এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বইবৈভব

  • বইবৈভব - ৪; ফিরে আসি, ফিরে যাই ‘রক্তকরবী’-তে

    শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
    পড়াবই | বইবৈভব | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ | ৫৯৫৯ বার পঠিত

  • রক্তকরবী। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রচ্ছদ: যক্ষপুরীর রাজপ্রাসাদের জালাবরণ। চিত্রশিল্পী: শ্রী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পাদক: রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৩১


    The Red Oleanders by Rabindranath. The Visva-Bharati Quarterly. Illustrations by Gaganendranath Tagore.


    রক্তকরবী নিয়ে নতুন চিন্তা। সম্পাদক : পাপিয়া রায়। প্রচ্ছদ: চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুর। মিরান্দা। মুদ্রিত মূল্য:১৫০ টাকা

    ক্ল্যাসিক-এর অনেক সংজ্ঞার মধ্যে একটি কথায় হোক, রঙে-রেখায় হোক, সুরে হোক, যে শিল্পকীর্তির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়, আর যতবারই ফিরে আসা যাক না কেন, নিজের জীবনকাণ্ডের অভিজ্ঞতায়, ইতিহাসের ক্রমানুবর্তিতায় তা নব ব্যঞ্জনায় চরিতার্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-র কাছে ফিরে এসেছি অনেকবার।



    রক্তকরবীর পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্ঠা

    শেষবার এসেছিলাম ২০০৩ সালে—আমার এক ছাত্রী-বান্ধবীকে প্ররোচিত করেছিলাম তার ক্ষীণতনু, ক্ষীণজীবী পত্রিকা ‘মিরান্দা’-র পৃথুল সচিত্র সংখ্যা প্রকাশ করতে, ‘রক্তকরবী’ নিয়ে নতুন চিন্তা বহন করে। প্রণয়কুমার কুণ্ডু তখন সদ্য তাঁর ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ পাঠভেদ-সংবলিত ‘রক্তকরবী’ প্রকাশ করেছেন। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। দশটি স্বতন্ত্র পাণ্ডুলিপিতে যে কতবার কত ভাবে নাটকটি রূপান্তরিত হয়েছে, তার সযত্ন সনিপুণ বয়ানে প্রণয়বাবু খুলে ধরেছেন একটি ক্ল্যাসিক রচনার ইতিহাস, ধরিয়ে দিয়েছেন আধুনিক সভ্যতার চরিত্রায়ণে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে তার জটিলতাকে ধারণ করতে চেয়েছেন। তাঁর এই চমৎকার সম্পাদকীয় অবদান থেকেই ‘রক্তকরবী’র কাছে ফিরে আসবার তাগিদ অনুভব করেছিলাম। তরুণী সম্পাদিকা পাপিয়া রায়ের অধ্যবসায়ে ও নাছোড়বান্দা তাগাদায় এই সংখ্যায় শেষ পর্যন্ত লিখেছিলেন প্রণয়কুমার কুণ্ডু, প্রশান্তকুমার পাল, অশোক মিত্র, সৌরীন ভট্টাচার্য, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, সুতপা ভট্টাচার্য, জ্যোতিভূষণ চাকী, প্রভাতকুমার দাস, দেবাশীষ রায়চৌধুরী, শুভেন্দু সরকার, ধীরানন্দ রায়।

    ‘রক্তকরবী’র অনুপ্রেরণায় ছবি এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন, শ্যামল দত্ত রায়, প্রকাশ কর্মকার, রবীন মণ্ডল, বিজন চৌধুরী, হিরণ মিত্র, ঈশা মহম্মদ, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, ওয়াসিম কাপুর, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা ভট্টাচার্য, শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী, ‘রক্তকরবী’র নাট্যাভিনয়ের প্রাপ্তি, পরীক্ষা ও সমস্যা বিষয়ে লিখেছিলেন থিয়েটারের প্রবীণ ও তরুণ নির্মাতা কুমার রায়, বিশাখা রায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, শিব মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় (শুভাশিস পরে দৃষ্টিহীন শিল্পীদের নিয়ে ‘রক্তকরবী’র একটি অসামান্য প্রযোজনা তৈরি করেছিলেন)। মণিপুরের রতন থিয়াম তাঁর নিজস্ব নাট্যভাবনাকে রূপ দিয়েছিলেন একটি রেখাচিত্রে।





    ‘রক্তকরবী’র অনুপ্রেরণায় কবিতা লিখেছিলেন রাম বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন, অমিতাভ দাশগুপ্ত, মণিভূষণ ভট্টাচার্য। আমারও একটি নিবন্ধ ছিল; তার কথায় পরে আসব।

    অশোক মিত্র লিখলেন, “রঞ্জনের মৃতদেহ দর্শনে নন্দিনীর উদ্‌ভ্রান্ত কাতর চিৎকার আকাশকে খানখান করে। কিন্তু নন্দিনী সেই চিৎকারে থেমে থাকেনি। সে মনস্থির করে, সে যোগ দিয়েছে ছোটো মানুষের মিছিলে। রাজার আড়কাঠি-এঁটোদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। যে রাজা তার বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, যে রাজা তাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি, সেই রাজার সাম্রাজ্যকে এবার ভেঙে টুকরো টুকরো করতে হবে।... শেষ পর্যন্ত আমরা নন্দিনীকে পাই সৌন্দর্যের শোভাযাত্রা সমারোহের মধ্যমণি হিসেবে। মিছিল এগিয়ে চলে, যেমন ইতিহাস এগিয়ে চলে। তাই বলব, ‘রক্তকরবী’ নাটক কোনো দূরবর্তী তারকার গা-ঘেঁষা রূপকের নয় বরঞ্চ মাটির পৃথিবীতে, আমাদের চারপাশে, আমাদের জড়িয়ে যা ঘটছে, তার অতি বিশ্বস্ত প্রতিরূপ।” লেখার শেষে অশোকবাবু বহুরূপীর ঐতিহাসিক ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনাকে আমাদের ইদানীন্তনকালের ‘রক্তকরবী’ পাঠের ‘প্রাঞ্জল উত্তরণে উপনীত হওয়ার অন্যতম সহায়’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, শম্ভুবাবু, “গণনাট্য সংঘ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু গণনাট্যের প্রেরণাগত রেশটুকু থেকে গেছে, তার প্রমাণ ‘রক্তকরবী’। যে সত্যের সারাৎসার গণনাট্যের প্রাঙ্গণে শম্ভু মিত্র আহরণ করে আনলেন, তাই কিন্তু আমাদের উপলব্ধিকে সম্পূর্ণ করতে গভীর সাহায্য করে।”

    ১৯৫৪ সালে বহুরূপীর সেই প্রযোজনা যা রূপক-রূপকথার আড়াল কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটককে সমকালীন তথা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত দিয়েছিল, তাকে ঘিরে বিশ্বভারতী ও তৎকালীন পত্রপত্রিকার বিশ্রি প্রতিরোধের কাহিনি এই সংকলনের একাধিক রচনায় সবিস্তারে (তখনকার লেখালেখির দীর্ঘ উদ্ধৃতিসহ) নথিবদ্ধ। ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪, তৃতীয় অভিনয় শেষে অধ্যাপকের সজ্জায়, মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে বহুরূপীর সভাপতি গঙ্গাপদ বসু ‘পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তাঁদের নিরুপায় পরিস্থিতির উল্লেখের পর সেদিনের অভিনয়কেই সম্ভবত ‘রক্তকরবী’র শেষ অভিনয় হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য’ হন। তথ্যসংগ্রহ ও তা যাচাই করে পরিবেশনায় সুদক্ষ প্রভাতকুমার দাস এই অচলায়তনী সেন্সরশিপ-এর দুষ্টগ্রহ থেকে বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’র মুক্তির বিবরণ দিয়েছেন। সেই কাহিনির একটি অধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে আছে। সেই অধ্যায়টির আরও বিস্তারিত বিবরণ শুনেছিলাম শম্ভু মিত্রের মুখে।

    ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ দিল্লিতে আইফ্যাক্‌স্‌ প্রেক্ষাগৃহে ‘রক্তকরবী’র এক অভিনয়ানুষ্ঠানে জওহরলাল নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে দর্শক রূপে আমন্ত্রণ জানানো হলে নেহরু আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জানিয়ে দেন, তিনি টিকিট কেটে আসবেন; বইটি সংগ্রহ করে পড়েও নেন তিনি। নির্ধারিত দিনে লোকসভায় তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনার কারণে তাঁর দশ মিনিট দেরি হবে বুঝতে পেরে তিনি প্রেক্ষাগৃহের কর্মকর্তাদের ফোন করে জানিয়ে দেন (তিনি নাট্য সম্প্রদায়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নটনটীদের কোনোভাবে বিরক্ত করতে চাননি) যে, অভিনয় শুরু করতে তাঁর অপেক্ষায় যেন এক মিনিটও দেরি না করা হয়, তাঁর বিলম্বিত প্রবেশে দর্শকদের অসুবিধা লাঘব করতে তিনি অনুরোধ করেন যে তৃতীয় সারিতে ‘আইল’-এর ধারে যেন তাঁদের আসন নির্দিষ্ট থাকে।

