
অল্পের জন্য দু দুবার মব লিঞ্চিং বা গণধোলাইয়ের হাত থেকে বেঁচেছি। মানে দেখার হাত থেকে। একটি গতকাল ট্রেণের কামরায়, আর একটি দূর শৈশবে।
আমার মফস্বলে মদনমোহন বাড়ির সামনে এক উদোম পাগলি আপনমনে থাকতো। নাম মনে আছে পানিয়াল পাগলি। কাউকে দেখলে আঁধলা ইট নিয়ে তেড়ে যেত। সঙ্গে অকথ্য গালাগাল। একবার সেই ইট কারো কপাল ফাটালে পানিয়ালকে ঘিরে ধরে শুরু হল কিলচড়লাথি। এত কষ্ট তা দেখা যে ছোট্ট আমি বাবার হাত টেনে টেনে ঝুলছিলাম,
-বাবা,ওদের থামতে বল না।
এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ও কাকু, কাকু, ও তো পাগলি, কিছু বোঝে না।
পাগলিদেরও যে রেহাই মেলে না সেটা ভিডিও ভাইরাল না হলে এখনো বিশ্বাস করতাম না হয়তো। যাইহোক জনতা জনার্দনের জঙ্গী মনস্তত্ত্ব তখনও এতো জান্তব হয়নি, নাকি পাড়ার মুরুব্বিদের হস্তক্ষেপেই, ঠিক মনে নেই, ভিড়টা দ্রুত পাতলা হতে শুরু করল।
বাবা আমায় সরিয়ে নিয়ে যাবার আগে একবার পানিয়ালকে দেখেছিলাম,পা ছড়িয়ে থেবড়ে আছে মাটিতে। পুরো মুখ ফোলা আর লাল। ডান হাতটা মোচড়ান কিনা কে জানে, তবে খসা আঁচলের ওপর বেজায় বেকায়দায় পড়ে ছিল সেটা।
সদ্য রেহাইটা সব খাঁজখোঁজ নিয়ে টাটকা গেঁথে আছে মনের ভেতর, যেন শূকরীমাংসে ঢোকানো গরম শিকের ছ্যাঁতছোঁত আওয়াজের আক্রোশ।
পর্শু থেকে ট্রেনে ছিলাম। আমি আর আমার সঙ্গিনী বছর পনের ষোলোর এক মেয়ে। রাত আটটা নাগাদ একজন উঠলেন অন্ধ্রপ্রদেশের কোন স্টেশন থেকে। অনেক বাক্সপ্যাঁটরা আর অল্পবয়সী চিবুকে লম্বা কালো দাড়ি। ফোনে খুব কথা বলছিলেন, তাই জেনে গেলাম উনি কোন মাদ্রাসাশিক্ষক। ধর্মপ্রাণ। কোন কারণে কাজের জায়গায় অশান্তি হওয়ায় ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। বিহারের কাটিহারে।
ওখানকার আটজন সহযাত্রীর বাকিরা পুরুষ। কোন ধর্মের আমি জানি না। শুধু যিনি পরিত্রাতা রূপে আবির্ভূত হবেন তার পাঁচ আঙুলে পাঁচটা আংটি আছে দেখেছিলাম। দুটো ছেলে, ত্রিশের এপারে, নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলছিল, শুনে মনে হচ্ছিল শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষাফেরত। প্রত্যেককেই তো ঠিকঠাক লেগেছিল, ভদ্র, সাহায্য করায় আগ্রহী।
এইখানে একটু নিজের কথাও বলি। ফেসবুকে আমার জাগতিক কিছু পাবার নেই। যারা মেসেঞ্জারে জিগায় তাদের জানাই বই লিখিনি, কখনও লিখবো কিনা সন্দেহ। সমাজকল্যাণের টুকটাকের সুবাদে আদালতেও ডাক পাই বটে, তবে একেবারেই বলার মতো নয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে শর্তই আছে সেসব কেউ জানবে না। আমার বন্ধুতালিকা থেকে তারা মিটিমিটি হাসি ছুঁড়ছেন হয়ত, তা হাসুন, কিন্তু তারাও জানেন আমি এক্কেবারে নামহীন, মানে যশহীন, রূপহীন, সাদামাটা এক মহিলা,যার লড়াইগুলি একেবারেই নিজস্ব, ফলাও করে বলবার মতো নয় একেবারেই। লক্ষের মধ্যে একজন বললেও বেশি বলা হবে।
একথাগুলো বলা দরকার ছিলো, কারণ তা না হলে এখন যা বলবো তাতে রজ্জুতে সর্পভ্রম হতে পারে।
গোল বাঁধলো যখন এই শিক্ষক এক বিশাল হাতব্যাগ থেকে ততোধিক বিশাল এক এলুমিনিয়াম ফয়েল বার করে খেতে বসলেন।
তার আগে অবশ্য আমাদের অনেক আলাপ হয়ে গেছে। ফোনে নামাজের আজান আসছে, আর এতো ঘুপচিতে উনি নামাজ পড়তে পারছেন না, এই নিয়ে দুঃখ করলে আমি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেছি, ঠিক আছে, মনে মনে পড়ে ফেলুন না।
মা আর ঠাকুরঘরে যেতে পারেনা বলে দুঃখ করলে আমি তাকেও এইরকমই বলি।
অন্তত সাতবার সহযাত্রীটি আমায় জিগিয়েছেন ট্রেনটা কত লেট করবে।কারণ হাওড়া থেকে শেয়ালদা গিয়ে তবে ওকে হাটেবাজারে এক্সপ্রেস ধরতে হবে। আমায় গ্রাম্য সরল ভঙ্গীতে বোঝাচ্ছিলেন কেন এসি কামরাই ভালো। গরম নেই, ভিড় না, সিট নিয়ে দখলদারিও না। আরামসে চলে যানা।
আমারও মজা লাগছিল ওর কথা শুনতে। কারণ ধার্মিকে আমার কোন এলার্জি নেই, যতক্ষণ না ধার্মিক হয়ে উঠছে সন্ত্রাসী আর গণহত্যাকারী। অতি ধার্মিক এবং বকধার্মিকের সঙ্গ পরিহার করি বটে তবে সেটা মতের অমিল এবং ঝগড়ার ভয়ে। এই বিশাল দেশের কোণে কোণে ঘুরে দেখেছি ধর্মের অমোচনীয় ছাপ। সত্তর শতাংশ বা তারও বেশি মানুষকে ত্যজ্য ভাবার দুঃসাহস আমার নেই। ফলে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এই বিশ্বাসেই স্থির আছি। আর সমান নিস্পৃহ নজরে দেখি সব জাতের ধার্মিকদের। একজন টিকিওয়ালা, কাষায়বস্ত্র পরিধান করে উঠলেও আমি এইভাবেই তার সঙ্গে গল্প করতাম।
তো গোল বাঁধলো ঐ এলুমিনিয়াম ফয়েলের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই। চারপাশ ভরে গেল গোলাপজলের সুবাসে আর ভাই আমার খেতে শুরু করলেন। এরপর পেটমোটা ব্যাগটি থেকে ঘন জাফরানরঙা ছোট ছোট মাংসের টুকরো ছড়িয়ে দিতেই আবার গন্ধের হুল্লোড়।
অল্পবয়সী ছেলেদুটো নড়েচড়ে বসল, চোখ হয়ে গেল ছুরির মতো ধারালো,
- ক্যায়া খা রহা হ্যায় আপ ?
শিক্ষকটির মুখে ফুটে উঠল একটা বোকা, ভ্যাবলা হাসি। সত্যি তো, আমার টিফিন বক্সে উঁকি মেরে কেউ যদি ধমকায়, কী খাচ্ছেন, আমি কি ভোম্বল হয়ে যাবো না ! আরো দু'জন আতিশয্যে উঠে পড়েছেন। এরা বাঙালী। চোখ হাসিতে ঝিকমিক, রগচটাদের প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
--গোস্ত খাচ্ছে দাদা। কোন সন্দেহ নেই তায়। আরে পাবলিকমে কিঁউ খাতা হ্যায় রে ?
এই ছেলেদুটোর আরো বন্ধুবান্ধব আছে ভেতরে। ওদের মুখের শক্ত রেখা আমাকে মনে করিয়ে দিল পানিয়াল পাগলির কথা। মাংসে লেগে ফিরে আসা দুমদাম প্রহারের আওয়াজ।
কী করছি নিজে বোঝবার আগেই একটুকরো মাংস উঠে এলো আমার কাঁপা হাতে। কোন স্বাদ পাইনি, তবু দাঁতে কেটে কড়া গলায় বললাম,
-চিকেন, অনলি চিকেন।
এবার এগিয়ে এলেন সেই আংটিধারী ব্যবসায়ী,
--আরে কে কী খাবে তোমাদের কৈফিয়ত দিতে হবে ! দেখছ তো ভদ্রমহিলা টেস্ট করে বললেন মুরগি। বস সব নিজের জায়গায়।
বিশাল ছ' ফুটের ওপর দেহটা একটা আড়াল হয়ে দাঁড়ালো শিক্ষক আর ছেলেদুটোর মাঝখানে।
সারারাত ঘুম এলো না। নড়াচড়ায় বুঝলাম শিক্ষকও ঘুমোননি। এই গ্রামীণ মানুষটি কাগজ পড়েন কিনা জানি না। নেট ব্যবহার করেন না। জানেনও না বোধহয় যে রাষ্ট্রের নজর এখন তার খাবার প্লেটে। অজান্তেই তিনি এখন গণধোলাইয়ের আদর্শ শিকার।
ছেলেগুলো ভোররাতে নেমে গেল উড়িষ্যায়। পরদিন দুপুরে উনি শুকনো মুখে খেলেন কেবল গোলাপ-গন্ধী রাইস। সেই জাফরানি মাংসখন্ডগুলিশুদ্ধ ব্যাগটাকেই বিসর্জন দিয়ে এলেন টয়লেটের সামনের ডাস্টবিনে।
আড়াইঘন্টা লেটে ট্রেন এলো হাওড়াতে। সন্ধে সাড়ে ছটা। দৃশ্যত বিহবল মানুষটাকে বললাম,
-চলুন, শেয়ালদার পাশ দিয়েই যাব আমি।
ভরসা করে এলেন। নামবার সময় হাজার সুক্রিয়া আর হলুদ আলোয় চোখের কোণ যেন চিকচিক।
ওঁর অনুমতি নিইনি বলে ইচ্ছে করেই মাথাকাটা ছবি দিলাম।
এবার একটু হুঁশিয়ারি। ছোট্ট ---
নট ইন আওয়ার নেম। নেভার।

অভিষেক | unkwn.***.*** | ৩০ জুন ২০১৭ ০৭:৩৫82528
kihobejene | unkwn.***.*** | ৩০ জুন ২০১৭ ০৯:৪৯82529
aranya | unkwn.***.*** | ৩০ জুন ২০১৭ ০৯:৫২82530
Du | unkwn.***.*** | ০১ জুলাই ২০১৭ ০২:২৭82535
b | unkwn.***.*** | ০১ জুলাই ২০১৭ ০২:৪৬82533
তির্যক | unkwn.***.*** | ০১ জুলাই ২০১৭ ০৫:১১82534
amit | unkwn.***.*** | ০১ জুলাই ২০১৭ ১২:১৭82531
amit | unkwn.***.*** | ০১ জুলাই ২০১৭ ১২:৪১82532
PT | unkwn.***.*** | ০২ জুলাই ২০১৭ ০২:১১82536
Titir | unkwn.***.*** | ০২ আগস্ট ২০১৭ ০৬:৫২82538
সঞ্জয় ঘোষ | unkwn.***.*** | ০২ আগস্ট ২০১৭ ১২:২৫82537
de | unkwn.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০১৭ ০৫:১৭82539