ভারে ও আয়তনে (খাড়াই ১২.১ সেমি, প্রস্থে ১৬.৬ সেমি, স্থূলতায় ২.৫ সেমি) বিপুল বইটির বাইরের সজ্জার রুচিমান খোলস ছাড়িয়ে বইটি খুলতেই চমকের পর চমক: প্রথমেই বিশাল পুস্তানি জুড়ে মঁসিয় ভের্দু ছবির শ্যুটিং প্ল্যানের দিনক্ষণ, উপকরণ, শিল্পীদের টিকমারা ছক; তারপর পাতা উলটোতেই, ফলস্ টাইট্ল্-এ বিজ্ঞপ্তি: “১০,০০০ কপি মাত্রে নির্দিষ্ট এই প্রথম মুদ্রণেই কেবল চার্লি চ্যাপলিন আর্কাইভ্স্-এ সংরক্ষিত সিটি লাইট্স্ ছবির মূল একটি ৩৫ মিমি প্রিন্ট থেকে কর্তিত ১২ ফ্রেম-এর দুর্মূল্য অংশটি যুক্ত হল,” পাশেই সেই ফিল্ম স্ট্রিপ। নীচে লেখা: “এটি বইয়ের ৪০০৬ সংখ্যক কপি।” ‘লিমিটেড’ তথা সীমিত সংস্করণে চিহ্নিত এই কপি সংখ্যাটা বইটির অনন্যতার অমূল্য সংকেত। চিত্রকলা-ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে গ্রন্থ প্রকাশে টাশেন-এর শিল্পমান ও মর্যাদা শ্লাঘনীয়। তবে এই বইটির সম্পাদনা ও বিন্যাসের জটিল দায় পালনে তাঁদের সার্থকতা প্রকাশনার ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
মঁসিয় ভের্দু ছবির শ্যুটিং প্ল্যান
চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন, একাধিক ভাষ্যে; তাঁর প্রামাণ্য জীবনী লিখেছেন ডেভিড রবিনসন। কিন্তু সারাজীবন তিনি সযত্নে আড়াল করে রেখেছেন তাঁর ছবি তৈরির প্রক্রিয়া। সাক্ষাৎকারে, বক্তৃতায়, সাংবাদিক সম্মেলনে অনেক কথা বলেছেন তিনি নিজের জীবন ও বিশ্বাস বিষয়ে; এত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, আলাপ ও সঙ্গ ঘটেছে তাঁর, তাঁরাও লিখেছেন, তাঁর সম্পর্কে; এই সব কিছু মেলালে চ্যাপলিনের যে জীবনচিত্র তৈরি হয়ে ওঠে, তা তাঁর জীবনী বা আত্মজীবনীর ধরাবাঁধা, সুবিন্যস্ত বৃত্তান্ত তথা পরিচিতি পেরিয়ে আরও বিস্তীর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর জীবন ও প্রতিটি ছবির নির্মাণ ভেঙে ছোটো ছোটো খণ্ডনথিতে আলোকচিত্র, চলচ্চিত্রের স্থিরচিত্র, তাঁর নিজের ও আশপাশের সঙ্গী-সহচর, প্রেমিকাদের লিখিত বা উচ্চারিত বয়ানে, চিত্রনাট্য বা দৈনিক শ্যুটিং-এর দিনলিপির পাণ্ডুলিপির প্রতিচ্ছবিতে, পোস্টারে, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বা চিত্রসমালোচনার প্রামাণ্য উদ্ধৃতিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পাদক পল ডানকান যেভাবে ৫৬০ বিশালাকার পৃষ্ঠায় গ্রন্থিত করেছেন, তাঁর সেই বর্ণময় চিত্রল জীবনালোকে পাঠচারণায় চ্যাপলিনের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম আশ্চর্য মহিমায় মূর্ত হয়ে ওঠে। ছবিতে, দলিলে, চ্যাপলিনের হস্তাক্ষরের প্রতিলিপিতে বারবার সান্নিধ্যের দুর্লভ উষ্ণতা আসে। পাশাপাশি সুশীতল ছাপা অক্ষরে স্বয়ং চ্যাপলিন সহ বহু স্বরের সাক্ষ্যে একটা দূরত্বও তৈরি হয়, নৈর্ব্যক্তিক বিচারের প্রেষণা দানা বাঁধে। ফলে এই বইটি অনুধাবন করাই একটা বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। দৃশ্যকল্পের বৈচিত্র্যে-বাহুল্যে মজে গিয়ে কেউ যদি এটি কফিটেবিল বই ধরে নিয়ে তুলে নেন, তবে তাঁর না পাওয়ার ক্ষতি অপরিমেয় থেকে যাবে। চ্যাপলিনের সব ছবি বহুবার দেখে, তাঁর আত্মজীবনী ও জীবনী পড়ে জেনেছিলাম/বুঝেছিলাম, যে দুটি নির্মম অভিজ্ঞতা তাঁর গভীরে আজীবন (ঠিক আজীবন নয়, ইউজীন ও’নীল-কন্যা উনার সঙ্গে ১৯৪৩ সালে বিবাহ থেকে আমৃত্যু দাম্পত্যে তিনি সাংসারিক স্থিতি ও শান্তি পেয়েছিলেন) পীড়িত করেছিল, ও সেই যন্ত্রণা থেকেই মুক্তির কামনা তাঁকে যে উদার মানবিকবাদে প্রাণিত করেছিল (তিনি যাকে আজীবন বারবার কেবল ‘বিউটি’ বা সৌন্দর্য বলেই চিহ্নিত করেছেন), সেই অভিজ্ঞতা দুটি ছিল দারিদ্র্যের ও নারী-পুরুষ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব-বিরোধ-বিপর্যয়ের।
(মাঝখানে) চার্লি চ্যাপলিন ও তাঁর স্ত্রী উনা ও’নিল। সন্তানেরা (বাঁ দিক থেকে ডান দিকে) জেরাল্ডিন, ইউজিন, ভিক্টোরিয়া, অ্যানেট, জোসেফিন ও মাইকেল। (১৯৬১ সালের ছবি)
বইটি শুরু হয় আত্মজীবনীর জন্য রচিত অথচ এ যাবৎ অপ্রকাশিত যে ভূমিকাটি দিয়ে, তার একটি অংশ তুলে দিচ্ছি: “একটা কথা আমাকে বলে নিতেই হবে যে সসম্ভ্রমে সভয়ে অনুসরণ করে চলব এমন কোনো নীতিবচনমালা আমি মানি না। আমি কোনো নিয়মবিধানে আস্থা রাখি না, কারণ সে তো অন্য কেউ লিখেছে। একজনের প্রজ্ঞা আর-একজনের ক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর হতেই পারে। প্রজ্ঞা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রেক্ষণেরই উত্তরফল, আর আমি তো সবসময় অন্য কারও মতো করে জীবনটাকে দেখি না। যে-কোনো নৈতিক সূত্রাবলির চেয়ে আমার অহংই আমার জীবন সম্পাদনা করে। আমি কোনোদিন এমন কোনো কাজ করব না যার জন্য আমাকে লজ্জা বোধ করতে হয়, কারণ আমাকে তো তাহলে ওই লজ্জা নিয়েই নিজের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে।
একটা জিনিস আমি জানি, দারিদ্র্য আমাকে কিচ্ছু শেখায়নি, বরং আমার মূল্যবোধকে তছনছ করে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে, জীবন সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি করে দিয়েছে; গরিবদের প্রতি করুণা আমার মনে আসেনি, কোনো সামাজিক বিবেকে আমি দীক্ষিত হইনি। যা ঘটেছে তা হল, শীতের রাত্রে টেম্স্-এর বাঁধের উপর নিদ্রিত নিঃস্ব মানুষদের দেখতে দেখতে আমার ইন্দ্রিয়বোধ যেন অসাড় হয়ে গেছিল। সেই অসাড়তার চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হয় যখন তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তার হাতে পাঁচ শিলিং ধরিয়ে দিয়ে কোথাও রাতের শয্যা ভাড়া নিতে বলি। বৃদ্ধা মুখ তুলে তাকায়, তারপর একটা শব্দ উচ্চারণ না করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।”
চ্যাপলিনের নিজের কথা, সহযোগীদের কথা, জীবনীকারদের কথা থেকে একের পর এক উদ্ধৃতি সাজিয়ে যে জীবনকথা এই বইটির সার বয়ান, তার একেবারে প্রথম উদ্ধৃতিটি চ্যাপলিনের: “এটা কোনো জীর্ণ বাস থেকে ঐশ্বর্যের চুড়োয় পৌঁছাবার কাহিনি নয়, বা কোনো হতদরিদ্র বালকের নিষ্ঠার গুণপনার বৃত্তান্ত নয়, বা একাগ্র দৃঢ় সংকল্পের জয়জয়কার নয়। দারিদ্র্য থেকে উঠে দাঁড়ানোয় কোনো মাহাত্ম্য নেই, আছে কেবল অযথা শক্তিক্ষয়ের গ্লানি। দারিদ্র্য স্বীকারে মর্যাদাহানি ঘটে ধরে নিয়ে তাকে হেসে উড়িয়ে দেবার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। দারিদ্র্য মানুষের ঘোর অবমাননা, প্রত্যেক জাতিতে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাকে নির্মূল করতে হবে। আমি দারিদ্র্য থেকে উঠে দাঁড়াতে পেরে কোনো গর্ব বোধ করি না। আমি যখনই আমার বাল্যের দারিদ্র্যের কথা লিখি, আমি ওই সময়টার সমালোচনা লিখি।”
বাল্য-কৈশোর ব্যাপী দারিদ্র্য তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল বাব-মায়ের মধ্যে বিরোধ, সেই সম্পর্কে ভাঙচুর, বারবার গৃহহীনতা, সরকারি দয়াদাক্ষিণ্যে দুঃস্থাবাসে কালযাপন ও শিক্ষা! কিন্তু তারই মধ্যে চ্যাপলিনের শিল্পীজীবনের উদ্বোধনের নাটকীয়তা যেন তাঁরই তৈরি যে-কোনো চলচ্ছবির বাস্তব ও মায়ার সেই অমোঘ যোগফল। চার্লি জননী হানা হিল তথা লিলি হার্লি (গ্রেট ডিকটেটর ছবিতে চ্যাপলিন অভিনীত ইহুদি ক্ষৌরকারের প্রেয়সীর নামও হানা—অভিনয় করেছেন পলেট গডার্ড) ছিলেন মিউজিক হলের পেশাদার গায়িকা-নর্তকী।
চার্লি চ্যাপলিনের মা হানা হিল (চ্যাপলিন)
বিবাহ-বিচ্ছিন্না হানার সঙ্গেই তখন চার্লির বাস। সান্ধ্য অনুষ্ঠানে বালক চার্লিকে সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর মা—বাড়িতে একা রেখে যাওয়া যায় না বলে। চ্যাপলিনের বয়ানে: “মা তখন বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ল্যারিনজাইটিস-এ ভুগছেন, তবুও নিয়মিত কাজে যেতে হচ্ছে। দিন দিনই গলা আরও খারাপ হচ্ছে। আমি উইংস-এ দাঁড়িয়ে শুনছি—একটা সময় গলাটা একেবারে ভেঙে ফিশফিশানি হয়ে গেল। দর্শকেরা প্রথমে হই হই করে হেসে উঠল, তারপর বেড়ালের ডাক! মাকে বাধ্য হয়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতে হল। স্টেজ ম্যানেজার অতীতে কখনও আমার মায়ের বন্ধুদের কাছে আমাকে গান করতে শুনেছেন। তিনিই অনন্যোপায় হয়ে স্থির করে ফেললেন, মায়ের জায়গায় আমাকেই তিনি মঞ্চে নামিয়ে দেবেন। আমার মনে আছে, তিনি আমাকে হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে গিয়ে দর্শকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলে আমাকে মঞ্চে রেখে ভিতরে চলে গেলেন। আমি গান ধরলাম, অর্কেস্ট্রা বেজে উঠল। গানের মাঝামাঝি পৌঁছেছি, এমন সময় দর্শকদের মধ্যে থেকে এক কাঁড়ি পয়সাকড়ি মঞ্চের উপর উড়ে এসে পড়তে থাকল। আমি গান থামিয়ে দিয়ে নিজেই ঘোষণা করে দিলাম আমি আগে আমার টাকাকড়ি তুলে নিই, তারপর আবার গাইব। তাতে দর্শকদের মধ্যে একটা হাসির দমক উঠল। স্টেজ ম্যানেজার একটা রুমাল হাতে মঞ্চে উঠে এসে মেঝে থেকে টাকা তুলতে আমায় সাহায্য করতে লাগলেন। আমার সন্দেহ হল, তিনিই আমার প্রাপ্য টাকাটা আত্মস্থ করবেন। আমার সেই সন্দেহের আঁচ পেয়ে দর্শকেরা আরও হইহই করে হাসতে লাগলেন, বিশেষ করে আমি যখন স্টেজ ম্যানেজারের পিছু পিছু মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলাম। ব্যাকস্টেজে যতক্ষণ না ম্যানেজার পুরো টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন, ততক্ষণ আমি মঞ্চে ফিরে আসিনি, তারপর এসে আবার গান ধরেছি। ততক্ষণে আমি বেশ সড়োগড়ো হয়ে উঠেছি, দর্শকদের সঙ্গে কথা বলছি, নাচছি, গান করছি, নানা মানুষের নকলনবিশি করছি, আমার মায়েরও। কোরাসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমি যখন মায়ের গলা ভেঙে যাওয়াটা হুবহু নকল করে দেখাই, তার প্রতিক্রিয়ায় আমি অবাক হয়ে যাই। আরও হাসি, আরও উল্লাস, আরও টাকা উড়ে আসে। শেষে মা যখন আমাকে নিয়ে যেতে মঞ্চে আসেন, তখন তাঁর উপস্থিতিতে ফেটে পড়ে বিপুল উল্লাস। সেই রাতেই আমার প্রথম মঞ্চাবতরণ!”
জীবননাট্য-মঞ্চনাট্যের এই সমীকরণ, শিল্পী মায়ের অসুস্থতাজনিত ব্যর্থতায় নির্মম দর্শকদের উপহাস কী করে পালটে যায় শিশুসন্তানের প্রতিভার দুঃসাহসী স্পর্ধিত উন্মোচনে, এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার মতোই তাঁর পরবর্তী লোকপ্রিয়, আপামর সাধারণ্যের অধিগম্য মিউজিক হল প্রমোদগীতাভিনয়ের কৈশোরক পেশায় চ্যাপলিন দর্শকসাধারণের আঁতের ভালো লাগা না লাগার স্বাদ ও শিক্ষা পেয়েছিলেন। সেই শিক্ষায় শিক্ষিত চ্যাপলিন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কমেডির দিক্নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৯৯-১৯১৩ মিউজিক-হল থিয়েটারে কাটিয়ে ১৯১৪ সালে চ্যাপলিন-এর সিনেমায় প্রবেশ। এই চার্লি চ্যাপলিন আর্কাইভ্স্ গ্রন্থে সেই পর্বের অসংখ্য আলোকচিত্র, পোস্টার ও স্মৃতিলেখমালায়, তাঁর প্রাক্চলচ্চিত্র সৃষ্টিকর্মের বিপুল সাক্ষ্যপ্রমাণ। স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর মন, তাঁর দর্শন, তাঁর কল্পনার নির্মাণ। এই পর্বে দেশবিদেশে অক্লান্ত সফরে দর্শকরুচির সঙ্গে তাঁর প্রতিদৈনিক আদানপ্রদানে তৈরি হয় যে জীবনবোধ, সেই জীবনবোধ আলোড়িত-আবর্তিত হয় এক ইতিহাসের টানাপোড়েনে। দুই বিশ্বযুদ্ধ সেই ইতিহাসের অঙ্গ, প্রত্যক্ষ সাক্ষী চার্লি চ্যাপলিন।
১৯২১ সালে মিউনিখবাসী উইলিয়ম ক্রচ তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি লিখছেন, “স্টিয়ের্শস্টাস্সে-তে প্রায়ই রাস্তায় একটি লোককে দেখি, কেমন যেন মনে হয় চ্যাপলিনের এক লড়াকু সংস্করণ, কারণ ওই মার্কামারা গোঁফ, হাঁটার লাফানে ধরন। তার হাতে সবসময়ই থাকে ঘোড়ার চাবুক। হাঁটতে হাঁটতে তার চাবুকের আস্ফালনে সে ক্রমাগতই যেন মুণ্ডু কেটে চলে। তাকে দেখে আমার এমন মজা লাগত যে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তার পরিচয় খুঁজে বার করলাম। আমার মুদির দোকানের মালিক জানালেন, লোকটার নাম অ্যাডল্ফ্ হিটলার এসেছে অস্ট্রিয়ার ব্রানাউ থেকে, এখানে ছোট্ট একটা পার্টি বানিয়েছে, নাম দিয়েছে জার্মান ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি।” আর অন্যদিকে ১৯১৭ সালের ১১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সমর দপ্তর সৈনিকদের চ্যাপলিনীয় গোঁফ রাখা নিষিদ্ধ করে আদেশ দেন, কারণ জার্মান কাগজপত্রে ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের চ্যাপলিনি গোঁফ নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রে টিটকিরি দেওয়া হচ্ছে! এমনই তথ্যসমাবেশে ধরা পড়ে গ্রেট ডিকটেটর ছবির ঐতিহাসিক প্রস্তুতি।
প্রযুক্তির একুশ শতকীয় উত্তরণের দাক্ষিণ্যে সহজেই যখন ইচ্ছে, চ্যাপলিনের যে-কোনো পর্বের যে-কোনো ছবি এখন স্মার্টফোনের ইউটিউব-এ দেখে নেওয়া যায়। দেখিও আমরা—নির্বাক পর্বের দু-রিলের ছবিগুলি থেকে শুরু করে দ্য গোল্ড্ রাশ (১৯২৫), সিটি লাইট্স্ (১৯৩১), মডার্ন টাইম্স্ (১৯৩৬) পেরিয়ে সেই পর্বে যখন কৌতুকের জগতের উপর ছায়া ঘনায় দ্য গ্রেট ডিকটেটর (১৯৪০), মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), লাইমলাইট (১৯৫২), এ কিং ইন নিউইয়র্ক (১৯৫৭), তাঁর একমাত্র রঙিন ছবি, সোফিয়া লরেন ও মার্লন ব্র্যানডো অভিনীত এ কাউনটেস ফ্রম হংকং (১৯৬৭) পর্যন্ত। দেখি আর ভাবি, কোন্টা তাঁর মহত্তম কীর্তি, এক একবার বাছি এক এক ছবি, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের এক একটা গর্বের অভিজ্ঞতা চিহ্নিত ভাবানুভবের নিরিখে, নয়তো ইতিহাসের যে মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁর এক একটা ছবি ফিরে আসে, আমাদের বর্তমানে অমোঘ স্থান করে নেয়। আবার কী আশ্চর্য সময়-সমীকরণে গোল্ড্ রাশ ও গ্রেট ডিকটেটর সমকালীন হয়ে যায়।
দুটি ছবিই আজ নতুন করে দেখতে গিয়ে দুটি মিলিয়ে যেন এক ইতিহাসপাঠই ঘটে যায়। গোল্ড্ রাশ-এ দারিদ্র্যের ভয়াবহতা প্রকট হয় তুষারাবৃত পাহাড়চূড়ায় তুষারঝড়ের মধ্যে সোনার খনির সন্ধানে দুই নিঃস্ব ভবঘুরের বিপন্ন অভিযানে—পায়ের জুতো সেদ্ধ করে তাতেই চারিয়ে ভোজ সারার মর্মান্তিক কৃষ্ণকৌতুকে, প্রকৃতি, বন্য পশু ও প্রাণধারণের চূড়ান্ত তাড়নায় আতঙ্ককেও কৌতুকের মাত্রায় জারিত করার দুর্লভ শিল্পকলায়।
এখানে দেখুন জুতো সেদ্ধ করে ভোজের দৃশ্যটি
আর্কাইভ্স্ গ্রন্থটিতেই এই শিল্পকলার নির্মিতি প্রথম প্রকাশ হয়। পূর্ব-প্রস্তুত চিত্রনাট্য নিয়ে এ-ছবির কাজ শুরু হয়নি। সহযোগীদের নথি সাজিয়ে এই বইয়ের সম্পাদকেরা দেখিয়ে দেন কীভাবে মিউজিক হল-এ অবাধ পরীক্ষানিরীক্ষার রীতি মেনেই এক একটি দৃশ্য ধরে যেমন তৎক্ষণাৎ মনে হয় সেইভাবেই ছবিতে তুলে ফেলে, একটা পর্ব পূর্ণ হলে একসঙ্গে সবটা দেখে নিয়ে প্রয়োজনমতো সংস্কার বা কিছুটা ফেলে দিয়ে আবার একেবারেই নতুন করে তোলেন, এই পদ্ধতিতে ছবিতে তুলে ফেলা কত সম্পূর্ণ দৃশ্য পুরোপুরি বর্জিত হয়, কাহিনির বিবর্তনেই কত অদলবদল ঘটে যায়। ‘রি-টেক’-এর অন্ত ছিল না। এডিটিং টেবিল-এ বসে ছবি সংস্কার-সম্পাদনার দুটি পৃষ্ঠা এই বইয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেটিতে রি-টেক-এর তালিকা দেখলে বোঝা যায় অভিনেত্রী জর্জিয়া হেইলের কথার যাথার্থ্য: “তিনি তাঁর পরিচালনায় থাকতেন শতকরা একশো ভাগ আবিষ্ট। তাতে কত সময় লাগবে, কত রি-টেক নিতে হবে, কত অর্থ ব্যয় হবে, তাতে তাঁর কিছুই যেন আসে যায় না। কোনো ছবি তৈরি করতে যদি পাঁচ বছরও লেগে যায়, তাঁর লক্ষ্য, ছবি যতটা সম্ভব নিখুঁত হবে। তিনি সবসময়ই বলতেন, তুমি কখনোই পুরোপুরি নিখুঁত করতে পারবে না, যা চেয়েছি তার পঞ্চাশ শতাংশ পেলেই আমি খুশি।”
যেন মিউজিক হল-এর একটার পর একটা অণুপর্ব—গ্যাগ—হালকা সুতোয় জুড়ে কাহিনি রচনার সেই রীতি যা কিড বা গোল্ড্ রাশ-এর মতো ছবির চরিত্রস্বরূপ, তার থেকে একটা বড়ো রকম উত্তরণ ঘটে দ্য গ্রেট ডিকটেটর-এ—চ্যাপলিনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রে—ছবির পোস্টারে বড়ো হরফে লেখা হল—‘He talks… ’ তার এগারো বছর আগে চলচ্চিত্র সবাক, ধ্বনিময় হয়ে গেছে, চ্যাপলিন তার মায়ার কাছে ধরা দেননি।
আর্কাইভ্স-এ প্রকাশ, চ্যাপলিন একটুকরো কাগজে লিখে রেখে গেছেন, “এই আমার প্রথম ছবি যাতে কাহিনিটা ছোটোখাটো ভবঘুরের চেয়ে মাপে বড়ো।” বড়ো তো হবেই, একে তার ঐতিহাসিক বিস্তার, প্রথম মহাযুদ্ধের প্রথম বোমারু বিমানের আক্রমণের মুখে খাদের মধ্যে সিঁধিয়ে যুদ্ধকৌশলে ছবি শুরু, তার চূড়ান্ত পরিণতি ইহুদি-দ্বেষে বর্বর হিটলারের উদয়ে, সৈনিক-ক্ষৌরকার সেই ভবঘুরে এই ইতিহাসের সহযাত্রী। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক ধার। চ্যাপলিন নিজেই বলেন, “আমি যাতে সবচেয়ে মজা পাই, তা হল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বুজরুকদের উপহাসে জর্জরিত করে। যত বড়ো বুজরুক ধরা যায়, ততই আরও মজার ছবি করার সুযোগ। হিটলার-এর চেয়ে বড়ো বুজরুক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।” ছবিতে প্রথম কথা বলার সুযোগ পেয়ে চ্যাপলিন তাঁর ছবি শেষ করেছিলেন এক সরাসরি ভাষণে, যার মানবিকবাদী আবেদন চ্যাপলিনের কৌতুকের ঠাটের আড়ালে নিহিত তাঁর জীবনভাবনাকে তুলে ধরেছিল, সেই প্রথমবার। সযত্নে সংগৃহীত দলিলপত্র, তথ্যনথি, শিল্পী-শিল্প নির্দেশক যে রাসেল স্পেনসার-এর আঁকা দৃশ্যপরিকল্পনা ইত্যাদির সমাবেশে আর্কাইভ্স্-এ নথিবদ্ধ হয়ে আছে দ্য গ্রেট ডিকটেটর-এর প্রস্তুতির ইতিহাস তথা সমকালীন ইতিহাস পাঠের আশ্চর্য দলিল।