পর্ব-৪
কাছাড় এবং নওগাঁ কাগজকলের পুনরুজ্জীবনের জন্য করা সমীক্ষার সামান্য অংশ
২০০৮-০৯ সাল থেকে কাছাড় এবং নওগাঁ এই দুই পেপার মিলে উৎপাদন কমতে শুরু করে। কেননা কাঁচামাল মানে বাঁশ এর যোগান হঠাৎই কমতে শুরু করে। বাঁশ থেকে তৈরী পেপার পাল্প এই দুই কাগজকল এর উৎপাদন এর মূল উপাদান। কাছাড় এবং নওগাঁ পেপারমিল দুইই মূলতঃ মিজোরামের বাঁশের ওপর নির্ভরশীল।
সেই মিজোরামের বাঁশ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। কেন?
বাঁশগাছে ফুল আসে প্রায় পঞ্চাশ বছর পরপর। এই বাঁশগাছে ফুল আসার সঙ্গে দুর্ভিক্ষ এবং মড়কের একটা নীবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলে উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষ মনে করেন। না, এটাকে ঠিক সেই অর্থে কুসংস্কার বলা যাবে না, কারণ সত্যিই বাঁশগাছের ফুল আসার সঙ্গে মড়কের সংযোগ আছে, এটা প্রমাণিত। ১৯৫৯ সালে যখন মিজোরামের বাঁশ গাছে ফুল আসে, তার একবছর আগে ১৯৫৮ সালের ২৯শে অক্টোবর মিজোরাম ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল ভারত সরকারকে আগামী দুর্ভিক্ষের কথা জানায় এবং অর্থনৈতিক রিলিফের জন্য আগাম আর্জি পেশ করে। কিন্তু আর্থিক অনুদানের বিষয়টি ভারত সরকার নাকচ করে দেয় কেননা তাদের ধারণায় এই পর্যালোচনাটি সার্বিকভাবে অবৈজ্ঞানিক। ১৯৫৯ সালে বাঁশ গাছে ফুল আসতে শুরু করে, লক্ষ লক্ষ ইঁদুরে ছেয়ে যায় ফসলক্ষেত। প্রবল দুর্ভিক্ষ এবং ফসল ধ্বংসের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পরে মিজোরাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয় প্রতিটি ইঁদুর মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতে। ২০.৫ লক্ষ ইঁদুর মারে গ্রামবাসীরা। দেশের প্রথম বাম্বু পলিসি তৈরী হয় মিজোরামে। ২০০৪-০৫ সাল থেকে মিজোরাম শুরু করেছিল পরবর্তী সাইকল এর বাম্বু ফ্লাওয়ারিং সতর্কতা সংকেত পাঠাতে। অথচ হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশন লিমিটেড সময়মত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। গবেষণায দেখা গেছে বাঁশের ফুল বিপুল পরিমাণ ইঁদুরকে আকৃষ্ট করে, তাদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে, এবং ক্ষিধের তাড়ণায় তারা ফসল খেতে শুরু করে। তাই বাঁশগাছে ফুল হওয়ার উপক্রম হওয়া মাত্র, মিজোরামের মানুষ নিজেরাই বাঁশ গাছ নির্মূল করতে শুরু করেছে। তার চাপ এসে পড়েছে কাগজকলে। উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। মাঝখানে কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে পাল্প কিনে এনে মিল চালানোর চেষ্টা করায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে সাংঘাতিক ভাবে। এই একই রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির নাগাল্যাণ্ড এর ইউনিটটি (তুলি) পেপার পাল্প উৎপাদন করতো, সেটিকেও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।নতুন যে সমস্যাটি এবারে উপরিতলে আসবে, তা হলো দীর্ঘদিন বসে থাকায় একটা কেমিকাল বেসড শিল্পকারখানায় যন্ত্রাদি অকেজো হয়ে পড়ার আশংকা প্রবল। এই মিল খুলে উৎপাদন চালু করতে বহু কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বারংবার পরিদর্শনের পরও কোনও ব্যক্তিমালিকানার শিল্পপতি এখনও মিল চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করেননি বলেই মিল বেসরকারী হাতে না দেবার জিগিরটাকেও পাশাপাশি ঘোষণা ফুঁকতে হচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য দুটো। এক, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনও শিল্পপতির সঙ্গে টাই-আপে গিয়ে কিছুদিনের জন্য (মানে ইলেকশান পর্যন্ত) মিল খোলা রাখা। সামান্য কিছু লোকের পাওনাগণ্ডা মেটানো। তারপর মিল বন্ধ ঘোষণা করা। বিনিময়ে শিল্পপতি জমি পাচ্ছেন, একটা বিরাট টাউনশিপ পাচ্ছেন, আনেক যন্ত্রাংশ পাচ্ছেন, প্রায় মুফতে। যেগুলি বিক্রয়যোগ্য বা অন্যত্র ব্যবহারযোগ্য। কর্মীদের পুনর্নিয়োগ বধ্যতামূলক থাকবে না। জেসপ, ডানলপ থেকে কানোরিয়া জুট পর্যন্ত এমনতরো বহু খেলা আমরা দেখেছি। দুই, প্রথম প্ল্যান সফল না হলে স্মার্টলি প্ল্যান বি তে চলে যাওয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন পেপার ইনডাস্ট্রি মালিকদের সঙ্গে ডিল এ চলে যাওয়া। রাষ্ট্রায়ত্ব সব পেপার মিলকে পার্মানেন্টলি বন্ধ করে দেওয়া হবে, তার বিনিময়ে...। ডিল টি অবশ্যই দিল্লীতে বা দিসপুরে সম্পন্ন হবে। আপাততঃ নমামি নদী উৎসবের নামে মোচ্ছব চলুক। মানুষ শেষবারের মত মজা লুটে নিক।
পর্ব-৫
সকাল থেকে কান ঝালাপালা করে দিল।
-কিতা বা মিঠুদা? নমামি তো সাকসেসফুল। পারলায় নি কিচ্ছু করতে? ইতা পেপারমিল লইয়া দুই লাইন লেখিয়া কিতা ভাবছিলায়? হাতী ঘুড়া মারি লাইছো? ব্যাঙ ও করতে পারলায় না।
-কিন্তু পেপার মিলোর অনশন চলের নি অটা ক।
-ইতা অখন কেউ চাইয়াও দেখের না। সিএমে ওয়ার্ড দিছোইন ছয় মাসের মইধ্যে মিল খুলি দিব।
-হুনো বা আমার একটা কথা মাথাত রাখিও। ঠগোর বাড়ির নিমন্তন্ন না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই।
-ধুরো বা তুমি তুমার অতা পিঞ্চকাটিং মাত লইয়া বই থাকো।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষ হেরে গেল? সামান্য ঢপ চার্জেই ভড়কি খেয়ে গেল? ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় ফোন।
-পার্থ মৈত্রর লগে একবার কথা কইতে পারুম?
-কে কইতাছেন?
-আমারে চিনবেন না। আমি কিন্তু আপনেরে চিনি। আপনের লেখা পড়ি। ভালও লাগে। কিন্তু নমামি বরাক নিয়া আপনে যা লেখতাছেন, এইটা সমর্থন করতে পারতাসি না।
-কুনটা সমর্থন করতে পারতাসেন না, না কইলে কীভাবে বুঝুম?
- ধরেন বরাকবাসীর একটা উৎসব, তার মধ্যে আপনে কমুনাল কথাবাত্রি লইয়া আইলেন।
-মুসলমানের সংস্কৃতি এইখানে রিপ্রেজেন্টেড না। ভুল কইলাম?
-ভুল শুদ্ধ বিচার করার আমি আপনে কে? দেশ বিচার করবো। আর দেশটা তো হিন্দু দেশ। অনুপ্রবেশকারীরারে আপনেরাও যদি সাপোর্ট দিতে থাকেন তাইলে তো এইটা দুঃখের বিষয়। আর এর লগে আপনে মিলাইয়া দিলেন পাঁচগ্রাম পেপারমিল। কংগ্রেস আমলে চুরি কইরা মিলটা বন্ধ করায় দিল। আর অখনকার গরমেন্ট প্রমিস করতাছে ছয়মাসের মধ্যে মিল খুল্যা দিব। তবু হেরা অনশনে বইল।
-না মানে কংগ্রেস আমলে তাও তো চালু আছিল মিলটা। প্রোডাকশনও হইতো। বিজেপি গভর্ণমেন্ট আইয়া তো পুরা বন্ধ কইরা দিল।
-আরে কইছে তো চালু করবো, ১৫০০ কুটি টাকা দিব। দিব তো। ওয়েট করেন।
অদ্ভূত। রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাছে সব আন্দোলন, সব বিক্ষোভ প্রতিরোধ, সব কান্না, হাহাকার, অভিশাপ, ধ্বস্ত হয়ে যায়। তবে কি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে? নাকি পুরাতন পথে পরিক্রমা ছেড়ে অন্যত্রে খুঁজতে হবে পথ? ভাবতে ভাতেই তিন নং ফোন।
-একবার আও বা। দেখিয়া যাও। অতদিন ধরিয়া আছি, অত মানুষ কুনও দিন দেখছি না। শুনছি কুম্ভমেলাত ইরকম ভীড় হয়। বরাক ভেলিত অত মানুষ থাকে অটাই জানতাম না। কাইল তো ভিড় আরও বাড়বো।
-কেনে? কাইল কিতা?
-কাইল কোবিন্দা আইব তো।
-এইন কে? গোবিন্দার দাদা?
-ধুরো বা রাষ্ট্রপতি।
-কোবিন্দ।
-অউ একতাউ অইল।
-আর কে আইবো?
-স্টার, মিনিস্টার, প্রচুর। হিমন্ত, বাবুল সুপ্রিয়, শান। জমি গেছে বা।
-আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থাকিয়া কেউ নাই?
-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক? তারা অনো আইয়া কিতা করতো?
-এরি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক না থাকলে তো ই নমামি প্রোগ্রামই অইলো না নে।
-কিতা ফাংফুং মাতো বা?
জানোনা হঠাৎ এই নদী উৎসব শুরু হলো কেন? আজ ব্রহ্মপুত্র, কাল বরাক, করিমগঞ্জের কুশিয়ারা, পরশু পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা, কেন? মনে হয়না? কেন ? কেন নদী উৎসব হচ্ছে এবং হবে? তার কারণ নর্থ-ইষ্ট থেকে বরাক ব্রহ্মপুত্র বেয়ে, বাংলাদেশের নদনদী সমুদ্র বন্দর ছুঁয়ে হলদিয়া, কোলকাতা হয়ে পণ্য পৌঁছাবে বারাণসী ঘাট অবধি, যেটা মোদীর কেন্দ্র। বরাক কুশিয়ারা দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলবে। তার জন্য কী প্রয়োজন? নদীখনন। নদীখননের জন্য কী প্রয়োজন? টাকা। কে দেবে? গৌরী সেন। মানে নরেন্দ্রভাই দামোদরভাই। তাও না? তাহলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক? আজ্ঞে হ্যাঁ? তাই।
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন ভারতবর্ষে টাকার বন্যা বইয়ে দেবার এক নতুন পরিকল্পনা ছকা হয়েছে। আন্তর্দেশ জলপথ পরিবহন। প্রাথমিক প্ল্যানটা হলো বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বারাণসী থেকে হলদিয়া হয়ে সদিয়া ৪০০০ কিমি জলপথ সংযোগ, ড্রেজিং, ভেসেল কেনা ইত্যাদি। সবটাই প্রায় ঋণের টাকায়, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ঔদার্যে সফ্ট লোন। কিছুদিন আগে নমামি ব্রহ্মপুত্র উৎসবের মাঝখানে এই বিষয়ে অনেকগুলি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। নমামি বরাক উৎসবের মাঝখানে ড্রেজিং শুরু হচ্ছে।
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, কোলকাতা থেকে বারাণসী জলপরিবহনের জন্য তৈরী হয়েছে ন্যাশন্যাল ওয়াটারওয়েজ ১ (NW-1), আনুমানিক ব্যয় ৫৩৬২ কোটি টাকা যার মুখ্য অংশ ধার দেবে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব রাজ্যসরকারের। এর সঙ্গে রয়েছে রূপনারাযণ নদীর জন্য ২৪ কোটি, সুন্দরবন জলপথের জন্য ১৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কোনও সরকারের নদী উৎসব না করে উপায় আছে?
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, নদীপথে পণ্যপরিবহনের জন্য, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়েছে বলে, সিরাজগঞ্জ-দইখাওয়া স্ট্রেচ আর যমুনা- আশুগঞ্জ-করিমগঞ্জ স্ট্রেচ এর নদী খননের আনুমানিক ব্যয় ৩০৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে ভারত দেবে আশী শতাংশ অর্থাৎ ২৪৪ কোটি টাকা। বাকী মাত্র কুড়ি শতাংশ টাকা দেবে বাংলাদেশ। এতদসত্বেও বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে যে, অতিশয় ভারতপ্রীতির জন্য তিনি বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে পণ্য পরিবহন শুল্ক কম করে ধার্য করেছেন।
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, বেশ কয়েকটি সার্ভে রিপোর্ট বলেছে বাংলাদেশের সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধে লিপ্ত হলে, বাংলাদেশ নদীপথ নির্ভর এই পরিকল্পনা যে কোন দিন মুখ থুবরে পড়বে।
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন বরাক নদীর জন্য (NW-16) প্রাথমিক খরচ দেখানো হয়েছ ৭৩ কোটি টাকা (শিলচর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত)।
আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, ৪৩৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্রের (NW-2) দুই তীরে সদিয়া থেকে ধুবরী পর্যন্ত স্বপ্নের ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস হাইওয়ে তৈরী হচ্ছে।
আপাততঃ এটুকু জানাই যথেষ্ট, যে প্রাথমিক ভাবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে টাকা ছেড়েছে, তারই একটা অংশ ব্যয়িত হচ্ছে নদী উৎসবে। ক্ষেত্র প্রস্তুত করাও তো বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। অতএব সামান্য একটা নদী উৎসবেও ছুটে আসতে হয় রাষ্ট্রপতি থেকে মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপাল, স্টার থেকে মিনিস্টার সবাইকে। এটাকে যদি আগমার্কা হিন্দুত্ব বা বরাক প্রেম মনে করেন তবে আপনি........।
(চলবে)