এ কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয়, যে, গোটা দক্ষিণবঙ্গ অভূতপূর্ব বিপর্যয়ে প্রায় ভেসে গেলেও ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে কুলুপ। এও কোনো আপতিক ঘটনা নয়, যে, আমপানের বিধ্বংসী কাণ্ড আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে জায়গা পেলেও, অন্তত গভীর রাত পর্যন্ত দিল্লির কথাকথিত 'জাতীয়' মিডিয়া যথেষ্ট গুরুত্ব দেবার সময় পায়নি। এসব কোনো অকল্পনীয় নতুন ঘটনা নয়। আপামর বাঙালি যতই বলিউডের যাত্রাপালা দেখে চোখের পানি ঝরাক, যতই কোহলির শতরানে তাথৈ নৃত্য করুক, ভারতবর্ষ নামক রাষ্ট্রটির পূর্ব দিকের পশ্চিমবংগ নামক রাজ্যটির অস্তিত্ব ভারতবর্ষের ম্যাপে সেভাবে কখনও ছিলইনা। পুরোনো বাম সরকারের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র, তাঁর নিজের স্মৃতিচারণাতে লিখেছেন, তিনি একবার দিল্লি গিয়ে যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে বলেছিলেন, কলকাতা থেকে দিল্লি এলে মনে হয় গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। কথাটা নেহাৎই রেটরিক ছিলনা। গ্রামকে শুষে যেমন শহর ফেঁপে ওঠে, কলোনিকে চুষে যেমন প্রভুর বাড়বৃদ্ধি, দিল্লি এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বাড়বৃদ্ধি যেকটি রাজ্যকে ছিবড়ে করে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গ তার মধ্যে সবার আগে থাকবে। অশোক মিত্র একে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা আখ্যা দিয়েছেন। না বললেও কোনো ক্ষতি ছিলনা, কারণ, এ কোনো গোপন কথা নয়, যে, স্বাধীনতা-উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি নীতি বস্তুত বাংলাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে। মাশুল সমীকরণ এর একটি উদাহরণ। কেন্দ্রীয় আয়কর আহরণ এবং যোজনা খাতে ব্যয়বরাদ্দের পদ্ধতি আরেকটি। যতদিন যোজনা কমিশনের অস্তিত্ব ছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কর বাবদ যে পরিমান টাকা দিল্লি নিয়ে গেছে, রাজ্যে ফেরত এসেছে তার ভগ্নাংশ মাত্র। ভারতের অন্যান্য প্রান্তকে মাশুল সমীকরণের মাধ্যমে যে সুবিধে দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিটিই পশ্চিমবঙ্গকে খাদে ঠেলে দেবার দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। খুব সোজা কথায় বললে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নীতি কাজ করেছে সাইফনের মতো, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যার এক ও একমাত্র কাজ ছিল এ রাজ্য থেকে সমৃদ্ধিকে অন্য রাজ্যে পাচার করা। এই কাজ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৬ ই আগস্ট থেকে এবং আজও চলছে। অজস্র জটিল অর্থনৈতিক রেটরিকের আড়ালে এই লুণ্ঠনকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাদা চোখে দেখলে লুণ্ঠন ছাড়া এর আর অন্য কোনো নাম থাকতে পারেনা। বস্তুত এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, যে, ব্রিটিশ আমলে কলোনিপ্রভুর আদায় করা টাকার যে ভগ্নাংশ বাংলায় ফেরত আসত, স্বাধীন ভারতে সেই ভগ্নাংশের পরিমান কমেছে কিনা। হিসেবটা সহজ নয়, কারণ অজস্র পরিভাষার মারপ্যাঁচে, অজস্র অনুদানের মোড়কে ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই হিসেবকে জটিল করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাদা বাংলায় হিসেব করলে দুই জমানার ভগ্নাংশে খুব তফাত হবার কথা নয়।
এই ট্র্যাডিশনও একেবারেই নতুন নয়, যে, এমনকি বিপর্যয়ের সময়ও হকের টাকা ফেরত পাবার পদ্ধতি হিসেবে ভারত সরকার কেবল একটি পদ্ধতিই সামনে রেখেছে, যার নাম হাত কচলানো। দেশভাগের পর বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যা, বিপর্যয়কে সামাল দিতে হয়েছে রাজ্যকে। টাকা? কেন্দ্রীয় সরকার করের টাকা নিয়ে গেছে, অন্যান্য অঞ্চলে ব্যয়িত হয়েছে সেসব। ধীরে-সুস্থে তৈরি হয়েছে নয়া দিল্লি, দিল্লি রাজধানী এলাকা। কিন্তু মেরুদন্ডহীন কংগ্রেস নেতারা কেঁদে-ককিয়েও বিপর্যয় সামলাতে নিজের টাকা ফেরত আনতে পারেননি। অন্যান্য অঞ্চলের টাকা এখানে আনা তো অনেক পরের কথা। তদুপরে প্রতিটি যোজনা বরাদ্দে বঞ্চিত হয়েছে বাংলা। মাশুল সমীকরণের বোঝা ঘাড়ে চেপেছে। পাটশিল্প, সিনেমা শিল্প লাটে উঠেছে। তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র নিদান ছিল, কেঁদে ককিয়ে কোনো লাভ নেই, নিজের ঠেলা নিজে সামলাও। জমিদারবাবু খাজনা হিসেবে বেশিরভাগ ফসল নিয়ে নিজের মতো খরচা করবেন, তিনি থাকেন শহর দিল্লিতে, গ্রাম বাংলায় কে কী খাবে, সেটা তারা বুঝে নিক। এই পুরো পদ্ধতিটা ধামাচাপা দেবার জন্য একটি রেটোরিকও চালু করা হয়েছে, "বাঙালি কর্মবিমুখ, ব্যবসাবিমুখ, তাই তার দ্বারা কিছু হবেনা"। সবার চেয়ে বেশি এই রেটরিক হজম করেছে বাঙালিই। শিল্প যে আকাশ থেকে পড়েনা, বস্তুত বৃহৎ এবং মাঝারি শিল্পপতিরা যে সরকারি নীতির পরোক্ষ সুবিধায় এবং সরকারি সাহায্য বা ঋণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, ঠাটবাট বাড়িয়ে চলেছে, এর পিছনে কোনো ম্যাজিক বা জাতিগত বৈশিষ্ট্য নেই, এটা কোনো অজ্ঞাত কারণে বুদ্ধিমান বাঙালিও বোঝেনি। আজ একটা কথা খুব চালু, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। বস্তুত লাইসেন্সরাজ চালিত গোটা পরিকল্পিত মিশ্র অর্থনীতিই ছিল সরকারি ছাপ্পায় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, যা বহুদশক ধরে চলেছে।
ফলে কেন্দ্র হল জমিদার, যাদের কাছে এ রাজ্যের অস্তিত্ব কেবল খাজনা আদায়ের সময়ে, এ বাস্তবতা বহুদিনের। ফলে আজ কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে কুলুপ, সর্বভারতীয় মিডিয়ার অভ্রংলিহ নীরবতা, নতুন কিছু নয়। আকাশ থেকে পড়ারও কিছু নেই। এটাই চালু পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে আমরাও মেনে নিয়েছি এবং স্বীকৃতি দিয়েছি। মেনে নিয়েছি, যে, করের টাকা আসলে কেন্দ্রের প্রাপ্য, রাজ্যের কাজ হল কাকুতি-মিনতি করা। বাবু দুটো কলামুলো দিন না। বাবু কখনও দিয়েছেন, কখনও দেননি। আমরা এই লাথিঝাঁটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। হিন্দুস্তানকে জাতি, দিল্লির মিডিয়াকে "জাতীয়" মিডিয়া, লুঠকে ন্যায়সঙ্গত এবং হাত কচলানোকে ভবিতব্য মনে করেছি। "বঞ্চনা" নিয়ে খিল্লি করেছি। বলিউড আর ক্রিকেট দেখে নিজেকে মূল ধারার ভারতীয় প্রমাণ করতে চেয়েছি। কিন্তু সবই একতরফা। আমরা দিল্লির অপরাধের ঘটনায় গর্জে ওঠাকে মূল ধারায় ঢোকার উপায় ভেবেছি, দিল্লির স্লোগান আওড়ানোকে "কুল" ভেবেছি, দিল্লির আবহাওয়ার বিপর্যয়কে সারা ভারতের বিপর্যয় ভেবেছি। সবেতেই "জাতীয়" মিডিয়া ধোঁয়া দিয়েছে। কারণ জমিদারের সমস্যা গোটা তালুকের সমস্যা। কিন্তু উল্টোটা নয়। কাজেই আশ্চর্যর কিছু নেই, যে, আজ যখন প্রকৃত বিপর্যয় আমাদের ঘাড়ের উপর, তখন ও প্রান্তের কেউ কেয়ার করছেনা। আমরা কান্নাকাটি করছি, দিল্লিকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করে আমাদের সাহায্যের প্যাকেজ দিতে হবে বলে চেঁচামেচি করছি, কিন্তু সেটাও বস্তুত জমিদারকে দয়ালু হতে বলা ছাড়া আর কিছু নয়। "প্লিজ স্যার, বিপদে পড়েছি, আমাদের কিছু সাহায্য করুন" -- এই তো আমাদের দাবীর সারকথা। কিন্তু আসলে তো ব্যাপারটা উল্টো। এটা জাতীয় বিপর্যয়, বাঙালির জাতীয় বিপর্যয়। টাকাটা বাংলার হকের। কেন্দ্র কোনো অনুদান দেবার অধিকারীই নয়। কেন্দ্র হকের টাকা নিয়ে এতদিন ফেরত দেয়নি। সেটা সুদে আসলে ফেরত চাওয়া উচিত। এবং হিসেবটা উল্টে ভাবা উচিত, যে, বাংলার টাকা মূলত বাংলার। সেখানেই তার থাকা উচিত। তার কিছু অংশকে অনুন্নত উত্তর ভারতের জন্য অনুদান দেওয়া যেতে পারে। মানবিকতার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বার্থে। সেটাই অনুদান। কেন্দ্রের দেওয়া টাকাটা প্যাকেজ বা অনুদান কিছুই নয়।
এসবও নতুন কিছু কথা নয়। কিন্তু এই বিপর্যয়ের সময়ে আবার কথাগুলো উঠে আসছে। এটা এই মুহূর্তে একটা বিপর্যয়ের ব্যাপার হলেও, ব্যাপারটা সেখানেই শুরু বা সেখানেই শেষ নয়। ঘুর্ণিঝড় হয়েছে, এরপর অন্য কিছু হবে, পরিকাঠামো উন্নয়ন তো একটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার। যতদিন না চিন্তার কাঠামোটা বদলাচ্ছে, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, যতদিন কেন্দ্র-রাজ্যের হাত কচলানোর সংস্কৃতি বজায় থাকবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবেনা। আজ এই দুঃখের মুহূর্তে, বিপর্যয়ের মুহূর্তেই এগুলো ভাবা এবং বলা দরকার। নইলে কোনো কিছুই বদলাবেনা।
এখনো অব্দি একটা টুইট করবারও সময় হয়নি মহাত্মাদের।
আর হ্যাঁ, কিছু বাঙালি তো এতে খুব খুশি।
পশ্চিমবাংলাকে যেন টেনিস কোর্টের বল ভেবে নেওয়া হয়েছে।একটার পর একটা দূর্যোগ। অসহায় হয়ে যাচ্ছে মানুষ্
এমনটাই প্রত্যাশিত। রং চাড়ানোর জায়গা নেই তাই ট্রেন্ডিংং নয়। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক চ্যানেল শেষ কবে বংলার খবর করেছে মনে নেই। জিয়াগঞ্জ ও দুর্গাপূজা বন্ধ করা নিয়ে প্রচুর বাজিমাত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শো মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
যথাযথ বলেছেন "দ"।
যথাযথ বলেছেন "দ"।
যথাযথ..তবে এ ব্যাপারে আমাদের দায়ও বোরো কম নয়...
