শঙ্খ ঘোষ আজ শুধু বাংলা কবিতা নয়, ভারতীয় কবিতার বৃহত্তম ও সূক্ষ্মতম মেটাফর। এক পড়শি ভাষার অনুজ কবি-ভাবে তাঁর সঙ্গে মাত্র দুই বা তিন বার সাক্ষাৎ করেছি একান্তে। শেষবার ২০২০-তে, যখন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। কলকাতায় অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারের অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক সাহিত্য অনুরাগী সাফল্যকুমার নন্দী শেষবারের সাক্ষাতের সময়ে আমার সঙ্গী ছিলেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের মুখবন্ধ সম্বলিত ‘শারলা পুরস্কার’-প্রাপ্ত আমার একটি কাব্যগ্রন্থ আছে—‘জেজে দেখিনথিবা ভারত’ (ঠাকুরদার না-দেখা ভারত)। ভারতী নন্দী তার বাংলা অনুবাদ করেছেন। সেই পুস্তকটি শঙ্খবাবুকে উৎসর্গ করায় বইটি স্বহস্তে ওঁকে অর্পণ করার অফুরন্ত বাসনা ছিল। কাজেই শেষ এই সাক্ষাৎ ছিল ব্যক্তিস্বার্থ সম্বলিত। শঙ্খদা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সারস্বত পুরস্কার ‘জ্ঞানপীঠ’ ও ‘সরস্বতী সম্মান’ পাওয়া কবি। তাঁর কবিত্বের উচ্চতার দিকে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস আমি কখনও করি না। কারণ তা হবে বামনের চাঁদ ধরার প্রয়াস।
বরং শঙ্খদার কবিতাকে আমি অনুসরণ করে এসেছি অনেক কাল ধরে। ব্যক্তিজীবনে ঘরোয়া ও তৃণাদপি ন্যূন-প্রতিভাত এই মানুষটির ভিতরে জীবনানুভবের যে সূক্ষ্মতা ভরপুর, তা ভেবে আমি বারবার আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। করুণা ও কারুণ্যকে শব্দে গেঁথে এত মরমিয়া একটি কাব্যস্বর যে দৃশ্যত অতি সাধারণ এই মানুষটি এত বিস্ময়কর ভাবে সৃজন করতে পারেন, তা তাঁর কবিতা মন দিয়ে না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন। ১৯৭০-এ প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র ভূমিকায় তিনি বলেছেন, “সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।” জীবনের নানা জাগতিক মিথ্যাজালে জড়িয়ে না পড়ে নিরুপায় যে-কোনো কবির পক্ষেই ‘জীবনসত্য’ নিয়ে কবিতা লেখা যে কী দুরূহ, এবং তেমন কবিতা যে কত দুর্লভ, তা ভেঙে বলার কোনো আবশ্যকতা নেই। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-য় সংকলিত কবির ‘দিনগুলি রাতগুলি’, ‘কবর’, ‘ঘরেবাইরে’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘বলো তারে, ‘শান্তি শান্তি’’, ‘যমুনাবতী’, ‘ভিড়’, ‘ফুলবাজার’, ‘বৃষ্টি’, ‘ছুটি’, ‘ভাষা’, ‘আরুণি উদ্দালক’, ‘জাবাল সত্যকাম’, ‘ক্রমাগত’, ‘বিকেলবেলা’, ‘নিগ্রো বন্ধুকে চিঠি’, ‘কলকাতা’, বোকা’, ‘সত্য’, ‘চিতা’, ‘বিরলতা’, ‘যৌবন’, ‘বৃষ্টিধারা’, ‘ত্যাগ’, ‘প্রেমিক’, ‘শরীর’, ‘খরা’, ‘সন্ততি’, ‘শাদাকালো’, ‘এই শহরের রাখাল’, ‘সেদিন অনন্ত মধ্যরাত’, ‘মণিকর্ণিকা’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘হাতেমতাই’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ‘ত্রিতাল’, ‘অগস্ত্যযাত্রা’, ‘চডুইটি কীভাবে মরেছিল’, ‘মন্ত্রীমশাই’, ‘দেশ আমাদের আজও কোনো’, ‘আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব’, ‘কাব্যতত্ত্ব’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘মেঘের মতো মানুষ’, ‘ক্যান্সার হাসপাতাল’, ‘অন্ধবিলাপ’, ‘বেলেঘাটার গলি’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ‘কথার ভিতরে কথা’, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’, ‘অবিনাশ’, ‘যাবার সময়ে বলেছিলেন’, ‘তুমি বলেছিলে জয় হবে জয় হবে’, ‘একটি গাথা’, ‘বদল’, ‘খবর’, ‘যা ঘটবার ঘটতে থাকে’ ও ‘শবসাধনা’ প্রভৃতি কবিতা, এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে সংকলিত আরও বহু কবিতা পড়ে আমি হতবাক হয়ে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এই কারণেই যে শব্দে অনুভবের বিস্ময়-রোপণ আমাকে অবাক করেছে। আপাত খোশমেজাজি মানুষটির মধ্যে কী গভীর একাকিত্ব, জাগতিক বিপন্নতার সাথে কী রক্তঝরা লড়াই, অন্যের ব্যথায় নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে দেওয়ার কী দায়বদ্ধতা শঙ্খদার কবিতায়! শব্দকে নিজের ভাবনার, চিন্তার সম্পূর্ণ আয়ত্তে আনার ক্ষমতাসম্পন্ন কবি আমি ক্বচিৎ দেখেছি ভারতীয় ভাষায়, যেমন দেখেছি শঙ্খদার কবিতায়। শঙ্খদার কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি, যদিও এ সব উদ্ধৃতির বাইরে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে অসংখ্য অমূল্য জীবনবোধে টইটম্বুর উচ্চারণ:
১। ‘‘কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না
বেদনার শাদা ফুলে আকাশ নিবিড় হবে, অবকাশে ভরে যাবে প্রাণ।’’ (দিনগুলি রাতগুলি)
২। ‘‘কবি রে, আজ প্রেমের মালায়
ঢেকে নে তোর দৈন্য!’’
(দিনগুলি রাতগুলি)
৩। ‘‘আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকোই কাঁচামাটির তলে—
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার
সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে।’’
(কবর)
৪। ‘‘এই সেই অনেকদিনের ঘর, তার দেয়াল ফাটছে, আশা ফাটছে।
যেদিকে তাকাই তার নির্বোধ নীরব চোখ,
ভীষণ লজ্জাহীন একঘেয়ে সূর্যহীন গন্ধ’’
(ঘরেবাইরে)
৫। ‘‘…ঘর ছেড়ে কোন্ খানে একটু নিশ্বাস মিলবে
শূন্য নীলে কিংবা শহরে
যেখানে ঘর নেই, ঘরের নৈরাশ্য নেই, ঠাকুমার চোখ নেই।’’
(ঘরেবাইরে)
৬। ‘‘…নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই’’
(শূন্যের ভিতরে ঢেউ)
৭। ‘‘শূন্যে পাক খেতে খেতে
ঝরে পড়েছে অনাথ পাতা
তার উদাসীনতা দেখতে
মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল’’
(মায়া, এও এক ব্যথা-উপশম)
৮। ‘‘এ চিঠি লেখার কোনো মানে
নেই জানি তবু লিখি
তবু লিখে যাই
এও এক ব্যথা-উপশম’’
(নিরুত্তর চিঠি: এও এক ব্যথা-উপশম)
শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়লে কখনো-কখনো মনে হয়, ভাষায় সরলতার থেকে বড়ো শক্তি বোধহয় আর কিছু নেই। সরলতাকে কবিতা করে ফেলার শক্তি থাকাটাই একজন কবির পক্ষে যথেষ্ট। শঙ্খদা লিখেছেন, “অনেকসময়ই কবি কথা বলেন নিজেরই সঙ্গে নিজে” (‘কবিতার তুমি’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’)। এই প্রসঙ্গে বারবার মনে হয় শঙ্খদার একটি বিশেষ কবিতা—
