ভালো লাগবে না।
    “চলুন, আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
    “দরকার নেই, আমার এরকম হয়। অভ্যাস আছে, আপনি গল্প করুন।”

    কেমন এক বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে মেয়েটিকে, মনে হল সত্যার্থীর। খুব ইচ্ছে করছিল, মেয়েটির হাত ছুঁয়ে তাকে বলে, এত ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, এত অল্প চেনায় কি কারো হাত ছোঁয়া যায়! বুকের ভিতর অদ্ভুত এক মোচড় লাগে সত্যার্থীর, যেন কোন এক পাণ্ডুলিপির আয়োজন চলছে, তিনি তার দর্শক মাত্র, ঘরে ফিরছে পাখি, কোন ঘরে, কার ঘরে?
    আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল ও। ওদের থাকার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো, নীচের দিকে তাকিয়ে থমকে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

    রাত বেড়ে যাচ্ছিল। অজানা অতিথির জন্য একটু অপেক্ষার পর আর দেরি না করে সবাই রাতের খাওয়া সেরে নিল। আইলীনের খাবার রঞ্জনা নিজেই ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে তিনতলায় উঠে গেল। বীরেন পাইপ ধরিয়েছে। সে আবার এই ব্যাপারে শৌখীন লোক। সেদিকে তাকিয়ে অনন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
    “ত্রিদিবদার ভালো পাইপের কালেকশান ছিল।” বলল নিনা।
    “আবার সেই নাম, বারবার এই নামটাই কী করে যেন সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে।” - কী এক অদ্ভুত অসহায় অসহিষ্ণুতায় বলে উঠল অলক। আর এই সময়ই, পরপর, প্রায় সাথে সাথেই বলা যায়, দুটো ঘটনা ঘটল। দেয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে নয় বার নটা বাজার ঘণ্টা বাজল আর শেষ ঘণ্টাধ্বনিটা মেলানোর আগেই সামনের দরজার ঘণ্টিটা দুবার বেজে উঠল – ডিং-ডং, ডিং-ডং।

    “ঐ এলেন মনে হয়,” – বলল অনন্ত।
    দরজার কাছাকাছি থাকার সুবাদে সৃজন চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেল। দরজার সামনে টাঙ্গানো পর্দাদুটো দুপাশে টেনে দিয়ে পাল্লাদুটো খুলে দিল। তারপর পিছিয়ে এল কয়েক পা। বাইরে বৃষ্টি আর নেই। কিন্তু এখনও ভালোই হাওয়া দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা ঢুকে এল। শরীরের পিছনে রাস্তার আলোটা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে এক সিল্যুয়েট মানুষ।
    “ভিতরে আসতে পারি?”
    “নিশ্চয়ই” – উত্তর দিল অনন্ত।

    পিছন ফিরে হাত তুলে একবার নাড়াল, তারপর ঘরে ঢুকে এসে দরজার পাল্লাদুটো ভেজিয়ে ল্যাচ ঘুরিয়ে তালাবন্ধ করে কয়েক পা ভিতরে ঢুকে এল রাতের অতিথি।
    রেনকোট। হাঁটুর খানিকটা নীচে এসে শেষ হয়েছে। পায়ে রেনকোটের প্রান্ত ছাড়ানো বাহারি জুতো। হাতে মনে হচ্ছে, চামড়ার দস্তানা। যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, দরজার উপরের রঙ্গিন কাঁচের মধ্য দিয়ে আলো এসে মুখে পড়ে এক অদ্ভুত মায়াবী মুর্তির সৃষ্টি করেছে।
    “আমি মায়া,” পরিষ্কার কণ্ঠস্বর, “মায়া মূর্তি।”
    চোখের সামনে ঢুকে আসতে না দেখলে মনে হত অন্ধকারে যেন কোন মায়াই মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
    “আসুন, আসুন, ভিজে যান নি ত? দিন, রেনকোটটা আমায় দিন,”
    “আরে না, না ব্যস্ত হবেন না। রেনকোট রাখার জায়গাটা ত দেখতেই পাচ্ছি, আমি-ই রেখে দিচ্ছি এটা।”
    দেয়ালের গায়ে একটা ফাঁকা হ্যাঙ্গারে রেনকোটটা টাঙ্গিয়ে, দস্তানা খুলে রেনকোটের পকেটে রেখে মায়া ঘরের মাঝখানে এসে এদিক ওদিক তাকাল।
    সত্যার্থীর ঠিক পাশে একটা চেয়ার। আইলীন ছেড়ে যাওয়ার পর সেটা খালি ছিল। সত্যার্থী উঠে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাল -
    “আপনি এখানে বসতে পারেন।”
    “ধন্যবাদ।”

    মায়া এগিয়ে এল, দৃঢ় পদক্ষেপে। মুখে কৌতুক মেশানো হাসি। সেই সাথে ঘরের আধো অন্ধকারেও সত্যার্থীর মনে হল যেন, হঠাৎ আসা অতিথির চোখে একটা রহস্যময় বিদ্যুৎ খেলে গেল। খানিকটা প্রশ্রয়েরও মনে হল। সত্যার্থীর ভিতরে একটা শিহরণ লাগল। যেন এই মুহূর্তটার জন্যই আজকে এই সন্ধ্যাটার প্রস্তুতি চলছিল। না কি সারা জীবনের? একটি নাটকের দুই কুশীলবের একজন ছিল, অন্যজনের এইমাত্র মঞ্চে প্রবেশ ঘটল। সত্যার্থীর সমগ্র সত্তা আসন্ন মুহূর্তগুলির জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল।
    অনন্ত এক এক করে মায়ার সাথে উপস্থিত সবার পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানাল -
    “মেয়েরা কেউ কেউ উপরের তলায় উঠে গেছে।”
    “স্বাভাবিক, অনেকটা রাত হয়ে গেছে। থানায় ঢুকে আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ঝামেলা করছিল। আজ ভালো মতন বসে গেছে। বদলি গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। আর ঘন্টা খানেক লাগবে। এখানেই চলে আসবে। মামুদ সাহেবের কাছে আপনাদের প্রতিবছরের এই দিনে সকলের একত্র হয়ে আড্ডার গল্প শুনছিলাম। বললাম যে আমার এইরকম আড্ডা খুব ভালো লাগে। মামুদ সাহেবকে ত জানেন। সাথে সাথে ফোন তুলে আপনার সাথে কথা বলে ফেললেন। চলে এলাম। ”
    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো করেছেন চলে এসে।” বলল অনন্ত।

    আমার নিজের গাড়ির ড্রাইভার অবশ্য খুশি হয়নি। মামুদ সাহেবের গাড়িতে ওঠার সময়ও সাবধান করে দিয়েছেন, এই বাড়ি নাকি ভূতের বাড়ি! কিন্তু আপনাদের কাঊকে দেখে ত ভূত বলে মনে হচ্ছে না।”
    “যা চোখের সামনে দেখা যায় সেটাই কি সব?” ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অলক। পানপাত্রটা আবার ভরে নিয়েছে সে।
    “ঠিক-ই বলেছেন আপনি, চোখের সামনে রাখা বুড়ো আঙ্গুলটা সরিয়ে নিলে গোটা চাঁদটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে। আমার ড্রাইভার যদি আমার অতীত দিনের কথা জানত, তা হলে বুঝতে পারত আমি কেন আজ এখানে আসতে চাইলাম। একসময় এই এলাকাতে আমি কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছি। এই বাড়িটা সেই সময় ছিল ত্রিদিব সামন্তর।”
    “আপনি ত্রিদিবকে চিনতেন?”
    “চিনতাম। ওনার সঙ্গে আমার সেই সময়ের কোম্পানির সূত্রে যোগাযোগ হয়েছিল। এই বাড়িতে এসেওছি বার দুয়েক। আজকে তাই রাতটা দুর্যোগের আর সময়টা অল্প হলেও এই বাড়িতে আসার সুযোগটা ছাড়তে মন চাইল না।”
    “খুব ভালো করেছেন, চলে এসে। কী নেবেন বলুন।”
    সিঁড়ির নীচেটায় দেয়াল ঘেঁষে খাবার টেবিলের ব্যবস্থা হয়েছিল। এখনও সেসব গোটানো হয়নি। প্রচুর খাবার রয়েছে সেখানে। অনন্ত টেবিলের পাশে গিয়ে একটা প্লেট হাতে নিয়ে অতিথিকে ডাকল খাবার পছন্দ করার জন্য।
    “আপনি ব্যস্ত হবেন না। মামুদ সাহেব না খাইয়ে ছাড়েননি।”
    “ড্রিঙ্কস কিছু – হার্ড, সফট?”
    “আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমি নিয়ে নেবো।”
    “ঠিক আছে।”
    অনন্ত ফিরে গেল নিজের আসনে।
    “হুইস্কিটা নিতে পারেন, ভালো লাগবে। দেবো?” আস্তে করে অতিথিকে বলল সত্যার্থী।
    “তাই?” আবার সেই প্রশ্রয়ের কৌতুক খেলে গেল অতিথির ঠোঁটে আর চোখের তারায়। “আজ থাক। সফ্‌ট কিছু আছে, কোক?”
    “অবশ্যই।” সত্যার্থী উঠে গিয়ে একটা গ্লাসে কোক নিয়ে এসে অতিথির হাতে দিল, সাথে একটি ছোট ন্যাপকিন আর একটি ছোট প্লেটে কিছু কাজু।
    “ধন্যবাদ।”
    “বাড়িটা তা হলে আপনি কিনে নিয়েছেন?” অনন্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মায়া।
    “নিতে হল, বুঝলেন! পার্টির কাজে বাড়িতে এখন অনেকটা জায়গার দরকার হয়ে পড়েছে। সারাদিন লোকজন আসে নানা রকম সমস্যা নিয়ে, শুনতে হয় সময় নিয়ে, সাধ্যমতন মেটাতেও লাগে। ভীড় লেগে যায় একেক সময়। সামনের বছর ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছি। আর, এই এলাকায় এই বাড়ির মতন বড় বাড়ি আর একটাও নেই। তাই এটাই কিনে ফেললাম। বাড়িটার একটু দুর্নাম এসে যাওয়ায় অনেক কমেও পেয়ে গেলাম।”
    অনন্তর এই গুণটা চমৎকার, বিনয়ের সাথে মাহাত্ম্য প্রচারে ও ত্রুটি রাখে না। জননেতা হওয়ার জন্য গুণটা বেশ কাজে লাগে। আবার, মানুষটা ভালো। সত্যার্থীকে যত্ন-আত্তিও ভালোই করে। অতএব ... ঠিক-ই আছে। নিজের মনে হাসল সত্যার্থী।
    “আপনার ভূতের ভয় নেই?” প্রশ্ন করল মায়া।
    “না, আমার কোনদিন-ই ভূত প্রেতের ভয় নেই। আমি বরং খুশি হতাম ওর ভূত যদি এসে বলে যেত ও আত্মহত্যাটা করল কেন।” হালকা সুরে বলল অনন্ত।
    কাণ্ডটা দেখো, ভাবল সত্যার্থী, গল্প শুরু হতেই সেই ত্রিদিব সামন্তর কথা এসে পড়ল। না কি মায়াই সূক্ষ্ম কৌশলে গল্পকে সেই পথে ঠেলে দিচ্ছে!
    "সেই, ওনার ভূতই সম্ভবতঃ বলতে পারবে কেন করেছিলেন ঐ কাণ্ড,” বলল অপালা, “সাধারণ মানুষের ব্যাখ্যার অতীত।"
    "হ্যাঁ, ওটা আর কোনদিন জানা যাবে না। বহুবার আলোচনা করেও এ ঘটনাটার কোন ব্যাখ্যাই আমরা কখনো খুঁজে পাই নি। একেবারে ব্যাখ্যার অতীত যাকে বলে।" - হাত পা নেড়ে প্রবল ভাবে নিজের মত জানালেন সমর।
    "তাই ভাবছেন?" উস্কে দিল মায়া।
    "ভাবাভাবির কিছু নেই আর।” বলল সমর, “পুরো ঘটনাটাই অভাবনীয়। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল একটি লোক, সাফল্যের চূড়ান্তে রয়েছে, পুরনো বন্ধুরা মিলে দিব্যি গল্প-গুজব করছি সবাই, হ্যাঁ অন্তত পাঁচ-ছজন ছিলাম আমরা সেই রাতে। ভবিষ্যতে কী কী করতে চলেছে তাই নিয়ে তার কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। সেই লোক ডিনার টেবিল থেকে উঠে তিনতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিসের জন্য? খোলা বারান্দা টপকে নীচে লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে মরে যাওয়ার জন্য! কেন? কিসের জন্য? কোনদিন আর সেটা জানা যাবে না। কোনদিন না।"
    "কোনদিন জানা যাবে না কথাটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না, সমরবাবু?" হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল মায়া।
    সমর অবাক হয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে।
    "বুঝলাম না। কী বলতে চাইছেন আপনি?"
    "একটি সমস্যা এক সময় সমাধান করা যায়নি মানে কি কোনদিনই আর সমধান করা যাবে না?"
    "হাঃ! দেখুন মিস মূর্তি, যে সমাধান সেইদিন বের করা যায়নি, আজকে, দশ বছর বাদে সেই সমাধান আপনি খুঁজে বার করবেন?"
    মায়ার মুখের মৃদু হাসি একটু ছড়িয়ে, কৌতূকী বাঁক নিয়ে আবার আগের অবস্থানে ফিরে এলো।
    “ইতিহাস কিন্তু তাই বলে সমরবাবু। আমাদের দেখাগুলো একান্তই আপেক্ষিক। ঘটনাকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার দরকার পরে। তিনটে মাত্রায় ঘটনাকে পুরো দেখা যায় না। চতুর্থ মাত্রাটিকে জুড়তে লাগে – সময়। চার মাত্রার ক্যানভাসে সমস্ত উপাদানগুলো ঠিকঠাক মতন বসে পুরো ছবিটা ফুটিয়ে তোলে।”
    অলক সেন এই সময় সামনের দিকে ঝুঁকে এল, যেন বিলাপ করে গলা ভেঙ্গে গেছে এমন হাহাকারের স্বরে বলে উঠল -
    "ঠিক বলেছেন, আপনি, মিস মূর্তি, একদম ঠিক বলেছেন। কোন রেহাই নেই। নো পাসারান। অতীত হয়ে গেছে বলেই সব কিছু ফুরিয়ে যায় না, মিটে যায় না। বরং আরো তীব্র হয়ে ফিরে আসে।”
    “তোমার মহাবিশ্বে কিছু, হারায় না তো কভু” নিঃশব্দে গুণগুণ করল সত্যার্থী।
    ধৈর্য্য ধরে হাসি হাসি মুখে অনন্ত এতক্ষণ চুপচাপ আলোচনাটা শুনে যাচ্ছিল। এখন মুখ খুলল।
    "তার মানে, মিস মূর্তি, আপনি বলতে চাইছেন যে আমরা যদি, ধরুন আজ রাতে, এইখানে, ত্রিদিব রায়ের মৃত্যু রহস্যটার নিষ্পত্তি ঘটানোর জন্য একটি তদন্ত কমিশন বসাই, সেই সত্যটার উদ্ঘাটন আমরা করতে পারব যেটা সেই সময়ে আসলেই ঘটেছিল?"
    “ভূতচতুর্দশীর রাতে ভূতেরা এসে সাক্ষী দিয়ে যেতেই পারে,” ঠাট্টা করল সৃজন।
    "অবশ্যই পারে সৃজনবাবু। ভূত মানে অতীত। আপনারা এতক্ষণ সেই অতীতের গল্প করছিলেন। তার মানে ভূতেরা এসে গেছে।”
    শিউরে উঠে সৃজনের হাত প্রায় খিমচে ধরল কল্পা।
    “এবার আমাদের কাজ তাদের কথা ঠিকমত শুনে নেয়া।” বলে চলল মায়া, “ অনন্তবাবু, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গগুলো অনেক কাল চুকেবুকে গেছে। এখন আপনি ঘটনাটাকে বা ঘটনাগুলোকে নির্মোহ ভাবে দেখতে পারবেন, নিছক ঘটনা হিসাবেই।"
    “নিছক ঘটনা হিসাবে ... ” অনন্তর ঠোঁটে কুঞ্চন, কপালে ভাঁজ, যা শুনছে, সেটা কিভাবে নেবে বুঝে উঠতে পারছেনা।
    "একটা কোথাও থেকে অবশ্য কাজটা শুরু করতে হবে।" বলল মায়া, মৃদু কিন্তু পরিষ্কার সতেজ কণ্ঠস্বর। " কোন একটা লাইন, ধারণা, একটা তত্ত্ব, একটা কোন অনুমান - কী বলেন, সমরেন্দ্রবাবু?"
    সমর চোখমুখ কুঁচকে একটু ভাবার চেষ্টা করল। তারপর একটু দম নিয়ে বলল,
    "হ্যাঁ, একটা ধারণা আমাদের অনেকের-ই ছিল, বা এখনও আছে। যদিও কলকাতার একটা কাগজ তাদের স্থানীয় খবরের বিভাগে ত্রিদিবের কিছু আর্থিক সমস্যার কথা লিখেছিল, আমরা কিন্তু অনেকেই ভেবেছিলাম যে, একটি কোন মেয়ের ব্যাপার আছে এর মধ্যে। কথায় বলে, কামিনী-কাঞ্চন, হয় কামিনী নয় কাঞ্চন অথবা দুটোই, তাই না? তা, ত্রিদিবের ক্ষেত্রে টাকাপয়সার দিকটা বড় হওয়ার কথা নয়। অঢেল ছিল ওর। কাজেই ..কামিনী ছাড়া আর কি হতে পারে?"

    অঢেল ছিল, তাই কি? হয়ত। মনের ভিতরের দ্বিধা নিজের অজান্তেই হাত-পায়ে নেমে এল সত্যার্থীর। নড়ে চড়ে বসল একটু। আর তখন-ই নজরে পড়ল - দোতলার একটি ঘরের দরজার এক আধখোলা পাল্লার গায়ে একটি নারী অবয়বের আভাস। এমনভাবে সে পাল্লার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন সে ঐ পাল্লাটির-ই একটি অংশ। ঘরের নিচু টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় তার পড়নের শাড়ীর নীচের দিকটি দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে পড়ে থাকা বাহারি শাড়ীটিই এখনও পড়ে আছে সে। আইলীন সেন। তার সমস্ত সত্ত্বা উন্মুখ হয়ে আছে নীচে এইখানের এই আলাপ-আলোচনায়।

    সত্যার্থীর মনের ভিতরটা শিরশির করে উঠল। অজস্র রেখার জটের মধ্যে যেন এক শিল্পী কোন কোন রেখাকে উজ্জ্বল, রঙ্গিন করে তুলছেন আর কোন কোন রেখাকে হাল্কা, ধূসর করে দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে গোটা ক্যানভাস জুড়ে একটা অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। অথবা যেন কোন পুতুলনাচের মঞ্চ। কেউ শুয়ে ছিল, কেউ ঝুলছিল পিছনের পর্দায় হেলান দিয়ে। তারপর বাজিকরের আঙ্গুলের ওঠা-নামা-এগোনো-পিছোনোর ছন্দে ছন্দে পুতুলরা জীবন্ত হয়ে উঠছে। পুনরাভিনয় ঘটছে একটি নাটকের যেখানে সময় সময়হীন। একটি বাঁকে মৃত কোন চরিত্র অনায়াসে কাহিনীর আস্তর খুলে এগোনোর সাথে তাল রেখে আর এক বাঁকে জেগে উঠে তার অভিনয় দেখিয়ে সরে যাচ্ছে। আর ধীরে ধীরে একটা চতুর্মাত্রিক ছবি গড়ে উঠছে। সত্যার্থী অনুভব করছেন নাটকের শেষ অঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। শুরু করে দিয়েছেন যে বাজিকর, সত্যার্থীর পাশেই বসে আছেন তিনি। সবটাই এই মায়ার মায়া। গোটা নাটকটাই তার নখের দর্পণে দেখতে পাচ্ছে সে। এমন কি ঐ যে দোতলার একটি ঘরের দরজার পাল্লায় ছায়ার চেয়েও ছায়া হয়ে মিশে আছে এক নারী, সেও এই মায়ার খেলার বাইরে নয়।
    চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে, দর্শকের ভূমিকায় মন দিল সত্যার্থী। চিন্তার সুতোগুলো ছিঁড়ে গেল একটা তীক্ষ্ণ স্বরের প্রশ্নে। টেবিলে দুই হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে আছে অলক।

    “আপনি কে বলুন তো? গোয়েন্দা? ত্রিদিব সামন্তর মৃত্যু নিয়ে কাজ করছেন?”
    শব্দ করে হেসে উঠল মায়া।
    “আরে না, না, আমি গোয়েন্দা নই। এখানে কোন মৃত্যুর তদন্ত করতেও আসিনি। সে সব মামুদ সাহেবের ডিপার্টমেন্ট।”
    “আপনি তা হলে কী করেন? কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?”
    অনন্ত একবার অলকের, একবার মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি কিছু একটা বলতে চাইল। তারপর মায়ার হাতের ভঙ্গীতে একটা নিশ্চিন্ত করা আশ্বাস দেখে শান্ত হয়ে বসে রইল।
    মায়া হাসি মুখে অলককে বলল,
    “অলকবাবু, একটা আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রে অজস্র স্তর থাকে, তার সবগুলি সকলের জন্য দৃশ্যমান নয়। ধরে নিন, আমি কেউ না। আজ রাতের আগে আমাকে আপনারা দেখেন নি, আজ রাতের পরেও দেখবেন না। আমি নিতান্তই মায়া।”
    মায়ার গলার স্বরে এমন একটা শান্ত, মধুর অথচ শেষ কথার সুর, অলক আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে টেবিল থেকে পানীয়ের পাত্রটি তুলে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ডুবে গেল।
    “যে কথা হচ্ছিল,” ছেড়ে রাখা সুতো তুলে নিল মায়া, "একটি মেয়ে, ঠিক, একদম ঠিক। আচ্ছা, সেই রাতের নৈশভোজে বা তার আগে-পরে যে গল্পগুজব করেছিলেন আপনারা সেখানে কোন মেয়ের কথা উঠেছিল কি?"
    "উঠবেনা কেন? অবশ্যই উঠেছিল।" বলল অনন্ত। "ত্রিদিব সেই সন্ধ্যায় আমাদের দু-তিনজনকে বলেছিল, ওর মুমতাজকে ও পেয়ে গেছে। আর কদিন বাদেই অফিসিয়াল এনগেজমেন্টের ঘোষণাও করত। সেই জন্যই আত্মহত্যার ঘটনাটা আরো এত অবিশ্বাস্য লেগেছিল। এমনিতে চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। কিন্তু সেদিন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল এই প্রেমটা নিয়ে ও টগবগ করে ফুটছে। কয়েক বার বলেছিল, মেয়েটি যে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছিল সেটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। প্রায় হিমালয় ডিঙ্গোতে পারার মত সাফল্য নাকি। বলেছিল অসম্ভব ঝুঁকি নিতে হয়েছে, কিন্তু সেই মেয়ের জন্য ঐ ঝুঁকিটা না নিয়ে আর কোন উপায় ছিল না। জানেন, ওর শ্যাম্পেনের গ্লাসটা আমার গ্লাসের সাথে ঠেকিয়ে কী একটা কবিতার লাইন ও বলেছিল। আমি ত ওর মত কবিতার লোক নই, এখন আর মনে করতে পারছি না। নিনা, তুমি ত কাছাকাছি ছিলে, তোমার মনে আছে?”
    “বলেছিল ত আপনাকে অনন্তদা,” হতাশায় একটা হাত ওলটাল নিনা, “আমার এখন যেটুকু মনে পড়ছে, আপনি ঐ লাইনটা নিয়ে কী একটা ঠাট্টা করলেন, তাতে ত্রিদিবদা বলেছিল এই লাইনও আর দুটো লেখা হয়নি।”
    “এ পৃথিবী এক বার পায় তারে, পায় নাকো আর।” বলল মায়া।
    “একেবারে ঠিক বলেছেন,” প্রায় চমকে উঠে বলল অনন্ত।
    পানীয়ের টেবিলটা সত্যার্থীর বসার চেয়ারের কাছাকাছি। সমর টেবিলের সামনে এসে পানীয় ভরে নিয়ে মায়ার দিকে ফিরল। বলল,
    “ও একটা অন্যরকম মানুষ ছিল, জানেন! খুব আবেগী ধরণের লোক ছিল। আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছিলাম, আমাদের কয়েকটা বাড়ির পরের তিয়াসা মৈত্র-ই ওর রাজকন্যা। সুন্দরী, ভালো মেয়ে। ওদের দুজনের মধ্যে একসময় ভালো বন্ধুত্ব ছিল। ত্রিদিব কবিতা পড়তে ভালবাসত, তিয়াসা লেখালেখি করে। চমৎকার জমত দুজনের।"
    মায়া সমরের মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল। যেন নীরবতা দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, তার পর? এখনও কি তাই মনে হচ্ছে?
    "তিয়াসা ছাড়া আর কে হতে পারত? অনন্ত, তুই কী বলিস?" সমর্থন চাইল সমর।
    "আমি জানি না," আস্তে আস্তে বলল অনন্ত। "ত্রিদিব ঠিক কী বলেছিল খেয়াল আছে? বলেছিল, ভালোবাসা আছে কি নেই এটা বুঝতেই দিন কাবার। আর তাই অনেক চেষ্টার পর নায়িকার মন পেলেও নাম প্রকাশের অনুমতি এখনও পাওয়া যায়নি। তুই ঠিক-ই বলেছিস, আমরা ধরে নিয়েছিলাম, তিয়াসাই হচ্ছে সেই মেয়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে - " কথা বন্ধ করে চুপ করে গেল অনন্ত।
    "কী বলতে চাইছিস তুই?"
    "দেখ, হিসেবটা ঠিক মিলছে না। তিয়াসাই যদি সেই মেয়ে হবে, সেই সন্ধ্যেতেই এনগেজমেণ্টের ঘোষণা করে দিতে ত কোন অসুবিধা ছিল না। মানে, তা হলে এত গোপনীয়তা কেন? আমার এখন কী মনে হচ্ছে জানিস? হতে পারে, ঘটনাটা কোন বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিস ত? ধর, তার হয়ত সদ্য স্বামী মারা গেছে, তখন তখনই বিয়ের কথা বলা ঠিক না। কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে, মেয়ের মন পাওয়া গেছে, কিন্তু সে মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদটা পাওয়া হয়নি তখনও, তাড়াহুড়ো করে জানাজানি হয়ে গেলে কোন কারণে যদি বিচ্ছেদটা আটকে যায়, সমস্ত গেল। জানি না, নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারব না। শুধু মনে হচ্ছে, সেদিনও মনে হয়েছিল, ও বাজি লড়ছিল একটা অসম্ভব কিছু পাওয়ার জন্য। সেটা পাওয়ার পথে এমন কিছু বাধা ছিল যা কোন ভাবেই টপকানো যায় না।"
    "কপাল কপাল, নিজের কপালকে কেউ টপকাতে পারে না।" যেন এক তীব্র হতাশায় বলে উঠল অলক সেন।

    ত্রিদিব সামন্তর ট্র্যাজেডি অলক সেনের নিজের কোনো গোপন ব্যথার জায়গা ছুঁয়ে গেছে মনে হয়, কিন্তু, কী ভাবে? অলক সেনের মাথার ভিতরটায় ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছিল সত্যার্থীর।
    কী এক অমোঘ টানে সত্যার্থী মুখ তুলে উপরে তাকাল। দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে ছায়ার মত সেই মেয়ে তখনও সেখানে স্থির হয়ে অন্ধকারে মিশে আছে, নজর রাখছে, শুনছে, কিন্তু নিঃসাড়, নিশ্চল, যেন কোন মৃতা রমণীর প্রেত।
    "হতে পারে," বলল সমর, "কিন্তু, ওকে দেখে তাই বলে আদৌ এইটা মনে হয়নি যে যুদ্ধটা ও হেরে গেছে।"
    "দেখে কি সব সময় সব বোঝা যায়!" বলল অলক।
    তারপর যেন কিছু চিন্তার জট ছাড়াতে ছাড়াতে পানপাত্রটা ভরে নেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে সুরার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
    "তা যায় না," দ্বিধান্বিত স্বরে বলল অনন্ত, "কিন্তু আমার কাছেও ওকে দেখে আদৌ কোন হেরো মানুষ বলে মনে হয়নি সেদিন। বরং কঠিন কোন যুদ্ধ জেতার আনন্দেই যেন ঝলমল করছিল ও।”
    "এবং সেই জয়ী লোক, মাত্র দশ মিনিট বাদে - " একটা হতাশার ভঙ্গী করল অলক।
    ঘরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। সবাই চুপ হয়ে গেছে।
    “আপনারা সিওর, দশ মিনিট, তার বেশি নয়?” বীরেনের ভরাট গলা এই আলোচনায় এই প্রথম শোনা গেল।
    “বিশও হতে পারে, তার বেশি নয় বলেই মনে হয়। কেন, তুমি কি কোনও ক্লু পাচ্ছ?” চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করল অনন্ত
    “না, সে রকম নির্দিষ্ট কিছু নয়, ভাবছিলাম যে ঐ সময়ে ওনার কাছে কোন ফোন্ টোন এসে থাকতে পারে কি না?”
    “ল্যান্ডলাইনে ফোন ত্ ছিল এই ঘরে, ঐ এখন যেখানে দেখছ, সেই খানেই। আর ওর সেলফোনটা ও ডিনারটেবিলেই ফেলে গিয়েছিল।” যেন অকারণে আদালতের সময় নষ্ট হচ্ছে এমন একটা অধৈর্য্য নিয়ে বলল অনন্ত।
    বীরেন তার স্বাভাবিক নীরবতায় ফিরে গেছে।
    “দশ হোক, কি বিশ হোক, কিছু একটা ত ঘটেছিল ঐ সময়টুকুর মধ্যেই, কী সেটা?” জিজ্ঞাসা করল অপালা।
    “জানি না,” বলল অনন্ত, “আমরা সবাই গল্প করছিলাম। এর মাঝখানে ত্রিদিব ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।”
    "হঠাৎ?" এতক্ষণে মুখ খুলল মায়া। আর বাধা পেয়ে থতমত খেয়ে থেমে গেল অনন্ত।
    "মানে?"
    "আমি শুধু জানতে চাইছি – ত্রিদিব কী কারণে ঘর ছেড়ে বের হয়েছিলেন?"
    “কী কারণে?” অনন্ত কপাল কুঁচকে স্মৃতি হাতড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর একটু অবাক হওয়া স্বরে বলল - "সেই সময় সেভাবে খেয়াল করিনি, জানেন। এখন ফিরে তাকিয়ে ভাবছি, কিভাবে যে সব ঘটে! সমর, তোর মনে আছে, সেই বছরটায় অসম্ভব বৃষ্টি হয়েছিল। ৭-এর পল্লী, শিমূলতলা, নীচুবাসা আরো কিছু কিছু এলাকায় ভালো মতন জল জমে গিয়েছিল। কদিন পোস্টঅফিস বন্ধ রয়েছিল, সেইদিন কি তার আগের দিন খুলেছিল। জমা চিঠপত্র ডাঁই করে বিলি করেছিল। এই বাড়িতেও সম্ভবতঃ সব চিঠি একসাথে এসেছিল। ঘরের একদিকে একটা ছোট টেবিলের উপর ত্রিদিবের একগাদা চিঠি এনে রাখা ছিল। সেইদিন আবার কোথায় রেল অবরোধ হয়ে আমাদের এলাকায় খবরের কাগজগুলোও অনেকটা দেরিকরে এসেছিল। ত্রিদিবের এখানে কাগজটা যেমন কে তেমন ভাঁজ করা অবস্থায় ডিনার টেবিল-এর একপাশে পড়ে ছিল। দুই-একজন কাগজটা একবার দুবার বেশি ভাঁজ না খুলে একটু চোখ বুলিয়ে আবার ভাঁজ করে রেখে দিচ্ছিল। কেউ একজন একসময় কাগজটা সরিয়ে ছোটো টেবিলটার চিঠিপত্রের ডাঁই-এর উপর রাখতেই কাগজ সমেত সমস্ত চিঠিপত্র হুড়মুড় করে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। ত্রিদিব কাছাকাছি ছিল। প্রথমে ওর কাজের লোকদের কাউকে একবার দুবার ডাকল। তারপর নিজেই এগিয়ে এসে সব কুড়িয়ে নিয়ে বলল উপরে ওর নিজের ঘরে রেখে আসবে। চিঠিপত্রের খামগুলোর গায়ে লেখা প্রেরকের ঠিকানাগুলো দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। তারপর আর সিঁড়ি দিয়ে নামেনি। একটু পরে, বাইরে সেই আওয়াজ। কোন কিছু কোথাও পড়ার। আমরা বাইরে বেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে, ওঃ ভাবা যায়না। একেবারে অভাবনীয়, ব্যখ্যার অতীত।

    "সমরদা, অভাবনীয় হতে পারে। কিন্তু ব্যাখ্যার অতীত নাও হতে পারে।" বলল অপালা। "এমন কি হতে পারে না, ঐ চিঠিগুলোর কোনটায় কিছু একটা উনি পড়েছিলেন। আর তার ফলে, কিভাবে বলি, ঐ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া ওনার মনে হয়নি আর কোন উপায় আছে!"
    “এইটাই” প্রায় লাফিয়ে উঠল অলক।
    "আরে আমরা কি আর সে সব ভাবিনি নাকি, যে কেউ সেটাই প্রথমে ভাববে। পুলিশ ও যদ্দুর মনে পড়ে, প্রথমেই সে লাইনে ট্রাই করেছিল। কিন্তু ত্রিদিব একটা চিঠিও খোলেনি। সমস্ত গোছাটাই একসাথে ওর বিছানার উপর রাখা ছিল।"
    অলকের মুখ দেখে মনে হল না এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি আছে ও।
    "একটা চিঠিও খোলেনি? সিওর?"
    "সিওর। ঘটনাটা ঘটার পর আমি আর সমর দুজনেই ওর ঘরে গিয়েছিলাম। মাথার দিকের খোলা জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলো এসে পড়েছিল বিছানায়। সব কটা চিঠি একসাথে না খোলা অবস্থায় বিছানায় বালিশের কাছাকাছি রাখা ছিল।"
    "পুলিশও তাই বলেছিল। একটা চিঠিও খোলা হয়নি।" বাঁ হাতের তিন আঙুল দিয়ে কপাল টিপে সেই রাতটা মনে করতে করতে বলল সমর।
    "হয়ত খুলে পুড়িয়ে ফেলেছিল।" শেষ চেষ্টা করার মত করে বলল অলক।
    "অত অল্প সময়ে পোড়ানোর চিহ্ন চাপা দেওয়া যায় না।" অনন্ত তার কথায় অনড়।
    অলক তবু যেন মানতে পারছে না
    "মিলছে না, কিছু একটা হিসেব মিলছে না।"
    "মিলছে না-ই ত। বীভৎস কাণ্ড! যেন ভুতে পেয়েছিল ওকে। কখন যে ওর ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দার রেলিং ধরে কি রেলিং টপকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, কেউ দেখে নি। যেখান থেকে লাফ মেরেছিল সেইদিকে একটা লম্বা গাছ ছিল। ওটার ছাদের দিকের দুটো ডাল হাওয়ায় এমনভাবে নড়ত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। একবার কাছে চলে আসত, আবার সরে যেত। আমি যদিও ভূতে বিশ্বাস করি না তবু কিরকম একটা আনক্যানি লাগত, গা ছমছমে। তাই রঞ্জনা যখন গাছটা কেটে ফেলতে বলল, আমি না করিনি। ভগবান জানে ত্রিদিব কী দেখেছিল ঐ গাছে। কোন নিশি ডেকেছিল ওকে। নীচে পড়ে এমনভাবে চোট খেয়েছিল, কিচ্ছু করার ছিল না আর।"
    রঞ্জনা কখন যেন এর মধ্যে নীচে নেমে এসেছে। মায়ার সাথে পরিচয় বিনিময় করে দুচারটে কথা সেরে নিয়ে সত্যার্থীর অন্য পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়েছে। এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিল। গাছটার উল্লেখে একবার শিউরে উঠে সত্যার্থীর দিকে হেলে এলো।
    ঘরের মধ্যে আবার নীরবতা নেমে এল।
    "পুলিশে কে খবর দিয়েছিল?" চেয়ার ছেড়ে উঠে কোক-এর টেবিলের দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করল মায়া।
    "আমিই পুলিশে ফোন করতাম। বোঝন-ই ত, থানার সাথে আমার যোগাযোগ রাখতেই হয়। কিন্তু তার আর দরকার পড়েনি।” বলল অনন্ত। “পরীর মাঠে যে মেলাটা চলছিল সেটায় সেই বিকালে না কি সন্ধ্যায়, কিছু একটা ঝামেলা হয়েছিল, ছুরি-টুরি চলেছিল। আমাদের এই রবীন্দ্র সরণীর উপর দিয়েই নাকি বাইকে করে চার-পাঁচজনের গ্যাংটা পালিয়েছিল। একটা সময় খোঁজখবর করতে বেরিয়ে এস আই দস্তিদার এইদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ির সামনেই একটা গগলস পড়ে থাকতে দেখে আর রাস্তার পাশে স্কিড মার্ক দেখতে পায়। তখন গাড়ি থামিয়ে আমাদের সাবধান করে দিতে বাড়িতে এসেছিল। আসলে ড্রাইভওয়েতে আমার গাড়িটা দেখেই চলে এসেছিল। আমায় একটু জানিয়ে রাখতে চেয়েছিল আর কি। ত্রিদিব তখন উপরে চিঠিপত্র রাখতে গেছে। ওর পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে আমাদের সাথে সাথেই দস্তিদারও ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দস্তিদারই বডি চেক করে জানায় যে কিছু আর করার নেই। কাজেই আমাদের আর আলাদা করে পুলিশে খবর দিতে হয়নি।
    "বছর ছিল বটে একটা।" সমর বলল। "এদিকে বন্যায় নিচু এলাকাগুলো ভেসে গেছে। পোষ্ট অফিস ভেসে গিয়ে মেল বন্ধ। রেল অবরোধ, মেলায় ছুরি চলছে। কোন মাসে ত্রিদিব মারা গেল বলত? এর মধ্যেই সব কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে। যা তা! মাত্রই ত দশ-বার বছর। এর মধ্যেই সময়গুলো কেমন গুলিয়ে গেছে। কোন মানে হয়?"
    "হয়।" বলল মায়া। তারপর গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল, "ঠিক ঠিক সময় মনে রাখাটা হচ্ছে স্মৃতির এক আশ্চর্য কৌশল। আমরা একটা সময়কে মনে রাখি কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে। খুব বড় ঘটনা নিজের নামেই মনে থাকে। সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ - টুইন টাওয়ার, আমেরিকা। নভেম্বার ২৬, ২০০৮ তাজ মুম্বাই। কখনো কখনো একই তারিখ একাধিক ঘটনায় জুড়ে যায় ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ - বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ২০১২ - দিল্লীতে নির্ভয়া । কোন কোন দিন আবার এলাকাভিত্তিক মনে থাকে। জুন ৭, ২০১৩, ক্যালিফোর্নিয়ায় পারিবারিক অশান্তির জেরে এক বন্দুকবাজ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে মেরে ফেলে। চীনে এক আত্মঘাতী গণহত্যায় এক বাসে বিস্ফোরণ ঘটে প্রায় পঞ্চাশের কাছে মানুষ মারা যায়। আর পশ্চিমবঙ্গের একটা ছোট্ট জায়গা কামদুনীর এক দুর্ভাগা পরিবার তারিখটা মনে রাখে তাদের এক অসহায় মেয়ের উপর ঘটা নৃশংস অত্যাচার আর হত্যার কারণে।”
    সত্যার্থীর মনে হল, মায়া একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে আনছে। সে সাগ্রহে মায়ার কথার অপেক্ষায় থাকল।
    “বাকি পৃথিবীর কাছে কোন গুরুত্ব না থাকলেও নিজের নিজের এলাকায় মানুষ একটা ঘটনাকে আরেকটা ঘটনারে সাথে জুড়ে মনে রেখে দেয়।” বলে চলল মায়া। “একটা বাড়ি কি উড়ালপুল ভেঙ্গে পড়া, স্থানীয় কোন অপ্রত্যাশিত ভোটের ফল, ক্লাবের উদ্বোধন, বাজারে আগুন, কোন খুন।”
    “দাঁড়ান, দাঁড়ান, অনন্ত, মনে আছে তোর,” চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল সমর, “এর কয়েকদিন আগেই ত দিগন্ত মল্লিকের ঘটনাটা ঘটেছিল, তাই না?”
    “কদিন আগে না পরে?”
    “না না, আগেই। আমার পরিষ্কার মনে আছে। ঐ বুড়োর বাড়িতে একটা সময় যাতায়াত বেড়েছিল ত্রিদিবের। মনে পড়ছে তোর? বুড়োর মরার হপ্তাখানেক আগেও ও বাড়িতে গেছে ও। ওর বউটার কথা বলত। বুড়োর সাথে বিশাল বয়সের তফাৎ। গরীবের ঘরের শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী লেখাপড়া-জানা মেয়ে। মেয়েটার এক দূর সম্পর্কের মামা না পিসের কাছ থেকে প্রায় কিনেই এলেছিল বলা যায়। বুড়োটার কী সব গণ্ডগোল ছিল। মেয়েটার দুর্দশার একশেষ। কিছু করতে পারত না। কোথাও যাওয়ার ও যায়গা ছিল না। পরে কাগজেও দু-একবার বের হয়েছিল।”
    “হ্যাঁ, ত্রিদিব মেয়েটার কথা বলেছিল বটে কয়েক বার। যে রকম করুণ অবস্থার কথা বলত ও, বুড়োকে ঝেড়ে দিয়ে থাকলে বৌটি অস্বাভাবিক কিছু করেনি”
    “মনে পড়েছে, ঐ দিনই কাগজে প্রথম পাতায় এক কোণে একটা খবর বের হয়েছিল। বেশি না – দু এক লাইন। তদন্তের খাতিরে দিগন্ত মল্লিকের বডি কফিন থেকে তোলা হবে। আশ্চর্য কী জানেন, লাইনটা যখন পড়েছিলাম, তখন তেমন ভাবে খেয়াল করিনি। অথচ আজ এত বছর বাদেও একেবারে পরিস্কারভাবে মাথার মধ্যে লাইনগুলো ভেসে এল।”
    “এ রকম হয়। মনের এ এক, বলতে পারেন স্বয়ংক্রিয় আত্মরক্ষার প্রক্রিয়া,” বলল মায়া। “ভীষণ চাপের মুখে, বিপর্যয় বিহ্বলতার মুখে মন নিজেকে একটা অন্য কিছুতে, কম গুরুত্বের কিছুতে সরিয়ে নেয়। পরে আপনি যখন আবার সেই দিনের কথা ভাবেন সেই অন্য ছবিটাও ফিরে আসে। যেন একটার সাথে আরেকটাকে একটা পেপারক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।”
    “একেবারে ঠিক বলেছেন আপনি।” বলল সমর। “বাইরে ওর বডিটা ঐ রকম অসহায়ভাবে পড়ে আছে, পুলিশ পুরো ব্যাপারটা টেক ওভার করেছে, বাকিরা সবাই হতভম্ব হয়ে যাতায়াত করছে, আর আমি চত্বরটার একপাশে দাঁড়িয়ে একবার মাথার উপরে উঁচুতে ঐ ডালগুলো দেখছি, একবার ওর দিকে তাকাচ্ছি। আর খবরের কাগজের ঐ লাইনগুলো মাথার মধ্যে ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মায়া, লাইনগুলো আমার মধ্যে কোনো রিঅ্যাকশান তৈরি করেনি তখন। অথচ কদিন বাদেই ঐ দিগন্ত মল্লিকের কেস নিয়ে এলাকায় ঝড় বয়ে গিয়েছিল।”
    “ত্রিদিব সামন্তর বডিটা যেখানে পড়েছিল সেটা কি ওর শোবার ঘরের কাছেই?” প্রশ্ন করল মায়া।
    “না, না। বডি পড়েছিল পিছনের উঠানে।” বলল সমর। “দোতলায় এই যে ঘরটা দেখছেন গ্যারাজের উপরে, এর উপরের তিনতলার ঘরটাই এ বাড়ির সবচেয়ে বড় শোবার ঘর। ঘরের সামনে চওড়া বারান্দা। গ্যারাজের পিছনের দরজার ওপাশ থেকে সিঁড়িটা ঐ বারান্দায় উঠে গেছে। বারান্দাটায় তখন গ্রিল ছিল না। ঐ বারান্দা থেকে নীচে, বাড়ির পিছনের উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও। বাড়ি আর গাছের মাঝখানে উঠানটায় ওর বডি পড়েছিল। ঐ গাছটা অবশ্য এখন আর নেই।”
    “ওটাতেই তো তখন ভূতের হাতের মত লম্বা লম্বা ডাল ছিল, দুলে দুলে ডাকত, তাই না?”
    “ঠিক বলেছেন।” শিউরে উঠে বলল রঞ্জনা।
    মুখে একটা খুশীর হাসি নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল মায়া। ওকে দেখে সত্যার্থীর মনে হল, যেন এক নিপুণ জেলে তার জাল গুটিয়ে আনছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
    ঘরের মধ্যে সবাই চুপ করে আছে। কেউ কেউ ফাঁকা গ্লাস ভরে নিচ্ছে।
    তাকাবো না তাকাবো না করেও সত্যার্থী একবার দোতলার দিকে তাকাল। ছায়াটি এখন আর অত ছায়া নেই। আঁধার থেকে খানিকটা আলোতে বেরিয়ে এসেছে সে। একদৃষ্টে নীচে তাকিয়ে আছে, একজনের দিকে – অলক।

    গ্লাস ভরে নিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসে বলল অনন্ত, “দিগন্ত মল্লিকের কেসটা নিয়ে তখন আমাদের এলাকায় কিছুটা হৈচৈ হয়েছিল। মল্লিক ক্রিশ্চান হওয়ায় পুলিশের একটা বড় সুবিধা হয়েছিল, বডিটা আবার তুলে এনে তদন্ত করতে পেরেছিল। আর তার ফলেই বিষের প্রমাণ মিলেছিল। তা না হলে, বডি পুড়ে গেলে আর কিছু করার থাকত না। তারপরেও অবশ্য কাজের কাজ কিছু হয়নি। মেয়েটার বিরুদ্ধে একটা ওয়াইন ডিক্যান্টার ভেঙে ফেলার গল্প আমদানি করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি পুলিশ। মেয়েটা, কতই বা বয়স, বেকসুর ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। তারপর একসময় ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে কোথায় চলে গেল। এরকম কত মেয়েই যে হারিয়ে যায়। তবে এ হয়ত ওর বরের কিছু টাকাপয়সা, অন্ততঃ বাড়ি বেচার টাকাটা পেয়েছিল। সেইটা ভাল। যদি না আত্মীয়স্বজনরা এসে বাগড়া দিয়ে থাকে।”

    এই সময় একটা কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজে সবাই চমকে উঠল। অলকের হাতের ধাক্কায় কী করে যেন ড্রিঙ্কসের টেবিল থেকে ওয়াইন ডিক্যান্টারটা উল্টে পড়ে গিয়ে একটা চেয়ারের পায়ায় লেগে কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছে। রঞ্জনা উঠে ভিতর দিকে গেল কাউকে একটা ডেকে এনে জায়গাটা পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য।
    “একদম বুঝতে পারিনি, বুঝলেন। কী ভাবে যে হাতটা ছিটকে গেল।” কাঁচুমাচু হয়ে বলল অলক।
    সত্যার্থীর মনে হল, লোকটা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে - তার কতটা পানীয়ের প্রভাবে আর কতটা ভিতরের কোন অশান্তির ফলে বলা কঠিন। কিন্তু অশান্তিটা কিসের? আর আজ রাতের আড্ডার সাথে সেটা কিভাবে যুক্ত?
    “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।” বলল রঞ্জনা।
    “এই কথাটাই, ঠিক এই কথাটাই বলেছিল মিসেস মল্লিক, তাই না অনন্ত?” বলল সমর।
    “দস্তিদার ত তাই বলেছিল। ও ই কেসটার দায়িত্বে ছিল। প্রথমে ত ওরা ন্যাচারাল ডেথ ধরে নিয়েছিল। তারপর খুনের কেস চালু করেছিল। কিন্তু সেটার সমাধান করে উঠতে পারেনি। বদলি হয়ে যাওয়ার সময় দস্তিদার আমায় বলেছিল, এই কেসটা ওর জন্যে একটা কাঁটা হয়েই থেকে গেল।

    “পুলিশ বলেছিল মল্লিকের রেগুলার ড্রিঙ্কসের অভ্যাস ছিল। রেড ওয়াইন। বেশি না, রোজ রাতে ঠিক এক গ্লাস। একটা ডিক্যান্টার থেকে ঢেলে ঢেলে নিত। এক ডিক্যান্টারের স্টক থেকে কয়েক দিন চলে যেত। ঐ ডিক্যান্টারটাই নাকি মল্লিকের বৌ ভেঙ্গে ফেলেছিল। কী নাম ছিল বল ত মেয়েটির? অদিতি, অদিতি মল্লিক, তাই না? দিগন্তর মৃত্যুর পরদিন ওর বাড়ির কাজের লোকজনদের মধ্যে একজন দেখেছিল, অদিতি ঐ ডিক্যান্টারটা হাতের ধাক্কায় টেবিল থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। তারপর ভাঙ্গা টুকরোগুলো গারবেজ ক্যানে ফেলে দেয়। পরদিন গারবেজের ছেলেটা এসে গারবেজ নিয়ে চলে গেলে সব চিহ্ন লোপাট হয়ে যায়।” অনন্ত গল্প চালিয়ে গেল। “পুলিশ এই ক্লু পেয়ে খুব চেতে গিয়েছিল। সবাই একটা ব্যাপারে শিওর ছিল, দিগন্ত মল্লিকের বৌ হওয়ার থেকে জেলে যাওয়া ভালো। তার মানে ঐ লোককে খুন করার মোটিভ মিসেস অদিতির ভালোই ছিল। দিগন্তর কিছু আত্মীয়স্বজনের চাপে পুলিশ একসময় বডিটা কবর থেকে তুলে আনে। আর ঐ আত্মীয়দের সন্দেহটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। বিষ পাওয়া যায়। আর্সেনিক, তাই না?”
    “না, আমার মনে হয়, স্ট্রিকনিন।” বলল সমর, “এখনও যে কেউ এইসব পুরনো দিনের বিষ ব্যবহার করে সেটা আমার কাছে একটু আশ্চর্যের লেগেছিল। তবে সব-ই চলে হয়ত। যাই হোক, কথাটা হচ্ছে, যে বিষ-ই হোক, অদিতি ছাড়া আর কারো পক্ষে সেটা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই সেটা প্রমাণ করে উঠতে পারে নি। ঐ একটা কাজের লোক ছাড়া আর কাউকে মেয়েটির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেনি। বরং যে কজন ওদের চিনত সবাই মেয়েটাকেই সাপোর্ট করেছিল। ফলে অদিতি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।”
    “মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবাই কিন্তু আড়ালে স্বীকার করত যে খুনটা মেয়েটাই করেছে। কারণ ও ছাড়া আর কারো কাজটা করার সুযোগ ছিল বলে পুলিশ কাউকে হাজির করতে পারেনি। কিন্তু সেই সাথেই পুলিশ ওকে জেলে ঢোকাতে পারেনি বলেও সবাই খুব খুশী হয়েছিল। পুলিশের উপর আর কে কবে খুশী বলুন। দস্তিদার মাঝে মাঝেই আফশোস করত যে অপরাধীকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হল।”
    এই সময় মায়া একটু ছোট করে কেশে উঠল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “এর পর অদিতি কোথায় গেল কেউ জানেন?”
    “নাঃ। কেউ বলে, অস্ট্রেলিয়া, কেউ বলে কানাডায় ওর এক কাকা আছে। তার কাছে চলে গেছে। আবার কেউ বলে ওর সেকেন্ড হাসব্যান্ড ওকে নিয়ে দুবাই চলে গেছে। ঠিক করে কেউ কিছু জানি না আমরা।” বলল সমর।
    সত্যার্থী অলককে নজর করে যাচ্ছিল। কিছু একটা এই শ্রীমানকে ভিতরে ভিতরে জ্বালাচ্ছে, কুরে কুরে খাচ্ছে মনে হয়। টেবিলের পাশটা কী শক্ত করে চেপে ধরে আছে! আর একটু চাপলে তোমার আঙ্গুলগুলো যাবে হে শ্রীমান, সত্যার্থী ভাবল মনে মনে। কী যে চলছে তোমার মাথার ভিতর!
    “যাই হোক, এই সব কথাবার্তায় আমাদের মূল প্রশ্নটার সমাধানে আমরা এক ইঞ্চিও এগোতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না।” বলল সৃজন।
    “কী সেটা?” প্রশ্ন করল মায়া।
    “ত্রিদিব কেন বারান্দা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়েছিল।” একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলল অনন্ত। “আজকের এজলাস সেইটা নিয়ে কোন কিছু করে উঠতে পারলনা, তাই ত?”
    “তাই?” হাসল মায়া।
    “তা ছাড়া আর কী!” অসহিষ্ণু শোনায় অনন্তকে।
    “ব্যাপার কি জানেন, অনন্তবাবু,” বলল মায়া, গলায় বিষণ্ণতার সুর, “আপনারা সবাই এখনও অতীত আঁকড়ে পড়ে আছেন। মনের মধ্যে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ধারণাগুলোই এখনও আপনাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু, আমি, আমি তো একজন বহিরাগত, আমি শুধু ঘটনাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি।”
    “শুধু ঘটনাগুলো?”
    “ঠিক – শুধুমাত্র ঘটনাগুলো।”
    “কী বলতে চাইছেন আপনি?” খানিকটা হতবুদ্ধি হয়েই প্রশ্ন করল অনন্ত।
    “ঘটনাগুলো পর পর যেভাবে ঘটেছিল আমি সেটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমাকে অবশ্য কষ্ট করে কিছু করতে হচ্ছে না। ঘটনারা নিজেরাই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বলছি। চলুন, ফিরে যাই দশ বছর আগের সেই রাতে। দেখতে শুরু করি ঘটনাগুলোকে - নির্মোহভাবে, কোন রকম ধারণা বা আবেগ বাদ দিয়ে। গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই আগে।”
    উঠে দাঁড়াল মায়া। এগিয়ে গেল পানীয়ের টেবিলের দিকে। গ্লাস ভরে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বাকিটা নিয়ে ফিরে এল নিজের চেয়ারে। একটু কি লম্বা লাগল এখন? কিন্তু সেটা ত আর হতে পারে না। সব-ই মনের কারসাজি, ভাবল সত্যার্থী।
    “চলুন, ফিরে যাই সেই রাতে। বন্ধুরা সবাই নৈশভোজে জড়ো হয়েছেন। ত্রিদিব সামন্ত তার নায়িকার মন জয়ের ঘোষণা করলেন। কিন্তু বললেন না কে তিনি।
    তারপরেই ঘটল সেই অতি তুচ্ছ ঘটনাটি। আপনাদের মধ্যে একজন সেদিনের খবরের কাগজটি ছোট টেবিলের চিঠিপত্রের বাণ্ডিলের উপর রাখলেন আর চিঠিপত্র, খবরের কাগজ সব গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল। সেদিন খবরের কাগজ দেরীতে এসেছিল। ত্রিদিব ঐদিন কাগজ পড়ে উঠতে পারেননি। তিনি প্রথম কাগজ খুললেন চিঠিপত্রের বাণ্ডিল নিয়ে উপরে নিজের ঘরে গিয়ে যখন হাতের সব কিছু বিছানার উপর নামিয়ে রাখলেন, তখন।
    কী দেখেছিলেন তিনি? হেডলাইনগুলো? বক্স ফ্রেমে কোন বিশেষ সংবাদ? হতেই পারে। কী ছিল সেই সংবাদ? ফ্রেডরিক দিগন্ত মল্লিকের বডি তুলে আনা হবে কবর থেকে।”
    “সবটাই আপনার অনুমান,” বলল অনন্ত।
    “ঠিক। অত্যন্ত সম্ভব একটি ঘটনার অনুমান। সমরেন্দ্র নিজেও ত সেদিন ঐ খবর পড়েছিলেন। পড়ে তাঁর সেদিন বিশেষ কিছু মনে হয়নি। কারণ তিনি ঐ খবরের কারণ বা ভুক্তভোগী কোনটাই ছিলেন না। কিন্তু যদি এর কোন একটা বা দুটোই তাঁর জন্য সত্য হত, তিনি যদি হতেন সেই লোক যিনি মৃত ব্যক্তির সাথে মৃত্যুর দিন সাতেক আগে পর্যন্তও বেশ কিছুদিন ধরে মাঝে মাঝে সান্ধ্য আড্ডা দিয়েছেন, তবে কী করতেন তিনি?”
    “কী বলছেন আপনি?”
    মায়া বলে চলল, “ত্রিদিব শোবার ঘরে গিয়ে কাগজটায় সেই সংবাদ দেখলেন। আর কী দেখলেন? আপনারা বলেছেন মাথার দিকের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা দেখা যায়। সে রাস্তায় কিছু একটা বা কাউকে দেখেছিলেন কি তিনি? কী বা কে হতে পারেন, যার জন্য ত্রিদিব সামন্ত নিজের প্রাণ বিসর্জন পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?”
    “কী বলতে চাইছেন আপনি? কী দেখেছিল ও?”
    “আপনাদের-ই কথা অনুসারে সেই সময় রাস্তায় একটি পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর ড্রাইভওয়ে দিয়ে হেঁটে আসছেন এস আই দস্তিদার। তিনি আসছিলেন সেইদিনের মেলায় ঘটা একটা দুর্ঘটনার ব্যাপারে তাঁর স্থানীয় প্রভাবশালী বন্ধু অনন্তবাবুকে খবরটা দিতে। কিন্তু ত্রিদিববাবু কী দেখলেন – একজন পুলিশ। একজন পুলিশ ঢুকছে ওনার বাড়িতে।”
    ঘরের মধ্যে দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। কিন্তু সে নীরবতা অত্যন্ত কর্মময়। ঘরে জমায়েত মস্তিষ্কগুলো তাদের নিউরনে নিউরনে সাজিয়ে তুলছে অনেকদিনের জানা কতকগুলো তথ্যকে একটা নির্দিষ্ট সজ্জায়। যে সজ্জাটা তারা সবে জেনেছে। আর এলোমেলো ঘটনাগুলো অর্থবাহী হয়ে উঠছে।
    “এ হতে পারে না।” প্রায় ফিসফিস করে বললেও অনন্তই প্রথম কথা বলার শক্তি ফিরে পেল। “ত্রিদিব? দিগন্ত যখন মারা যায় ত্রিদিব ত তখন সেখানে ছিলই না! কাজের লোকেরা আর ওর বৌ – বুড়োর কাছাকাছি ত আর কেউই ছিল না।”
    “ঠিক,” বলল মায়া। “কিন্তু মৃত্যুর দিন সাতেক আগে? দেখা করে থাকতে পারেন, তাই ত? সে দিন ভরা ডিক্যান্টারে বিষটি মিশিয়ে দিলেন। এমন ত হতে পারে যে বিষটি ওয়াইনে গুলতে সময় নেয় আর ভারী বলে পাত্রের তলায় গিয়ে জমা হয়। গাঢ় লাল ওয়াইনের তলায় গুঁড়োগুলো কারো নজরে পড়বে না। যত তলার দিকের ওয়াইন, বিষের মাত্রা তত বেশি । শেষ দিনের গ্লাসের ওয়াইনেই বিষের পরিমাণ সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি ছিল।”

    অলক এইসময় প্রায় ছিটকে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এল। “কিন্তু, অদিতি কেন ডিক্যান্টারটা ভেঙ্গে ফেলল? সেইটা আপনি বলুন আমায়। ও কেন ডিক্যান্টারটা নষ্ট করে ফেলল।” বলার তীব্রতায় গলা ভেঙ্গে গেছে প্রায় তার।
    সত্যার্থীর দিকে ফিরল মায়া। ভুরু তুলল। ভুরু সমান হল, ঠোঁটের হাসি ছড়াল একটু। সত্যার্থীর মনে হল যেন ভ্রুপল্লবে ডাক এসেছে চন্দনের বনে দেখা করার।
    “প্রফেসর - ”
    চটকা ভাঙ্গল সত্যার্থীর। ডাক পড়েছে তার। মঞ্চ প্রস্তুত। তাই হোক, তবে তাই হোক।
    মৃদুস্বরে শুরু করল সত্যার্থী। প্রথমে একটু গলা কেঁপে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল।
    “অলক, আমার কী মনে হয় জানো, উনি ত্রিদিবকে সত্যি-ই ভালোবেসেছিলেন। ত্রিদিব চাইলে এমনিতেই ওর প্রতি মুগ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। তার উপরে, অদিতির কষ্টের কঠিন জীবনে ত্রিদিব ছিল প্রথম এবং একমাত্র খোলা হাওয়া। সরল, ভালো মনের মেয়ে। ত্রিদিবকে উনি ভালো না বেসে পারেননি। কিন্তু কর্তব্যে কোন ত্রুটি ছিল না তার। ত্রিদিবকে উনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দিগন্তর মৃত্যুর পর হয়ত সত্যিটা সন্দেহ করেছিলেন। আর এ ও বুঝেছিলেন যে অদিতিকে ওর কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দিতেই ত্রিদিব এত বড় ঝুঁকিটা নিয়েছেন। তাই ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিতে ওনার কোন দ্বিধা হয়নি। তবে সবটাই আমার অনুমান। ইচ্ছে করেই যে ফেলে দিয়েছেন, সেটা নাও হতে পারে। অনেকসময় আমরা গভীরভাবে যেটা চাই, আমাদের শরীর-মন আমাদের অজান্তে সেটাই করে বসে থাকে। পরে ত্রিদিব নিশ্চয়ই ওনাকে বুঝিয়েছিলেন যে দিগন্তর চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। অদিতির সন্দেহ তার পরেও মিটেছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু তাকে ভালোবেসে যে মানুষ এতবড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার মুখ চেয়ে রাজি হয়ে যান।”
    থামল সত্যার্থী, আর কিছু বলার নেই তার। মায়া চেয়ারে বসে হাসিমুখে সত্যার্থীর দিকে তাকিয়ে ছিল।

    কাছেই একটা চাপা কান্নার শব্দ বের হতে গিয়ে থেমে গেল। আর কেউ শুনতে না পেলেও সত্যার্থী পেয়েছে। না, আরো একজন পেয়েছে। তার মৃদু ঘাড় ঘোরানো নজর এড়ায়নি সত্যার্থীর।

    খুব মৃদু একটা ফোন বাজার শব্দ শোনা গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মায়া। পকেট থেকে ফোন বার করে কানে নিয়ে ও প্রান্তের কথা শুনে ফোন বন্ধ করে অনন্তর দিকে তাকিয়ে বলল -
    “মিস্টার ঘোষাল, আপনার আতিথেয়তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার গাড়ি কাছাকাছি এসে গেছে। আর একটুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। সামনে এসে অপেক্ষা করবে। ভালো কাটল আমার সময়টা। আশা করি, আপনাদেরও ভালো কাটল।”
    মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। কথা নেই কোন। মাথার ভিতরের কোষ গুলোতে সদ্য যে ঝড় বয়ে গেছে তার প্রভাব মুখে চোখে ফুটে আছে।
    “না মেলা হিসেবগুলো এতদিনে যে মিলে গেল, সেইটা অন্ততঃ ভালো লাগছে, তাই না? ভেবে দেখুন, ত্রিদিববাবু মেয়েটিকে অন্তর থেকে ভালবেসেছিলেন। এতটাই যে তার জন্য খুন পর্যন্ত করেছিলেন। যখন প্রায়শ্চিত্তের সময় এল বলে ভাবলেন, ভুল করে ভাবলেও, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। শুধু আফশোস এই, নিজেকে শেষ করে দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকেই চূড়ান্ত বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেলেন।”
    “মেয়েটি কিন্তু ছাড়া পেয়ে গিয়েছলি।” বিড়বিড় করল অনন্ত।
    “সেটা ত ওর বিরুদ্ধে কেসটা প্রমাণ করা যায়নি বলে। তবে আমার কী মনে হয় জানেন, সে দুর্ভাগিনী যেখানেই থাকুক, এখনও তার দাম দিয়ে চলেছে।”
    সমর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, অনন্ত যদিও মায়ার দিকে তাকিয়ে, চোখ তার অন্যমনস্ক, মন সম্ভবতঃ একের পর এক ছবি দেখে যাচ্ছে। রঞ্জনা তাকিয়ে আছে অনন্তর দিকে। অলক তার সোফায় দু হাতের মাঝে একটা খালি গ্লাস ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
    মায়া সত্যার্থীর দিকে ফিরল।
    “আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগল, প্রফেসর। জীবনটাকে দেখতে ভালোবাসেন আপনি, তাই না? এই রঙ্গমঞ্চ, এর চরিত্ররা, লাইমলাইট কখন কাকে ধরছে। মঞ্চমায়া কাকে যে আড়াল করে আর কাকে যে তুলে আনে।”
    “কেমন ভাবে কোন মায়াবী বাজিকর তার পুতুলদের দিয়ে অতীতের ঘটনাগুলো পর পর সাজিয়ে গল্প থেকে সত্য তুলে আনে।” আস্তে আস্তে বলে সত্যার্থী।
    “ঠিক। কিন্তু, এবার যে যেতে হবে আমাকে।”
    “চলুন, এগিয়ে দিই আপনাকে।”
    “চলুন।”
    “আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞসে করব?” যেতে যেতে খুব নিচু গলায় বলে সত্যার্থী, তারপর কী ভেবে বলে, “না থাক।”
    “আপনি কী ভাবছেন, আমি জানি।” বলল মায়া। “বাজারে ত্রিদিবের দেনা ছিল, বিধবা অদিতিকে পেলে রূপ আর অর্থ দুটোই চলে আসে ... গাছের ডালটা হয়ত একটা ইলিউশন ক্রিয়েট করেছিল ... পালানোর একটা প্ররোচনা দিয়েছিল ... অথবা উল্টোটা, বারান্দার কার্নিশ বেয়ে ঠিকই নেমে যাচ্ছিল ত্রিদিব, গাছের ডালটা হাওয়ায় দুলে হঠাৎ কাছে চলে এসে মনঃসংযোগে চিড় ধরে হাত ফসকে যায়।”
    ঘাড় নাড়ল সত্যার্থী। আর অবাক হচ্ছে না সে।
    “হতে পারে। না ও হতে পারে। আত্মহত্যাটাই থাক বরং। কী হবে অমন সর্বস্ব বাজি রাখা প্রেমের আর কাটা-ছেঁড়া করে!”
    মনটা হাল্কা লাগছে সত্যার্থীর। ঘরের দরজা খুলে মায়াকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। মায়ার সাথে সাথে কয়েক পা যাওয়ার পর হঠাৎ পিছন থেকে দরজা খুলে ছুটে এল একজন। সত্যার্থীর পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মায়ার সামনে। তুলে নিল মায়ার একটি হাত।
    আইলীন।
    “আপনাকে যে কী বলে ...” আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
    সস্নেহে তাকে কাছে টেনে নিল মায়া।
    “জানি, বলতে হবে না। ভালো থাকবেন।”
    মায়ার সাথে সাথে আইলীন প্রায় গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গেল। সত্যার্থী আগেই থেমে গিয়েছিল। মায়া উঠে গেল গাড়িতে। হাত নাড়ল। হাত নাড়ল আইলীন। হাত নাড়ল সত্যার্থী।
    আইলীন ফিরে আসছে। সত্যার্থী তাকাল আইলীনের মুখের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের অল্প আলোতেও বোঝা যাচ্ছে সে মুখ খুশীতে ঝলমল করছে। সত্যার্থীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উষ্ণ হাসি ছড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে তখন দরজার ফ্রেম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অলক সেন। দু হাত ছড়িয়ে আইলীন এগিয়ে গেল তার দিকে। অলক এগিয়ে এসে ডান হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর পিঠে বেড় দিয়ে তাকে নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকে গেল। কয়েক পা পিছনে সত্যার্থীও ঢুকে এল।
    বৈঠকখানায় তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। একটু আগে অলক যে সোফায় বসেছিল আইলীন সেটায় বসে পড়েছে। অলক তার সামনে মাটিতে বসা। হাতদুটি আইলীনের কোলের উপর রাখা।

    “আইলীন” অলকের গলা থেকে ঝরে পড়া আবেগ যেন দু হাত বাড়িয়ে আইলীনকে জড়িয়ে ধরছে, এমনটাই মনে হল সত্যার্থীর। “আইলীন, আমায় ক্ষমা করে দাও, আইলীন। তুমি আমায় বার বার বলেছ, কিন্তু আমি কিছুতেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। এ যে কী যন্ত্রণা সে আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।”
    সত্যার্থী তাদেরকে নিজেদের নিয়ে থাকতে দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
    “আমি জানি, আমি জানি ত। কী নরকের মধ্যে তুমি কাটাচ্ছ, আমার থেকে বেশি আর কেউ জানে না। যাকে ভালবাসি তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। একবার বিশ্বাস করছি আবার পরমুহূর্তেই সন্দেহে ভরে যাচ্ছে মন। ভয়ংকর। কিন্তু কি জানো, এর থেকেও ভয়ংকর হচ্ছে যে নরকের মধ্যে গত কটা মাস আমি রয়েছি, সেইটা। ভালোবাসার জনকে নিজেকে অবিশ্বাস করতে দেখা, আমাকে নিয়ে তোমার যে আতঙ্ক, আমায় তুমি ভালোবাস, অথচ তোমার চোখে আমি ভয় দেখতে পাচ্ছি, আমাকে ভয়। দিন-রাত এ নরক যন্ত্রণা মানুষকে তার সহ্যের সীমা পার করে দেয়। অনেকদিন আগে ঐ মানুষটা আমায় নিয়ে এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই গিয়েছিল। আজ সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলা, যাঁর আমাদের জীবনে আসার কথাই না, ঘটনাচক্রে এই রাতে এখানে এসে হাজির না হলে আমার জীবনে এই রাত আর ভোর হত না, অলক। তিনতলার বারান্দায় গ্রিল বসে গেছে, আমি ছাদের চাবি যোগাড় করে রেখে ছিলাম। আজ রাতেই ...”
    সত্যার্থী দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় একটু থেমে গেল। আইলীনদের ঘরের আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আলোর ফালি বাইরে বেরিয়ে এসে বারান্দা পার হয়ে রেলিংয়ের মাঝখান দিয়ে নীচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেখানে এখন দুটি হৃদয় ভালোবাসায় উপচে যাচ্ছে। সত্যার্থী মৃদু হেসে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।


    ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক

    পড়তে থাকুন, শারদ গুরুচণ্ডা৯ র অন্য লেখাগুলি >>
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ৩০ অক্টোবর ২০২০ | ৩৭৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ৩০ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৪৬99420
  • ভালো লাগল। আরও লিখুন, প্লীজ।

  • চিরশ্রী দেবনাথ | 2409:4066:e94:13f4::2bcb:***:*** | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫৬99462
  • আরোও লিখুন, দারুণ লাগল, অসাধারণ গল্প

  • | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ১৭:২৯99463
  • এমনিতে ভালই লেগেছে। দুই একটা জায়গা অল্প আড়ষ্ট মনে হল, এখন সে হয়ত আসল গল্পটা মনে পড়ে যাচ্ছিল বলেই মনে হল নাকি কি জানি। 

  • স্বাতী রায় | 2402:3a80:a54:a5a6:d2c8:f59a:a9c2:***:*** | ০২ নভেম্বর ২০২০ ১১:৩২99556
  • আগাথা ক্রিস্টি র লেখার যে বঙ্গীকরণ করা যায় এটাই কোনদিন ভাবতে পারি নি। সেই চ্যালেঞ্জটা আপনি নিয়েছেন। এবং প্রথম দিকের কালীপূজা  ইত্যাদি  আবহে বেশ ভাল surprise দিলেন। ভাল লাগল বলেই পরের কথা গুলো বলছি।  


    মায়া র চরিত্র ইন্টারেস্টিং তবে ভারতীয় হল কি? বা এই রকম চরিত্র ভারতীয় পটভূমিকায় কল্পনা করা যায় কি আদৌ? অদিতি থেকে আইলীন ও আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটু খাপছাড়া ঠেকেছে। গল্পের পরিসীমার বাইরে হলেও একটু কল্পনার মারফত অলক আইলীনের বিয়ের কথা দেখাল হত কি? আসলে ঠোঁট চাপা ইংল্যান্ডে যেটা সম্ভব, আমাদের দেশে বাল্য পরিচিত র বউ এর হাঁড়ির খবর অন্যরা জানবে না এইটা একটু কেমন লাগলো।  এত অফিস পার্টি না, কালীপুজোর আগের রাতে পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে বসানো আসরের ডাইনামিক্স আমাদের দেশে কি একটু অন্য রকম হয় না ? 


    তবু আবারো বলি, ভাল উদ্যোগ। আরও চাই। 

  • এলেবেলে | 202.142.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০২০ ১২:০৭99558
  • পড়লাম। 'বৈঠকখানা', 'পানীয়' চোখে লাগল। চোখে লাগল সংলাপে অসংখ্য উদ্ধৃতি চিহ্ন। চোখে লাগল সত্যার্থী ও মায়া মূর্তি নাম। বাকিটা ভালো লাগল। আরও হোক। তবে আরেকটু আড়ষ্টতা কমুক।

  • একলহমা | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ১৩:০৪99612
  • রঞ্জনদা, অনেক ধন্যবাদ উৎসাহ দেওয়ার জন্য। লিখতে অবশ্যই ইচ্ছা রাখি। তবে পড়তে যতটা ভালোবাসি, লিখতে অতটা নয়। লেখার জন্য এইটা একটা সমস্যা।


    চিরশ্রীদিদি, আপনার ভালো লাগার কথা  জানানোর এবং লেখায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। 


    দমুদি, গল্পটায় অনেক আড়ষ্টতাই আছে। এতটা লম্বা গল্প লিখতে লম্বা সময় লেগে গেল। ফলে  গল্প জমা দেওয়ার আগে মাস খানেক ফেলে রেখে তারপরে আবার ফিরে পড়বার যে কাজটা করতে পছন্দ করি সেটা করা হলনা। 


    স্বাতীদি, প্রথম অংশের ভাল লাগার কথা জানানোর জন্য ধন্যবাদ। এবার পরের কথায় আসি। ভারতীয় পটভূমিকায় মায়ার অস্তিত্ব – একেবারে অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়েছিল আমার। হতে পারে, অতিরিক্ত কল্পনা হয়ে গেছে। বাকি সব কিছু ঠিক থাকলে পাঠক হয়ত এই অত্যাচারটুকু মেনে নিতে পারেন এইরকম একটা ভরসা নিজেকে দিয়েছিলাম। অদিতি থেকে আইলীন – এইটা ত গল্পের বর্তমান দিনটিতে পৌঁছানোর মূল সূত্র। কাজটা যথেষ্ট ভালভাবে করা হয়নি, বোঝা গেল। একটু পরে যেটা আপনি বলেছেন – “বাল্য পরিচিতর বউ এর হাঁড়ির খবর অন্যরা জানবে না এইটা একটু কেমন লাগলো” – একেবারে ক্যাচ-কট-কট। ফিরে লিখলে এইখানে আরও খাটতে হবে। ভবিষ্যতের লেখায় এটা মনে রাখব। এতগুলি ত্রুটির পর গল্পটি আর ভাল উদ্যোগের বেশী কিছু হয়ে ওঠেনি। এত লম্বা লেখা ধৈর্য্য ধরে পড়ে এসে প্রাপ্তির খাতায় এতটা কমতি – খরচে পোষায় না। লেখক-পাঠক উভয়েরই সময় নষ্ট। 


    এলেবেলে, এমন লেখা আরও হওয়ার উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে সেটা আদৌ আমার সাধ্যের মধ্যে কি না তাই নিয়ে আমার দ্বিধা যে একেবারেই অমূলক নয় এ বিষয়ে এখন আমি নিঃসন্দেহ হয়ে গেছি। ‘বৈঠকখানা’, ‘পানীয়’ চোখে লাগা – সংলাপের বাইরে যথাসাধ্য চেষ্টা করি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে। হয়ত আরো সময় দিলে চোখ না লাগার মত কিছু বসানো যাবে। অসংখ্য উদ্ধৃতি চিহ্ন চোখে লাগা – সংলাপে উদ্ধৃতি চিহ্ন না দিতে বলছ? তাই হবে তা হলে পরের গল্পে। সত্যার্থী আর মায়া মূর্তির নাম - না, সেগুলি পালাটানো যাবে না। ঐ নিয়েও তো গল্প ফাঁদার ইচ্ছে আছে। আড়ষ্টতা কমা – লাও ত বটে, আনে টা কে? এটা মনে হয় না যাবে বলে, তবে চেষ্টা অবশ্যই করব।   

     
  • এলেবেলে | 202.142.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:৩৩99618
  • যেখানে ড্রিঙ্কস সার্ভ করা হচ্ছে, সেটা ড্রয়িংরুম। কারণ ওই ডিক্যান্টার। বৈঠকখানা বাঙালি, কিন্তু পুরনো বাঙালি। বড়জোর হুঁকো। একটু আয়েসি।


    সংলাপ লেখায় উদ্ধৃতি চিহ্ন প্রায় উঠে যাওয়ার পথে। বিকল্পে একটি ড্যাশ। এই রকম 

  • Swati Ray | 117.194.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ০১:৫৫99784
  • "লেখক-পাঠক উভয়েরই সময় নষ্ট। " এমন কথা ​​​​​​​আমি ​​​​​​​একদমই ​​​​​​​বলতে ​​​​​​​চাই ​​​​​​​নি।  এইরকম ​​​​​​​কিছু ​​​​​​​মনে ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​থাকলে ​​​​​​​অত্যন্ত ​​​​​​​দু:খিত। ​​​​​​​তাহলে ​​​​​​​সেটা ​​​​​​​আমার ​​​​​​​বোঝানোর ​​​​​​​অক্ষমতা। 


    আমার ভাল লেগেছে ।আরও পড়ার আশায় থাকব .

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন