এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • চৌখাম্বার চত্বরে - ৩

    সুদীপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ৮২৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাই নি, স্লিপিং ব্যাগের আরামে ঠান্ডা সেভাবে বুঝতে পারছিলাম না, যদিও নাক বাইরে থাকায় সেটুকু প্রায় জমে যাওয়ার উপক্রম! হঠাৎ সরসর, খস খস আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। তাঁবুর বাইরে কোনো প্রাণী যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। ভালুক নয় তো! তাদের যা নখের ধার আর দৈর্ঘ্য, এই তাঁবু এক মিনিটেই ফালা ফালা হয়ে যাবে। প্রথমে আওয়াজটা ডানপাশে ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বাঁপাশে সরে গেল। দু-একবার গলায় জোরে আওয়াজ করতে হুড়মুড় করে কিছু একটা পালানোর শব্দ পেলাম। সাহস করে একবার টেন্টের চেন ফাঁক করে দেখি অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। আবার চেন টেনে দিলাম। ঘড়িতে দেখি চারটে। আর ঘন্টাখানেক ঝিঁঝিঁর ডাক, জঙ্গলের শব্দ এসব শুনেই কাটালাম, ঘুম এলো না। পাঁচটা বাজতে টেন্ট ছেড়ে বেরোলাম, পৃথ্বীও সবে উঠেছে। পূবের আকাশে আলো ফুটছে দেখে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা ধীরে ধীরে আবার তালের রাস্তা ধরলাম। পৃথ্বী আলুর পরোটা বানানোয় মন দিয়েছে। ওকে বলে গেলাম ওখানেই তালের কাছে আমরা মিলব আর ট্রেক শুরু করব চোপতার দিকে, ও যেন দুপুরের খাবার প্যাক করে নিয়ে চলে আসে।
     
    আকাশে আলো দেখা দিলেও এপাশে তখনো বেশ অন্ধকার, টর্চ নিয়েই চলতে হল শ-দুয়েক মিটার। তালের কাছে এসে দেখি ফাঁকা, কেউ নেই আর। অবশ্য মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটি পরিবার এসে পৌঁছলো, তারা আর একটু দূরে একটা ক্যাম্পে ছিল। আজ আকাশ একেবারে পরিষ্কার, মেঘ বা কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। আবছা আলোয় চৌখাম্বা থেকে কেদার সব শিখর বিরাজ করছে। এখান থেকে চৌখাম্বার সুবিশাল অবয়বটা অনেকটা নীচে পর্যন্ত দেখা যায়। তালের ওপাশে (যেদিক দিয়ে ঢকার রাস্তা তার ঠিক বিপরীতে) একটা ওয়াচ  টাওয়ার আছে, তবে কিছুটা নড়বড়ে, বেশীক্ষণ থাকার সাহস হল না। আধঘন্টা যেতে আলো বেশ ফুটে উঠলো, তবে তখনও সূর্যের আলো পাহাড়ের গায়ে লাগেনি। সাকুল্যে ১০ জন পর্যটক পুরো জায়গা জুড়ে, অতএব ভিড় নেই, তাড়াহুড়ো নেই, পাড়ে দাঁড়িয়ে দেওরিয়া তালের শান্ত রূপ দেখছি, পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই, তালের জল-ও একেবারে সুস্থির, মাছেরাও বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে।  প্রতিফলনেও অপর দিকে গাছপালার সঙ্গে চৌখাম্বা, কেদারের রূপ স্পষ্ট হচ্ছে।
     
    সূর্যোদয়ের আগে 

     
    চৌখাম্বায় প্রথম আলো 

     
    আমরা এগিয়ে গিয়ে সেই আয়তাকার ঘাটের মত বাঁধানো জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনের জলে সেই প্রতিফলনের ছবি সুস্পষ্ট! চৌখাম্বা, মন্দানি, সুমেরু, খর্চাকুন্ট আর কেদার – বাকি শৃঙ্গরা ঢাকা পড়েছে ওক, দেওদার, রডোডেনড্রনের বনানীর পেছনে, তার-ও ছায়া জলে। আমাদের দেখাদেখি আরও চার-পাঁচজন পর্যটক এসে জড়ো হন সেই জায়গায়। সকলেই আমরা নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে সেই স্নিগ্ধ ভোরের অলৌকিক দৃশ্যটুকু শরীর-মনের অলিন্দে পূর্ণ করে নিতে থাকি। তবু এই পূর্ণতার কি সীমা আছে! না শেষ আছে!
     
    “অসীম কালসাগরে ভুবন ভেসে চলেছে।
    অমৃতভবন কোথা আছে তাহা কে জানে।।
    হেরো আপন হৃদয়মাঝে ডুবিয়ে, একি শোভা!
    অমৃতময় দেবতা সতত
    বিরাজে এই মন্দিরে, এই সুধানিকেতনে।।“
     


    কিন্তু পরে যখন আর এই দৃশ্য এমন চাক্ষুষ দেখার উপায় থাকবে না, তখনকার জন্যেও কিছু ব্যবস্থা করে নিতে হয়, অতএব ক্যামেরায় বন্দী করে নিতে থাকি, যাতে সারাজীবন এই ছবি খুললেই এই ভোরের স্মৃতি অমলিন হয়ে ওঠে।  তালের পাশ দিয়ে আর একবার চক্কর কাটতে কাটতে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা লম্বা লেজওয়ালা ম্যাগপাই পাখির, অবাক হয়ে ছবি তুলতে না তুলতেই আরও খান-দুই ম্যাগপাই এসে তার সাথী হয়। পরে নেট ঘেঁটে জানতে পারি, এর নাম ইয়েলো-বিলড ব্লু ম্যাগপাই। যেটা অবাক লাগলো, এদের মূলতঃ কাশ্মীর বা হিমাচল অঞ্চলের হিমালয়ে পাওয়া যায়, তবে কি এরা পরিযায়ী হয়ে এ-পথে চলে এসেছে? যাক, চলতি পথে মাধুকরী যা মেলে তাই সম্পদ! দেড়-দু ফুটের লম্বা ল্যাজ নিয়ে ম্যাগপাই-দের ওড়াউড়ি দেখতে বেশ লাগে। কখনো গাছের ডালে, আবার কখনো মাটিতে নেমে পোকা-মাকড় খোঁজে। ওদিকে চৌখাম্বা, মন্দানি হয়ে রোদের পরশ লাগে কেদারের গিরিশ্রেণীতে, ছড়িয়ে পরে ওপাশেও যোগিন, বান্দরপুঞ্ছের দিকে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। এদিকে পৃথ্বী কখন জানি এসে পড়েছে পেছনে, আমাদের খুঁজে নিয়েছে। এবার সে তাড়া লাগায়, ঘড়িতে দেখি সাড়ে সাতটা, এবার চলা শুরু করতে হয়। চোখে-মুখে জল দিয়ে হালকা কিছু খাবার খেয়ে এবার আমরা দেওরিয়া তাল-কে বিদায় জানিয়ে চলা শুরু করি চোপতার পথে।
     
    ডানদিক থেকে ভার্তেকুন্ট , থালায়সাগর

     
    যোগিন ও গঙ্গোত্রী শিখরশ্রেণী

     
    বান্দরপুঞ্ছ

     
    ইয়েলো-বিলড ব্লু ম্যাগপাই

     
    দেওরিয়া তাল থেকে চোপতা ১৫ কিলোমিটার রাস্তা। তবে সেটা চোপতা যাওয়ার রাস্তায় তুলে দেওয়া পর্যন্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে সেই রাস্তা ধরে আরও দেড় কিলমিটার মত চলার পর চোপতার বাজার এলাকা, যেখান থেকে তুঙ্গনাথের পথ উঠে যায়। তো এই পরিমাণ রাস্তা আমাদের আট ঘন্টা মতো লাগবে চলতে। সাড়ে সাতটায় আমরা রওনা দিলাম। তালের পাশ দিয়ে পায়ে চলা রাস্তায় এগিয়ে এসে প্রথম পাঁচশো মিটার বেশ সবুজ ঘাসের গালিচায় হাঁটা, এখানে একটা বনদপ্তরের ছোট্টো গেস্ট হাউজ আছে, তার পাশ দিয়ে চলি। বাঁদিকে ধরে চৌখাম্বা আর তার সঙ্গী-সাথীরা লুকোচুরি খেলতে থাকে ঘন রডোডেনড্রনের আড়াল থেকে। এবার একটা প্রচন্ড চড়াই শুরু হল, যেটা গিয়ে একেবারে থামে ঝান্ডি টপ-এ (বা ঝান্ডি ধার)। এই ঝান্ডি টপ এই ট্রেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। দেওরিয়া তাল থেকে দূরত্ব প্রায় দু-আড়াই কিলোমিটার। তবে বেশ কিছু জায়গায় মনে হল, ভাগ্যিস এখান দিয়ে ফিরে যেতে অর্থাৎ নামতে হবে না ফের। এতটাই খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা   ঝান্ডি টপ থেকে ৩৬০ ডিগ্রী ভিউ পাওয়া যায় পুরো এলাকাটার। যদিও চৌখাম্বার দিকটা গাছের ভিড়ে কিছুটা অদৃশ্য। এখান থেকে সারি গ্রাম আর তার চারপাশ জুড়ে চাষবাসের এলাকার একটা ধারণা পাওয়া যায়। আর দেখে চমক লাগে ঠিক কতটা উপরে আমরা উঠে এসেছি; সকাল নটার আগেই এখানে পৌঁছে গেছি, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, চকোলেট ধ্বংস করে আবার চলা শুরু। এই ট্রেকে জলের সমস্যা আছে, শেষ চার-পাঁচ কিলোমিটার আগে আকাশ-কামিনীর ধারা ভরসা। তাই সঙ্গে জলের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরী।
     
    ঝান্ডি টপের দিকে 

     
    চড়াই ভাঙা 

     
    ঝান্ডি টপ থেকে - নীচে সারি গ্রাম 

     
    ঝান্ডি টপ থেকে বেশ কিছুটা নেমে আসার পর ঘন জঙ্গলের রাস্তা শুরু। দুপাশে ওক, দেওদার, রডোডেনড্রন আর বাঁশের ঝাড় ঘন হয়ে আছে, রীতিমতো গা ছমছমে রাস্তা। হঠাৎ খসখস শব্দ শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ি, নড়াচড়ার আওয়াজ, কোনো জানোয়ার আছে নিঃসন্দেহে। একটু এগোতেই চোখে পড়ে নীলচে ছাই রঙা অবয়ব, তবে ছোটো আকারের, একটু পাশ ফিরতেই দেখি দুটো ছোটো শূকর শাবক, কিন্তু তার পাশেই বেশ বড় চেহারার জংলী শুয়োর, মুখের দুপাশে লম্বা দাঁত বেরিয়ে রয়েছে। দুজনেই দাঁড়িয়ে যাই। বাচ্চা নিয়ে রয়েছে মানে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর জীব আর দুটি নেই এই মুহূর্তে। পেছন থেকে পৃথ্বী দৌড়ে আসে একটা কুড়িয়ে পাওয়া খেঁটে বাঁশের টুকরো হাতে। অদ্ভুত গলার আওয়াজ করে বাঁশের লাঠিটা দিয়ে গাছে, ঝোপে ঝাড়ে আওয়াজ করতেই ধুপ ধাপ শব্দে ওপাশ দিয়ে নেমে যায়। পৃথ্বী বলে, ওরা ওপাশে নেমে না গিয়ে আমাদের দিকেও সরাসরি ধেয়ে আসতে পারত! শুয়োরের মর্জি! বেশ কিছুক্ষণ মুখে জোরে আওয়াজ করে আর ট্রেকিং পোল, লাঠি দিয়ে ঝোপ ঝাড় পিটিয়ে শব্দ করে চলতে হল। এবার একটা খোলা বুগিয়ালে এসে পৌঁছোলাম, এর নাম খামি বুগিয়াল। উপর থেকে ঢাল হয়ে এসে নীচের দিকে নেমে গেছে। আর পুরো বুগিয়ালের অর্ধেক জুড়ে ছোটো ছোটো সাদা ফুল ভরা। পৃথ্বী বলে এই ফুলের ভেষজ গুণ আছে, কখনো নাকি শুকিয়ে যায় না। চোখে অবিশ্বাস দেখে পকেটে এক ঝাঁক গুঁজে দিয়ে বলে, কলকাতা ফিরে যেন মিলিয়ে দেখি।  এগিয়ে চলি রাস্তার পাকদন্ডী ধরে, কখনো কখনো গাছের বেড় এমন, মনে হয় যাওয়ার উপায় নেই, সেই গাছের মাঝখান দিয়েই আবার পথ বের হয়! পথ কখনো চড়াই, কখনো উৎরাই, আবার কখনো বুগিয়াল বা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সমতল। ঘন জঙ্গলে মহীরূহদের শাখা-প্রশাখার সাথে আকাশ লুকোচুরি খেলে, আলো-ছায়ার আলপনা রাস্তা জুড়ে। গাছের গায়ে কয়েক কিলোমিটার অন্তর চোপতার দিক-নির্দেশ, বুঝে নেওয়া যায় ঠিক পথেই চলেছি। এই পথে গাইড ছাড়া রাস্তা চলা অসম্ভব, শুধু পথনির্দেশ নয়, দুর্গমতার জন্যেও।
    এরপর শুরু হল আখরোটের বন। আখরোট মানে মনের মধ্যে একেবারেই ছিল কাশ্মীর বা মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু হিমালয়ের এই তরাই অঞ্চলে যে এমন বুনো আখরোটের গাছে ভরা থাকবে কে জানতো! আর শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে লাখে লাখে আখরোট হয়ে আছে সেসব গাছে। মনে হয় কেউ যেন যত্ন করে চাষ করেছে। মাটিতে অযত্নে পড়ে আছে কত যে আখরোট। পৃথ্বী তো সেসব দেখে আনন্দে আখরোট কুড়োতে লেগে গেল, একটা করে কুড়িয়ে আনে, পাথরে রেখে পাথর দিয়ে ভাঙ্গে, নিজে খায় আর আমাদের খাওয়ায়। এবার আসার সময় ড্রাই ফ্রুটস আনতে ভুলে গিয়েছিলাম, এখানেও বুঝি হিমালয় তার ঝুলি উপুড় করে দিল। গোল মতো সবুজ ফল, তার ভিতরের বীজ হল আখরোট আর খাওয়ার জিনিসটুকু সেই বীজের ভিতরে। ফল পেকে গেলে ফেটে ভিতর থেকে আখরোট বেরিয়ে আসে। এই অঞ্চলে পাখিদের পোয়াবারো! পৃথ্বী নয় নয় করেও অন্ততঃ গোটা ত্রিশেক আস্ত আখরোট ব্যাগে ভরে ফেললো এই রাস্তায়!
    আখরোটের বন পার হতেই আবার গাছে গাছে ঝুপ ঝাপ শব্দ! এবার দেখা লাঙ্গুর-এর, সোজা কথায় হনুমান। সে কত যে হনুমান ঠিক নেই, এ ডাল থেকে ও-ডালে ঝাঁপায়, কখনো দেখি মগডালে, জঙ্গলের একটা পুরো এলাকা জুড়ে শুধু তাদের সাম্রাজ্য! দ্রুতপায়ে সে জায়গা পার হয়ে আসি। চলতে চলতে শ্রান্ত পায়ে কখন যে আট কিলোমিটার পার করে ফেলেছি খেয়াল নেই। এবার এসে পৌঁছলাম রোহিণী বুগিয়ালে। বিরাট প্রশস্ত এলাকা জুড়ে এই বুগিয়াল, এখান থেকে একটা পথ চলে যায় চোপতার দিকে, আর একটা সোজা তুঙ্গনাথের দিকে। এখানে খানিক বিশ্রাম। পৃথ্বীর ছাঁদা বেঁধে আনা আলুর পরোটা আর আচার দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া গেল। যদিও ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবে খিদের মুখে তাই অমৃত! কিছু খাবার হিমালয়ের কতিপয় দাঁড়কাকের সঙ্গেও ভাগ করে নেওয়া হল। আর নিম্বুস তো সঙ্গে আছেই। হাত-পা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার এগোই। আরও প্রায় অর্ধেক রাস্তা বাকি!
     
    জঙ্গলের রাস্তা 

     
    খামি বুগিয়ালের ফুলে ভরা গালিচা

     
    রোহিণী বুগিয়াল 

     
    গাছের মধ্যে দিয়েই পথ 

     
    আখরোট তুলে দেখাচ্ছে পৃথ্বী 

    রোহিণী বুগিয়াল থেকেই সামনের পাহাড় থেকে কালো মেঘের নেমে আসা দেখা যাচ্ছিল। বুগিয়াল পার হতে না হতেই শুরু হলো বৃষ্টি! হালকা বৃষ্টি, আর আমাদের গায়ে আপাততঃ উইন্ড-চিটার আছে জল-রোধী, সুতরাং পঞ্চো এখন-ই না বের করে চলতে থাকলাম। খানিক পরে দেখি জল কই, এতো জমাট বাঁধা জল। বরফ পড়াও শুরু হয়ে গেল। তবে মিনিট পনেরো চলার পর মেঘ সরে গেল ধীরে ধীরে, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! দেড়-দুই কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার পর দেখলাম এক জায়গায় লেখা চোপতা আর চার কিলোমিটার। পৃথ্বী জানালো এখান থেকে রাস্তা একেবারে সটান পাক খেয়ে নীচে নেমে যাবে দু-কিলোমিটার, তারপর আকাশকামিনী নদী। সেই ঝোরা পার হয়ে সটান দু-কিলোমিটার উঠে চোপতা। শুনে দু-কিলোমিটার নামা শুনে খুশী হবো না আবার দু-কিলোমিটার খাড়া উঠতে হবে ভেবে দুঃখ পাবো ঠিক করতে পারলাম না। এখান থেকে দূরে ঠিক সামনের পাহাড়ের গায়ে দেখিয়ে পৃথ্বী বললো ওতাই নাকি মার্তোলি বুগিয়াল, অখানে পৌঁছোতে পারলে আর চিন্তা নেই, প্রায় চোপতায় ঢুকে পড়ব। নামা শুরু করে কিছুটা এসে পাকদন্ডী ভুল করে একটা শর্টকাট ধরে ফেললাম, কিছুদূর নেমে বুঝলাম এবার প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে নামতে হবে, এত কঠিণ সে উৎরাই! প্রার্থনাও একবার পা পিছলে আছাড় খেল, তবে সামলে নিয়ে আবার নামতে থাকল। পৃথ্বী খানিক এগিয়ে গেছে তখন। মূল রাস্তায় ফিরে তাকে খানিক বকাবকি করলাম আমাদের ফেলে চলে এসেছে বলে।  এভাবে দু-কিলোমিটার নেমে এসে দেখি পাহাড়ী এক ঝোরা, আকাশ-কামিনী। এর উপরে ছোট্টো একটা পুল পার হয়ে আবার উপর দিকে সটান ওঠা। এই সময় পৃথ্বী আমাদের দেখালো ঠিক উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে কিছু নড়াচড়া করছে। ভালো করে চেয়ে দেখি আরে এতো ব্ল্যাক বিয়ার, মানে ভালুক। আর সেটা একটা গাছের গায়ে আঁচড়াচ্ছে। ধারালো নখে গাছের ছাল খুলে ফেলে ভিতরে লুকিয়ে থাকা কীট-পতঙ্গ তার খাদ্য। ওর ঠিক পাশের রাস্তা দিয়েই আমরা এসেছি আধঘন্টা আগে! কি সাংঘাতিক! খানিকক্ষণ তার কর্মকান্ড দেখে আবার এগিয়ে চলি। পরিশ্রান্ত শরীর আর পা দুই-ই এবার জবাব দিতে চায়। আর তিন কিলোমিটার বাকি, তার মধ্যে দেড় কিলোমিটার পাকা রাস্তায় হাঁটতে হবে শেষে। এক কিলোমিটার পর পৌঁছোলাম সেই মার্তোলি বুগিয়ালে। এই বুগিয়াল বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে আছে, পায়ে চলা পথ-ও বেশ স্পষ্ট। প্রায় আধ কিলোমিটার বুগিয়াল ধরে এগোনোর পর হঠাৎ দেখি পৃথ্বী বলছে একটু পাশ দিয়ে আসতে! কি ব্যাপার! এগিয়ে দেখি একটি গরু-কে অর্ধেকটা খাওয়া অবস্থায় রেখে গেছে, নির্ঘাৎ কোনো চিতাবাঘের কাজ! বিকেল পড়ে আসছে, সে যে আবার এই মড়ির দিকে ফিরবে সন্দেহ নেই। যদিও চিতাবাঘ মানুষকে সরাসরি আক্রমণ করে না নেহাৎ মানুষখেকো না হলে, তবে সেই মুহূর্তে সে অবস্থায় এসব ভাবনার অব্বকাশ নেই। দুদ্দাড় করে সে জায়গা কোনোরকমে পার করে আসি তিনজনে। মড়ির কিছুটা আগে নরম মাটিতে চিতাবাঘের পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখলাম। আরও আধ কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আসতেই রাস্তার গাড়ির শব্দ শুনে তবে শান্তি। একটা মোড় ঘুরেই দেখি, পথ এসে মিশেছে চোপতার রাস্তায়। পৃথ্বী এখান থেকেই বিদায় নেবে, ও না থাকলে এই পথে পনেরো কিলোমিটার এভাবে ট্রেক করে আসা অসম্ভব ছিল! ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে টাকাপয়সা মিটিয়ে আমরা চোপতার পথ ধরি।
     
    ঘন জঙ্গলের রাস্তা

     
    আকাশ কামিনী নদী বা ঝোরা পার হওয়া 

     
    মার্তোলি বুগিয়াল 

    চারটে বাজে ঘড়িতে; আমরা শেষের দিকে বেশ আস্তে হেঁটেছি, খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, সাড়ে আট ঘন্টা লেগে গেল তাই। তবে এই গভীর জঙ্গলের রাস্তা মাত্র দু’জন আসার পক্ষে খুব নিরাপদ নয়। দল বেঁধে আসাই ভালো। তবে চলে যখন এসেছি, সেও এক প্রাপ্তি বৈকি! ভালুক, জংলি শুয়োর, লাঙ্গুর, চিতাবাঘের আধ-খাওয়া মড়ি, থাবার ছাপ - অ্যাডভেঞ্চারের বাকি কিছু আর আছে কি! চোপতা বাজারে এসে আনন্দ ভান্ডারী-জী কে ফোন করে নিলাম, উনি এসে সঙ্গে ক্যাম্পের একজন লোককে দিয়ে দিলেন, যিনি আমাদের নিয়ে যাবেন ক্যাম্পে। আমাদের তো মাথায় হাত, আবার ক্যাম্প কত দূরে, একে তো পা আর চলছে না! শুনি এখান থেকে আরও দু-তিনশো মিটার নীচে। আর সে কি ভয়ানক রাস্তা, রাস্তা বলে কিছু নেই, ছোটো-বড় নড়বড়ে সব পাথর ফেলে একটা অস্থায়ী পথ! 
     
    ক্যাম্পের রাস্তা

     
    খুব সাবধানে নামতে হল, কিন্তু শেষ অবধি ক্যাম্পে পৌঁছে সামনের সবুজ বুগিয়াল, দূরে বরফে ঢাকা কেদারের শিখরশ্রেণী দেখে এক নিমেষে সব ক্লান্তি যেন উধাও হয়ে গেল। এখানে ঠান্ডা সারি এমনকি দেওরিয়া তালের তুলনায় বেশ বেশী। উচ্চতা প্রায় দশ হাজার ফুটের আশেপাশে। পোষাক বদলে ক্যাম্পের বাইরে ঘাসের উপর চেয়ার পেতে যখন বসেছি, সারাদিনের পথশ্রম, অভিজ্ঞতার হিসেব মেলাচ্ছি; ওদিকে সূর্যাস্ত হচ্ছে, আর দুধসাদা পাহাড়ের গায়ে তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে! ধোঁয়া-ওঠা কফির কাপ হাতে সেই অপার্থিব দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছি আমরা!
     

    “কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে
    ঠিক যেন প’ড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা
    অনেক দিনের পর মিলে যাবে অবসর,
    আশা রাখি পেয়ে যাবো বাকি দু-আনা।“

    সেই আশাতেই পথে নামি, সেই আশাতেই পকেট ভরি। পরের গন্তব্য তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশিলা!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ৮২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুদীপ্ত | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:৪৭526024
  • সামান্য এডিট করে দিলাম।
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:7a6a:9d53:7567:***:*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৫২526027
  • এই পর্বেরও লেখা আর ছবি দুইই খুব ভালো লাগলো। সিরিজটা খুবই উপভোগ্য হচ্ছে।
  • দীমু | 182.69.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০১:১৯526028
  • আগে গাড়োয়ালের এই জায়গাটায় এরকম বিপজ্জনক ট্রেকের অভিজ্ঞতা পড়িনি/দেখিনি। চমৎকার এগোচ্ছে yes
  • সুদীপ্ত | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২০526049
  • ধন্যবাদ kk! 
     
    ধন্যবাদ দীমু। দেওরিয়া তাল থেকে চোপতার ট্রেক রুট একেবারেই 'less travelled' যাকে বলে। আমরা সারাদিন আমাদের ছাড়া একটি মানুষ দেখিনি পুরো রাস্তায়। আমরা চলে গেছি বটে, কিন্তু বারবার মনে হয়েছে অন্তত: চার-পাঁচজন মিলে অবশ্যই গাইড-সহ এই ট্রেক করা উচিৎ। 
  • | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২৮526051
  • আরে দারুণ দারুণ। দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। 
     
    এমনিতে তো চোপতা অবধি গাড়ি যায় বোধহয়। এই ট্রেকরুটটায় এখন কি আর তেমন কেউ যায়? ভাগ্যিস তোরা গেলি তাই পড়তে পেলাম। চড়াইটা দেখে রীতিমত ভয় পেলাম। 
  • সুদীপ্ত | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০০526052
  • দমদি, এই রুটটা ওই দেওরিয়া তাল থেকে পর্ছি কেটে যাওয়া যায়, ওরা বলে রাস্তায় বনবিভাগের লোক চেক করতে পারে, যদিও তার তেমন সম্ভাবনা নেই দেখলাম। তবে সাধারণত: সবাই সারি থেকে দেওরিয়া তাল হয়ে আবার সারি ফিরে চোপতা যায়। সারি অবধি গাড়ির রাস্তা আছে, গাড়ি মেলেও।
    উখীমঠ থেকে চোপতা যাওয়ার রাস্তায় (এই রাস্তা গোপেশ্বর হয়ে যোশীমঠ, গোবিন্দঘাট, বদ্রী যায়) চোপতার দশ কিলোমিটার আগে সারির রাস্তা আলাদা হয়ে যায়।
     
    তবে এই রুটে লোক যায়, যথারীতি ভ্লগে দেখেছি এবং বেকুব বনেছি
  • শিবাংশু | ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:৫১526070
  • চমৎকার হচ্ছে, 
    যাকে বলে 'আন্তরিক পর্যটন',  
  • Arindam Basu | ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৩৪526075
  • খুব, খুব ভাল লাগল।
  • সুদীপ্ত | ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৭526144
  • ধন্যবাদ শিবাংশুদা, তোমার ভালো লেগেছে এ বড় পাওনা, পর্যটন আন্তরিক তো হবেই, তীর্থযাত্রা যে, 'বাবা চৌখাম্বার চরণে.. ’ ইত্যাদি
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন