পর্ব-১
বরাক উপত্যকা তুমি কার? কেন বিজেপির ! বরাক নদী তুমি কার? কেন বিজেপির ! নমামি বরাক তুমি কার? বিজেপির ! নদী উৎসব তুমি কার? বিজেপি, বিজেপির ! কাছাড় কাগজকল তুমি কার?
এ আবার কেমন প্রশ্ন? কিসের সঙ্গে কী, পান্তাভাতে ঘি। কাছাড় কাগজকল কারও নয়, অনাথ। নাথবতী অনাথবৎ।
আমাদের সদ্য যৌবনে এই কাগজকল গড়ে উঠতে দেখেছি। তখন শুনেছিলাম এশিয়ার বৃহত্তম কাগজকল হতে চলেছে আমাদের গর্বের এইচ.পি.সি,পাঁচগ্রাম। একটা ধুঁকতে থাকা চিনি কল ছাড়া আমাদের কর্মসংস্থানের একমাত্র ভরসাস্থল তখন এই কাগজকল। বিজেপি তখনও জন্মায়নি। আমাদের যৌবনের স্বপ্নস্থল পাঁচগ্রাম পেপার মিল। একটা মিলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে একটা জনপদ। তার যাপন ক্রিয়া।
আজ চোদ্দমাস হতে চললো পেপার মিলের কর্মীরা মাইনে পায়না। অন্নচিন্তা চমৎকারা। চোদ্দমাসের কপর্দক শূণ্যতা সহস্রাধিক সংসারকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জনপদ ধ্বস্ত। রাঙা অধর নয়ন কালো, ভরা পেটেই লাগে ভালো। এত দিনের স্বপ্ন ভেঙ্গে চূরচূর। এক্সোডাস শুরু হয়ে গেছে। এই অশণি সংকেত সূদূর কল্পনাতেও ছিল না কাগজকল ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদের। উজার করে তারা ভোট দিয়েছে, ক্ষমতায় এনেছে বিজেপিকে। তারপরই বন্ধ হয়ে গেল পাঁচগ্রামের মিল কর্মীদের মাসমাইনে। প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি, তারপর আশার ছলনে ভুলি....। শুধু কর্মহীন স্টাফদের হিসেব নিলে চলবে? ক্যাজুয়াল কর্মী রয়েছে আরও সহস্রাধিক। তাদের উপার্জন বন্ধ ষোল মাস। তাদের ঘিরে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য দোকানী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এক্সোডাস, এক্সোডাস। রোজ শোনা যাচ্ছে মিল বিক্রী হয়ে যাচ্ছে প্রাইভেট চত্বরে। তারা যে পুরোনো কর্মীদের বহাল রাখবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর সরকারের হাতে মাসমাইনের টাকাটুকুও নাকি অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু নমামি বরাক নদী উৎসব? সেটি কীভাবে সম্পন্ন হবে? এর আগে হয়েছে নমামি ব্রহ্মপুত্র। সেখানে কোটি কোটি টাকা উড়েছে। এবারে নমামি বরাক। এখানেও কোটি কোটি টাকা ওড়ার গল্প। শুধু থিম সং বানাতেই শোনা যাচ্ছে ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় হচ্ছে। কাগজকলের কর্মীরা মাত্র কুড়ি কোটি টাকা ধার চেয়েছিল বিজেপি সরকারের কাছে, কয়েকমাসের মাইনের জন্য। বেঁচে থাকতে হবে তো। কিন্তু সরকারের তো টাকা নেই। উপত্যকার রাস্তাঘাট চলাফেরার অযোগ্য। একদিকে বিদেশী বিতাড়ণ যজ্ঞ, এন.আর.সি, ডিটেনশন ক্যাম্প। অন্যদিকে নিরন্ন অভুক্ত শ্রমিক কৃষকও তাদের পরিবার। কিন্তু নদী উৎসব চাই। এর পাশাপাশি যদি একটা নমামি মোদী উৎসব লাগিয়ে দেওয়া যেতো, জমে যেতো। সর্বে দুঃখানি নিরাময় সন্তু, সর্বে আনন্দ (সর্বানন্দ) ভবন্তু।
নমামি মোদী, নমামি নদী।
পর্ব-২
অনেককাল আগে,পাঁচগ্রাম স্টেশনের ঠিক পাশেই ছিল বি.এস.এফের ক্যাম্প। সেখানে আমি আর আমার প্রাণের বন্ধু বিশ্বরূপ যেতাম টিটি খেলতে। আশে পাশের কোথাও তখন টিটি বোর্ড ছিলনা বি.এস.এফ ক্যাম্প ছাড়া। আমাদের মাথায় তখন ড্রাগোটিন সুরবেক ভর করেছে এবং কম্যাণ্ডার অতি উৎসাহী দুটো সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণকে প্রচুর দূর অবধি অ্যালাও করতেন। পাঁচগ্রাম পাহাড় তখন জঙ্গলে ভর্তী এবং মাঝেমাঝে ফেঁচি বাঘ বেরিয়ে কলোনী থেকে ছাগলটা মুরগীটা খেয়ে পালিয়ে যেতো।
হনুমানকুল তখনও বদরপুরে নামেনি। রাজনীতি বলতে কংগ্রেস, কংগ্রেস এবং ছুটকোছাটকা সিপিএম।
সেই বি.এস.এফের ক্যাম্প একদিন উঠে গেল। শুরু হলো পেপার মিলের যুগ। পাহাড় কেটে টাউনশিপ আর নীচের এবরোখেবরো মাটি সমান করে মিল তৈরী শুরু হলো। সেই প্রথম আমাদের পে লোডার দেখা। আমাদের বয়সে বড় বন্ধুরা, বয়সে ছোট বন্ধুরা, সব হৈহৈ করে ঢুকে পড়লো মিল কর্মী হয়ে। আর বাইরে থেকে দলে দলে কর্মী আসতে লাগলো ভিন জেলা, ভিন রাজ্য থেকে। তাদের কেন্দ্র করে দোকান হাটবাজার ভোগ্য পণ্য বিলাস, তাদের ঘিরে পাহাড়ের ঢালে ঢালে আলোকমালায় সাজানো টাউনশিপ, শিফটের বাস, কারখানার ভোঁ, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়। ছোটবড় মিলে অজস্র বন্ধু। আমি পেপার মিলে কোনদিন রাজনীতি করতে যাইনি। প্রায়ই যেতাম নিখাদ আড্ডা মারতে। সবাই মন খুলে, প্রাণের কথা বলতো। অনেক গূহ্য সত্যকথন।
সে সত্যকথন দুএকটা ল্যাংড়া কাগজে লেখা ছাড়া কাউকে বলিনি। আজ বলবো। বলবো যে কাছাড় পেপার মিল চালু হয়েছে অশুভ রাজনীতির ঔরসে এবং আজ যে দুর্নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে মিল বন্ধ হয়ে যাবার কারণ হিসাবে, সেই দুর্নীতির পাঁকেই তার জন্ম। সেই অর্থে এই মিল পঙ্কজ। কাগজকলের কর্মীরা সবাই দুর্নীতির ঊর্ধে সেটা প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তাদের ক্ষমতা কতটুকু। সাপ্লায়ারের কাছ থেকে কাটমানি খাওয়া একটি ভারতীয় অসুখ। কোনও ক্ষেত্র তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সমস্যা অন্যত্রে। সেটা প্রথমে অনুধাবন করা দরকার। হাজার হাজার কোটি টাকা যে মিল মুনাফা দেয়, যে দুটি মিলের মিলিত প্রোডাকশন টার্গেট বছরে দু লাখ টন সেই মিল দুটি সারা ভারতবর্ষের পেপার ইনডাষ্ট্রিতে যে সুনামি এনে দেওয়ার কথা ছিল, তার তোড়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন কাগজকলগুলির পঞ্চত্ব প্রাপ্তির কথা। অতএব জন্মাবধি মিলদুটিকে লড়তে হয়েছে, বিশেষতঃ কাছাড় পেপার মিলকে, ( তার ভৌগলিক অবস্থানগত দুর্গমতার কারণে ) সারা ভারতের পেপার লবির বিরুদ্ধে। তাদের বাহুবল এবং অর্থবলের বিরুদ্ধে এই পেপার মিলকে বাঁচিয়ে রেখেছে মিল শ্রমিকরাই।
কাগজকলের দুর্নীতির দুটি পর্যায়, একটি উচ্চতর (অদৃশ্যপ্রায়), অন্যটি ক্ষুদ্রতর এবং দৃশ্যমান। আজ বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা ঘটা করে নদী উৎসব করছেন, ঘোষণা করছেন এবার বরাকে ড্রেজিং শুরু হবে এবং তারপরেই নদীপথে বাণিজ্য চালু, তখন আমাদের মত কিছুই ভুলিনা শ্রেণীর কিছু মানুষের মনে পড়ে যায় কাগজকলের প্রথমভাগে কয়েকশো বার নদী খননের কথা উঠেছে, এবং জলপথে পরিবহনের ফলে কাগজকলের সোনালী ভবিষ্যতের কথাও শুনেছি ঢের। এই নদী খনন বাৎসরিক প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয় বাৎসরিক বন্যার প্রেক্ষিতে। নদীখাত ভরাট হয়ে গেছে বলে বন্যা, আর খনন করলেই বন্যা বন্ধ, পরিবহন চালু। মন্ত্রী হলেই সব জেনে যায়। ফলে চন্চ্রমোহন পাটোয়ারীর নদী বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না খননের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। এর জন্য যে একটা টেকনো-কমার্শিয়াল সার্ভের প্রয়োজন, সেই সার্ভে পেপারটা দেখাতে বলুন, দেখবেন পলিটিকাল সার্কাস শুরু হয়ে গেছে। কোলকাতাতেও মাঝে মাঝেই হুগলী নদীখাত খনন করে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর ধুয়ো ওঠে। তারপর সব থিতিয়ে যায়। এখানেও তাই হবে তবে বাতেলাগুলি একটু প্রলম্বিত হবে, কেননা উনিশে ইলেকশন যে। টুপিটা সেই সময় পর্যন্ত পরিয়ে রাখতে হবে তো।
পর্ব-৩
আমার এ বিষয়ে লেখার প্রথম পর্বে, কেউ কেউ দাবী করেছেন কাগজকলের কর্মীদের দুর্নীতির কারণেই মিলের দুরবস্থা। কেউ কেউ দুর্নীতির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন বাঁশের মধ্যে কাদা ঢুকিয়ে, ওজন বাড়ানো হয়েছে, কয়লা ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাপ্লায়ারের কাছ থেকে কাটমানি খাওয়া হয়েছে। এখানে কাটমানির বিষয়টি বাদ রাখছি কারণ ওটা সর্বভারতীয় রোগ। ডিফেন্স পারচেজেও কাটমানি খাওয়া হয়, এমনকি সততার পরাকাষ্ঠা মোদী সরকারের আমলেও।
মনে করুন দীর্ঘকাল ধরে বরাকে ব্রডগেজ লাইনের গল্প বাতাসে উড়ছিল। কখনও ফিসফাস কখনও সোচ্চার ঘোষণা। ব্রডগেজের কাজ শুরু হয়েছিল বিজেপি সরকারের আসার আগেই। ব্রীজ বানানো থেকে টানেল খোঁড়া রেল পাতা সব কাজই এগিয়ে গিয়েছিল অনেকদূর। কিন্তু কাজটা কিছুতেই সম্পূর্ণ হচ্ছিল না। সবাই জানে এর পিছনে ছিল রোড-লবির খেলা। নতুন সরকার এসে ফাইন্যালি সবুজ পতাকা নাড়ালো আর মোদীর দল স্যুইপিং মেজরিটি নিয়ে জিতলো বরাকে। হ্যাঁ, প্রাক্তন আসু তাত্বিক, অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি সর্বানন্দ সোনোয়ালের খপ্পরে পড়ার জন্য, এনআরসির খাঁড়া মাথায় নিয়েও।
কিন্তু আমরা যারা মনে রাখতে তাড়িত হই তাদের মনে আছে ব্রডগজেরও আগে বাড়ানো হয়েছিল পাহাড়লাইনের রেলের মালবহন ক্ষমতা। হেভিয়ার চালানোর কথা ছিল, একসঙ্গে অনেক কম খরচে অনেক বেশী বাঁশ ও কয়লা পরিবহনের জন্য। রোড লবির প্রতাপে হেভিয়ার চালানোর ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়া হলো। যখন চলতো তখনও বগি ভাড়া পাওয়া দুষ্কর। সড়ক পথেই বাঁশ কয়লা আসা অব্যাহত রইলো বহুগুণ বেশী খরচে। এবং এসব ডিল সেটেলমেন্ট হতো দিল্লীতে। এখনও তাই হয়।
সাল |
কাছাড় পেপার মিলে উৎপাদন (টন) |
নওগাঁ পেপার মিলে উৎপাদন (টন) |
২০১০-১১ |
৫২,৭৮১ |
১০২০০২ |
২০১১-১২ |
৮০০৬১ |
১০০২০১ |
২০১২-১৩ |
৫২৬৮৩ |
৮৬২৭৯ |
২০১৩-১৪ |
৬৪০৩৭ |
৮০০২৩ |
২০১৪-১৫ |
৭৪৬৭০ |
৯২৬৫১ |
২০১৫-১৬ |
১২৭৭৯ |
৭২,২২০ |
২০১৬-১৭ |
উৎপাদন বন্ধ |
৩৫৫৪৬ |
এখানে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও কাছাড় কাগজকল মোটামুটি উৎপাদন কম হলেও টার্গেটের খুব দূরে ছিলনা ( দুটি মিলের ক্ষেত্রেই টার্গেট প্রোডাকশন ১০০০০০ টন)। মনে রাখতে হবে এ সময় থেকে কাগজের দাম বিপুলভাবে বাড়তে শুরু করে। আগে যে কাগজ ৪০০০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তার দাম ৮০০০০ টাকা। অর্থাৎ দ্বিগুণ। মুনাফাও তাই হবার কথা। কিন্তু দেখা গেল উৎপাদন কমছে। সর্বা সরকার ক্ষমতায় আসীন হবার পরই উৎপাদন চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হলো। মিলশ্রমিকদের দুর্নীতি যদি উৎপাদন বন্ধ হবার কারণ হয়, তবে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার উভয়ে মিলে সে দুর্নীতি বন্ধ করতে অক্ষম হলো কেন? দু লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থান শুধু নয়, একটা সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব এনে দিয়ছে এই দুটি মিল।
কিন্তু একথা সত্য যে এই দুটি রাষ্ট্রায়ত্ব কাগজকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারা ভারতবর্ষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কাগজকল গুলি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এ সরকার তাদের সরকার। এখন উৎসবের সময়। একটা কথা ভেবে গর্ব হয় যে মমতা ব্যানার্জীর কাছে আর কিছু না শিখুন, সারা ভারতের মুখ্যমন্ত্রীরা এই বিষয়টি অন্ততঃ শিখে নিয়েছেন। উৎসবের কুলোর বাতাস দিয়ে পাবলিকের দুঃখ-দুর্দশা ভুলিয়ে রাখা।