কাঁসাইয়ের পুব থেকে দক্ষিণে ছেনালের মতো মোচড় মারা বাঁকটা দেখলে কানুর কেবল আহিরডিহির চম্পার কথা মনে হয় মাইরি। মানে চম্পার কোমরের নিখুঁত খাঁজের কথা। এক ধাপ খাঁজকাটা চকচকে ঘামে ভেজা চর্বি, কিন্তু কী খোশবো ! কাজ কাম ফেলে রেখে চম্পার কোমরের ভাঁজে কনুই ঢুকিয়ে পাশাপাশি বসে থাকতে ইচ্ছে করতো দিনমান, যখন তারা একা একা দেখা করতো অবরেসবরে। মনে হতো সামনে কাঁসাইকে সাক্ষী রেখে পেছনে কোন অদৃশ্য চোঙায় অনবরত বেজে চলেছে রক্ত উথালপাতাল করা গান, কোমরিয়া লপালপ ললিপপ লাগেলু। ধানের খেত থেকে শুরু করে গামার, শাল, নিম, সব গাছ মাথা নাড়িয়ে তাল ঠুকছে।
তা ঐ অব্দিই। আর বেশি এগোতে দেয়নি চম্পা তাকে। দশ বিঘে ধানী জমিওয়ালা পাত্রের সন্ধান পেতেই বেজাতের বাগাল প্রেমিককে বেমালুম ভুলে মেরে দিয়ে বাদনা পরবের ধারেকাছেই উলুলু দিয়ে বিয়ে হয়ে গেল চম্পার। শ্বশুরঘর যাবার কালে ঘোমটার ফাঁকে মাহাতো ঘরের কানুর দিকে একবার তাকিয়েছিলোও যেন কুর্মিদের বাড়ির মেয়েটা।
তা তাই ধুয়ে কি জল খাবে কানু। প্রথম ক'দিন কনুই সুড়সুড় করলেও দিন পনেরোর মধ্যেই সে বেশ সামলে নিলো। সারা পাড়ার গরু বাছুর নিয়ে আবার গোঠ চরাতে গেল। কালীপুজোর সময় তারস্বরে বাজানো ভোজপুরি গানের সুরটুকু মনে আসা মাত্র সামনের কালো গরুটাকে এক পাঁচনের বাড়ি, হুড়োহুড়ি পড়ে গেলে সবকটিকে নদীতে ঠেলে নামিয়ে গা দলাইমলাই করা। কোমরিয়া ললিপপের সুর এক টুসকিতে কোথায় হাওয়া ! এসব বাগালির কাজে আজকাল কাউকে পাওয়া যায়না বলে তার কদর আছে এ গ্রামে। এ বাড়ি থেকে ডাক পড়বে কানু, তো ওবাড়ি থেকে চিল্লাবে কানাই।
সাতকুলে তার কেউ নেই, শুধু ঐ জ্যাঠাবাবা ছাড়া। সে বুড়ো লাঠি ঠুকঠুক করে একদিন এসে বললে, এইবার তুই বিহা না কইল্লে চইলবেক নাই। কইল্লে কর, নাইলে মইল্লে তোর কাছে ইকটু জলেরও আশা নাই।
আয় বলতে তো ঐ গোঠচরানো। আর কংসাবতীতে জাল ফেলে রেখে মাছ ধরা, রাস্তার ধারে সে মাছ বিক্রি করা। কখনোসখনো গাঁয়ের ঝুমুরদলের দোহার হয়ে গান গাইতে অযোধ্যা পাহাড়, বড়জোর ঝাড়গ্রাম। বৌকে কানু খাওয়াবে কী ! তাতে আবার সেই মেয়ে নাকি মাধ্যমিক পাস। তবে তার মতোই বাপ মা মরা। গালে হাত দিয়ে নদীর ধারে বসে ভাবতে ভাবতে কানু বিরক্ত হয়ে গেল। শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছল, ইসব ভাবনা টাবনা বড় ঝামেলার কাজ বঠে। তার থিকে মিশিরডির বাপ মা মরা মেয়েটাকে বিহা কইরে লিলেই হয়। কবে থেকে বইলে যাচ্ছে জ্যাঠাবাবা।
তো বিহার পরদিনই কানু মাহাতো আবিষ্কার করলো তার বৌ বড় গম্ভীর। পাড়ার মেয়েদের সাত কলকলানিতেও রা কাড়ে না। সবাই চলে গেলে পাশে বসে কানু শুধু জিজ্ঞাসা করতে গেছে, তুর কী কী লাইগবেক হামাকে বল, অমনি সেই মেয়ে বড় বড় চোখদুটি তুলে স্বামীর পা থেকে মাথা অব্দি জরিপ করে নেয় আর সরে বসে চৌকির ওপর যতটা সরা যায়। কাঁসাইয়ের দ' এর মতো সেই গভীর চাহনি দেখে প্রেমালাপ তো দূরের কথা, কানুর স্বাভাবিক কথা বন্ধ হয়ে যায়। রাতভর দুজনে দুজনের দিকে পেছন করে শুয়ে রইল। কানু তো কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েই পড়ল, বৌ কী করল সে জানে না।