কলকাতা
বাপজান হে
কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে
আমিই কিছু জানি না
আমারে কেউ পুছত না
কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্য সবাই দুষ্ট বটে
নিজে তো কেউ দুষ্ট না
কইলকাত্তার লাশে
যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যিকালের মজা পুকুর
শ্যাওলাপচা ভাসে
অ সোনা বৌ আমিনা
আমারে তুই বাইন্দা রাখিস, জীবন ভইরা আমি তো আর
কইলকাত্তায় যামু না।
প্রথম পঙ্ক্তি ক-টি লক্ষ করুন—“বাপজান হে/কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে/ আমিই কিছু জানি না,” সরল, সহজ কথা। ধরা পড়ে কলকাতার মানুষের সবজান্তা চরিত্র, উঠে আসে একটা সেয়ানা ভাব, যার মধ্যে কিন্তু অপরাধমূলক কোনো মনোবৃত্তি নেই। শঙ্খের কবিতার এক-একটি পঙ্ক্তিতে যেন দেখা যায় গভীর কুয়োর মধ্যে অনুভবের অতলতা। মধ্যরাত্রের ঝরে পড়া বৃষ্টির জল মুছে নিয়ে যায় ‘জীবনের শেষ অপমান’ (সেদিন অনন্ত মধ্যরাত)। শব্দে ব্যঞ্জিত অনুভবের শেষ সীমা অবধি দৃষ্টি পৌঁছায় না। গাঁয়ের কিশোরী মেয়ের হাতে বোনা সাদা রুমালের মতো, কখনো-কখনো মনে হয়, শঙ্খদার কবিতাও কবে-যেন-লেখা প্রথম প্রেমপত্রের অতৃপ্তির মতো অসমাপ্ত।
দুই দিগন্তের মাঝে থাকা সীমাহীন শূন্যতার মতো শঙ্খদার বহু কবিতায় ধরা-দেওয়া জীবনোপলব্ধিকে অনুশীলন করতে পারলে পাঠকের মধ্যে জেগে ওঠে জীবন সার্থক হওয়ার একটা বোধ। এই কবিতাটি পড়ুন—
বৃষ্টি
আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান!
এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।
“এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে / আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।” এবং “এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে / আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।”—শব্দের ভিতরে অনুভবের অতল গর্ভগৃহ। মনে হয় না কি-এক অভিজ্ঞতা, এই প্রথম বার জেগে উঠল কবির মনে? শঙ্খদা তো নিজে বলেছেন ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ (ভূমিকা)-তে, ‘‘একটি অভিজ্ঞতা যা এই প্রথম যেন জেগে উঠল কবির মনে—তখনই তাকে বলতে চাই কবিতা।” বৃষ্টির দিন স্থির, কিন্তু মনে পড়ে মৃত্যু, মনে পড়ে অফুরন্ত জন্মের বাসনা।
শঙ্খদার কবিতার অন্য একটি বিশেষত্ব হল, তাঁর কবিতায় প্রথম পঙ্ক্তিটি অনেক ক্ষেত্রে আকস্মিক, মনে হয় যেন তা কোনো কথার মাঝখান থেকেই আরম্ভ হয়েছে। যেমন ধরুন—
ছুটি
হয়তো এসেছিল। কিন্তু আমি দেখিনি।
এখন কি সে অনেক দূরে চলে গেছে?
যাব যাব। যাব।
সব তো ঠিক করাই আছে। এখন কেবল বিদায় নেওয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম।
কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকা বাঁধা আছে দুটি,
দূরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে—
ছুটি, প্রভু, ছুটি!
ওই যে প্রথম পঙ্ক্তি—“হয়তো এসেছিল। কিন্তু আমি দেখিনি।” বা ‘ভাষা’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি, “এই তো, রাত্রি এল। বলো, এখন তোমার কথা বলো।”
আবার, কবিতার ভিতর থেকে কোনো কোনো পঙ্ক্তি তুলে আনলেও তা নিঃসঙ্গ হয়ে যায় না— এও এক বিশেষত্ব শঙ্খদার কবিতার। যেমন ধরুন, ‘‘তোমার সমগ্র সত্তা যতক্ষণ না-দাও আমাকে/ততক্ষণ কোনো জ্ঞান নেই।’’ (আরুণি উদ্দালক) শঙ্খদার কবিতায় ছত্রে ছত্রে দর্শন, জীবনকে আলাদা ভাবে দেখার এক সূক্ষ্মবোধ। কিন্তু তিনি কখনও কবিতাকে তত্ত্ব করেননি। বরং তত্ত্বকে করেন মনমোহী কবিতা। নজির অনেক, তবে এখানে দেখি একটিমাত্র—
মণিকর্ণিকা
চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা
তার ওপরে আমাদের পলকা নৌকোর নিশ্বাস
মুখে এসে লাগে মণিকর্ণিকার আভা
আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না
হাতে শুধু ছুঁয়ে থাকি পাটাতন
আর দু-এক ফোঁটা জলের তিলক লাগে কপালে
দিনের বেলায় যাকে দেখেছিলে চণ্ডাল
আর রাত্রিবেলা এই আমাদের মাঝি
কোনো ভেদ নেই এদের চোখের তারায়
জলের ওপর উড়ে পড়ছে স্ফুলিঙ্গ
বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ভস্ম
পাঁজরের মধ্যে ডুব দিচ্ছে শুশুক
এবার আমরা ঘুরিয়ে নেব নৌকো
দক্ষিণে ওই হরিশ্চন্দ্রের ঘাট
দুদিকেই দেখা যায় কালুডোমের ঘর
চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা
এক শ্মশান থেকে আরেক শ্মশানের মাঝখানে
আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না।
বিশেষ করে ভাবায়, “চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা/এক শ্মশান থেকে আরেক শ্মশানের মাঝখানে/আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না।” দুই শ্মশানের মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, অনন্ত বিষাদের প্রতীক হয়ে। জীবনানুভবের যে বৈরাগ্য উপচে পড়ছে পঙ্ক্তিগুলি থেকে, সেটিই শঙ্খদার মন্ত্রদীপ্ত কবিশক্তি। জীবন ও মৃত্যুবোধ এখানে মুখ্য, গঙ্গা শুধুমাত্র উপলক্ষ্য। হুমায়ুনের রোগশয্যার পাশে বসে বাবরের প্রার্থনা, ‘‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার/জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে?/ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’’ (বাবরের প্রার্থনা)। লোভ-মোহে পরিপূর্ণ জীবনের অসারতা বোধ মৃত্যুর তাগিদে ঝলসে ওঠে, মেঘ-আঁধার রাতে বিজলির ঝাঁকুনি লেগে যেমন ঝলসে ওঠে সামনের গভীর খাদ।
‘জাবাল সত্যকাম’ কবিতায় গুরুকে প্রশ্ন করে সত্যকাম, ‘‘আমি যে আমিই এই পরিচয়ে ভরে না হৃদয়? কেন চাও আত্মপরিচয়?’’ আকাশকে তছনছ করে ‘ছান্দোগ্য’-র পুরাতন পৃষ্ঠাকে কাঁপিয়ে সত্যকামের মুখে কবির এই প্রশ্ন লক্ষ শরৎ ধরে প্রতিধ্বনি তোলে। এ প্রশ্ন শুধু সত্যকামের নয়, এই ধরাধামে ‘পিতৃপরিচয়হীন’ প্রত্যেক অনাথের। ‘বহু পরিচর্যাজাত’ অনেক ‘আমি’র। “আয়তনহীন এই দশদিকে আজ আর আমার দুঃখের কোনো ভারতবর্ষ নেই।”-র মতো পঙ্ক্তি ‘জাবাল সত্যকাম’ প্রসঙ্গে শঙ্খ ভিন্ন কেউ কি দিয়েছেন আজ পর্যন্ত ভারতীয় কবিতাকে? যে পঙ্ক্তি ব্যক্তিগত বেদনাকে এক ঝলকে বিগলিত করে দেয় অশ্রু-অধীর সর্বজনীন এক হাহাকারে।
৫০
নিচু হয়ে এসেছিল যে মানুষ অপমানে, ঘাতে
ঝরে গিয়েছিল যার দিনগুলি প্রহরে উজানে
তারই কাছে এসে ওই পাঁজরে পালক রেখেছিলে
তোমার আঙুলে আমি ঈশ্বর দেখেছি কাল রাতে।
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ)
বা
৬১
প্রতি মুহূর্তের ধান আসক্ত মুঠোয় রাখি ধরে
তারপরে যায় যদি অবাধ সন্ন্যাসে ঝরে যায়
এই মাঠে আসে যারা সকলেই বোঝে একদিন
এক মুহূর্তের মুখ আরেক মুহূর্তে সত্য নয়।
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ)
এমন পঙ্ক্তি দৈবপ্রাপ্ত না কবি-নির্মাণ? আমি বলব, ‘নিজের জোরে মাতাল’ (ত্রিতাল) হলে তবেই এমন পঙ্ক্তি লিখতে পারেন কোনো শব্দশিল্পী।
আবার শ্লেষ। তাও আকর্ষণীয় সুষমামণ্ডিত হয়ে বিরাজ করে শঙ্খদার কবিতায়। কখনও মুক্তকণ্ঠ, কখনও-বা অবগুণ্ঠিত। যেমন, ‘‘আর তাছাড়া সবটা কথা কেমন করে বলি/ বাইরে লেনিন ভিতরে শিব বেলেঘাটার গলি!’’ (বেলেঘাটার গলি)। কিংবা, ‘‘জন্মভূমি? কোথায় আমার জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।’’ (মন্ত্রীমশাই)।
এই শ্লেষ আবার কখন বেদনা হয়ে ঘনিয়ে আসে সেই কবিতাটির অন্য এক ধাপে—
“দেশটাকে যে নষ্ট করে দিলাম ভেবে কষ্ট হলো।
এখান থেকে ওখানে যাই এ-কোণ থেকে ওই কোনাতে
একটা শুধু পুরোনো জল জমতে থাকে
চোখের পাশে”
(মন্ত্রীমশাই)
‘দেশ আমাদের আজও কোনো’ কবিতায় কবি দেশ হারানো মানুষের হয়ে প্রশ্ন তোলেন—
“অর্থহীন শব্দগুলি আর্তনাদ করে আর তুমি তাই স্তব্ধ হয়ে শোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের আজও কোনো
দেশ আমাদের কোনো মাতৃভাষা দেয়নি এখনও।”
পুনরাবৃত্তি এখানে কবিতার বক্তব্যকে মন্থর করছে না, বরং এনেছে প্রত্যাশিত ফুর্তি। মিথ্-এর মধ্যে ধরা দিয়েছে বদলে যাওয়া সময়ের নতুন তাৎপর্য। যুধিষ্ঠিরের বহু বছরের শাসনের পরে দুর্নীতি ও দুরাচারে পতনমুখী বৃষ্ণিবংশ, পরস্পরের বিনাশ সাধনে হয়েছে যার পূর্ণাহুতি। মহাভারতের মৌষলপর্বকে পৃষ্ঠভূমি করে শঙ্খ স্ব-সময়ের ভারতবর্ষের বৈকল্যকে বারংবার এঁকেছেন তাঁর কবিতায়—
১। “কালপুরুষ ঘুরে বেড়ায় গোপন পায়ে ঘরে ঘরে
উপড়ে নেয় মগজ
ইঁদুর ঘোরে উল্কা খসে পলক ফেলতে কবন্ধ
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব”
(আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব)
২। “গরুই আজ গাধার মা, হাতির বাচ্চা খচ্চরের
বেজির পেটে ইঁদুর
সারস ডাকে পেঁচার মতো, ছাগলদের শেয়ালডাক
ঘরের বুকে রক্ত পায়ে পাণ্ডুরং কপোত”
(আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
৩। “সত্যকে আজ ঘুরিয়ে নিলেই এক লহমায় মিথ্যে, আর
মিথ্যেকেই বানিয়ে নিই সত্য
পাতায় পাতায় খুঁজে বেড়াই কে আমাদের শত্রু, যেন
কারোই কোনো বন্ধু নেই কোথাও”
(আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব)
৪। “গলায় মুণ্ডুর মালা, তাথৈ তাথৈ নাচে
গোটা দেশ হয়েছে ভাস্বর--
আজ সে পরীক্ষা হবে আমরা শুধু শববাহক
না কি কোনো সত্যভাষী স্বর।”
(তিসরা ঝাঁকি। এও এক ব্যথা-উপশম)
সমকালের ভারতে কবি দেখেছেন মানব-বিশ্বের অধঃপতন এবং আতুরভাবে খুঁজে চলেছেন ভয়াবহ এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে নিষ্ক্রমণের পথ। সকলেই শুধু উপভোক্তা, নিশ্চিহ্ন প্রায় মানুষের আত্মসত্তা। চতুর্দিকে শুধু বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। কোথায় অন্তরের সৌকুমার্যকে বাঁচিয়ে রাখার আড়াল? ‘অমৃতের পুত্র’ আজ স্থূল এক তথ্যপঞ্জি। সামূহিকতায় ধ্বস্ত যা-কিছু ব্যক্তিগত। এমনই এক সময়ের বাধ্য সাক্ষী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর কি সম্ভব কবিতার? শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন তাঁর বহু চর্চিত এই কবিতা—
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
‘খবর’ শীর্ষক কবিতায় যে দৃশ্যপট চোখে পড়ে, তা এমন— সব জায়গায় কাঁপিয়ে ঢোকে খবর। আধা খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে কে ঢোকে? না, খবর। জানালার ধার ধরে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে কে? না, খবর। এদিক-ওদিক, যে দিকে হেলান দিলে চেপে ধরে কে? না, খবর। ঘরে বাইরে সর্বত্র খবরের রাজ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে স্তূপের মতো উপরে চেপে বসে খবর। রুদ্ধ হয়ে যায় নিশ্বাস। মৃত শরীরের উপর খবর নাচে আহ্লাদে, নেচে চলে। গভীর শ্লেষ থেকে নিমেষেই পরিহাস তুলে আনেন শঙ্খদা অনায়াসে, যেমন ‘কোমা’ থেকে চেতনায় ফিরে আসে চেতনাহত। উপলব্ধির এই স্তর বদলে কবি শঙ্খ ঘোষ দক্ষ। গণতন্ত্রের দলবদলের নির্বোধ উল্লাসকে কটাক্ষ করেন শঙ্খদা তাঁর ‘বদল’ শীর্ষক কবিতায়, শব্দের ভেতরে লুকিয়ে রেখে শানিত বিদ্রুপ—
১। “একটা আশ্চর্য দিন আজ
তন্ন তন্ন খুঁজে দেখি ভোরের কাগজে,
কিন্তু কোনখানে হত্যাকাণ্ড নেই”
(অক্ষরে অক্ষরে ঝুঁকে, এও এক ব্যথা-উপশম)
২। “এই তো ভালো হলো
আমরা এখন হয়ে গেছি ওরা।
আর কোনো অশান্তি রইল না আমাদের
দেখো কেমন চমৎকার কেটে যাচ্ছে আমাদের কৃমিকীট জীবন।”
‘আমরা’ থেকে ‘ওরা’ হয়ে যাওয়াতে যে মানুষের দল দেখে বেঁচে থাকার তৃপ্তি, তাদের বিবেচনার তুচ্ছতায় উহ্য হয়ে থাকে কবির সহস্র ‘আহ্’। যেমন, হত্যাকাণ্ড নিত্য সত্য এই সময়ে, না থাকাটাই বিরলতা।
শুধু বক্তব্য নয়, কবিতার পোশাকে শঙ্খদা সবসময়ে খোঁজেন এক নতুন ভাষা, বারবার ব্যবহারে যা জীর্ণ নয়। ‘মহাশূন্যে অন্ধকারের ফুটে ওঠার মতন’, সে ভাষা ‘প্রথম আবির্ভাবের মতো শুচি, কুমারী-শষ্পের মতো গহন, গম্ভীর’ (ভাষা)। অপরাজিতা ফুলের ছোটো ছোটো রং-এর ছিটার মতো কবির কবিতায় রুপোজ্জ্বল হয়ে থাকে প্রভাবী ‘চিত্রকল্প’। ‘রৌদ্র হবে ব্যাধের মতন’, ‘প্রধূম গোধূলি’ (দিনগুলি রাতগুলি), ‘ঠাকুমার নামাবলির মতো মূঢ় দেয়াল’ (ঘরেবাইরে), ‘জাগনলোভী চাঁদে’-র ‘দুল’ (বলো তারে, ‘শান্তি শান্তি’), ‘হাসি,’ যেমন ‘দুপুরে বাতাসভরা কেঁপেওঠা অশথের পাতা’, ‘নীল কাচে আলো লেগে প্রতিফলনের মত স্মৃতি’ (আরুণি উদ্দালক) ইত্যাদি শঙ্খদার চিত্রনির্মাণ দক্ষতার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
কবির ভাষা প্রসঙ্গে অনেকদিন আগে চোখে-পড়া অমিতা সেনের একটি চিঠি মনে পড়ে। এই চিঠিটি তিনি শান্তিনিকেতন থেকে কবিকে লিখেছেন ২৬ জুন ১৯৮১-তে ‘উর্বশীর হাসি’ কাব্যগ্রন্থ পাঠের তৎকালীন প্রতিক্রিয়ায়, “কি ভালো একটি বই লিখেছ—এ রকম বই তুমি ছাড়া আর কে লিখতে পারে বল?... কি স্বচ্ছ ঋজু ভাষা তোমার। শুষ্ক নয় এতোটুকু, রসে টুপুটুপু। গম্ভীর সুরের মধ্যে কি সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা।” (‘পুরোনো চিঠির ঝাঁপি’, পৃ-১৩)। ‘মানুষকে মানুষের বলা’ (ওয়ার্ড্স্ওয়র্থ) শঙ্খদার কবিতা। ‘শব্দে’র ভেতরে ‘নিঃশব্দ’ অক্লেশে ধরা দেয় তাঁর কবিতায়। এক সাধারণ নিরীহ চিত্র থেকে গ্রামীণ স্বল্পতা নিয়ে আরম্ভ হয় তাঁর কবিতা, অথচ কী প্রকাণ্ড বিস্তার ঘটতে থাকে ক্রমে ক্রমে। আত্মজিজ্ঞাসার গভীরতাই শঙ্খদার কবিতার বৈশিষ্ট্য।
‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ কবিতাটি পড়ে বন্ধু শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (২২ জুন, ১৯৭৪) কবিকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘‘এ কবিতাগুলো অনেকাংশে যেন তোমার নতুন identity ঘোষণা করছে। … প্রগাঢ়তায়, দীপ্তিশলাকার মত এ কবিতা তামস অভিজ্ঞতাকে ভাস্বর করে তুলেছে।’’ (‘পুরোনো চিঠির ঝাঁপি’, পৃ-৩০)। ১৯৫৬-তে প্রকাশিত হয়েছিল শঙ্খদার প্রথম কবিতার বই ‘দিনগুলি রাতগুলি’। প্রায় ৬৫ বছর আগে। আমার হাতে পৌঁছানো ওঁর শেষ বইটি হল ‘এও এক ব্যথা-উপশম’ (২০১৭)। মনে হয়, আজও অতি পরিণত বয়েসে ওঁর কবিমন সমভাবে জেগে আছে যেমন ছিল সৃজনের প্রথম লগ্নে। কবিতা রচনার পেছনে স্মৃতির দ্যোতনাকে নিয়ে তিনি ‘কবিতার মুহুর্ত’ বইটিতে যা লিখেছেন তা পাঠ করলে ওঁর কবিতা খুব কাছ থেকে চেনা যায়। ওঁর গদ্যও কবিতার মতো! শঙ্খদার কবিতাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই, জানি। “যা বলার ছিল, বলা হয়নি সে কথা” (‘আরো একবার’। এও এক ব্যথা-উপশম)। তবে পড়শি এক অন্য ভাষার অনুজ কবি-ভাবে তাঁর কবিতা আমার চেতনায় যে রেখাপাত করেছে, তাকেই এই নিবন্ধে ধরে রাখার ধৃষ্টতা মাত্র করেছি। শঙ্খদা যে ভারতীয় কবিতায় বহুকাল ধরে চিরনূতনতার কবি হয়ে থাকবেন— শঙ্খমনা পাঠক, কবি ও আলোচকরা, আমি নিশ্চিত, এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন।