চানতারা বানু যে গ্রামে এসেছেন তার নাম লোহাগড়া। গ্রামের একপাশে বিশাল এক দীঘি, দীঘির এক পাশে বিস্তীর্ন জঙ্গল, অন্য পাশে গ্রাম।
আশরাফ আলী খান সাহেবের মত বংশীয় লোক যখন তার সাহায্য চাইলেন তখন না করতে পারেন নি।
কয়েকদিন ধরে তিনি কিছু খারাপ স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই স্বপ্নে একটা গ্রাম আছে, বড় দীঘি আছে, আছে বিশাল জঙ্গল। এবং একটা মেয়ে আছে, ছোট মেয়ে। চানতারা বানু স্বপ্নে দেখতেন সেই মেয়েটি দীঘি কুচকুচে কালো জলে তলিয়ে যাচ্ছে।
অন্যসব কেইস যেগুলির তিনি সমাধান করেছেন সেসবের ক্ষেত্রেও একই ধরণের স্বপ্ন দেখতেন। ফলে স্বপ্নের ব্যাপারটা তার কাছে নতুন না। এটা শুরু হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। চানতারা খুব সাধারণ এক মহিলাই ছিলেন, এক রাতে বাড়ির বাইরের শৌচাগারে গিয়েছিলেন তিনি, আর সেখানে বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। পুরো শৌচাগার পুড়ে যায় কিন্তু চানতারা অক্ষত থাকেন।
ওই ঘটনার পর থেকে তার মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আসে। তিনি যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পান, এবং মৃত মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন। মানুষের দেহটাই আসল না, দেহকে কেন্দ্র করে তার এক অশরীরী দেহ, ওঁরা থাকে। কিভাবে যেন চানতারা এই ওঁরা'র সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
তাদের এলাকার একটা লোক হারিয়ে গিয়েছিল। কোথায় আছে সে, কোথায় গেছে কেউ জানে না। একরাতে চানতারা স্বপ্নে দেখলেন ঐ লোকটাকে। প্রকাণ্ড এক গাছের নিচে বসে আছে। তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে।
চানতারা এই ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে ওঠেন। তার মা সিতারা বানুকে সব বলেন।
সিতারা বানুর যাদু টোনায় বিশ্বাস ছিল, কিছু চর্চা ছিল। তিনি বুঝতে পারলেন তার মেয়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ভর করেছে।
যে লোকটি হারিয়ে গিয়েছিল তার পরিবারকে ডেকে আনা হল। সিতারা বানু তাদের বলে দিলেন, মেয়ের স্বপ্নের কথা। তিনি তাদের একটি বড় গাছ খুঁজতে বললেন। সেই গাছের নিচেই লোকটাকে মিলবে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লোকটার লাশ মিলেছিল, একটা গাছের নিচে। মাথায় আঘাত করে তাকে খুন করে কেউ এই জায়গায় পুঁতে রেখেছিল।
এই থেকে শুরু চানতারার স্বপ্নের। তিনি প্রায়ই এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখেন। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হত, খারাপ লাগত। স্বপ্নে দেখা মৃত মানুষগুলির চোখমুখের আকুতি তিনি দেখতে পেতেন। তারা তার সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু পারে না। যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তাদের যোগাযোগের মাঝখানে বাধা।
বছর বছর ধরে এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় ব্যাপারটা তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে আসল। চানতারা পুলিশকেও সাহায্য করতে লাগলেন। তিনি একসময় মনে ইচ্ছা নিয়েই ঘুমাতেন, আজ এর কী হয়েছে স্বপ্নে দেখব। ঠিকঠাক সবাই যে ঐরাতেই চলে আসত এমন না। অনেকে চলে আসত। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যেত কয়েক মাস বা বছর পরে হঠাৎ করে চলে এসেছে স্বপ্নে।
চানতারা মনে করেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন সব আত্মার ওঁরা শক্তি একরকম থাকে না। কোন কোন আত্মা দ্রুত যোগাযোগ করতে পারে। কোন কোন আত্মা অনেকদিনের চেষ্টায় এই ক্ষমতা অর্জন করে। যার যোগাযোগের শক্তি যত বেশি হয় তাকে তত স্পষ্ট দেখা যায়। এই শক্তির তারতম্য কেন হয় তা তিনি জানেন না। চানতারা মনে করেন, যেখানে ব্যক্তির লাশ রয়েছে তার আশেপাশেই আত্মার শক্তি প্রবল থাকে। এইজন্য আশেপাশেই আত্মাদের দেখা যায় মনুষ্য অবয়বে। খুব কম আত্মাই দূরে দেখা দেবার শক্তি অর্জন করতে পারে। মন্ত্র তন্ত্রের মাধ্যমে দূরে আত্মাদের ডেকে নেয়া যায় অবশ্য, কিন্তু সেক্ষেত্রে মন্ত্রই শক্তি জোগায়।
লোহাগড়া গ্রামে আসার আগে কয়েকদিন ধরে চানতারা যে স্বপ্ন দেখছিলেন এটি অন্য স্বপ্নগুলির মত হলেও আলাদা। প্রতিদিন স্বপ্নটা দেখার পরে যখন ঘুম ভাঙত তার, সারা শরীরে একটা কাঁপুনি হত ভয়ের। মনে হত মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা অজানা অচেনা ভয় প্রবাহিত হচ্ছে। দীঘির পানিতে ডুবতে থাকা মেয়েটার চোখ তিনি দেখতে পেতেন। এত শক্তিশালী চোখ তিনি জীবনে কখনো দেখেন নি।
চানতারা বুঝতে পারছিলেন এটা কোন ভয়ানক বিপদের সংকেত। কিন্তু কী বিপদ বুঝতে পারছিলেন না।
এরই মধ্যে বড় রাজনীতিবিদ আশরাফ আলী খান সাহেব তাকে চিঠি পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। তার মেয়ের এক অদ্ভুত অসুস্থতা। একে সারিয়ে তুলতে হবে।
চানতারা বানুর কাছে এই আমন্ত্রণ একটা বিজয়ের মত ছিল। কারণ আশরাফ আলী খানেরা বড় জমিদার বংশ, এবং তাদের পরিবারের একজন, তালাশ মাহমুদ পত্রিকায় লিখে চানতারার বিরোধিতা করেছিল। এখন যখন চানতারা এদের বাড়িতে, তাদেরই আমন্ত্রণে যাবেন, তখন তার বিজয়টা সবাই জেনে যাবে।
চানতারা রাজী হলেন। তার নিত্যসঙ্গী সহকারী কয়েকজনকে নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন।
অদ্ভুত বিষয়। লোহাগড়া গ্রামে প্রবেশের ঠিক আগে আগেই তার শরীরে কাঁপুনি এলো। তিনি জ্ঞান হারালেন।
সঙ্গীদের শুশ্রূষায় যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন তিনি আশরাফ আলী খানের বাড়িতে।
চোখ মেলে তিনি প্রথম কথাটি বললেন, মেয়েটি কোথায়?
তার সঙ্গীদের একজন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কোন মেয়ে ম্যাডাম?
চানতারা বললেন, আশরাফ আলি খান সাহেবের মেয়ে।
বিছানায় উঠে বসলেন চানতারা। মেয়েটিকে আনা হল, সাথে এলেন এলেমেলো চুলের এক উদ্ভ্রান্ত চেহারার মহিলা, সুপারি চিবুচ্ছেন।
মেয়েটি ছয় সাত বছরের, শান্ত চেহারা। সে তার বড় চোখ মেলে চানতারার দিকে তাকাল।
চানতারা বাকরুদ্ধ হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটিকে, যাকে তিনি স্বপ্নে দেখে এসেছেন। মৃতদের স্বপ্নে দেখলেও অচেনা কাউকে স্বপ্নে দেখে আবার বাস্তবে দেখেছেন, এমন আশ্চর্য ঘটনা তার জীবনে আর ঘটে নি।
এই জীবিত মেয়ে কেন তার সাথে স্বপ্নে যোগাযোগ করতে চাইছিল? এই মেয়ে কি আসলে মৃত?
চানতারা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী আম্মা?
মেয়েটা কোন কথা বলল না।
মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলেন যে মহিলা তিনি আশরাফ আলী খানের স্ত্রী গোলাপজান বিবি। তিনি সুপারি চিবিয়ে বললেন, ও কথা কয় না।
চানতারা বললেন, কথা বলতে পারে না?
গোলাপজান বললেন, পারে, কিন্তু কথা কয় না। গত কয় বছরে দুই একটা শব্দ বলছে। এর আগে স্বাভাবিক বলত। তারপরে একটা ঘটনা...তবে এখন থাক এইসব কথা। পরে বলা যাবে। আপনি বিশ্রাম নেন, আমি শুনছি আপনি অসুস্থ হইয়া পড়ছিলেন।
চানতারা বললেন, আমি অসুস্থ না। ঠিক আছি। আপনি বলুন ঘটনাটা, আমার জানা খুব দরকার।
গোলাপজান হাত নেড়ে ইশারা করলেন। একজন কাজের লোক চেয়ার এগিয়ে দিল। তিনি সেখানে বসলেন।
এরপর বললেন, তিন বছর আগে প্রথম ঘটনাটা ঘটে। আমরা তখন ঢাকার বাড়িতে ছিলাম। ওর বয়স চার বছর ছিল। একদিন সায়ংকালে ও বাইরের উঠানে ছিল, আর তখন এক নীল আলো ছুইটা আসে ওর উপর। এত নীল আমি কখনো দেখি নাই আগে। সেই নীল আলো ওর মাথার উপরে ঘুরতে থাকে, ভন ভন, ঘুরতেই থাকে। তখন মাগরেবের আজান হয়, আল্লাহু আকবার, এবং ঘুরতে ঘুরতে ঐ আলো চইলা যায়।
চানতারা বললেন, এরপর?
গোলাপজান বললেন, এরপর আমি দেখতে পাই ও পইড়া আছে, ঘুমাইয়া আছে যেন। আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া দৌড়াইয়া যাই এবং ওরে কোলে তুইলা নেই। কানের কাছে নিয়া নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করি। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ পাইয়া আশ্বস্ত হই যে বাইচা আছে। ঘরে নিয়া মাথায় পানি ঢালার পর জ্ঞান আসে।
গোলাপজান থেমে বললেন, এইদিনের পর থেকে কথা বলা বন্ধ। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখাইছি, কাজ হয় নাই। আর নতুন ঘটনাটার কথা আপনি হয়ত জানেন। উনি আপনারে বলছেন নিশ্চয়ই।
চানতারা বললেন, না, খান সাহেব আমাকে কিছু বলেন নি। শুধু চিঠিতে বলেছেন তার সাহায্য দরকার। তার কাছ থেকে এটাই যথেষ্ট ছিল আমার আসার জন্য।
গোলাপজান বললেন, হ্যাঁ, উনি কম কথা বলেন। তাহলে নিশ্চয়ই উনি নিজে থেকে আপনারে ঘটনাটা বলবেন। আমি আর না বলি। আপনি বিশ্রাম নেন।
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন।
এই এতক্ষণ পুরোটা সময় মেয়েটি চানতারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
গোলাপজান বিবি ঘুরে গিয়ে আবার ফিরে তাকালেন, বললেন, ও আপনে ওর নাম জানতে চাইছিলেন। ওর নাম হাসনাহেনা। আমরা হেনা নামেই ডাকি। আপনার নাম তো লালমতি?
উত্তরের অপেক্ষা না করে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।
এদিকে চানতারা বানু চমকে উঠেছেন।
এই নাম যে তার এটা কেউ জানে না। তার মা সিতারা বানুও জানতেন না। একজন বিশেষ মানুষ এই নাম তাকে দিয়েছিলেন, এই নামে ডাকতেন। মানুষ নিজের নাম হিসেবে যেটাকে মন থেকে পছন্দ করে সেটাই তার নাম। চানতারা লালমতি নামটাই পছন্দ করেন। কিন্তু এই কথা তিনি কাউকে বলেন নি। তাহলে এই মহিলা কীভাবে জানলেন?
অনেক বছর আগে সেই বিশেষ মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছিল, যিনি এই অতিলৌকিক দুনিয়ার গলিপথে ঘোরার সাহস দিয়েছিলেন, বলেছিলেন এই পথই তোমার পথ লালমতি। এই লোকের ব্যাপারে গোলাপজানের জানার কথা না।
লোহাগড়া গ্রামটির এই নাম হওয়ার পিছনে এক গল্প আছে। গ্রামে এক জায়গায়, দীঘির কাছে বড় বড় কিছু পাথর খণ্ড রয়েছে। কোনটা খাড়া হয়ে উঠে গেছে পাঁচ ছয় ফিট। কোনটা বেদীর মত। এই পাথরখণ্ডগুলি কেন এইখানে, কবে কে বসিয়েছিল, কেউ জানেনা। সবাই জন্ম থেকে দেখে আসছে। পাথরখণ্ডগুলির রঙ কালো। শক্ত এই প্রাচীন স্থাপনাগুলিকে লোহা বলে ভুল হয়। এগুলির সাথে মিল রেখেই গ্রামের নাম হয়েছে লোহাগড়া, এমন শোনা যায়।
এই পাথরগুলিকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় নি কখনো।
ফকির ফয়জুল্লাকে, প্রায়ই, বিশেষত সন্ধ্যার দিকে পাথরখণ্ডগুলির আশপাশে দেখা যায়।
ফকির ফয়জুল্লা এক অদ্ভুত লোক। তার জ্ঞাতি গোষ্ঠীর খবর কেউ জানে না। কয়েক বছর আগে সহসা তিনি এই গ্রামে উদয় হন।
গ্রামের প্রতাপশালী মাতবর ইদ্রিস আলীর তখন অসুখ। ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হয়েছে, কিন্তু রোগ সারার কোন লক্ষণ নেই। ইদ্রিস আলী দূর্বল হয়ে শয্যা নিলেন। বাড়ির সবাই ধরে নিলেন তিনি মারা যাবেন।
তখন এক সন্ধ্যাকালে সাদা আলখেল্লা পরা, সাদা লম্বা দাড়ি ও লম্বা সাদা চুলের এই লোকটি উপস্থিত হন ইদ্রিস আলীর বাড়ির সামনে। তার কাঁধে ঝোলানো চটের বেশ বড় এক ঝোলা, হাঁতে আঁকাবাঁকা কালো লাঠি।
তিনি বলেন, মাতবর সাবের নাকি বিমার হইছে। খবর পাইয়া আইলাম।
ইদ্রিস আলীর বড় ছেলে ফজিলত আলী বারান্দায় বসা ছিল। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, আপনে কে?
লোকটা বলেন, আমি কে সেইটা তো এখন বড় কতা না বাজান। এখন বড় কতা হইল আপনের বাপজানরে বাঁচাইতে হইব। ঠিক কি না?
ফজিলত মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক। কিন্তু আপনারে...
লোকটা বলেন, আমারে আপনার চিনতে হইব না। আপনার বাপজানরে এই উঠানে বাইর কইরা নিয়া আসেন। আমি এক নাদান মানুষ। স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত হইছি এই খবর, আপনার বাপে অসুস্থ। আমি আসছি তারে সুস্থ করতে। আপনে যান, ত্বরা কইরা উনারে বাইরে নিয়া আসেন। সময় যে খুব বেশি নাই বাজান।
ফজিলত বলে, আপনে ঘরে গিয়া দেখতে পারেন, সেইটাই ভালো হয়।
লোকটা বলেন, না বাজান। আমি কারো ঘরে যাই না। ঘরে গেলে আমার দম বন্ধ লাগে। আপনে উনারে বাইরে নিয়া আসেন।
ফজিলত ভেতরে যায়। অন্যদের সাথে কথা বলে। তখন তাদের কাছে আর করার কিছুই ছিল না। সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। তাই এই লোকটার কথা মেনে দেখতে চাইলেন বাড়ির অন্যরা। এইরকম ফকিরদের অনেক কারামতের কথা শোনা যায়।
মৃতপ্রায় ইদ্রিস আলীকে বাইরে আনা হল উঠানে।
বুড়ো লোকটা তার আলখেল্লার ভেতর থেকে একটা কৌটা বের করলেন। সেইখান থেকে কিছু গুঁড়া জিনিশ ঢাললেন একটা গ্লাসে। সেই গ্লাসে পানি ঢেলে কিয়ৎক্ষণ নাড়লেন। এরপর তা ইদ্রিস আলীকে খাইয়ে দিলেন আস্তে আস্তে।
খেয়ে ইদ্রিস আলী যেন আরও নিস্তেজ হলেন।
ইদ্রিস আলীকে ঘরের ভেতরে নেয়া হল।
ইদ্রিস আলীর ছেলে ফজিলত আলী দুইজন লোক রাখল বুড়ো ফকির লোকটাকে দেখে রাখতে, যাতে লোকটা পালাতে না পারে। তার মনোবাসনা, যদি ইদ্রিস আলীর মৃত্যু হয় এই জিনিষ খেয়ে, তাহলে ফকিরকে ধোলাই দেবে।
ফকিরকে তার পুরো বিশ্বাস হয় নি।
না হওয়ার কারণের মধ্যে একটা, ওষুধ খাওয়ানোর পর, ফজিলত লোকটাকে বলছিল, আপনে যাবেন না। অপেক্ষা করেন। কাইল আপনার সাথে কথা বলব।
সাথের লোকজনকে বলল, উনারে সামনের বৈঠক ঘরে নিয়া বসতে দে।
লোকটা তখন শব্দহীনতার সাথে অল্প অল্প হাসছিল, এবং সে কোন আপত্তি না করেই বৈঠক ঘরে চলে গেল। অথচ কিছুক্ষণ আগেই সে বলছিল সে ঘরে প্রবেশ করে না, তার দম বন্ধ লাগে।
বৈঠক ঘরে খাটের উপরে লোকটা বসেছিল। দরজায় দুইজন লোক বসা পাহাড়ায়।
লোকটা নিঃশব্দে বসে রইল। এদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।
ইদ্রিস আলীর কোন নড়াচড়া ছিল না। কেবল আলতোভাবে নিঃশ্বাসটা পড়ছে এমন।
রাত গভীরে সেই ইদ্রিস আলীর হুংকারেই বাড়ি প্রকম্পিত হল। তার ঘরে যারা ছিলেন জেগে, অসুস্থ রোগীর পাহারায়, এদের চোখ লেগে এসেছিল সামান্য। সেই সময়েই এলো ইদ্রিস আলীর জলদগম্ভীর স্বরে হুংকার।
তিনি বললেন, এই ক্যাডা আছোস এইখানে? ঐ তুমরা কই?
ইদ্রিস আলীর স্ত্রীসহ আরও যারা ছিলেন সেই কক্ষে তারা চমকে উঠলেন। দেখলেন ইদ্রিস আলী বিছানায় উঠে বসেছেন ও লাল লাল চোখে তাকিয়ে আছেন।
বাড়িতে হইচই পড়ে গেল।
ইদ্রিস আলী তার ছেলে ফজিলতকে জিজ্ঞেস করলেন, উনারে রাখছস কই?
ফজিলত বলল, বৈঠক ঘরে।
ইদ্রিস আলী সোজা খাট থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন বৈঠক ঘরে। ফকির তখনো খাটের উপরে নিঃশব্দে বসে আছেন, এবার তার চোখ বন্ধ।
ইদ্রিস আলী তার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, বাবা, আপনে আমারে বাঁচাইলেন, বাবা।
ফকির চোখ খুলে হাসলেন। বললেন, মানুষ বাচানির কে রে পাগলা? আমি তো তর কাছে এক আর্জি নিয়া আসছিলাম, আইসা দেখি তুই বিমার।
ইদ্রিস আলী বলেন, কী আর্জি বলেন বাবা? আমি আপনের খেদমতে বাকি জিন্দেগী পার করব।
ফকির বললেন, তর এই গ্রামে আমারে থাকার অনুমতি দে। আর কিছু করতে হইব না।
ইদ্রিস আলী বলেন, থাকেন বাবা, যতদিন ইচ্ছা থাকেন, আমার বাড়িতে থাকেন…
ফকির বলেন, তর বাড়িতে না, আমি অন্যখানে থাকব। আমি এক ফকির। তর মত আমিরের বাড়িতে থাকলে মানায় না। ফকির ফয়জুল্লা, থাকে বনে বনে, থাকে পাতায় পাতায়।
সেই থেকে ফকির ফয়জুল্লা লোহাগড়া গ্রামে আছেন। তিনি এক পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভূতের বাড়ি এবং সাপখোপের আস্তানা বলে এদিকে কেউ আসে না। দীঘির ধারে জঙলামত জায়গার ভেতরে সেই ভাঙ্গা বাড়ি।
সেখানে ফকির থাকেন। প্রায় সন্ধ্যার দিকে তাকে দেখা যায় দীঘির ধারের কালো পাথর খণ্ডগুলির চারদিকে ঘুরছেন ও বিড়বিড় করছেন। কখনো কখনো তাকে বাজারে দেখা যায় খুব অল্প সময়ের জন্য।
ইদ্রিস আলী সুস্থ হয়ে যাবার পর অনেক মানুষ তাদের রোগ ও সমস্যা নিয়ে ফকিরের কাছে আসত। তিনি তাদের একজনকেও কোন সাহায্য করেন নি। দুর্ব্যবহার করেছেন।
কালু সর্দার তার অসুস্থ একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। ফকির সাহায্য করেন নি। তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ঝড়ের রাতে। ওই রাতেই মেয়েটা মারা যায়।
কালু মেয়েকে ছুঁয়ে শপথ নিয়েছে এই ফকিরের ক্ষতি করে ছাড়বে।
সে তক্কে তক্কে আছে সুযোগের। এই ক'বছরেই ফকিরের নামে অনেক ভয়ংকর কথা ছড়িয়ে পড়েছে। মসজিদের হুজুর কেরামত মোল্লা বলেছেন, এই ফকির বেদ্বীন, কোনদিন তারে মসজিদের আশেপাশেও দেখা যায় নি। এ হল শয়তানের উপাসক। নাউজুবিল্লাহ।
অনেকে নাকি রাতের বেলা পুরনো বাড়িটার ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে। মড়ার খুলির ভেতরে টকটকা রক্ত নিয়ে নাকি ফকির পান করে। এইসব গল্প ছড়িয়ে পড়াতে এখন মাতবর ইদ্রিস আলীও বিব্রত বোধ করেন। অনেকে তার কাছে অভিযোগ নিয়ে গেছে। তাদের ধারণা এই লোক গ্রামে থাকলে গ্রামের ক্ষতি হবে। এর আসল নাম পরিচয়, কোথা থেকে এসেছে, কেউ জানে না। কী তার উদ্দেশ্য এখানে তাও বুঝা যাচ্ছে না। ইদ্রিস আলী অভিযোগের যৌক্তিকতা বুঝতে পারেন কিন্তু ফকিরকে চলে যাবার কথাও বলতে পারেন না। তার ভয় হয়।
কালু সর্দার সিঁধেল চোর। সে চাইলেই ফকিরের ঘরে রাতে হানা দিতে পারে। সেই ভাঙ্গা ঘরে ঢুকতে সিঁধ কাটতেও হবে না। কিন্তু কালুর সাহস হয় না।
সে অন্য একটা ফন্দী এঁটেছে।
হালিমা নামের গ্রামের এক মহিলা ফকিরকে খাবার দেয়। রাতে একবার।
যেভাবেই হোক এই মহিলাকে হাত করতে হবে।
তারপরই ফকিরের দিন শেষ।
প্রতিশোধ নেবার আনন্দে কালুর চোখ চকচক করে ওঠে।
ক্রমশ... ... ... (আগামীকাল)