

বারে স্ত্রীলোকটির সাথে আমার পরিচয়। তার নাম টিল্ডা। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। এক কোণে বসেছিল একা একা। আমি এগিয়ে গিয়ে আলাপ শুরু করলাম। আলাপ করতে করতে আমরা সহজ হয়ে উঠলাম। জানতে পারলাম সে একা থাকে। তার বিবাহচ্ছেদ হয়েছে ছয় বছর আগে। সে একটা অটো পার্টসের কোম্পানিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কাজ করে। অনেক কথার পরে আমরা সেই কথার দিকে গেলাম। আপনি হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন কথাটি কী। মানে, আজকে রাতে আমরা একটা আনন্দময় সময় কাটাতে পারি কি না। যেহেতু প্রাথমিক আলাপে আমাদের পরস্পরকে ভালো লেগেছে, সুতরাং, এতে টিল্ডা বা আমার কোন আপত্তি ছিল না।
আমরা তার বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলাম। শহরের উত্তরদিকে একটা অঞ্চল আছে যেখানে মানুষজন খুব কম থাকে। বছর ছয়েক আগের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কালে ঐ এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে, আর জমজমাট হয় নি। দিনের বেলাতেও ওদিকে কেউ তেমন যায় না, কারণ যাবার দরকার পড়ে না। কোন কারণে ওদিকে গেলে পরিত্যক্ত বাড়িগুলি চোখে পড়ে। আগাছা জন্মেছে, কোন বাড়ির জানালা কালো হয়ে আছে, ঘোষণা দিচ্ছে এখানে একসময় আগুন লেগেছিল। টিল্ডার বাড়ি সেই অঞ্চলের কাছে।
যেতে যেতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আগে এদিকে এসেছো কখনো?
— আমি বললাম, হ্যাঁ, আসব না কেন। এমনকি ঐ পরিত্যক্ত জায়গাটাতেও গিয়েছিলাম।
— কেন, ওখানে তোমার কেউ থাকে নাকি?
— না, একবার আমার ফটোগ্রাফি শেখার শখ জাগে। তখন একটা কোর্সে ভর্তি হই, আর প্র্যাকটিসের জন্য ঐ অঞ্চলে গিয়েছিলাম বাড়িগুলির ছবি তুলতে।
— ছবিগুলি কি আছে তোমার কাছে?
— খুঁজলে পাব হয়ত। কেন?
— দেখব। ঐ এলাকা একসময় খুব সুন্দর ছিল। আমাদের ছোটবেলায়, আমার চাচারা ওইদিকে থাকতেন। এইজন্যই আমার বাবা কাছে বাড়ি বানিয়েছিলেন। আমিও বাড়িটা ছাড়ছি না, কারণ মনে হয় যেন এই এলাকাটাই আসলে আমাদের। এইখানেই আমার জন্ম। মানুষের জন্মস্থানই তার একমাত্র আপন জায়গা। এর একটা অন্যরকম টান আছে যা মানুষ কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না। কেন জানো?
— আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
— টিল্ডা বলল, হয়ত জন্মস্থান এমন এক মূর্ত বাস্তবতা যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সে এখানে চিরকাল ধরে ছিল না।
টিল্ডার এই কথা আমাকে আমার বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিল। আমাদের বাড়ি বাংলাদেশের এক গ্রামে, হয়ত এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যে বাড়িতে আমার অনেককাল কেটেছে, আর আমি কি কখনো ভেবেছিলাম ঐ বাড়ি থেকে এত দূরে এসে আমি বাস করব কখনো? আমার গ্রামের সেই বাড়ি ও তার পেছনের পুকুরে জমে থাকা শেওলার ছবি যেন আমি দেখতে পেলাম। হ্যান্স এবেনডরফ নামে একজন জার্মান দার্শনিক বলেছিলেন, সর্বজনীন ঘরবাড়িহীনতার এক বোধের ভেতরে মানুষ বাস করে। তার চিন্তা তাকে আমি থেকে সরিয়ে দেয়, আমি সরিয়ে দেয় বাইরের দুনিয়া থেকে, বাইরের দুনিয়া সরিয়ে দেয় সময় থেকে, তার আগামিকাল তাকে সরিয়ে দেয় আজকে থেকে, তার আজ তাকে সরিয়ে দেয় গতকাল থেকে। কোথাও মানুষের কোন সত্যিকার ঘরবাড়ি নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্ধকারে স্ত্রীলোকের ভিতরে ডুব দিয়ে দেশলাই জ্বেলে ঘরবাড়ির খোঁজ করে পান নি, কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, মানুষের কোথাও কোন বাড়িঘর নেই। এবেনডরফ এই বাস্তব বোঝার জন্য কিছু বিরতি বা অনুপস্থিতির পরে, নিজের জন্মস্থানে ফিরতে বলেছিলেন। আমার জন্মস্থানের জন্য হাহাকার বোধের জন্ম হল, এবং একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
টিল্ডার বাড়ির সামনে আমরা নামলাম। কংক্রিটের বাড়ি, পুরনো। সামনে বিশাল দরজা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টিল্ডা বলল, তুমি সুযোগ পেলে এই দরজার ছবি তুলতে পারো। খুব মজবুত কাঠ দিয়ে এটি বানানো হয়েছিল, এবং এর কারুকাজগুলি একে অসামান্য করে তুলেছে। বিশ্বাস করবে কি না জানিনা, এই পুরো বাড়ির মধ্যে এই দরজাটিই হলো সবচাইতে দামি। আমার বাবা বলতেন, বাড়ির মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিশ হল দরজা, কারণ দরজা ভেতর ও বাহিরের মধ্যে বাঁধা এবং যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। এর কাজের ভিতরে দ্বিচারিতা আছে। দরজা দ্বিধার প্রতীক। ভেতরে প্রবেশ করে টিল্ডা ও আমি খুব অল্প সময় কথাবার্তা বললাম। সে মূলত বাড়িটা নিয়েই কথা বলল। আমি শুনে গেলাম। তার কথা বলার ধরণে বুঝতে পারলাম বাড়িতে সে একাই থাকে। টিল্ডা আমাকে তার বেডরুমে নিয়ে গেল। দরজা খোলাই রইল।
এরপর, আপনি বুঝতেই পারছেন যা হবার তাই হলো। টিল্ডা শব্দ করছিল অনেক যৌনক্রিয়ার সময়, এবং এটাকে ভদ্র ভাষায় কীভাবে প্রকাশ করার উপায় নেই, মানে, যৌন খিস্তিসমূহ বলে যাচ্ছিল অনবরত, জোরে জোরে। শব্দ একটা শক্তিশালী জিনিস, অনেকের অর্গাজমে এটি সাহায্য করে থাকে। এতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু এত জোরে সে চেঁচাচ্ছিল যে আমি চমকে উঠছিলাম মাঝে মাঝে। এবং আমি এতে আরো নিশ্চিত হয়েছিলাম বাড়িতে আর কোন জনমানব নেই।
আমাদের সেক্স শেষ হলো। এত ভালো সেক্স আমি অনেকদিন উপভোগ করি নি। আমার চোখ গরম হয়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল চোখ জ্বলছে। ভালো সেক্সের পরে এই জিনিস হয়। এক ডাক্তার বন্ধুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এর কারণ কী? সে বলল, পানিশূন্যতা। পানি খাবি। তার পরামর্শ আমি মেনে চলার চেষ্টা করি। তাই পানি খেতে রুম থেকে বের হলাম। আমার গা খালি, পরনে শুধু প্যান্ট। টিল্ডার বেডরুমের পাশে ডাইনিং রুম। ওইখানের ফ্রিজ খুলে আমি পানির বোতল বের করলাম, এবং ঘুরে পানি মুখে দেব তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ল।
আকস্মিকতায় আমার মাথা ঘুরে যাবার দশা হলো। দেখলাম, পাশের এক রুমের দরজায় নয় দশ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এবং শীতল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার বড় বড় দুই চোখ। সে হাঁ করে আমাকে পুরো জিভ বের করে দেখাল, সে জিভে একটা সবুজ পাতা। জীবনে প্রথমবারের মত আমার লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এটি নিশ্চয়ই টিল্ডার মেয়ে। তার মানে, সে সব কিছু শুনেছে, এবং এখানে আমি খালি গায়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে তৃতীয় শ্রেণির একটা লম্পট মনে হচ্ছিল আমার। আমি দ্রুত পানি খেয়ে টিল্ডার রুমে গেলাম।
ততক্ষণে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে। টিল্ডা কথা চেপে গেছে যে তার মেয়ে আছে। এরকম জিনিস আমার পছন্দ না। দীর্ঘদিন একরাত্রির আনন্দভ্রমণ অভিজ্ঞতা আমাকে বলে এটা রেড ফ্ল্যাগ তথা লাল সিগনাল, সতর্ক সংকেত। যারা এরকম কথা চেপে যায়, মিথ্যা বলে তাদের সাথে আনন্দভ্রমণ নিরানন্দের সূত্রপাত ঘটাতে পারে যে কোন সময়ে। এখন এক ঘরে দেখা গেছে মেয়ে, আরেক ঘর থেকে স্বামী বের হয়ে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আমি আমার শার্ট পরতে শুরু করলাম।
— টিল্ডা শীতল গলায় বলল, কী হয়েছে?
— কথা না বাড়িয়ে আমি বললাম, এখন মনে পড়ল একটা কাজ আছে সকালে, আমার যেতে হবে।
— টিল্ডা বলল, কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম আজ আমরা সারারাত থাকব।
— আমি বললাম, আমি আসলেই দুঃখিত।
টিল্ডা চুপ হয়ে গেল। আমি শার্ট পরে উঠলাম, রুম থেকে বের হলাম। কেন জানি আমার তখন মনে হল, মেয়েটাকে হাই বলে যাই, কারণ তখন কিছুই বলা হয় নি। আমি এগিয়ে গিয়ে ঐ রুমে গেলাম, যেখানের দরজায় মেয়েটি ছিল। ভেতরে প্রবেশ করলাম। পরিপাটি সাজানো রুম। খালি। দেয়ালে বড় করে ঝুলানো দ্য স্ক্রিমের এক কপি।
আমি ঐ রুম থেকে বের হয়ে দেখি টিল্ডা বিছানার চাদর কোনওরকমে গায়ে জড়িয়ে আমার পিছু পিছু এসে, বেডরুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং সিগারেট ধরিয়েছে। আমি তার দিকে গেলে সে আমাকে সিগারেট বাড়িয়ে দিল, আর শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, ঐ রুমে গিয়েছিলে কেন? আমি তখন তাকে পালটা প্রশ্ন করলাম, ঘরে তোমার মেয়ে আছে তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন? এই প্রশ্নে টিল্ডা পাথরের মত স্থির হয়ে গেল কিছুক্ষণ। এই অল্প সময় আমার কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। আমি চাইছিলাম এ নিয়ে কোন কথা না বলে জায়গাটা ত্যাগ করতে। কারণ এসব কাজে এসে অহেতুক ঝামেলায় না জড়ানো হলো প্রথম নিয়ম। আর দ্বিতীয় নিয়ম হলো প্রথম নিয়ম কখনো বিস্মৃত হওয়া যাবে না।
আমি জিনিস কাটাতে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, সমস্যা নেই। হয়তো কোন কারণে তুমি বলোনি। যাই তাহলে আজ আমি, আরেকদিন কথা হবে। আমি মূল দরজার দিকে যাচ্ছি, তখন পেছন থেকে টিল্ডার শীতল কণ্ঠ এল, দাঁড়াও। টিল্ডা বলল, আমার মেয়ে ছিল। দেড় বছর আগে সে মারা গেছে।
আমি ঘুরে তাকালাম। টিল্ডা সিগারেট ফুঁকছে। তার গায়ে কোন কাপড় নেই। বিছানার চাদর মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। ধোঁয়া তার মুখ ঢেকে দিচ্ছে। আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম, কিন্তু আমি যে স্পষ্ট দেখলাম? টিল্ডা বলল, সে আসে। কারণ এইরকম কিছু তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ছিল। যখন ওইদিনের মত পরিস্থিতি তৈরি হয় এখানে, যেন সময়ের পুনরাবৃত্তি হয়, তখন সে আসে, আবার চলে যায়। আমি দেখতে পাই না। কিন্তু আমার ভাবতে ভাল লাগে যে সে আমার কাছাকাছি আছে। অন্তত এইভাবে হলেও।
সায়ন্তন চৌধুরী | ২৮ মে ২০২১ ২১:৩৫106518মুডটা ঠিক তৈরি হলোনা; যেহেতু প্রেডিক্টেবল প্লট, গল্পটা একটা ওপেন-এন্ডেড বারস্টোরির মতো করে লিখলে বোধহয় জমত, সাররিয়েলের দিকে সামান্য ঝুঁকে। এছাড়া বাংলাদেশ আর সুনীলের পদ্যের রেফারেন্স সমেত ঐ প্যারাটা অপ্রয়োজনীয় লেগেছে, কেননা ওটা খামোকা ন্যারেটরের ব্যাকস্টোরি জোগাচ্ছে। অথবা সেটা হয়তো একধরনের ব্লিকনেস আশা করছিলাম বলে আমার নিজস্ব নান্দনিকবোধ ঐ প্যারাটায় ধাক্কা খেল।