ক্যা বিরোধী আন্দোলনের সব খবরই সুখবর নয়। যেমন নয় আসামে। লিখলেন একজন ভূমিপুত্র, যাঁকে আর ভূমিপুত্র বলা যাবে কিনা, সেটিই এখন প্রশ্নচিহ্নের আওতায়।
এন.আর.সি আসামে যে উনিশ লক্ষ তালিকাছুট মানুষের নাম রয়েছে তার মধ্যে কত শতাংশ হিন্দু? আরও নির্দিষ্টভাবে বললে কত শতাংশ বাঙালী হিন্দু? ভারতবাসী, এমনকি বিশ্ববাসী জানে, হিন্দুর সংখ্যা বা ক্ষেত্রবিশেষে বাঙালী হিন্দুর সংখ্যা বারো লক্ষের আশেপাশে। আমাদের মতো কিছু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রথম থেকে প্রশ্ন করে আসছিলাম এই তথ্যের সূত্র কী? প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই পরিসংখ্যানের উৎস বিজেপি নেতৃবৃন্দ। একে তো উনিশ লক্ষ মাত্র তালিকাছুট, তার উপর বারো লক্ষ হিন্দু। অতএব এই এন.আর.সি ভ্রান্ত এবং এই ভ্রম সংশোধনের দুটি উপায়। এক নতুন করে এন.আর.সি করা, আর দুই হলো সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে কুড়ি শতাংশ ও অন্যত্র দশ শতাংশ স্ক্রুটিনি করার দাবী তোলা। কিন্তু সব সমাধানের সেরা সমাধান হলো সি.এ.বি সংসদের উভয় কক্ষে পাশ করানো, যাতে বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হিন্দুদের নাগরিক করে নেওয়া যায়। এর পরের ইতিহাসও সবার জানা। সি.এ.বি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সি.এ.এ হয়ে গেল। আর শ্রীযুক্ত শাহ ঘোষণা করলেন সারা ভারতবর্ষের সঙ্গে আসামেও নতুন করে এন.আর.সি হবে। সারা ভারত বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। সি.এ.এ-র বিরুদ্ধে, এন.আর.সি-র বিরুদ্ধে। আসামেও আগুন জ্বললো সি.এ.এ-র বিরুদ্ধে কিন্তু ভিন্নতর কারণে।
প্রশ্ন হচ্ছে সারা ভারতের এই বিক্ষোভ কি বিজেপি-র হিসেবের মধ্যে ছিল না? প্রশ্ন হচ্ছে আসামের এই বিক্ষোভ কি বিজেপি-র হিসেবের মধ্যে ছিল না? অবশ্যই ছিল। যেহেতু ভারত জ্বলছে, আসাম একটু অন্তরালে চলে গেছে। আসামবাসীদের মূল আপত্তি দুটো ক্ষেত্রে। এক, তাদের বোঝানো হয়েছে সত্তর আশী লক্ষ বিদেশীর চাপে নুয়ে পড়েছে আসামের উন্নয়ন। দুই বাংলাদেশ থেকে আসামে ঢুকে পড়া এই বিপুল সংখ্যক বাঙালী (সঙ্গে সারা ভারতবর্ষের থেকে আসামে আসা লক্ষ লক্ষ বিহারী, গোর্খা, নেপালি, সাঁওতাল ইত্যাদি) র চাপে অসমীয়া কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এমনকি এই বহিরাগতদের চাপে অসমীয়াদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এবার সমাধান বিজেপি স্টাইল। সংসদে সি.এ.বি পাশ হওয়া মাত্র আসামে যেমন আগুন জ্বলেছে, ঠিক তেমনি হিন্দুর সংখ্যা বারো লক্ষ থেকে কমে পাঁচ লক্ষে নেমে এসেছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্মার্টলি প্রশ্ন করছেন আচ্ছা এই বারো লক্ষ সংখ্যাটা আপনারা কোথায় পেলেন? নতুন এন.আর.সি-র প্রস্তাবে অসমীয়া জনগণ তেমন আপ্লুত হচ্ছেন না। বরং তাঁরা আতঙ্কিত এন.আর.সি আর সি.এ.এ-র ব্যকল্যাশে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর চাপ বাড়বে আর কোটি খানেক বাংলাদেশী ভারতে ঢুকে পড়বে। যদিও এসব আশংকাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন রাজ্য বিজেপি।
বরং ভারতবাসীর প্রায় অগোচরে দুটি প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। আসাম চুক্তির ধারা ৬নং ধারায় বলা আছে সাংবিধানিক, আইনী ও প্রশাসনিক সুরক্ষা হিসাবে অসমীয়া জনগণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভাষাগত পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য সরবরাহ করা হবে। অসমীয়া জনগণের সামনে এই ৬ নং ধারা টোপ হিসাবে ব্যবহার করছে। এমনকি একটি হাই পাওয়ার কমিটি তৈরী হয়েছে, এবং যতদূর জানি বাঙালী তো নয়ই, তথাকথিত খিলঞ্জীয়া ছাড়া অন্য কোনও ভাষাভাষি মানুষকেই এই কমিটিতে রাখা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ঘোষিত নতুন প্যানেলে সাবেক গৌহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি বিচারপতি (অবসর প্রাপ্ত) বিপ্লব কুমার শর্মা চেয়ারম্যান থাকবেন। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- রমেশ বড়পাত্রগোঁহাইন (অ্যাডভোকেট জেনারেল, আসাম), নিলয় দত্ত (অ্যাডভোকেট জেনারেল, অরুণাচল প্রদেশ), সুভাষ দাস (প্রাক্তন আইএএস), পল্লভ ভট্টাচার্য (প্রাক্তন আইপিএস), ডাঃ সৃস্টিধর দত্ত (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক), সুমন্ত চলিহা (লেখক ও কলামিস্ট) , ডঃ জয়কান্ত শর্মা (অধ্যাপক ও কলামিস্ট), ওয়াসবীর হুসেন (প্রবীণ সাংবাদিক), সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য (প্রধান উপদেষ্টা, আসু)। ফলে বাঙালী এবং অখিলঞ্জীয়া মানুষ আতংকিত। কারণ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক সুরক্ষা নয়, সামাজিক, ভাষাগত পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে ভাষার প্রশ্নটি এখানে বাংলাভাষির হাড়ে কাঁপুনি ধরাচ্ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসাম মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেট কমিটির মিটিং এ গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ।
