সম্পদ বা ক্ষমতা কোনটাতেই তালাশ মাহমুদের আগ্রহ নেই। পুর্বপুরুষের জমিদারীর কোথায় কী আছে এগুলি জানার ব্যাপারেও কোনোদিন তার আগ্রহ হয় নি। তার আগ্রহ কেবল রহস্যে, এবং রহস্য উদঘাটনে। এর জন্য দেশ দেশান্তরে ছুটে যেতেও তিনি পিছপা হন না।
আশরাফ আলী খানের কথা শুনে তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন এখানে তার কোন কাজ নেই। ফলে, একটা সুযোগ বের করেই কেটে পড়তে হবে।
সম্ভবত, আশরাফ আলী খান এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এমনিতে থাকবেন না, তাই ঐ ম্যাডামকে নিয়ে এসেছেন। যাতে ওই দ্বৈরথকে কেন্দ্র করে তালাশ মাহমুদ রয়ে যান।
হাসনাহেনার উপরে নীল আলোর ব্যাপারটাতে তালাশ মাহমুদ আগ্রহ বোধ করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু একজন মাত্র সাক্ষী ঘটনার, এবং তার নিজেরই অবস্থা এখন ঠিক নেই, ফলে এটাকে বেশী পাত্তা দেবার মত বিষয় মনে হলো না। মোটকথা, তালাশ মাহমুদ চান না আশরাফ আলী খানের রাজনীতির ঘুটি হতে।
বিকেলের দিকে বব ও লালফর মিয়াকে দেখা গেলো কোথাও বের হতে। তালাশ মাহমুদকে দেখে বব বললেন, আপনিও চলেন আমাদের সাথে, হীরাটার খোঁজ তো পেতেই হবে।
অন্য কোন কিছুতে আগ্রহ বোধ না করায় তালাশ মাহমুদ এদের সাথেই চললেন। তার সাথে সাথে চললো তার প্রিয় কুকুর হার্মিসও।
পথে বব বললেন, আপনাদের গ্রামে যে বুড়ো ফকিরটা এসেছে তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বের হয়েছিলাম আমরা দুজন। অনেক তথ্য জানলাম। লোকটা আসলেই রহস্যময়, জঙ্গলের ভেতরে থাকে। তার আস্তানায় যাবার সাহস হয় নি। এখন যাচ্ছি দীঘির পাড়ে যেইখানে বড় বড় পাথর আছে, আপনাদের এখানে যে এতো মনোলিথ আছে আপনি তো আমাকে বলেন নি?
তালাশ মাহমুদ বললেন, মনোলিথ আছে আমি তো নিজেই জানি না!
বব বললেন, তাহলে চলেন, নিজের চোখেই দেখবেন।
তারা দীঘির পাশে পাথর ঘেরা জায়গাটাতে পৌঁছালেন। বব একেকটা পাথর খণ্ডের কাছে গিয়ে বুঝাচ্ছিলেন এগুলি কত হাজার হাজার বছর আগের। প্রাচীর মানুষেরা এগুলাতে পূজা করতো। কত শত বিশ্বাস যে জড়িয়ে আছে এইরকম মনোলিথদের নিয়ে।
বব জঙ্গলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওইদিকেই ভেতরে এক ভাঙ্গা ঘরে ফকির থাকে। ওর কাছেই আছে হীরাটা।
তালাশ মাহমুদ বললেন, আপনার মনোলিথের গল্প ভালো লেগেছে। কিন্তু এইরকম প্রাচীন পাথর তো পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই আছে। আর ফকিরের ব্যাপারটা যা বলছেন, আমি কোনই আগ্রহ পাচ্ছি না। যে হীরার কথা আপনি বলছেন, ঐতিহাসিক ভাবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। আর থাকলেই একটা ফকিরের কাছে থাকবে, এটা আমি সহজে বিশ্বাস করছি না।
তালাশ মাহমুদের অনাগ্রহ দেখে একবার বব তার হাত চেপে ধরে অনুরোধ করলেন, আপনি এই কাজটায় আমাকে সাহায্য করেন। একবার ওর ঘরে গিয়ে তল্লাশিটা করি।
লালফর মিয়াও অনুরোধ করলো, স্যার, না কইরেন না।
তালাশ মাহমুদ বললেন, না, আমি এর মধ্যে নেই। আপনাদের ইচ্ছা হলে যান।
তালাশ মাহমুদ চাচ্ছিলেন না উটকো কোন অকাজে আর জড়াতে। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে।
এই গ্রামের মধ্যে এই ফকিরের সাথে কোন কিছুতে জড়ালে তা ইদ্রিস আলী চেয়ারম্যানের সাথে ঝামেলার সাথে গিয়ে মিলবে, যেহেতু তারাই এঁকে আশ্রয় দিয়েছে। তাছাড়া, যতদিন গ্রামে আছেন তিনি ততদিনই একটা সম্ভাবনা থাকে গ্রামের এই বিরোধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার। তালাশ মাহমুদ এটাতে পড়তে চান না।
এইসব বিবেচনায় তিনি না করলেন, যদিও বুঝতে পারছিলেন এতে বব ও লালফর মিয়া দুজনই অসন্তুষ্ট হয়েছে।
সন্ধ্যার পড়ে তারা বাড়িতে ফিরে এলেন।
রাতের খাবারের পর তালাশ মাহমুদ দেখলেন বব ও লালফর মিয়া আবার বের হচ্ছে টর্চ লাইট নিয়ে। তার সাথে দেখা হলো, কিন্তু তাকে তারা কিছুই বললো না।
গ্রামের রাত নিস্তব্দ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। তালাশ মাহমুদ উঠানে বের হয়ে দেখলেন এক কোনে ওই ম্যাডাম বসে আছেন তার সহযোগীদের নিয়ে। মাঝখানে বড় কয়েকটা হারিকেনের আলো জ্বলছে।
তালাশ মাহমুদ এগিয়ে গেলেন। মহিলার সাথে কথা বললে মন্দ হয় না।
তালাশ মাহমুদকে দেখে চানতারা বানু বললেন, কেমন আছেন? আপনি এসেছেন শুনেছিলাম, দেখা হয় নি।
তালাশ মাহমুদ বললেন, হ্যাঁ, আজ সকালেই এলাম। আপনার এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
চানতারা বানু বললেন, না, আপনাদের বাড়ি তো বিশাল, সব কিছুরই সুব্যবস্থা আছে।
তালাশ মাহমুদ বললেন, তা যে জন্য এসেছেন, সেই রহস্য সমাধানে কিছু পেলেন কী? মানে, এই ব্যাপারেই তো আমার আগ্রহ তাই জিজ্ঞেস করা।
চানতারা বানু হেসে বললেন, এই ব্যাপারে যে আপনার আগ্রহ তা তো সবারই জানা। এও জানা যে, আমি যে পদ্বতিতে কাজ করি তা আপনার কাছে বোগাস। আপনি এখন প্রশ্নটা করেছেন কেবল ভদ্রতার খাতিরে।
তালাশ মাহমুদ সামান্য হেসে বললেন, না সেটা নয়, আমি যে আপনার পদ্বতি সম্পর্কে জানি না তা কিন্তু নয়। সেদিন মোহিনীমোহনের আর্টিকেল পড়লাম ওই গ্রেট মাস্টারদের নিয়ে যারা হিমালয় পর্বতে আছেন। আপনার কি সত্যি মনে হয় উনারা আছেন?
চানতারা বানু পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনার কি মনে হয় উনারা নেই?
তালাশ মাহমুদ বললেন, দেখুন দাবীটা কিন্তু আপনাদেরই করা, তাই আপনাদেরই উচিত প্রমাণ দেয়া, ঠিক না? আমি তো বলি নাই কোন গ্রেট মাস্টারেরা হিমালয় পর্বতে আছেন ও আমাদের দেখছেন। আর মাঝে মাঝে চ্যালা নিযুক্ত করছেন।
চানতারা বানু ভ্রু কুঁচকে বললেন, ব্যঙ্গ করলেন?
তালাশ মাহমুদ বললেন, আরে না! মজা করব কেন, এই এক সমস্যা, আপনাদের প্রশ্ন করলেই ভাবেন ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন ছাড়া কি রহস্যের মীমাংসা হয়?
চানতারা বানু বললেন, প্রশ্নটাই কি আরো রহস্য নয়? আর সকল রহস্যের সমাধানে কি পৌঁছাতে পারে আপনার প্রশ্ন, তার পিঠে আরো প্রশ্ন, আরো প্রশ্ন?
তালাশ মাহমুদ এবার কৌতুকের সুরে বললেন, তাহলে সত্যে কীভাবে পৌছব?
চানতারা বানু বললেন, উপলব্ধির মাধ্যমে।
অন্য কোন জায়গা হলে তালাশ মাহমুদ তর্ক করতেন। কিন্তু তার মনে ছিল আশরাফ আলী খানের কথা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে হাসনাহেনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভাতিজি হাসনাহেনাকে কি দেখেছেন?
এই প্রশ্নে চানতারা বানুর মুখ কালো হয়ে গেলো, হারিকেনের আলোতেও সেটা লক্ষ করলেন তালাশ মাহমুদ।
আস্তে করে চানতারা বানু বললেন, মেয়েটার খুব বিপদ।
আর সহ্য করতে পারলো না তালাশ মাহমুদের যুক্তিবাদী মন। তিনি উঠে পড়লেন। এখানে থাকার আর মানে হয় না। এই রকম দ্ব্যর্থবোধক কথা, ভয় দেখানো ভবিষ্যৎবাণী এদের প্রধান অস্ত্র। তার উপর এর প্রয়োগ দেখে তালাশ মাহমুদ বিরক্ত হলেন ভেতরে ভেতরে। চালাক চালাকি করে এটা সমস্যা না, বরং সে যে ভাবে চালাকি অন্যরা ধরতে পারবে না, এটাই বিরক্তিকর ঠেকে তালাশ মাহমুদের কাছে।
তালাশ মাহমুদ বললেন, যাই তাহলে। পরে হয়ত আরেকবার কথা হবে।
তালাশ মাহমুদ যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন চানতারা বানু বলে উঠলেন, তালাশ মাহমুদ সাবধান থাকবেন, আপনারও বিপদ সামনে।
চানতারা বানুর চোখে হারিকেনের আগুনের শিখা প্রতিফলিত হচ্ছিল, তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের দিকে।
শুধুমাত্র নিজেদের বাড়িতে অতিথি বলে তালাশ মাহমুদ সহ্য করে গেলেন। তা না হলে এই কথাটাকে হুমকি ধরে নিয়ে তিনি উদ্ধার করে ছাড়তেন কীভাবে এই বিপদ ভদ্রমহিলা দেখতে পেলেন।
কালু সর্দার এসেছে জঙ্গলের মধ্যে। ফকিরের ভাঙ্গা ঘরের দিকে তাকিয়ে সে ঠায় বসে আছে, তার চোখ চক চক করছে উত্তেজনায়।
ফকির ফয়জুল্লাহ রাতে তার ঘরে বসে আছেন জঙ্গলার মধ্যে। তিনি ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছেন তার সামনে বসা হালিমার দিকে। হালিমা তার জন্য ভাত নিয়ে এসেছে।
ফকির ফয়জুল্লাহ দাড়ি গোঁফের জঙ্গল নাড়িয়ে নিঃশব্দে হাসলেন। হালিমাকে বললেন, দে মা, ভাত দে।
হালিমা মাটির সানকিতে করে ভাত রাখলো বাবার সামনে। সাথে সিদ্ধ আলু।
ফকির ফয়জুল্লাহ হাত দিয়ে ভাত নিয়ে মুখে দিলেন।
তারপর হালিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আরো দে।
হালিমা বিব্রত মুখে বলল, কী বাবা?
ফকির বললেন, ঐ যেইটা দিছস, কাপড়ে বাইন্ধা আনছস, ওইটা আরও দে। অনেকদিন পরে খাইতেছি।
হালিমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল দৌড়ে পালাতে কিন্তু হাত পা যেন অবশ হয়ে আছে।
ফকির বললেন, ভয় পাইস না, জিনিসটা দে।
হালিমা হাত পা নড়াতে পারলো না ভয়ে।
ফকির তখন গর্জে উঠলেন, দে খানকি মাগির বেটি, ঢাইলা দে।
হুংকারের চোটে হালিমা তার কাপড়ে বাঁধা বিষের শিশি বের করে কাঁপা হাতে ঢেলে দিলো ভাতের মধ্যে।
ফকির ফয়জুল্লা বিষ মাখিয়ে আলু সিদ্ধ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভাত খেলেন।
তারপর বললেন, বিষে আমি মরুম না। আমার মরণ নাই রে। কত লোক বিষ দিলো আমারে। খাইতে খাইতে স্বাদ জন্মাইছে। ভালো করছস তুই দিয়া। কত স্মৃতি মনে হইল, এখন যা, দূর হ।
হালিমা এক দৌড়ে চলে গেলো।
কালু সর্দারের টাকার লোভে পড়ে সে ফকির ফয়জুল্লাহকে বিষ দিতে এসেছিলো।
লুকিয়ে থাকা কালু সর্দারও দৌড় দিলো।
তার নিজের হাতে কেনা বিষ, সবচাইতে বিষাক্ত বিষ। যার এক ফোটাতেই মৃত্যু অনিবার্য, পুরোটা খেয়ে নিলো লোকটা। এ তো মানুষ না।
কালু সর্দার জঙ্গল থেকে বের হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দীঘির ধারে গেল। ভয়ে উত্তেজনায় এবং এতক্ষণ দৌড়ে আসায় তার পিপাসা পেয়েছিলো। সে দীঘিতে গিয়েছিল পানি খেতে।
তখন দেখল অদ্ভুত দৃশ্যটি।
দীঘির এক অংশে, পানির তলদেশ থেকে নীল আলো আসছে। এবং একটি গণ্ডারের মত কালো বস্তু যেন ভেসে উঠছে।
কালু হতভম্ব হয়ে গেলো।
আরো কিছু দেখলো কালু সর্দার। কী দেখলো তা ঠিকমত বুঝে উঠার আগেই নীল আলোকরশ্মি তাকে এসে ঘিরে ধরলো।
কালু সর্দার নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল দীঘির পাড়ে।
তার জীবনাবসান হলো।
সাধারণ চুরি এবং অন্যের জমিতে কাজকর্ম করেই সে তার জীবিকা নির্বাহ করে গেছে জীবনে। সে ভালো লোক ছিল এটা বলা যায় না কোন হিসাবেই। কিন্তু সে তার ছোট মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসতো। ওই মেয়েটার মৃত্যুই তাকে প্রায় উন্মাদ করে দেয়।
সে মনে করতে থাকে ফকির ফয়জুল্লাহ চাইলেই তার মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতো।
তারই শোধ নিতে এসে কালু আজ মারা গেল।
প্রতিশোধ সমাধান করে না, একটার পর একটা নতুন মৃত্যু আনে, পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলে।
কালুর মৃতদেহ পরদিন সকালে পাওয়া গেল।
গ্রামে হইচই পড়ে গেলো।
গ্রামের মানুষ শোক প্রকাশ করতে লাগলো কালুকে নিয়ে। যদিও সে তেমন ভালো লোক ছিলো না।
শোকের চাইতে বেশি ছিল ভয়। কী হয়েছিলো কালুর সাথে।
এই দীঘি এবং এর পাশের জঙ্গল নিয়ে ভয়ংকর গল্পগুলা প্রচলিত সেই আদিকাল থেকে। সবাই তার বাপ দাদা পরদাদার মুখে শুনে আসছে। প্রায় প্রতি কালেই যেন একটা দুইটা ঘটনার মাধ্যমে দীঘি জানান দেয় তার ক্ষমতা শেষ হয়ে যায় নি।
কালুর মৃতদেহ দেখতে সবাই আসলেও আসলো না কেবল হালিমা। ভয়ে তার জ্বর এসেছে। এবং সে মনে করতে লাগলো, সে তো জানে আসলে কালুর এই পরিণতির কারণ কী।
আরেকটি ঘটনা ঘটে গেলো ওইদিন সকালে।
তালাশ মাহমুদের কুকুর হার্মিসকে পাওয়া যাচ্ছিলো না, দীঘির পাশের একটা বড় মনোলিথের বেদীতে কুকুরটাকে মিললো। গলা কেটে ফেলে রাখা হয়েছে, সাথে কয়েকটা রক্তজবা ফুল। দেখলেই যে কারো বুঝে যাবার কথা, কোন প্রাচীন দেবতাকে তুষ্ট করতে কুকুরটাকে বলি দেয়া হয়েছে।
ক্রমশ... ... ... (আগামীকাল)