প্রশ্ন তো উঠতেই পারে ওয়েট লিস্টে যারা তাদের কেন চাকরি হবে? মেইন লিস্টে যারা আছে তাদেরই হলো না যখন এখনও? ওয়েট লিস্ট অনশনে বসে পড়লেই হলো? মামদোবাজি !!
দোলের দিন পাড়ায় প্রভাতফেরি হল। কী সুন্দরী সব মহিলা, সুবেশ পুরুষ, খোল দ্বার খোলের সঙ্গে অভিজাত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। যে তরুণের বাইকে চেপে প্রেস ক্লাবে যাচ্ছিলাম সে বলল,দেখছেন রাস্তাও লালে লাল, আর আবীরের গন্ধমাখা। অসাধারণ গদ্য আর কবিতা পড়লাম কিছু। সত্যি অসাধারণ। এমনকি যেখানে ছেলেমেয়েরা অনশনে বসেছে সেখানেও বাঁধানো বেদীর মস্ত গাছে নতুন কচি পাতা। শুধু বাইশ দিনের উপোসে শুকনো মুখগুলোতে বসন্ত অনুপস্থিত। হাতে প্ল্যাকার্ড, রোদ এড়াতে ছাতা আর ফুটপাথে বিছানো ত্রিপলের ওপর ক্ষিদে আর আশাভঙ্গের অভিঘাতে শুয়ে আছেন যারা, তারা এ দেশের হবু শিক্ষক !
অজস্র মেয়েরা অনশন করছেন। ধারেকাছে লেডিজ টয়লেট নেই, আর্মি এরিয়া বলে ত্রিপল খুলে দেয় বার বার, রাতের হাওয়ায় অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ভেসে আসে, একজন নয়, দুজনের গর্ভপাত হয়েছে, দ্বিতীয়জনের পারিবারিক সম্মানবোধ সে কষ্ট তাকে নীরবে গলাধঃকরণ করিয়েছে, তবু তারা লড়ছেন। ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনশন করছেন আজ বাইশদিন। আমার পাশে বসা মেয়েটির মুখ বড় মলিন। জিজ্ঞেস করে জানলাম সে হাসপাতালফেরত। অক্সিজেন নেওয়া শেষ হতেই আবার এসে বসেছে।অঙ্কের এম এস সি মেয়েটির প্রশ্ন, সরকার যে বলে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই বলে এতো পদ খালি, আমরা তবে কারা ?
মেডিকেল কলেজের হবু ডাক্তারবাবুরা আমার সামনেই স্বেচ্ছাশ্রম দিতে এলেন। শুনলাম সকালেও ওরা ব্লাড প্রেসার, সুগার চেক করে গেছেন। অনশনকারীদের সকলের রক্তে গ্লুকোজ বিপজ্জনক ভাবে কম। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন, ডেঙ্গু খুব হচ্ছে দুর্বল শরীরগুলোতে। তবু ওরা বলছেন, আমাদের আর কোন উপায় নেই। পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। হয় চাকরি, নয় মৃত্যু।
প্রথমেই যে প্রশ্ন তোলা তার উত্তরেই লুকিয়ে আছে গোটা ব্যাপারখানার ব্যাখ্যা। শুনুন তবে, গোটা পশ্চিমবঙ্গে মোট কতো স্কুলটিচারের পদ খালি আছে তার কোন ঘোষণা হয়নি। অথচ স্কুল সার্ভিস কমিশনের গেজেট অনুযায়ী চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রকাশের ১৫দিন আগে আপ টু ডেট ভেকেন্সি জানাতে তারা বাধ্য। অনশনকারীরা জানাচ্ছেন নিজের নিয়ম নিজেই ভাঙছে সব সরকারি সংস্থা। ২০১৭ মে মাসে রেজাল্ট বেরলো, নিয়মানুযায়ী উচিত ছিল ২০১৭র এপ্রিল অব্দি কতো শূন্যপদ আছে তার তালিকা প্রকাশ করা। কিন্তু বাস্তবে করা হল ২০১৫ অব্দি। মাঝের দুবছর কি উবে গেল ?
কথা বলে জানা গেল, নিয়ম হয়েছিল ১:১.৪ অনুপাতে নিয়োগ হবে (লিফলেটে অবশ্য দেখা যাচ্ছে অনুপাতটি ১:১:৪, কিন্তু সম্ভবত সেটি ছাপার ভুল। ) অর্থাৎ ১০টি সিট থাকলে ১৪ জনকে ডাকবে, ৪ জন থাকবে ওয়েটলিস্টে। তার মানে ১০০ জনে ৪০ জন থাকবে ওয়েট লিস্টে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ১০০ পদের ওয়েট লিস্টে রাখা হয়েছে ২৫০/৩০০ জনকে। এই বেনিয়মগুলো না হলে আমরা আজ রাস্তায় শুয়ে থাকতাম না, সখেদে বলে লক্ষ্মীকান্তপুরের তরুণটি। তার প্রশ্ন গত ৭ বছর রিক্রুটমেন্ট হয়নি, ভেকান্সিগুলো গেল কোথায়?
এছাড়াও অঙ্কিত অধিকারীসংক্রান্ত ঘটনা, টাকাপয়সার লেনদেন, আরো অনেক বেনিয়ম নিয়ে কথা বলতে তারা দৃশ্যতই বিব্রত বোধ করছে। কারণ মঞ্চটিকে অরাজনৈতিক রাখতে হবে তো। কিন্তু মুখ খুললেই যে জড়িয়ে যাচ্ছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল। সান্ত্বনা দেবার সাধ্য ছিল না, তাদের ফান্ডে অল্প সাহায্য আর সমবেদনার প্রকাশ ছাড়া এ শর্মার আর কোন সাধ্যই নেই।
তবু ফিরতি পথে পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া দেড় কোটি টাকার গাড়ি, উড়ালপুলের ওপর থেকে পাঁচতারা হোটেলের কালো কাচ ফুঁড়ে তার সুসজ্জিত অন্দরমহল দেখতে দেখতে ফিরতি আমি-র কানে বাজতে লাগলো এক তরুণের আক্ষেপ - একটা সিস্টেম গড়ে উঠতে এতো সময় লাগে, আর সেই সিস্টেমকে ধ্বংস করে দিতে কতো অল্প সময় ! মদ খেয়ে মরলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়, আমরা অনশনে মরলে কি হবে ?
আমার কথা যাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না, তাদের দোলের চূড়ান্ত শুভেচ্ছা জানিয়েও বলি, আমাকে মিথ্যুক এবং অনশনকারীদের ষড়যন্ত্রী প্রমাণের জন্যও তো ওদের কাছে আপনার একবার যাওয়া উচিত, ওদের বক্তব্য শোনা উচিত। আরো নতুন অনেক কথা জানতে পারবেন যা এই লেখায় নেই। নাগরিক সমাজের চাপে যদি প্রশাসন যদি ওদের সমস্যা নিয়ে বসে সেটা হবে মানবতার জয়।