রাজারহাট, নিউ-টাউন --- উচ্ছেদ ও নয়াবসতির ছত্তিরিশ কাহন যেখানে ছড়িয়ে আছে প্রতি কাঠা জমিতে| নব্বইয়ের দশকে কে যে প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল জলাজমি, ধানজমি আর অজস্র জীববৈচিত্র্যে ভরা ধুপির বিল , ঘুণির বিল সহ এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ছেনে উপড়ে ঢেলে নতুন করে সাজাবে, তা আজ আর জানার কোনও উপায়ই নেই| ইমতিয়াজ আলি, বালু সর্দার, সুশান্ত মিস্ত্রিরা ত্খনও জানত লাল পার্টি হল গরীবের বন্ধু, ত্রাতা, তাদের কাছের লোক| তাই যখন হঠাৎই একদিন তাদের ফলন্ত ধানের ক্ষেতে ঢেলে দেওয়া হয় কয়েক ট্রাক মাটি, কিম্বা চালিয়ে দেওয়া হয় ভলভো বাস্ আর তদারকিতে থাকে লোকাল কমিটির '--'দা; তারা ভারি অবাক হয়ে গেছিল, এতটাই অবাক যে একটা কথাও বলতে পারে নি| আর অমনি করেই তারা টুপ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল একদিন, আর তাদের খুঁজেও পাওয়া গেল না| যাদের মুখে কথা ফুটেছিল, চোখে রাগ আর হাতে কাটারি উঠেছিল তাদের কেউ কেউ পাখি সর্দারের মত গুলি খেয়ে টপকে গেল, কিম্বা বাপি সর্দারের মত হঠাৎই মস্ত বড়লোক হয়ে বাইক দাপিয়ে ঘুরতে লাগল| ধানক্ষেত আর বিল, জলা ভরে উঠল মাটিতে, যে মাটিকে ওরা মা বলেই জানত| 'মা-মাটি-মানুষ'এর মমতাময়ী শ্লোগান তৈরী হতে তখনও একযুগ বাকি|
নিজের খুন হওয়ার পিছনে পাখির যে একেবারে কোনও অবদান নেই, এমনটা কিন্তু বলা যাবে না| খুনের মত এতবড় একটা বেআইনি কাজে সেও যে ইন্ধন যুগিয়েছিল তার খবর পাওয়া যাবে রাজারহাট এলাকায় বৌ-ঝিদের এককাট্টা করে সে-ই যে প্রথম জমি বাঁচানোর আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল সেই বিবরণ খুঁজে কিম্বা খুঁড়ে বের করতে পারলে| তার প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হাত পা ছোঁড়া, এক দালালকে একসময় ঝাঁটাপেটা করার ইতিবৃত্ত জন্ম দিতে পারে নি কোনও বড়্সড় আন্দোলনের| তাই পাখি হঠাৎ লাশ হয়ে যেতে তার সোয়ামি বালু সর্দার ছাড়া আর কেউ তেমন নড়েচড়ে বসে নি| আর বসে নি বলেই অঞ্চলের বা পার্টির কেউ ভাবেই নি 'প্রোমোটার হটাও, পার্টি বাঁচাও' শ্লোগানের মধ্যে এই পাখি বৃত্তান্তটি ঢুকে পড়বে| এমনিতে বালুর অভিযোগ থানায় জমা হওয়ার পরও কেটে যাওয়ার কথা অনেক দিনরাত, আসামী ফেরার এবং কোর্টের ডেট বছরে, দুবছরে একবার করে পড়তে পড়তে আসামীটির একসময় ৬৩ বা ৭৭ বছর বয়সে সিরোসিস অব লিভার বা উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে নির্বিঘ্নে মারা যাওয়ার কথা, কিন্তু বৃত্তান্তটির এমন সরল হওয়ার পথে বাধ সাধল ননী সাহা| রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় তার ঘোর প্রতিদ্বন্দী এবং পার্টির 'ভদ্র লবির নেতা'কে নাস্তানাবুদ করতেই ননীর নাকটি তেরচা করে ঢোকে পাখি উপাখ্যানে|
ননী সাহা, রাজারাহাট নামক স্বপ্ন প্রকল্পটি যার হাতে এনে দিয়েছে কোটি কোটি টাকা, অন্য প্রোমোটারদের মত জাতে ওঠার জন্য সে বাংলা সিনেমা প্রযোজনা কিম্বা সংবাদপত্র-সিনেমা-টিভি চ্যানেল নিয়ে মিডিয়া ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নি| জীবনী লেখাবে বলে লেখক হিসেবে ননী ভাড়া করে এক উঠতি সাংবাদিককে| লেখক শর্তসাপেক্ষে একটি বছর ননীকে বেচে দিয়েছে| এ বাবদে লেখকের প্রাপ্তির তালিকাটি বেশ লম্বাই বলতে হবে; নিউ টাউনে দেড় হাজার স্কোয়ার ফিট কার্পেট এরিয়ার ফার্নিশড ফ্ল্যাট, দশলাখ টাকা এবং লাক্ষাদ্বীপে প্রমোদ ভ্রমণ| এরকম মোটা মজুরির আঁচ বঙ্গীয় লেখককূল পেলে অনেকেই যে টেন্ডার জমা দিয়ে, একে তাকে গুঁতিয়ে, প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে, পায়ে পড়ে, ধর্ণা দিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিত সে বিলক্ষণ জানা ছিল ননীর, কিন্তু দারুণ নিউজ ভ্যালুর এই খবরটি যে গজাবার সুযোগই পায় নি তার কারণ ননীর দূরদর্শিতা| শুধু তাই নয় ননী বেশ স্পষ্ট করে বলেছে বইটি শুধু ননী সংকীর্তন হওয়া চলবে না, ননীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেসব গল্প হারিয়ে যাবে তাদের একটা বিশ্বাসযোগ্য রেকর্ড থাকাটাও জরুরী|
'বিশ্বাসযোগ্য' শব্দটা শুনতে বেশ ভারিসারি, কিন্তু সত্যিই তার ওজন কতটুকু? জমির দাম নিয়েই ধরা যাক, দশ বছর ধরে যে দামে জমি বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামটা নিয়ে তার ওপরে পঁচিস ত্রিশ পার্সেন্ট চাপিয়ে তবে জমির দাম ধার্য্য করা হয়েছে, সেই দামে জমি কেনা হয়েছে, এর মধ্যে অন্যায়টা কোথায় -- বলে ননী, বলে হিডকোর অফিসাররাও| গল্পটা কিন্তু এত সহজ সরল নয়, তা জীবনে কটা জিনিষই বা আর সহজ সরল আছে? এই 'জমির দাম ধার্য্যের বিশ্বাসযোগ্য গল্পটির মধ্যে উহ্য থাকে মন্ত্রী গৌতম দেবের সমস্ত জমি রেজিস্ট্রেশান বন্ধ করে দেবার কথা, ইন্ডিয়ান রেজিস্ট্রেশান অ্যাক্টের ২২ নম্বর ধারা বলবৎ করে জমি কেনাবেচাই বন্ধ করে দেন মন্ত্রীমশাই| কেনাবেচা বন্ধ থাকায় জমির দর বাড়ার কোনও সুযোগই আর রইল না| হিডকো পরে যখন জমি কিনতে শুরু করে তখন আগের দামের ওপরে সামান্য কিছু চাপিয়ে জমি কেনে এবং একটি ডাহা মিথ্যে বিশ্বাসযোগ্য খবরে পরিণত হয়| তাও জমির দাম নেয় নি বা পায় নি, জমি বিক্রি হয়ে গেছে সে খবরটাও জানে না এমন ছোট, মেজ, বড় কৃষকের সংখ্যাও রাজারহাটে নেহাৎ কম নয়| অনেকের চাষ জমিতে আবার সেচ দপ্তর হঠাৎ একদিন জল দেওয়া বন্ধ করে দেবার কথাও শোনা যায় কিছু বাসিন্দার কাছে, ফলত চাষীর ক্ষেত শুকিয়ে শস্যহানি হয়, জমি সুবিধাজনক দামে ইচ্ছামত বেচার কোনও উপায় থাকে না, হিডকোকেই বেচতে হয়| ৬০০০ একর উর্বর চাষজমি এমন নানা উপায়েই আসে হিডকোর হাতে আর কর্পোরেট্সংস্থাগুলিকে তা বেচে বহু টাকা লাভ করে হিডকো পরিণত হয় সরকারের সবচেয়ে ধনী দপ্তরে|
ডি কে চক্রবর্তী, এন গোস্বামী এবং আর কে চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালে 'সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে' লিখছেন হাজার তিনেক বছর আগে কলকাতা, গোটা চব্বিশ পরগণা, তার দক্ষিণ অংশ আর পূর্ব কলকাতার রাজারহাট এলাকা ম্যানগ্রোভের নিজস্বভূমি ছিল| উন্নয়নের বার্তাবাহী মুখপাত্ররা বলে থাকেন জঙ্গল পুড়িয়ে চাষজমি আর চাষজমি ভরিয়ে আবাসন, কারখানা, আইটি হাব, শপিং মল বানানোর মধ্যে আসলে তফাৎ কতটুকু? পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে প্রকৃতির ওপরে চাপও ততই বাড়ছে, এইই তো হবার ক্থা| কিন্তু দুটোতে একটু ফারাক তো আছেই, চাষজমিকে ইচ্ছে করলেই ফেলে রেখে বা গাছ রোপণ করে আবার ফেরত যাওয়া যায় জঙ্গলে, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে জমিকে আর কোনওভাবেই ফেরানো যাবে না চাষজমিতে| তবে মানুষ তার আরামে থাকার হাতটাকে লম্বা করতে করতে ক্রমশই আরো বেশি করে শহরমুখী হয়েই যাচ্ছে --- এই সবই যখন ভাবছিল বিলে ঠিক সেই সময়ই কারন আলি সর্দার রেগে আগুন, চোখে জল নিয়ে জানালেন "যাত্রাগাছি রেকজোয়ানি মৌজায় এখন বিক্ষোভ চলছে, কেউ কি তার কোনও খোঁজ নিচ্ছে? চার বিঘে পাঁচ কাঠা জমি ছিল আমার,ভয় দেখিয়ে তখন দখল করল| নতুন সরকারের দল কিরা কেটে বলেছিল পাশে থাকবে, ন্যায় বিচার হবে| ক্ষতিপূরণ দেবে, নাহলে জমি ফিরত পাইয়ে দেবে| সব ভোঁ ভাঁ| এর জন্য, এরই জন্য এই আশাতেই জিতিয়ে আনলুম কিন্তু মন্ত্রী সান্ত্রী ন্যাতা কারো সাহায্য পাইনি কো| একটা টাকা অবধি পাইনি" স্থান- হাতিয়াড়া, তারিখ - ৮ই জানুয়ারী ২০১২, সমাবেশের উদ্দেশ্য - নিউটাউনের জমিহারাদের ক্ষোভ, অভিযোগ ইত্যাদির গণশুনানি| ৫০০ জন অংশ নেন এই গণশুনানিতে, বিলে-পুষ্প, কারন আলি সর্দার এঁরা ছিলেন সেইখানেই; তাঁদের সব অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়| অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আশ্বাস দেন তিনি এইসব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে অনুরোধ করবেন, যাতে সবাই সুবিচার পায়| সাধারণত যা হয়, এই ধরণের সমাবেশ এরকম নোটেই সমাপ্ত হয় এবং সরকারী শিলমোহরের ঘুমপাড়ানি ছোঁয়ায় তারপরে তা ঘুমিয়ে পড়ে|
কোনও পার্টি পাশে না থাকলে ছোট্খাট আন্দোলন কখনও বেড়ে ওঠে না, ফল দেয় না এইই উপলব্ধি রাজারহাটের সেইসব চাষীদের, যাদের কেউ কেউ এখন দিনে দশ ঘন্টা কোনও গেটেড কম্যুনিটির গেট রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন| শিখরপুর বান্ধব সমিতি আয়োজিত রক্তদান শিবিরে বসে রাজারহাট জমিরক্ষা সমিতি'র সদস্য বাবলু মিঞা অবশ্য এইসব কিছু বলেন না, বরং 'ভেদিক ভিলেজ'এর বাসিন্দাদের প্রচুর সুখ্যাতি করেন, বলেন ভেদিক ভিলেজের জন্যই ওঁদের এখানে প্রতি তিনমাসে হয় রক্তদান নয় চক্ষুপরীক্ষা ক্যাম্প হয়, একেই তো বলে 'উন্নয়ন'| সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বড়দা এই রাজারহাট জমিরক্ষা আন্দোলনের এখন কী অবস্থা জিগ্যেস করলে ভারি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েন, বিড়বিড় করে কি যেন বলেন বোঝা যায় না, তারপরেই দ্রুত বলতে থাকেন্ ভেদিক ভিলেজ তৈরী হওয়ায় শিখরপুর কালুর মোড় অঞ্চলের কী কী উন্নতি হয়েছে| কালুর মোড় থেকে ডিপিএস মেগাসিটির দিকে এগোলে এঁকেবেঁকে চলা সরু রাস্তাটার পাশে এখনও পাওয়া যায় ঝুপসি বাঁশবন, দেখা যায় মাছরাঙা, ইষ্টিকুটুম, হাঁড়িচাচা পাখি, বেজি এমনকি ভাম পর্যন্ত| ডিপিএস ছাড়িয়ে রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ের দিকে এগোলে আস্তে আস্তে দেখা যায় ইউনিটেক, স্টারলিট-এর মত গেটেড কমিউনিটিগুলো, এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেপড়ে হু হু করে চলে আসুন সেক্টর পাঁচের দিকে, আসবে আরও সব তাবড় তাবড় সোসাইটি, তবে যদি আপনি হেলাবাড়ী/প্রাইড হোটেল থেকে ডানদিক ধরে ভেতরে ঢুকে যান, তাহলে মিনিট পাঁচ হাঁটলেই পোঁছে যাবেন 'একান্ন নম্বর কলোনী'| সে আরেক মহামানবের সাগরতীরবিশেষ| সেখানে প্রতিদিন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বাংলাদেশ থেকে লোক এসে নয়াবসতি স্থাপন করে, সপ্তাহে পনেরো দিনে একবার করে হিডকো এসে কিছু দরমার বেড়া, টালির চাল ভেঙে দিয়ে যায়, বেড়ে যায় সিন্ডিকেটের দালালের আনাগোণা| বিভিন্ন শর্তে মেলে কিছু লোকের মাথাগোঁজার ঠাঁই| কিন্তু সে তো অন্য গল্প, অন্য আরেকদিন বলা যাবেখন|
পড়ছিলাম রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অপারেশান রাজারহাট'| নিউ টাউন হয়ে যাওয়ার পরের গল্প নয়, এ বই রাজারহাটের নিউ টাউন হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকে হয়ে ওঠার মুহূর্তটি অবধি গল্প বলে| পড়তে পড়তে সমানে মিলেমিশে যাচ্ছে নিজের অভিজ্ঞতা এই বিলে, কিরণবালা, পুষ্পদের আমিও চিনি, প্রায় এইসব কথাই আমিও শুনেছি| রাঘবের তীক্ষ্ণ কলম আর গভীর অনুসন্ধিৎসা নিউ টাউনের উন্নত উপনগরীর তলা থেকে পরতে পরতে তুলে এনেছে গল্প, কাহিনী, প্রচলিত গাথা, মূক হয়ে যাওয়া কিছু ব্যক্তিগত ইতিহাস| উপন্যাসটির চলন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব লিখনশৈলী অনুযায়ী কখনও সরলরৈখিক পথে চলে না| অনবরত এগিয়ে পিছিয়ে হঠাৎ গোঁত্তা মেরে বাঁক ঘুরে বলে চলে এক বয়ে যাওয়া জীবনের কথা, হারিয়ে যাওয়া, মুছে যাওয়া কিছু নিরুপায় মানুষের কথা| বালিগড়ি, পাথরঘাটা, নতুনপুকুর, চকবেড়িয়া, নস্করহাট, ছাপনা, ভোজেরহাট সর্বত্র মিলবে পাখির দোসর, পুষ্পর জুড়ি কিম্বা বাসন্তীবালার আরো কয়েকজনা, যার যাদের মাতৃভূমি ছিল এই রাজারহাট| তাদের সেই নিজস্ব ভূমি, মাতৃভূমির সাথে ছিল তাদের নাড়ির যোগ| সেই যোগ ছিঁড়তে রক্তপাত অনিবার্য করে তুলেছিল হিডকো-পার্টি-দালাল-প্রোমোটার-নেতা-কোম্প[আনি-গুন্ডা| ৩০০ পাতার বইটি একবারে একটানে শুধু যে পড়েই ফেলতে হয়, তাই নয়, বইটির কাছে রাজারহাট আখ্যানের কাছে ফিরতেও হয় বারবার, একবার পড়েই আলমারির পেছনে ঠেলে রাখা যায় না এ বই|
বইঃ অপারেশান রাজারহাট
লেখকঃ রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ ভবানী বুকস
দামঃ ৩০০/- টাকা