এখন উঠোনময় নরম রোদ ছড়িয়ে পড়তেই গোঠের পাঁচনবাড়ি হাতে নিয়ে কানু মানে মানে সটকে পড়তে চায়। তবে তার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করেছিলো। যাবার সময় বৌ নিঃশব্দে তার হাতে ঝুলিয়ে দেয় পুরনো শাড়ির টুকরোয় বাঁধা ঝকঝকে করে মাজা স্টিলের কৌটোয় লাল মোটা চালের পান্তাভাত নুন আর বুট সেদ্ধ। সঙ্গে চারটি ঘন সবুজ কাঁচা লঙ্কা। কোন ভোরে উঠে খুঁজেপেতে সে এইসব যোগাড় করেছে। ঘরে তার শাস শ্বশুর কেউ নেই। নাহয় সে জেনেই এসেছে একেবারে প্রথম দিন থেকে না রাঁধলে তার খাওয়া নেই। কিন্তু একবার মুখে তো বলবে, ভাতটা খাঁইয়ে লিবে। নিম গাছের ডগায় নজর আটকে সে যন্ত্রের মতো কানুর হাতে কৌটো তুলে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। অন্ধকারে তার লাল শাড়ির আঁচল খয়েরি, কালচে খয়েরি হয়ে একেবারেই মিলিয়ে গেল।
- ই কেমন মেয়া ! মনে কি দয়ামায়া নাই ? নরম হঁয়ে দুটা কথা বইলতে পারবেক নাই !
কাঁসাইয়ের বুকের ওপর দিয়ে গরু মোষগুলোকে পারাপার করাতে করাতে আপন মনেই গজগজ করছিলো কানু। এ যেন চোরের মার ! কারুক্কে বইলবার যো নাই হে। পড়হা শুনা জানে বলে মেয়াটার কি অঙ্কার বেশি ? নাকি হামাকে উয়ার পছন্দই হয় নাই ?
জ্যাঠাবাবার কথা শুনে বিহা না বইসলেই ভালো ছিল ।
নিজেকেই বলে কানু, বড় পাথরের ওপর বসতে গিয়ে সতর্ক চোখে তাকায়। একটু উঁচাতে বসার সুবিধা পেলে গাঁয়ের মানুষজন ভ্যারভেরিয়ে বিষ্ঠা ফেলে নদীজলে। তাই সাবধানে দেখতে হয়, নাক উঁচু করে লম্বা শ্বাস নিতে হয়। নইলে কোন চোরা খাঁজে ওঁত পাতা কোন নোংরা গায়ে হঠাত জড়িয়ে যাবে কেউ জানে না।
পাথরের ওপর কাপড়ে বাঁধা কৌটোটাকে বসায় কানু, তারপর নিজে বসে। একটু দূরেই চওড়া চট্টানের মতো অনেক লালচে পাথর যেন উবুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নদীজলে। ফাঁকে ফাঁকে শক্ত সবুজ কাশফুলের অজস্র ঝাড়। যেগুলোতে ফুল আছে সেগুলো জ্যাঠাবাবার সাদা মাথার কথা মনে করায়। সঙ্গে আরো কতো জলজ উদ্ভিদ। গাঁয়ের ছেলে হয়েও কানু সবের নাম জানে না।
এই পাথরের চট্টানের পাশেই আকাশমুখো উদলা গা মেলে আর এক কাছিমের পিঠের মতো পাথর। এদের মধ্য দিয়ে নালার মতো বয়ে গেছে নদী। সরু ধারা কিন্তু খুব উছল, কলকল আওয়াজে জল বয়ে যায়। এইটা কানুর মাছ ধরার জায়গা। একটা নাইলনের মশারির লম্বা টুকরো সে নদীগর্ভে ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে দুই চট্টান ঘেঁষে। যেন শুধু জল গলতে পারে। ওপরের কানা দুটো দুপাশে বাঁধা বুড়ো কাশের নীচের মোটা অংশে। যেদিক থেকে স্রোত আসছে সেদিকে শিং উঁচিয়ে অজস্র ছোটবড় পাথরের টুকরো। ফলে মশারিজালের পা বরাবর তৈরি হয়েছে লম্বা অগভীর একটা গর্ত মতো।
দেদার মাছ রাতভর জমা হতে থাকে সেখানে। বারোমাস। শুধু বানের জল যখন নদীর বুকে পাথরের উপর দিয়ে বহে যায় সেই বৃষ্টির দিনগুলি ছাড়া। অন্য সময় সকালে উঠে চুবড়ি ভরে মাছ তোলে কানু, যেন কুলো ভরে ধান তুলছে তুষ ঝাড়বে ব'লে। দুহাত ভরে প্রকৃতির দেওয়া জলের ফসলে।
কথায় বলে বোবার শত্রু নাই। সারা দিনমান বোবার মতোই খেটে যায় কানু, কিন্তু তবু তার শত্রু আছে। রাতের বেলা ডিঙি নিয়ে কারা আসে চুপি চুপিচুপি, জল যেখানে গভীর সেখানে লগির মোচড়ে ডিঙি স্থির রাখে কেউ, কেউ লম্বা লম্বা পা ফেলে পাথর বেয়ে নামে কানুর জালের কাছে। কখনো মাছ উঠিয়ে নিয়ে যায়, কখনো জাল কেটে দেয় ফালা ফালা।
নজরদারি করবার জন্য পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ি বাগালি করে কালো পলিথিন যোগাড় করে কানু। মাছ ধরার জায়গাটুকুর পাশেই সাদা বালি, টুকরো পাথর জমা হয়ে ছোট্ট একটা চর মতো তৈরি হয়েছে। সেখানে বাঁশের কঞ্চি বাঁকিয়ে, পলিথিন খাটিয়ে একটা নড়বড়ে কুঁড়ে তৈরি করে কানু। চট বিছিয়ে সেখানেই সারা রাত কাটাতো এতোদিন। কান থাকতো নদীর বুকে কোনো অস্বাভাবিক শব্দ হলো কিনা সেদিকে। মশা তাড়াবার জন্য সারা গায়ে রেড়ির তেল মাখা। অন্ধকারে কেউ তাকে দেখলে ভুতপ্রেত ভেবে ভির্মি খাবে। কিন্তু স্রোতের কুলকুল আওয়াজ, দখিনদিক থেকে আসা মিঠা বাতাস আর পুন্নিমার রাত্তিরে ভাতের থালার মতো চাঁদ, এইসব দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে হাবা হয়ে যেত কানু। সারারাত ঘুম নেই, শুধু বাতাসে কারা ফিসফাস কথা কয়, কংসাবতীর স্রোতের আওয়াজে তা অস্পষ্টতর হতে হতে মিলিয়ে যেত, আর কানুর মনে হতো তার ছোটবেলায় মরা বাপ মা ঘুরে বেড়াচ্ছে চরময়,
- ডর নাই বাপ ডর নাই। তুই জাইগে আছিস তো হামরাও আছি তোর সঁঁগে।
চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু নিয়ে ভোরের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগিয়ে কানু বাগাল ঘুমিয়ে পড়তো পলিথিনের চালের নীচে, বড় শান্তির সে ঘুম।
ভাবতে ভাবতে বেহুঁশ, কিন্তু গোরুমোষের দিক থেকে চোখ সরায় না কানু। মোষ চারটে ধারের দিকে গা ডুবিয়ে, গরুগুলো দূরে তালগাছের নীচ বরাবর চরে বেড়াচ্ছে। গাঁয়ের দিকে চলে যাওয়া উঁচু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে চেনা ভুলি কুকুরটা মাথা কাত করে করে তার নেকড়াবাঁধা বাটিটা জরিপ করছে। দমে খিদা লাইগছে হে। খিদাই হল ভগমান। আর আহার হলো সেই ভগমানের নৈবিদ্য। ফলে আর দেরি করে না কানু। নদীর জলে হাতমুখ ধুয়ে ভোজনে বসে। কানের পাশে গোঁজা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেয় আকাশমুখো শুয়ে। বাতাসে ভেসে সরু ধোঁয়ার রেখা যেদিক পানে ধায়, ঠিক সেখানেই কাঁসাইয়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তার খোড়ো চালের কুঁড়ে। আজ সেটা পেটের ভেতর পুরে রেখেছে একখান আস্ত নতুন বৌ। ডাগর আর গম্ভীর।