    এই বিবরণ শম্ভু মিত্রের মুখে শোনা। গঙ্গাপদ বসু তাঁর লেখায় যোগ করেন, “তিনি অভিনয় আরম্ভ হয়েছে জেনে খুশি হয়ে বসলেন। তারপর মুহূর্তের মধ্যে সারাদিনের কূট তর্ক, উত্তেজনা, ক্লান্তি সব ভুলে গিয়ে অভিনয়ের মধ্যে তন্ময় হয়ে ডুবে গেলেন—কখনও হাসছেন, কখনও চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে, কখনও-বা শিশুর মতো আনন্দে হাততালি দিচ্ছেন।” একদিক থেকে ঘটনাটা ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তখনও সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রপরম্পরার এই মর্যাদা ছিল, আজ যা দেশের তাবৎ মন্ত্রীকুলের কাছে কল্পনাতীত।

    পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটি পরে গ্রন্থাকারে পুনর্মুদ্রিত হয় ‘রক্তকরবী নিয়ে নতুন চিন্তা’ (২০০৬) নামে; অচিরেই নিঃশেষিত হয়ে হারিয়ে যায়। এত বিভিন্ন দৃষ্টি থেকে বিচারিত ‘রক্তকরবী’র বিচিত্র ভাষ্যগুলির মধ্যে ফিরে পড়তে গিয়ে এখন আমায় অন্তত যা সবচেয়ে সম্মোহিত করে তা হল মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘শবাসীন উপনিবেশ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের নাটকেরই যেন আর-এক নাট্যবিন্যাস, পাশাপাশি কয়েকটি কক্ষের সমাবেশে কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে যাওয়ার মধ্যে এক সমাজোত্তরণের অমোঘ পরিক্রমা—“রঞ্জনের মৃতস্তূপের উপর দিন ও রাত্রির সন্ধিপর্ব মন্থন করে জেগে ওঠে মহাকালপরিসীমা, তারপর অনন্ত সংঘর্ষের কাল, সাজানো ছকের ভিতরে বর্ণগুচ্ছকে তোলপাড় করে চরাচর, চাপা প্লাবন হয়ে ওঠে,

    যন্ত্রযন্ত্রণা স্বর্ণ অধিপতি, মানবী কলরবে সংজ্ঞাহীন
    অশেষ ভূমিঘাতে অগ্নিবিনিময়ে করোটি প্রহরের প্রহর গ্রাস...”

    ওই লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিন-এর পাতা ছেড়ে এবার যে ‘রক্তকরবী’-তে ফিরে আসছি, তা ধারণ করে আছে দুটি বই, আমার বইবৈভব সংগ্রহের সম্পদ, আবার বাবার সংগ্রহ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আমার অধিকারে—প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন রেশমে বাঁধাই, ধারে ও চার কোণায় চামড়ার ফালি যথাক্রমে ‘The Visva-Bharati Quarterly’ ও প্রবাসী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ ‘রেড ওলিঅ্যানডার্স’ ও ‘রক্তকরবী’ ক্রোড়পত্র। ‘রেড ওলিঅ্যানডার্স’-এর আমার সংগ্রহান্তর্গত বাঁধানো বইটিতে প্রচ্ছদে বাঁয়ে গাঢ় কালো জমি বিদীর্ণ করে সাদা ফালি ও সাদা-কালোয় জালির বুনটের বিন্যাসের মধ্যে থেকে ফুটে ওঠে জাপানি বহু পরতের বস্ত্র সম্ভারে সাড়ম্বরে সজ্জিত উদ্ধত এক রাজন্যমূর্তি। তার ডান দিকে লাল অক্ষরে ‘Red Oleanders by Rabindranath’, তার নীচে Illustrations by Gaganendranath Tagore। পৃষ্ঠার উলটো পিঠে To L K Elmhirst। মুখোমুখি পৃষ্ঠাটি সাদা আর্ট প্লেট। তার উলটো পিঠে, অর্থাৎ বইয়ের বাঁদিকে গগনেন্দ্রনাথের বহু বর্ণ চিত্রে বিভিন্ন উঁচুনীচু অসম স্তরে সারি সারি ঝুলন্ত বারান্দার পৃষ্ঠপটে মাটি থেকে ঊর্ধ্বমুখী বহুধাপ্রসারিত রক্তকরবীর গাছ—গাঢ় বাদামি-খয়েরি পৃষ্ঠভূমিকে রঙের দোলায়িত উচ্ছ্বাসে যেন স্পন্দিত করে তোলে।



    তার মুখোমুখি পৃষ্ঠায় নাটক শুরু হয়ে যায়।

    নাটকের নামের নীচেই প্রথম বক্র নির্দেশ, তার নীচেই সাদা-কালোয় গগনেন্দ্রনাথের একটি ছবি—উদ্ধত দাপুটে স্তম্ভ প্রাচীর যেন দুদিক থেকে অবরোধ সৃষ্টি করে ঝুঁকে পড়ছে ছবির কেন্দ্রবর্তিনী এক নারীর উপর; স্তম্ভগুলি দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক, তার এক তল সাদা, আর-এক তল কালো, আর-এক তল জাল।



    ইংরেজি নাটকের শুরু ‘রক্তকরবী’-র দশম বা একাদশ ভাষ্যের মতো নয়। কিশোরের ‘নন্দিনী! নন্দিনী! নন্দিনী!’ ডাক এখানে নেই। কিশোর জিজ্ঞেস করে, “তোমার যথেষ্ট ফুল আছে, নন্দিনী? দেখ, তোমার জন্য আমি আরও কিছু ফুল এনেছি।” উদ্‌বিগ্ন নন্দিনী সত্রাসে বলে, “ছুটে পালা, কিশোর, কাজে ফিরে যা, শিগ্‌গির! তোর আবার দেরি হয়ে যাবে।” তারপর ফিরে আসে ‘রক্তকরবী’র পরিচিত সংলাপ—কিশোরের তেজি আবদার!

    ইংরেজি ‘রক্তকরবী’ ও বাংলা ‘রক্তকরবী’র প্রকাশ একযোগেই—দুই পত্রিকারই আশ্বিন ১৩৩১ ব. তথা সেপ্টেম্বর ১৯২৪ সংখ্যায়। ‘প্রবাসী’-র আর্ট পেপারে আখ্যাপত্রে সব লেখাই লাল হরফে—একেবারে উপরে ‘রক্তকরবী’, তার নীচে ‘শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, তার নীচে কার্যত পাতা জোড়া ছবি সাদা-কালোয়, আকাশচুম্বী ইমারতের সারি সারি সমাবেশের উপরে জালের বিন্যাস, নীচে ভূমিপট থেকে মাথা তুলেছে লাল রক্তকরবীর ক-টি ডাঁটি, ছবির দক্ষিণ প্রান্তে (Red Oleanders-এর মতো ছবি জোড়া উচ্ছ্বাস নেই সেই গুচ্ছের)। তার নীচে ছোটো হরফে বর্ণনা: ‘যক্ষপুরীর রাজপ্রাসাদের জালাবরণ। চিত্রশিল্পী—শ্রী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ তার নীচে আরও বড়ো হরফে ‘আশ্বিন প্রবাসী ১৩৩১’।
    আর্ট পেপারে মুদ্রিত এই আখ্যাপত্রের উলটো পিঠে উপরে-নীচে রবীন্দ্রনাথের দুটি আলোকচিত্র। তার সঙ্গে একটি বিজ্ঞাপন:

    রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে স্বাক্ষরিত ফোটোগ্রাফ

    কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎকৃষ্ট ব্রোমাইড ফোটো (এই সঙ্গে ছাপা ছবির মতো) প্রত্যেক খানি তাঁহার নিজহস্তে ইংরেজি অথবা বাংলায় স্বাক্ষরিত। সিপিয়া ফিনিশ, ফুল প্লেট সাইজ (প্রায় প্রবাসীর সমান) ৮" × ৬" অতি সুন্দর রূপে মাউন্ট করা।

    বিক্রয়ের লভ্যাংশ শান্তিনিকেতন পিয়ার্সন মেমোরিয়্যাল হাসপাতালে যাইবে। মূল্য প্রত্যেকখানি ১৫ টাকা। এক-তৃতীয়াংশ অগ্রিম পাঠাইলে ভিঃপিঃতে পাঠানো যাইতে পারে। অতি নির্দিষ্ট সংখ্যক ছবিই মাত্র পাওয়া যাইবে।

    কার এন্ড্‌ মহলানবিশ
    ১-২ চৌরঙ্গী রোড
    কলিকাতা


    তারপর ডানদিকের পৃষ্ঠায় নাটক শুরু। প্রায় দু-বছর পর ১৩৩৩ ব./ডিসেম্বর ১৯২৬ ‘রক্তকরবী’র গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশে দেখা যায়, ‘প্রবাসী’-র পাঠে ফাগুলাল-চন্দ্রা-বিশু-র সংলাপে খানিকটা অংশ বাদ পড়ে গেছিল। প্রশান্ত কুমার পালের ‘রবিজীবনী’, নবম খণ্ডে (কলকাতা: আনন্দ ২০০০, পৃষ্ঠা ১৫৫) জীবনীকার লিখেছেন, ‘প্রবাসী’-তে “মুদ্রণের বিভিন্ন প্রমাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরক্তি প্রকাশ করেন। এই বিষয়ে রথীন্দ্রনাথ লেখেন: “‘রক্তকরবী’র একটা corrected কপি তোমার কাছ পাঠাচ্ছি—এটা তোমারই কাছে carefully রেখে দিও। যখন বই ছাপানো হবে তখন দরকার হবে। ... ‘রক্তকরবী’-তে মাঝে এক জায়গায় কথাবার্ত্তার উলোটপালট কিছু হয়ে গেছে। বাবা বল্লেন তাঁর কাছে mss. নেই বলে correction করতে পারলেন না। ইংরেজি ‘Red Oleanders’-এর ২১ ও ২২ নং পাতায় যে কথাবার্ত্তা আছে সেইটাই ঠিক—বাংলাটা তার সঙ্গে তুলনা করে দেখে রেখো।” কাকে লেখা এই চিঠি, প্রশান্ত কুমার বলেননি; অনুমান করছি, তখন বিশ্বভারতীর প্রকাশক কিশোরীমোহন সাঁত্রাকে।


    রবীন্দ্রনাথ অন্তত চারবার সবিস্তারে ‘রক্তকরবী’ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। চারটির বয়ান পাওয়া যায়: বর্তমানে প্রচলিত সংস্করণে ‘প্রস্তাবনা’ নামে অন্তর্গত ১৩৩১ ব. লিখিত কবির একটি অভিভাষণ (প্রথম প্রবাস, ‘প্রবাসী’, বৈশাখ, ১৩৩২ ব. ; ১২৫তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ অষ্টম খণ্ডের ‘গ্রন্থ পরিচয়’ বিভাগের অন্তর্গত); ওই খণ্ডে নাটকের সূচনায় ‘নাট্যপরিচয়’, রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত ‘রক্তকরবী’ পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত; ‘Red Oleanders/Author’s Interpretation’, প্রথম প্রকাশ—‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’ পত্রিকায় নভেম্বর ১৯৫১—জানুয়ারি ১৯৫২ সংখ্যায়, সঙ্গে টীকা; আর্জেন্টিনায় নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্রি. একটি আলোচনা থেকে লেনার্ড কে এলন্‌হার্ট্‌স্‌ কর্তৃক অনুলিখিত, নিত্যপ্রিয় ঘোষ সম্পাদিত ‘English Writings of Tagore, New Delhi, Sahitya Akademi 2007, Vol. 4, pp 333ff-র অন্তর্গত; ‘Red Oleanders: Author’s Interpretation’, প্রথম প্রকাশ: ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, ২৮ আগস্ট ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ, চিঠিতে স্বাক্ষরিত তারিখ ৫ আগস্ট ১৯২৫, ‘English Writings of Tagore’ Vol. 4-এ অন্তর্গত।
    দশবার লিখন-পুনর্লিখন করেছেন। কোনোরকমে শেষ করেই নিজে সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাসী পাঠকদের জন্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, গগনেন্দ্রনাথকে দিয়ে তাঁর অভ্যস্ত অন্তর্ভেদী দ্যোতনাময় এক্‌স্‌প্রেশনিস্ট চিত্রভাষায় চিত্রিত করিয়েছেন, তবুও তাঁর সংশয় যায় না, আরও ব্যাখ্যা আরও বিশ্লেষণে যেন নিশ্চিত করতে চান, তাঁর ভাবনার—না কি দুঃস্বপ্নের বার্তা যেন দেশবিদেশে তাঁর সমূহ পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়। এই ভাবনাটা তাঁর মনে দানা বেঁধেছে বিংশ শতাব্দীর সূচনা মুহূর্তে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও চোদ্দো বছর আগে—‘নৈবেদ্য’-র সেই রোমাঞ্চকর উচ্চারণে:

    স্বার্থ যত পূর্ণ হয় লোভ ক্ষুধানল
    তত তার বেড়ে ওঠে বিশ্বধরাতল
    আপনার খাদ্য বলি না করি বিচার
    জঠরে পুরিতে চায়। বীভৎস আহার
    বীভৎস ক্ষুধারে করে নির্দয় নিলাজ—
    তখন গর্জিয়া নামে তব রুদ্র বাজ।
    ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে
    বাহি স্বার্থতরী, গুপ্ত পর্বতের পানে।

    ‘শতাব্দীর সূর্য’ যখন ‘রক্তমেঘ-মাঝে অস্ত’ গেছে, তখনই রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন ধনতান্ত্রিক ‘লোভ’-এর গভীর থেকে উৎসারিত এই ‘হিংসার উৎসব’ যাতে “দায়হীন সভ্যতানাগিনী/তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে/গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।” সভ্যতারই অন্তর থেকে বর্বরতার এই উত্থান তথা সভ্যতারই সংকট রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণ করে গেছেন, পরতে পরতে তাকে উন্মোচন করেছেন প্রথমে ‘ন্যাশনালিজ্‌ম্‌’ নামে ভাষণগুচ্ছে, তারপর ‘রক্তকরবী’ নাটকে, তারপর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে লেখা ‘ধ্বংস’ নামে সেই অমোঘ গল্পে ও তার পরিপূরক কবিতায় ‘কলবলসম্বল সিভিলাইজেশন’-এর তীব্র সমালোচনায় ও সবশেষে ‘সভ্যতার সংকট’-এর চূড়ান্ত উচ্চারণে।

    ‘রক্তকরবী’-র চার চারটি ব্যাখ্যামূলক বিবৃতিতে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেন, ধনতন্ত্র আর অন্তহীন লোভকে চরিতার্থ করতে কীভাবে বিজ্ঞান, ধর্ম, শাসন প্রক্রিয়া, বিদ্যাশিক্ষা সবকিছুকে তার ‘কলবল’ মাত্রে পরিণত করে। দুই বিশ্বযুদ্ধের এই অন্তর্বর্তী পর্বে পশ্চিম ভূখণ্ডে চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে, থিয়েটারে এক্‌স্‌প্রেশনিস্ট চিত্রভাষার বিস্ফোরক উদ্‌ভাসে মানবতার উপর ধনতন্ত্রের এই নৃশংস সর্বত্র বিস্তারী আক্রমণই চিহ্নিত হয়। আমার দুর্বল অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “লোভের অভ্যাস—বস্তুর জন্য, ক্ষমতার জন্য, তথ্যের জন্য লোভ; মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে সেই লোভ যতরকম জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, তা-ই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মানুষে মানুষে সহানুভূতি, প্রতিবেশিতা, সাহচর্য, প্রেম, যে বিস্ফোরক শক্তিকে আমরা এক কথায় ভালো বলি, তারই বিরুদ্ধে। ভালোকে দাঁড়াতে হয়েছে ধনদানবের অমানবিকী শক্তি, স্বার্থপরতা, অশুভ, মানুষে মানুষে বিরোধ সৃষ্টিতে নিয়োজিত যাবতীয় শক্তির বিরুদ্ধে, কারণ... যা কিছু আমাদের বিভাজিত করে, তা-ই মিথ্যা, অসত্য।” (আর্জেন্টিনায় নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্রি. একটি আলোচনা থেকে লেনার্ড কে এলন্‌হার্ট্‌স্‌ কর্তৃক অনুলিখিত, নিত্যপ্রিয় ঘোষ সম্পাদিত ‘English Writings of Tagore, New Delhi, Sahitya Akademi 2007, Vol. 4, pp 333ff)।

    ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরীকে শুধু এই লোভেরই নির্মাণ বলে ক্ষান্ত হন না রবীন্দ্রনাথ বরং ‘বিপুল সঞ্চয়ের ভার’ সৃষ্টি করতে মাটি, মানবচরিত্র, মানবসম্পর্ক, মানুষের কামনা-বাসনা, মানুষের শ্রম, মাটির গভীরে নিহিত পাথর, সবই নিংড়ে, ধন নিষ্কাশনের এলাহি যে প্রক্রিয়া তিনি খুলে ধরেন, যেমন আমাদের চোখ ও বোধের সামনে তেমনই সম্প্রতি আগতা নন্দিনীর সামনে, তার শীর্ষে যে কালান্তরালবর্তী রাজা, তিনি আসলে কিন্তু বিজ্ঞানী, যে কথাটা রবীন্দ্রনাথ একবারও নাটকে কিংবা তার এতগুলি ব্যাখ্যায় একবারও সরাসরি বলেন না।

    কেন বলেন না, তা নিয়ে ভেবেছি অনেক। মানুষের জ্ঞানের সারাৎসার তথা জ্ঞানাহরণের অপরিহার্য পদ্ধতি যে বিজ্ঞান, তার মূল্য রবীন্দ্রনাথের কাছে অপরিসীম। অথচ সেই বিজ্ঞানই যে কীভাবে ধনাকাঙ্ক্ষার ধারক-বাহক-অস্ত্র হয়ে ওঠে, বিজ্ঞানীও মানবতাবিমুখ শক্তিসাধনায় নিজের ব্যক্তিগত শক্তির জয়জয়কারের নেশায় ‘বীভৎস’ হয়ে ওঠেন, তা দেখেই আতঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের গভীরেই লালিত শুভবুদ্ধি তথা শুদ্ধ জ্ঞানের পুনরভ্যুদয়েই—‘রক্তকরবী’র পরম পরিণতি সেই পুনরভ্যুদয়ে—ভরসা রাখেন। তাই বহু ইঙ্গিতে রাজাকে বিজ্ঞানী বলে চিহ্নিত করেও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ওই অভিধায় বেঁধে দেন না, বরং যেন এমন একটা বাড়তি সম্ভাবনা তথা আশঙ্কা ছুঁয়ে যান: বিজ্ঞানীর কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষার ফাউস্টীয় উড়ান কখন যে অবাধে শক্তির স্বরাট মহিমায় অনুপ্রাণিত হয়ে মানবতা তথা মানবপ্রেম পরিহার করে রাজশক্তি তথা রাষ্ট্রশক্তির ধারক হয়ে উঠতে পারে, তা যথাসময়ে ধরা নাও পড়তে পারে!

    ‘রক্তকরবী’র নিবিড় পাঠে একবার এই রাজা-বিজ্ঞানী অভিন্নতার বিষয়টি দেখে নেওয়া যাক। নাটকের ঘটনাক্রম একবার অনুসরণ করে গেলে একবারও কোথায়ও এই রাজার রাজশক্তির সরাসরি প্রয়োগের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না; বস্তুত সর্দার, মোড়ল প্রমুখ এই রাষ্ট্রের আধিকারিকদের সঙ্গে তাঁর একবারও কোনো কথালাপ নেই, আদেশ-নির্দেশ দান-পালনের কোনো প্রত্যক্ষ ঘটনাই নেই। রাজার যা-কিছু কথা-সংলাপ কেবল নন্দিনীর সঙ্গেই, প্রায় শেষে একবার ফাগুলালের সঙ্গে! রাজভূমিকায় তাঁর অচরিতার্থতার স্বীকৃতি তাঁর নিজের কথায়: “ঠকিয়েছে। আমাকে ঠকিয়েছে এরা। সর্বনাশ! আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।” সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্বীকৃতিও যে, যথার্থই শক্তিমান, মানবদ্বেষী যে-কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মাণে যেমন বিজ্ঞানের হাত আছে, বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের যুক্তিকে রাজমর্যাদায় অভিষিক্ত করাও সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মাণকর্ম; সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘বানিয়ে তোলা কাপড়েই কেউ-বা রাজা।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নৈবেদ্য’ থেকেই, বা ‘রক্তকরবী’র ব্যাখ্যায় জ্ঞানের লোভ, রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার লোভ ও বিজ্ঞানের লোভকে একই অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত করে ইঙ্গিত করেছেন, এই সমূহ লোভই তার স্বকীয় পথেই শেষ পর্যন্ত মানবতাবোধস্খলিত হয়ে ‘লোভক্ষুধানলের’ তাড়নায় ‘স্বার্থদীপ্ত লুব্ধ’, ‘নির্দয় নিলাজ’ হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানানুসন্ধিৎসা মানবতাবোধচ্যুত হয়ে ‘রক্তকরবী’র রাজার কথায় বৈনাশিক এক তীব্রতা লাভ করে, রাজা যখন নন্দিনীকে বলেন: ‘নন্দিনী, তুমি কি জানো, বিধাতা তোমাকেও রূপের মায়ার আড়ালে অপরূপ করে রেখেছেন? তার মধ্যে থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমার মুঠোর ভেতর পেতে চাচ্ছি, কিছুতেই ধরতে পারছি না। আমি তোমাকে উলটিয়ে-পালটিয়ে দেখতে চাই, না পারি তো ভেঙেচুরে ফেলতে চাই।” নন্দিনী যখন যক্ষপুরীতে বিজ্ঞান ও তারই পোষিত রাষ্ট্রযন্ত্রের বিধানে ‘খুনোখুনি কাড়াকাড়ির অভিসম্পাতে’র কথা তোলে তখন রাজার জবাব “শাপের কথা জানিনে। এ জানি যে আমরা শক্তি নিয়ে আসি। আমার শক্তিতে তুমি খুশি, ও নন্দিনী?” নন্দিনী মানে, “ভারী খুশি লাগে।” বিজ্ঞানের সহজাত শক্তির এক পিঠ তার নিপাট যুক্তিবহতার নিশ্ছিদ্র শৈলশৈলী, যাতে মুগ্ধ নন্দিনী: “অদ্ভুত তোমার শক্তি। যেদিন আমাকে তোমার ভাণ্ডারে ঢুকতে দিয়েছিলে তোমার সোনার তাল দেখে কিছু আশ্চর্য হইনি, কিন্তু যে বিপুল শক্তি দিয়ে অনায়াসে সেইগুলোকে নিয়ে চুড়ো করা সাজাচ্ছিলে তাই দেখে মুগ্ধ হয়েছিলুম।” বিজ্ঞানের শক্তির এক পিঠ যুক্তি মহিমার এই অপরূপ সংহতি। যার টানে রাজা বারবার নন্দিনীকে বলেন, “আমি তোমাকে জানতে চাই।” ওই জানবার দূরন্ত কামনাই ওই শক্তির অন্য পিঠ, যে পিঠে রাজার অন্য রূপ: “আমি হয় পাবো, নয় নষ্ট করব। যাকে পাইনে তাকে দয়া করতে পারিনে। তাকে ভেঙে ফেলাও খুব এক রকম করে পাওয়া।” রাজার এই ‘নিষ্ঠুর’তা বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক অনন্ত জিজ্ঞাসারই অন্তর্গত: “সৃষ্টিকর্তার চাতুরী আমি ভাঙি।” তাতে ‘বিশ্বের মর্মস্থানে’ যে ব্যথা লাগে, তা সারাতে লাগে ‘নিখিল-প্লাবী আনন্দ-আলোক’, যা আসবে বিপ্লবের পথে, ‘নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা’য়, লোভ ও শক্তির জাল থেকে মুক্তিতে। “নিষ্ঠুর সংগ্রহের লুব্ধ চেষ্টার তাড়নায় প্রাণের মাধুর্য সেখান থেকে নির্বাসিত। সেখানে জটিলতার জালে আপনাকে আপনি জড়িত করে মানুষ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই সে ভুলেছে, সোনার চেয়ে আনন্দের দাম বেশি; ভুলেছে, প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই। সেখানে মানুষকে দাস করে রাখবার প্রশস্ত আয়োজনে মানুষ নিজেকে নিজেই বন্দি করেছে। এমন সময় সেখানে নারী এল, নন্দিনী এল; প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের উপর। প্রেমের আকাশ আঘাত করতে লাগল লুব্ধ দুশ্চেষ্টার বন্ধনজালকে। তখন সেই নারীশক্তির নিগূঢ় প্রবর্তনায় কী করে পুরুষ নিজের রচিত কারাগারকে ভেঙে ফেলে প্রাণের প্রবাহকে বাধামুক্ত করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হল, এই নাটকে তাই বর্ণিত আছে।” [‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি’, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৪]



    ১৯৫৪ সালে বহুরূপী প্রযোজিত, শম্ভু মিত্র নির্দেশত রক্তকরবী নাটকের একটি সংক্ষেপিত শ্রুতিনাটক-রূপ পরে সম্প্রচারিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে। সেটি শুনতে পারেন এখানে



    গ্রাফিক্স: স্মিতা দাশগুপ্ত

    এই বিভাগের লেখাগুলি হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করে 'পড়াবই'এর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ | ৫৯৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • i | 61.68.***.*** | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৩৬102222
  • অসম্ভব ভালো লাগল।
    "ক্ল্যাসিক-এর অনেক সংজ্ঞার মধ্যে একটি কথায় হোক, রঙে-রেখায় হোক, সুরে হোক, যে শিল্পকীর্তির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়, আর যতবারই ফিরে আসা যাক না কেন, নিজের জীবনকাণ্ডের অভিজ্ঞতায়, ইতিহাসের ক্রমানুবর্তিতায় তা নব ব্যঞ্জনায় চরিতার্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-র কাছে ফিরে এসেছি অনেকবার।"
    এই যে ফিরে ফিরে আসা যে কতভাবে কতরকমে- তার বিবরণ এবং উপস্থাপনা মুগ্ধ করল।
    ব্যক্তিগত পাঠ, সংগ্রহ ইত্যাদি সঞ্জাত আলোচনা যে কতখানি জীবন্ত আর কতটা বহুমাত্রিক হয়ে উঠতে পারে- এই লেখাটি ( ছবিগুলি সমেত) তার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে রইল।

    ব্যক্তিগতভাবে এই লেখাটি পড়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

  • মলয় রক্ষিত | 223.19.***.*** | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ ১০:০৭102226
  • অসম্ভব মূল্যবান আলোচনা। রক্তকরবীর মুদ্রণ সংক্রান্ত তথ্যাবলি বিশেষত চিত্রগুলি নিয়ে এমন সচিত্র উপস্থাপনা খুবই চিত্তাকর্ষক। 


    লেখাটিতে শমীকবাবুর আলোচনার কেন্দ্রীয় প্রশ্নটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর সীমায়িত পরিসর থেকে রক্তকরবীর রাজা কীভাবে রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতায় প্রসারিত হতে পারে তার ইঙ্গিত মাত্র শমীক দিয়েছেন। 


    শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখাটি আরও বিস্তার ব্যাখ্যা দাবি করে। লেখার সমাপ্তিতে এসে মনে হয় যেন মাঝখান থেকে হটাৎ পূর্ণচ্ছেদ টানা হয়েছে।

  • santosh banerjee | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ ২০:১৮102233
  • খুব জানতে আগ্রহী এই যে ।...শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্ত মহাশয় শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্রর "রক্তকরবী "প্রযোজনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন ।...সেটা কি প্রকাশ করা যায় না?? 

  • Rantideb Roy | ১৭ জুন ২০২১ ২৩:৩২495027
  • আজ শমীক বন্দোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ভালো থাকবেন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন