এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • চৌখাম্বার চত্বরে - ১

    সুদীপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ৯৮০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • “অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ…”

    উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল থেকে শুরু করে শঙ্কু মহারাজ বা তারও পরে শতসহস্র হিমালয়প্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের অতিব্যবহারে কালিদাসের কুমারসম্ভবের প্রথম সর্গ-র এই প্রথম বাক্যটি যতই ক্লিশে হয়ে যাক (হয়েছে কি আদৌ?), গাড়োয়াল হিমালয়ের বিস্তীর্ণতা, দুর্গমতা আর উচ্চতা তাকে মনে করাবেই! রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অগস্ত্যমুনির দিকে গাড়ি এগনোর সাথে সাথেই চারপাশের পাহাড়গুলো কেমন হঠাৎ ক’রে উঁচু হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলছিল, ঘিরে ফেলছিল পাঁচিলের মত, বাঁক নেওয়ার মুহূর্তে  মনে হচ্ছিল এরপর আর রাস্তা আছে তো? অলকানন্দার বাঁদিক ধরে চলতে চলতে অগস্ত্যমুনি পৌঁছনোর একটু আগে গাড়ির কাঁচে হঠাৎ একঝলক দুধসাদা পাহাড়ের অংশ, একেবারেই হতবাক করে দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল। মেঘ বলে ভুল করার কোনো উপায় নেই, চারটে কোণ আর শিখরদেশের ট্রাপিজিয়ামের আকৃতিতে ওই এক ঝলকেই চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছে সে নিজেকে; হ্যাঁ, চৌখাম্বা দর্শন দিয়েই তাহলে এ’যাত্রার শুরু; তখনো জানিনা, এরপর এ-যাত্রা যেখানেই যাই আকাশের গায়ে চৌখাম্বা লেগে থাকবে সফেদ-শুভ্র শিখরশ্রেণীর কিরীটে কোহিনূর-এর মতো! কিন্তু ওই একবারই, অগস্ত্যমুনির কাছে এসে বাঁদিকে কেদারের গিরিশ্রেণী দৃশ্যমান হলেও সামনের উঁচু পাহাড়-প্রাচীরে চৌখাম্বা আবার অদৃশ্য উখিমঠের কাছাকাছি আসা পর্যন্ত। পাহাড় কিভাবে প্রাচীর হয়ে তার ভয়ঙ্কর সুন্দর চেহারা নিয়ে দিগবিদিক জুড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, গাড়োয়ালের হিমালয় তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ!
     
    শুরুর গল্পে ফিরি। ছুটির সমস্যায় এবার দুজনেই (আমি আর প্রার্থনা) ভেবেছিলাম পুজোর ছুটিকে কিছুটা কাজে লাগাতেই হবে। নবমী-দশমী ছুটির দিন হলেও সপ্তাহের শুরু, সুতরাং নবমীতেই হোক যাত্রা শুরু। কিন্তু ট্রেনের টিকিট ততদিনে হাওয়া, তৎকালের চক্করে বসে থাকলে আর যাওয়া হয় না, আর দেশের ভেতরে ট্রাভেল এজেন্ট বা ট্যুর কোম্পানীর ঝামেলায় কোনোকালেই যাই না। গন্তব্য নিয়ে ঝামেলা নেই, গাড়োয়াল যাবো, তারপর ভাববো গাড়োয়ালের কোথায়। অতএব ভরসা আকাশপথ। সেখানেও টিকিটের দাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ! কলকাতা থেকে দেরাদুন, এটুকু দূরত্বের এত ভাড়া! অবশেষে এদিক ওদিক খুঁজে পেতে ছাড়ের কিছু ছাড়পত্র পেয়ে দাম কমতি হল, তবে পকেটের আগুন তাতে নেভে না মোটেই। আসা-যাওয়ার টিকিট হতেই এবার গন্তব্য ঠিক করার পালা। যেহেতু দুজনেই যাবো, এবারে ঠিক ছিল ছোটোখাটো ট্রেক করার। প্রথমে ভাবলাম কেদারনাথ গিয়ে বাসুকী তাল ঘুরে আসবো। কিন্তু ব্রহ্মকমলের সময়টা ততদিনে পেরিয়ে যাবে। তাহলে আর এক কেদারের দিকে যাওয়া যাক, তুঙ্গনাথ। তারিখ ইত্যাদি মিলিয়ে দেখা গেল, ভালোই দাঁড়াচ্ছে ব্যাপার। প্রথম দিনেই দেরাদুন থেকে চলে যাবো রুদ্রপ্রয়াগ, তারপর রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সারি গ্রাম, সেখান থেকে ট্রেক করে দেওরিয়া তাল। দেওরিয়া তাল থেকে ট্রেক করে রোহিনী বুগিয়াল হয়ে চোপতা; চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ, সেখান থেকে পরদিন চন্দ্রশিলা হয়ে আবার চোপতায় ফিরে আসা; চোপতা থেকে কনকচৌরি, সেখান থেকে আবার ট্রেক করে কার্তিকস্বামী ঘুরে এসে সটান হৃষীকেশ। ফলে ফেরার দিন বিশেষ ঝামেলা নেই, হৃষীকেশ থেকে দেরাদুনের জলি গ্র্যান্ট এয়ারপোর্ট আধঘন্টার রাস্তা। প্ল্যান ছকে ফেলা গেল। 

    ২৩ – যাত্রা শুরু, রুদ্রপ্রয়াগে রাত্রিবাস
    ২৪- রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সারি, সেখান থেকে ট্রেক করে দেওরিয়া তাল, দেওরিয়া তালে রাত্রিবাস
    ২৫ – দেওরিয়া তাল থেকে ট্রেক করে চোপতা, চোপতায় রাত্রিবাস
    ২৬ – চোপতা থেকে ট্রেক করে তুঙ্গনাথ, তুঙ্গনাথে রাত্রিবাস
    ২৭ – তুঙ্গনাথ থেকে ট্রেক করে চন্দ্রশিলা, পরে চোপতায় নেমে আসা, চোপতায় রাত্রিবাস
    ২৮ – চোপতা থেকে কনকচৌরি, কনকচৌরিতে রাত্রিবাস
    ২৯ – কনকচৌরি থেকে ট্রেক করে কার্তিকস্বামী ওঠা-নামা, পরে হৃষীকেশ, হৃষীকেশে রাত্রিবাস
    ৩০ – যাত্রা শেষ, ঘরে ফেরা

    ট্রেকের দূরত্ব, কতটা কঠিণ বা যাত্রাপথের দ্রষ্টব্য (যা যা আমরা দেখেছি) আবার বিশদে লিখবো।
    ঠিক হল, শুধু রুদ্রপ্রয়াগ আর হৃষীকেশে জি এম ভি এন এর গেস্ট হাউজে বুক করব, বাকি সব ‘ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’। কিন্তু পরে গাড়ি না পাওয়ার সমস্যায় কনকচৌরিতে শ্রীকার্তিকেয় প্যালেস নামের একটা হোটেলে ঘরের ব্যাবস্থা করতেই হল, আর হোটেলের মালিক সঞ্জয় নেগি ব্যবস্থা করে দিলেন গাড়ির, ওই একই গ্রামের পবন নেগি। সারিতে শুধু পৃথ্বী নেগির সাথে কথা হয়ে রইল গাইড-এর জন্যে, যেহেতু দেওরিয়া তাল থেকে চোপতা ট্রেক করব। বাকি খাওয়া-দাওয়া, থাকা সবই পথে পথে ঠিক হবে। এবার বসলাম মানচিত্র নিয়ে, অবশ্যই প্রাকৃতিক, যাতে একটু বিভিন্ন শিখরগুলো কারা কোন অবস্থানে আছে, কোথা থেকে কিভাবে দেখা যেতে পারে, সেসব কিছুট বুঝে নিতে। যদিও জানি, হিমালয় তার সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে দেবে কিনা সে হিমালয়-ই জানে। কারণ যদিও অক্টোবরের শেষ, চোপতা অঞ্চলের আবহাওয়া দেখাচ্ছে ওই ক’দিন শুধুই মেঘের ঘনঘটা। যাক, এবার অপেক্ষার পালা।
    “ইচ্ছে সম্যক ভ্রমণ গমনে…”
    ‘রক্তের দাগ’ গল্পে সত্যবতী কোনো এক বসন্তের দিনে ব্যোমকেশের কাছে আবদার করে বেড়িয়ে আসার জন্যে। উত্তরে ব্যোমকেশের এই কবিতা। আমরাও শারদপ্রাতে ঘোর নবমী তিথিতেই বেরিয়ে পড়লাম বিমানপোতের উদ্দেশ্যে। পুজোর সময় যেরকম ভিড় হয় শুনেছি, সে-তুলনায় এয়ারপোর্ট বেশ ফাঁকাই পাওয়া গেল। দেখাও পেলাম চন্দ্রবিন্দুর কলাকুশলীদের, একই সারিতে দাঁড়িয়ে ব্যাগ জমা করছেন চন্দ্রিল, উপল, অনিন্দ্য – নিশয়ই কোনো প্রবাসী পুজোর নবমী নিশির উদযাপন সার্থক করতে চলেছেন। বিমান আকাশে উঠেছে, মিনিট দশেক পরেই ঘোষণা, ‘আপনার জানলার ডানদিকে তাকিয়ে দেখুন, এভারেস্টের শিখরশ্রেণী’। আরে কি কান্ড, আমরা যে ডানদিকেই বসেছি, আর ঝকঝকে নীল আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট, মাকালু-র দুধসাদা শরীর ঝলসে উঠছে! এক বছর-ও হয়নি সান্দাকফু থেকে এদের দেখে এসেছি মন ভরে, আবার এভাবে দেখে ফেলব, কে জানত! আর তারপর পুরোটাই প্রায় হিমালয়, হিমালয় আর হিমালয়। ঘন্টা দেড়েক পর নামার সময় গঙ্গার দেখাও মিলল সরু ফিতের মতো। যাঁরা দেরাদুন যাবেন এবং এভারেস্ট ইত্যাদি দেখতে চাইবেন ফ্লাইট থেকে, ডানদিকে বসতেই হবে, সুতরাং সিট ম্যাপ দেখে আগে সিট বুক করে নেওয়াই ভালো।
     
    জানলার বাইরে এইসব সারাক্ষণ সঙ্গী 

     
    গঙ্গার অবয়ব - ২৫০০০ ফুট উপর থেকে 

     
    পবনের সাথে কথা বলাই ছিল, এয়ারপোর্টে নেমে জানাতেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে আমাদের তুলে নিল।  পবন যে এত বাচ্চা ছেলে আগে বুঝতে পারিনি,বয়স মাত্র ২৪ বেশ হাসিখুশী। ঠিক করাই ছিল যে যাওয়ার পথে হৃষীকেশে আমরা দাঁড়াবো না, দেবপ্রয়াগেই লাঞ্চ সেরে নেওয়া যাবে রাস্তার পাশে কোনো ধাবায়। দেরাদুন থেকে হৃষীকেশের রাস্তা বেশ চওড়া আর পরিচ্ছন্ন, আধঘন্টার কমেই গঙ্গার ধারে এসে পড়লাম, তারপর তপোবনের দিক দিয়ে এগিয়ে চললাম। লছমনঝুলা ছাড়িয়ে নদীর অপর পারে বিখ্যাত গরুড় চটি, ফুলবাড়ি চটি ছাড়িয়ে শিবপুরী হয়ে এগিয়ে চলি। জলধর সেন, উমাপ্রসাদের হিমালয়ের যাত্রাপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করি, কিন্তু সেসব পায়ে হাঁটা পথ কবেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে গাড়ি চলার পাকা রাস্তার আড়ালে, চটি-র প্রয়োজন-ও ফুরিয়েছে।  ধীরে ধীরে গঙ্গার গিরিখাত এতটাই  নীচে চলে গেল যে আর দেখাই যায় না। এখানে একটা কথা বলার, এই হৃষীকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ, প্রায় শ্রীনগর পর্যন্তই বলা চলে, রাস্তার অবস্থা জায়গায় জায়গায় ধ্বসের জন্যে বেশ খারাপ আর ধুলোভরা। গাড়ির জানলা প্রায় খোলাই যাচ্ছিল না। দেবপ্রয়াগের কিলোমিটার পাঁচেক আগে বেশ ফাঁকা দেখে নদীখাতের ধার ঘেঁষে একটা ছোটো দোকানে ডাল, রুটি আর পনীরের তরকারি খেয়ে আবার চলা শুরু।
     
    প্রচলিত যে,  দেব শর্মা নামে কোনো এক সন্ন্যাসী এখানে বিষ্ণুর আরাধনা করে বর পেয়েছিলেন যে এই স্থান তাঁর নামেই নামাঙ্কিত হবে, তাই দেবপ্রয়াগ। আবার রাবণ বধ করার পর ব্রহ্মহত্যার পাপস্খালন করতে রাম-ও নাকি বহু বছর এই দেবপ্রয়াগেই তপস্যা করেছিলেন। দেবপ্রয়াগে নীচে নামব না আগে থেকেই ঠিক ছিল, এবারে সময় হবে না। পবন আমাদের এনে দাঁড় করালো ঠিক যেখান থেকে নীচে তাকালেই দেখা যায় সঙ্গমের জলোচ্ছ্বাস। মূল রাস্তা থেকে দুই নদীর গিরিখাত বা সঙ্গম অনেকটাই নীচে। এখানে এসে একটু ধন্দ লাগলো! উমাপ্রসাদ লিখে গিয়েছেন “ভাগীরথীর চিরন্তন গেরুয়া বসন। অলকানন্দার স্বচ্ছ নীল জলধারা।“ কিন্তু এখানে চাক্ষুষ দেখছি বাঁদিক থেকে বয়ে আসা ভাগীরথীর জল একেবারে পান্না-সবুজ, আর ডানদিক থেকে নেমে আসা অলকানন্দা ধূসর-গেরুয়া (কাদাজলের ঘোলা রঙ - ঠিক যেমনটি গঙ্গার রঙ দেখি)। জানি না বর্ষার পরের অবস্থা বলে কিনা! তা বলে এমন উলট-পুরাণ! সঙ্গমে যে দুই প্রবাহ প্রবল জলোচ্ছ্বাস তৈরী করে হু হু করে মিশে যাচ্ছে, তা ঠিক নয়, বরং দুই নদী যেন হাত ধরাধরি করে বেশ কিছুদূর প্রবহমান। তারপর গঙ্গার চিরন্তন রূপ ও রঙে এক হয়ে বয়ে চলেছে সমতলের দিকে। জয় গোস্বামী যদি এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে দুই নদীকে দেখতেন, হৃদি-কে কোন জলে ভাসাতেন, ভাবতে গিয়ে ভেবলে গেলাম কিছুটা। কিন্তু দেবপ্রয়াগের বাড়িঘর, সঙ্গম, চারিদিকের পাহাড়ের সমাবেশ সুন্দর দৃশ্যকল্প নির্মাণ করে দিয়েছে। সঙ্গমের দিক থেকে যেন চোখ ফেরানো যায় না! কিন্তু থামার উপায় নেই, এখনো পথ বাকি অনেক। 
     
    দেবপ্রয়াগ - ১

     
    দেবপ্রয়াগ - ২

     
    এখান থেকে ভাগীরথীর ধার ধরে কিছুটা এগিয়ে পুল পার হয়ে এবার রাস্তা চলল অলকানন্দার বাঁদিক ধরে। দেবপ্রয়াগে রাস্তা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়, দুটি তার মধ্যে দু-ভাগ হয়ে ভিন্নপথে টেহরী-তে গিয়ে মেলে, ও-রাস্তা সোজা চলে যায় ধরাসু, উত্তরকাশীর দিকে। আমরা তিন নম্বর রাস্তা ধরে চলতে থাকি শ্রীনগরের দিকে। শ্রীনগর এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আর ব্যস্ত বাজার-দোকান ভরা জায়গা। আর এই পথে এইখানেই একমাত্র মাছ-মাংস-ডিম মেলে। তবে পরে দেখেছিলাম কনকচৌরিতেও মেলে। চোরা-গোপ্তা হয়ত সর্বত্র-ই সব মেলে, শুধু পবিত্র স্থানের নামে শাকাহারের ব্যবস্থা, ওই অবধিই। এমনকি তুঙ্গনাথে উঠেও – যাক, সেকথা যথাস্থানে। শ্রীনগরের যানজট আর ভিড়ভাট্টা পার হয়ে আবার চলি। পথে ধারিদেবীর মন্দির পড়বে বটে, আর তার অবস্থানের জন্যে দেখার ইচ্ছেও আছে, কিন্তু সে আসার সময়, এখন সোজা রুদ্রপ্রয়াগ।
     
    'হৃদি ভেসে গেলো অলকানন্দা জলে...' - উন্নয়নের খড়্গের নীচে তিস্তার মতোই এর অবস্থাও সঙ্গীণ! 

    “খুঁটির মধ্যে মাপ – সাত ফুট ছয় ইঞ্চি
    দেহের বক্রতা সুদ্ধ মাপ – সাত ফুট দশ ইঞ্চি
    রঙ – হালকা খড়ের মতো
    লোম – ছোট, শক্ত
    গোঁফ – ছিল না
    দাঁত – ক্ষয়প্রাপ্ত, বিবর্ণ, একটা বড় দাঁত ভাঙা
    জিভ এবং মুখের ভিতর – কালো
    ক্ষত – ডান কাঁধে তাজা গুলির আঘাত…”

    আশা করি এতক্ষণে পাঠক বুঝে গেছেন এখানে একটি জানোয়ারের কথা বলা হচ্ছে, এবং সেটি রুদ্রপ্রয়াগের কুখ্যাত নরখাদক চিতাবাঘের (লেপার্ড) মাপজোক আর বর্ণনা, ঠিক যেমনটি করবেট সাহেব বাঘটিকে মারার পর লিখে গেছেন। এই বাঘের শিকার ছিল প্রায় ১২৫ জন মানুষ (করবেটের মতে অবশ্য এর চেয়েও বিপজ্জনক ছিল পানারের মানুষখেকোটি, তার শিকার সংখ্যাও অনেক বেশী; কিন্তু কেদার-বদ্রী তীর্থযাত্রার মূল পথের উপর রুদ্রপ্রয়াগের চিতার দৌরাত্ম্য থাকায় এর খ্যাতি অনেক বেশী ছড়িয়ে পড়ে)। বই পড়েন এমন বাঙালী খুব কমই আছেন যিনি বাংলায় বা ইংরাজীতে এই গল্প পড়েন নি। ছোটবেলা থেকে এতবার এই শিকারের গল্প পড়েছি, যে যখন জীবনে প্রথম গাড়োয়াল আসব ঠিক করলাম, আর রুদ্রপ্রয়াগ যখন যাবোই, জায়গাটা দেখে আসতেই হবে, যেখানে করবেটের গুলি রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘকে ধরাশায়ী করেছিল। অবশ্য এখানে তার গুলিটা লেগেছিল, নাকি এখানে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল তা একটু ধোঁয়াশা, কারণ কাহিনী অনুযায়ী চিতাবাঘটা গুলি লাগার পর প্রায় পঞ্চাশ গজ এসে পড়ে গিয়েছিল। গুলাবরাই একটি ছোট্টো জনপদ, রুদ্রপ্রয়াগের প্রায় গা ঘেঁষে। পবন তো বটেই, এমনকি আশপাশের লোকজন বা ড্রাইভার-রাও করবেট বা রুদ্রপ্রয়াগের চিতার নাম শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে, আর আমি হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসে তাদের দেশের গল্পি তাদের শোনাবো, এ মানে এক অভিজ্ঞতা বটে। অগত্যা গুগল আর ম্যাপ ঘেঁটে নিজেই বার করলাম সেই জায়গা। একটা ছোটো দোতলা বাড়ী, দেখে বোঝার উপায় নেই, শুধু বাইরে বোর্ডে লেখা আছে জিম করবেট মেমোরিয়াল, সে বাড়ি নিয়ে আমি করবটা কি, যদি তা হয় তালা বন্ধ আর ভেতরে কিছুই না থাকে, কেউ-ই না থাকে! সে বাড়ি কোনো মিউজিয়াম-ও নয়, ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে। বাড়ির পিছনে একটা কোল্যাপসিবল গেট দিয়ে উপরে উঠে সেই ফলকের দেখা পাওয়া গেল। আশপাশে কংক্রিট আর কাঠের স্তূপ। নিতান্তই অবহেলায় এক পাশে সে আবক্ষ মূর্তি আর লেখার ফলক দাঁড়িয়ে আছে, লেখাও অর্ধেক উঠে গেছে অযত্নে। দেখে খারাপই লাগলো। করবেটের ভাস্কর্যটিও তথৈবচ। সে যা হোক, গল্প-বাস্তব-ইতিহাসের মেলবন্ধন যে হল এখানে এসে, তাকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। ছোটোবেলার শিকার-কাহিনীর করবেট আর তার চিতার সামনে এসে দাঁড়ানোর কথা তো আগে ভাবিনি, সেও তো এক পরম পাওয়া!
     
    করবেট মেমোরিয়াল এর প্রস্তরমূর্তি আর ফলক 

     
    পঞ্চপ্রয়াগের সঙ্গে বিষ্ণুর যোগ থাকলেও, এই রুদ্রপ্রয়াগের নামের উৎস শিবের রুদ্ররূপ। কথিত আছে পান্ডবরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ভ্রাতৃহত্যার পাপস্খালন করতে এখানে তপস্যা করেছিলেন, পরে এখান থেকেই নাকি শুরু হয়েছিল তাঁদের মহাপ্রস্থান পর্ব। গাড়োয়ালের সব রাস্তাঘাট, বনজঙ্গল, পাহাড়পর্বতে পান্ডবদের নানা গল্প মিশে আছে, স্থান-মাহাত্ম্যে কাহিনীগুলো মন্দ হয় না, যদিও এর সাথে প্রামাণ্য ইতিহাসের যোগ নেই। রুদ্রপ্রয়াগ এলাকাটি গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান স্বামী সচ্চিদানন্দ নামে এক জন্মান্ধ সাধুর। তিনি নাকি কলেজ, হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয় অনেক কিছু গড়ে তুলেছিলেন।  রুদ্রপ্রয়াগে আমাদের জি এম ভি এন-এর গেস্ট হাউজ বুক করাই ছিল। গেস্ট হাউসের ঘরগুলো অসাধারণ। না, অবশ্যই দেখভালের কথা বলছি না, সে খুব সুবিধের নয় তবে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সেই ঘরের ব্যালকনি-তেই সাত খুন মাফ হয়। গেস্ট হাউজটি উঁচু গিরিখাতের একেবারে ধারে, সুতরাং ব্যালকনিতে এলেই সরাসরি নীচে অলকনন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম, গঙ্গেশ্বর মহাদেবের মন্দির থেকে ধাপে ধাপে ঘাট এসে নেমে গেছে সঙ্গমে। আমরা যেদিকে রয়েছি সেদিন থেকে ধেয়ে আসছে অলকনন্দা তার ধূসর-গেরুয়া জলরাশি নিয়ে, আর ওপাশ থেকে মন্দাকিনী তার স্বচ্ছ নীল জলধারা নিয়ে আসছে, তারপর এক দেহে লীন হয়ে অলকানন্দার নামে জলধারা নেমে যাচ্ছে দেবপ্রয়াগের দিকে, সেখানে ভাগীরথী রয়েছে অপেক্ষায়। একটু দূরেই জলের মধ্যে জেগে আছে নারদ-শিলা। এই ব্যালকনিতে বসেই সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়! এখানে অবশ্য বেশ তর্জন-গর্জন দুই নদীর মিলে যাওয়ার। সারাক্ষণ ঘরে সেই শব্দব্রহ্ম বাজতে থাকে কানে। আর আশপাশের সুবিশাল পাহাড় তার সবুজের সমারোহে যেন যত্নে আগলে রেখেছে রুদ্রপ্রয়াগের এই এলাকাটি। 
     
    রুদ্রপ্রয়াগ - ১

     
    রুদ্রপ্রয়াগ - ২ 

     
    ব্যাগপত্র রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যে নামার আগে একবার সঙ্গম দেখে আসতে। ব্যস্ত বাজার এলাকা পার হয়ে এদিক ওদিক জিজ্ঞাসা করে নেমে এলাম সঙ্গমের ঘাটে, খানিকক্ষণ দুই নদীর মিলনের কলোচ্ছ্বাস দেখেশুনে ফিরে চললাম। এখানেও সন্ধ্যেবেলা ঘাটে আরতি হয় স্তোত্রোচ্চারণ-সহ। সেসব বেশ স্পষ্ট-ই দেখেশুনে নেওয়া গেল ঘরের ব্যালকনি থেকেই। তারপর পাহাড় জুড়ে আঁধার নেমে আসা, অপর পাড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়ির ইতিউতি আনাগোনা, সঙ্গমের ঘাট সুনসান হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে কখন যেন দিন শেষ হয়ে গেল; রাতের খাবার ব্যবস্থা গেস্ট হাউজেই, সেই রুটি-ডাল-সব্জি, গাড়োয়ালের খাওয়া-দাওয়া খুবই সাধারণ, পাকশৈলী-ও আহামরি কিছু নয়; কিন্তু স্থান-কাল বিশেষে তা-ই অমৃত, আর যদি তা গরম-গরম পাওয়া যায়, সে কথা পরে আরও ভালো বুঝেছিলাম। আগামীকাল সারি, দেওরিয়া তালের পথে যাত্রা। আমাদের ট্রেক শুরু। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ৯৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৩525569
  • দারুণ yes নীল আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আবহাওয়া খুবই ভাল ছিল। করবেটের ফলকটার কথা আগে জানতাম না। 
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:c5e4:bfd6:bab5:***:*** | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৩৪525570
  • নদীর ছবিগুলো খুব সুন্দর। লেখাও ভালো লাগছে। চলুক।
  • | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১৭525577
  • ওহ এই সিরিজটার অপেক্ষা করছিলাম। চলুক চলুক। রুদ্রপ্রয়াগের ছবিগুলো সবচেয়ে ভাল লাগল।
  • সুদীপ্ত | ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৫525622
  • ধন্যবাদ দীপাঞ্জন, হ্যাঁ আবহাওয়া ভালো ছিল, মানে আশা করিনি এতটা ভালো থাকবে, রেন-পঞ্চো ব্যবহার করতেই হয়নি কোথাও! করবেটের ফলকটা দেখতে পেলাম এটুকুই, ওটাও কোনদিন অলকানন্দায় ভাসিয়ে দেবে, বেচেও দিতে পারে... 
     
    ধন্যবাদ kk 
     
    থ্যাঙ্কু দ-দি, রুদ্রপ্রয়াগে ঘর থেকে বের হলে ভিড়, গাড়ি, বাজার, হৈ চৈ। একমাত্র সঙ্গমের কাছটা, বা পুলটা আর ঘরের ব্যালকনি, এটুকুই ভালো। আমরা অবশ্য খুব বেশী এক্সপ্লোর করিনি, ভবিষ্যতের জন্য পায়ে দম দিচ্ছিলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন