রাষ্ট্রহীন ৪০লাখ!
৪০ লাখ মানুষ রাতারাতি নাগরিকত্ব হারানোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলেন। আসামে। সেখানকার রাজ্য সরকার ৩০ জুলাই নাগরিক তালিকার (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স, NRC) চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের ঘোষণার সাথে সাথে এল এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এই নিয়ে হইচই অবশ্য অনেক দিন ধরেই চলছিল। প্রাথমিক খসড়া আগেই বেরিয়েছিলো, এখন এল চূড়ান্ত খসড়া। চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ তালিকা আসবে এবছরের শেষের দিকে। তা' এই NRC-র আমদানির পিছনে আসামের ইতিহাসের যাত্রাপথের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে।
আসামের জাতিবিন্যাস: ইতিহাসের পথ বেয়ে
আসামের দীর্ঘ ইতিহাস বহিরাগত আর খিলঞ্জিয়া (স্থানীয়)দের বিরোধে ভারাক্রান্ত। আর এই বহিরাগতদের তালিকায় বিপুল পরিমাণে ছিলেন বাঙালিরা। এই ইতিহাসের কথা যে সময়ের, তখন আজকের ভারতের বা তার ভিতরে আসাম রাজ্যের সীমানাগুলো এভাবে চিহ্নিত ছিল না। বরাক উপত্যকায় আদি বাসিন্দা হিসেবে বাঙালিরা ছিলেন। প্রশাসনিক কাজে, চাকরি সুত্রে, বা আরো জীবন-জীবিকার সন্ধানে প্রচুর বাঙালিই অসমীয়া অধ্যুষিত বিস্তৃত ভুখন্ডে পাড়ি দেন। যেমন ছিলেন নেপালিরাও। দার্জিলিং-তরাই-ডুয়ার্সে যত নেপালি থাকেন তার চেয়েও বেশি নেপালি থাকেন অসম রাজ্যে। এভাবে পাড়ি দেওয়া বা জীবিকার বাধ্যতায় আসামে যাওয়া মানুষের মধ্যে আরো ছিলেন বিহারী বা অন্য প্রদেশের মানুষরাও। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অন্য অঞ্চল থেকে আসা মানুষের সংখ্যাও বিপুল। আসামের মাটিতে বসবাসকারী অসংখ্য জাতি-উপজাতি-জনজাতির বিন্যাসও রয়েছে তারই সাথে। আসামের খিলঞ্জিয়া হোক বা এই জনজাতিগুলি হোক— এর শিকড়ের সন্ধান করে সঠিক তথ্য পাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার।
যাই হোক, এপ্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত কথা বলে রাখি। আসামের চা বাগানে শতাব্দীকাল আগে কাজ করতে যাওয়া মধ্য ভারতের আদিবাসী মানুষদেরও স্থানীয়রা 'বঙ্গালী'ই বলে! কেননা আসামে বাইরে থেকে আসা সবাইকেই বঙ্গালী বলা হত। সাহেবরা ছিল 'গোরা বঙ্গালী'! অসমীয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঙালি মানুষদের আগমনের দীর্ঘ ও নিবিড় ইতিহাস এর থেকে বোঝা যায়। এবং অবশ্যই প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক কাজে বাঙালিদের আধিপত্য স্থানীয় মানুষদের চোখে এক বিদ্বেষের ভাবনা তৈরী করতে করতে গেছে বিগত শতাব্দীগুলোর ইতিহাস জুড়ে। মিলেমিশে থাকার ইতিহাসও ছিল অবশ্যই। বাহ্যিক উস্কানি ছাড়া মানুষ এক জায়গায় থাকলে যেভাবে মিলেমিশে থাকে, সেরকম। সেই থাকার মধ্যে জীবন সংগ্রাম ছিল, জীবনের গানও ছিল। ভুপেন হাজারিকা, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা যখন একসাথে মিলে মানুষের গান গাইছেন, তখন সেই সমষ্টিযাপন আর সংগ্রামের ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আসাম একর্ড: নাগরিকত্ব বিতর্কের আনুষ্ঠানিক সূচনা
ইতিহাস এগোতে থেকেছে। '৪৭-এর দেশভাগ, '৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের স্রোত বাংলার মতই আসামকেও প্লাবিত করেছে। জীবন বাঁচানোর জন্য এবং তদুপরি জীবিকার সন্ধানে মানুষের এই যাত্রা। এবং তার পরের সময়েও আসামে চলতে থেকেছে এরকম আরো আগমনের ঘটনা। সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসই এই স্রোতের শরিক এবং সাক্ষী। দেশ, সীমানা, কাঁটাতার তো তার তুলনায় অনেক নতুন ব্যাপার।
যাই হোক, ৮০-র দশকে আসাম আন্দোলন আসামের স্থানীয় মানুষদের কন্ঠস্বরকে জোরালো রূপ দেয়। মূলতঃ ভারতীয় মূল ভূখন্ডের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই উত্তাল আন্দোলন ১৯৮৫ সালে দিল্লিতে সাক্ষরিত 'আসাম একর্ড'-এর মধ্যে দিয়ে তখনকার মত সমাপ্ত হয়। অন্য আলোচনায় না গিয়ে, আজকের 'NRC' সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়টুকুকে বেছে নিলে বলতে হয় যে এই আসাম একর্ড-এর মধ্যে দিয়ে অন্যান্য ব্যাপারের সাথে এও ঠিক হয় যে 'বহিরাগতদের ভারে আক্রান্ত আসামে নাগরিকদের সঠিক তালিকা' তৈরী করা হবে।
নাগরিকত্ব নথিভুক্তিকরণ নিয়ে আসামের জনমতের পিছনে
এটা লক্ষ্য করার মত বিষয় যে সেই সময়ে হোক, বা তার পরের পর্ব জুড়ে এই নাগরিক তালিকা চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আসামের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত বলেই বোধহয় অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো, অন্য জনজাতির সংগঠনগুলো, মায় বিভিন্ন ধরনের বামপন্থী-প্রগতিশীলরাও এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়, জরুরী বলে মেনে নেয়। বামপন্থীরা সাধারণতঃ সীমানা-কাঁটাতারের বাঁধনের চেয়ে মানুষের জীবন-জীবিকার সন্ধানে মাইগ্রেশনকে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে সঠিকভাবেই মনে করে, এবং মানবিকভাবে বিষয়টিকে দেখা উচিত বলে মনে করে। কিন্তু আসামে ব্যাপারটা কিছুটা অন্যরকম হল। আজকের আক্রমনের সবচেয়ে সফট টার্গেট যে মুসলিম সম্প্রদায় (যাদের মধ্যে মুসলিম বাঙালিরা আরো ভীতসন্ত্রস্ত), তাদের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত সংগঠন অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AAMSU) এবং অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (AIUDF) এই NRC-র পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। কারণটা স্পষ্ট এবং স্বাভাবিক।
বাংলাদেশী বিতর্ক ও জাতিদাঙ্গার দীর্ঘ ইতিহাস
বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ আসামে দীর্ঘ সময় ধরে এসেছেন, এবং আসছেন— এটা সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে অন্য ভাষাভাষী মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ও তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সদাবিরাজমান হুমকির বাতাবরণ। এই নিয়ে সংঘাত লেগেই থাকে, কখনো কখনো তা বড় সংঘর্ষের রূপও নেয়। এবং এটার প্রধান লক্ষ্য সাধারণতঃ মুসলিম বাঙালিরা, স্থানীয়ভাবে যাদেরকে মিঞা সম্প্রদায় বলে বলা হয়। এই আক্রমণ, হুমকি বা সন্দেহের ভ্রুকুটি আসামে চলতেই থাকে। ১৯৮৩ সালে নওগাও জেলার ‘নেলি হত্যাকান্ডে’ প্রায় ২২০০ মানুষ নিহত হন। আজও সেই গভীর ক্ষত বয়ে বেড়ায় আসাম। এর পাশাপাশি অন্য আরো বহু জাতি-জনজাতি-উপজাতিদের ভূমির উপর অধিকার নিয়ে সংঘর্ষেও ক্লান্ত আসাম। তাই নাগরিক পঞ্জীকরণ হোক, সঠিক নাগরিক চিহ্নিত হোক, অনুমান-নির্ভর তকমা লাগানো-হুমকি দেওয়া বন্ধ হোক— এই হল মোটামুটি সর্বসম্মত ন্যুনতম অবস্থান, একটু মানবিক বা অমানবিক দিকে ঝুঁকে থাকা নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত সহ।
নাগরিকত্বের মাপকাঠি
কী হবে সেই চিহ্নিতকরণের মাপকাঠি? ১৯৮৫ তেই ঠিক হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-এর পরে যারা এসেছেন তাদেরকে বিদেশী বলে ধরা হবে। এপ্রশ্নে আবার কেউ কেউ ১৯৫১ সালকে মাপকাঠি ধরার কথাও বলে, তাদের যুক্তি শেষ নাগরিক পঞ্জীকরণ হয়েছিল ঐ ১৯৫১তে। আসাম একর্ড-এর রূপায়ন নিয়ে তারপর কোনো সরকারই তেমন এগোয়নি। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের সরকার ভোটার লিস্ট থেকে প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে বাদ দেয়। এবং আশ্চর্য যে সেই ১ লক্ষ মানুষ কোথায় কিভাবে সমাজজীবনে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে তার কোনো হদিস নেই।
আসাম একর্ড রূপায়ণের নয়া পর্ব শুরু
এরপর সম্প্রতি ২০১৬ সালে আসামে ক্ষমতায় এসে বিজেপি সরকার এর রূপায়নে তত্পর হয়ে ওঠে। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে যাদের তূণে জনবিরোধী নীতির তীরের গোছা, যাদের আস্তিনে ধর্মের তাস, যারা নিজেদের গোলা ভরতে চায় আসলে সংখ্যালঘু-দলিত-মহিলা-জনজাতির ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ থেকে তুলে আনা ফসলে, তারা যে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়বে তাতে আর সন্দেহ কি?
বিজেপি তালিকা তৈরী করে চূড়ান্ত খসড়া বলে ঘোষণা করে দিল, আর এক লহমায় ৪০ লক্ষ মানুষ 'রাষ্ট্রহীন' হয়ে গেল। মুশকিল হল এই NRCতে কারা এবং কতজন বাদ গেল— সরকারিভাবে তা জানা যাওয়ার কথা নয়। শুধু ব্যক্তি মানুষেরই জানতে পাওয়ার কথা যে তার নাম তালিকায় আছে না নেই! এই ৪০ লাখের খবরটা ‘লিক’ হয়ে আসা। কিন্তু এর মধ্যে ভাষিক বা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে বা আর্থিক অংশ হিসেবে কারা কতটা আছেন তা জানার কোনো উপায় নেই! তারপর থেকে যা চলছে সেগুলো নিছক অনুমান! আর তার সাথে এক-একটা ব্যক্তিগত ন্যারেটিভ বেদনায় ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছে আমাদের।
নাগরিক তালিকায় কাদের নাম নেই?
ভাষিক দিক থেকে দেখলে এই ৪০ লাখের মধ্যে বেশিরভাগই বাঙালি। মুসলিম এবং হিন্দু বাঙালি। বৌদ্ধ, ক্রিশ্চান, জৈন কিংবা নাস্তিকরাও নিশ্চয়ই তালিকায় আছেন! বিশাল সংখ্যায় আছেন কোচ-রাজবংশীরা। আছেন নেপালি-বিহারীরা। আছেন চা জনজাতি সহ আরও নানা জনজাতির মানুষ। এবং আছেন অসমীয়া খিলঞ্জিয়া (স্থানীয়)রাও! যে দেশে আধারের তথ্য ভুলে ভরা আর যখন তখন লিক হয়, সেখানে যে এই বিপুল কাজের অসংখ্য টেকনিকাল ত্রুটি থাকবে এবং তার ভোগান্তি পোয়াতে হবে সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিভিন্ন মানুষকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অন্য দিকটা হল রাজনৈতিক অভিসন্ধি। কী সেটা?
আরও বড় ষড়যন্ত্র আসছে: নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬
ভুললে চলবে না যে এর পাশাপাশি বিজেপি সরকার ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (Citizenship Amendment Bill) নিয়ে এসেছে, যা এখনও পাশ হয়নি। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী? ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বিজেপি সরকার ধর্মকে মাপকাঠি করে নাগরিকত্ব দিতে চাইছে। এ আইন সংশোধিত হলে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারতে আসা সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ও পার্সিরা) ৭ বছর থাকলেই এ দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। আগে প্রয়োজন হতো ১২ বছর। মুসলিমদের ক্ষেত্রে সময়কালটা তাই থাকবে। এভাবে নাগরিকত্ব লাভের ক্ষেত্রে ধর্ম একটি মাপকাঠি হিসাবে বিবেচিত হবে, যা ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় দেশের সব নাগরিক জাতিধর্মনির্বিশেষে সমান বলে বিবৃত ধারণার বিপরীত।
বিজেপির বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক তাস
আসামের নাগরিক পঞ্জীকরণের সাথে দেশের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের একটা অলিখিত সম্পর্ক আছে। আর তাই এই সময়ে আসামের স্থানীয় মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। একদিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হলে এই NRC দ্বারা শেষতঃ চিহ্নিত উদ্বৃত্ত মানুষের অ-মুসলিম অংশটাকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অ-মুসলিম মানুষদের, বিশেষতঃ হিন্দু বাংলাদেশীদের ভারতে আসার প্রবণতাকে কার্যতঃ ইন্ধন দেওয়া হবে, এবং আবারও শরণার্থীর ভারে ন্যুব্জ হবে আসাম; এরই সাথে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও বিপুল বাড়বে বলেও আসামের নাগরিক সংগঠন, বিভিন্ন জনজাতি সংগঠন ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজের মত। তাই আসামে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক বিপুল গণজমায়েত হয়ে চলেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে কেন্দ্র করে।
রাষ্ট্রহীন হওয়াদের ব্যাপারে সমাধানটা কী?
কিন্তু আজকের NRC-র ফলে উদ্বৃত্ত হওয়া মানুষদের কী হবে? এই উদ্ভুত সমস্যার রাজনৈতিক-কুটনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমাধান কী? বিজেপির জন্য তো হিন্দুরাষ্ট্রের কানাগলি আছে, এরাজ্যের সরকারের রয়েছে ভোটের জন্য বাঙালি কার্ড খেলা, কিন্তু আমরা কি সুস্থ ও সুষ্ঠভাবে এর সমাধান খুঁজবো না?
প্রাসঙ্গিকভাবে ভুপালি শরণার্থী কান্ড
এতটা মাত্রায় না হলেও এক দশক আগের এরকমই একটা সংকটকে পিছন ফিরে দেখা যেতে পারে। ভুটানে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করা কয়েক লক্ষ নেপালি মানুষ (যাদেরকে ভূপালি বলা হয়) ভুটান রাজার প্রকোপে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ছাড়েন এবং তার মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ পূর্ব নেপালে সাতটি UNHCR (United Nations High Commissioner for Refugees)-এর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। বলাই বাহুল্য, এর আগেই মাঝের পর্বে কিয়দংশ ভারত ও নেপালের সামাজিক জীবনে নিশ্চুপে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। অত্যাচার ও প্রতিরোধের নানা ঘটনাপরম্পরা সত্ত্বেও শেষতঃ ভুটান ও নেপাল ওই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করায় শেষমেশ বিগত এক দশক ধরে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি সাতটি দেশে থার্ড কান্ট্রি পুনর্বাসন দেওয়া হয় ৮৩০০০ হাজার মানুষকে। বাকি রয়েছে ২৫০০০ মানুষ, যাদের এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি বা যারা এরকম বিদেশ-বিভুঁয়ে পুনর্বাসনে সম্মত নন। এখনো নেপালের ক্যাম্পে বসবাস করছেন তাঁরা।
সমস্যা কোনটা?— ‘অনাহুত মানুষ’ নাকি অপদার্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা?
আসামের প্রসঙ্গে এই ঘটনাকে টেনে আনলাম এটা বলতে যে খুঁচিয়ে তোলা এই সমস্যার সমাধান করা খুবই জটিল। যারা কোনো জায়গার সাবেকি বাসিন্দা অথবা কাজের সুত্রে সময়ান্তরে সেখানে এসে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন, তাদের গ্রহণ করে নেওয়াটাই সবচেয়ে বাঞ্ছিত ও বাস্তবোচিত সমাধান। জনগণের জীবনের সংকট এই অনাহুত মানুষদের থেকে যতটা জন্ম নেয়, তার থেকে ঢের বেশি জন্ম নেয় সরকারী বা রাষ্ট্রব্যবস্থার অপদার্থতা থেকে। সেগুলো সমাধান করতে পারে না বলে বা করতে চায় না বলে ক্ষমতাসীনরা জনগণের ক্ষোভের বর্শামুখ নিজেদের দিক থেকে জনগণের অন্য অংশের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। উগ্র-দক্ষিণপন্থী বা ফাসিস্তদের ভয়াবহ জনবিরোধী নীতি আর তার সংকটে পড়া জনতাকে সমস্যার মূল শিকড় চিনতে না দিতে এটাই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়।
তালিকার বাইরের মানুষদের ব্যাপারে একটা আনুমানিক তথ্য
একদমই অনুমাননির্ভর তথ্য— তবু একটা হিসেব শোনা যাচ্ছে এই ৪০ লক্ষের। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা স্যাম্পল সার্ভেগুলোর থেকে উঠে আসা অনুমান এরকম যে — এই ৪০ লক্ষের মধ্যে ১৫ লক্ষ হল মুসলিম বাঙালি, ২০ লক্ষ হিন্দু বাঙালি, আর বাকি ৫ লক্ষের মধ্যে কোচ-রাজবংশী, নানা জনজাতি, নেপালি (১ লাখের ওপর), বিহারী এবং বেশ বড় সংখ্যায় অসমীয়া খিলঞ্জিয়ারাও আছেন। এই হিন্দু বাঙালিদের ৮০ শতাংশ নমঃশূদ্র মানুষ বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট সংগঠন। এরকম হিসেব আরো আসতে থাকবে। কিন্তু সমাধান?
ডিটেনশন ক্যাম্প? নো ম্যানস ল্যান্ড? পুশব্যাক?— সম্ভব?
ডিটেনশন ক্যাম্পে এখন বারো হাজার মানুষ আছেন। সেখানে কত ধরবে আর? যদি ধরেও নিই যে এরা বাংলাদেশ থেকে আসা, তাহলে তাদেরকে বাংলাদেশ ফেরত নেবে নাকি?! এরকম কোনো কথাই আসেনি এখনো। যারা কথায় কথায় ‘পাকিস্তান বা বাংলাদেশ চলে যা’ বলে, তারা এরকম খোঁয়ারি দেখতে পারে, কিন্তু বাস্তব সমাধান তো খুঁজতে হবে!
এরকমও শোনা যাচ্ছে যে NRC-র এই খসড়াকে চূড়ান্ত করার পর্বে এই ৪০ লাখের মধ্যে ৩৫ লাখই হয়ত বৈধ হয়ে যাবেন। কিন্তু যদি বাকী থাকেন ৫ লক্ষ মানুষ, কী করবেন তাঁরা? কোথায় যাবেন? নো-ম্যানস ল্যান্ড তৈরী করা হবে তাদের জন্য? সুবিশাল ডিটেনশন ক্যাম্প হবে? তার খরচা কে চালাবে? আমাদের ট্যাক্সের টাকায় চলবে নাকি এসব তুঘলকি করবার? নাকি থার্ড কান্ট্রি রিহ্যাবিলিটেশন? নাকি নাগরিকত্ববিহীন ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে তাদের থেকে শুষে নেওয়া হবে সস্তার শ্রম? এটা কি চলতে পারে সভ্য দুনিয়ায়? নাগরিকত্ববিহীন, নাগরিক অধিকারবিহীন জীবনে ঠেলে দেওয়া হবে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে?
বাস্তবোচিত সমাধান প্রসঙ্গে
সত্যিই বলতে কি, এইসব খুঁচিয়ে তোলা সমস্যা আর গাঁজাখুরি সমাধানের ব্যর্থতার চেয়ে কাঁটাতারবিহীন, সীমানাবিহীন দুনিয়ার স্বপ্নটা অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে মনে হয়। তবু আপাততঃ এটুকু বলার যে, যারা আছেন তাঁরা তাঁদের শ্রম দিয়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন এই দেশে, এই সমাজে। NRC-র আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছেন যারা, আর কিছু মাস বাদে তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর ভীত-সন্ত্রস্ত-বিপন্ন সেই মানুষরা জীবন ও জীবিকার ঠাঁই খোঁজার মরিয়া চেষ্টায় কেউ হয়ত হারিয়ে যাবেন, কেউ মারা যাবেন, কেউ পালিয়ে যাবেন অন্য কোথাও, কেউ বা বেছে নেবেন অধিকারবিহীন মজুরি শ্রমের রোজনামচা, আর কেউ সুযোগ থাকলে ফিরে যাবেন বাংলাদেশ বা অন্য কোথাও! কিন্তু তারও পর? যারা থাকবেন শেষ তালিকায়? তাঁদেরকে নিয়ে রাষ্ট্রকে নিজের থুতু নিজেই গিলতে হবে তখন। সেই অবশিষ্ট মানুষদের নাগরিকত্বটুকু তো দিতেই হবে! নাগরিকত্বই!! কেননা রুজি-রুটির বন্দোবস্ত করার জন্য অন্ততঃ তাঁরা রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে ছিল না এতদিন!