তালাশ মাহমুদ ঘুম থেকে উঠলেন তার কুকুর হার্মিসের ডাকে। গত পাঁচ বছর ধরে এই জার্মান শেফার্ডটি তার একমাত্র সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
হার্মিস মুখে করে একটি চিঠি নিয়ে এসেছে।
তালাশ মাহমুদ বিছানায় উঠে হেলান দিয়ে বসলেন, পাশের টেবিল থেকে তার চশমা নিয়ে পরলেন এবং খাম খুলে চিঠি পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে তার ভ্রূ কুঁচকে গেল। তিনি বাম হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকালেন। চিঠিতে তারিখ দেয়া আছে তিন সপ্তাহ আগের।
তালাশ মাহমুদ গতকাল রাতে বাসায় এসেছেন, একমাসের মত শহরের বাইরে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই চিঠিটা এসেছে।
হার্মিস আগ্রহ নিয়ে দেখল। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে কোথাও কোন ঝামেলা হয়েছে, তাদের শীঘ্রই বের হতে হবে।
তালাশ মাহমুদ যখন বের হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন তার ঘরে আসলেন আহমেদ সবুর খান। একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং তালাশ মাহমুদের বন্ধুসম প্রতিবেশী।
ছোটবেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তিনি বাম হাতে ব্যথা পেয়েছিলেন। তখন থেকে বাম হাত পকেটে পুরে হাঁটা শুরু, এখনো সেই অভ্যাস যায় নি।
সবুর খান তালাশ মাহমুদের প্রস্তুতি নেয়া দেখে বুঝলেন তিনি কোথাও বের হচ্ছেন। এরকম বের হয়ে তিনি কখনো সপ্তাহ খানেক থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত লাপাত্তা থাকেন প্রায়ই।
খান তাই একটু ব্যস্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, কি স্যার, কোথাও মিশনে যাচ্ছেন নাকি?
তালাশ মাহমুদ বললেন, হ্যাঁ যেতে হচ্ছে বলা ভালো। আমার ইচ্ছা ছিল কয়েকদিন আরাম করব, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
খান বললেন, আমার তো ধারণা ছিল ম্যাডামের কেসটা যখন পেয়ে গেছেন তখন কিছুদিন আপনি ঘরে বসেই কাজ করবেন। আমার মনে হয় না আপনি এক কেস অসমাপ্ত রেখে অন্যটাতে ঢুকে পড়েন। তা, এটা কি এই কেসেই যাচ্ছেন নাকি অন্য কোন ঘটনা?
তালাশ মাহমুদ বললেন, না, এটা না। এটার মীমাংসা শেষ।
খান সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শেষ মানে? বলছেন কি স্যার? ম্যাডাম তো এই গত সপ্তাহেই একটা কেস সমাধা করে এলেন। খবর বের হল পত্রিকায়। আপনি পড়েন নি পুলিশ সুপারের বিবৃতি? মুণ্ডু কাটা লাশ গাছের নিচেই পাওয়া যায়, তেরো হাত মাটির নিচে। ভয়াবহ অবস্থা!
তালাশ মাহমুদ কোন উত্তর দিলেন না। তিনই গুন গুন করে কি একটা গান গাইতে গাইতে তার চটের ব্যাগে জিনিসপত্র ভরছিলেন।
খান সাহেব তাগাদা দিলেন, কী স্যার, বলেন কিছু, কীসের মীমাংসা হল? আমার তো মনে হয় ম্যাডামের কাছে আপনি ফেঁসে গেলেন। অবশ্য ম্যাডাম সুন্দরী আছেন, সমস্যা নেই। সুন্দরীদের সাথে তো আপনার হারতে অসুবিধা নেই?
তালাশ মাহমুদ ব্যাগ রেখে খান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, খান সাহেব, গল্প বানানো আপনার পেশা, সেই কারণে আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলা বৃথা। তবে ওগুলি আপনার পত্রিকার পাতায় মানায়। যেইভাবে এই ম্যাডামকে আপনারা গল্প বানিয়ে বানিয়ে তৈরি করেছেন, আর পুরা পুলিশি তদন্তকে একটা সার্কাস বানিয়ে ছেড়েছেন, তেমনি পত্রিকার পাতাতেই গল্প ছাপান।
খান সাহেব হেসে বললেন, তাহলে বলছেন, আপনার আর ম্যাডামের সম্পর্ক নিয়ে একটা গল্প ছাপা হলে মন্দ হয় না?
তালাশ মাহমুদ বিরক্ত মুখে তাকালেন খানের দিকে।
খান এবার স্বর বদলে বললেন, আরে ভাই, বিরক্ত হন কেন? সাংবাদিকদের প্রতি আপনার এত রাগ কেন? আপনার খবর কি আমরা ছাপি না? আজেবাজে কথা বাদ, আমি আসলে এসেছিলাম লেখাটা নিতে। ম্যাডামের লাস্ট কেস নিয়ে আপনি লেখাটা দিবেন বলেছিলেন...
তালাশ মাহমুদ বললেন, ওটা শেষ হয় নি।
খান সাহেব বললেন, তাহলে হবে কী করে? ম্যাডামকে নিয়ে খবর বের হচ্ছে, রেডিওতে অনুষ্ঠান হচ্ছে।
তালাশ মাহমুদ বললেন, হতে থাক।
খান সাহেব বললেন, তিনি তো আপনাকে ডিফিট...
তালাশ মাহমুদ কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন দেখে খান সাহেব থেমে গিয়ে কথা বদলালেন, মানে বলছি, ম্যাডাম তো যুক্তিতে আপনার থেকে এগিয়ে গেলেন, তাই না?
তালাশ মাহমুদ বললেন, বেশি বুজরুকি দেখালে, আর বেশি বললেই যুক্তি শক্ত হয় না। আপনার ম্যাডামের সব কেচ্ছাকাহিনী শেষ করে দেব সামনের লেখায়। তাই সময় লাগছে। এর মধ্যে এখন আবার আরেক জরুরী কাজে যেতে হচ্ছে। সেখানে ক'দিন থাকতে হবে, পরিস্থিতি কেমন হবে, কীরকম সময় পাব জানি না। যদি সময় পাই তাহলে ওখানে বসেই লেখা শেষ করে আপনাকে পাঠিয়ে দেব। চিন্তার কিছু নেই। একশো ভাগ নিশ্চিত থাকুন, আমি জিতবই। কারণ আমার আগ্রহ সত্যে।
সবুর খান বললেন, তাহলে আগে কিছু বলুন, দুয়েকটা পয়েন্ট।
তালাশ মাহমুদ বিরক্ত স্বরে বললেন, কী আর বলব, এসব রেট্রোফিটিং, কিছু জেনারালাইজড অনুমান করে, তারপর যেটা মিলে ওইটারেই আপনারা সবাই মিলে সামনে আনেন। এসব চালাকি তো নতুন না।
তালাশ মাহমুদ ও খান সাহেব দুজনই একসাথে বের হলেন ঘর থেকে। সাথে হার্মিস।
পথে একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে একদল ইংরেজ সৈন্য চলে গেলো, হার্মিস তাদের পিছু পিছু গিয়ে ঘেউ ঘেউ করলো কিছুক্ষণ।
খান সাহেব বললেন, খবর পেয়েছেন স্যার, জর্মনরা চেক দখল করে নিল। যুদ্ধটা মনে হচ্ছে খারাপই হবে।
ঢাকা শহরের লোকালয়ে বেশ কিছুদিন ধরে অন্যরকম এক চাঞ্চল্য এসেছে। শহরে ইংরেজ সেনাবাহিনী এসেছে।
পথেঘাটে যুদ্ধ নিয়ে মানুষেরা আলাপ আলোচনা চলছে। গুজব রটছে। এরইমধ্যে দেয়ালে দেয়ালে ইংরাজ সরকার বিজ্ঞপ্তি টাঙ্গিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধ নিয়ে আলাপ আলোচনা থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়ে।
তালাশ মাহমুদ গাড়িটির দিকে তাকিয়ে খান সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, এরা উঠেছে কোথায়?
খান সাহেব যেহেতু পত্রিকা চালান, প্রায় সব খবর তার কাছে আসে। তিনি বললেন, হাইকোর্ট এলাকায়। এই যে দেখছেন গাড়িতে যাচ্ছে, নেমে কিন্তু পয়সা দিবে না, পয়সা চাইলে গাড়োয়ান মার খেতে পারে।
তালাশ মাহমুদ বললেন, তাই নাকি?
খান সাহেব গলার স্বর নামিয়ে বললেন, আরও মজার কাহিনী আছে স্যার। হাইকোর্টের পেছনে যে বড় পুকুরটা আছে, চেনেন তো?
তালাশ মাহমুদ বললেন, হ্যাঁ, চিনব না কেন।
খান সাহেব বলতে থাকলেন, এই সৈন্যগুলা মেয়ে পুরুষ মিলে ঔ পুকুরে ন্যাংটা হয়ে গোসল করে।
তালাশ মাহমুদ বললেন, আপনার এই কথা বিশ্বাস করলাম না।
খান সাহেব বললেন, কেন স্যার! আমার সোর্স নিজ চোখে দেখেছে। আরও অনেক মানুষ দেয়ালের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। আর দেশ বিদেশ ঘুরেছেন জানেনই তো ওরা কেমন।
তালাশ মাহমুদ বললেন, আগ্রহ নেই। আপনি বরং আপনার পত্রিকায় ছাপান, এইরকম জিনিশই তো আপনারা খুঁজে বেড়ান। এই চমৎকার নিউজটি ছাপছেন না কেন ভেবে অবাক হচ্ছি।
খান সাহেব হেসে বললেন, ছেপে জেলে যাবার সাধ নেই স্যার। তবে আরেকটা মারাত্মক খবর পেলাম সেদিন, জর্মন এক স্পাই ধরা পড়েছে পলাশী ব্যারাকের কাছে। ভিখারির বেশে ঘুরছিল। তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায় পেটের কাছে বাঁধা ছোট এক রেডিও, হাতঘড়ির সাইজ, পেটে বাঁধা ছিল যেহেতু তাই পেটঘড়ি বলা যায়। এর মাধ্যমে সেনাদের গতিবিধির খবর পাঠাচ্ছিল জর্মন দেশে। বুঝেন অবস্থা!
তালাশ মাহমুদ সামান্য হাসলেন খান সাহেবের স্পাই ধরা পড়ার গল্পে।
খান সাহেব এক পর্যায়ে ভিন্ন পথে চলে গেলেন বিদায় জানিয়ে। তালাশ মাহমুদ একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে চললেন তার গন্তব্যের পানে।
চিঠিটার বিষয়বস্তু তাকে চিন্তিত করেছে।
তার বড় ভাই আশরাফ আলী খান লিখেছেন, চিঠি পাওয়ামাত্র অতি দ্রুত চলে আসিবে। হাসনাহেনার সাথে আবার সেই ঝামেলা শুরু হয়েছে।
হার্মিস কিছুক্ষণ পররপরই ঘেউ ঘেউ করছে, এ এক অশুভ সংকেত।
তালাশ মাহমুদ ভাবতে থাকলেন কুকুরের ডাক নিয়ে। কুকুরের বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন ধরণের ডাকের অর্থ তিনি বুঝতে পারেন বলে তার মনে হয়।
ছোটবেলা থেকেই রাতে ঘুমানোর সময় দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাক শুনতে তার ভালো লাগে। যেন অশরীরী এক দুনিয়া থেকে সেই ডাক ভেসে আসে।
এখন হার্মিস যেভাবে ডাকছে, তালাশ মাহমুদ অনুভব করছেন এর মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা। সামনে কি তাহলে কোন বিপদ ওঁত পেতে আছে? কী আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছে হার্মিস?
তালাশ মাহমুদ গাড়িতে বসে তার ব্যাগ থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত এক মাসিক পত্রিকা বের করলেন। নতুন যুগ নামের এই পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়, থিওসফিস্ট সোসাইটির সাথে যুক্ত অনেকে এখানে লেখালেখি করেন।
থিওসফিস্ট সোসাইটির কাজকর্মে তালাশ মাহমুদের আগ্রহ নেই। তিনি অবিশ্বাসের চোখেই তাদের দেখেন। কিন্তু এই পত্রিকাটি সংগ্রহ করেছিলেন মোহিনী মোহন চ্যাটার্জির পুরনো এক লেখা এখানে আছে সেজন্য। লেখাটি ইংরাজিতে প্রথম প্রকাশ পায় ১৮৮৩ সালে। কয়েক বছর আগে মোহিনী মোহন মারা গেছেন লন্ডনে। অবশ্য তার অনেক আগেই মাদাম ব্লাভাটস্কির এই "প্রিয় ছেলে" থিওসফিস্টদের সংঘ ছেড়েছিলেন। তার ইংরাজি লেখাটির বঙ্গানুবাদ ছাপা হয়েছে, "হিমালয়ের ভ্রাতৃবৃন্দঃ তারা কি সত্যিই এখনো আছেন?" নামে। দ্য গ্রেট হোয়াইট ব্রাদারহুড নিয়ে লেখা, থিওসফিস্টদের ধারণায় এরা হলেন মানবজাতির মহাশিক্ষক, এরা অমরত্ব অর্জন করেছেন, তিব্বতে থাকেন, এবং মানবজাতিকে পর্যবেক্ষণ করছেন। মোহিনী মোহন এই লেখায় লিখেছেন, এমন এক মহাত্মার সাথে তার দেখা হয়েছিল।
তালাশ মাহমুদের আগ্রহ ছিল তিনি কীভাবে হোয়াইট ব্রাদারহুডের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন সেটা দেখা। পড়ে রীতিমত বিরক্ত হলেন।
তালাশ মাহমুদ দেখলেন সেই পত্রিকাতে 'ম্যাডাম' নামে খ্যাতি পাওয়া মহিলাটির স্বাক্ষাতকার আছে।
মহিলা বিস্তর কথা বলে।
এর নাম চানতারা বানু। বয়স চল্লিশের মতন। তার নাকি অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে।
তালাশ মাহমুদ কয়েক বছর আগে থেকেই তার ব্যাপারে অল্প কথাবার্তা শুনছিলেন। কিন্তু গতবছর মহিলার সাথে তার সরাসরি সাক্ষাত, বা বলা ভালো সংঘর্ষের সূত্রপাত।
তালাশ মাহমুদ রহস্য ইনভেস্টিগেশন করেন। যেকোন রকম রহস্য তাকে টানে। কেবল ক্রাইম সম্পর্কিত ঘটনা না, দেখা যায় অতিপ্রাকৃতিক কোন রহস্যে বা প্রাচীন প্রত্মসম্পদ অনুসন্ধানে তিনি প্রায়ই ব্যস্ত হয়ে যান। নিজের কাজ নিয়ে লেখালেখির সূত্রে তার পরিচিতি তৈরি হয়েছে। সব কিছুকে যুক্তি দিয়ে দেখার মনোভাব তার প্রবল। পত্রিকায় লেখার জনপ্রিয়তাসূত্রে পুলিশেরাও বিভিন্ন মামলার রহস্য সমাধানে একজন সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট হিসেবে তার পরামর্শ নিয়ে থাকেন।
বেশীরভাগ মামলাতেই তিনি তাদের গুরুত্বপূর্ণ ইনসাইট দিয়ে সহায়তা করেছেন। কিন্তু বইয়ের গোয়েন্দাদের মত প্রত্যেকটি রহস্যের সমাধান দিতে পারেন নি। কারণ, বাস্তবের ক্রাইমে অনেক সময় কোন তথ্য বা চিহ্ন থাকে না যা ধরে আগানো যায়। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক দেরীতে পুলিশ যোগাযোগ করেছে, এর মধ্যে সব চিহ্ন নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রায় দুই বছর আগে ঢাকা শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বালক ছেলে নিখোঁজ হয়। তালাশ মাহমুদ তখন শহরে ছিলেন না। একজন গবেষক কিং সলোমনের গুপ্তধন অনুসন্ধান করছিলেন তিউনিশিয়ায়, নানা প্রাচীন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি বের করেছিলেন, রাজা সলোমনের গুপ্তধনের সম্ভাব্য স্থান বর্তমান তিউনিশিয়া। তিনি একটি সম্ভাব্য মানচিত্রও বের করেছিলেন। এই সলোমন, ওল্ড টেস্টামেন্টের কিং সলোমন, মহাপ্রতাপশালী, মহাজ্ঞানী রাজা। ইসলাম ধর্মে যিনি নবী হযরত সুলাইমান (আঃ)।
একটা আর্কিওলজি ম্যাগাজিনে লেখার সূত্রে ভদ্রলোকের সাথে তালাশ মাহমুদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। ভদ্রলোক যখন অভিযানে গেলেন তখন তালাশ মাহমুদকে সাথে নিয়ে যান।
প্রায় বছরব্যাপী সে অভিযান চলে। অনেক চেষ্টা করেও গুপ্তধনের হদিস মেলে নি। পরে তালাশ মাহমুদ জানতে পারলেন, জেরুজালেমে কিছু বয়স্ক লোকেরা আছে, উন্মাদের মত বেশভূষা ধরে থাকে, এরা প্রায়ই নবী সুলাইমানের গুপ্তধনের মানচিত্র বিক্রি করে।
তাদের বেচার ভঙ্গি ও গোপনীয়তা দেখলে বুঝার উপায় নেই তারা ভুল মানচিত্র বিক্রি করছে। গুপ্তধনের অনুসন্ধান শেষ হলে তালাশ মাহমুদ পবিত্র ভূমি জেরুজালেম ঘুরে এসেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর ইতিহাস হলো জেরুজালেমের ইতিহাস।
তিনি সেখানে খুঁজে খুঁজে সেই উন্মাদ ধরণের একজন বুড়ো লোককে বের করেন, এবং অবিশ্বাসের সাথে তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে একটি মানচিত্র কিনে এনেছেন। যুক্তির মানুষ হলেও, যখন তিনি দেখলেন এই মানচিত্রে ভারত তথা পূর্ববঙ্গের দিকে ইংগিত করা হয়েছে, তখন আর কৌতূহল ধরে রাখতে পারেন নি।
পরে অবশ্য এটাও তার মনে হয়েছে, হয়ত লোকটা আগেই জেনে গিয়েছিল তিনি বাংলা থেকে গেছেন, এবং তাই সেই ভাবেই ম্যাপ তৈরি করেছে!
যাইহোক, তালাশ মাহমুদ বাইরে থাকার এই সময়টাতেই ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বালক ছেলে নিখোঁজ হয়।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তাকে পাওয়া যায় নি।
বছর খানেক পরে তালাশ মাহমুদ ফিরে এলে পুলিশের পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়।
তিনি ঘটনাটি বুঝতে পুলিশ অফিসারের সাথে ঐ পরিবারের বিশাল বাড়িতে যেদিন গেলেন, সেখানেই দেখতে পান ম্যাডামকে।
ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে পুলিশ অফিসার রাম কানাই দাস বলেছিলেন, ইনি হচ্ছেন ম্যাডাম। একজন সাইকিক। আমাদেরকে সাহায্য করছেন। এনার ব্যাপারে পড়েছেন নিশ্চয়ই। বিহারে ছিলেন এনার পূর্বপুরুষেরা।
তালাশ মাহমুদ দেখলেন মহিলার চারপাশে ঘিরে বসে আছেন কয়েকজন। তারা আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছেন মহিলার। মহিলা খুব ধীরে ধীরে হাত নেড়ে কী যেন বুঝাচ্ছিলেন। ভদ্রমহিলার ধারালো নাক তালাশ মাহমুদের দৃষ্টি এড়াল না।
তালাশ মাহমুদ বিরক্ত হলেন। এই সাইকিকের ব্যাপারে পত্রিকাতে লেখালেখি হচ্ছে, রেডিওতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। নানা ধরণের গুজব তাকে নিয়ে। সে নাকি মৃত মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। মৃতরা স্বপ্নে এসে তাকে দৃশ্য দেখায়, বলে যায় কে তাকে মেরেছে, কোথায় মেরেছে। বকোয়াজ কথাবার্তা সব।
বিরক্তির প্রভাবেই সাইকিকদের ভাঁওতাবাজি এবং অযৌক্তিকতা নিয়ে এক প্রবন্ধ লেখেন তালাশ মাহমুদ। কলকাতার পত্রিকাতে ছাপা হয়।
ছেলেটার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কিছু খোঁজখবর করলেন তালাশ মাহমুদ, তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এতদিন আগের ঘটনা তাই তেমন কিছু মিলল না। ছেলেটা মারা গেছে না বেঁচে আছে তাও বুঝার উপায় নেই।
একটা সূত্র ছিল, বাড়ির একজন চাকরও নিখোঁজ। কিন্তু, সে ছেলেটাকে নিয়ে গেলে তার মোটিভ কী? সে কোন মুক্তিপণ দাবী করে নি।
তালাশ মাহমুদ মোটিভ ও নিখোঁজ চাকরটিকে লক্ষ্যে রেখে যখন তদন্ত একটা করে দেখবেন ভাবছিলেন, তখনই পত্রিকায় খবর এলো, ঐ পরিবারের বাসার পেছনে বাগানের মধ্যে ছেলেটির কবর মিলেছে, একটি তেঁতুল গাছের নিচে।
পত্রিকায় ম্যাডামের জয় জয়কার।
ম্যাডাম নাকি বলেছিলেন, স্বপ্নে ঝাপসা ভাবে দেখেছেন, ছেলেটি তাকে হাত নেড়ে ডাকছে, একটা গাছের নিচে বসে।
পত্রিকাতে এও উল্লেখ করা হয়, রহস্য বিশেষজ্ঞ তালাশ মাহমুদ যা পারেন নি, ম্যাডাম তা পেরেছেন।
ম্যাডামকে তালাশ মাহমুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হল। এটা পত্রিকাওলাদের ট্রিক, প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে পারলে একটা উত্তেজনা আসে, জনগণের সেই নিউজে বেশি আগ্রহ জন্মায়।
ম্যাডামের কয়েকটা ছোট স্বাক্ষাতকার পর পর প্রকাশ পেল। সেখানে ভদ্রমহিলা পরোক্ষভাবে তালাশ মাহমুদকে আক্রমণও করলেন।
বললেন, কিছু মানুষ কেবল দুনিয়ার জ্ঞানে বিশ্বাস করে। গায়েবে তাদের অবিশ্বাস। এদের জন্য আমার খারাপ লাগে। জ্ঞান থাকলেও এরা অন্ধ। এমন অন্ধরা আমার কাজ বুঝবে না।
এই কেইসের পর থেকে, বিশেষত পত্রিকাগুলি যেভাবে উপস্থাপন করেছিল, তালাশ মাহমুদকে হারিয়ে দেবার পরে ম্যাডামের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেল। তিনি এই কেইস সামাধা করছেন, ঐ কেইসে ক্লু দিচ্ছেন, এসব নিউজ নিয়মিত বিরতিতে ছাপা হতে লাগল।
শোনা যেতে থাকল ইংরাজ সরকারের বড় বড় অফিসার নাকি মহিলার বাসায় যাতায়াত করেন। এও গুজব রটল একবার, কবি কাজী নজরুল নাকি ম্যাডামের সাথে এসে দেখা করে গেছেন, তিনি তার গুণে মুগ্ধ হয়ে তার নাম দিয়েছেন নির্মলা।
ক্রমশ...