খানিককাল সে ঘুমিয়েছে নিশ্চিত। গরু মোষের গা খড়ের পাকানো ডেলা দিয়ে দলাইমলাই শেষে সে আর একটি বিড়ি ধরাল।তারপর সূর্য খেতের নতুন চকচকে গোল বেগুনের মতো আকাশের গায়ে ঝুলে রয়েছে দেখে কানু হাঁকডাক শুরু করলে। জিভ কখনো টাগরায় জড়িয়ে, কখনো পুরো মুখ খুলে হেই হেই, ট্যারারারা, কতো রকমের শব্দ। সঙ্গে পাথরের ওপর পাঁচন বাড়ি ঠোকার আওয়াজ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মোষেরা জল থেকে উঠে আসে, শান্ত গরু ক'টি জাবর কাটতে কাটতে তীরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কখন বাগাল চেনা হ্যাট হ্যাট শব্দে তাদের বাড়ির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
উঁচু রাস্তায় কানু তার চারপেয়ের দলবল নিয়ে উঠেছে কী উঠে নাই, গাঁয়ের মেয়ে সীতা আর প্রিয়া প্রায় নাচতে নাচতে তার দিকে ছুটে আসে,
--কানুদাদা, নতুন বহু কথায় গেল, কথায় গেল ?
তাদের মিচকে হাসি, চঞ্চল চোখ আর আঙুল মটকানো দেখে কানুর মনে পড়ে গেল তার বাপদাদার আমল থেকে পালন করা কিছু রীতিনীতির কথা। বিয়ের পরদিন মাহাতোর বৌ পালায়। পালায় মানে কোথাও গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। নতুন বরের কাজ হলো তাকে খুঁজে বার করে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এইসময় এক হাতে একটি লাঠি, অন্য হাতে ছাতা নেবার দস্তুর। লাঠির মর্মার্থ খুঁজতে গিয়ে কানুর মনে হলো অবাধ্য, ঝগড়ুটে, বর-পছন্দ-না-হওয়া কনের জন্য এই বন্দোবস্ত। মরদের হাতে দু ঘা না খেলে গিন্নী হয়ে ওঠা বাকী থেকে যায় নাকি ! হোক সে যতই আনকোরা। তবু লাঠিটা নিতে ইতস্তত করলো কানু। সব ওষুধ তো আর সব রোগীর জন্য নয়। ছাতা ঠিক আছে। ঠা ঠা রোদে ভাজা ভাজা এই দিগরে সূর্যের নীচে উড়তে উড়তে পাখি ঝপ ক'রে পড়ে মারা যায়। নতুন বৌয়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে সোনা অঙ্গ যাতে একটুও কালি না হয় তা তো দেখতেই হবে। কিন্তু তাই বলে লাঠি ! ওরে বাপরে ! খরিশের মতো চাউনি বৌটার। তাতে আবার মাধ্যমিক পাশ।
গাঁয়ের চার কোণায় ছাতা হাতে অনেকক্ষণ বৌ খুঁজে বেড়ালো কানু মাহাতো। গাছের ছায়া লম্বা হতে হতে ঘাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল, কাঁসাইয়ের স্রোত অন্ধকারে এমন গা ঢাকা দিলো যে শুধু শব্দ ছাড়া আর কিছু থাকলো না। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে যে সাদা ফেনা তুমুল হল্লা করে তারা অব্দি গায়েব হলো কী করে কে জানে! উপরন্তু আকাশে মেঘ। গা ছমছমে আন্ধারে দাঁড়িয়ে কানু কুলকুল ক'রে ঘামতে লাগলো। বিয়ের পর দিনই বৌ পালানোর গল্প সে অনেক শুনেছে। কিন্তু পালিয়ে এ বৌ যাবে কোথায় ! দাদা বৌদি বেড়াল পার করবে বলেই না মাধ্যমিক পাশকে বাগালের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
মরীয়া হয়ে কানু ডাক ছাড়ে, বহু, ও লতুন বহু !
