বলতে কোনো সংকোচ নেই, আমি কোনোদিনই শঙ্খ ঘোষের ঘনিষ্ঠ সমাজের অন্তর্গত ছিলাম না, বরং আমি তাঁর থেকে একটা দূরত্বই লালন করে এসেছি চিরদিন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরিচয় থাকলেও এতদিনে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি কুল্যে হয়তো দশবার; তার মধ্যে মাত্র একবারই তাঁর সরাসরি টেলিফোনে আহ্বানে, আমাকে ডেকে হাতে তুলে দিয়েছিলেন রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি, ‘অজিতেশের শেষ ঠিকানা’ নামে যা আমরা থীমা থেকে প্রকাশ করেছিলাম। গ্রন্থ প্রকাশাকাঙ্ক্ষী লেখক-লেখিকাদের বহু পাণ্ডুলিপিই যত্নভরেই শঙ্খদা পাঠ করতেন, সমালোচনা করতেন, উৎসাহ দিতেন, কিন্তু খুব কমক্ষেত্রেই প্রকাশকের কাছে প্রকাশের সুপারিশ করে পাঠাতেন। বইয়ের প্রতি তাঁর সম্ভ্রম থেকেই প্রকাশনার মূল্যবোধ তথা এথিক্স্-এ তাঁর এই অটল আস্থা।
প্রকাশ/প্রকাশনার মর্যাদা আমাকে বহুদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তাই তাঁর এই গভীর বই-বোধটা আমাকে তাঁর প্রতি এমনই শ্রদ্ধামুগ্ধ করে তোলে যে এই ধারণাটাই সর্বদা আমাকে চালিত করত যে, এই মানুষটি যাতে সবটা সময় বই পড়া, বই ভাবনা ও বই লেখায় যাপন করার নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করার দায় সমগ্র তন্নিষ্ঠ পাঠককুলের। আমার সমসময়ই মনে হত, আমাদের তাৎক্ষণিক চাহিদায় বা নিতান্তই সঙ্গসুখলোভে আমরা ওঁর যে সময়টা গ্রাস করে নিই, সেই নষ্ট সময়েই তো তৈরি হতে পারত অনন্ত সম্পদ—কিছু লেখায় রূপ নিত, কিছু ওঁর অপারসক্রিয় ভাবনায় মথিত হত—যা থেকে যেত কত কালের আস্বাদনের জন্য। তাঁর বাড়ির সপ্তাহান্তিক বিখ্যাত আড্ডায় আমি কখনও যাইনি, ওই ভাবনা থেকেই।
আমি তো নিজে লেখক নই, আশি বছর বয়স পেরিয়েও একটাও বই লিখবার সাহস হয়নি। বইমহলে আমি মিস্তিরিগিরি করি, পরের বই, যথার্থ লেখকদের বই ছোটোখাটো মেরামতি করি, ঝাড়পোঁছ করি, সাজাই-গোছাই করি, সেবাযত্ন করি। বইমহলে আমার সেই পেশায় আমি শঙ্খদাকে ওস্তাদ কারিগর মানতাম। সেই খাতিরেই যে-ক-বার যাওয়া। দুটো বইয়ের কারিগরিতে শঙ্খদার অবদান গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়—শঙ্খদার মতনই—গদ্যে ও কবিতায়—বাঙলা ভাষার নির্মাতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সেই সুভাষদাই একেবারেই অসুস্থ শেষ জীবনে বাঙলা ভাষা শেখার বই লিখেছিলেন—‘দেখি, শুনি, পড়ি, লিখি’, আমাকে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন থীমা থেকে, তাঁর শেষ বই। সুভাষদা তখন কানে শুনতে পান না, বই নিয়ে যাবতীয় খুঁটিনাটি আলোচনা হয় সামনে কাগজ রেখে তাতে আমার প্রশ্ন লিখে। সুভাষদার তখন স্থির সিদ্ধান্ত, আজকালকার ছোটো ছেলেমেয়েরা হাতে আঁকা ছবি ভালোবাসে না, তাদের টানে আলোকচিত্র, তাই তাঁর বইয়ে তিনি চান না ‘সহজপাঠ’-এর চিত্রালংকরণ, চান ফোটোগ্রাফ। ফোটোগ্রাফির বাজারে পেশাদারদের মধ্যে—কোথায় পাব সেই চিত্রকরকে যে সুভাষদার এই ঐতিহাসিক কীর্তিকে তাঁর সেই কল্পনায় জারিত করে চিত্রিত করবে? সুভাষদার অন্তিম দিনগুলিতে সেই শিল্পীকে পাওয়া গেল না। দৃক্-এর আলোকচিত্রীদের যখন প্রণোদিত করতে পারলাম, ততদিনে সুভাষদা অন্তর্হিত। সুভাষদারই নির্দেশে উমা সিদ্ধান্তের কাছে গেলাম। বাঙলা বর্ণমালার ছাঁদটা সুভাষদার মনোমতো রেখার বিন্যাসে চিত্রিত করে দিলেন উমাদি। এত খুঁতখুঁতে ছিলেন সুভাষদা এই বইটা নিয়ে! সুভাষদার বিহনে সেই খুঁতখুঁতানিটা বর্তে গিয়েছিল আমাদের—মিস্তিরিদের গভীরে। সুভাষদার সঙ্গে শঙ্খদার আজীবন গভীর ভাব দেওয়া-নেওয়ার ইতিহাসে এটাও হোক আর-এক অধ্যায়, ভেবে শঙ্খদাকে আলোকচিত্রে চিত্রিত ছাপা একটা ভাষ্য পৌঁছে দিই। গোয়েন্দার প্রখর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে পড়ে দু-একটি সংশোধন চিহ্নিত করে শঙ্খদা লিখে দেন এই বইয়ের ভূমিকা। সুভাষ-শঙ্খ একত্র রয়ে গেলেন বইটায়।
২০১৩ সালে মনোবিজ্ঞানী সুধীর কাকর তাঁর ‘ইয়ং টেগোর: দ্য মেকিংস অভ্ এ জিনিয়াস’ বইটি আমাকে উপহার দিয়ে অনুবাদ করে দিতে অনুরোধ করেন; রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জীবনের বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, তিনি চান বাঙালি রবীন্দ্রানুরাগীদের প্রতিক্রিয়া। রাজি হয়ে যাই। কিন্তু রবীন্দ্রচর্চায় কোনো বড়োমাপের কাজ হাতে নিয়েই স্থির করি, শঙ্খদার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে হবে। শঙ্খদাকে ফোন করে দিনক্ষণ স্থির করে তাঁর কাছে যেতেই নিজের তাক থেকেই বইটা নামিয়ে তার ভিতর থেকে একটা চিরকুট বার করলেন, তাতে পৃষ্ঠাসংখ্যা দিয়ে সযত্নে লেখা সুধীরের বইয়ের সন-তারিখ-তথ্যের ভুল-ত্রুটির একটি খতিয়ান! আমি দ্রুত লিখে নিয়ে সুধীরকে অনতিকালের মধ্যে জানিয়ে দিই, মূল ইংরেজি বইয়ের পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধনের জন্য। আমি নিজেও অনুবাদকালে শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাই। ক-মাস আগে অনুবাদ শেষ করে আবার একটা সংশয়ে পড়ি। বইয়ের নামকরণ নিয়ে। কথা বলতে কষ্ট হয় শঙ্খদার, বিশেষত ফোনে, তাই বিরক্ত করতে চাইনি, সোমেশ্বরের শরণ নিই। শঙ্খদাই নামকরণ করে দেন: ‘তরুণ রবি: এক প্রতিভার নির্মাণ’। শঙ্খদার সঙ্গে শেষ দেখা হয় ‘অনুষ্টুপ’-এর অনুষ্ঠানে। প্রথম সারিতেই বসেছিলাম, শঙ্খদার থেকে একটু দূরত্ব রেখেই যথারীতি। উনি ঝুঁকে পড়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: “সুধীরের বই কত দূর?”
কী যেন এক স্পর্শ, ঘ্রাণ জুড়ে দিলেন যা অন্যদের লেখায় নেই। বরং বলা ভালো অনালোকিত অংশে উজ্জ্বল আলো ফেললেন। সহজকে আরও সহজ করেই উপস্থাপিত করলেন। এ লেখায় আত্মীকতা,শ্রদ্ধা এবং নমন যেন মিশে রয়ে গেছে।