আমরা এর আগে বাংলার তথা ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে আলোচনা করেছি। সমসাময়িক কালে আনন্দবাই যোশী, রুক্মাবাই, হৈমবতী সেনের মতো আরও কয়েকজন অপ্রতিরোধ্য বীর চিকিৎসক-নারী আমাদের ভারতেই জন্মেছেন। এদেশের মাটিতেই চিরকালের জন্য শায়িত হয়ে আছেন। এবার তাঁদের কাহিনি।
আনন্দবাই যোশী (১৮৬৫-১৮৮৭)
মেডিসিনের মধ্যে অদৃশ্য দুটি ভাগ আছে। একদিকে রয়েছে “নরম” বিষয় যেমন শিশুরোগ, চর্মরোগ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা ইত্যাদি যেগুলো নারীদের জন্য বেশি প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে রয়েছে “কঠোর” বিষয়গুলো যেমন কার্ডিও-থোরাসিক সার্জারি, অস্থিবিদ্যা, নিউরোসার্জারি ইত্যাদি যেগুলোকে ধরে নেওয়া হয় পুরুষদের জন্য বেশি উপযুক্ত। মেডিসিনে এমডি এ দুয়ের মাঝে পড়ে। তবে ১৮৮৬ সালে উপনিবেশিক ভারতের কোন নারী/মহিলা যদি মেডিসিনে এমডি করার জন্য সরাসরি আমেরিকা পাড়ি দেন তাহলে তাকে কোন স্পেস বা অঞ্চলে স্থাপন করা যাবে তা বিশেষ ধন্দের বিষয় হয়ে ওঠে তো বটেই।
আনন্দবাই যোশী এরকম এক মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করা নারী, যিনি কাদম্বিনী গাঙ্গুলির মতোই বিদেশ থেকে পাশ করা ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। আনন্দবাই-এর জীবন বড়ো সুখের ছিলনা। মহারাষ্ট্রের কল্যাণে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্ম ৩১ মার্চ, ১৮৬৫। পরিবারের ১০ সন্তানের মাঝে ৬ নম্বর সন্তান তিনি। তাঁর আরও পাঁচ বোন এবং চার ভাই ছিল (অবশ্য দুজন পুত্র সন্তানের অকালমৃত্যু হয়)। মাত্র ৯ বছর বয়সে ৩১ মার্চ, ১৮৭৪ সালে বিয়ে হল তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড়ো গোপালরাও যোশীর সাথে। আনন্দবাই স্বামীর রাখা নাম – “হৃদয়ের আনন্দ”, বাবার বাড়িতে নাম ছিল যমুনা। আনন্দবাই-এর ১৪ বচর বয়সে অর্থাৎ ১৮৭৮ সালে এক সন্তানের জন্ম হয়। ১০ দিনের মাথায় সে সন্তান মারা যায়। তাঁর গভীর উপলব্ধি হল যে উপযুক্ত চিকিৎসক না থাকার জন্য শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনা তাঁকে চিকিৎসক হবার ব্রতের দিকে যেতে উজ্জীবিত করে তুললো। সন্তানের মৃত্যুর পরে তাঁর উপলব্ধি আমাদের গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায় – “একটি শিশুর মৃত্যু তার পিতার কোন ক্ষতি করেনা, কিন্তু মা চায় না তার সন্তান তাকে ছেড়ে চলে যাক।” (Caroline Healy Dali, The Life of Dr. Anandabai Joshee, Boston, 1888, p. 32)
প্রসঙ্গত উল্লেখ করার যে আনন্দবাইকে লেখার জন্য তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত Caroline Healy Dali-র এই বইটির ওপরে আমি সর্বাধিক নির্ভর করেছি।
সন্তানের মৃত্যুর পরে আনন্দবাই এবং গোপালরাও দুজনেই চেষ্টা করেন যাতে আনন্দবাই বোম্বের মিশনারি স্কুলে ভর্তি হতে পারেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি। তখন তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে আনন্দবাই সংস্কৃত এবং ইংরেজিতে সুপণ্ডিত হবার কাজে ব্রতী হন। তাঁর এক বন্ধুকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে তাঁরা কলকাতায় ১৮৮১ সালের ৪ এপ্রিল এসে পৌঁছেছিলেন। (Dali, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮) কিন্তু বোম্বে থেকে কলকাতায় আসার আগে গোপালরাও একটি বৃহৎ কর্ম করেছিলেন, যা পরে আনন্দবাই-এর জীবনের মোড় ঘোরানোর ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছিল। এখানে কাদম্বিনীর জীবনে দ্বারকানাথের যে উজ্জ্বল ভূমিকা তার সাথে এ ঘটনার সাদৃশ্য বিপুল পরিমাণে রয়েছে।
সেসময় বোম্বে প্রদেশের প্রায় সমস্ত শহরে Presbyterian মিশনারিদের দেখা যেত। এরকম এক মিশনারির সঙ্গে গোপাল রাও-এর পরিচয় হয়ে থাকবে। আমেরিকায় প্রিন্সটনে বসবাসকারী তেমনই এক মিশনারিকে গোপালরাও ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৮-এ একটি চিঠি লিখলেন আনন্দবাই-এর লেখাপড়ার বিষয়ে। এ চিঠিকে ফরওয়ার্ড করে দেওয়া হল প্রিন্সটনের “মিশনারি রিভিউ” পত্রিকার সম্পাদক ডঃ ওয়াইল্ডারের কাছে। সে চিঠিগুলো ছাপা হল পত্রিকাটির জানুয়ারি, ১৮৭৯ সংখ্যায়। সঙ্গে ছিল ওয়াইল্ডারের প্রত্যুত্তর। ওয়াইল্ডার “thoroughly discourages Gopal’s project. He evidently does not wish any unconverted Hindu to come to America; he believes that his intelligent correspondent will be led to “confess Christ” and trusts to the mission schools to educate Mrs. Joshee sufficiently.” (Dali, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩-৩৪)
এরপরের ইতিহাস বিশেষ কৌতূহলজনক। থিওডিসিয়া কার্পেন্টার নাম্নী এক ফিল্যানথ্রপিস্ট এবং আধ্যাত্মবাদী মহিলা নিউ জার্সির এক ছোট শহর রসেলে থেকে এলিজাবেথ শহরে তাঁর ডেন্টিস্টকে দেখাতে যান। দেখানোর আগে চেম্বারে অপেক্ষা করার সময়ে মিশনারি রিভিউ-এর পুরনো সংখ্যাগুলি দেখতে। সংখ্যাগুলি ঘাঁটতৈ ঘাঁটতে হঠাৎ গোপাল রাও-এর চিঠিগুলো তাঁর চোখে পড়ে। তাঁর মনে হয়েছিল – “a genuine cry for help, and her whole soul roused to indignation by the brutal manner in which she thought this cry was repulsed.” (p. 35) তিনি গোপাল রাও-এর ঠিকানা টুকে নিয়ে বাড়ি যান। তাঁর অন্তর বলছিল এই সাহায্যপ্রার্থী মেয়েটিকে সাহায্য করা দরকার। মার্চ, ১৮৮০-র কোন একদিন তিনি গোপাল রাও-কে কোলাপুরের ঠিকানায় চিঠি লেখেন। অনেক ঘুরে সে চিঠি পৌঁছয় গোপালের হাতে। তাঁর চিঠিতে কার্পেন্টার “offered the shelter of her own home to the young wife in whom she had already begun to feel a tender interest.” (p. 36) এরপরে আনন্দবাই এবং শ্রীমতী কার্পেন্টারের মধ্যে নিয়মিত, অব্যাহত দীর্ঘ পত্রালাপ চলতে থাকে। দুজনে দেখা না হওয়া সত্ত্বেও এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। আনন্দবাই কার্পেন্টারকে “মাসি” (aunt) সম্বোধন করে চিঠি লেখেন। কার্পেন্টার আনন্দবাইকে “বোনঝি” হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরা এ ইতিবৃত্তের এখানে ইতি টানি। কিন্তু এটুকু মাথায় রাখি আনন্দবাই স্বধর্মে, স্ব-পোষাকে, স্ব-সংস্কৃতিতে পূর্ণত স্থিত থেকে একেবারে অচেনা কয়েক হাজার মাইল দূরের এক মহাদেশে, অজানা অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছেন কেবলমাত্র ডাক্তারি শিক্ষালাভের জন্য। স্ব-তে স্থিত থাকার জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময়ে কি কলকাতা, বারাকপুর বা শ্রীরামপুরে, কি আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়াতে অনেক নিগ্রহ সইতে হয়েছে, বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছে। এমনকি তাঁর গায়ে ঢিল ছোড়া হয়েছে। কিন্তু তিনি অটল প্রত্যয়ে নিজের কাজ করেছেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৩-র এক চিঠিতে আনন্দবাই লিখলেন – “আমি ২৪ ফেব্রুয়ারিতে শ্রীরামপুর কলেজে আমার বিদেশ যাত্রা এবং এ বিষয়ে সাধারণ কৌতূহল মেটানোর বিষয়ে লেকচার দিই। প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় এবং কিছু ইউরোপীয় আমার লেকচার শোনার জন্য ভিড় করেছিলেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯১) সে ভাষণে তিনি বলেন – “We must try. Never mind whether we are victorious or victims. Manu has divided people into three classes. The meanest are those who never attempt anything for fear of failure. Those who begin, & are disheartened by the first obstacles, come next, but those who begin, & persevere through failure & obstacles, are those who win.” তাঁর ভাষণেক বিষয়ে জেনে তৎকালীন পোস্ট মাস্টার জেনারেল এইচ ই এম জেমস গোপাল রাওকে তাঁর বিদেশ যাত্রার সাফল্য কামনা করে ১০০ টাকার একটি চেক দেন। শুধু তাই নয়, তিনি এ কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহে ব্রতী হন। যাঁরা সেসময়ে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কয়েকজন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল – ২০০ টাকা, লেফটন্যান্ট গভর্নর – ১০০ টাকা, প্রধান বিচারপতি গার্থ – ৫০ টাকা, মি. জেমস – ২০০ টাকা। এভাবে মোট ৭৫০ টাকা সংগৃহীত হয় আনন্দবাইয়ের বিদেশ যাত্রা সুগম করার জন্য। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৩) লক্ষ্য করার বিষয়, এ সৌভাগ্য কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে জোটেনি।
অবশেষে কলকাতা বন্দর থেকে ৭ এপ্রিল, ১৮৮৩ সালে তিনি আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। নিউ ইয়র্কে পৌঁছন ৪ জুন, ১৮৮৩-তে। সেখানে কার্পেন্টার দম্পতি তাঁকে সাগ্রহে বরণ করে নেন একান্ত নিকট আত্মীয়ের মতো। রসেলেতে কার্পেন্টার দম্পতির গৃহে ৪ জুন থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত অবস্থান করেন তিনি। এরপরে পেনসিলভ্যানিয়ায় যাত্রা। ওয়মেন’স মেডিক্যাল কলেজ-এ ভর্তির আগে নিউ ইয়র্কে হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজে একটি স্কলারশিপের “অফার” পান, কিন্তু সবিনয় প্রত্যাখ্যান করেন। ৩ অক্টোবর, ১৮৮৩ – পেনসিলভ্যানিয়ার কলেজ থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি পান। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১) তাঁর ক্লাস শুরু হবার কয়েকদিন আগে ডিন ডঃ বডলি আনন্দবাইয়ের সম্মানে একটি ডিনার পার্টি দেন। প্রোফেসর হোয়াইট প্রথম লেকচার দিলেন “Physic”-এর ওপরে। অ্যানাটমির ডেমন্সট্রেটর ডঃ এমিলি দু বয়েস দুয়েকদিন ক্লাস নেবার পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৯ অক্টোবর, ১৮৮৪, ফিলাডেলফিয়া থেকে কার্পেন্টারকে চিঠিতে জানাচ্ছেন – “the opening address was by Professor Parish ... the subject being Practical Hygiene ... I have to attend all the lectures except those on Materia Medica and Surgery, which I take up next year. I work from fifteen to sixteen hours daily”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১১)
৭ মার্চ, ১৮৮৬, তাঁর “মাসী”-কে জানাচ্ছেন – “গতকাল রেজাল্ট পেয়েছি এবং আমি পাশ করেছি। শেষ পেপারের শেষ প্রশ্নে আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমি জানিনা বাক্য সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলাম কিনা। এমনকি অধ্যাপককে অভিবাদন না জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছি। আমাদের জাপানী বন্ধুরা খুব ভালো করেছে। সিরিয়ার বন্ধুরাও অসুস্থতার পরেও ভালো করেছে।
(Anandabai’s medical classmates. From left- Anandibai Joshi from India, Kei Okami from Japan, Tabat Islambooly from Syria. Image Source: Wikimedia Commons.)
আমেরিকা যাবার আগে বোম্বেতে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন – “কেন আমি আমেরিকা যাচ্ছি?” তাঁর উত্তর ছিল – “আমি আমেরিকা যাচ্ছি কারণ আমি মেডিসিন নিয়ে পড়াশুনো করতে চাই ... ভারতে একেবারে সুযোগ নেই এমনটা নয়। কিন্তু অসুবিধে প্রচুর। মাদ্রাজে একটি কলেজ আছে এবং ধাত্রীবিদ্যা সব মেডিক্যাল কলেজেই পড়ানো হয়। কিন্তু যা শেখানো হয় তাতে ভ্রান্তি আছে এবং অসম্পূর্ণ ... আমি খ্রীষ্টান কিংবা ব্রাহ্ম কোনটাই নই। একজন হিন্দু নারী হিসেবে স্বধর্মে থেকে মেডিক্যাল শিক্ষা করা ভারতের সব প্রান্তেই সমস্যাসংকুল।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৩-৮৫)
অবশেষে ১১ মার্চ, ১৮৮৬, তিনি মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হলেন। তিনি যে থিসিসটি জমা দিয়েছিলেন তার পূর্ণ চেহারা এরকম – Obstetrics Among the Aryari Hindoos, Submitted to the Faculty of the Women's Medical College of Pennsylvania for the degree of Doctor of Medicine, Anandibai Joshee, Class of 1886”। তাঁর থিসিসের শুরুতেই তিনি বলেন – “The Hindoos divide the signs into those of conception & of pregnancy. "The signs of conception if carefully observed are: the women feels languid [,] fatigued, thirty with weakness of the thighs, irritable with throbbing in the vagina. Fecundation not uncommonly sets in with febrile reaction in which case high temperature, full[,] quick and headache and thirst are very marked. bounding pulse, anoerexia[,] Fever may set in with a sense of chilliness or may be nervous in character. Duration from a few days to 2 weeks.”
১ জুন, ১৮৮৬, কোলাপুরের অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হসপিটালে ফিজিসিয়ান-ইন-চার্জ হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। নিউ ইয়র্ক থেকে যাত্রা করেন ৯ অক্টোবর, ১৮৮৬ তারিখে। কিন্তু এ পদে যোগ দেবার আগেই ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৭ তারিখে দীর্ঘদিন যক্ষ্মায় ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি বলেছিলেন – “Let the surgeon bear in mind that they are but second hands to Nature and any effort should be to assist Nature.” (মৃদুলা রামান্না, ওয়েস্টার্ন মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ ইন কলোনিয়াল বোম্বে ১৮৪৫-১৮৯৫, ২০০২, পৃঃ ২০০)
একটি ২১ বছরের মেয়ে বা নারী যে অসীম ঝড়ঝাপটার সাথে লড়াই করে ভারত থেকে আমেরিকায় গিয়ে শুধুমাত্র ভালো চিকিৎসক হবার জন্য সবকিছু করেছেন, আমেরিকা থেকে রওনা হবার (৯ অক্টোবর, ১৯৮৬) দুদিন পরে “এট্রুসিয়া” জাহাজ থেকে তাঁর স্বামী গোপালরাও জানাচ্ছেন যে আনন্দবাই বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না। বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করে বাইরে নিয়ে আসার পরে এত অস্থির হয়ে পড়ছিলেন যে সামান্য বাতাসও সহ্য করতে পারছিলেন না। শেষ অব্দি ওপিয়েট দিয়ে স্থির করতে হয়। (Dali, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭২) দ্য ইন্ডেক্স পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৬, গোপাল রাও-এর একটি চিঠি থেকে জানা যায় – “আমরা নিউ ইয়র্ক থেকে লিভারপুলে এলাম সবার অনেক যত্নের মধ্যে। জাহাজের ডাক্তারবাবু দিনে দুবার করে ডঃ যোশীকে দেখে গেছেন। আমরা নিরামিষাশী বলে জাহাজে যখন দরকার আঙ্গুর, আপেল, বেদানা, পীচ ছাড়াও ভেজিটেবল স্যুপ, টম্যাটো, আইস ক্রিম, সেঁকা আপেল, পুডিং সবকিছু পাওয়া গেছে। আমরা সম্মান পেয়েছি। যখন ডঃ যোশী আমেরিকায় ছিলেন এবং ইংল্যান্ডে পা রাখার আগে পর্যন্ত কখনো জানতে পারেননি যে ইংরেজরা কালা চামড়ার মানুষদের ব্যাপারে কতটা বিদ্বেষ পোষণ করে। প্রায় ৪ বছর ধরে তিনি সাদা মানুষদের মধ্যে বাস করেছেন যেখানে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে মহিলা বলে গণ্য হয়েছেন”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৩) মিসেস কার্পেন্টারকে লেখা শেষ চিঠিতে আনন্দবাই জানাচ্ছেন – “আমি আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছি। কাশির উন্নতি হয়েছে, গলার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একটু খেতে পারলেই আমি ভা্লো হয়ে যাবো। তোমার মহার্ঘ্য আত্মাকে আমি হারিয়ে ফেলিনি। আমি বিছানায় বসে লিখছি এবং আমার ডাক্তারবাবুকে দিনে দুবার করে দেখাচ্ছি।” দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার শেষের দিকে আনন্দবাই বাড়াবাড়ি রকমের সংকটজনক হয়ে পড়েন। এসময়ে প্রতিটি মুহূর্তে গোপাল রাও পাশে থেকে নার্সের মতো মমতা নিয়ে সেবা করেছেন।
যাহোক, বোম্বেতে এসে কোলাপুরের বাড়িতে পৌঁছনোর পরে সমস্ত আত্মীয়স্বজনেরা ভিড় করে দেখতে আসে। তিনি আধা-চেতনে থাকতেন, কখনো আবার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেননি। আমেরিকার কোন কোন মেডিক্যাল জার্নালে চাঁদা পাঠাতে হবে সেসব নিয়ে ভেবেছেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮০) একের পর এক ডাক্তার পালটানো হয়েছে। কোন উপকার হয়নি। একজন ডাক্তার পুণাতে যাবার পরামর্শ দেন। অবস্থা আরও খারাপ হয়। পুণার মানুষ তাঁর আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা শুরু করে। ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বোঝা গেল শেষের সেদিন আর দূরে নেই। বাড়িতে এসে ব্রাহ্মণেরা শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান শুরু করেন। অবশেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭-র মধ্যরাত্রিতে তাঁর পৃথিবীতে থাকার অন্তিম লগ্ন এল। তাঁর শ্রবণযোগ্য শেষ শব্দগুলো ছিল – “আমার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল আমি সবকিছু করেছি।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮৫)
চিতায় তাঁর দেহ তোলার পরে ভি এম রানাডে একটি ছোট বক্তব্য রাখেন এবং তারপরে দাহকার্য সম্পন্ন হয়। রানাডে বলেছিলেন – “But she is dead! That sweet intellectual soul, that large-brained self-forgetful womanly creature – dead at the early age of twenty-one years and eleven months – dead on the threshold of the work for which she was so well equipped!” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮৬)
রুক্মাবাই রাউত
রুক্মাবাই ১৮৬৪ সালের ২২ নভেম্বর এক ছুতোর মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেসময় ছুতোরদের মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহের প্রচলন ছিল বলে রুক্মাবাই-এর মা জয়ন্তী দ্বিতীয় বিবাহ করেন বিপত্নীক ডঃ সখারাম অর্জুনকে। সেসময় রুক্মাবাই-এর বয়স সাড়ে আট বছর। আড়াই বছর পরে যখন রুক্মাবাই-এর বয়স ১১ সেসময় তাঁর বিয়ে দেওয়া হয় ১৯ বছর বয়সী দাদাজি ভিকাজির সাথে। ছেলেটি অকর্মণ্য ছিল। লেখাপড়াও বিশেষ জানত না। এজন্য রুক্মাবাই পিতৃগৃহেই থাকেন। পরে তাঁর বয়ঃসন্ধি প্রাপ্তির পরে স্বামীগৃহে যাবার কথা উঠলে তিনি আপত্তি করেন। তাঁর পাশে পান সৎপিতা ডঃ সখারাম অর্জুনকে। ডঃ সখারাম অর্জুন রিফর্মিস্ট বা সংস্কারপন্থী ছিলেন। এবং তাঁর সুবাদেই রুক্মাবাই বিখ্যাত সংস্কারক এবং নারীদের স্বাধীনতাপন্থী বিষ্ণু শাস্ত্রী পণ্ডিত এবং ইউরোপীয় চিন্তার সংস্পর্শে আসেন। শেষ অব্দি রুক্মাবাই-এর বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা আদালত অবধি গড়ায়। শিশু মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে কিনা এ প্রশ্নে ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৮ পর্যন্ত বিভিন্ন কোর্টে মামলা চলে। সেসময়ে আলোড়ন ফেলা এ মামলার শিরোনাম ছিল “Restitution of conjugal rights”।
রুক্মাবাই-এর একটি প্রতিবেদন টাইমস অফ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে “A Hindu Lady” শিরোনামে (জুন ২৬, ১৮৮৫) ছাপা হয়। সে প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র ভাষায় তাঁর বক্তব্য রাখেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র তৎকালীন সম্পাদক হেনরি কারওয়েন নারীমুক্তির সপক্ষে ছিলেন এবং রুক্মাবাই-এর ঘটনায় উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ নিয়ে “A Hindu Lady”-তে এক জায়গায় রুক্মাবাই-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল – “has destroyed the happiness of my life. It comes between me and the thing which I prize above all others—study and mental cultivation”। আমরা পরের শব্দদুটোর দিকে নজর দিই – “স্টাডি” এবং “কাল্টিভেশন”। অর্থাৎ, একজন বালিকা তথা মানুষের পড়াশুনো, অনুসন্ধিৎসা এবং মানসিক বৃত্তির উন্নত চর্চা দুটি থেকেই বাল্যবিবাহের ফলে বঞ্চিত হয়। রুক্মাবাই-এর ঘটনাটি সম্পর্কে নীরা দেশাই এবং উষা ঠক্কর বলছেন – “The case brought to the surface the acute tension pertaining to social change and gender justice.” (Women in Indian Society, 2001, p. 126)
একের পর এক আদালত ঘুরে নিষ্পত্তি না হওয়ায় পরিশেষে রুক্মাবাই রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে চিঠি লেখেন। সে চিঠি প্রকাশিত হয় তখন ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ-এ – ১৫ জুলাই ১৮৮৭, ২য় পৃষ্ঠায়। চিঠিটিতে তিনি লেখেন – “Everywhere it is considered one of the greatest blessings of God that we are under the protection of our beloved Queen Victoria's Government, which has its world wide fame for best administration. If such a Government cannot help unyoke us Hindu woman, what Government on earth has the power to relieve the daughters of Ind from their present miseries? This 50th year of our Queen's accession to the most renowned throne is the jubilee year in which every town and every village in her dominions is to show their loyalty in the best way it can, and wish the mother Queen a long happy life, to rule over us for many years with peace and prosperity. At such an unusual occasion will the mother listen to an earnest appeal from her millions of Indian daughters and grant them a few simple words of change into the book on Hindu law- that ‘marriages performed before the respective ages of 20 in boys and 15 in girls shall not be considered legal in the eyes of the law if brought before the Court.’ This mere sentence will be sufficient for the present to have enough check on child marriages, without creating a great vexation among the ignorant masses. This jubilee year must leave some expression on us Hindu women, and nothing will be more gratefully received than the introduction of this mere sentence into our law books. It is the work of a day if God wished it, but without His aid every effort seems to be in vain. So far, dear lady, I have dwelt on your patience, for which an apology is necessary. With best compliments –
I remain yours very sincerely,
Rukhmabai.”
রানি ভিক্টোরিয়ার হস্তক্ষেপে কোর্টের রায় রুক্মাবাই-এর সপক্ষে যায়। এ রায়ের প্রভাব পড়ে ১৮৯১ সালের “Age of Consent Act”-এ – বিবাহকালীন সহবাসের বয়স ১০ থেকে বেড়ে ১২ হয়। কাদম্বিনী এবং আনন্দবাই-এর ক্ষেত্রে আমরা যা দেখেছি সামাজিক ক্ষেত্রে একদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ, অন্যদিকে ইউরোপীয় আধুনিক চিন্তা ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থানকে পুনর্নিধারণ করতে শুরু করল, যার ফসল ও সুফল ভোগ করছি আমরা একবিংশ শতাব্দীতে। এভাবেই পৃথিবী এগোয়।
সেসময়ে বোম্বের কামা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক এডিথ পেচে-র (Edith Pechey) কাছ থেকে সহযোগিতা পান পরবর্তী পড়াশুনো চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে। এমনকি রুক্মাবাই-এর জন্য অর্থ সংগ্রহেও ব্রতী হন এডিথ। এছাড়া সহযোগিতা পান শিবাজিরাও হোলকারের কাছ থেকে, যিনি নগদ ৫০০ টকা অর্থসাহায্য করেন। ডাফরিন ফান্ড থেকেও আর্থিক সাহায্য লাভ করেন। “The Rukhmabai Defence Committee” নামে একটি তহবিলও খোলা হয়। অবশেষে ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। ভর্তি হন লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিন ফর উইমেন-এ। ১৮৯৪-এ গ্র্যাজুয়েট হিসেবে পাশ করেন। এরপরে ব্রাসেলস থেকে তাঁর এমডি ডিগ্রি অর্জন এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রয়্যাল ফ্রি হসপিটাল-এ। প্রশিক্ষণ শেষে ফীড়ে আসেন দেশে। অনারারি সার্জন হিসেবে কামা হাসপাতালে ৮ মাস কাজ করেন। পরবর্তীতে সুরাটের মোরাভাই বজ্রভূষণদাস হাসপাতালে যোগ দেন। (অনন্যা চট্টোপাধায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৪২-৪৩) তবে তাঁর কর্মজীবন বিস্তৃত ছিল ১ জানুয়ারি, ১৯৫৫-তে মৃত্যু পর্যন্ত।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ মে, ১৮৯০ সংখায় তাঁর একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয় – “A CASE OF MYXOMA OPERATED UPON AT THE WOMEN'S HOSPITAL, SURAT. By RUKHMABAI, L.R.C.P. & S., M.D. (Bkux.), Medical Officer in Charge, Women's Hospital, Sural. WITH THE KIND ASSISTANCE OF B. H. BENNETT, MAJOR, I.M.S., Civil Surgeon.”
ল্যান্সেট-এর মতো বন্দিত মেডিক্যাল জার্নালে “Rukhmabai: doctor and social reformer” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (নভেম্বর ৯, ২০১৯, পৃঃ ১৭০৩)। লেখিকা জর্জিনা ফেরি। তিনি জানাচ্ছেন – “In 1918, Rukhmabai was offered a medical officer role in the Women’s Medical Service (WMS), founded by the British Indian administration 4 years previously. But she chose instead to accept a position at the Rasulkhanji Zenana Hospital in Rajkot, where she supervised the care of women
in the more than 200 semiautonomous princely states of Saurashtra (now part of Gujarat).” উপনিবেশিক ভারতে প্লেগ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির মতো সময়ে রুক্মাবাই প্রাণ দিয়ে, মমতা নিয়ে মানুষকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন জনস্বাস্থ্যের অবস্থান থেকে। এর ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কাইজার-এ-হিন্দ মেডেল দিয়ে সম্মানিত করে। জর্জিনা ফেরি জানাচ্ছেন – “She also raised money from her contacts among the maharajas and nawabs of Saurashtra to train Indian women as nurses.”
যে অসম বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে তাঁর জীবনে পথচলার লড়াই শুরু হয়েছিল দাম্পত্য জীবনে সে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্থায়ী নিশানা হিসেবে তিনি আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। “আর্য মহিলা সমাজ”-এর একজন সদস্য হিসেবে নারীশিক্ষার সপক্ষে, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং নারীদের স্বাভাবিক বিকাশের যে কোন প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন – আমৃত্যু, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫ পর্যন্ত।
হৈমবতী সেন (১৮৬৬ – ১৯৩২ বা ১৯৩৩)
হৈমবতী সেনের মর্মন্তুদ এবং সুকঠোর জীবন সংগ্রামের বৃত্তান্ত অতি সংক্ষেপে (মূলত যেটুকু তাঁর চিকিৎসক সত্তার সাথে যুক্ত কেবলমাত্র সে অংশটুকু) বলার আগে আমি যেখান থেকে তিনি পাশ করেছেন সেই ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল নিয়ে প্রাথমিক কিছু কথা বলবো। উপনিবেশিক সরকারের তরফে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথমে ভার্নাকুলার এবং নাগরি ক্লাস (মূলত অসামান্য বিজ্ঞানী তথা চিকিৎসক ও’শনেসির উদ্যোগে) এবং পরে বাংলায় ডাক্তারি শিক্ষার ক্লাস শুরু হয় ২৩ জানুয়ারি, ১৮৫২ সালে। এ ক্লাসে ভর্তির জন্য ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা জরুরী ছিলনা এবং বাংলায় পড়ানো হত। ১৮৫২ সালের আগেই আধুনিক চিকিৎসা জনগ্রাহ্যতা পেয়েছে এবং প্রচুর সংখ্যক ছাত্র ভর্তি হতে শুরু করে। এত বেশি ছাত্রের চাপ সামলানো মেডিক্যাল কলেজের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এজন্য ১৮৭৩ সালে শিয়ালদায় এই ক্লাস স্থানান্তরিত করা হয়। (ডি জি ক্রফোর্ড, আ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস, ১৯১৩, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৪১) এই স্কুলটিরই ১৮৮৪ সালে নাম বদলে হল ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল। ১৮৮৭ সালে এর দরজা মহিলাদের শিক্ষার জন্য খোলা হয়।
হৈমবতী সেনের বাংলায় লেখা আত্মজীবনী পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। জেরাল্ডাইন ফোর্বস এবং তপন রায়চৌধুরী অনুদিত ও সম্পাদিত দ্য মেময়ার্স অফ ডঃ হৈমবতী সেনঃ ফ্রম চাইল্ড উইডো টু লেডি ডক্টর বইটি হৈমবতী সেনকে নিয়ে যেকোন লেখার প্রধান উপজীব্য – আমারও। পরিণত বয়সে লেখা তাঁর এই আত্মজীবনীর পরতে পরতে এত কথা নিজেই (প্রায় বৈজ্ঞানিক নিরাসক্তি নিয়ে) বলেছেন যে সেখানে পাঠকদের নিজেদের মতো করে ব্যাখা এবং টীকা যোগ করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার থাকেনা। এই বইটি পাঠ করার শুরুতেই আর্তনাদের মতো শোনায় যখন হৈমবতী তাঁর সম্ভাব্য পাঠককে প্রশ্ন করেন – এত কিছু যন্ত্রণা যে আমায় সহ্য করতে হচ্ছে সে কি কেবল এজন্য যে আমি একজন মেয়ে?
উপনিবেশিক বাঙ্গালি হিন্দু সমাজে একজন নারীর অবস্থান ও পরিস্থিতি, বাল্যাবিবাহ, হিন্দু সমাজের সাথে ব্রাহ্মসমাজের রীতি ও নৈতিকতার পার্থক্য, পুরুষ-শাসিত সমাজের বহুস্তরীয় চরিত্র, উপনিবেশিক শাসনে নারীদের জন্য সাধারণ শিক্ষার ও ডাক্তারি শিক্ষার দরজা খুলে যাওয়া, পেশাগত জীবনে পুরুষ সহকর্মীর হাতে যৌন নিগ্রহ এবং পুরুষ ডাক্তারের সাথে বিপুল বেতন বৈষম্য, সে যুগে অসাধু ডাক্তারের ঘুষ খাওয়ার ঘটনা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান ও বর্ণনায় পরিকীর্ণ তাঁর আত্মজীবনী। এখানে লক্ষ্যণীয় যে কাদম্বিনী এবং আনন্দবাই তাঁদের স্বামীদের কাছ থেকে যে যত্নশীল মমতাময় সাহচর্য পেয়েছেন রুক্মাবাই এবং হৈমবতীর ক্ষেত্রে একেবারেই তার বিপরীতটি ঘটেছে। উপনিবেশিক এবং সমকালেও পুরুষতন্ত্র একমাত্রিক নয়। এর মাঝে স্তরের ভিন্নতা আছে।
সাড়ে নয় বছর বয়সে বিয়ে হয় সে মেয়ের যাকে নিজের জীবনের সবচেয়ে শক্ত অবলম্বন বাবা আদর করে “চুনিবাবু” বলে ডাকতেন। এবং “চুনিবাবু” ছেলেদের পোষাক পরে বাড়ীর ও পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতো। এখানে খেয়াল রাখতে হবে রুক্মাবাই-এর ঘটনার পরোক্ষ অভিঘাতে ১৮৯১ সালে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১০ থেকে বেড়ে ১২ হয়। কিন্তু তার আগে ১৮৬০ সালে সহবাসের আইনী অনুমতি মেলার বয়স ছিল ১০। হৈমবতীর বিয়ে এর চেয়েও কম বয়সে। বিয়ে হয় একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে, যাঁকে ধরে নেওয়া হয় আইনের রক্ষক এবং বিয়াচ্রকর্তা – সেকালে এবং একালেও। মধ্যবয়সী এ লোকটি বিপত্নীক ছিল। তার বড়ো মেয়ের বয়স হৈমবতীর চেয়ে সামান্য কম ছিল। সাড়ে নয় বছরের “আইনি” স্ত্রীকে ধর্ষণ করা ছাড়াও বাড়িতে বেশ্যা নিয়ে পাশে শুইয়ে হৈমবতীর সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো, রতিক্রিয়া করার মতো চারিত্রিক “গুণও” এই মানুষটির ছিল। হৈমবতীর নিজের বয়ানে শোনা যাক – “One night, when I woke up at a very late hour because I wanted to go to the toilet, I saw the babu and a woman clasping each other and thrashing around ... I lay like a corpse on my side of the bed. After a while they poured some drinks and drank together (p. 84)। এর বাংলা করার প্রবৃত্তি হচ্ছেনা। এ ঘটনার পরে একই সজ্জায় শুয়ে থাকা বেশ্যাটিকে এই লম্পট বলে – প্রিয়ে, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। ও আমাদের দেখে ফেলেছে। কিন্তু না দেখলে শিখবেই বা কি করে? নরকের কোন স্তরে এই অভিজ্ঞতা হয়? আরেক রাতে হৈমবতী হঠাৎ জেগে উঠে স্বামী ও বেশ্যার এক অস্বভাবিক ধরনের রতিক্রিয়ার দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকেন এবং জ্ঞান হারান। এরপর? বেশ্যাটি স্বামীকে তিরস্কার করে বলে – “She has been scared by what you were up to. She is still shivering. Precious, don’t do such things again. She comes from a decent home and is a mere child...She has been scared by the very sight of what was going on ... One should not do such things at home (p. 86)। পরবর্তীতে এই লম্পটটি নিউমোনিয়া এবং লিভার অ্যাবসেসে ভুগে মারা যায়।
হৈমবতীর জীবন এরপরে একরাশ কালো আঁধারের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। আমাদের চিকিৎসক হৈমবতীকে খুঁজে পাবার জন্য সে ইতিহাস আপাতত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি উপায়ান্তর না দেখে বিধবা মহিলাদের সেসময়ের আশ্রয়স্থল বলে পরিচিত বিপদসংকুল কাশীবাসী হন। কেন লম্পট স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হলেন এর পাপ তাঁর – এমনটাই সেসময়ে আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনের মতামত ছিল। এমনকি “স্বামী-খেকো ডাইনী” অপবাদের বোঝাও তাঁকে বহন করতে হয়েছে। আরেককদলের অভিমত ছিল মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে এমনটাই হবার কথা। যৌন নৈতিকতা আর অনৈতিকতার কথা তাঁকে শুনতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে – মেয়েটি নাকি সুন্দরী। তাহলে তো এমন ছেনালী করা মাগী তো হবেই।
এর পরের অধ্যায় তাঁর ব্রাহ্মধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া। ব্রাহ্মধর্মকে গ্রহণ, আমাদের অনুমান, বিশ্বাস থেকে হয়নি। তাঁর নারী হিসেবে বেঁচে থাকার এবং শিক্ষিত হবার পাথেয় হিসেবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার ঘটনা ঘটেছে। কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ব্রাহ্ম হবার জন্য তিনি সেসময়ের সংস্কারের নিগড়ে বাঁধা হিন্দু সমাজে কতদূর অবধি যেতে পেরেছিলেন। অবশেষে ২৪ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে নীচুতলার ব্রাহ্মকর্মী কুঞ্জবিহারী সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় – হৈমবতী সেন হলে – ঘোষ এবং মিত্র পার হয়ে এসে। তাঁর আরেকটি আত্মপরিচয় তৈরি হল। এবং তাঁর এই আত্মপরিচয় তাঁর কাছে জীবনের নতুন অর্থ উন্মোচিত করল।
এবারে এমন এক পুরুষের সাথে তাঁর বৈবাহিক বন্ধন তৈরি হল যে ব্যবহারিক জীবনে পূর্ণত অপদার্থ বলা চলে। কোন স্থায়ী আয় নেই। সংসারে ৫ জন সন্তান – ৪টি ছেলে ও ১টি মেয়ে। হৈমবতীর স্বগতোক্তির মতো সখেদ উক্তি – “My debts were quite substantial by now … My husband was not worried about anything. All the worries were mine (p. 324)।
হৈমবতী ১৮৯১ সালে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে ৩ বছরের গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হন, কোলে শিশুকে সাথে নিয়ে। অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৭৫) সেসময় ঐ কোর্সের নাম ছিল ভার্নাকুলার লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (VLMS)। এই কোর্সে ভর্তি হবার ক্ষেত্রে হৈমবতীর জন্য যে কারণগুলো কাজ করেছে – (১) মহিলা ছাত্রীদের ক্ষেত্রে মাসিক ৭ টাকা স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা ছিল, যার ফলে তাঁর সাংসারিক ভার লাঘব হবে; (২) আরও মহিলা স্টুডেন্ট ভর্তি হচ্ছে, ফলে তাঁর ভর্তি হওয়া স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হবে; (৩) ব্রাহ্ম হবার ফলে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার সামাজিক শৃঙ্খল হিন্দু সমাজের মতো নয়, বরঞ্চ অনেক উদার ও মুক্তমনা; (৪) এই কোর্সে ভর্তি হবার জন্য মেডিক্যাল কলেজের মতো বিএ পাশ আবশ্যিক ছিলনা; (৫) ক্লাস এবং বইপত্র সবই বাংলায়, ফলে বোঝার ক্ষেত্রে বিশেষ করে হৈমবতীর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের কোন অসুবিধে হবেনা; এবং (৬) সর্বোপরি, “লেডি ডাক্তার” হিসেবে চাকরি পাবেন এবং আয়ের উৎস একেবারে বাঁধা।
জেরাল্ডাইন ফোর্বস জানাচ্ছেন – “It was not until 1885 that the British Raj became indirectly involved
with providing medical care to Indian women through the establishment of the Dufferin Fund (The Countess of Dufferin.s Fund for Supplying Medical Aid to the Women of India ... This new organization aimed to provide medical relief to Indian women, to build hospitals, and to encourage women to study medicine.” (“Medical Careers and Health Care for Indian Women: patterns of control”, Women.s History Review, Volume 3, Number 4, 1994, p. 516) ফোর্বস আরেকটি তথ্যও দিয়েছেন – “Dr Sen earned a VLMS (Vernacular Licentiate in Medicine and Surgery) ... without a university degree, she was not entitled to receive the more prestigious LMS ... she could never aspire to a title higher than ‘hospital assistant’। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২০) হৈমবতীর নিজের বয়ান থেকে জানা যায় তিনি ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেলের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু ক্লাসের পুরুষ ছাত্রদের অহং আহত হয়। কলেজে বিক্ষোভ, পিকেটিং চলে, এমনকি হৈমবতীর ওপরে ঢিল ছোঁড়াও। সংবাদপত্রগুলোও পুরুষ ছাত্রদের পক্ষে সওয়াল করে – “Why don’t we kill off that girl? That would be the end of the matter. It is a great mistake to pamper women”। এসবের পরিণতিতে ইংরেজ কলেজ কর্তৃপক্ষের আপাত “অপক্ষপাত” নীতি ভূলুন্ঠিত হয়ে যে ছেলেটি দ্বিতীয় হয়েছিল তাকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। হৈমবতীকে রৌপ্যপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কাদম্বিনীকেও এরকম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল – আমরা এর আগে দেখেছি। উল্লেখ করা দরকার ফাইনাল পরীক্ষায় তাদেরকে ধাত্রীবিদ্যা, সার্জারি এবং সার্জিকাল অ্যানাটমির মতো বিষয়ে পাশ করতে হয় হৈমবতীকে।
তাঁর ক্লাসে ৪ জন মহিলা এবং ১২ জন পুরুষ ছাত্র ছিল। পাশ করার পরে অর্থোপার্জন করা তাঁর কাছে জরুরী হয়ে উঠেছিল। ৫০ টাকা মাসিক মাইনেতে তিনি হুগলির লেডি ডাফরিন উইমেন’স হসপিটাল-এ যোগ দেন। মজার ব্যাপার হল, একদিকে “পুরুষ”-এর ভূমীকায় গৃহের বাইরে বেরিয়ে সংসারের অন্ন সংস্থান করা, অন্যদিকে, নারী ও মা হিসেবে গৃহের অন্দর সামলানো – দুটো কাজই তাঁকে সমান গুরুত্ব দিয়ে করতে হয়েছে। অন্তত হৈমবতীর ক্ষেত্রে এসে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমনটা দেখিয়েছেন (ন্যাশনালিস্ট থট অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড) ভারতীয় সমাজে ঘর/বাহির-এর বিভাজন তেমনটা হুবহু খাটেনা। তিনি তাঁর আয়ের সমস্ত অর্থ বাড়িতে প্রায় অকর্মণ্য স্বামীর হাতে তুলে দিতেন। ইন্দ্রানী সেন বলছেন – “even after she had became a practising doctor and was earning well, she continued with this practice and gave him full control over the purse strings – clearly revealing how deeply rooted the internalisation of patriarchy can be ... Haimbati creates an “imagined reality” of economic dependence for herself. (“Resisiting Patriarchy: Complexities and Conflicts in the Memoir of Haimabati Sen”, Econoimic and Political Weekly, March 24, 2012)
পূর্বোল্লেখিত “মেময়ার্স”-এ পেশাগত জগতে ও জীবনে পুরুষতান্ত্রিকতার নিদর্শন তিনি পদে পদে পেয়েছেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল – “Lady doctors and midwives were but pawns in the hands of the male doctors…when I thought of these things, I lamented the fact that we were born as women (p. 317)। একই হাসপাতালে কর্মরত মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বেরনো অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন বদ্রিকানাথ মুখার্জির কাছে যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় তাঁকে। তিনি এ বিষয়ে উপরতলার ইংরেজ ডাক্তারের কাছে অভিযোগ জানালে ক্রুদ্ধ বদ্রিকানাথ তাঁর রান্নাঘরের কাছে রাতে মলত্যাগ থেকে গুণ্ডা পাঠিয়ে ভয় দেখানো – সমস্ত ধরনের কাজই করেছিলেন।
এরপরের ঘটনাটি মর্মন্তুদ। একটি ১১ বছরের মেয়ে স্বামীর হাতে ধর্ষিত হয়ে (মনে রাখতে হবে ১৮৯১ সালের পরে আইনত সহবাসের বয়স বেড়ে ১২ হয়েছে) প্রবল রক্তক্ষরণে মারা যায়। নিকৃষ্ট দুর্নীতির এক উপাখ্যান রচিত হয়। অনেক টাকা ঘুষ খেয়ে সিভিল সার্জেন ডঃ কালীপদ গুপ্ত এবং ডঃ বদ্রিকানাথ মুখার্জি কেসটি ধামা চাপা দিতে চান। এমনকি সিভিল সার্জেন গুপ্ত মেয়েটির ডেথ সার্টিফিকেটে মেয়েটির বয়স ১৪ বলে লেখেন। এবং লেখা হয় “সেপ্টিসেমিয়া এবং স্বাভাবিক ঋতুস্রাবে” মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। এ কাজের জন্য সিভিল সার্জেন ৫০০০ টাকা পান, বদ্রিকা পান ১০০০ টাকা। হৈমবতীকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। তিনি প্রথমে টাকা নিতে অস্বীকার করলেও ভয়ে এবং চাপে টাকা গ্রহণ করেন।
ফোর্বস জানাচ্ছেন – “Haimavati Sen.s approach to medical care in this district, treating some patients at home, others in her own quarters, and still others in the hospital made her very popular ... In the same year there were 26 operations performed at the hospital: ten by Captain Gwythe, ten by Dr Sen, and six by Major D. G. Crawford, IMS Civil Surgeon.” (ফোর্বস, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২৩)
ইন্দ্রানী সেনের মন্তব্য – “Haimabati Sen’s extraordinary memoir maps the nuances, the twists and turns of the immeasurably long journey of a woman in 19th century rural East Bengal from becoming a child-widow at the age of 10 to finally becoming a lady doctor (hospital assistant) in the Hooghly Lady Dufferin Women’s Hospital ... this autobiography traces the growth of selfhood, female subjectivity, the exercise of female agency and self-assertion as well as the carving out of an identity in the cultural and historical context of gender oppression in late 19th century colonial India.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬২)
হৈমবতী সেনের চিকিৎসক-নারী হিসেবে অবস্থান ওপরে যে অন্য তিনজন চিকিৎসকের থেকে ভিন্ন। বাংলার তৎকালীন সমাজের অভ্যন্তরের অনেক জটিল স্তরে স্তরায়িত তাঁর জীবন ও চিকিৎসক সত্তা। একই সাথে আরেকটি সত্যও স্পষ্ট হয় যে কলকাতা বা বোম্বের মতো নাগরিক যেগুলো ঘটেনা সেগুলো হুগলির মতো জেলা সদর এবং গ্রামাঞ্চলে ঘটে। এটাও স্পষ্ট হয় যে “লেডি ডাক্তার” এবং পাশ করা ডাক্তারের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য কি প্রকটভাবে ছিল।
গুরুবাই কার্মারকার
গুরুবাই কার্মারকার ১০ অক্টোবর, ১৮৬২ সালে এক ভারতীয় খৃষ্টাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৮ সালে তাঁর স্বামীর সাথে আমেরিকায় যান। ভর্তি হন আনন্দবাই যে কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন সেই পেনসিলভ্যানিয়া উওম্যান’স মেডিক্যাল কলেজে। ১৮৯২ সালে সে কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে স্বামীর সাথে ১৮৯৩ সালে ভারতে ফিরে আসেন।
(১৮৯১ সালের ফটো। পরেরটি পেনসিলভ্যানিয়ায় সহপাঠীদের সাথে।)
দেশে ফিরে এসে আমেরিকান মারাঠি মিশনের সাথে কাজ শুরু করেন। গুডউইল ডিসপেন্সারির দায়িত্বে থেকে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বোম্বের সর্বস্তরের মানুষের আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দিয়েছেন। “She worked hard for social awakening on important social issues related to socio-economic condition of women in India. She tried to improve condition of women in the society by preventing child marriage and social evil against child widows. She opened many schools for girls and boys and also adopted many children. She made outstanding contributions to save famine struck children.” (অনন্যা চট্টোপাধায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯০-১৯১)
Life and Light for Woman-এ (ভল্যুম ২৮, ১৮৯৬) তাঁর সম্পর্কে লেখা হল – “One instance has come to our notice of a child rescued by Mrs. Karmarkar, and adopted as their own by her husband and herself, and is described as follows; ‘She was almost starved; the hair on her head looked like grass, and long hair had grown on her face till she looked more like a monkey than a human being. Mrs. Karmarkar oiled the face, and gently pulled out one of these long hairs after another until not a trace of them remains.” (p. 67)
সেদিন উপনিবেশিক রাষ্ট্র যে নিরাপত্তা, মমতা এবং যত্ন এ চালচুলোহীন শিশু আর মানুষগুলোকে দিতে পারেনি গুরুবাই কার্মারকার সেসব মানবিক অনুষঙ্গগুলো এই হতভাগ্যদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের শূণ্যস্থান পূরণ করেছিলেন। আজ মিশনারিরা যদি এরকম কাজ করে তাহলে জেলে স্থান হওয়া প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা।
মৃদুলা রামান্নার পূর্বোল্লেখিত পুস্তক ওয়েস্টার্ন মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ ইন কলোনিয়াল বোম্বেঃ ১৮৪৫-১৮৯৫ থেকে জানতে পারছি যে অ্যানি জগন্নাথন এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯২ সালে পাশ করে। কিন্তু ১৮৯৪ সালে তাঁর অকাল প্রয়ান ঘটে। (পৃঃ ১৯০)
ফার্নি কামা ১৮৯২ সালে গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (LM&S)। কিন্তু চাকরির জগতে তাঁর মেডিক্যাল ডিগ্রির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হইয় এবং দৃষ্টিকটু রকমের বৈষম্যের শিকার হন। তাঁর প্রাপ্য বাংলো নিয়ে নেওয়া হ্য এবং ইংল্যান্ডে পড়তে যাবার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। শেষ অবধি ১৮৯৬ সালে তিনি কাজে ইস্তফা দেন। (পৃঃ ১৯০)
বিভিন্ন পরতে উপনিবেশিক শাসনের বৈষম্য এবং সমাজে নারীর অবস্থানের বিশেষ চেহারা আমরা দেখলাম। এ বৈষম্য এখনও বিদ্যমান – ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন ঢংয়ে। ঊনিশ শতকের চিকিৎসক-নারীদের সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা শেষ হল।
ইতিহাস সবার পাঠ্য, বিশেষ করে যে ইতিহাস আমাদের দেহ মনে লড়াই করার শক্তি ও প্রেরণা যোগায়। সমস্ত লড়াকু মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ লেখা বৌদ্ধিক উত্তরণের সাহস ও রসদ যোগায়। তবে একথা সত্য যে বৈষম্য আজও আছে স্বমহিমায়------ অন্য রূপে অন্য সাজে।
ইতিহাসে সমৃদ্ধ বুনোট লেখনী
খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
আমি খুব অল্পদিনের পাঠক। কিনতু যত পড়ছি তত অাগ্রহ বাাড়ছে। অনেক ধন্যবাদ।
তপতী সাহা।
Coordinator, School of Social work and Community Service, National Council of Education, Bengal, Jadavpur University.
এতো চমৎকার একটি লেখায় বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ। হয়তো বেশি দৈর্ঘ্যের লেখা বলে সময়াভাব ছিল। তবু বিষয়ের টানে পড়ে নেওয়া যায়।
খুব ভালো লাগলো স্যার লেখা টি
Excellent and এক্সট্রাঅর্ডিনারি। Please print the ম্যাটার্স in এ বুক ফর্ম। ময় বেস্ট wishes
আনন্দ বাঈ হৈমবতী দের লড়াই এরকথা ভীষণ inspiring .. আজ ও আছে এমন বৈষম্য অন্য রূপে তবু ওনাদের জীবন কথা নতুন করে শক্তি যোগায় সমৃদ্ধ হলাম ভীষণ ভাবে
"মেডিসিনের মধ্যে অদৃশ্য দুটি ভাগ আছে। একদিকে রয়েছে “নরম” বিষয় যেমন শিশুরোগ, চর্মরোগ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা ইত্যাদি যেগুলো নারীদের জন্য বেশি প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে রয়েছে “কঠোর” বিষয়গুলো যেমন কার্ডিও-থোরাসিক সার্জারি, অস্থিবিদ্যা, নিউরোসার্জারি ইত্যাদি যেগুলোকে ধরে নেওয়া হয় পুরুষদের জন্য বেশি উপযুক্ত। মেডিসিনে এমডি এ দুয়ের মাঝে পড়ে।"
লেখকের কাছে প্রশ্নঃ
মেডিসিনের দুই অদৃশ্য ভাগ ২০২১'এ আছে? ২০২১ তে এই "নরম" / "কঠোর" বিভাজন কতোটা সত্যি। পুরোটাই আছে? একদমই নেই?? আজকে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ বা পিজির কার্ডিওলজি বা নিউরোলজি বিভাগে মহিলা সার্জেনের সংখ্যা কত?