১. ভারতের প্রতিটি রাজ্য ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে মাইগ্রেশনের কারণে, রাজ্যের ভাষায় কথা বলার লোকের সংখ্যায় প্রভেদ হতে পারে। তবে কোন ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যটি পুনর্গঠিত হয়েছিল তা মনে রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৪৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বরাক উপত্যকা, বিটিএডি অঞ্চল এবং পার্বত্য জেলা বাদে অসমিয়া ভাষাকে অসমের রাজ্য ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে পারে।
২. আসাম সরকার পরবর্তী বিধানসভা অধিবেশনে আইন নিয়ে আসবে যে, সমস্ত ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে পড়াতে হবে। তবে এই আইন পার্বত্য জেলা, বিটিএডি, বোডো অধ্যুষিত অঞ্চল এবং বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
এই মিটিং এর শেষ দুটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে
১৭. আসামের আদিবাসীন্দাদের ভূমির অধিকার রক্ষার জন্য অসম বিধানসভার পরবর্তী অধিবেশনে একটি বিল পেশ করা হবে।
১৮. আসামের ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিল আসাম বিধানসভার পরবর্তী অধিবেশনে প্রবর্তিত হবে।
চাকুরীর ক্ষেত্রেও খিলঞ্জীয়াদের জন্য সিংহভাগই সংরক্ষিত হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আসামের সি.এ.এ বিরোধী প্রবল বিক্ষোভ সামাল দেবার টোপ দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনসমীয়া জনগণের জমি-জিরেত বা রুটিরুজি নিয়ে আতংকিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখানে আরও একবার আসাম চুক্তির ছয় নম্বর ধারা রূপায়ণের প্শেনটি খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অসমীয়া জনগণের ক্ষতে প্রলেপ দেবার জন্য যে হাই পাওয়ার কমিটি তৈরী হয়েছে সে কমিটির টার্মস অব রেফারেন্সগুলি এরকম:
এখানে প্রশ্ন উঠবেই অসমীয়া কারা? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন খিলঞ্জীয়া বা ভূমিপুত্র কারা? শ্রীহট্ট বা গোয়ালপাড়ার প্রাচীন বাসীন্দা কিন্তু বাংলাভাষী তারাও ভূমিপুত্র নয়? ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যারা সেই বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে এ দেশে এসে জমি আবাদ করলো তারা ভূমিপুত্র নয়? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে আসাম চুক্তিই কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ? কারণ এটি তো সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত নয়। তা ছাড়া ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত রাজ্যের ভূমিপুত্রদের জন্য সিংহভাগ সংরক্ষণ করা শুরু হলে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই একই দাবী উঠবে। নাগরিক ও অনাগরিক প্রভেদ, আর শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী (!!!) প্রভেদের পর ভূমিপুত্র ও বহিরাগত নিয়ে সারা ভারতে নতুন করে আগুন জ্বলবে।
দ্বিতীয় কারণটি আরও ভয়ংকর। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিধানসভার বিজেপি বিধায়কদের এক গোপন সভায় সর্বানন্দ সানোয়াল এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মার উপস্থিতিতে অসমীয়া বিধায়করা বাঙালী বিধায়কদের কোনঠাসা করে ফেলেন। সভায় দাবী ওঠে জনগণনায় অসমীয়া পরিচয় লেখাতে হবে বাঙালী হিন্দুদেরও। অথচ বাঙালী হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে আজও হিন্দুত্ববাদের রমরমা। সবাই বিশ্বাস করে বসে আছে কবে লাইনে দাঁড়াবে আর মোদিশা প্রত্যেকের হাতে একটা করে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেবে। মুসলিমদের যে বাদ দেওয়া হয়েছে তাতেও একাংশ প্রবল খুশী। শুধু ধর্মে হিন্দু হলে হবেনা। কর্মে বিজেপিও হতে হবে। জিঘাংসু অসমীয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে পুচ্ছ আন্দোলন আর উচ্ছিষ্টভোগী বরাকের নেতৃত্ব মুসলিম বিতাড়ণ এর সুখস্বপ্নে বিভোর। তার বিনিময়ে যদি উপত্যকা বেচে দিতে হয় সেও ভি আচ্ছা। ধর্মীয় অত্যাচার কেন হবে, ভাষিক অত্যাচার হোক। বাঙালী হিন্দুর ললাটলিখন কোনদিন খণ্ডানো যাবে না। বাঙালী মুসলমানের ললাটলিখন কি খণ্ডানো যাবে? বোধহয় না। ভাষাবন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। এখন ধর্মবন্ধন ললাটলিপি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ আপাততঃ ভিকট্রি ল্যাপের প্রস্তুতি নিচ্ছে।