সূত্রধার। বিরতির সময় দর্শকরা কী বলাবলি করছিল আর্যে ?
নটী। মনে হয় দর্শকরা একাত্ম হয়ে গেছেন নাটকটির সঙ্গে, ভরতের দুঃখে তাঁরা অশ্রুপাত করছেন, কৈকেয়ীর ওপর মারমুখী হয়ে আছেন একদল দর্শক।
সূত্রধার। আর দশরথ? দশরথের ওপর?
নটী। কঠিন প্রশ্ন, আর্য। বাস্তবে, মহারাজ দশরথকে নিয়ে কোন আলোচনাই শুনলাম না। এতো বড় একটা কাজ শুরু করলেন যিনি, প্রজাসাধারণ নির্বাচন করবে তাঁর উত্তরাধিকারী, সবই কি ভুলে গেল দর্শকরা?
সূত্রধার। তুমি ঠিকই বলেছো আর্যে, ভুলে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক! যিনি রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সেই দশরথ তো প্রতিমা হয়ে গেছেন, আর প্রতিমার বিষয়ে কে আলোচনা করবে! রামরাজ্য হল না, প্রতিমা রইল।
নটী। আর্য, একমত হতে পারলাম না আমি। রামরাজ্য হল না বলছ কেন! প্রতিমাগৃহ থেকে সোজা তপোবনে গিয়ে রামের সঙ্গে দেখা করলেন ভরত, রাম তাঁকে অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলেন অযোধ্যায়, ফেরার আগে রামের সামনেই রামেরই পাদুকার উপর অভিষেক-বারি ঢেলে দিয়ে রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই পাদুকাকে নিয়ে এসে অযোধ্যায় প্রজাপালন করছেন ভরত, চোদ্দ বছরের পরেই রাম আবার ফিরে এসে অযোধ্যার সিংহাসনে বসবেন, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আবারও তো রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে তখন।
সূত্রধার। শুনে বড়ই প্রীত হলাম আর্যে, তাহলে চলো আমরা অযোধ্যায় গিয়ে দেখি কী হচ্ছে সেখানে।
নটী। হ্যাঁ, ঐ তো দেখতে পাচ্ছি কাঞ্চনতোরণদ্বারে কাঞ্চুকীয় কিছু বলছেন।
সূত্রধার। চলো, দেখে আসি। (প্রস্থান)
কাঞ্চুকীয়। কাঞ্চনতোরণদ্বারের দায়িত্বে কে আছ? কে আছ এখানে?
বিজয়া। আর্য, আমি বিজয়া। কাকে চাইছেন?
কাঞ্চুকীয়। ও, বিজয়া। বিজয়া, আর্য শ্রীরামচন্দ্রকে দেখতে মহামাত্য মাননীয় সুমন্ত্র গিয়েছিলেন জনস্থানে, তিনি ফিরে এসেছেন। কুমার ভরতের কাছে এই খবর পাঠিয়ে দাও।
বিজয়া। সংবাদ শুভ তো আর্য?
কাঞ্চুকীয়। তা তো জানিনা। মহারাজের মৃত্যুর পর থেকে কুমার ভরত তো সব সময়ই শোকমগ্ন, মহামাত্য সুমন্ত্রও তদ্রূপ। শোকানল-বিশুষ্ক মুখ তাঁর। সেভাবেই তিনি আছেন, কোন পরিবর্তন তো আমার চোখে পড়ল না।
বিজয়া। শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে এলেন, তবুও মনের কোন পরিবর্তন হল না! এ তো উদ্বেগের কারণ আর্য।
কাঞ্চুকীয়। যাও, আর দেরি কোরো না, কুমার ভরতকে জানিয়ে এস। (হঠাৎ দূরের দিকে তাকিয়ে) মনে হয় কুমার খবর পেয়ে গেছেন, ওই তো তিনি এদিকেই আসছেন। (ভরতের প্রবেশ) কুমারের জয় হোক।
ভরত। আর্য সুমন্ত্র কোথায় আছেন?
কাঞ্চুকীয়। তিনি কাঞ্চনতোরণদ্বারের বাইরেই অপেক্ষা করছেন।
ভরত। তাঁকে শীঘ্র নিয়ে আসুন।
কাঞ্চুকীয়। যাই কুমার।
সুমন্ত্র। (শোকার্তভাবে, স্বগত) ধিক জীবন, ধিক দীর্ঘায়ু! মহারাজের মৃত্যু, রামের বনবাস, এমনকি সীতার অপহরণও দেখতে হল!
কাঞ্চুকীয়। (সুমন্ত্রকে) আসুন আর্য। এই যে কুমার, এগিয়ে আসুন।
সুমন্ত্র। (এগিয়ে এসে) কুমারের জয় হোক।
ভরত। তাত, পিতৃস্নেহের উদাহরণ যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই আর্য রামের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার? অরুন্ধতী-চিত্র মাতৃসমা সীতাদেবীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন? সৌভ্রাত্রের প্রতিষ্ঠাতা অকারণ বনবাসী লক্ষ্মণকে দেখেছেন আপনি?
কাঞ্চুকীয়। আর্য, কুমার আপনাকেই জিজ্ঞাসা করছেন।
সুমন্ত্র। আমাকে কি?
ভরত। (স্বগত) শোকগ্রস্ত, কষ্ট পাচ্ছেন। আজকাল তো আনমনা হয়েই থাকেন। (প্রকাশ্যে) আপনি কি মাঝপথ থেকেই ফিরে এসেছেন আর্য?
সুমন্ত্র। কুমার, তোমার আদেশে জনস্থান যাত্রা করেছিলাম। মাঝপথ থেকেই ফিরে আসব কেন?
ভরত। কেমন আছেন তাঁরা?
সুমন্ত্র। পেলাম না তাঁদের, তাঁদের পরিত্যক্ত শূন্য তপোবন দেখে ফিরে এলাম।
ভরত। পরিত্যক্ত? কোথায় গেছেন তাঁরা?
সুমন্ত্র। জানি না বৎস, জনস্থানে বনের যে প্রান্তে তাঁদের কুটির সে-অঞ্চলে কোন মুনির আশ্রমও নেই। তাঁদের অন্বেষণে বনের অনেকটা গভীরে গিয়ে একাকী এক তপস্বী যুবকের দেখা পেলাম। তিনি শুনেছেন সীতা এক রাক্ষস কর্তৃক অপহৃত হয়েছেন। রাম এবং ভ্রাতা লক্ষ্মণ সীতার সন্ধানে তপোবন ত্যাগ করে বনের অন্য কোন অঞ্চলে গিয়েছেন। কোথায়, তপস্বীর ধারণা নেই।
ভরত। (মস্তকে করাঘাত) অপহৃত!
সুমন্ত্র। শান্ত হও কুমার, শান্ত হও।
ভরত। শান্ত হব! পাপী আমি শান্ত হব! পিতা, সমস্ত স্বজন, সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে ধ্বস্ত শরীর-মন নিয়ে এখন প্রিয়তমা পত্নীর থেকেও বিচ্ছিন্ন! তাত, আমার সঙ্গে আসুন তো। (দুজনে খানিকটা এগিয়ে যায়)
সুমন্ত্র। আর এগিয়ো না কুমার, ওখানে মহিষীদের অন্তঃপুর।
ভরত। এখানেই আমার প্রয়োজন। কে আছ দ্বারে?
বিজয়া। কুমারের জয় হোক, আমি বিজয়া।
ভরত। বিজয়া, তাঁকে এ সংবাদ দাও যে ভরত দেখা করতে চায়।
বিজয়া। কাকে? সংবাদ দেব কোন্ রাণীমাকে?
ভরত। যাও যাও বিজয়া, দ্রুত যাও, আমাকে রাজা দেখতে চান যিনি, তাঁকে ডেকে আনো দ্রুত।
কৈকেয়ী। ভরত? ভরত খুঁজছে আমাকে? কেন? কী ব্যাপারে সে আমাকে তিরস্কার করতে চায়?
বিজয়া। মহামাত্য আর্য সুমন্ত্র শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে ফিরেছেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কুমার ভরত এসেছেন। ডেকে আনব?
কৈকেয়ী। নিয়ে এস।
কৈকেয়ী। বৎস ভরত, বিজয়া বলছিল রামের কাছ থেকে আর্য সুমন্ত্র ফিরেছেন। কী সংবাদ?
ভরত। সংবাদ শুভ এবং অতি শ্রুতিমধুর।
কৈকেয়ী। তাহলে কৌশল্যা আর সুমিত্রাকেও ডাকছ না কেন?
ভরত। না না, ওঁদের শোনার মতো খবর নয়। (তীক্ষ্ণ অথচ নিম্নস্বরে) এ সংবাদ শুধুমাত্র তোমার জন্য! শোন, তোমার আদেশে যিনি রাজ্য ছেড়ে আজ বনবাসী, তাঁর বিষয়ে একটি অতি সুখসংবাদ তোমাকে দিচ্ছি!
কৈকেয়ী। (বিভ্রান্ত) কী সংবাদ?
ভরত। রামের পত্নী সীতা অপহৃতা, রাক্ষস তাঁকে অপহরণ করেছে! কী রাণীমাতা, আপনার মনস্কামনা পূর্ণ তো?
কৈকেয়ী। অপহৃতা!
ভরত। হায় পাপীয়সী, বধূরূপে তুমি কেন প্রবেশ করেছিলে ইক্ষ্বাকু বংশে! তোমার পাপে এই কুল কলঙ্কিত হল। বধূধর্ষণ! বধূধর্ষণও সম্ভব হলো ইক্ষ্বাকুকুলে! ধন্য তুমি!
কৈকেয়ী। যা তোমার মুখে আসে তাই যদি চাও তো আমাকে বলতে পার বৎস, কিন্তু মহারাজের অভিশাপের কথা কি তুমি জান না?
ভরত। মহারাজের অভিশাপ? তিনি অভিশপ্ত হয়েছিলেন?
কৈকেয়ী। আর্য সুমন্ত্র, মহারাজের মৃত্যুর পর থেকেই আপনি আমার ওপর বিরক্ত আমি জানি, কিন্তু এ-ও জানি যতই বিরক্ত হোন না কেন, আপনি সত্যবাদী। সেই সত্যের দোহাই, কিছু গোপন না করে আপনি বৎস ভরতকে সেই অভিশাপের বিষয়ে যা জানেন, বলুন।
সুমন্ত্র। আপনার আদেশ শিরোধার্য। শুনুন কুমার, বহুদিন আগে, প্রথম যৌবনে, একবার মৃগয়ায় গিয়ে মহারাজ দশরথ প্রায় ব্যর্থমনোরথ হয়ে পড়েন, পছন্দের শিকার তিনি কিছুই পাচ্ছিলেন না। এমন সময় দূরস্থিত এক সরোবর থেকে বন্যগজের জলক্রীড়ার শব্দের মতো এক শব্দ তাঁর কানে আসে। এতক্ষণে একটা হাতি পাওয়া গেলো ― মনে মনে এই বাক্য উচ্চারণ করে মহারাজ শব্দের উৎস লক্ষ্য করে একটি শব্দবেধী বাণ প্রয়োগ করেন। তারপর শব্দের উৎসে গিয়ে তিনি অর্ধপূর্ণ কলস সহ এক মৃত মুনিকুমারকে দেখতে পান। বিস্ময়াহত মহারাজ বুঝতে পারেন নির্জনস্থানে শূন্যকলসে জলপূরণের শব্দকে তিনি হাতির জলক্রীড়া মনে করে মুনিপুত্রকে হত্যা করেছেন। অনুশোচনায় কাতর মহারাজ মুনির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বিশদ জানান। সত্যবাক্ এই মুনি অন্ধ ছিলেন। পুত্রের মৃত্যুর শোকে মুনিও প্রাণত্যাগ করেন, ও মহারাজকে এই বলে অভিশাপ দেন যে তিনি যেমন পুত্রশোকে প্রাণত্যাগ করলেন, ভবিষ্যতে মহারাজকেও সেই একই রকম পুত্রশোকে প্রাণত্যাগ করতে হবে।
ভরত। দৈব কী ভয়ঙ্কর!
কৈকেয়ী। বৎস, এই জন্য, শুধুমাত্র এই জন্য, যাবতীয় কলঙ্ক নিজের মাথায় নিয়েও আমি রামের প্রবাসের অবস্থা তৈরি করেছিলাম। সত্যবাক্ মুনির বাক্য অব্যর্থ, পুত্রপ্রবাস ছাড়া তা সম্ভব হতে পারত না; রামকে তাই বনে পাঠিয়ে আমি মর্মস্পর্শী বিষাদের আবহ তৈরি করেছি, যা করেছি তা সত্যের অনুরোধে, রাজ্যলোভে নয়!
ভরত। কিন্তু পুত্রের প্রবাস যদি প্রয়োজন ছিল, তাহলে সে সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হলাম কেন, আমি কি পিতার ঔরসপুত্র নই?
কৈকেয়ী। পুত্র, তুমি তো আশৈশব প্রবাসেই, মাতুলগৃহ নন্দীগ্রামে। তোমার প্রবাসে অভ্যস্ত মহারাজ কি অতটা ব্যাকুল হতেন?
ভরত। মহারাণী, আপনার কূটচিন্তা প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আপনার যুক্তিজালে ছোট একটি রন্ধ্র দেখা যাচ্ছে! প্রবাস― অতএব রামের বনবাস, মানা গেল! কিন্তু চোদ্দ বছর কেন?
কৈকেয়ী। (স্পষ্টতই অস্বস্তিতে) না, মানে কী ভাবে তোমাকে আমি বোঝাব বৎস আমি জানিনা। আর তা ছাড়া তুমি তো এমনিতেই আমার উপর বিরূপ! তবুও যা সত্য সে কথা তো বলতেই হবে! আমি বলতে চেয়েছিলাম চতুর্দশ দিন, কিন্তু অস্থির মনে, ভুল করে, বলে ফেলেছিলাম চতুর্দশ বর্ষ!
ভরত। হাঃ হাঃ হাঃ, অতি দুঃখেও হাস্য সম্বরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে মহারাণী; আপনি বুদ্ধিমতী, বহু চিন্তায়, বহু যুক্তি সাজিয়ে কাজ করেন আপনি। প্রভাবশালীরা এরকমই হন, তা না হলে এত প্রভাব কেন? মহারাজ দশরথের ঊপর আপনার প্রভাব, তিনিও হেটমুণ্ডে মেনে নেন আপনার কথা, তাঁর মতো কূটনীতিজ্ঞও আপনার কাছে হেরে যান, এবং তার ফল? রামরাজ্যের চিন্তা ধুলিধুসরিত হয় এক মুহূর্তে! প্রতিমাগৃহে পড়ে থাকে মহারাজের বিগ্রহ!