হ্যারি পটারের ফ্যান নিজে কোন দিন ছিলাম না। পটারের যখন স্বর্ণযুগ তখন আমি ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করি, কিন্তু তা সত্ত্বেও হ্যারি-র ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিলাম যেখন কিনা ইউনিভার্সিটির বন্ধু/বান্ধবীরা রাত জেগে দোকানের সামনে চ্যাটাই বিছিয়ে লাইন দিচ্ছে বই রিলিজের আগে! সেই আমি কোন দিন ভাবতে পারি নি যে কালের চক্রে আমাকে একদিন ‘হ্যারি-পটার’-র খোঁজে লন্ডনে এদিক ওদিকে ঘুরতে হবে! বাই দি ওয়ে, এই যে ‘হ্যারি-পটার ট্রেল’ এটা নতুন কিছু নয়। হ্যারি পটার ফ্র্যানচাইজ গোটা পৃথিবী জুড়ে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাষ্ট্রি। তো সেই ফ্র্যানচাইজের ডাইরেক্ট পার্ট না হলেও, কিছু লোকাল লোক করে খাচ্ছে এই হ্যারি পটার ওয়াকিং ট্যুর করিয়ে।
হয়েছে কি, গত বছর শেষের দিকে হঠাৎ করে একবার লন্ডন যেতে হয়েছিল কয়েকদিনের জন্য, সাথে ছিল আমার ডাচ্ বন্ধু টম। হাতে সময় ছিল না একদম, কেবল একটা দিন খালি ছিল একটু। ইংল্যান্ডে অনেক দিন থাকার জন্য বহুবার ঘোরা এবং থাকা লন্ডনে, আলাদা করে আমার কিছু দেখার ছিল না। টম-কে জিজ্ঞেস করলাম, কি দেখতে চাস – তাই তোকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। আমি ভেবেছিলাম চেনা শুনা বিখ্যাত জায়গা গুলো দেখবে বলবে টম! ওমা, কোথায় কি! বলে কিনা হ্যারি পটার মিউজিয়াম (ওই যেটা স্টুডিও ট্যুর আর কি) দেখতে যাবে! আমি ঢোক গিললাম, কিন্তু আর পিছোতে পারছি না – কারণ কথা দিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু রাখে হরি মারে কে! হ্যারি পটার স্টুডিও ট্যুর-র ক্রেজ আজও প্রচন্ড – এবং ওরা প্রতিদিন লিমিটেড টিকিট রিলিজ করে। তাই অনেক আগে থেকে বুক না করা থাকলে এক নির্দিষ্ট দিনে পাবার চান্স কম, কেউ ক্যান্সেল করলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে। তো আমরা টিকিট পেলাম না। ভাবলাম বাঁচা গেল – কোথায় কি, টম বলল তাহলে পায়ে হেঁটে হ্যারি পটার ট্রেল করা যাক – মানে, লন্ডনের যেখানে যেখানে হ্যারি পটারের নানা সিনেমার শুটিং করা হয়েছিল সেগুলো ঘুরে দেখা আর কি। এর জন্য আপনি গাইড-ও নিতে পারেন। কিন্তু লন্ডনে গাইড নিয়ে ঘোরা আমার ধাতে সইবে না বলে টম-কে জানালাম হ্যারি পটারের কোথায় কি আমি কিচ্ছু জানি না। টম যদি নিজে ম্যাপে মার্ক করতে পারে জায়গা গুলো তা হলে আমি নিয়ে ঘুরিয়ে দেব।
তো সেই মত কথা হল – রাতের বেলা টম গুগুল ম্যাপে মার্ক করে দিল কোথায় কোথায় যেতে চায় সে। এবার আমি সেই ম্যাপ অনুযায়ী টম-কে নিয়ে বেরোলাম হ্যারির সন্ধানে। সাথের ছবি গুলো সেই দিনের তোলা। আচ্ছা এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক লন্ডনে শুধু ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর হ্যারি পটারের স্টুডিও যেখানে শুটিং হয়েছিল তাই শুধু নেই, লন্ডনেই আছে পটার সিনেমার বিখ্যাত এবং বলা যায় আইকনিক কিছু জায়গা/বিল্ডিং।
তার কতগুলো উদাহরণ হল, ডায়াগন অ্যালি, প্লাটফর্ম 9 ¾ , গ্রিংওটস্, মিনিষ্ট্রি অব ম্যাজিক এর দর্শনার্থীর প্রবেশ পথ, ফিনিক্সের অর্ডেনের সদর দফতর ইত্যাদি।
তবে বলাই বাহুল্য হ্যারি পটার সিনেমার লন্ডনে শ্যুট হওয়া জায়াগা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে কিংস্-ক্রস রেলওয়ে স্টেশন। প্রতি বছর যখন ছাত্ররা হোগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে স্কুলে যায় তাদের কিংস ক্রস-এ প্লাটফর্ম 9 ¾ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। বলাই বাহুল্য 9 ¾ নাম্বারে কোন প্লাটফর্ম নেই। আসল সিনেমার শ্যুট হয়েছিল প্লাটফর্ম ৪ এবং ৫ এ। আমরা সকাল সকাল হোটেল থেকে ব্রেকফাষ্ট করে কিংস-ক্রস স্টেশন দিয়েই শুরু করলাম হ্যারি পটার খোঁজা।
আপনিও যদি যেতে চান আর সেই হ্যারির লাগেজ কাটের সাথে ছবি তুলতে চান, তাহলে সকাল সকাল চলে যাবেন। তবে যত আগেই যান গিয়ে দেখবেন আরো লোক সেখানে ওয়েট করছে। কি না, একটা লাগেজ-কার্ট যেটা করে হ্যারি-রা বাক্স বয়ে রেলের কামড়ায় উঠত, সেটা এক দেওয়ালের গায়ে লাগানো আছে (সাথের ছবি দেখে নিন)। পুরো ঢপবাজি – ২০০ টাকা খরচ করে একটা দেওয়ালের গায়ে কার্ট বসিয়ে দিনের পর দিন লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে! এই কার্টের সাথে ছবি তুলতে কোন টিকিট নেই, তবে লম্বা লাইন আছে! টম-কে অনেক বোঝালাম যে এই বুড়ো বয়েসে আর লাইন দিয়ে হ্যারি-র ছবি তোলা মানায় না। নিজেদের ছবি না তুলে আমরা পাশের শ্যুভেনিয়র শপে ঢুকলাম – আসল বিজনেস এখানে। চীনে তৈরী হ্যারির প্রপস্ পাউন্ডে বিক্রি হচ্ছে দেদার – পাবলিকে লাইন দিয়ে কিনছে! টম গাদা খানেক জিনিস কিনল – সেই ম্যাজিক ওয়ান্ড থেকে শুরু করে, টিশার্ট। আমিও কিছু কিছু কিনলাম! – কি আর করা – পয়সা নষ্ট ওকেই বলে!
এই কিংস-ক্রসের পাশেই সেন্ট প্যানক্রাস রেলস্টেশন। “হ্যারি পটার এবং চেম্বার অফ সিক্রেটস” সিনেমায় হ্যারি এবং রনকে এই সেন্ট প্যানক্রাস থেকেই হোগওয়ার্টসের উদ্দেশ্যে উড়ে যেতে দেখবেন, যখন ওরা একবার ট্রেন মিস করেছিল স্টেশন থেকে।
এই জায়গা থেকে মিনিট ২০ হেঁটে গেলেই আপনি পোঁছে যাবেন ক্লারমন্ট স্কোয়ারে। হ্যারি পটার এবং ফিনিক্সের অর্ডেনে এই ক্লারমন্ট স্কোয়ারের বাড়িগুলি গ্রিমমল্ড প্লেস 12 এ অর্ডেনের সদর দফতর হিসাবে শ্যুট করা হয়েছিল। কিস্যু নেই এই বাড়ি গুলোয় আলাদা করে দেখার মত। এমন বাড়ি এবং স্ট্রীট হাজার হাজার আছে লন্ডনে। কিন্তু কে কাকে বোঝায়! নানা অ্যাঙ্গেল থেকে টম ছবি তুলতে লাগলো, আমি হাসি হাসি মুখে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি এই আরেকটা দল ওই ওয়াকিং ট্যুরে বের হয়ে এসেছে সেই বাড়ির সামনে – এরাও বয়েসে দামড়া। দেখে আমার মনের ক্ষত একটু জুড়ালো এই ভেবে যে আমরাই কেবল মাত্র পাগল নয়! সেই দলের উচ্চারণ শুনে যা বুঝলুম, গোটা কতক ফ্রেঞ্চ এবং কয়েকটা পোলিশ ছেলে মেয়ে ছিল। আমাকে একজন জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে? জানালাম – দূর্দান্ত! আবার প্রশ্ন, “কি কি দেখলে?”। আমি বললাম – “সব দেখছি, যা যা আছে বইতে! আর সবই ফ্যাসিনেটিং!” শুধু শুধু অন্য লোকের দিন খারাপ করি কেন!
এবার যাওয়া হল লেডেনহল মার্কেট-এ, যেটাকে আপনারা সিনেমার ডায়াগন অ্যালি হিসাবে চিনবেন। এই মার্কেটটা এক ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের স্থাপত্যে তৈরী, মাথা ঢাকা এক মার্কেট। হ্যারি পটারের প্রথম সিনেমাতে এই মার্কেটে হ্যারি কিছু স্কুলের জিনিস কিনতে গিয়েছিল। এবং তখন এই মার্কেটের পিছন দিকে এক পাবের সামনে আসে যার নাম ‘দি লিকি ক্যালড্রন’ এবং এর মধ্যে দিয়েই গোপন রাস্তা আছে ডায়াগন অ্যালিতে ঢোকার। হ্যারি পটার এবং ফিলোসফারস স্টোন সিনেমার জন্য জন্য লিডেনহাল মার্কেটের বুল’স হেড প্যাসেজ এর একটি চশমার দোকানকে লিকি ক্যালড্রনের প্রবেশপথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এর থেকে কিছু দূরে হেঁটে গেলে আপনি পেয়ে যাবেন সেই মিলেনিয়াম ব্রীজ। এই সেই ব্রীজ যা হ্যারি পটার এবং হাফ-ব্লাড প্রিন্সের শুরুতে ডেথ-ইটার দ্বারা ধ্বংস হয়। বাস্তবিকে প্রচুর পদচারীর চাপে এই ব্রীজ নাকি মাঝে বন্ধ রাখতে হয়েছিল কিছুদিন। তবে আমরা যাখন গিয়েছিলাম তখন তো ওটা খোলাই ছিল – একটু হাঁটা হাঁটি করে নিলাম ব্রীজের উপর দিয়ে নদীর ওপাড় থেকে এপাড়ে। টম যথারীতি প্রচুর ছবি তুলল।
সেখান থেকে যাওয়া হল টাওয়ার ব্রীজে - লন্ডনের সেই আইকনিক টাওয়ার ব্রীজও ব্যবহার করা হয়েছিল হ্যারি পটার এবং ফিনিক্সের অর্ডারে, যেখানে দেখা যায় হ্যারি এবং কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ তাদের ঝাড়ু নিয়ে থেমসের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ছবি ছাবা তুলে, টাওয়ার ব্রীজ দেখা যায় এমন ভিউ সহ এক রেষ্টুরান্টে লাঞ্চ সেরে নিলাম। আমি হ্যারি পটারের সিনেমা দেখলেও, নাম-ধাম কিছু মনে রাখতে পারি না। এখন যা লিখছি তার বেশির ভাগটাই টমের কাছ থেকে শোনা এবং পরে ভুলে যাওয়া অংশ গুলো ইন্টারনেট থেকে যাচাই করে নেওয়া। তো টাওয়ার ব্রীজ দেখে আমারও হিন্দী সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। শুধু টম-ই আমায় কেন সিনেমার গল্প শোনায়, আমিও উলটে টম্-কে বললাম, ‘বুঝলে এই টাওয়ার ব্রীজে আমাদের বলিউডের অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে”। কোন সিনেমা জানতে চাইলে যথারীতি বলতে পারলাম না – শুধু বললাম, “শাহরুখ তো কোন একটা সিনেমার শুটিং করেছিল বটেই এখানে”। টম জিজ্ঞাসিলো, “হুজ মুভি”? বললাম, “শাহরুখ খান – ওই যে টম্ ক্রুজের বন্ধু”!
লাঞ্চ-টাঞ্চ করে ভরা পেটে রওনা দিলাম অষ্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের উদ্দেশ্যে। উইজার্ডিং ব্যাংক গ্রিংওটসের দৃশ্য শ্যুট করা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান হাউস/অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের ভিতরে। কিন্তু আমাদের তো আর ওখানে ঢুকতে দেবে না, তাই বাইরে থেকে ছবি তুলেই ক্ষান্তি দিল টম্।
সেখান থেকে স্কটল্যান্ড প্লেসের সামনে গেলাম। মিনিস্ট্রি অব্ ম্যাজিক-এর ভিতরে যাবার একটা প্রবেশ পথ যা দেখানো হয়েছে সিনেমায় তা শ্যুট করা হয়েছিল গ্রেট স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড / স্কটল্যান্ড প্লেসের সামনে। ওয়েসলি আর পটার এটা ব্যবহার করেছিল “হ্যারি পটার এবং হাফ-ব্লাড প্রিন্স” সিনেমায়। তবে সিনেমায় যে ভাঙা লাল ফোনের বাক্সটি দেখিয়েছে তা বাস্তবে নেই। ওটা যাষ্ট সিনেমার একটা প্রপ। এই রাস্তার ধারে পাশে কেউ নেই, ট্রাফিকও খুব কম। তাই টম্ মনের সুখে ছবি তুলল।
এবং একই ভাবে সিনেমায় এসেছে পিকাডেলি সার্কাস। বলাই বাহুল্য এটা লন্ডনের এক অন্যতম বিখ্যাত চত্ত্বর।
“হ্যারি পটার এবং ডেথলি হ্যালোস পার্ট -১” এ শ্যুটিং হয়েছিল সেই দৃশ্যর যখন হ্যারি, রন এবং হেরমিন কেটে পড়েছিল বিল এবং ফ্লুয়ার্স বিয়ে থেকে। পিক্যাডিলি সার্কাসের আশেপাশে একটি ক্যাফেতে কফি পান করার সময় তাদের উপর দু'জন ‘ডেথ-ইটার’ রা আক্রমণ করেছিল। বিকেল তিনটের সময় আবার আমাদের কফি পানের সময় – তাই একটা পুরানো টাইপের দেখতে ক্যাফেতে ঢুকে পরলাম দুজনে। কে জানে এখানেও হ্যারি এসেছিল নাকি! বেশ সময় নিয়ে এসপ্রেসো পান করলাম, সাথে পেষ্ট্রী হালকা। আবার এনার্জী জমা হল শরীরে।
হাঁটা শুরু করলাম রাস্তায় – সিনেমায় যেটা হয়, লন্ডনে শুটিং করব আর ওয়েষ্টমিনষ্টার ব্রীজ, ওয়েষ্টমিনষ্টার প্রাসাদ এই সব দেখাবো না তা হয় নাকি! লন্ডনের এই দুই আইকনিক জায়গাও দেখা যায় “হ্যারি পটার এবং ফিনিক্সের অর্ডেন” সিনেমায় যখন হ্যারি এবং অর্ডেনের কিছু সদস্য তাদের ঝাড়ুতে চেপে লন্ডন পাক মারছিল। তো সেই সব দেখলাম – আশে পাশের লন্ডন আই একটু ঘুরে দেখেনিলাম। আমাদের হোটেলটা ছিল ঠিক ওয়েষ্টমিনষ্টার ব্রীজের পাশেই।
দিন প্রায় শেষ হয়ে এল – টম বলল, তাহলে শেষ ভিজিট ওই MI-6 বিল্ডিংটা হয়ে যাবে নাকি? আমি বললাম, হ্যারি পটারের সাথে জেমস বন্ড মেশানো মনে হয় ঠিক হবে না। ওটা পরের বারের জন্য তোলা থাক!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।