করোনাকালের দু’টো ঢেউয়ের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বা মৃতের সংখ্যার কোনো মিল না থাকলেও, একটা মিল আপনি খুজে পাবেন, সেটা হল – মদের দোকানের দীর্ঘ লাইন, আর তা নিয়ে গণমাধ্যমের কৌতুক আর ছিছিক্কার। এই গেল-গেল রবের মূল চালিকা-শক্তিই হল বাঙালির শতাব্দী-লালিত নৈতিকতা। কিন্তু এহেন নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা বাঙালি, মদ্যপান নিয়ে ছুঁতমার্গ চালিয়ে গেলেও, বিহার বা গুজরাটের মত ‘non-liquor state’ ঘোষণা করতে পারেনি, আবার অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলেঙ্গানার মত মদ্যপানের সংস্কৃতিকে সহজও করতে পারেনি। বাঙালির সাথে মদ্যের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের; সেখানে মদ্যপকে নিয়ে কৌতুক-মিশ্রিত লঘুরস ও নীতিবাগিশের শুচিবায়ু যেমন আছে, ‘দেবদাস’-দের নিয়ে রোম্যান্টিকতাও আছে। তাই করোনা-কালে মদের লাইন ও কৌতুকময় আশঙ্কার মাঝে এক দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের সমান্তরাল বহমানতা রয়েছে, তার মাঝের দূরত্বটি নাগরিক সমাজের জাতি ও শ্রেণিগত দূরত্বের সমানুপাতিক।
এই মদ্যপান নিয়ে বাঙালির নৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বড় পুরাতন। মূলধারার সাথে অস্ফুট লোকাচারের পার্থক্য তো ছিলই; কিন্তু মূল সুর ছিল সহাবস্থানের। কথিত আছে, একবার শাক্ত সাধক কমলাকান্তকে মদ্যপান করতে দেখলে, বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র তিরস্কার করেন। প্রত্যুত্তরে মাতৃভক্ত কমলাকান্ত মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করে সেই দুধে দেবীপ্রতিমার পূজা করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতিভূ তেজচন্দ্রের কাছে যা অনৈতিক, সাধক কমলাকান্তের কাছে তা নয়। ভারতীয় লোকাচারের ঊর্ধ্বে থাকা সাধক সামাজিক নিয়মনীতির অধীন নন। কমলাকান্তের মতই, সাধক রামপ্রসাদও মদ্যপান করতেন। পণ্ডিতসমাজের প্রধান কুমারহট্ট এ নিয়ে তাঁকে তিরস্কার করলে, রামপ্রসাদ বলতেন, “সুরাপান করিনা আমি / সুধা খাই জয় কালী বলে”। কিন্তু সব প্রেমিক যেমন দেবদাস নয়, সকল মদ্যপই রামপ্রসাদ নয়। শাক্তমতে গুহ্যসাধন-ক্রিয়ায় মদ্যপানের যে রীতি, তা প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ না হওয়াটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘প্রাত্যহিক জীবন’ তো কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়, বরং তা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। একদিকে প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় উচ্চবর্গ যেমন পারতপক্ষে মদ্যপান এড়িয়ে চলেছে, মঙ্গলকাব্যের অন্ত্যজ শ্রেণি অবশ্য শুঁড়িখানায় ক্রমাগত ভিড় জমিয়ে গেছে। তাই মদের বিচারেই বাঙালি অনেক আগেই ‘আমরা-ওরা’-র ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছে। অর্থাৎ ধর্মকেন্দ্রিক মদ্যপান যেমন ছিল, তেমনই ছিল ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার প্রভাবে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা; কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ছিল জাতিগত। আদি বঙ্গজীবনে সামাজিক লোকাচারের নোটবুক-সুলভ গ্রন্থ ছিল স্মৃতিশাস্ত্র। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’, স্মার্ত রঘুনন্দনের ‘অষ্টবিংশতি তত্ত্ব’ প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ, প্রাচীন দুর্গাপূজায় অবাধ মদ্যপানের আচারের কথা বলেছেন। আবার ভবদেবভট্ট তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ’-এ ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলের জন্যই মদ্যপান নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। তবে কুমারহট্ট-রামপ্রসাদের দ্বন্দ্ব দেখে বোঝা যায় উচ্চবর্ণে মদ্যপান ছিল গৌণ গুহ্যধর্মাচারের বিষয় আর অব্রাহ্মণের মদ্যপান ছিল প্রাত্যহিক লোকাচারমূলক। যা হোক, মোট কথায়, ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য কলিযুগে ব্রাহ্মণ ছাড়া সকলকে শূদ্র বলে ঘোষণাই করে দিলেন আর মদিরাচার পক্ষান্তরে পরিণত হল শূদ্রাচারে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, যে সমাজে বাস করে না – সে হয় দেবতা, নয় পশু; কুমারহট্টদের ভাষায় তা হয়ে দাঁড়াল, যে মদ্যপান করে – সে হয় সাধক, না হয় শূদ্র।। ব্রাহ্মণের মদ্যপান যে লোকাচারবিরুদ্ধ, তা জানা যায় অতীব পরিচিত শ্লেষ-বক্রোক্তিতে;-
অবশ্যই করতে পারেন। ইমেল আই ডি দিলাম।
aryama.foucault.ghosh@gmail.com