"গ্রাম থেকে শহরে" হবে। লেখকেরই ভুল।
"যতদিন না চিন্তার কাঠামোটা বদলাচ্ছে, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, যতদিন কেন্দ্র-রাজ্যের হাত কচলানোর সংস্কৃতি বজায় থাকবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবেনা।" - পুরোপুরি।
সাম্প্রতিক কালে সৈকতের সবচে বলিষ্ঠ লেখা।লা জবাব!
এই লেখায় প্রচুর রাগ। ,অভিমান আছে।কিন্তু কিছু কিছু খামতি চোখে পড়লো।
মাশুল সমীকরণ নিয়ে বেশি কিছু লেখার দরকার নেই।কারণ ওসব জিনিষ তামাদি হয়ে গেছে।কিন্তু জটিল কর ব্যবস্থা নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া উচিত।বেঙ্গল থেকে কতো টাকা ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স কালেক্ট হয় এবং কেন্দ্র কতো ফেরত দেয় ?
দুই,লোকসংখ্যা অনুপাত অনুযায়ী পশ্চিম বঙ্গের প্রাপ্য কতো?
তিন,জমিদার কোনদিন গরীব প্রজাকে অনুদান দেয় না।তাই দুটো উপায় আছে, বিভিন্ন ফর্মে প্রতিবাদ করা। সেটা কোর্ট,পার্লামেন্ট,মিডিয়া যা কিছু হতে পারে।অথবা নিজে জমিদার হয়ে যাওয়া।
ধংশস্তূপের মত ছবিগুলো এক এক করে ফিডে, হোয়াটস্যাপে আসছে ~ এয়ারপোর্ট জলের তলায়, পথঘাট চিরে চলে গেছে কোনও ডাইনোসর, বইপাড়া ভাসছে, বাড়িতে বাড়িতে ছাত/ বাগান ওলোটপালট| এ তো সেইসব ছবি, যা তোলা হয়েছে, এর বাইরের বাংলা? সে ছবি তুলবে কে?
সোশাল মিডিয়াতে একটার পর একটা হতাশার ছবি| জাতীয় সংবাদমাধ্যমের উপেক্ষা - কিন্তু এসবের মধ্যে একটা বড় আসার আলো, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা এক নবরত্ন রাজ্যপাল পেয়েছি বটে| উনি তো বললেন ন্যূনতম ক্ষতি হয়েছে নাকি| মাননীয় দিলিপবাবু চুপ - উনি ঊল্টোদিক করে পেদে দেওয়ায় নাকি এবারের মত আমফান দিক বদলে গেছে| আর যাবে নাই বা কেন? না গিয়ে উপায় আছে?
মুখ্যমন্ত্রী অনেক লোক হাসান ভাষন দিয়ে থাকলেও আজ যখন বলছেন সত্যিই হেরে যাচ্ছি, তখন মনে হয় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার রোখটা বাঙালির আছে তো, না সেও এই দুর্ভোগে ভেসে গেল? সত্যিই ঘুরে দাঁড়ান যাবে তো?
টুইটারে এই পোস্টটা লেখার সময় চেক করলাম - #prayforwestbengal হ্যাশট্যাগটা দশ নম্বরে ট্রেন্ডিং, তার অনেক আগে আছে #RamMandirExisted, যে জাতটার ওপর গোড়া থেকেই বানের জলে ভেসে আসা ছাগলের তৃতীয় সন্তানসুলভ ভালোবাসা কেন্দ্রের সেখানে আর কিই বা আশা করা যায়|
তাই বলছিলাম কি আপনি বাঁচলে রামের নাম না হয় হবে, আপাতত রাজনীতি বানের জলে ভাসুক| ঐ যে শ্রীজাত বলতেন না শিরদাঁড়ায় নাকি তফাত, সেটা বরং করে দেখাই|