গত প্রায় ১২ দিন ধরে আমি হতাশ, প্রতারিত ফ্ল্যাট ক্রেতাদের সমস্যা নিয়ে পাঁচটা ডেডিকেটেড প্রাইম টাইমের সিরিজ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিলাম, কিন্তু তার বাইরেও, কিছু একটা আমাকে ভেতর থেকে টেনে ধরে রাখছিল।
ইতিমধ্যে, জেপি ইনফ্রাটেক আর আম্রপালী গ্রুপের দয়াদাক্ষিণ্যে টিকে থাকা ৭০,০০০ ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের দুর্দশা পর পর মূলধারার খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হয়ে চলেছিল।
যদি আমি এই খবরের কাগজগুলোর প্রচারসংখ্যা পরপর যোগ করি, সেই সংখ্যা এই দিল্লি এবং তার আশেপাশের এলাকার এক বিশাল সংখ্যক বাসিন্দাকে কভার করবে। এই কাগজগুলোর কিছু কপি নিশ্চয়ই আমলা এবং মন্ত্রীদের টেবিলেও কিছু সংখ্যায় পৌঁছে যাচ্ছে। আর যে সমস্ত হোমবায়ার এই দুর্গতির শিকার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সরকারি কর্মচারিও রয়েছেন।
মিডিয়ার হাতে যদি কিছুমাত্র ক্ষমতা অবশিষ্ট থেকে থাকে, তা হলে এই সমস্ত মূলধারার খবরের কাগজে প্রকাশিত এই ঘটনার কভারেজের একটা ভালো রকমের অভিঘাত হত দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশে। প্রাইমটাইম টেলিভিশন কভারেজের কোনও দরকারই হত না। প্রতারিত ফ্ল্যাট-ক্রেতাদের এই দুর্দশা, সমাবেশ এবং মীটিং গত দু তিন বছর ধরেই নিয়মিত কভারেজ পেয়ে আসছে।
এর মধ্যেই, কেন্দ্রীয় সরকার, এমনকি সমস্ত রেসিডেন্সিয়াল এবং বাণিজ্যিক প্রপার্টির জন্য রিয়েল এস্টেট (রেগুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) অ্যাক্ট ২০১৬ নামে একটা আইনও পাস করিয়ে নিয়েছে, যেটা পয়লা মে ২০১৭ থেকে চালুও হয়ে গেছে। কিন্তু এই আইন দুর্দশাগ্রস্ত ফ্ল্যাট ওনারদের সমস্যা সমাধানে কতটা কার্যকরী হয়েছে, সে ব্যাপারে সরকারি বিজ্ঞাপন একেবারেই নীরব। এই আইনের বলে, ঘা খাওয়া মধ্যবিত্ত ভারতীয় নাগরিক কতটা বলীয়ান হল তার পয়সায় কেনা ফ্ল্যাটের চাবি পাবার ব্যাপারে, সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত একজনও মন্ত্রী একটিও টুইট করেন নি।
স্বাভাবিকভাবেই, নিউজ চ্যানেলগুলোও তাদের সাধ্যমত আম্রপালী আর জেপির কেসগুলো কভার করে চলেছে, ন্যাশনাল ওয়াচডগদের গলার বকলস ধরে সর্বশক্তিতে ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছেন নিউজ অ্যাঙ্করেরা। যদিও, সাংবাদিকতার নৈতিক মাপকাঠিটি আমাদের সময়ের অন্য অন্য গণতান্ত্রিক সম্পদগুলির মতই ভেঙেচুরে গেছে অনেকদিনই – তবুও, এই মিডিয়া যতই মহীয়ান সম্রাটের পদতলে নতজানু হয়ে থাকুক, সাধারণ মানুষ একে তাঁর মাথার মুকুট হিসেবেই দেখে এবং সেলাম ঠোকে।
খুব তাড়াতাড়িই মিডিয়া তাদের নজর আম্রপালী আর জেপির গল্পের থেকে সরিয়ে আনল সেই হান্টিং গ্রাউন্ডে, যেখানে তাদের আলোচ্য মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটের ক্রেতাটি তার সন্ধ্যে কাটায়। আমি এই শিকারের একটা নাম দিয়েছি – ‘হিন্দু-মুসলিম ইস্যু’।
মধ্যবিত্তদের ন্যূনতম ধারণাও নেই যে তারা দিনের পর দিন সন্ধ্যের টেলিভিশন শো-গুলোর মাধ্যমে কীভাবে তাদের “দ্য পিপল” হয়ে ওঠার মূল ভাবনাটাকেই বিসর্জন দিয়ে চলেছে।
সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক চেতনাই তখন হাস্যকর হয়ে ওঠে, মানুষ যখন প্রতিবাদ সমাবেশের বদলে যাগযজ্ঞ করে। কয়েকদিন আগেই নয়ডার আম্রপালী গ্রুপের কর্পোরেট অফিসের সামনে প্রতারিত ক্রেতারা এক যজ্ঞের আয়োজন করে। সম্ভবত সেই যজ্ঞের পুরোহিতও ছিলেনএকই সমস্যার শিকার।
ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের এর চেয়েও বড় একটা গ্রুপ – যারা কোনও না কোনও সময়ে আম্রপালী গ্রুপ বা জেপি ইনফ্রাটেক জাতীয় রিয়েল এস্টেট সংস্থার মাধ্যমে কোনও না কোনও ভাবে প্রতারিত বা হ্যারাসড হয়েছেন, তাঁরাও তাঁদের মত করে প্রতিবাদ সমাবেশে বসছেন। কয়েকদিন আগে আমি টেবিল গোছানোর সময়ে যখন কিছু পুরনো খবরের কাগজ গোছাচ্ছিলাম, আমার চোখ পড়ল এই রকমই একটা সমাবেশের ছবির ওপর, দিল্লির জন্তর মন্তরে।
ছবিটায় কিছু একটা ছিল যা অনেকক্ষণ আমার নজর ধরে রেখেছিল। এই লোকগুলি রাজনীতিকদের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী বানিয়েছে, আর নিজেদের বানিয়েছে ভিখারীরও অধম, যেখানে একটা গণতান্ত্রিক দেশে তাদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কল্পনা করা হয়েছিল, যে তারা হবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎনিয়ন্তা।
এই যদি অবস্থা হয়, তা হলে তারা কেন ধর্ণায় বসছে? মিডিয়ার ক্ষমতা কমে গেছে বলে, নাকি জনতার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে?
সত্তর হাজার ফ্ল্যাটের ক্রেতা – তাদের অনেকগুলো আইডেন্টিটির মধ্যে এটাও একটা। তবে এই আইডেন্টিটিটাই যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার নাম মিশ্র, আগরওয়াল, যাদব, শাহ না মোদী – সেগুলো কোনও অর্থই আলাদা করে বহন করে না। ফ্ল্যাটের ক্রেতারা রিয়েলটি সেক্টরের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে গণ্য হয়, যে সেক্টর চালিত হয় অর্থলোভী রাজনীতিক, অফিশিয়াল এবং বিল্ডারদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে।
গত বছরেও প্রাইম টাইমে আমরা নিয়মিতভাবে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছিলাম। শুধু আমরাই নয়, চ্যানেলের পর চ্যানেলে, মধ্যবিত্তের সান্ধ্যকালীন অবসরযাপনে, আমাদের এই প্রিয় দেশের অ্যাঙ্করেরা এই বিষয়ে তাদের পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছিলেন, সর্ব সময়ে এই মধ্যবিত্ত দর্শক শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় তাঁদের নিজেদের ধরে রাখার একটা দায় ছিল। এবং তার কিছুদিন পরেই তাঁরা ফিরে গেছিলেন তাঁদের সেই চিরাচরিত হিন্দু-মুসলমান টপিকে। অন্যদিকে, মাসের পর মাস ফ্ল্যাটের ক্রেতারা প্রতি রবিবার নয়ডা আর গ্রেটার নয়ডা এলাকায় বিল্ডারদের অফিসের বাইরে বসে ধর্ণা সমাবেশ করতেন। কিন্তু কিছুই বদলায় নি।
মধ্যবিত্ত নাগরিকরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেন না যে তাঁরা তাঁদের জনতার আইডেন্টিটিকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যেবেলার টেলিভিশনের উপচারের অনুষঙ্গে বদলে ফেলছেন, দিনের পর দিন ধরে। অ্যাঙ্কররা এই জাতীয়তাবাদী উপচারের নতুন পুরোহিত। জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে তাঁরা উপস্থিত সবাইকে নিজের আইডেন্টিটি বিসর্জন দেবার আহ্বান জানান।
জনতার হাতে যত বেশি ক্ষমতা থাকে, গণতন্ত্র তত বেশি শক্তিশালী হয়। জনতার আইডেন্টিটি হারিয়ে ফেললেই আপনি মহাশক্তিধর সেই সিস্টেমের ক্ষমতার সামনে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন – হ্যাঁ, সেই সংখ্যালঘু, যার মৃত্যুতে আপনি আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠেন। এই হাততালি দিতে দিতে আপনি ভুলে যান যে, আপনিও সেই সংখ্যাগুরুর শক্তির সামনে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছেন।
আমি সেই সংখ্যালঘুদের স্পষ্ট দেখতে পাই – সত্তর হাজার ফ্ল্যাটের ক্রেতা, কয়েক লক্ষ শিক্ষা-মিত্র, কর্মহীন বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষাকর্মী, সুরাতের লক্ষ লক্ষ কাপড়ের ব্যবসায়ী আর কোটি কোটি কৃষক। এঁরা সকলেই সংখ্যাগুরু – সংখ্যার হিসেবে, কিন্তু ক্ষমতার অসম বণ্টনের মাধ্যমে তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যান।
আর এই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার কারণেই, এত প্রতিবাদ প্রতিরোধ ধর্ণা সমাবেশের পরেও – তাঁদের সমস্যার কোনও সমাধান হয় না। আম্রপালী গ্রুপ আর জেপি ইনফ্রাটেকের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা তাই যখন জানান যে তাঁরা যাগযজ্ঞ করছেন কারণ ভগবানের দয়া ছাড়া আর তাঁদের কাছে কোনও আশা নেই, তাঁরা সেই মুহূর্তে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তাঁরা ভারতের মহান জনগণতন্ত্রের মূল শক্তি, জনতা – ‘দ্য পিপল’ -এর ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।
তাঁরা যদি দ্য পিপল হতেন, তাঁরা রাজনীতিকদের নামে শ্লোগান দিতেন, ভগবানের শরণ নিতেন না। মিডিয়া একটা ধারণা প্রচার করছে যে এই ঘটনাক্রম নাকি আগামী দু বছরের ভোটের ফলাফল নির্ধারিত করে ফেলেছে। ভক্তির আতিশয্যে লোকে সেই খেলার অংশও বনে যাচ্ছে।
তাঁদের কোনও ধারণাই নেই যে এই সব আচরণের মাধ্যমে তাঁরা ‘দ্য পিপল’ হবার অন্তর্নিহিত শক্তিকে রাজনৈতিক শক্তির আগুনে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন, যার ফলে দর কষাকষির ক্ষেত্রটাই সমকুচিত হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিকদের কানে নিজেদের অভিযোগ পৌঁছে দেবার জায়গায় তাঁরা ভজন আর যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতার কানে সেগুলো পৌঁছনোর ব্যবস্থা করছেন, আজকের দিনে গণতন্ত্রে এর চেয়ে বেশি লজ্জাজনক আর কী হতে পারে! তাঁদের কি প্রতিবাদ প্রতিরোধ পথসভায় দোষী রাজনীতিকদের নাম ধরে শ্লোগান দেবার ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে গেছে – সেই রাজনীতিকদের, যাদের ছত্রছায়ায় থেকে বিল্ডাররা আশ্বস্ত বোধ কর্ আর ভাবে, তারা যে কোনও কীর্তি করে আইনের লম্বা হাত থেকে অনায়াসে নিস্তার পেয়ে যাবে?
লোকগুলো মিশে গেছে সেই নেতাদের ছায়ায়। মানুষ যখন নিজেই কোনও নেতার ছায়ায় পরিণত হয়, তখন সে আসলে সেই নেতার একটা কাটআউটে পরিণত হয়ে দাঁড়ায়, তার বেশি কিছু নয়।
আমার সমস্যা হচ্ছে, আমার সারাদিন কেটে যায় অসংখ্য ফোন কলে। সুরাতের কাপড় ব্যবসায়ী যখন ফোনের অন্যপ্রান্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন, আমি বুঝতে পারি না আমার কী বলা উচিত, কী করা উচিত। এই যে আমার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়া সমস্ত সমস্যা আমি নিজে কভার করে উঠতে পারি না – এই অপরাধবোধ আমায় কুরে কুরে খায়। আমার সেই লোকবল বা ব্যক্তিগত ক্ষমতা নেই সে সব কভার করবার মত।
দিনে ১০-১২টা ফোন কল যখন আমি অ্যাটেন্ড করি, আমার মনে হয় না যে আমি মানুষের সাথে কথা বলছি। যখন সেই সমস্ত লোকগুলো ভোটের ফল বেরোবার আগেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করে দেয় বিজয়ী দল হিসেবে, তখন সেই রাজনৈতিক দল কেন মাথা ঘামাবে আর, এদের সমস্যা নিয়ে?
আমি শুনতে পাই যে আমি নাকি টিআরপির দৌড়ে অনেক পিছিয়ে আছি। যেখানেই থাকি, আমি যদি দিনে এতগুলো করে ফোন কল পাই, তা হলে যে সমস্ত নিউজ অ্যাঙ্কররা ভারতের ৪০-৭০% এলাকা কভার করেন, তাঁরা তা হলে দিনে কতগুলো করে ফোন কল পান?
ঝাড়খণ্ডের চাতরা থেকে গুজরাতের আশা কর্মী থেকে সারা ভারতের রেডিও ঘোষকরা, এরা সবাই অস্থায়ী পদে কাজ করেন। আমি এদের কাছ থেকে এত ফোন কল পাই, মাঝে মাঝে আমার চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি নিয়মিত এই ধরণের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাই – “গত আটদিন ধরে রাজস্থানের প্রায় ৫৭,০০০ কর্মচারী ধর্মঘট করছেন, আপনিই একমাত্র আমাদের আওয়াজ তুলে ধরতে পারেন, প্লিজ কিছু করুন”। কখনও কখনও প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যাই, পরক্ষণেই অপরাধবোধ এসে গ্রাস করে নেয় সেই বিরক্তিকে।
আমি নিউজ চ্যানেল দেখি না; হয় তো তারাও একই বিষয় কভার করে। যদি তাইই হয়, কেন তবে সেই সমস্যাগুলোর কোনও সমাধান হয় না? আমার যদি মনে হয়, তারা যখন সরকারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তারা আর ‘দ্য পিপল’ থাকে না – সেটা কি ঠিক মনে হওয়া? তারা তখন শুধু একটা গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয় – একটা হিন্দু গোষ্ঠী বা মুসলমান গোষ্ঠী। হিন্দু গোষ্ঠীর মধ্যে আবার আরও দল তৈরি হয়, উচ্চবর্ণের দল, নিম্নবর্ণের দল, দলিতের দল। মুসলমানদের গোষ্ঠীতে তৈরি হয় শিয়া দল, সুন্নী দল।
মানুষ মানুষের সমস্যার প্রতি উদাসীন হয়ে থাকে, এটাই কি কারণ যার জন্য কোনও সমস্যার সমাধান হয় না? এই যে ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের দল, তাঁরা যখন পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর খবর শোনেন, অথবা গ্রামীন সমস্যায় জেরবার কৃষকদের বিক্ষোভের কথা শোনেন, তখন তাঁরা কি বিচলিত হন? তাঁরা কি কৃষকদের আত্মহত্যার খবরে বিচলিত হন? ক্রমবর্ধমান বেরোজগারি কিংবা বিভিন্ন দাবিদাওয়া সমেত যাঁরা প্রত্যেক দিন জন্তর মন্তরে ধর্ণায় বসেন, তাঁদের জন্য কি এঁরা এতটুকুও চিন্তা করেন?
মধ্যবিত্ত ভারতের এই নাগরিকেরা কখনও সামান্য চিন্তা করেছে একজন মেধা পাটকরের জন্য, যিনি দিনের পর দিন নর্মদা বাঁধের কারণে ঘরহারা মানুষদের জন্য অনশন করেছেন? এর উত্তরগুলো পেলেই বোঝা যাবে জন্তর মন্তরে ঘটা করে ‘হবন’ বা যজ্ঞ করাটা কতটুকু অর্থ বহন করে।
কিছুদিন আগে আমি গান্ধীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট পি রাজাগোপালের একটা ইন্টারভিউ পড়ছিলাম, ডাউন টু আর্থ ম্যাগাজিনের হিন্দি সংস্করণে। সাংবাদিক অনিল অশ্বিনী শর্মা গত এক দশকে বিভিন্ন ইস্যুতে আদিবাসীদের সাথে দিল্লিতে বেশ কয়েকবার লং মার্চ করেছেন। সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য যা ছিল, ক্ষমতার অলিন্দে আদিবাসীদের দুঃখ দুর্দশার কথা পৌঁছে দেওয়া, সেই কাজে তিনি সফল হতে পেরেছিলেন কিনা।
সত্যাগ্রহ মানে সত্যের মধ্যে থেকে জন্ম নেওয়া শক্তি। ২০০৬ সালে আমার একটা পদযাত্রা প্রচুর সাড়া জাগিয়েছিল। ২০০৭এর পদযাত্রায় ২৫০০০ আদিবাসী কৃষক আমার সাথে পা মিলিয়ে হেঁটেছিল। এই যাত্রায় একটা লাভ হয়েছিল, ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট চালু হয়েছিল, এবং আমি এটা বলতে পারি এই আইনের ফলে ষাট লাখ মানুষ নিজেদের পায়ের তলায় জমি পেয়েছিল। তার পরের পাঁচ বছরে যখন কিছুই হল না, আমরা এক লাখ লোক নিয়ে যাত্রা করতে প্রস্তুত হলাম। জয়রাম রমেশ জানতেন, যদি এক লাখ লোক পদযাত্রা করে দিল্লিতে ঢোকে, সেটা সরকারের কাছে একটা বিপজ্জনক বার্তা নিয়ে যাবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বললেন এবং আমাদের পদযাত্রা যখন আগ্রা পৌঁছলো, তিনি নিজে সেখানে পৌঁছে একটা দশ পয়েন্টের এগ্রিমেন্টে সই করলেন। সত্যাগ্রহীদের কাছে এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার কখনও এক লাখ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও এগ্রিমেন্টে সই করে নি।
এবার আত্মসমীক্ষা করার পালা আম্রপালী আর জেপি-র সেই ফ্ল্যাট ক্রেতাদের, সুরাতের কাপড় ব্যবসায়ীদের, হাজার হাজার রেলওয়ে অ্যাপ্রেন্টিস কর্মীদের, আশা কর্মীদের, আর কর্মহীন শিক্ষাকর্মীদের, তাঁদের আন্দোলনে কি সত্যের থেকে জন্ম নেওয়া সেই শক্তি আছে? আদিবাসীরা যেখানে সংগ্রামের পথ ধরে জয় লাভ করতে পেরেছিল, সেখানে শিক্ষিত ক্ষমতাশালী মধ্যবিত্তরা কেন হেরে যাচ্ছে? কেন তাদের সংগ্রামের শুরু আর শেষ হয় কেবল মিডিয়া কভারেজের মধ্যেই, তার বাইরে আর কোথাও তা আলোড়ন তৈরি করে না?
যতদিন না হাজারো দুর্দশাগ্রস্ত ফ্ল্যাটের ক্রেতারা এই প্রশ্নের যোগ্য জবাব না খুঁজে পান, ততদিনের জন্য আমি তাঁদের একটা উপদেশ দেব – খালি পায়ে হেঁটে নয়ডা থেকে জন্তর মন্তরে যান, পুরো ৭০,০০০ জন মিলে, একবার নয়, বার বার। শুধু নিজেদের দাবি পূরণের জন্য নয়, জনগণ হিসেবে নিজেদের ক্ষমতা বুঝে নেবার জন্য হাঁটুন। সত্যের থেকে জন্ম নেওয়া সেই শক্তি আপনাদের সংগ্রামকে উদ্দীপিত করুক।
মিডিয়ার ওপর আশা হারাবেন না, সেই মিডিয়া যাকে আপনি এক হাতে ধ্বংস করে দেবার সংকল্প পোষেন মনে মনে। সেই মিডিয়া, যা ক্ষমতাশালী সম্রাটের পদতলে চিরকালের জন্য অবনত – যার আপনার জন্য আর কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই।
মিডিয়াকে আপনার দুর্বলতার জায়গা বানিয়ে তুলবেন না।
হাঁটুন। খালি পায়ে।