তারিখটা ছিল ৩ অক্টোবর। সাল ১৯২৩। একজন চিকিৎসক তাঁর প্রাত্যহিক নিয়মে একজন রোগী দেখে দুপুরে বাড়িতে ফিরলেন। তিনি নিজেও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। নিজে ভালো বোধ করছিলেন না। সন্ধেবেলায় প্রয়াত হলেন। সেরকম কোন চিকিৎসাই হলনা। কিংবা বলা ভালো চিকিৎসার হাতিয়ারই বিশেষ ছিলনা তখন উচ্চ রক্তচাপের জন্য। মারা গেলেন শুধু কলকাতা, বাংলা বা ভারত নয়, সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম মহিলা যিনি চিকিৎসাবৃত্তিকে জীবনের ধর্ম, জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। জন্মের সাল তারিখ জানা যায় ১৮ জুলাই, ১৮৬১। যদিও সংসদ বাঙ্গালী চরিতাভিধান অনুযায়ী জন্মের তারিখ ৮ মে – একেবারেই রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী। তাঁর জীবন নিয়ে কথা বলার সুবাদেই এসে পড়বে তাঁর সময়কালে চিকিৎসার চালচিত্র, সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং নারী হিসেবে সমাজের যে বিশেষ ভার ও সংঘাত বহন করতে হয়েছে সেসবের কথা। ১৫০ বছর উজিয়ে এসে আমাদের নতুন করে ফিরে দেখতে হবে সেসমস্ত দিনগুলি। হয়তো বা আমাদের মনে একবারের জন্য উঁকিও দিয়ে যেতে পারে যে আমরা এই মহীরুহ বা টাইটানদের তুলনায় কতটা গুল্মজাতীয় বা বামন।
সেই সময় (ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ) – চিকিৎসা, সমাজ, সংস্কৃতি
করোনা অতিমারিকালে আমরা যখন ভেন্টিলেটর, ECMO, উচ্চ চাপের অক্সিজেন প্রবাহ কিংবা অন্যান্য উচ্চপ্রযুক্তির চিকিৎসায় মুগ্ধ হয়ে থাকছি সেরকম সময়ে আমাদের একবার অতীতকে দেখে নিতে পারি, নেওয়া দরকার। অতীতের সিঁড়িগুলো যত্ন নিয়ে সাজানো হয়েছিল বলেই আজ আমরা ধাপে ধাপে উপরে উঠছি।
১৯২৩ সালে কাদম্বিনী যেসময় মারা যান কিংবা ১৮৬১ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন সেরকম সময়ে কি ছিল উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা? এমনকি ১৯৫০-এর দশকে খোদ আমেরিকার নিউ ইয়র্কে বস্তুত চিকিৎসার হাতিয়ার বলতে ছিল কেবল ভাত এবং চালের জল খাইয়ে যাওয়া (অন্য খাবার প্রায় কিছুই দেওয়া হতনা) কিংবা এক বিশেষ ধরণের সার্জারির সাহায্যে শরীরের নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ু কেটে দেওয়ার মতো পদ্ধতি। মেডিসিনের জগতে সর্বাধিক মান্য জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ “The Hypertension Paradox — More Uncontrolled Disease despite Improved Therapy” শিরোনামের প্রবন্ধে (২৭ আগস্ট, ২০০৯) লেখা হচ্ছে – “the prevailing medical opinion well into the 1950s was that lowering of elevated blood pressure was detrimental because it would impair perfusion of vital organs and thereby increase the risk of cardiovascular and renal diseases. Three early pioneers who thought otherwise and aggressively pursued blood-pressure lowering were Walter Kempner, Reginald Smithwick, and Robert Wilkins. Each had a different approach: Kempner used dietary manipulation; Smithwick, surgery; and Wilkins, drug therapy.”
অর্থাৎ ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত চিকিৎসসার জগতে প্রাধান্যকারী ধারণা ছিল যে রক্তচাপ কমিয়ে দিলে শরীরের প্রধান অঙ্গগুলোতে (যেমন হার্ট, কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি জায়গায়) রক্তপ্রবাহ কম চলাচল করবে। ফলে রক্তচাপ কমাতেই হবে এরকম কোন বালাই চিকিৎসকমহলে ছিলনা। অথচ, বাস্তবে এর ঠিক উল্টোটাই ঘটে। দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে কিডনি, হার্ট, রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাহোক, সেসময় অব্দি চিকিৎসার জন্য ওষুধই বা কটা ছিল? ছিল ব্রোমাইড গোত্রের ওষুধ, ছিল জোঁক দিয়ে রক্তমোক্ষণ (এমনকি একদিনে ১০-১২ আউন্স অব্দি রক্তমোক্ষণ করা হত), ছিল পটাসিয়াম থায়োসায়ানেট এবং Lumbodorsal sympathectomy। ১৯৫০-এর দশকে এলো Rauwolfia serpentine বা সর্পগন্ধা গাছের ক্ষার থেকে তৈরি রেসার্পিন, যদিও এখানে উল্লেখ করা দরকার সর্পগন্ধা গাছের মূল থেকে তৈরি ক্কাথের ব্যবহার আয়ুর্বেদে প্রায় হাজার বছর বা তার বেশি সময় ধরে প্রচলিত ছিল।
এশিয়ার আধুনিক মেডিসিনের প্রথম প্রতিষ্ঠান কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নক্ষত্র ছাত্র ছিলেন সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী – যে চারজন ছাত্র প্রথম উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা করেছিলেন তাঁদের একজন এবং প্রথম ভারতীয় যিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস (IMS)-এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৪) প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে (“Present State of Medical Profession in India”) বলেছিলেন – “যে সময়ের কথা বলছি সেদিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়তো তাহল বগলে একটি বাক্স নিয়ে কবিরাজেরা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। এই বাক্স ভর্তি থাকত বিভিন্ন গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন ধরনের ওষুধে। এরা যখন বিভিন্ন বাড়িতে যেত সেসময় গৃহস্থকে তুলসী বা বেল পাতার সাথে কিভাবে এসব ওষুধ খেতে হবে বিশেষ করে বুঝিয়ে বলত”। একই প্রবন্ধে পরবর্তীতে লিখছেন – “এই কবিরাজদের মধ্যে কেউ কেউ শাস্ত্রাভিজ্ঞ এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। এরকম দু’জন হচ্ছেন রামদুর্লভ সেন ও নীলাম্বর সেন যাদের পরিচিতি বহুবিস্তৃত ছিল এবং কথিত যে এরা অসাধারণ সব আরোগ্য ঘটাতে পারতেন। আমি নিজে ৩০ বছর আগে বিস্মিত হয়ে দেখেছি নীলাম্বর সেন একজন রোগী দেখতে গেলে গ্রামের লোকজন তাঁকে একবারটি দেখার জন্য কিভাবে দৌড়ে আসতো এবং গোটা রাস্তার ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি যে রোগীর কথা বলছি তার অন্তিম দশা ছিল। তিনি যখন বুঝলেন যে রোগীর চিকিৎসা করে কোন ফল লাভ হবেনা তিনি দৃঢ়ভাবে রোগীর পরিণতির পূর্বাভাস দিলেন এবং রোগী কবে ও কোন সময়ে মারা যাবে সেকথা বলে দিলেন। এই ভবিষ্যদবাণী সঠিক ছিল।” একই প্রবন্ধে তিনি প্রায় ২০ ধরনের ভ্রাম্যমান গ্রামীণ চিকিৎসকের উল্লেখ করেছিলেন – “besides the Kobirajes, Barber-Surgeons, Ticcadars, and midwives, there are a host specialists. There were itinerant eye-doctors, who went about to perform the operation of extraction for the cataract; itinerant phlebotomists, who bled for all sorts pains and aches; itinerant lithotomists, who cut for stone in the bladder; itinerant cuppers; itinerant leech-men; itinerant devotees, who sold all manner of charms and amulets for prevention and cure of diseases; itinerant exorcisers, who pretended to cure hysteria, mania, and epilepsy by expelling evil spirits; Ojhas, who professed to extract the venom from poisoned wounds by charms, incantations, ad religious mummeries; priests of Hindu temples, who advised penance and money-gifts to particular idols, who, they said, had the power effecting miraculous cures; cauterisers, who used gool (or burning coal) and red-hot iron for chronic disorders; acupuncture-men, who would puncture the enlarged spleen and liver; issue-men, who would make large issues on the legs and arms for all diseases of plethora; women-doctors for complaints connected with generative functions; travelling-aurists; tooth-extractors; and so on.” এই চিত্র কেবল বাংলার গ্রাম বা শহরের ছিলনা। প্রবন্ধের শিরোনাম থেকে বোঝা যায় ভারতের সর্বত্রই প্রায় একই রকম চিত্র ছিল – কিছু ইতরবিশেষ থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতে হবে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক অ্যালান ওয়েবের লেখা Pathologia Indic’a (১৮৪৮, লন্ডন) পুস্তকে পাতার পর পাতা জুড়ে বর্ণনা রয়েছে কিভাবে প্রসূতি মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রসবকালীন পরিস্থিতি জটিল হলে খোদ মেডিক্যাল কলেজে একের পর এক মহিলার মৃত্যু হয়। একটি ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কলেজের মিডওয়াইফারির অধ্যাপক ডঃ স্টুয়ার্ট সখেদে বলছেন – “The second remark I may make, is one of self-condemnation for not applying the forceps.”
সেসময় একদিকে যেমন মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হচ্ছে, এর কিছুদিন পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হবে, ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে নারীমুক্তির প্রশ্নও খানিকটা সামাজিক গুরুত্ব পাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে গোঁড়া, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ রয়েছে, রয়েছে আয়ুর্বেদের চর্চা, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রকৃত আন্দোলন হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে, কুলিন প্রথা সামাজিভাবে গ্রাহ্য হয়ে থাকছে। আবার কলকাতার নীচু বর্গের মানুষের মাঝে জড়িবুটি এবং গার্হস্থ্য চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকছে। সেসময় বেদেনীদের তৈরি ওষুধ কলকাতার রাস্তায়, ঘরে ঘরে ঘুরে বিক্রী চলছে –
এই ওষুধ মোর ছুঁতে ছুঁতে,
হুড়কো বউ যায় আপনি শুতে,
বারো-ফাটকা পুরুষ যারা,
আঁচল-ধরা হয়ে উঠে!
(সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, The Parllour and the Streets, 1998, p. 106)
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সেসময়ের সমাজে নারীদের বিশেষ অবস্থান এবং সাহিত্যে এর প্রতিফলন নিয়ে অল্প কথায় বলছেন – “The code of love as found in English romantic novels of the period, marked by a display of male gallantry and heroism, female subservience and the ultimate triumph of fidelity and domestic bliss, was presented in Bankim’s novels in the framework of the traditional brahminical value system,” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬১)
তৎকালীন সামাজিক মানসিকতার আরেকটি পরিচয় ধরা আছে রাজনারায়ণ বসুর সে কাল এ কাল-এ। রাজনারায়ণ লিখছেন – “কোন উদ্ভট কবিতাকার, হিন্দুদিগের প্রাতঃস্মরণীয় স্ত্রীলোকদিগের নাম যে শ্লোকে উল্লেখিত আছে, তাহার পরিবর্তে সে কালের কতিপয় ইংরাজ মহাত্মার নাম উল্লেখ করিয়া এই শ্লোকটি প্রস্তুত করিয়াছিলেন।” মূল শ্লোক ছিল – “অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা। / পঞ্চ কন্যাঃ স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনং।।” সে শ্লোক হয়ে গেল – “হেয়ার্ কল্বিন্ পামরশ্চ কেরি মার্শমেন্সতথা। / পঞ্চ গোরাঃ স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনং।।”
এরকম এক ঐতিহাসিক সময়কালে আমাদের আলোচিত এই বীর নারীরা তাঁদের যাপিত জীবনে আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করেছেন। সময়কে ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন। আগামী সময়ের বৈতালিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সমগ্র বাঙ্গালী তথা ভারতীয় সমাজে এবং সামাজিক মানসিকতায় এঁদের কাজ গণবিতর্কের সূচনা করেছিল। গণবিতর্ক এবং ডিসকোর্সের প্রধান উপাদান হিসেবে ছিল – সামাজিক সংস্কার বনাম রক্ষণশীলতা, ঐতিহ্য বনাম আধুনিক আইন, এবং, সর্বোপরি, নারীবাদের উন্মেষ। ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর “The Difference-Deferral of a Colonial Modernity: Public Debates on Domesticity in British Bengal” প্রবন্ধে বলছেন – “It was thus that the idea of the ‘new woman’ came to be written into the techniques of the self that nationalism evolved, which looked on the domestic as an inseparable part of the national. The public sphere could not be erected without reconstructing the private.” (Subaltern Studies, VIII, p. 58)
কাদম্বিনীর কথা
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মহিলা ছাত্রদের ভর্তি করা নিয়ে চিন্তাভাবনা ১৮৭৬ সাল থেকে শুরু হয়। সেসময়ের বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল এ বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। ১৮৮১-তে প্রধানত ভর্তি হতে উৎসাহী ছাত্রীদের অভিভাবকদের চাপে এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় “discussing the question of accepting an inferior admission qualification for lady students.” (Centenary Volume, 1935, p.46) এই দলিলের ভাষ্য অনুযায়ী সম্ভবত ১৮৮৪ সালে প্রথম মহিলা হিসেবে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি অ্যাডমিশন নেন (বা বলা ভালো অ্যাডমিশনের অধিকার পান)। উল্লেখ করা দরকার যেহেতু অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিলনা সেজন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ মহিলাদের ভর্তির ব্যাপারে গররাজি ছিল। কাদম্বিনী এর আগে ১৮৮০ সালে First Arts (FA) পরীক্ষা পাশ করেন। ১৮৮২-তে কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু যুগ্মভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে উত্তীর্ণ হন। মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসেও পুরুষ ছাত্রদের তরফে কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে কাদম্বিনীকে। এবং বিশেষ করে একজন শিক্ষকের (ডঃ আর সি চন্দ্র) নিতান্ত ব্যক্তিগতভাবে কাদম্বিনীর বিরুদ্ধে বিরূপতার কারণে (এর প্রধান কারণ ছিল এই ভদ্রলোক প্রবল নারীশিক্ষা বিরোধী ছিলেন) মেটেরিয়া মেডিকা এবং কম্প্যারেটিভ অ্যানাটমির পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হন মাত্র এক নম্বরের জন্য। ফলে তাঁর পক্ষে এমবি ডিগ্রি অর্জন করা হলনা। কিন্তু সেসময় কলেজের প্রিন্সিপালের বিশেষ ক্ষমতা ছিল পাশ করানোর। সে ক্ষমতার বলে তৎকালীন প্রিন্সিপাল ডঃ জে এম কোটস কাদম্বিনীকে GBMC (Graduate of Bengal Medical College) ডিগ্রি দেন। ১৮৮৬ সালে আরেক বীর নারী আনন্দবাই যোশীর সাথে (যদিও আনন্দবাই আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়া মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করেন) প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হলেন। সরকারের তরফে মহিলা ছাত্রদের জন্য মাসিক ২০ টাকা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হয়। স্কলারশিপের “retrospective effect” হিসেবে কাদম্বিনী ১৮৮৩-র জুলাই মাস থেকে তাঁর প্রাপ্য স্কলারশিপের সুবিধে পান (অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, উইমেন সায়ান্টিস্টস ইন ইন্ডিয়াঃ লাইভস, স্ট্রাগলস অ্যান্ড অ্যাচিভমেন্ট, ২০১৮, পৃঃ ১৪১) এরপরে একক একজন মহিলা হিসেবে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে ১৮৯২ সালে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, কাদম্বিনী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ব্রাহ্মসমাজের একজন সক্রিয় নেতা তথা কর্মী এবং নারীমুক্তির প্রশ্নে সোচ্চার ও সামাজিক/শ্রমিক আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সাথে। তাদের বিবাহের ফসল ৫ জন সন্তান। দ্বারকানাথ বিপত্নীক ছিলেন। তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানের সংখ্যা ৩ জন। মোট ৮ জন সন্তানকে মানুষ করেছেন কাদম্বিনী। সংসার সামলেছেন, কলকাতায় রীতিমতো প্র্যাকটিস করেছেন, সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন, এমনকি রাজনৈতিক কাজেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ২১ শতকেও এর তুলনা মেলা ভার। আমরা এঁদেরকে স্বীকৃতি জানাতে না পারলে, অন্তরের শ্রদ্ধাটুকু নিবেদন করতে না পারলে আমরা মানুষ হিসেবে বামন থেকে বামনতর হয়ে থাকবো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় তাঁর এক কন্যা জ্যোতির্ময়ী পরে রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং পুত্র প্রভাসচন্দ্র সাংবাদিকতায় যান।
১৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছন। ১৩ এপ্রিল, ১৮৯৩-এ তিনি “Triple Diploma” কোর্সের জন্য ফর্ম পূরণ করে জমা দেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এবং মেডিক্যাল কলেজের GBMC ডিগ্রি থাকার জন্য নিতান্ত স্বল্প সময়ে পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন করেন। অবশ্য তার আগে তাঁকে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস-এ ক্লাস করতে হয়। অবশেষে ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কটিশ কলেজ থেকে “Triple Diplomas” – LRCP (Licentiate of the Royal College of Physicians), LRCS (Licentiate of the Royal College of Surgeons, University of Glasgow) এবং LFPS (Licentiate of the Faculty of Physicians and Surgeons, University of Dublin) – ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ফিরে আসেন দেশে। সেবছর মোট ১৪ জন Triple Diplomas পায়। তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা (বি কে সেন, “ফিমেল গ্র্যাজুয়েট অফ ব্রিটিশ এম্পায়া্র – কাদম্বিনী গাঙ্গুলি”, সায়ান্স রিপোর্টার, জুলাই, ২০১৪)। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন – “becoming the first fully qualified woman physician in India. Mrs. Ganguly’s case was hardly typical even among the more emancipated Brahmo and Christian women in contemporary Bengali society.” (David Kopf, The Brahmo Samaj and the Shaping of the Modern Indian Mind, 2015, p. 125) একই সাথে প্রসূতিবিদ্যা এবং শিশুরোগের বিষয়ে কাদম্বিনী বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ইংল্যান্ডে যাবার আগে ১৮৮৮ সালে তিনি লেডি ডাফরিন উইমেন’স হসপিটাল-এ চিকিৎসক হিসবে যোগ দেন। সেসময় তাঁর মাসিক মাইনে ছিল ৩০০ টাকা (বর্তমান মূল্যে প্রায় ৪৫০,০০০ টাকার সমান)। এর সাথে জড়িয়ে একটি ছোট ইতিহাস আছে। ভারতীয় মহিলাদের চিকিৎসার দুরবস্থার কথা মাদ্রাজের চিকিৎসক মেরি শারলিয়েব এবং অন্যান্যদের কাছে শুনে রাণী ভিক্টোরিয়া তৎকালীন ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি ডাফরিনকে বলেন মহিলাদের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি ফান্ড তৈরি করতে। সালটা ছিল ১৮৮৫। সরকারের তরফে কিছু অর্থ সাহায্যও করা হয়। কিন্তু প্রধান অর্থ সাহায্য আসে এদেশের ধনী পার্শি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে, ধনী বাঙ্গালীরাও এতে কিছু পরিমাণে অংশগ্রহণ করে। এই ফান্ডের নাম হয় ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়শন ফর সাপ্লায়িং ফিমেল এইড টু দ্য ফিমেল অফ ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে ডাফরিন ফান্ড)। (ডেভিড আর্নল্ড, কলোনাইজিং দ্য বডি, পৃঃ ২৬২-২৬৩) এই ফান্ডের টাকায় কলকাতায় লেডি ডাফরিন উইমেন’স হসপিটাল তৈরি হয়। এবং নারী চিকিৎসকেরা কিছু পরিমাণে প্রশাসকের ভূমিকাও পালন করছিলেন। নারীদের জন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি physical-social space তৈরি হল। এ ঘটনা ঐতিহাসিক। এর আগে ভারতে কখনো ঘটেনি। আর্নল্ড মন্তব্য করছেন – “It was possible for women doctors to “colonize” this social and professional space precisely because it was largely inaccessible to male physicians, and though the latter were (as the editorials in the Indian Medical Gazette attest) initially hostile to the development, there seems to have been a more ready acceptance than in Britain at the time that women had a distinctive role to perform.” (আর্নল্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬১)
যেসময়ের কথা আলোচনা হচ্ছে সেসময় সম্পন্ন ঘরের মহিলাদের চিকিৎসার জন্য অন্দরমহলে পুরুষ চিকিৎসকের প্রবেশাধিকার ছিলনা – চালু ভাষায় “জেনানা” বা “পর্দা প্রথা” বহাল তবিয়তে চালু ছিল। বাংলায় ঠাকুর পরিবারের মতো অঙ্গুলিমেয় দু-একটি গৃহ ছাড়া মাদ্রাজ বা বোম্বের ক্ষেত্রেও একই চিত্র ছিল। ফলে বিশেষ করে উচ্চবর্গের মহিলাদের চিকিৎসার জন্য মহিলা চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত বাড়ছিল। শুধু উচ্চবর্গের কথাই বা বলি কেন মেডিক্যাল কলেজে ১৮৪০-৪১ সালে প্রসূতি বিভাগ চালু করার পরে উঁচুতলার মহিলারা তো নয়ই এমনকি নীচুতলার (যাদের নামগোত্রহীন, পরিচয়হীন হতভাগ্য দেহ মেডিক্যাল কলেজে ডিসেকশনের কাজে ব্যবহার করা হত) মহিলারাও প্রসবের জন্য মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে চাইত না। ফলে প্রসূতিবিভাগ কার্যত অকার্যকরী হয়ে পড়ে থাকার উপক্রম হয়েছিল। অথচ প্রগতিশীল ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন-এর অনুসরণে তৈরি মেডিক্যাল কলেজের সিলেবাসে ছাত্রদের শিক্ষার জন্য শিক্ষাক্রমে “মিডওয়াইফারি”-র শিক্ষা আবশ্যিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১০০ জন রোগীকে রেখে প্রসব ও চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজে। অবশেষে ১৮৪৯-৫০ সালে একটি নতুন কায়দা নেওয়া হল – ভর্তি হওয়া গরীব চালচুলোহীন মায়েদের পারিতোষিক তথা “ঘুষ” দেওয়া হবে – “to encourage women to resort to the Institution for delivery, and, for this purpose, it became necessary to hold out many little advantages to them, ‘for the present at least’, in the shape of clothes for themselves and their children when they depart, allowances for tobacco”. (General Report on Public Instruction, From 1st Oct. 1849 to 30th Sept. 1850, p. 129) মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ গুডিভ উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন – “The number of patients has continued to increase during the past year (there are at this moment twenty women awaiting their in the Wards, and I expect others daily), in yet larger proportion than formerly, and I have no doubt, if properly managed and supported, the already established utility of this Institution will rapidly advance in importance.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯)
আবার কাদম্বিনী
এর আগে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রসঙ্গে ডাক্তার মেরি শারলিয়েবের যে পরিচিতির কথা উল্লেখ করেছি সেই শারলিয়েবের সাথে কাদম্বিনীর এক অদৃশ্য যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল ফ্লোরেন্স নাইটেংগেল মারফত। অন্য দিক থেকে দেখলে ফ্লোরেন্স নাইটেংগেলের যে আগ্রহ জন্মেছিল উপনিবেশিক ভারতের এই অসামান্যা নারী সম্পর্কে তার যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছিলেন শারলিয়েব।
১ ডিসেম্বর, ১৮৮৭, নাইটেংগেল শারলিয়েবকে একটি চিঠিতে লিখলেন – “I am so stupid I cannot find my memorandum of the name of that Hindu lady [Ganguly] who will graduate at Calcutta next spring as a qualified medical woman and whom her cousin, a friend of mine, Mrs. Manmohun Ghose, of Calcutta, asked me to mention to Lady Dufferin. But I shall find the memorandum and then by your kind leave ask you.” এরপরে ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৮, নাইটেংগেল শারলিয়েবকে আবার লিখলেন – “Do you know or could you tell me anything about this lady Mrs. Ganguly, or give me any advice?... asked me to recommend Mrs. Ganguly, if she is successful, to Lady Dufferin, for any post about the female wards in Calcutta. Mrs. Ganguly is, I believe, a young woman of high caste and cultivation and it would be a great encouragement to the Hindu ladies to embrace medicine if she were appointed. The Hindu lady’s name is Mrs. Kadambini Ganguly still studying in the Medical College at Calcutta; [she] has already passed what is called the first licentiate of medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination March next. (This young lady, Mrs. Ganguly, married! After she had made up her mind to become a doctor! And has had one; if not two children since. But she was only absent thirteen days for her lying-in! And did not miss, I believe, a single lecture!!) (Florence Nightingale on Social Change in India, ed. Gerard Valle, 2007, pp. 763, 764) একজন গর্ভবতী নারী তাঁর পূর্ণ গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রসবের আগে মাত্র ১৩ দিন কলেজের ক্লাস বাদ দিয়েছেন বা বলা ভালো ক্লাসে আসা সম্ভব ছিলনা। বাকি সময়টা আর সবার মতো নিয়মিত ক্লাস করে গেছেন – এ ঘটনা আরেক মহাদেশের ও ভিন্ন সংস্কৃতির নাইটিংগেলকে বিস্মিত এবং চমৎকৃত করেছে। ১৫০ বছর পরেও আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে – কি অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও মনের জোর থাকলে এটা করা সম্ভব! বর্তমান সময়েও এমনটা ভাবা দুষ্কর।
অথচ লেডি ডাফরিন হাসপাতালে ইংরেজ চিকিৎসকদের সমতুল্য মর্যাদা তিনি পাননি। সেখানেও উপনিবেশ কালের এবং নারী হবার যন্ত্রণা তাঁকে বহন করতে হয়েছে। একদিকে ইংরেজদের সাথে সমান মর্যাদা পাবার জেদ, অন্যদিকে স্বাধীন নারী হিসেবে তাঁর চিকিৎসক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার দুর্মর দৃঢ়তা তাঁকে বোধ করি ভিন্ন মাত্রার শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর জীবনের দুটো ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। কলকাতার এক সম্পন্ন বাড়িতে এক প্রসূতির সফলভাবে প্রসব করানোর পরে কাদম্বিনী এবং তাঁর সহকারীকে বারান্দায় যেখানে বাড়ির কাজের লোকের খাবার দেওয়া হ্য় সেখানে খেতে দেওয়া হয়েছিল এবং নিজেদের বাসন ধুয়ে রাখতে হয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতাও তাঁকে সঞ্চয় করতে হয়েছে। সেসময়ের সমাজে একজন মহিলা চিকিৎসককে একজন ধাই-এর উন্নত সংস্করণের অতিরিক্ত কিছু ভাবার মানসিক জগৎ জন্ম নেয়নি। তাঁর পেশাগত জীবনে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল একজন পুরুষ চিকিৎসক একজন নারীর পেটে টিউমার হয়েছে বলে ডায়াগনোসিস করেন। কিন্তু কাদম্বিনীর ডায়াগনোসিস ছিল মেয়েটি গর্ভবতী এবং তিনি পরবর্তীতে সফলভাবে সন্তান প্রসব করান। ১৮৯৫-৯৬ সালে তিনি নেপালের রাজমাতার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দায়িত্ব পান। (বি কে সেন, প্রাগুক্ত)
১৮৮৭ সালে কাদম্বিনী যখন মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক হচ্ছেন সেবছরেই তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির লেখা “Slave Trade of Assam” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে কে কে মিত্র সম্পাদিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র সঞ্জিবনী-তে। দ্বারকানাথ আক্ষরিক অর্থে একজন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরে শ্রমিকদের অবর্ণনীয় অবস্থা এবং নিদারুণ শোষণ প্রত্যক্ষ করেন। পরে সহযোগী হিসেবে পান বিপিনচন্দ্র পালকে। কংগ্রেসের অধিবেশনে আসামের শ্রমিকদের অবস্থা উত্থাপনও করেছিলেন। সাফল্য আসেনি। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব একে প্রাদেশিক বিষয় বলে এড়িয়ে যান। ফলে যা হবার তাই হল। দ্বারকানাথদের উদ্যম সর্বভারতীয় স্তরে এসে অর্থহীন হয়ে গেল। (নির্মল সিনহা, ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৮১৮-১৯০৪, ১৯৬৮, পৃঃ ৪১৫-১৬)
১৮৮৯ সালে বম্বেতে কংগ্রেসের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে স্বর্ণকুমারী দেবী, পণ্ডিতা রমাবাই, কাদম্বিনী সহ মোট ৬ জন মহিলা প্রতিনিধিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন দ্বারকানাথ এবং তাঁর সহযোগীরা। কংগ্রেসের অধিবেশনে সেটাই হল প্রথম মহিলা প্রতিনিধিত্ব। বোম্বে অধিবেশনের পরের বছর ১৮৯০-এ কলকাতায় কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে কাদম্বিনী ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯১০, সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হল – “The last Congress saw more than a hundred native ladies. And not only did native ladies attend the Congress, but one of them, Mrs. Kadambini Ganguly, B.A., even addressed the assembly. How delighted was it to see one of India’s daughters addressing such an assembly in English!” (নির্মল সিনহা, ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৮১৮-১৯০৪, ১৯৬৮, পৃঃ ৫৫৬-৫৭) তাঁর ইংরেজিতে সুললিত বক্তব্য সম্মেলনের প্রতিনিধিদের মাঝে আলোড়ন (stir) তৈরি করে। এখানে আমরা খেয়াল করবো নিশ্চয়ই যে কলকাতা সম্মেলনে ১০০ জনের বেশি মহিলা প্রতিনিধিত্ব থাকা। অথচ একবছর আগে সংখ্যাটা ছিল ৬। এক নতুন জাতীয়তাবাদী জাগরণের উন্মেষকাল তখন।
১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে মহিলাদের সম্মেলন সংগঠিত করেন কাদম্বিনী। ১৯০৮-এ ট্রান্সভালে গান্ধির নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছিল তাকে সমর্থন করে কলকাতায় মিটিং সংগঠিত করেন। ১৯১৪ সালে গান্ধির সম্মানে আয়োজিত সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভাতে সভাপতিত্ব করেন কাদম্বিনী। আসামের শ্রমিকদের দুরবস্থা মোচনের জন্য দ্বারকানাথ যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে উদ্যোগের সহগামী ছিলেন তিনি। ১৯২২ সালে কবি কামিনী রায়ের সাথে বিহার এবং উড়িষ্যায় যান কয়লা খনিতে শ্রমিকদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য। (বি কে সেন, প্রাগুক্ত)
Chronology of Medical College/Institution which Started Admission for Women Students | ||
S No. | Year | Medical College/Institution |
1. | 1850 | Women’s Medical College of Pennsylvania, USA |
2. | 1874 | London School of Medicine for Women, UK |
3. | 1875 | Madras Medical College (India) |
4. | 1883 | Calcutta Medical College (India) |
5. | 1884 | Bombay University (India) (Grant Medical College) |
6. | 1886 | Edinburgh School of Medicine for Women, UK |
7. | 1888 | Campbell Medical School (Sealdah, Calcutta) |
8. | 1895 | Christian Medical College for Women, Ludhiana, India |
Chronology of Indian Women Achievers in Medicine | ||||
S. No. | Year | Name | Degree | Name of Medical College |
1. | 1886 | Kadambini Ganguly | GBMS (Graduate of Bengal Medical College) | Calcutta Medical College, Calcutta |
2. | 1886 | Ananadibai Joshi | Graduate in Medicine | Women’s Medical College, Pennsylvania, Philadelphia, USA |
3. | 1892 | Gurubai Karmarkar, | M D | Women’s Medical College, Pennsylvania, Philadelphia, USA |
4. | 1894 | Rukmabai | M D | London School of Medicine for Women, London. |
5. | 1894 | Haimabati Sen | Graduate in Medicine | Campbell Medical School, Calcutta |
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নারী ছাত্রীদের ভর্তি না করার যে প্রথা চালু ছিল ১৯১৫ সালে কাদম্বিনী প্রকাশ্যে সে প্রথাকে আক্রমণ করেন। কেন নারীরা ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এ প্রশ্ন স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেন। (চন্দ্রানী সাধ্য, “ওয়ান অফ দ্য পায়োনিয়ারস ইন ওয়েস্টার্ন মেডিসিন – ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলি”, Aegafum Journal, 2020, p. 965) মনে রাখতে হবে, এর আগে কংগ্রেসের সম্মেলনে তাঁর ভাষণ এবং কয়লা খনির শ্রমিকদের সাথে সরকারি কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত হবার সুবাদে তাঁর বক্তব্যের সামাজিক গুরুত্ব ও ওজন ছিল। ১৯১৫-র পরে নারীদের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হবার ব্যাপারে একেবারেই কোন বিধিনিষেধ রইলনা বলা চলে।
ভাগ্যিস কাদম্বিনী নির্ভয়া বা হাথরাসের ঘটনা দেখে জাননি। হয়তো বিমূঢ় হয়ে যেতেন এটা স্বাধীন ভারতের ঘটনা ভেবে। তিনি তো উপনিবেশ কালের নারী। স্বাধীন ভারতের জন্য এমন বার্তা রেখে যাবার কথা ঘোর দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি নিশ্চয়ই!
সংযোজন পরবর্তীতে আমরা অন্য চিকিৎসকদের কথা আলোচনা করবো। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আনন্দবাই যোশী, রুক্ষ্মাবাই এবং গুরুবাই কর্মকার – তিনজনই বোম্বের, এবং বাংলার হৈমবতী সেন ও মাদ্রাজের অ্যান জগন্নাথন।
খুবই তথ্যবহুল লেখা, সমৃদ্ধ হলাম
অসাধারণ টান টান একটা লেখা । তথ্য সমৃদ্ধ ।
খুব ভালো লাগলো লেখাটি স্যার
তথ্য বহুল ও অসাধারণ লেখনী ।
লেখাটি পড়ে খুব সমৃদ্ধ হলাম।জানলাম অনেক না জানা কথা।
পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। কীভাবে এক বাঙালি তরুণীর /রমণীর অদম্য লড়াইয়ের ফলে এক সুচির তমসার উন্মোচন ঘটিয়ে আলোকোজ্জ্বল দিনের সূচনা হয়েছিল তার এক সুলিখিত বিবরণ পাঠ করে।এমন তথ্যবহুল সুখপাঠ্য নিবন্ধ উপহার দেবার জন্য রচয়িতাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ! এই প্রণম্যা নারীদের নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
Darun lekha,narider agrogatir ei history aro besi kore alochito haoa darkar.Kato rakom badha otikrom kore je ei aloy tader aste hoachhe ta sabar , bisesh kore seisab manusder besi kore jana darkar jara ajo vay pay ba nijeder nari bole nijerai abohela kare.
চিকিৎসার সাথে আপনি যেভাবে কাদম্বিনীর জীবনদর্শনকে মিলিয়ে এই পাঠ নির্মাণ করেছেন, মিলিয়েছেন ওঁর লড়াই এবং রাজনীতিবোধকে, তা কুর্নিশ জানানোর মত। ইতিহাসকে যে কীভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে, আপনার লেখা থেকে নিয়ত শিখি।
সমৃদ্ধ হলাম এই গবেষণা ধর্মী লেখাটি পড়ে,কিছুটা জানা কিছুটা অজানা ছিল,আমাদের বিদ্যালয়গুলির পাঠ্যপুস্তক এ এই মহামানবী র জীবনকাহিনী অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।