এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ব্রেইন শর্ট

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১০ জুলাই ২০২৪ | ৫০৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ‘এই… এই… কই যাছ্‌ …না…না...’

    মোরসালিন ততক্ষণে খাবার ঘরের দরজা ঠেলে মাঝের উঠোনটুকু পেরিয়ে পৌঁছে গেছে মূল ঘরের চৌকাঠে। এক হাতে পরিষ্কার কাপড় আর অন্য হাতে পানির মগ ধরে রেখে  শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মা - ছেলেটা যতই দিন যাচ্ছে আরও বেশী খেয়ালী হয়ে উঠছে, আর কি অদ্ভূত তার স্বভাব, নানু বাড়িতে এলেই খাওয়া শেষে নতুন মামির আঁচলে এঁটো মুখখানা ঘঁষা চাই!  নতুন মামি আর নতুন নেই, বছর তিনেক হতে চলল সে ঘোমটা সরিয়েছ;, তাছাড়া, গহনাগাটি-শাড়ি-ফিতা-টিপ বাক্সবন্দী করেছে সেও তো ম্যালা দিন।  মোরসালিনও পাকা ওয়ান কবেই শেষ করে ক্লাস ফাইভ ধরবে ধরবে করছে। কিন্তু এখনো যখন সে অমনটি করে আর এক দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাড়ির পূর্বদিকে রাস্তার সাথের পুকুরটাতে, নতুন মামি শরীরটা একটুখানি ঝাঁকিয়ে মুখ টিপে হাসে কেবল – তখন এ আস্কারা না শ্বশুরালয়ের চিরাচরিত অত্যাচার সওয়া, তা কেউ বুঝতে পারে না, বোঝার চেষ্টাও করে না।

    পুকুর তলের এক বিশাল রাজ্যে দাপড়ে বেড়াচ্ছিল সে। কোথাও পুঁটি, ইঁচা মাছের ঝাঁক,  কোথাও শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা – যা-ই সামনে পড়ছিল, হানা দিচ্ছিল।  গভীর এক ধ্যানে ঢুকে পড়েছিল মোরসালিন - হঠাৎ  চা-বিস্কিট-বেদানা-কমলা-নুডলস সমেত এক বিশাল ট্রে এল তার জন্য। সাথে আলাদা একটি পাত্রে ডিমের জর্দা, তার জন্য আলাদা করে বানানো - সে জানে। কিন্তু খুশী হওয়ার পরিবর্তে চিন্তার ভাঁজ পড়ল তার চোখে-মুখে, ফোনটা দ্বিতীয়বারের মত পকেট থেকে বার করল সে, ৬ টা বেজে গেছে।  সে প্রায় ঘন্টাখানেক বসে আছে এক সুদৃশ্য ড্রয়িং রুমে। বিশাল শোকেজটির পানে তাকাতে তাকাতে চোখ দুটো এক সময় ক্লান্ত হয়,  কত চিনেমাটির প্রাণ সে আছে ধারণ করে! ইচ্ছেমত ছাঁচে ঢেলে কতশত নকশা করা যায় এই চিনেদের নিয়ে!
    চাকরিটা পাওয়ার পর প্রথম বেতনের টাকা তুলে দিতে গেলে মা-ই অনেক দিন পর নতুন মামির কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘সারা জীবন তো তার আঁচল কম ময়লা করস্‌ নাই, এইবার একটা সুন্দর দেইখা শাড়ি কিইনা দে মামিরে।‘   কিন্তু মোরসালিন কি কখনো শাড়ি কিনেছে? কাপড়ের মান, ডিজাইন, দাম - কোন ধারনাই যে নেই! মামির কাছে গিয়ে যখন কাঁচুমাঁচু করে নিজের অযোগ্যতাটা পাড়ে, খিলখিল শব্দে ভেসে যায় ঘর, ‘আইচ্ছা, আমারে নিয়া যাইয়ো, দেখি কি করতে পারি তোমার জন্য!’   

    মোরসালিন ঘুরে ঘুরে দেখছিল বাসাটা, চার হাজার স্কোয়ার ফুটের এক বিশাল গ্যালারি যেন, কত যে ছবি, ভাস্কর্য! সব তার শৌখিন মামার কাজ! ঘর সাজাতে বড্ড ভালবাসেন! হাঁটতে হাঁটতে ঘরটার শেষ প্রান্তে এসে পড়ে মোরসালিন, একটা বিশাল জানালা, কৌতূহলবশত পর্দা সরিয়ে চোখ পাতে ওপারে - কিছু নেই একটি দেয়াল ছাড়া যেটি পরের অ-মিশুক বাড়িটিকে একান্তে পাহাড়া দিচ্ছিল। অবশ্য কষ্ট সয়ে ঘাড়টা একটুখানি নীচু করলে চোখে পড়ে সংকীর্ণ এক নালা  যেখানে দুনিয়ার সব অকর্মা জিনিসপত্রদের নিবাস। একটা অর্ধ নগ্ন কাপড়ের পুতুলে চোখ আটকে যায় মোরসালিনের, বুকের দিকটা জড়িয়ে রয়েছে লাল ডুরে শাড়ির একটা কোণা। হঠাৎ একটি পোড়া গন্ধ কোথা থেকে এসে ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে আর সংজ্ঞাহীণ করে ফেলে বিশ্বচরাচরকে!    

    বিছানায় খাতা পেতে দিয়ে হাঁটু মুড়ে সরল অংক করছিল মোরসালিন। মা এসে যখন সেই খবরটা দিল প্রথমে অংকের গতি বেড়ে গেলেও পরে স্লো হতে হতে এক সময় থেমে গেল। ক্লাস ফাইভের ছাত্র সে, কদিন বাদেই প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা। মুড পরিবর্তনের জন্য এরপর সমীকরণ ধরল, কিন্তু শুধু পাতার পর পাতাই ভরল, মেলাতে পারলো না একখানাও। বার কয়েক মুতেও এল। একবার মনে হল, মাকে গিয়ে বলে; বিপদটা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কড়া একটা ধমক বা এক চোট হাসিতামাশা  - এর বাইরে আর কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখতে পেল না। তবে কি কেউই কি বুঝতে পারবে না শেষ হতে চলেছে একটি জীবন? নিশ্চয়ই পারবে, হয়ত অন্যরাও জানে, আর সময়মত তারা আটকাবে তার মামার হঠকারী সিদ্ধান্ত!

    তবু স্বস্তি পায় না মোরসালিন, মনে পড়ে যখন প্রথম বারের মত পীর নানাকে পাগড়িটা খুলতে দেখেছিল, নতুন মামির বাবার চোখ সেদিন আর বাঁধ মানছিলই না। মোরসালিনের বাবা আর মা দুজন মিলে দুদিক থেকে ধরে রেখেছিল তাকে, সেদিনের আগ পর্যন্ত সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটিকে একজন জ্বীন ছাড়া আর কিছু মনে হত না, যার মুখের কবাট খুলে হাসির রেখারা মাঝে মধ্যে বেরিয়ে এলেও কথারা কণ্ঠগুহার নিভৃতেই দিন কাটাতে পছন্দ করত। ‘’না কুলাইলে দিবো না, কিন্তু এমন নিস্যা জিনিস কি কইরা উডাইতে পারলো হাতে!” - কাইজাটা লাগিয়েছিল মোরসালিনের মা-ই, মোরসালিনের বাবার জন্য তার ভাই যে পাঞ্জাবিটা কিনেছে, তা একদমই পছন্দ হয় নাই। তাছাড়া, এও উঠে আসে যে নিজের বোনদের থেকে বেশী দামের শাড়ি কেনা হয়েছে নতুন মামির বোনদের জন্য। অনেকক্ষণ ষাড়ের মত হুংকার ছাড়ার পর মামা এক পর্যায়ে নতুন মামির দিকে নজর দেন, ঠাস্‌ ঠাস্‌ চড়-থাপ্পড়, ঘরের বাইরের কল পার থেকে দৌড়ে এসে ঠেকাতে গেলে নানুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়, মাকে বাঁচাতে এসে মোরসালিনের মায়েরও কপাল ফাটে। মামা এক সময় শান্ত হন, নতুন মামি, মা, ও নানু  -সবার হাত-পা ধরে মাফ চাইতে থাকেন। কিন্তু এসব কিছুর আগে আরো একটা কাজ করেন, আলমারিটা খুলে খুঁজে বের করেন ঈদে কেনা শাড়িগুলো। এরপর একে একে ফেলতে থাকেন গমগমে চুলোয়। মা ও নানু প্রাথমিক চিকিৎসায় সেরে উঠলেও নতুন মামিকে প্রায় দুই সপ্তাহ হাসপাতাল বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল!

    সেই নতুন মামি একবার সারা গ্রামকে রাষ্ট্র করে ফেলল তার কান্ডকারখানা দিয়ে। একে থাপড়ায়, তার কান মলে দেয়, গান গায়, নাচে, মুরব্বিদের তুই তোকারি করে, গালে আঙ্গুল দেয়। নানু তাবিজ কবচে ঘর ভরে দিলেও তার ছেলে ঐসবে কানই দিল না, প্রথম প্রথম ‘মাইর দিয়া ভুত তাড়ানির' চেষ্টা চালালেও মোরসালিনের মামা এক সময় বোঝে, অন্য কোন গোলমাল আছে। ঢাকার ডাক্তারও বিস্তারিত বিবরণ শুনে অন্য রকম আভাস দেন, কেইসটা নাকি ব্রেইন শকে্‌র! এরপর  ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ব্রেইনের ট্রিট্মেন্ট করানোর ঔষুধপত্র নিয়ে মামা যখন হাজির হন বাড়িতে, রান্নাঘরে ডালের বাগাড় দেয়ার কাজটা মাঝপথেই থামিয়ে দেন নতুন মামি;  এক দৌঁড়ে গিয়ে ছিনিয়ে নেন মামার হাত থেকে ঔষুধের সুদৃশ্য বাক্সগুলি, সেইদিনের বাকী অংশটা মামী ব্যয় করেন শোকেজে সুন্দর করে ঔষধগুলো সাজিয়ে রাখতে। মামি এক ফোঁটা ঔষুধও গেলেননি, কিন্তু ততদিনে তার রোগটি নিয়ে কথা বলার জন্য একটি শব্দ পেয়ে গেছে গ্রামবাসী, যদিও তাদের কাছে এসে ‘ব্রেইন শক্‌’ শব্দটা ‘ব্রেইন শর্টে’ রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু এতটুকুও গুরুত্ব হারায়নি এর তাৎপর্য ও ইতিহাস, পেছনের আরো অনেকের গল্পের সাথে ‘ব্রেইন শর্ট’কে এক সুতোয় বাঁধার একটা প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখা যায় গ্রামবাসীর মাঝে।

    অংক বইটার দিকে সেদিন এক নাগাড়ে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল মনে নেই মোরসালিনের, তবে  ‘ তর মামায়  নতুন একটা বাসা নিছে, দেখতে যাবি?’ মায়ের কাছ থেকে শোনামাত্র বইখাতা গুটিয়ে প্যান্ট জুতো পরে মায়ের হাত ধরেছিল বেশ মনে আছে। প্রয়োজনের থেকেও বেশী জায়গা ছিল বাসাটিতে। যদিও ইলেকশান করার ইচ্ছে নেই মামার, কিন্তু মানুষগুলা তার, তাদের দিকে না তাকালে চলে? বড় বাসা দেখে মোরসালিন অন্তত কিছুটা টেনশানফ্রি হয়, অন্তত বাসা লোকজনে ভর্তি থাকবে… কিন্তু লোকগুলো মামীর চিৎকার শুনেও যদি এগিয়ে না আসে, কানে তালা দিয়ে থাকে? পরে বাসা থেকে সবাই  বের হয়ে গেলে নিজের রুমে ঢুকে যদি কপাট দেয় নতুন মামি?  শরীর বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় মোরসালিনের, একবারটি চায় মায়ের মুখের দিকে, যিনি পান মুখে রান্নাঘরের সাজসজ্জা ভাল করে দেখে নিচ্ছিলেন। হায়! এরা একটুও বুঝতে পারছে না, কি রোজ কেয়ামত অপেক্ষা করছে সামনে!

    ফ্যানের সাথে ঝুলানো নতুন মামীর শরীরটা এরপরের কয়েকটি দিন প্রতি বেলায় অন্তত একবার করে ভেসেছে মোরসালিনের চোখে! বড়দের দিয়ে ভরসা নেই, তারা সব ভুলে যায়। তাই সে নিজেই এক বুদ্ধি আঁটে। মামিকে যেবার নিয়ে আসবে গ্রাম থেকে ঢাকায়, সেও মামার লগ ধরে। দু একদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে - সব আগের মত, একটুও বদলায়নি পরিবেশ-প্রকৃতি। একদিন সুযোগ বুঝে নতুন মামিকে ‘একটা কথা আছে’ বলতে বলতে টেনে নিয়ে যায় মোরসালিন গোয়াল ঘরের পেছনের একটা জায়গায়, ফিস্‌ ফিস্‌ করে বললো,  ‘তুমি  কি ব্রেইন শর্ট আরেকটা বার কইরা দেখাইতে পারবা? সত্যি সত্যি না,  মিছামিছি।“ নতুন মামি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ; তারপর একগাল হাসি উপহার দিয়ে মোরসালিনকে সেই আবডালে একা ফেলে চলে আসে সে। 

    সেদিন ছট্‌ফট্‌ করতে করতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল অনেক ভোরেই; প্রথম সূর্যের এক চিলতে আলো দেখে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে মামির ঘরের দিকে তাকায় সে - কপাট দেয়া না থাকলেও মোটা পর্দা টানা, একটি মাছিরও প্রবেশাধিকার নেই। এক সাথেই ফিরে যাবে ঢাকায়, প্রতিবারই যায়, কিন্তু এবার মামার সাথে মামিও থাকছে, আর নিয়মের এই ক্ষুদে লঙ্ঘনটুকু মোরসালিনের কাছে জগতের সব সূত্র কেটে দেয়ার মত ছিল! ঘর থেকে বেরিয়ে চুলো থেকে এক টুকরো কয়লা নিয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ঘাঁটার দিকে, মসজিদের সামনের বেঞ্চিতে বসে পুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকে এক নয়নে। এই সকালেও বয়ে যাচ্ছে একটা শির্‌ শির্‌ হাওয়া। একটা বিশাল আয়তাকার জলাধার - স্বচ্ছ স্ফটিকের ন্যয় জ্বলজ্বল করতে থাকে চাঁদের আলোয়; এই মুহুর্তে বাতাসের ঘূর্ণি লেগেছে সেখানে, প্রায়ই কেঁপে কেঁপে উঠছে সে, টলে উঠছে তার তরল দালানকোঠা।  

    নতুন মামি কি পারবে? সেই সময় তো অচেতন ছিল, কিন্তু এখন চেতন অবস্থাতেই এমন কিছু প্রদর্শন করতে হবে, যাতে মানুষের মনে পড়ে যায় আর বলতে থাকে  ‘ব্রেইন শর্ট ….আবার…. সেই আগের মত ….. বউডার কি কপাল … নিজের কইরা সংসারডা শুরু করতে না করতেই …..।‘  হঠাৎ বুক ফাটা আর্তনাদ শুনে চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে মোরসালিন।  শব্দের উৎস লক্ষ করে পেছনে ছুটতেই দেখে তার গ্যাদা মামাতো ভাইটাকে বুকে জাপটে আছেন নানু। এদিকে নতুন মামি লাগেজ বাঁধাছেঁদা করছেন এক মনে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মোরসালিন, অপূর্ব দেখাচ্ছে নতুন মামিকে আজ, একটা গোলাপি জামদানি শাড়ি পরেছিল, আর চোখ-মুখের অন্য রকম আভা বলে দিচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে সেজেছে, মুখটা একটু কাঁদো কাঁদো রয়েছে যদিও।  সব কিছু প্রস্তুত,  মোরসালিন তবু আশা ছেড়ে দেয় না, ব্রেইন শক্‌ তো ইলেকট্রিক শকে্‌র মতই, হঠাৎ করেই হয়ত আসবে, জানান না দিয়ে, আচমকা! কিছুক্ষণ পর নতুন মামী গ্যাদাটিকে কোলে তুলে বড়টিকে অন্য  হাতে ধরলে মোরসালিন বুঝতে পারে তাকে এখন লাগেজটা ধরে নিয়ে যেতে হবে স্টেশনে যাওয়ার জন্য রাখা ভ্যানটির দিকে; মোরসালিনের মামা আগেই ঘাঁটে পৌছে গেছে টিকিট কাটার জন্য। নানুর চোখ বেয়ে পানির ফোয়ারা আরো ঘন হলে, নতুন মামি অবশ্য একবার নেমে আসে ভ্যান থেকে, ‘’চলেন না আম্মা, অহনো সময় আছে, আমাগো লগে থাকবেন।‘’

    মামার নতুন  বাসায় একদিন দাওয়াত পায় সব আত্মীয়স্বজন, সেদিন নতুন মামির সদ্য বিয়ে হওয়া বোনেরও আসার কথা ছিল বরকে সাথে করে । কিন্তু দুপুর পার হয়ে যখন বিকেল গড়ায়, আর তাদের দেখা মেলে না, মামা ড্রইয়িং রুম থেকে ভেতরে যায় ভাল করে খবরটা জানতে, আর তার কিছুক্ষন পরই সবার সাথে সাথে মোরসালিনেরও কানে আসে প্রথম ধুপ্‌ধাপ্‌ শব্দ, পরে রক্ত হিম করা চাপা কান্না। ঢাকায় এসেও মোরসালিনে প্রায় আতঙ্কে থাকতো প্রথম প্রথম, মনে হত, এই বুঝি এল দুঃসংবাদটা, তাদের বাড়িটা ভরে যাবে অচেনা লোকজনে, সংবাদপত্রে শোভা পাবে তাদের পরিবারের ছবি! কিন্তু ঐ ঘটনার পর  কি হয় যেন, মামার বাড়িকে একটা লম্বা সালাম জানায় সে দূর থেকে, এমনকি মামার কোন কাজ টাজ এলেও এটা সেটা বলে পাশ কাটায়। এদিকে মামির আরো একটি ছেলে হয়, এবং পরে মেয়েও, তাদেরও সে এক বা দুই নজর মাত্র দেখে, তাও নিজেদের বাসায় ।

    নতুন মামিদের সেই প্রথম বাসাটা ছেড়ে দেয়ার আগেই মামা চাকরি ছেড়েছিল ব্যবসা ধরতে।  এরপর যত সে উপরে উঠেছে, তত তার দানবাক্স বিস্তৃত হয়েছে, অতিথিদের জন্য তিনটে রুম রয়েছে তার বালাখানায়, আগে হয়ত নিজ গ্রাম থেকেই লোকজন আসতো, এখন দুরদুরান্ত থেকে লোক আসে। ঘর জুড়ে আয়া-বুয়ারা আছে। গ্রামের মানুষ, মামার ভাষায়, তার নিজের মানুষ - তাদের যদি সামান্যতম অনাদরও চোখে পড়ে, মামা আগের মতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেন!  

    “কি জোয়ান হওয়ার লগে লগে ক্ষুধা মইরা যাইতেসে?” ডিমের জর্দাটার একটা টুকরো মুখে দিয়েছিল মাত্র মোরসালিন,  তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে নতুন মামির দিকে, যে আজ পুরনো মামি হয়ে গেছে!!! নীল জর্জেট  শাড়িটার মধ্য থেকে পারফিউমের কড়া গন্ধ আসতে থাকে। এতটা সাজতে শেষ কবে দেখেছে মনে পড়ে না মোরসালিনের। চুল রিবন দিয়ে বেঁধে নিয়েছে, সেখানে তাজা ফুলের দল।

    দুটো গাড়ি ছিল মামার, একটি নিজের সাথে রেখেছিল, আর অন্যটি তার কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে বহন করছিল।  মোরসালিন একটা সিএনজি ডাকতে যাচ্ছিল, মামি হাত চেপে ধরল, ‘আমার দম বন্ধ হয়ে আসে ঐডার মধ্যে, একটা রিকশা ডাকো।‘

    প্রথম দোকানটিই গাট্রাগোট্রা ছিল, কিন্ত নতুন মামিকে কেন যেন আকৃষ্ট করতে পারে না, ‘বেশী ভীড়, কিছুই দেখা যায় না ঠিকমতন।‘ কিছুক্ষণ পর মোরসালিন একটি শুকনো দোকানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নতুন মামি প্রথমে দ্বিধায় ভুগলেও কি মনে করে ঢুকে পড়েন। কাতান, বেনারসি, জামদানি - সব জাতেরই ছিল। কয়েকটি তো বেশ লাগলো মোরসালিনের। কিন্তু মামি ওগুলো ধরেন, টিপেন, সুতো মাপেন, ফুল-পাতা-নক্ষত্র-নকশার লাইন ঘাট পরীক্ষা করেন মন দিয়ে, জ্যামিতিক সূত্র অনূসরিত হয়েছে কিনা খালি চোখের স্কেলে মেপে নিতে চান, এভাবে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে মোরসালিনের দিকে ফিরে বলেন, “চল অন্য কোথাও।“ এমনি আরও অনেক দোকান চড়ে বেড়ায় তারা; কোথাও কাপড়, ডিজাইন সব পছন্দ হয়, কিন্তু রংটা একটু বেশী কটা; আবার কোথাও ডিজাইন, রং নিয়ে প্রশ্ন তোলা বেয়াদবী শোনায়, যদিও কাপড়ের মান নিয়ে রয়ে যায় সন্দেহ।  এই সেন্ট্রাল এসি মার্কেটেও ঘাম ছুটতে থাকে মোরসালিনের, পুরো মার্কেট ইতিমধ্যে দু দফা রাউন্ড দেয়া হয়ে গেছে। এক সময় খুঁড়োতে থাকেন নতুন মামিও, মোরসালিন যখন তার হাতটি ধরে হাঁটতে সাহায্য করার জন্য, কাতর স্বরে বলতে শোনা যায় নতুন মামিকে ‘’নিতেই হবে? না নিলে হয় না? আজ থাকুক, আর একদিন নাহয়…..!’

    রিকশায় উঠার পরেও মামির পা’টা ভাল হচ্ছিল না, তার মধ্যেই হাসতে হাসতে বলল,‘ চাকরি হইছে, এখন ভাল দেইখা একটা বউ আনো ঘরে।' বিকেল ও সন্ধ্যে ছাড়িয়ে তখন বাড়ি ফেরা বাতাসের ছুটোছুটি, আশেপাশের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাছের রবীন্দ্র স্মরনী থেকে ভেসে আসছে ‘বধু কোন আলো লাগলো চোখে’ গানের সুর। অনেক্ষণ ধরে চুপচাপ ছিল নতুন মামি, যেন নীরবতাটুকু ভাংগতেই জিজ্ঞাসা করে মোরসালিন,  ‘মামি মনে পড়ে, এই গানটা গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন ছোট খালার বিয়েতে।‘  কোন কথা বার হয় না দেখে মোরসালিন রবীন্দ্র স্মরনীর গানটায় আবার কান পাততে চেষ্টা করে, কিন্তু ততক্ষণে তাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর এসে পড়েছিল তারা আর গাড়ির হর্ন, মানুষের শব্দ তাকে পুরো গ্রাস করে নিয়েছিল।

    ‘এখানে নিয়া আসছিল তোমার মামা গত বছর, তোমার ভাইবোনের তো ফেভারিট।‘ হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে মোরসালিনের। রেস্তোরাটার সামনে রিকশা থামাতে বললে নতুন মামি তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, ‘পাগল হইস নাকি, আমি তো এমনি বললাম।‘ পরে মামাতো ভাইবোনগুলোর জন্য কিছু পার্সেল সংগ্রহের কথা বলে হাত ছাড়াতে সক্ষম হয় মোরসালিন।  

    রেস্তোরাটিতে ঢুকে মামি তন্ময় হয়ে দেখতে থাকে প্রোডাক্ট বইগুলো, মোট চারটে বই ছিল, যেন এগুলো নিরীক্ষা করাটা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ! বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে মোরসালিন, মামিকে পার্সেল মেনু সিলেক্টের দায়িত্ব দিয়েছিল, কিন্তু সাপার টাইম নিজেকে অতিক্রম করে বিপদজনক দিকে মোড় নিচ্ছিল, যেকোন সময় দশটা বাজবে। কিছুক্ষণ বাদে ওয়েলকাম ড্রিংক চলে আসে। মামিকে বইটা রেখে পান করতে বলে সেও মুখে দিতে যায়, কিন্তু কোন এক অজানা টেনশান্‌ থেকেই কিনা – গ্লাসটা কাত হয়ে মোরসালিনের মুখ, বুকের গেঞ্জি ও প্যান্ট পেরিয়ে মেঝের দিকে গড়াতে থাকে সেই স্পেশাল শরবত। বেয়ারাকে ডাকতে যাচ্ছিল টাওয়েলের জন্য, কিন্তু এক ঝটকায় ছুটে আসে নতুন মামি তার ঘাড়ের কাছে; অচিরেই দেখতে পায় মোরসালিন, একটা বিশাল আঁচল পাতা রয়েছে তার সামনে।

    হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে, যেন তব্দা খেয়েছে… সে অবস্থাতেই বহু দূর থেকে আসা একটা কণ্ঠ মন্দ্রধ্বনি তোলে তার কর্ণকুহরে, ‘’আঁইটা হইলে হোক্‌ ….চিন্তা কইরো না… নতুন একটা  তো আসতেসে।“ মামির চোখে-মুখে সেই টেপানো হাসি, কেমন এক অশরীরি সংকেত! তাহলে কি সেই ব্রেইন শক্‌, থুক্কু, ব্রেইন শর্ট রোগটা ফিরে এসেছে? ভর করেছে আবার নতুন মামির উপর? মোরসালিন ফের ফোনটায় চোখ রাখে, এগারটা ছাড়িয়ে গেছে, বারোটা বাজতে আর দেরী নেই।   

    (সমাপ্ত)
    ………………………………………………………………………
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১০ জুলাই ২০২৪ | ৫০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত  | 165.225.***.*** | ১১ জুলাই ২০২৪ ০৭:০৭534490
  • বলছিলাম কি, এই লেখাটা নিয়ে কারোর কোন বক্তব্য নাই  হয়ত যথেষ্ট মন দিই নাই, আমার কাছে একটু অধরা লেগেছে এখনও। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১১ জুলাই ২০২৪ ১৮:০৬534503
  • অনন্য অসাধারণ । স্তম্ভিত বিস্ময় 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ১২ জুলাই ২০২৪ ০৯:৫৭534529
  • @মতামত
    অধরা লাগলে ভাল। সব কিছু ধরে ফেলতে নেই। তাহলে সৌন্দর্য্য ও আনন্দ থাকে না। একান্তই আমার মত অবশ্য। 
    @হীরেন সিংহরায় দাদা 
    অনেক ধন্যবাদ দাদা অন্তহীন উৎসাহ দানের জন্য। 
  • Aditi Dasgupta | ১২ জুলাই ২০২৪ ১৪:১৫534536
  • স্তব্ধ সুগন্ধ!  ব্রেইন শক আবার হোক, বারবার হোক। বাঁচার একমাত্র ঠিকানা বুঝি সেটাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন