উত্তর তীর দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের সমান্তরাল যে রাস্তাটি চলে গেছে তার নম্বর ৫২। আমার পরিচিত পথ। শহর থেকে বেরিয়ে কখন বাস প্যাসেঞ্জারের চরিত্র বদলাবে আন্দাজ করতে পারি। সুবেশ অসমিয়া চাকুরে, মোবাইলদুরস্ত মারোয়াড়ি ব্যবসাদার,ব্যাগ আঁকড়ানো বাঙালি মেডিকাল রিপ্রেজ??ন্টেটিভদের অনুপাত কমে আসবে। জায়গা নেবে চা বাগিচার কুলি রমণীরা। কখনো চমৎকার স্বাস্থ্যের বোড়ো যুবক যুবতী। আর কখন উঠবেন লুঙ্গিওলা 'মিঞা' চাষি্, গলা ঘোমটা বিবি, আন্ডাবাচ্চা। বাসের পরিবেশ তখন সামান্য চিড়বিড়ে। এক কন্ডাক্টারকে বাদ দিলে বাকি সহৃদয় মুখগুলো ভ্যানিশ।
পথ গেছে বোড়োল্যান্ডের ভেতর দিয়ে। ২০০৮-এর অক্টোবর মাসে এলে এই রাস্তাকে দুর্গম পেতেন। মিঞা-বোড়ো দাঙ্গায় গোটা ৬০ জন মারা যায়। বন্ধুদের চাপা আনন্দ দেখেছিলাম, ঞ্ছমিঞাগুলারে যা দিসে না!ঞ্জ। দেখতে পেতেন দগ্ধ দোকানের সারি। অথবা বাঁশের পোড়া কাঠামোরা দাঁড়িয়ে আছে। দলগাঁও, খারুপেটিয়া ছোট শহর। সেখানে রাস্তার পাশে ইস্কুল, হাসপাতাল চত্তরে রিফিউজি ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। দেখতেন ঠ্যালায় করে সংসার, মায় বাড়ি বাঁধার বাঁশ,তুলে মিঞাবিবি চলেছেন নিকটের ক্যাম্পে। বছর খানেক ছিল ক্যাম্পগুলো।
মিঞাদের আরো নাম আছে। পুরাতন অসমিয়াদের কাছে তারা 'ময়মনসিংগিয়া'। সম্বোধনটি তাচ্ছিল্যমিশ্রিত। তবে এর খানিক ইতিহাসভিত্তি আছে। বৃটিশদের ভূমিরাজস্বের খাঁই ছিল ভরপেট। আসামদেশ দখল করার পর সায়েবদের খেয়াল হল এখানে জমির অভাব নেই। অথচ জনসংখ্যা অপ্রতুল। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য জমি চাষে লাগানো দরকার। ব্রহ্মপুত্রের চর, পলিজমি পাট চাষের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু চাষ করবেটা কে? বাংলার জনঘনত্ব সেই সময় আসামের কয়েকগুণ। অতএব প্রশাসন পূর্ববঙ্গ থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চাষিদের আনার উদ্যোগ নিল। এদের প্রায় সবাই মুসলমান ছিলেন, এবং বেশিরভাগ ময়মনসিংহের। কালে পূর্ববঙ্গের মুসলমান মাইগ্রান্ট চাষি মানেই ময়মনসিংগিয়া নাম হল। বর্তমানে তাদের 'ন-অসমিয়া' নাম দিয়ে অসমিয়া সমাজে একাত্ম করার চেষ্টা চলছে। সরকারি প্রচেষ্টা আর কী। মধ্যবিত্ত মানসের অবস্থা বাসের মত।
পাট চাষ নিয়ে এই লেখা,মাঝখানে শিবের গীত এসে গেছে। পরশু, ১০ অক্টোবর বেসিমারি গঞ্জে পুলিশের গুলিতে ৪ জন পাট চাষি মারা গেছেন, অনেকে আহত। দাবি ছিল পাটের জন্য ন্যায্য দামের, পাটের স্তুপ বানিয়ে ৫২ নং সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের মাথায় ঢিল পড়লে পুলিশ কয়েন, মানে গুলি, ছোঁড়ে।
বেসিমারির উদ্ভব বেশ রাতারাতি। ১০ বছর আগে জায়গাটিকে খেয়াল করতেন না। প্রব্রজনী চাষিদের খাটার ক্ষমতা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কামড়ে থাকার ফল বেসিমারি। ৩০ বছর আগের নিছক জনমজুর, প্রান্তিক চাষির পরের প্রজন্মকে আজ ব্যবসা, চাকরি, দক্ষ শ্রমিকের কাজে দেখা যাচ্ছে। বেসিমারি রমরমে গঞ্জে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পরশু রাতে পাট চাষি হত্যার খবর পেলাম কলকাতার টিভি চ্যানেল থেকে। স্থানীয় অসমিয়া, অন্য ভাষার নিউজ? চ্যানেলে ঘুরলাম। পরকীয়া প্রেমে গৃহবধূ খুন বাদে কিছু জানা গেল না। পরের দিন খবরের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বেরোলো। অন্য সব প্রধান খবরের মধ্যে অন্যতম, তার বাইরে কিছু নয়। জাতীয় মিডিয়াতেও বিশেষ কাভারেজ পায়নি। বাস প্যাসেঞ্জারদের কপালের ভাঁজ কখনো কাটবে?