খোলা আকাশের নীচে ভালাডুংরির বড় পাথরের গায়ে সেই ডাক ধাক্কা খেয়ে কেমন আর্তনাদের মতো শোনায়। সেহেরি গাছের পাতা খসে পড়ে টুপটাপ। দু একটা বাদুড় উড়ে যায়। দূরের পাহাড় জুড়ে কুয়াশার পর্দা নামতে থাকে।
ঠিক তখনই মেঘ ফেটে যায় দুভাগে। ঝলমলিয়ে চাঁদ ওঠে আর দৃশ্যমান হয় সারা জগত, কাঁসাইয়ের ধারের প্রাচীন মন্দির, সাদা ফেনার হুল্লোড়, ধানের ক্ষেত আর বাতাসে মাথা নাড়ানো গাছের দল। কালো পর্দা সরিয়ে হঠাতই আবির্ভূত হয় এইসব আর রহস্যময় শতাব্দী প্রাচীন রূপের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চরাচর। কানু বৌকে ডাকতে ভুলে যায়, হয়তো ভুলেই থাকতো যদি না তার চোখে পড়তো নদীর মাঝখানে সাদা চরের কালো পলিথিন কুঁড়ের সামনে কার যেন আবছা ছায়া। প্রথমেই সে ভাবলো মাছচোর। বাবা ভৈঁরোনাথের দিব্বি, আজ ওকে ধরবই, এ কথা ভাবতেই লাঠিটা ঘরে রেখে এসেছে বলে দারুণ দুঃখ হলো কানুর। তবু হেই হেই থাম থাম চিৎকারে সাজোয়ান পা-জোড়া ছুটে চললো এক পাথর থেকে আর এক পাথরে, পড়তে গিয়ে টাল সামলে নিলো কতোবার।
শেষে যখন হাঁটু অব্দি জলের ধারা ঠেলে চরের বালিতে পা রাখা, ঠিক তার আগের মূহুর্তে কানু খেয়াল করলো ছায়াটি একজন মেয়েমানুষের। অবলীলায় সে নেমে যাচ্ছে কোমর জলে, হাতে চুবড়ি মতো কিছু একটা। আবার উঠে আসছে, কিছু ঢালছে বালির ওপর, পর মূহুর্তে আবার নামছে জলে। এই ভয়ংকর দ্রুততায় তার চুল খুলে গেছে। ভেজা কাপড় আর জ্যোৎস্না মিলে স্পষ্ট করেছে তার শরীরের প্রতিটি রেখা। যেন সে এক আন্ধার কুহকী, বালি জল কাদা বাতাসে তৈরি তার অবয়ব। চাঁদ লুকালেই অদৃশ্য হয়ে যাবে সে। খন্ড খন্ড হয়ে পড়ে থাকবে কাশ,পাথর, জল, ফেনার মধ্যে।
কানুর শরীরে কাঁটা দিলো। মাথায় ছাতা মারবে কী, সে ততোক্ষণ দেখে নিয়েছে খরিশের মতো চোখ। লতুন বহু !
সে চোখ এখন কানুকে দেখে লাজুক হাসছে,
- লুকইছিলাম। এখন এইদিগে দৌড়ে আইসো। দমে মাছ আইটকে গেইছে জালে। হাওয়াই জলের গন্ধ, আকাশে মেঘ। মনে হছে নদীর জল বাইড়তে চইলেছে। মাছ গিলা চটপট ঝুড়িতে ঝাইড়ে লে।
নদীর ফুলেফেঁপে ওঠার ষড়যন্ত্রে মাছেরা দ্রুত হারিয়ে যাবে খর স্রোতের সঙ্গে একথা বুঝে কানু নিশিডাক শোনা মানুষের মতো, লতুন বহুর পেছন পেছন মাছধরা জালের দিকে এগোয়। দুজনে একসঙ্গে উবুড় হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গীতে হাত ঢোকায় জলের গভীরে।