এবারের অলিম্পিকে সবথেকে নাটকীয় ঘটনা হয়তো আল্লা রাশো ও মহম্মদ রাশো, দুই সিরিয় সাঁতারু ভাইয়ের আলিঙ্গন। প্রথম জন দেশত্যাগ করে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করছেন রিফিউজি দলের হয়ে ও অন্যজন সিরিয়ার হয়ে। সীমান্তের বেড়াজাল ও গৃহযুদ্ধের দুর্দশাকে অতিক্রম করে এক অনন্য নজির। রিফিউজি অলিম্পিক দলের বিষয়টি নতুন নয়; তবে ২০১৬ সালের ব্রাজিল অলিম্পিকের দলটি বর্তমানে বেড়ে হয়েছে প্রায় তিনগুণ। ঊনত্রিশ জন অ্যাথলেট প্রতিনিধিত্ব করছেন দুই কোটি সাত লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষের যাদের কোন দেশ নেই। এই রাষ্ট্রহীন মানুষদের ঘিরে উচ্ছ্বাসের উদযাপন প্রশংসনীয় তবে প্রশ্নাতীত নয়। উদ্বাস্তু পরিচয়ের মোড়কটিকে মহিমান্বিত করে কি পরিচয়হীনতার অসহায়তার কথাটি আমরা ভুলে যাচ্ছি না? আবার এটাও কি ভাবছি যে যাঁদের ঘিরে এই উচ্ছ্বাস তাঁরা নিজেরা এই পরিচয়হীনতার পরিচয়ে স্বচ্ছন্দ কি না?
ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একটি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব ও জনগোষ্ঠীগত পরিচিতির পারস্পরিক সম্পর্কের পরিসরটি জড়িয়ে রয়েছে জাতীয়তাবাদের চেতনার সাথে। ১৮৯৬ সালের অলিম্পিকে খেলোয়াড়দের ব্যক্তি প্রতিনিধিত্বের বিচারে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়, তবে ওটাই শেষ। তবে বোঝাই যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উদ্বাস্তু সমস্যাদীর্ণ বিশ্বে ক্রমে জাতিরাষ্ট্র ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি ঘিরে সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছিল। একদিকে ফ্রান্সের মত দেশগুলি বিশ্বযুদ্ধোত্তর শ্রমিক সংকট (পড়ুন ক্রীড়াবিদের সংকট) মেটাতে পরিযানে উৎসাহ দেওয়ার ফলে গৃহযুদ্ধদীর্ণ গরিব দেশগুলো থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে ইউরোপে। এরফলে যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠনের যুগে ফ্রান্স-জার্মানির মত দেশে যথাক্রমে ২৭ ও ২৩ লক্ষ পরিযায়ীর আগমন ঘটে এবং এই সংখ্যা সত্তর-আশির দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়তে থাকে। এর প্রভাব দেখা যায় ফরাসি ফুটবল দলেও; ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপ জয়ের মূল কাণ্ডারীরা ছিলেন মূলত পরিযায়ী বা পরিযায়ী পিতা-মাতার সন্তান। এই সকল খেলোয়াড়দের জাতীয় সংগীত না গাওয়া নিয়ে ফরাসি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের বিরোধ উঠেছিল বটে কিন্তু ফরাসি বহুত্ববাদী সংস্কৃতি তাকে অতিক্রম করেছে। তারপর রাইন-দানিয়ুব দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে; ২০১৫ সাল থেকে ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সর্বাধিক পরিমাণ বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার আগমন ঘটেছে। এর ফলে আমরা দেখি ২০১৮ এর ফুটবল বিশ্বকাপে বিরাশি জন খেলোয়াড় এমন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যা তাদের জন্মস্থান নয়। কিন্তু পরিযায়ী খেলোয়াড়দের অন্য দেশের হয়ে খেলা এক বিষয় আর খেলোয়াড়দের নিয়ে রাষ্ট্রহীন দল গঠন করা অন্য বিষয়। প্রথমটি রাষ্ট্রের বহুত্ববাদী গণতন্ত্রিকতার পরিচয় দেয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মূলে আক্রমণ করে, কিন্তু কীভাবে?
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তি পরিচয় যে বৃহত্তর পরিচয়ের অধীন থাকে তাহলো নাগরিকত্বের ধারণা। কিন্তু যাদের তা থাকেনা তারা হলেন রাষ্ট্রহীন, যেমন- উদ্বাস্তু জনসমষ্টি। রাষ্ট্রহীনতা এক অর্থে নাগরিক অধিকারহীনতাও বটে। ১৯৪৮ সালে ইউনাইটেড নেশনস্ ইকোনমিক এন্ড স্যোসাল কাউন্সিল রাষ্ট্রহীনতার যে ব্যাখ্যান দিয়েছে তাতে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তির অধিকারহীনতা বা তার মানবিক অবস্থানের অসহায়তার কথা উঠে আসে। সিরিয়ার যুদ্ধপরবর্তী উদ্বাস্তু অভিবাসনের যে ঢেউ ইউরোপের দেশে স্থান পায় তাঁদের জীবনযাপনের মান আমূল বদলালেও সামূহিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু আজও তাঁরা রাষ্ট্রহীন। রাষ্ট্র কিংবা জাতিপুঞ্জের ন্যায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দায় হল ব্যক্তি বা সমষ্টির রাষ্ট্রহীনতার অবসান ঘটানো, কিন্তু তার বদলে অলিম্পিকের মত মঞ্চে রাষ্ট্রহীনতার এই উদযাপন কি মূল সমস্যার সমাধান করতে পারে? এখানেই বর্তমান অলিম্পিকে উদ্বাস্তু টিমের অংশগ্রহণের বিষয়টি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু পরিচয়ের অন্তর্নিহিত অসহায় চরিত্র কিন্তু উদ্বাস্তু অলিম্পিক দলের পরিচয়ের সাথে মেলে না; বরং তার মধ্যে রয়েছে গৌরবের বিজ্ঞাপন। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের পরিচয় কি কেবলই বিশ্বমানবতার বোধ দ্বারা প্রভাবিত, নাকি এর কিছু রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক পটভূমি আছে?
নব্য-উদারনৈতিক দক্ষিণপন্থার মতে জনকল্যাণের মত পরিষেবা যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের হাতে থাকার কথা তা রাষ্ট্র ব্যতিরেকেও সুষ্ঠভাবে পরিচালন সম্ভব। ক্রীড়াব্যবস্থাও জনকল্যাণের এমনই একটি দিক। তাই রাষ্ট্র না হয়েও যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া বা দক্ষিণ সুদানের উদ্বাস্তু মানুষদের অলিম্পিকে সুযোগ করে দেওয়ার ফলে অলিম্পিক কমিটির অবস্থান হয়তো সেই অর্থে রাষ্ট্রকেও ছাপিয়ে যায়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা সর্বদাই ব্যক্তির উত্থানে বাধাস্বরূপ, আবার সেখানেই অলিম্পিক কমিটির মত না-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থ পালনে ও উন্নয়নে সক্ষম। এই ভাবেই গ্লোবাল ক্যাপিটালের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের পরিসর জাতিরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাচ্ছে এবং জনকল্যাণ ক্রমশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আন্তর্জাতিক বিষয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রের (তৃতীয় বিশ্বের) কার্যকারিতার দিকে যে প্রশ্ন ধেয়ে আসে তা উদ্বেগের। অলিম্পিকের মঞ্চে বাস্তুচ্যুত খেলোয়াড়দের দলের মিছিল হয়তো এই প্রশ্নটিরই প্রতীকী সংস্করণ। গোটা দল কোন রাষ্ট্রের পতাকার সাথে না হেঁটে অলিম্পিকের পতাকা তলে সমবেত হল। টোকিওর রঙিন সহমর্মী উচ্ছ্বাসের রঙ্গমঞ্চে বাস্তুচ্যুতদের দলের নাম রাখা হল ফরাসি ভাষায়। ইঙ্গিত স্পষ্ট- তৃতীয় বিশ্বের ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা খেলোয়াড়দের জনকল্যাণমূলক পরিকাঠামো দিতে অক্ষম এবং তা দিচ্ছে স্পষ্টতই পশ্চিমী আন্তর্জাতিক সংস্থা। এনিয়ে ভীতি হয়তো নেহাতই তাত্ত্বিক সিঁদুরে মেঘ! কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের ঘর পোড়া গরুরা জানে 'অত্যাচারী' রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমী বহুত্ববাদী গণতন্ত্রসমূহের 'স্বাধীনতা' রক্ষার্থে তেড়ে আসার ঐতিহাসিক নজিরও তো কম নয়! তাই প্রশ্ন রয়েই যায় যে রাষ্ট্রহীনতার এই উচ্ছ্বসিত উদযাপন কতখানি উদ্বাস্তুদের নিজস্ব মনোনয়ন, আর কতখানিই বা আশ্রয়দাতা কর্তৃক আরোপিত পরিচয়। প্রশ্নটি ওঠে যখন রিফিউজি দলের খেলোয়াড় তোচালিনি লুউ গ্যাব্রিয়েসোস নিজেকে আশ্রয়দাতা ইজরাইলের নাগরিক ভাবতেই আগ্রহী হন। কিন্তু ইজরাইল কি এরাট্রিয়া থেকে আসা এই উদ্বাস্তু খেলোয়াড়কে গ্রহণ করবে? বিশেষ করে যখন নাগরিকত্ব এখনো একটি মূলত: জন্মসূত্র-জাত পরিচয় সেখানে রাষ্ট্রহীনতার উদযাপন করলে কি সমস্যার সমাধান হবে? নাকি আশ্রয়দাতার আরোপিত পরিচয়ের তলায় বাস্তুচ্যুতের সমস্যা চাপা পরে যাবে? নাকি পশ্চিমী সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের 'উদারনৈতিক' দানের চাপে অপশ্চিমী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত আসবে? তবে এ সকল প্রশ্নের মাঝে আরো বড় প্রশ্নটি জেগে থাকে। ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যকার জীবনসংকট ও আশ্রয়দাতার কৃতজ্ঞতাপাশে মতপ্রকাশের বন্ধনের মধ্যে দুটিই কি সমস্যা নয়? হয়তো, কিন্তু দ্বিতীয়টি 'লেসার ইভিল'।
আসলে প্রশ্নটি ওঠার জায়গা ও রয়েছে অনেক। একটি প্রতিবেদনে জানা যায় রিফিউজি দলের দৌড়বিদদের মধ্যে ছয়জন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চাননি কারণ তাঁদের দলের নিজস্ব কাঠামোগত চরিত্র তাঁদের যথাযথ স্বাধীনতা দিচ্ছেন না। বিতর্কের শুরু হয় দক্ষিণ সুদান থেকে বাস্তুচ্যুত দৌড়বিদ দমিনিক লোকিনয়োমো লোবালু সুইস দৌড় প্রতিযোগিতায় জেতার পর পুরস্কারের অর্থমূল্য না পাওয়া নিয়ে। সাক্ষাতকারে লোবালু জানান দলের কর্মকর্তাদের ভাবভঙ্গিই হল যে দলের প্রতিযোগীরা যেহেতু উদ্বাস্তু তাই তাদের পুরস্কার অর্থ বা অন্যান্য বিষয়ে কথা বলার অধিকার নেই। যদিও এই সকল দৌড়বিদদের অলিম্পিক কর্তৃপক্ষের তরফে ভাতা বাবদ একশ ডলার করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে লোবালু সহ অন্যদের কথায় দেওয়া হত মাত্র সাতচল্লিশ ডলার। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির রিফিউজি প্রোগ্রামের মূলকর্ত্রী লোরুপে উত্তরে বলেন যে এই কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য হল বাকিদের জন্য আশার প্রতীক হয়ে উঠতে পারা; অর্থ এখানে মুখ্য নয়। ‘আশার ছলনে’ ভুলে বাস্তুচ্যুত খেলোয়াড়েরা ফল লাভের কথা ভাববেন কি! ফলের আশা না করে কর্ম করে যাওয়াটাই দস্তুর। ডেপুটি চিফ অলিভার নিয়ামকির কথায় আশ্রয়দাতার অহংবোধ স্পষ্ট। তিনি জানান যে খেলোয়াড়দের বোঝা উচিত রিফিউজি দলের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য কোন পতাকাই নেই। কথাটিকে একটু সাজিয়ে নিলেই হয় যে বাস্তুচ্যুতদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এটাই যথেষ্ট তাই তাদের অনুযোগের অধিকার থাকে কী করে! অর্থাৎ হয় প্রদত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ কর বা কাকুমার উদ্বাস্তু শিবিরে ফেরত যাও। 'Savior's Complex' কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের রয়েছে তাই নয়, বরং তা কেনিয়া পরিচালিত গোটা রিফিউজি দলের বিষয়টির সাথেও জড়িয়ে রয়েছে। অত্যাচারী যেমন অত্যাচারিতের মতের অপেক্ষা করে না; রক্ষাকর্তাও অনুগ্রহপ্রার্থীর মতের আশায় থাকে না। দ্বিতীয়টিও উদারনৈতিক মোড়কের আড়ালে একপ্রকার অবমানবয়ন প্রক্রিয়া। তাই হয়তো লোবালুর মত খেলোয়াড়দের সমস্যাটি 'বড়কথা' নয় কারণ উদ্বাস্তু দল গঠনের মত এত বড় কর্মকাণ্ডে এরকম দু-একটি সামান্য ব্যাপার হয়েই থাকে। বিশেষ করে লোবালুরা যখন সমগ্র বাস্তুচ্যুতদের কাছে একটি প্রতীক, তখন সেই প্রতীক হওয়ার কিছু বিড়ম্বনার স্বাদ তো তাঁদের নিতেই হবে।
অবশ্য সবথেকে উজ্জ্বল প্রদীপের নীচেই অন্ধকার থাকে বেশি। ইংল্যান্ড ইউরো কাপের ফাইনালে টাইব্রেকারে হারার পর জাতিবিদ্বেষমূলক আক্রমণের শিকার হন পেনাল্টি মিস করা তিন অশ্বেতাঙ্গ ফুটবলার রাশফোর্ড, সাঙ্কো, ও শাকা। ফ্রান্সের মত পরিযায়ী খেলোয়াড়ে ভরা বহুত্ববাদী দলেও সমস্যাটি যে নেই তা নয়। ক্রীড়া সাংবাদিক শিরিন আহমেদ ফরাসি দল প্রসঙ্গেই বলেছেন যে যখন সাফল্য আসে সকল পরিযায়ী খেলোয়াড় যত দ্রুত 'ফরাসি' হয়ে যায়, অসাফল্যের সাথে সাথেই তাদের অপাংক্তেয় উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়না। ভারোত্তোলনে রুপো জয়ী মীরাবাঈ চানুর কথাতেও কি একই অনুরণন দেখি না? তাই 'উদ্বাস্তু' বা 'পরিযায়ী' শব্দগুলিকে নিয়ে পশ্চিমী উদারনৈতিক বহুত্ববাদী আত্মরতির উদযাপন কতখানি রাষ্ট্রহীনতার অসহায়তাকে প্রলেপ দিতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।